জিয়া পরিবার ও বিএনপির দুর্নীতি
বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে অন্ধকার অধ্যায় হিসেবে বিবেচনা করা হয় বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০০১-০৬ সাল পর্যন্ত চার দলীয় জোট সরকারের আমলকে। সেই সময় ক্ষমতার শীর্ষে থাকা ব্যক্তিরা দুর্নীতির মাধ্যমে আয় করা টাকার ভাগ নিতেন। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া, তার কুলাঙ্গার দুই পুত্র তারেক রহমান ও আরাফাত রহমান কোকো’র দুর্নীতি ও সন্ত্রাসের কারণে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশকে খুব বাজেভাবে পরিচিতি পেতে হয়েছিল। দেশে ব্যাপকভাবে দুর্নীতির কারণে টান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের করাপশন পারসেপশন ইনডেক্স (সিপিআই) এ বাংলাদেশে পর পর পাঁচবার দুর্নীতিতে বিশ্বের মধ্যে প্রথম হয়েছিল। বেগম খালেদা জিয়ার শাসন আমল ছিল সর্বগ্রাসী দুর্নীতিতে নিমজ্জিত। দুর্নীতিপরায়ন এই সরকারের শাসনামলে খুব একটা প্রকাশিত না হলেও ২০০৭-০৮ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় দুর্নীতিকে বিএনপির প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া এবং সার্বিক সমর্থন দেওয়ার খবর প্রকাশিত হতে থাকলে খালেদা জিয়া, তার দুই ছেলে ও অন্যান্য শীর্ষ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া শুরু হয়। ওই সময়েই তাদের দুর্নীতির জন্য তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয় যা এখন বিচারাধীন রয়েছে। এই প্রবন্ধে বেগম খালেদা জিয়া এবং তার দুই কুলাঙ্গার পুত্রের আলোচিত দুর্নীতি মামলা নিয়ে আলোচনা করা হবে।
কোকোর সিমেন্সের দুর্নীতি কেলেঙ্কারী:
বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোকে ঘুষ দেওয়ার কথা স্বীকার করে সিমেন্স। বিভিন্ন অভিযোগ ও সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে মার্কিন জাস্টিস ডিপার্টমেন্ট আরাফাত রহমান কোকোর কয়েকটি ব্যাংক হিসাবের বিরুদ্ধে ২০০৯ সালের ৮ জানুয়ারি সম্পত্তি বাজেয়াপ্তের মামলা করে যা নম্বর 1:09-cv-00021(JDB)। এই ব্যাংক হিসাবগুলোতে ৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার গচ্ছিত ছিল। আরাফাত রহমান কোকো সিমেন্স এবং চাইনা হারবার ইঞ্জিনিয়ারিং এর কাছ থেকে তার অ্যাকাউন্টে ঘুষ হিসেবে নিয়েছিল ওই টাকা। মার্কিন বিচার বিভাগ কোকোর ব্যাংক অ্যাকাউন্ট বায়েজাপ্ত করার মামলা করেছিল কারণ তার সিঙ্গাপুরের ব্যাংক অ্যাকউন্টের কিছু টাকা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে এসেছিল। কোকোর ব্যাংক অ্যাকাউন্টে মার্কিন ডলারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকেই তার ঘুষের টাকা পরিশোধ করা হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রকে ব্যবহার করে বিদেশ থেকে ঘুষ ও জোরপুর্বক টাকা আদায় করলে তা যুক্তরাষ্ট্রের মানি লন্ডারিং আইনের আওতায় পড়ে । তার মামলার বিষয়টি পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, তার অ্যাকাউন্টের লেনদেন হয়েছে বিদেশে বসে এবং ঘুষ ও জবরদস্তিমূলকভাবেই তিনি ওই অর্থ নিয়েছিলেন। যেহেতু যুক্তরাষ্ট্রে কোকোর ওই অর্থ বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিল তাই বাংলাদেশ এবং যুক্তরাষ্ট্র যৌথভাবে কোকোর মানি সিমেন্স ঘুষ কেলেঙ্কারী নিয়ে কাজ করে। কোকো জাসজ (ZASZ) নামে একটি সিঙ্গাপুরে একটি কোম্পানীর নামে তার ঘুষের অর্থ রেখেছিল যা তার পরিবারের সদস্যদের অদ্যাক্ষর নিয়ে গঠিত। ( যাফরিয়া কোকোর বড় মেয়ে, আরাফাত রহমান কোকো নিজে, কোকোর স্ত্রী শর্মিলা এবং জাহিয়া কোকোর ছোট মেয়ে এই চার জনের নামের অদ্যাক্ষর নিয়ে জাসজ নামের কোম্পানীটি গঠিত হয়েছিল।) আরাফাত রহমান কোকো ঘুষের মাধ্যমে সিঙ্গাপুরে বিপুল পরিমাণে অর্থ জমা করেছিল, এমন প্রমাণ পাওয়ার পর সেদেশের সরকার ২০১৩ সালে বাংলাদেশ সরকারকে ২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ফেরত দিয়েছিল। এর আগে অবৈধভাবে অর্থ উপার্জনকারী হিসেবে আরাফাত রহমান কোকোকে বাংলাদেশের একটি আদালত ২০১১ সালে ৬ বছরের জেল দিয়েছিল। সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর সিঙ্গাপুরে ফেয়ারহিল নামে একটি কোম্পানীর মাধ্যমে অর্থ আত্মসাতের মামলায় তাকে আরো ৫.২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার জরিমানা গুনতে হয়েছিল।
তারেক ও মামুনের মানি লন্ডারিং দুর্নীতি:
মার্কিন ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন-এফবিআই বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার বড় ছেলে ও বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান এবং তার ঘনিষ্ট বন্ধু ও ব্যবসায়িক পার্টনার গিয়াসউদ্দিন আল মামুনের বিরুদ্ধে ঘুষ ও মানি লন্ডারিং নিয়ে তদন্ত করেছে এবং বাংলাদেশের আদালতে তাদের বিরুদ্ধে এসে সাক্ষ্য দিয়ে গেছেন এফবিআইয়ের সাবেক বিশেষ প্রতিনিধি। এফবিআইয়ের তদন্তে উঠে এসেছে যে, তারেক ও মামুন তাদের সিঙ্গাপুরের একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে নির্মান কনস্ট্রাকশন লিমিটেড এর পরিচালক এবং চীনের হারবিন ইঞ্জিনিয়ারিং কন্সট্রাকশন এর এদেশীয় এজেন্ট খাদিজা ইসলামের কাছ থেকে সাড়ে ৭ লাখ মার্কিন ডলার ঘুষ নিয়েছিল। হারবিন ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানীর লোকাল এজেন্ট হিসেবে টঙ্গীতে ৮০ মেগাওয়াটের একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মানের কাজ পাওয়ার জন্য তারেক ও মামুনকে ওই টাকা দিয়েছিল ঘুষ হিসেবে। এফবিআইয়ের এজেন্ট ডেব্রা লাপ্রিভেট গ্রিফিথ এই বিষয়ে তারেক ও মামুনের দুর্নীতি নিয়ে তদন্ত করেছিলেন। তিনি বাংলাদেশের আদালতের সামনে সাক্ষ্য দেন যে, ব্যবসায়ী খাদিজা ইসলাম সিঙ্গাপুরে মামুনের সিটি ব্যাংকে (তারেকের বন্ধু মামুনের সিঙ্গাপুরের সিটি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নাম্বার: ১৫৮০৫২-০১৬-০০৮) ওই টাকা জমা দিয়েছিলেন। ওই একই ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে তারেক রহমানের নামে সাপ্লিমেন্টারি গোল্ড ভিসা কার্ড ( যার নাম্বার: ৪৫৬৮-৮১৭০-১০০৬-৪১২২) ইস্যু করা হয়। সিঙ্গাপুরের সিটি ব্যাংকের কাছ থেকে সাপ্লিমেন্টারি গোল্ড ভিসা কার্ড নিতে তারেক রহমান তার পাসপোর্টের একটি ফটো কপি জমা দিয়েছিল ( তারেক রহমানের পাসপোর্ট নাম্বার: Y ০০৮৫৪৮৩) যেখানে তার পিতার নামের জায়গাতে লেখা ছিল মৃত জিয়াউর রহমান এবং মাতার নাম ছিল বেগম খালেদা জিয়া। তারেক রহমান এই কার্ড বিভিন্ন দেশে যেমন; গ্রিস, জার্মানী, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতে প্রমোদ ভ্রমণের জন্য ব্যবহার করেছিল এমন তথ্যই উঠে এসেছে এফবিআইয়ের তদন্তে। এভাবে মোয়াজ্জেম হোসাইন এবং মারিনা জামান ঘুষের টাকা মামুনের সিঙ্গাপুরের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে দিয়েছিল যে অ্যাকাউন্টে তারেক রহমানের সরাসরি ছিল। ২১ জুলাই ২০১৬ সালে বাংলাদেশের উচ্চ আদালত তারেক রহমানকে সাত বছরের জেল এবং ২০ কোটি টাকা জরিমানা করেছে মানি লন্ডারিং এর জন্য। দেশের সর্বোচ্চ আদালত শুধু রায়ই দেননি তখন রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছিল যে, এ ধরনের অপরাধমূলক কাজ ‘ ফিনানশিয়াল ক্রাইম’ ছিল এবং এ ধরনের কাজ দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য বড় ধরনের একটি বাধা। মামুনের অ্যাকাউন্টে খাদিজা ইসলামের দেয়া ৭ লাখ ৫০ হাজার ডলারে খোঁজ পেয়ে সুপ্রীম কোর্ট তারেক সম্পর্কে মন্তব্য করেছিলেন ওই টাকাটা ঘুষের টাকা। কিন্তু তারেক রহমান এবং তার বন্ধু মামুন ওই টাকাকে পরামর্শক ফি হিসেবে নিয়েছে।
নাইকো দুর্নীতি কেলেঙ্কারী:
২০১১ সালেল ২৩ জুন কানাডার একটি আদালত বেগম জিয়া প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন তার সরকারের জ্বালানী প্রতিমন্ত্রী একেএম মোশাররফ হোসাইনের দুর্নীতি মামলার বিষয়ে উপযুক্ত তথ্যপ্রমাণ পেয়েছিল। মোশাররফ কানাডার কোম্পানী নাইকোকে অনৈতিকভাবে সুবিধা দেয়ার বিনিময়ে একটি দামি গাড়ি উপহার পেয়েছিল নাইকোর কাছ থেকে যার আর্থিক মূল্য ছিল কানাডিয়ান ডলারে ১,৯০,৯৮৪ ডলার। নাইকো আরো ৫ হাজার কানাডিয়ান ডলার ঘুষ দিয়েছিল মোশাররফকে তার স্বপরিবারে যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণের জন্য। আর নাইকো একেএম মোশাররফ হোসাইনকে ওই ঘুষ দিয়েছিল এটা নিশ্চিত করতে যে, নাইকো বাংলাদেশ থেকে তাদের ঠিক করা দামে গ্যাস কিনতে পারবে এবং তা বিক্রী করতে পারবে এবং গ্যাসক্ষেত্রে বিস্ফোরনের কারণে সরকার কর্তৃক নির্ধারিত জরিমানা আরো কমানো হবে।। ২০১৭ সালের ২৪ আগস্ট বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্ট রিট পিটিশনের ( পিটিশন নাম্বার: ৫৬৭৩) রায় দেয়। রয়্যাল কানাডিয়ান মাউন্টেড পুলিশ, এফবিআই এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের সমস্ত তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে আদালত এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে যে, ২০০৩-০৬ সাল পর্যন্ত অর্থাৎ খালেদা জিয়ার প্রধানমন্ত্রীত্বকালীন সময়ে নাইকোর কাছ থেকে বড় ধরনের ঘুষ লেনদেনের ঘটনা ঘটেছিল অনৈতিকভাবে তাদের সুবিধা দেয়ার নামে। বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের আদেশের লক্ষণীয় বিষয় হলো, নাইকো একেবারে নির্লজ্জভাবে ঘুষ দিয়েছিল। নাইকোর এজেন্ট কাশিম শরীফকে ৪ মিলিয়ন ডলার দিয়েছিল এবং ঢাকা ক্লাবের সাবেক সভাপতি সেলিম ভুইয়ার মাধ্যমে ৫ লাখ ডলার দিয়েছিল। আর নাইকো তাদেরকে পরামর্শক হিসেবে এইসব টাকা দিয়েছিল যা তৎকালীন সরকারের উচ্চ পদস্থ কর্তাদের প্রদান করতে এবং তাদের সাথে যোগাযোগ করিয়ে দিয়েছিলেন। আর এইসব সকল তথ্যপ্রমাণ জোগাড় করেছে রয়্যাল কানাডিয়ান মাউন্টেড পুলিশ এবং মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই। তাদের তথ্যপ্রমাণ এটাই প্রমাণ করে যে, নাইকো তাদের বাংলাদেশী এজেন্টদেরকে সুইস ব্যাংকের মাধ্যমে প্রথমে বার্বাডোজের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে কাশিম শরিফ এবং সেলিম ভুইয়ার অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে টাকাগুলো দেন। পরে ওই টাকা চলে যায় তারেকের ঘনিষ্ঠ বন্ধু গিয়াসউদ্দিন আল মামুনের অ্যাকাউন্টে।
জিয়া পরিবারের দুর্নীতি নিয়ে এফবিআইয়ের বিশেষ প্রতিনিধির সাক্ষ্যঃ
বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ এবং মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন -এফবিআই’য়ের সাবেক বিশেষ প্রতিনিধি ডেবরা লাপ্রিভেট গ্রিফিথ কয়েক বছর দুর্নীতি নিয়ে তদন্ত করেছেন। বাংলাদেশে ২০০১-২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের সময় রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় কিভাবে দুর্নীতি হয়েছিল তা নিয়েই মূলত তিনি তদন্ত করেছেন। ২০১৬ সালের ২১ নভেম্বর আদালতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার বড় ছেলে এবং বিএনপির দ্বিতীয় শীর্ষ নেতা তারেক রহমান এবং তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও ব্যবসায়িক পার্টনার গিয়াস উদ্দিন আল মামুনের বিরুদ্ধে তিনি যে জবানবন্দী দিয়েছেন সেখানে তিনি কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য এবং জিয়া পরিবার নিয়ে বাস্তবতার নিরীখে কিছু মন্তব্য করেন। সেই সময়ের সরকার এবং জিয়ার পরিবারের ঔদ্ধত্যের কারণে কিভাবে তখন দেশে সর্বগ্রাসী দুর্নীতি হয়েছিল তা তিনি তুলে ধরেন। এখানে গ্রিফিথের করা কিছু মন্তব্য কোন প্রকার সম্পাদনা ছাড়াই আক্ষরিকভাবে তুলে ধরছি।
কিছু “পরামর্শক” এর মাধ্যমে সরকারি কর্মকর্তাদের ঘুষ দেওয়া হয়েছিলো যারা টাকাটা ঐসকল সরকারি কর্মকর্তা ও তাদের প্রাপ্তবয়স্ক সন্তানদের কাছে পৌছে দেন। গিয়াসউদ্দিন আল মামুন ও তার ভাই হাফিজ ইব্রাহিম, এই দুইজনই মুলত তারেক রহমান ও মন্ত্রনালয়ের বিভিন্ন গুরুত্বপুর্ন ক্ষমতাসীনদের প্রাপ্তবয়স্ক সন্তানদের কাছে টাকা স্থানান্তর করে। যারা পরে নিজেদের রাজনৈতিক প্রভাব ব্যবহার করে ঘুষ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানকে কাজ পাইয়ে দেয়। বাংলাদেশ কাজ করতে ইচ্ছুক এমন অনেক প্রতিষ্ঠান এধরনের মধ্যস্ততাকারীদের পরামর্শক হিসেবে নিয়োগ দিতো যাদের আসলে টেলিযোগাযোগ, জলবিদ্যুৎ, তেল বা গ্যাস এধরনের ক্ষেত্রে কোন বিশেষ জ্ঞান নেই। ক্ষমতাশালী লোকদের সাথে তাদের সুসম্পর্ককে ব্যবহার করেই ঘুষ প্রদান করতো।
কয়েকজন আমার কাছে এই বলে সাক্ষ্য দিয়েছেন যে, বাংলাদেশে যে কোন ধরনের কাজের চুক্তি পেতে হলে প্রতিষ্ঠানটিকে মামুন বা তার ভাই হাফিজ ইব্রাহিমকে টাকা দিতে হতো যারা পরে সেই টাকা প্রধানমন্ত্রীর দুই ছেলে তারেক ও কোকোর কাছে পৌঁছে দিতো। আমরা যতগুলো দুর্নীতির মামলার তদন্ত করেছি প্রতিটি তদন্তই একথা সমর্থন করে, এবং আরো প্রমাণ বের হয় যে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী এমনকি নিচুপদস্থ অনেক সরকারী কর্মকর্তারাও ঘুষের টাকা পেতেন।
উদাহরস্বরুপ, সিমেন্স দুর্নীতি মামলার তদন্ত করতে গিয়ে সিঙ্গাপুরে আরাফাত রহমানের ঘুষের ব্যাপারে সেদেশের তদন্ত কর্মকর্তারা একটি অফিসে তল্লাশী চালান এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের ওয়ারিদ টেলিকমের আরাফাত রহমানকে পরামর্শক হিসেবে নিয়োগ দিয়ে একটি ‘পরামর্শক চুক্তি’র কাগজ খুজে পান। আরাফাত রহমানের টেলিকম খাতে কোন দক্ষতা বা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার কোন প্রমাণ নেই এবং পরামর্শক হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার যোগ্যতাও তার নেই। আরাফাত রহমান আরব আমিরাতে বাড়ি কেনেন এবং আরব আমিরাত থেকে টাকা তার সিঙ্গাপুরের একাউন্টে টাকা জমা করার তথ্য আমার তদন্তে উঠে আসে।
তারেক রহমান সম্পর্কে উইকিলিকস যা বলেছিল:
ঢাকায় মার্কিন দূতাবাস ২০০৮ সালের ৩ নভেম্বর তৎকালীন রাষ্ট্রদূত জেমস এফ মরিয়ার্টি মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টে এক গোপন তারবার্তায় তারকে রহমান সম্পর্কে লেখেন। যা পরে সারা বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টিকারী উইকিলিকসের ফাঁস করা নথিতে পাওয়া যায়। মরিয়ার্টি তারেক রহমান সম্পর্কে লিখেন:
“তারেক রহমান বিপুল পরিমাণ দুর্নীতির জন্য দায়ী যা যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় স্বার্থের ওপর খারাপ প্রভাব ফেলছে...
সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার ছেলে তারেক রহমান অত্যন্ত দুর্ধর্ষ ও ভয়ঙ্কর এবং একটি দুর্নীতিপরায়ণ সরকার ও বাংলাদেশে রাজনৈতিক সহিংসতার প্রতীক।
তারেক রহমানের প্রকাশ্য দুর্নীতি মার্কিন সরকারের তিনটি লক্ষ্যকে, যথাঃ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, উন্নয়ন এবং জঙ্গিবাদ নির্মুল করার মিশনকে প্রচণ্ডভাবে হুমকির সম্মুখীন করেছে...... আইনের প্রতি তার প্রকাশ্য অশ্রদ্ধা বাংলাদেশে জঙ্গিদের মূল শক্ত করতে সহায়তা করেছে”
জিয়া পরিবারের অন্যান্য দুর্নীতির মামলা যেগুলো বিচারাধীন রয়েছে:
যেসব মামলায় জিয়া পরিবারের বিরুদ্ধে ইতিমধ্যে সাক্ষ্য প্রমাণ পাওয়া গেছে সেই মামলার বাইরেও জিয়ার পরিবারের বেগম খালেদা জিয়া,তার পুত্র তারেক রহমান এবং বিএনপির অন্য শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে বেশ কিছু মামলা বিচারাধীন রয়েছে। আর ওই সব মামলাগুলো বিগত ২০০৭-০৮ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে দুর্নীতি দম কমিশন করেছিল। এর একটি মামলাও বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে করা হয়নি।
জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলাঃ ২০১১ সালের ৮ আগস্ট দুর্নীতি দমন কমিশন তেজগাঁও থানায় এই মামলা করে। জিয়াউর রহমানের নামে একটি চ্যারিটেবল ট্রাস্ট প্রতিষ্ঠা করে ৩ কোটি ১৫ লক্ষ টাকার বেআইনি লেনদেনের কারণে এই মামলা করা হয়। খালেদা জিয়াসহ চার জনকে আসামী করে চার্জশীট প্রদান করা হয়।
জিয়া এতিমখানা ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলাঃ ২০০৮ সালের ৩ জুলাই দুর্নীতি দমন কমিশন রমনা থানায় খালেদা জিয়া, তার বড় ছেলে তারেক রহমান ও আরো চারজনকে অভিযুক্ত করে মামলা দায়ের করে। অভিযোগে বলা হয়, অভিযুক্তরা অরফানেজ ট্রাস্টের নামে দেশের এতিমদের জন্য বিদেশি দাতা সংস্থা থেকে আসা ২ কোটি ১০ লক্ষ টাকার অনুদান আত্মসাৎ করে। ২০১০ সালের ৫ আগস্ট কোর্টে চার্জশীট দাখিল করা হয়। ৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ তারিখে খালেদা জিয়াকে ৫ বছর ও তারেক রহমানকে ১০ বছরের কারাদন্ডের রায় ঘোষণা করে আদালত।।
বড়পুকুরিয়া দুর্নীতি মামলাঃ ২০০৮ সালের ২৬ জানুয়ারি দুর্নীতি দমন কমিশন শাহবাগ থানায় খালেদা জিয়াসহ ১৬ জনকে অভিযুক্ত করে এই মামলা দায়ের করে। মামলায় বলা হয়, বড়পুকুরিয়া কয়লা খনিতে কন্ট্রাক্টর নিয়োগের ব্যাপারে অভিযুক্তরা দুর্নীতির আশ্রয় নিয়েছেন এবং প্রায় ১৫৯ কোটি টাকা ঘুষ হিসেবে আদায় করেছেন। মামলাটি এখন ঢাকা জজকোর্টে প্রক্রিয়াধীন আছে। খালেদা জিয়া এই মামলার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্ট বিভাগে আবেদন করেন যা ২০১৬ সালের ২৫ মে আদালত খারিজ করে দেন। মামলার প্রক্রিয়া চলতে এখন আর কোন বাধা রইলো না।
গ্যাটকো দুর্নীতি মামলাঃ ২০০৭ সালের ২ সেপ্টেম্বর দুর্নীতি দমন কমিশন খালেদা জিয়াসহ আরো ১৪ জনের নামে এই মামলা দায়ের করে। মামলায় বলা হয় চট্টগ্রাম বন্দর ও ঢাকা ইনল্যান্ড কন্টেইনার ডিপোর কন্টেইনার ওঠানামার কাজ গ্যাটকোকে দেওয়ার ফলে রাষ্ট্রীয় কোষাগারের ১৪৫ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। খালেদা জিয়া দুই দফায় এই মামলার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে আবেদন করেন যা আদালতে খারিজ হয়ে যায়। বর্তমানে অভিযোগপত্র দাখিলের অপেক্ষায় আছে মামলাটি।
নাইকো দুর্নীতি মামলাঃ ২০০৭ সালের ৯ ডিসেম্বর দুর্নীতি দমন কমিশন খালেদা জিয়াসহ আরো কয়েকজনের বিরুদ্ধে এই মামলা দায়ের করে। ২০০৮ সালের ৫ মে খালেদা জিয়াসহ এগারো জনের বিরুদ্ধে চার্জশীট দাখিল করে। খালেদা জিয়া মামলার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করেন। ২০১৫ সালের ১৮ই জুন হাইকোর্ট এই আবেদন খারিজ করে দিলে খালেদা জিয়া সুপ্রিম কোর্টের আপিল ডিভিশনে লিভ টু আপিলের আবেদন করেন। ২০১৬ সালের ২৪ নভেম্বর আপিল বিভাগ খালেদা জিয়ার এই আবেদন খারিজ করে দেয় এবং বিচারিক আদালতকে মামলার কার্যক্রম এগিয়ে নিতে আদেশ দেয়। মামলার চার্জ গঠনের শুনানির কাজ এখন প্রক্রিয়াধীন।
Comments