নতুন এই ভূ-রাজনৈতিক সম্ভাবনা যুক্তরাষ্ট্র তো বটেই, তার মিত্র ভারতের জন্যও এটা নি:সন্দেহে মাথাব্যথার কারণ।
ইরানে চীনা সৈন্য মোতায়েনের সুযোগ
চীন এবং ইরানের সরকার এখনো এই চুক্তির বিস্তারিত কিছু ভেঙ্গে বলছে না তবে, নিউ ইয়র্ক টাইমস এবং হংকং-ভিত্তিক এশিয়া টাইমসসহ বেশ কিছু শীর্ষ সারির মিডিয়া বলছে তারা ১৮-পাতার খসড়া চুক্তিটি দেখেছে।
সেই সূত্রে এবং সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন সূত্রে প্রকাশিত নানা তথ্যের ভিত্তিতে যা জানা গেছে তাতে চীন ইরানের তেল-গ্যাস, ব্যাংকিং, টেলিকম, বন্দর উন্নয়ন, রেলওয়ে উন্নয়ন এবং আরো কয়েক ডজন খানেক গুরুত্বপূর্ণ খাতে চীন ব্যাপক বিনিয়োগ করবে।
এই বিনিয়োগের পরিমাণ আগামী ২৫ বছরে কমপক্ষে ৪৪ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ হতে পারে। সেই সাথে প্রস্তাবিত চুক্তিতে সামরিক ও নিরাপত্তার ক্ষেত্রে ‘যৌথ প্রশিক্ষণ, মহড়া, গবেষণা, যুদ্ধাস্ত্র তৈরি এবং গোয়েন্দা তথ্য আদান-প্রদানের‘ কথা রয়েছে।
মিডল-ইস্ট আই নিউজ ওয়েবসাইটে একটি রিপোর্টে লেখা হয়েছে, চুক্তির আওতায় চীন তাদের বিনিয়োগের সুরক্ষায় ইরানে পাঁচ হাজার পর্যন্ত সৈন্য মোতায়েন করতে পারবে।
সুতরাং এই চুক্তি সই হলে, মধ্যপ্রাচ্যে এই প্রথম সরাসরি চীনা সামরিক উপস্থিতির সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।
বিনিয়োগের বদলে চীনকে জ্বালানি কেনার ক্ষেত্রে চীনকে অনেক ছাড় দেবে ইরান। বাজার মূল্যের চেয়ে অনেক কম মূল্যে তেল-গ্যাস পাবে চীন। এবং চীনা মুদ্রায় দেয়া সেই দাম পরিশোধ করতে পারবে।
মিডিয়ায় ফাঁস হওয়া চুক্তির এসব শর্ত নিয়ে ইরান বা চীনের সরকারের পক্ষ থেকে খোলাসা করে কিছু বলা হয়নি। তবে সোমবার ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র আব্বাস মুসাভি এই প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন : “(চীনের সাথে প্রস্তাবিত এই চুক্তি) ইরানের কূটনীতির জন্য গর্ব করার মত একটি অধ্যায়।“
ওয়াশিংটনে আরব গালফ স্টেটস ইন্সটিটিউটের সিনিয়র ফেলো আলী আলফোনেহ বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞায় দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া ইরান এখন অস্তিত্বের স্বার্থে চীনের দ্বারস্থ হচ্ছে।
জ্বালানি তেল ও গ্যাস মজুদের হিসাবে ইরান বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ দেশ হলেও যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞায় জ্বালানি বিক্রি করা তাদের জন্য দুরূহ কাজ হয়ে পড়েছে। সেই সাথে বিনিয়োগের অভাবে তেল ক্ষেত্র উন্নয়নের পথও কার্যত বন্ধ হয়ে পড়েছে।
চীনা বিনিয়োগ তাদেরকে সেই ‘মহা-সঙ্কট‘ থেকে বের করে আনতে পারবে।
জ্বালানি খাতের জন্য বিশেষ সাময়িকী পেট্রোলিয়াম ইকোনমিস্ট গত সেপ্টেম্বর মাসে প্রথম প্রকাশ করে যে ইরানের তেল, গ্যাস এবং পেট্রো-কেমিক্যাল খাতে ২৮০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবে চীন।
ঐ সাময়িকী সে সময় বলে, “চীন ও ইরানের এই চুক্তি বিশ্বের তেল ও গ্যাস খাতের ভারসাম্যে মৌলিক পরিবর্তন আনবে যেখানে লেনদেনের ক্ষেত্রে মার্কিন ডলারের কোনো অস্তিত্ব থাকবে না।“
তবে অনেক পর্যবেক্ষক বলছেন, চীন ও ইরানের মধ্যে সম্পর্কে ঘনিষ্ঠতা হঠাৎ করে আকাশ থেকে পড়েনি।
নব্বইয়ের দশকে থেকেই এই দুই দেশ সহযোগিতা নিয়ে কথা বলছে। ২০১৫ সালে ইরানের সাথে করা পারমানবিক চুক্তি থেকে একতরফাভাবে আমেরিকার সরে যাওয়া এবং ইরানের একের পর এক নিষেধাজ্ঞায় এই প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হয়েছে।
চীনের স্বার্থ কী
২০১৬ সালে শি জিন পিংয়ের ইরান সফরের সময় ২৫ বছরের একটি ‘কৌশলগত সহযোগিতা চুক্তি‘ নিয়ে দুই সরকারের মধ্যে প্রথম প্রাথমিক একটি বোঝাপড়া হয়। গত চার বছর ধরে তা চূড়ান্ত রূপ নিয়েছে।
কুয়ালালামপুরে মালয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউ আব চায়নার অধ্যাপক ড মাহমুদ আলী বলেন, ইরানকে তাদের ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড‘ প্রকল্পের মধ্যে শক্তভাবে আনার জন্য চীন অনেকদিন ধরেই চেষ্টা করছে।
“মলাক্কা প্রণালী দিয়ে তাদের বাণিজ্য, বিশেষ করে জ্বালানি সরবরাহের নির্ভরতা কমানোর জন্য চীন বহু দিন ধরে উদগ্রীব, কারণ ঐ সমুদ্র রুটটির নিয়ন্ত্রণ এখনো যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্রদের হাতে, সুতরাং ইরানকে পাশে পেলে সমুদ্র রুটকে পাশ কাটিয়ে জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করা চীনের জন্য অনেক সহজ হবে।“
“সুতরাং চীনের জন্য এটা বিরাট এক ভূ-রাজনৈতিক উদ্যোগ।“
ইতিমধ্যেই অবশ্য চীন ও ইরানের মধ্যে সরাসরি রেল লিংক রয়েছে। এই রেল রুট “নতুন সিল্ক রোড নামে“ পরিচিত যা শিনজিয়াং থেকে কাজাখস্তান, উজবেকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান. কিরগিস্তানকে যুক্ত করে তেহরান পর্যন্ত ২৩০০ কিমি দীর্ঘ।তবে এই রুটকে আরো সংহত এবং আধুনিক এবং কার্যকরী করতে উদগ্রীব চীন।
সহযোগিতা চুক্তি হওয়ার আগেই চীন ইরানের রেল অবকাঠামোর উন্নয়নের কাজে জড়িয়ে পড়েছে।
চীনা কোম্পানি সিনোম্যাক পশ্চিম ইরানে নতুন একটি রেলর লাইন তৈরির চুক্তি সই করেছে।তবে বেইজিংয়ের সবচেয়ে বড় প্রকল্প তেহরান এবং মাশাদের মধ্যে ৯২৬ কিলোমিটার রেল লাইনের বৈদ্যুতিক-করণ। তেহরান-কোম-ইস্পাহানের মধ্যে একটি দ্রুতগতির রেল লাইন নির্মাণ নিয়েও কথা হচ্ছে চীনের সাথে।
এসব রেল প্রকল্প ‘নতুন সিল্ক রোডে‘র অংশ হবে।
চীন-ইরান এই সম্পর্কের প্রভাব কী হবে?
যুক্তরাষ্ট্রের জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয় গবেষক এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক শিরিন হান্টার মিডল-ইস্ট আইতে এক নিবন্ধে বলছেন, ইরানের সাথে চুক্তি মধ্যপ্রাচ্যে চীনের অবস্থান সংহত করবে। “সেই সাথে ইরানের অর্থনীতির প্রভূত উন্নতি হবে। ফলে তাদের রাজনীতিও স্থিতিশীল হবে।“
হান্টার মনে করেন, ইরানের সাথে সংঘাতের ব্যাপারে মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশের মধ্যে আগ্রহ কমবে। “এমনকি উপসাগরের অনেক দেশে চীনের সাথে এই ধরণের বিশেষ চুক্তিতে আগ্রহী হয়ে উঠতে পারে।“
আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ওপর ইরান এবং যুক্তরাষ্ট্রের অনেকগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন কাবেহ আফছার সারসাইয়াবি। হংকংয়ের দৈনিক এশিয়া টাইমসে এক নিবন্ধে তিনি বলছেন. ইরান যদি চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড প্রকল্পের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয় তাহলে ঐ অঞ্চলের ভূ-রাজনীতির কৌশলগত সমীকরণ বদলে যাবে।
তিনি বলেন, “খুব ধীরে হলেও নিশ্চিতভাবে চীন-ইরান এবং পাকিস্তানের মধ্যে একটি কৌশলগত জোট দানা বাঁধছে, যার সাথে অদূর ভবিষ্যতে যুক্ত হবে আফগানিস্তান, ইরাক এবং সিরিয়া।“
তার মতে, নতুন এই ভূ-রাজনৈতিক সম্ভাবনা যুক্তরাষ্ট্র তো বটেই, তার মিত্র ভারতের জন্যও এটা নি:সন্দেহে মাথাব্যথার কারণ।
Comments