Skip to main content

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা



মোঃ সাখাওয়াত হোসেন:


বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের পটভূমিতে অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ আখ্যান ইতিহাসকে করেছে সমৃদ্ধ, করেছে জনপ্রিয়। বাঙালীর ইতিহাস শাশ্বত, সত্য ও চিরন্তন। এই ইতিহাস সকলের নিকট গ্রহণযোগ্য ও সমাদৃত। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ২১ ফেব্রুয়ারি বিশ্বব্যাপী পালিত হচ্ছে, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ বিশ্ব ঐতিহ্যের গুরুত্বপূর্ণ দলিল হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। এ সকল কিছুই বাঙালীর জীবনকে অর্থবহ করেছে, দিয়েছে পূর্ণতা। বাঙালী জাতি অন্যদের নিকট হয়েছে মর্যাদাবান।


২৬ মার্চ মহান স্বাধীনতা দিবস। বাংলাদেশ সৃষ্টির পর থেকে প্রতি বছর ২৬ মার্চকে যথেষ্ট ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ পরিবেশে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় পালন করে থাকে সমগ্র বাঙালী জাতি। আবার ১৯৭১ সালে আজকের এ দিনেই অর্থাৎ ২৫ মার্চের প্রথম প্রহরে বাঙালী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালীর স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। দেশব্যাপী বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণাকে প্রচারের নিমিত্তে যোগাযোগের সকল মাধ্যম ব্যবহার করা হয়ে থাকে। বিভিন্ন গবেষণা গ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে, বঙ্গবন্ধু গ্রেফতার হলে তাঁর অনুপস্থিতিতে নেতাকর্মীরা কিভাবে স্বাধীনতা যুদ্ধ পরিচালনা করবে তার ফিরিস্তি তিনি বহু পূর্বেই সন্নিবেশ করেছেন। স্বাধীনতার ঘোষণা সংক্রান্ত তৎকালীন সময়ে দেশী-বিদেশী গণমাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকে উদ্ধৃত করে সংবাদ পরিবেশন করা হয়- বঙ্গবন্ধু ২৬ মার্চ বাঙালী জাতির মহান স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদান করেছেন। খুব সহজে, সচেতনভাবে এবং সুুচিন্তিত উপায়ে উল্লেখ করা যায়, ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের উত্তাল দিনগুলোতে বঙ্গবন্ধু সকল শ্রেণীর মানুষের নিকট একক নেতৃত্ব হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সমর্থ হয়েছিলেন তাঁর ক্যারিশমেটিক দক্ষতায়। আন্দোলন সংগ্রামের অংশ হিসেবে বঙ্গবন্ধু সারাদেশ সফর করেছিলেন এবং বাঙালীদের সঙ্গে একাত্ব হয়ে নিপীড়িত বাঙালীর ভাষা বুঝতে পেরে সে অনুসারে আন্দোলন সংগ্রামের ইতিবৃত্ত এনেছিলেন এবং সফলও হয়েছেন। কারণ, বাঙালী বঙ্গবন্ধুর সকল নির্দেশনাকে অকুণ্ঠ চিত্তে সমর্থন দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনাগুলো বাস্তবায়নের জন্য ঐক্যবদ্ধ স্লোগানে ছাত্র-শিক্ষক-জনতা, কৃষক-শ্রমিক-দিনমজুর, পেশাজীবীসহ সকল শ্রেণীর মানুষ সম্মিলিতভাবে উদ্যোগ গ্রহণ করেন এবং সাধ্যমতো সাহায্য সহযোগিতার হাতও প্রসারিত করেন আন্দোলনকে বেগবান করার নিমিত্তে। রাজনৈতিক ও সমাজ বিশ্লেষকগণ বঙ্গবন্ধুর ক্যারিশমেটিক দক্ষতা নিয়ে তুলনামূলক বিশ্লেষণপূর্বক নানাভাবে মূল্যায়নের চেষ্টা করে চলেছেন। তবে সকলেই এ বিষয়ে একমত যে, বঙ্গবন্ধু শ্বাপদসঙ্কুল পরিস্থিতিতে পাহাড়সম সমস্যাকে মোকাবেলা করে সীমিত সম্পদের ব্যবহারের মাধ্যমে কাক্সিক্ষত স্বাধীনতার স্বাদ অর্জনে সমর্থ হয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর দৃপ্ত সংগ্রামের অন্যতম সফলতা ছিল তিনি বাঙালীদের জাগ্রত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এ সকল কারণেই বিশ্বশ্রেষ্ঠ নেতৃত্বের তুলনায় বঙ্গবন্ধু অনন্য, অতুলনীয় ও মর্মস্পর্শী। সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্ববরেণ্য নেতৃবৃন্দ সমসাময়িক প্রেক্ষাপটে বঙ্গবন্ধুর প্রযোজ্যতাকে সামনে নিয়ে এসেছেন এবং নেতা বঙ্গবন্ধুর ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। বিশ্বব্যাপী বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে জানার আগ্রহ তৈরি হয়েছে সবার মাঝে এবং বঙ্গবন্ধুর লিখিত বই বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়ে ভিন্ন ভাষাভাষী মানুষের নিকট যাচ্ছে।


আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির অর্থ হচ্ছে, আন্তর্জাতিকভাবে যে কোন বিষয়ের ক্ষেত্রে মর্যাদা প্রদান করা এবং সুনির্দিষ্ট দিনে ওই বিষয় নিয়ে আলোচনা করে বিষয়টি সম্বন্ধে পৃথিবীবাসীর নিকট বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের নিকট ইতিহাসের গোড়াপত্তন ঘটানো। অর্থাৎ পৃথিবীব্যাপী যে সকল বিষয় সকলের নিকট উপস্থাপন করলে পরে দৃষ্টান্ত হিসেবে প্রতিস্থাপিত হয়ে অন্যদের নিকট প্রলুব্ধ করে উৎসাহিত করার মানসিকতা তৈরি হয় সে বিষয়গুলোই আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত সত্য। সব থেকে বড় কথা হলো, ভাষণটি যাদের জন্য প্রযোজ্য তারা সত্যিকার অর্থে কতটুকু উপকৃত হয়েছেন কিংবা সার্বজনীনভাবে বিষয়টি তারা গ্রহণ করেছেন কিনা সেটিই মাত্রা পরিমাপের নিয়ামক হিসেবে কাজ করে। উল্লেখ্য, ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ The New York Times, Time of India সহ অসংখ্য বিশ্বখ্যাত সংবাদপত্রে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা নিয়ে বঙ্গবন্ধুকে উদ্ধৃত করে সংবাদ পরিবেশন করে। বাংলাদেশের ‘দৈনিক সংবাদ’ পত্রিকায় বাংলার স্বাধীনতা ঘোষণা নিয়ে সংবাদ পরিবেশন করা হয়।


২৬ মার্চের স্বাধীনতার ঘোষণাটি সার্বিকভাবে কতটুকু গ্রহণযোগ্য তার সাপেক্ষে বেশকিছু কারণ উল্লেখ করা যেতে পারে। উল্লিখিত কারণগুলো বঙ্গবন্ধুর ভাষণের সার্বজনীনতাকে তুলে ধরতে সহায়ক হিসেবে কাজ করবে। প্রথমত, বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার সার্বজনীনতা এবং গ্রহণযোগ্যতা ভাষণের ৫০ বছর পরেও একই রকম হওয়ায় এটিকে বিশ্বজনীনতার অন্যতম অংশ হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের সরকার স্বাধীনতা ঘোষণাটির স্বীকৃতি ও বৈধতা প্রদান করেছে সাংবিধানিকভাবে। তৃতীয়ত, সকল পেশা শ্রেণীর মানুষের নিকট ঘোষণাটির মর্মার্থ ও গুরুত্ব অপরিসীম। চতুর্থত, ঘোষণাটির আবেদন এখনও অমলিন এবং ঘোষণাটি প্রচার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সংগ্রামী বাঙালী জাতি প্রতিরোধ গড়ে তোলে। পঞ্চমত, বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণার জন্য যে সময়টি বেছে নিয়েছিলেন সেটি যুদ্ধের দামামায় উপযুক্ত হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে, কেননা পশ্চিম পাকিস্তানীরা অতর্কিতভাবে পৃথিবীর ইতিহাসের সকল ধরনের ন্যক্কারজনক পরিস্থিতিকে পদদলিত করে বাঙালীর ওপর নির্বিচারে হত্যাকা- চালায়। বঙ্গবন্ধুর এ ধরনের বিচক্ষণ সিদ্ধান্তের কারণে পরবর্তীতে যুদ্ধকালীন এবং যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে বিশ্বনেতৃবৃন্দের সহযোগিতা ও সাহায্য পাওয়ার ক্ষেত্রে ইতিবাচক হিসেবে কাজ করেছে। বিশেষ করে অল্প সময়ের ব্যবধানে বিশ্ব জনমত সৃষ্টির পেছনে স্বাধীনতার ঘোষণা সংক্রান্ত বিচক্ষণ সিদ্ধান্ত খুব কাজে লেগেছে। সর্বোপরি, স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রধান নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধুর অসামান্য দৃঢ়তা, দূরদৃষ্টি আপামর জনসাধারণকে একত্রিত করে স্বাধীনতা সংগ্রামে বিজয় লাভে অগ্রণী ভূমিকা পালনে ইতিবাচক হিসেবে কাজ করে। তার পরিপ্রেক্ষিতে স্বাধীনতার ঘোষণা ঐতিহাসিকভাবে বিভিন্ন জায়গায় স্বীকৃতি লাভ করেছে। বঙ্গবন্ধু প্রদত্ত স্বাধীনতা ঘোষণার জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি রয়েছে এবং বাস্তবায়ন সাপেক্ষে ঘোষণাটির ঐতিহাসিক ফলাফল হচ্ছে বাংলাদেশের স্বাধীনতাপ্রাপ্তি।


একটি ধারাবাহিক অনুশীলনের মাধ্যমে তথা ধারাবাহিক আন্দোলনের মাধ্যমে ঘটনা প্রতিঘটনার আলোকে একটির পর অপর আখ্যান উপস্থাপিত হয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসকে মহিমান্বিত করেছে। স্বাধীনতা সংগ্রামের মঞ্চটিকে তিলে তিলে গড়ে তুলেছেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি তাঁর দীর্ঘ সংগ্রামময় জীবনের মাধ্যমে বাঙালীদের অতি প্রিয় পাত্রে পরিণত হতে পেরেছিলেন এবং সেটির সঠিক বাস্তবায়ন করেছেন বাংলার স্বাধীনতা অর্জনের মধ্য দিয়ে। দীর্ঘ সময়ের শৃঙ্খল ভেঙ্গে পরাধীনতার শিকল পরাভূত করে তিনি হয়ে উঠেছিলেন মুক্তিকামী মানুষের কণ্ঠস্বর। এবং কোন ধরনের শর্ত ব্যতিরেকেই বাঙালী জাতির নয়নের মণি হয়ে তিনি স্বাধীনতাকে শোষিত বাঙালীর নিকট উপস্থাপন করেছিলেন আপন মহিমায়, দেশাত্মবোধের দ্যুতিতে। প্রকৃতার্থে ৭ মার্চের ভাষণের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু বাঙালীকে স্বাধীনতা যুদ্ধের পূর্ব প্রস্তুতি নিতে বলেছিলেন এবং অফিসিয়াল ঘোষণাটি আসে মূলত ২৬ মার্চের ভাষণের মাধ্যমে। পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে অনেকেই স্বাধীনতার ঘোষণাটি পাঠ করেন এবং ইতিহাসও তাদের মূল্যায়ন করছে, ভবিষ্যতেও করবে।


ঘোষক আর ঘোষকের পক্ষে বক্তব্য পাঠ করা কখনোই একই মর্যাদার হতে পারে না। যার যে ভূমিকা তাকে সে জায়গায় রেখে মূল্যায়ন করা জরুরী এবং সেটিও হওয়া উচিত। কাউকে বড় করে অন্যকে ছোট করার মানসিকতার হীন প্রয়াস আমাদের মধ্যে প্রবল আকার ধারণ করেছে। এ ধরনের অনাকাক্সিক্ষত ও অনভিপ্রেত পরিস্থিতি থেকে আমাদের বের হয়ে আসতে হবে। সত্য ও সততার অনুশীলন করতে হবে, সত্যকে জানতে হবে। প্রকৃত সত্য ইতিহাস জেনে ঘটনার পরম্পরায় অবদান রাখা ব্যক্তিকে সম্মানের জায়গায় বসানো উচিত। না হলে শ্রদ্ধা-ভক্তি, স্নেহ-ভালবাসা, আবেগ-অনুভূতির মেলবন্ধন থাকবে না, দেখা দেবে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি, সৃষ্টি হবে ইতিহাস নৈরাজ্যের পরিপত্র।


২৬ মার্চ মহান স্বাধীনতা দিবসের ৫১ বছরের পূর্তি পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধু প্রদত্ত মহান স্বাধীনতার ঘোষণাটি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত, সমাদৃত ও সর্বজনবিদিত। এ ঘোষণার সব থেকে মহিমান্বিত বিষয় হচ্ছে যাদের জন্য এ ভাষণ, যে উদ্দেশ্যে এ ভাষণের যবনিকাপাত তারা কি ভাষণটি সমাদরে গ্রহণ করেছে কিনা এবং ঘোষণাটির সার্থক প্রতিফলন হয়েছে কিনা। সেদিক থেকে বলা যায়, ২৬ মার্চ মহান স্বাধীনতার ঘোষণাটি সমগ্র বাঙালী জাতি ঐক্যবদ্ধ চিত্তে গ্রহণ করেছে এবং শুধু গ্রহণ করেই ক্ষান্ত হননি বরঞ্চ স্বাধীনতা লাভের পূর্ব পর্যন্ত সর্বস্ব বিকিয়ে দিয়ে নেতা মুজিবের অমর ঘোষণার বাস্তবায়নে ছিল বদ্ধপরিকর।


লেখক: সহকারী অধ্যাপক, ক্রিমিনোলজি এ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়


সৌজন্যেঃ দৈনিক জনকণ্ঠ


Comments

Popular posts from this blog

How to Protect Your Intellectual Property Rights in Bangladesh

Banking Litigation and Dispute Resolution