বুড়ো মানুষের মূল্য – শিক্ষামূলক গল্প
'বুড়ো মানুষের মূল্য' শিক্ষামূলক গল্প
কোন এক দেশে অভাব অনটন লেগেই থাকতো। রাজা ভাবলো, দেশের মানুষ কমাতে হবে। তবেই অভাব থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে। রাজা এক অদ্ভুত আইন জারি করলো, যে সব বুড়ো বাবা-মা কাজ করতে পারে না, কেবল শুয়ে বসে খায়, তাদেরকে বনে ফেলে আসতে হবে। কি আর করা যায়, আইন না মানলে যে প্রাণ যায়। তাই লোকজন তাদের বুড়ো বাবা-মাকে পাহাড়ের ধারে বনে ফেলে আসতো। বুড়ো- বুড়িরা সেখানে না খেয়ে মরতো, কিংবা যেতো বাঘের পেটে।
বুড়ো-বুড়িদের বনবাসে না পঠিয়ে উপায় ছিলনা। প্রহরীরা ঘুরে ঘুরে দেখতো কারা আইন অমান্য করেছে। বুড়ো- বুড়িকে বসিয়ে খাওয়ানো হচ্ছে জানতে পারলেই, প্রহরীরা বাড়ির কর্তাকে ধরে নিয়ে যেতো। তার মাথাটা কেটে ফেলতো ঘ্যাচাং করে। বুড়ো-বুড়িকেতো বনবাসে পাঠাতোই।
একটি ছেলে তার বাপকে খুব ভালোবাসতো। বাপও তার ছেলেকে প্রাণের চেয়ে বেশী ভালবাসতো। তবুও রাজার ভয়ে বাপকে বনবাসে যেতে হবে। কারণ সে কাজ করতে পারেনা। গায়ে শক্তি নেই, লাঠি ভর দিয়ে হাঁটে। ছেলে কাঁদতে কাঁদতে বাপকে কাধে নিলো। তারপর চললো বনের দিকে। বাপের মনেও নানা চিন্তা। নিজে মরে গেলেও, ছেলে কেমন করে বেঁচে থাকবে–এই চিন্তায় তার কান্না পেলো।
ছেলে হাঁটছে বাপকে কাঁধে নিয়ে। বাপ গাছের ছোট ডাল ভেঙে পথে ফেলছে। ছেলে যাতে ঠিকভাবে বাড়ি ফিরতে পারে, বাপ তাই ভাঙ্গা ডাল ফেলে পথের চিহ্ রাখছে। পথেতো বাঘ ভালুকের অভাব নেই। ছেলের যদি বিপদ ঘটে | বাপ ছেলের হাতে তুলে দিলো একটি কচি ডাল। বললোঃ বাবা, আমি সারা পথে এ রকম ডাল ফেলে এসেছি। তুমি সে সব ভাঙ্গা ডাল দেখে বাড়ি যেয়ো। অন্য পথে গেলে বাঘের কবলে পড়বে।
বাপ তাকে এত ভালবাসে–এ কথা ভাবতেই ছেলের আরো কান্না পেলো। সে থমকে দাঁড়ালো। বললোঃ বাবা, আমি তোমাকে ফেলে বাড়ি যাবো না। তোমাকে নিয়েই বাড়ি যাবো। আমি রাজার আইনকে ভয় পাই না। বাপ বললোঃ বাবা, তোর যে ক্ষতি হবে। ছেলে বললোঃ বাবা, তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচবো না৷ ছেলের মনের জোর দেখে বাপ আর কিছু বলতে পরলোনা। ছেলের কাঁধে চড়ে বাড়ি ফিরে এলো।
ছেলে বাড়ির পেছনে একটা বড় গর্ত তৈরি করে বাপকে সেখানে লুকিয়ে রাখলো। পাড়ার লোকেরা যাতে জানতে না পারে, সে জন্য সে গোপনে বাপকে খাবার দিতে লাগলো। ছেলে যা রোজগার করে, সামান্যই নিজে খায়। বাপ কেমন করে সুখে থাকবে, এই তার চিন্তা। সে বাপকে কোন দিন পোলাও কোরমা, কোন দিন দুধ ছানা খেতে দিলো। কোনদিন দূরের বাজার থেকে নিয়ে এলো আপেল আঙ্গুর। খেতে দিলো বাপকে। এ ভাবে ছেলের হৃদয়ের ছোঁয়া পেয়ে গুহার মধ্যে থেকেও বাপের মনে হলো, সে স্বর্গে বাস করছে।
একদিন রাজার ঢাকীরা ঢাক পিটিয়ে ঘোষণা করলোঃ ছাই দিয়ে দড়ি বানাতে পারলে পাঁচ হাজার টাকা পুরস্কার দেয়া হবে। দেশের যত লোক শত চেষ্টা করেও ছাই দিয়ে দড়ি বানাতে পারলোনা।
ছেলে বাপের কাছে গিয়ে বললোঃ বাবা, রাজা ছাইয়ের দড়ি চেয়েছে। পাঁচ হাজার টাকা পুরস্কার দেবে। এই দড়ি কেমন করে বানানো যায়? বাপ কতক্ষণ ভাবলো। তারপর বললোঃ একটা লম্বা কাঠের এ মাথা ও মাথায় একটা দড়ি টান করে বেঁধে নাও। তারপর দড়িটা পুরে ছাই করে ফেলো। দেখবে ছাইয়ের দড়ি হয়েছে। ছেলে বাপের বুদ্ধিমত তাই করলো। সুন্দর পাকানো ছাই এর দড়ি হয়ে গেলো। ছেলে দেখালো রাজাকে। রাজা খুশী হয়ে গেলো। ছেলেকে পুরস্কার দিতে চাইলো। ছেলে বললোঃ মহারাজ, আপনার আশির্বাদই যথেষ্ট, আমি টাকা চাইনা।
কিছুদিন পর রাজার ঢাকীরা আবার ঢোল পিটিয়ে ঘোষণা করলোঃ রাজবাড়িতে দশ হাত লব্বা একটা কাঠ আছে। এই কাঠের কোন্টি আগা, কোনটি গোড়া যে বলতে পারবে, তাকে দেয়া হবে দশ হাজার টাকা পুরস্কার। পুরস্কারের লোভে লাখ লাখ লোক গিয়ে হাজির হলো রাজবাড়িতে। সবাই দেখলো কাঠখানা। কেউ হাত দিয়ে ওজন করে দেখলো, কেউ টোকা দিয়ে দেখলো। কেউবা দেখলো গন্ধ শুঁকে। কেউবা বললো যে এটা আগা, কেউবা বললো, ওটা গোড়া। কিন্তু.কেউ প্রমাণ দিতে পারলোনা রাজাও প্রমাণ না পেয়ে খুশী হলোনা।
ছেলে বাপকে খুলে বললো সব কথা। বাপ বললোঃ এটাতো সহজ বাবা। কাঠটা পানিতে নামিয়ে দাও। যে মাথা ডুবুডুবু দেখবে সেটাই গোড়া, যে মাথা উঁচু সেটা আগা।
বাপের বুদ্ধি নিয়ে ছেলে গেলো রাজবাড়িতে। গিয়ে দেখলো, লাখ লাখ লোক কাঠখানা নিয়ে টানাটানি করছে। কেউ বলছে, আমার কথা ঠিক, কেউবা বলছে, তোমার নয়, আমার কথা ঠিক। ছেলে রাজার লোকদের বললোঃ আসল জবাব আমি দিতে পারি। প্রমাণও দিতে পরি।
সবাই বল্লোঃ দেখাও দেখি কোনটা আগা, কোনটা গোড়া। ছেলে কাঠখানা নিয়ে দীঘির পানিতে ফেললো। কাঠের একদিক উঁচু, অন্যদিক নীচু দেখা গেলো। ছেলে সহজেই বলে দিলো কোনটি আগা আর কোনটি গোড়া। লাখ লাখ লোক বিশ্মিত হলো। রাজাতো মহাখুশী। রাজা ছেলেকে দশ হাজার টাকা পুরস্কার দিতে চাইলো।
ছেলে বললোঃ মহারাজ, আমি টাকা চাইনা । আপনার আশির্বাদই আমার পুরস্কার।
ছেলেটির লোভ নেই দেখে রাজা ভারী খুশী হলো। আবার একদিন ঢাকীরা ঢাক পিটিয়ে ঘোষণা করলোঃ এমন ঢোল কে বানাতে পারে, যা না বাজালেও বাজবে। যে বানাতে পারবে, তাকে বিশ হাজার টাকা পুরস্কার। মোটা পুরস্কার। মেতে উঠলো সারা দেশ। হাজার হাজার ঢোল এলো রাজবাড়িতে। ঢোল এলো মোটা, লম্বা, খাটো, ঢাউস — নানা রকমের। ঢোল যাতে বিনা বাজনায় বাজে, সে জন্যে ঢোলের সঙ্গে জুড়ে দেয়া হলো নানা কলকাঠি। কিন্তু কারুর ঢোলই রাজার পছন্দ হল না। কারণ এসব ঢোল বিনা বাজনায় বাজেনা।
ছেলে বাপকে খুলে বললো সব কিছু। বাপ তাকে চামড়া কিনে আনতে বললো। গাছ থেকে মৌমাছিসহ চাক ভেঙ্গে আনতে বললো। ছেলে বাপের কথা মত কাজ করলো। বাপ মাটির ঢোল বানিয়ে তার মধ্যে হাজার হাজার মৌমাছি ঢুকিয়ে দিলো। চামড়া দিয়ে বন্ধ করে দিলো ঢোলের মুখ। ছেলে ঢোল নিয়ে ছুটে গেলো রাজবাড়িতে।
রাজার হাতে ঢোল তুলে দিয়ে বললোঃ মহারাজ, এই আমার ঢোল নিন। বাজনা ছাড়াই বাজে।
আসলে হাজার হাজার মৌমাছি গুণ্ গুণ করে গান গাইছিল আর ঢোলের চামড়ায় আঘাত করছিল। তাই ভেতরে কেমন একটা ঝম্ ঝম্ শব্দ হচ্ছিল। শুনে মনে হলো, বিনা বাজনায় ঢোল বাজছে। রাজা এই ঢোল দেখেতো মহাখুশী। সে ছেলকে চিনতে পারলো। ছেলেকে আগের পুরস্কারসহ চল্লিশ হাজার টাকা দিতে চাইলো। ছেলে তা নিতে চাইলোনা।
বললোঃ আমি টাকা চাইনা । আপনার আশির্বাদই আমার পুরস্কার।
রাজা ছেলেটিকে কাছে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞেস করলোঃ তুমিতো পর পর তিনটি রহস্যের সমাধান দিলে। তুমি এত বুদ্ধি কোথায় পেলে?
ছেলে বললোঃ মহারাজ, আপনি অভয় দিলে বলতে পরি।
রাজা বললোঃ তুমি নিশ্চিন্তে বলতে পারো।
ছেলে বললোঃ তিনটি রহস্যেরই সমাধান দিয়েছেন আমার বাবা। তার কাছ থেকে বুদ্ধি নিয়েই আমি সমাধানগুলো আপনার কাছে হাজির করেছি। ছেলে বাপকে বনবাসে না দিয়ে কি করে ফিরিয়ে আনলো, গুহায় রাখলো, সে কথা খুলে বললো রাজাকে। রাজা একটুও রাগ করল না। বুঝতে পারলো মানুষ বুড়ো হলে হলে জ্ঞানী হয়। অনেক বুদ্ধির অধিকারী হয়। বুড়োদের জ্ঞানবুদ্ধি সমাজের উপকারে আসে। তারা না থাকলে সমাজ অচল হয়ে পড়ে।
রাজা এবার আইন জারি করলোঃ বুড়ো বাপ-মাকে বনবাসে পাঠানো যাবে না। রাজা ছেলেকে দু’লাখ টাকা পুরস্কার দিলো। ছেলে তার বাপকে গুহা থেকে বের করে আনলো। মহা সুখে বসবাস করতে লাগলো। দেশের অন্যসব লোকও বুড়ো বাপ-মাকে নিয়ে নিশ্চিন্তে বসবাস করতে লাগলো।
Comments