সন্ত্রাসের রাজনীতির প্রতীক বিএনপি-জামায়াত
২০০৯ সালে থেকে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপির সাথে এর চরমপন্থী মিত্র জামায়াত-ই-ইসলামি এবং এর ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাথে একটি ভয়ঙ্কর রাজনৈতিক সংস্কৃতি চালু করেছে, যার বৈশিষ্ট্য হচ্ছে প্রতিবাদের নামে রাজপথে সাধারন নাগরিক ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর সহিংস ও প্রাণঘাতী হামলা , ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হামলা ও তাদের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে হত্যা ইত্যাদি। এসকল কাজে তারা প্রায়ই জামায়াতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ- জেএমবি এবং হরকাতুল জিহাদের মতো সহিংস চরমপন্থী সংগঠনগুলোকে ব্যবহার করে। ২০১৩ সাল থেকে, বিভিন্ন গণপরিবহনে, যথা বাস, ট্রাক, অটোরিক্সা, ইজিবাইকের যাত্রীদের উপর পেট্রোল বোমা এবং মলোটভ ককটেল আক্রমণ তাদের সাহিংসতায় একটি নতুন মাত্রা যোগ করে। ২০০১ সাল হতে বিএনপি-জামাতের দুঃশাসন ও সন্ত্রাসের ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে এই প্রতিবেদনে।
বিএনপি-জামায়াত ৪ দলীয় জোট সরকার (২০০১-০৬)
আওয়ামী লীগের ওপর হামলা: ২০০১ সালে সাধারণ নির্বাচনে জয়লাভের পর বিএনপি-জামায়াত জোটের "সন্ত্রাস-রাজনীতি” প্রকাশ পায় এবং তা পরবর্তী পাঁচ বছর ধরে চলতে থাকে। এই সময়কালে বিএনপি-জামায়াত জোটসাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়া ও সাবেক সংসদ সদস্য আহসানউল্লাহ মাস্টারসহ আওয়ামী লীগের ২৬ হাজার নেতা ও কর্মীদের হত্যা করে। এই সময়েই আওয়ামী লীগের সভাপতি ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার জন্য ১৮ বারের বেশি চেষ্টা চালানো হয়। এজন্য বিএনপি-জামায়াত হুজি ও জেএমবির মতো চরমপন্থী গোষ্ঠীকে ব্যবহার করে, এবং হত্যাকাণ্ডের মতো নৃশংসতার জন্য তাদেরকে রাজনৈতিক নিরাপত্তাও প্রদান করে। এমনকি বিএনপি-জামায়াতের ভবিষ্যৎ নেতা ও মানি লন্ডারিং মামলায় দোষী সাব্যস্ত তারেক রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। হামলার উদ্দেশ্য ছিলো দলের সভাপতি ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ সকল নেতাকে হত্যা করা। এরপর ২১শে আগস্ট হামলার ঘটনায় আওয়ামী লীগের ২৪ জন নেতাকর্মী এবং এর সহযোগী সংগঠনের সদস্যরা নিহত হন এবং আহত হন ৩শ’ জনেরও বেশি নেতাকর্মী। নিহতদের মধ্যে ছিলেন মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও মরহুম প্রেসিডেন্ট জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আইভী রহমান।
সংখ্যালঘুদের উপর সহিংসতা: অক্টোবরের ২০০১ সালের নির্বাচনকে ঘিরে বিএনপি এবং জামায়াত জোট হিন্দুদের উপর যে আক্রমণ করে তার বিভিন্ন খবরে ও প্রতিবেদনে অনেকবার উঠে এসেছে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের রিপোর্ট মতে, “২০০১ সালের ১ অক্টোবর বাংলাদেশের সাধারণ নির্বাচনের আগে ভোট না দেয়ার জন্য হিন্দু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে বিএনপি-জামাত জোট একের পর এক হামলা করতে শুরু করে, কারণ তাদের বিশ্বাস ছিলো যে হিন্দু ধর্মাবলম্বী ভোটারেরা আওয়ামী লীগকেই ভোট দেবে। নির্বাচনের পরের অবস্থা ছিলো আরো পরিকল্পিত, ছকবদ্ধ এবং গুরুতর। প্রতিবেদনগুলো ইঙ্গিত দেয় সেসময় বিএনপি জোটের হামলায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা ছিলো বরিশাল, ভোলা, পিরোজপুর, খুলনা, সাতক্ষীরা, গোপালগঞ্জ, বাগেরহাট, যশোর, কুমিল্লা ও নরসিংদী। ওই সময় আক্রমণকারীরা হিন্দুদের বাড়িতে ঢুকে তাদের পরিবারের সদস্যদের মারধর, তাদের সম্পত্তি লুটপাট এবং অনেক হিন্দু নারীদের ধর্ষণও করে।”
ওইসময় ধর্ষণ সহিংসতা এবং ভয় দেখানোর প্রধান উপায় হিসেবে ব্যবহৃত হয়। বাংলাদেশে মানবাধিকার সংগঠনের মতে,ওই সময় হয়ত ১০০ জন নারীকে ধর্ষণের শিকার হয়। বিভিন্ন রিপোর্টের মতে এই ঘটনায় বিএনপি-জামায়াত জোটের কর্মীরাই দায়ি। ওই সময় কয়েকজন হিন্দু মেয়েকে অপহরণও করে তারা। অপহৃতরা এখনো তাদের পরিবারের কাছে ফিরে এসেছেন কি-না তা এখনো অজানা। আর হামলা এবং জীবনের ওপর হুমকির কারণে ওই সময়কালে শত শত হিন্দু পরিবার সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশ থেকে ভারতে পালিয়ে যায়। এমনকি দূরবর্তী আত্মীয়দের বাসায় গিয়েও আশ্রয় নেয়। সাংবাদিকদের কাছে সাক্ষাৎকারে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষেরা বলেছেন, তারা হেরে যাওয়া আওয়ামী লীগের সমর্থক বলে মনে করেই হামলার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে। ওই সময়টিতে হিন্দুদের মন্দিরও হামলার শিকার থেকে বাদ পড়েনি।
কানাডার ইমিগ্রেশন এবং শরণাথী বোর্ডের গবেষণা অধিদপ্তরের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০০১ সালের ১ অক্টোবর বাংলাদেশে নির্বাচনের সময়কালে হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর সহিংসতার ঘটনাগুলো বিবিসি (১০ অক্টোবর ২০০১), গাল্ফ নিউজ (১২ ফেব্রুয়ারী ২০০২), প্রেস ট্রাস্ট অব ইন্ডিয়া (২০ অক্টোবর ২০০১), এবং প্যাক্স ক্রিস্টি (২৬ নভেম্বর, ২০০১) ছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ পায় । এই রিপোর্টে বলা হয়েছে, “ঘটনাগুলোতে ধর্ষণ, নির্যাতন, হত্যা ও লুটপাটের পাশাপাশি হিন্দুদের ঘরবাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। সহিংসতার শিকার হয়ে শত শত হিন্দু পরিবার সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে পালিয়ে যায়। দ্য ফেয়ার ইলেকশন মনিটরিং অ্যালায়য়েন্স জানায় যে বেশিরভাগ সহিংসতা বিএনপির কর্মীদের দ্বারা সংঘটিত হয়... হিন্দুদের উপর আক্রমণগুলো সারাদেশে বিভিন্ন জেলায় ঘটেছে।”
২০০১ সালের নির্বাচনের পর সংখ্যালঘুদের উপর বিএনপি জামায়াতের হামলার খবর যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টর আন্তর্জাতিক ধর্মীয় স্বাধীনতা প্রতিবেদন ২০০৫-এ প্রকাশ পায়। সেখানে বলা হয় হিন্দুদের উপর সহিংস আচরণ করেছে যারা ঐতিহ্যগত ভাবেই আওয়ামী লীগকে ভোট দেয়। প্রতিবেদনটিতে বিভিন্ন ঘটনার মধ্যে হত্যা, ধর্ষণ, লুট এবং নির্যাতনের কথা উল্লেখ ছিল।
২০০১ সালের নির্বাচনের পর থেকে ধর্মীয় সংখ্যালঘদের উপর হামলা অব্যাহত রয়েছে আর এ কারণেই বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে মন্দির এবং গির্জায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতি প্রয়েজন পড়ছে। রিপোর্টে উল্লেখযোগ্য ঘটনাগুলোর মধ্যে রয়েছে হত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন, প্রার্থনার স্থানে হামলা, ঘরবাড়ি নষ্ট, জোরপূর্বক উচ্ছেদ এবং উপাসনার সামগ্রী নষ্ট করে। এই অভিযোগগুলোও প্রতিবেদনের মধ্যে রয়েছে।
বাংলাদেশে সুপ্রীম কোর্টের নির্দেশে গঠিত বিচার বিভাগের তদন্ত অনুযায়ী, দেখা গেছে (বিএনপি) এবং জামায়াতের ২৬,৩৫২ নেতা এবং সমর্থকদের ওই দাঙ্গায় জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয় গেছে। এর মধ্যে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের ২৬ জন মন্ত্রী এবং আইনপ্রণেতারা রয়েছেন। অভিযুক্ত ৬ মন্ত্রী হলেন: রহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু, আবদুস সালাম পিন্টু, মতিউর রহমান নিজামী, আলতাফ হোসেন চৌধুরী, তারিকুল ইসলাম ও হাফিজউদ্দিন। তাদের মধ্যে, আলতাফ হোসেন চৌধুরী তখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন।
যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিরুদ্ধে জামায়াত-শিবিরের সহিংসতা (২০১৩)
২০১৩ সালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধ করার জন্য বিএনপির পক্ষ থেকে জামায়াত-শিবির সমর্থকরা ১৫ জন পুলিশ সদস্যকে হত্যা করে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের যুদ্ধাপরাধ, গণহত্যা এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য দেশের অভ্যন্তরে ট্রাইবুনাল গঠন করা হয়। এ কারণেই ২০১৩ সালে জামায়াত-শিবিরের রাজনৈতিক সহিংসতার ৪১৯ টি প্রধান ঘটনায় ৪৯২ জন নিহত হয় এবং ২২০০ জন আহত হয়।
কাদের মোল্লার রায়ের পর সহিংসতা: ৫ ফেব্রুয়ারী আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালে কাদের মেল্লার আমৃত্যু কারাদন্ডাদেশের ঘোষণায় দুই দিনের হরতাল ডাকে জামায়াত-ই-ইসলামী। সারাদেশে জামায়াত ও এর ছাত্র সংগঠন-ছাত্র শিবিরের হরতাল বিক্ষবে কমপক্ষে তিন জন নিহত হয়। এর পর ২৪ ফেব্রুয়ারী মানিকগঞ্জ জেলার সিংগাইর উপজেলায় হরতালে পুলিশের সাথে জামায়াত-শিবির কর্মীদের সংঘর্ষে ৪ জন নিহত এবং কমপক্ষে ৫০ জন আহত হয় ।
কাদের মোল্লার ফাঁসির পর সহিংসতা: ১২ ডিসেম্বরমৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াত নেতা ও যুদ্ধাপরাধের আসামি আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় কার্যকরের পর জামায়াত-ই-ইসলামীর কর্মীরা এবং এদের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র শিবিরের সহিংসতায় সারাদেশে সংঘর্ষে কমপক্ষে সাত জন নিহত ও ১৫০ জন আহত হয়।
সাঈদীর রায়ের পর সহিংসতা: ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে মৃত্যুদ-ে ¬¬দ-িত করার পর ২৮ ফেব্রুয়ারি আন্দোলনের নামে জামায়াত-ই-ইসলামী ও এর ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র শিবিরের সহিংসতায় ১২ জন পুলিশ সদস্যসহ অন্তত ৪০ জন নিহত হন এবং ২ হাজারেরও বেশি লোক আহত হয়। গাইবান্ধা জেলায় ৪ পুলিশ সদস্যসহ ৬ জন নিহত হয়, সাতক্ষীরায় ১ জন বেসামরিক নাগরিক, ঠাকুরগাঁওয়ে ৪ জন, চট্টগ্রামে ৪, কক্সবাজার, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, ও নোয়াখালী জেলার দুই জন করে এবং ঢাকা, মৌলভীবাজার, নাটোর ও বগুড়া জেলায় একজন করে বেসামরিক নাগরিক নিহত হন। আর ১ মার্চ সারা দেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাথে সংঘর্ষে জামায়াত ইসলামীর সংঘর্ষে কমপক্ষে সাত জন মানুষ নিহত হয় আর এ নিয়ে মৃতের সংখ্যা বেড়ে ৪৭ জনে দাঁড়ায়। ওই সময়ও বাংলাদেশের হিন্দুরা বিশেষ লক্ষ্যবন্তু থাকে, যা তাদের শারীরিক সহিংসতা লুটপাট এবং অগ্নিসংযোগের সম্মুখীন করে।
গাইবান্ধার বঙ্গশারহাট শহরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে জামায়াত-শিবিরের সংঘর্ষে এক রিকশাচালক ও চায়ের দোকানের এক মালিক নিহত হন। সিলেট নগরীতে সন্দেহভাজন শিবির কর্মীরা ছাত্রলীগ নেতা জগতজ্যোতি তালুকদারকে হত্যা করে । ৩রা মার্চ ২৪ ঘণ্টার হরতাল ডাকে জামায়াত-শিবির। হরতালের প্রথম দিনে পুলিশের সাথে জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীদের সংঘর্ষে ২৩ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছিলেন আর আহত হন এক হাজারের বেশি মানুষ। বগুড়া জেলায় জামায়াত শিবিরের কর্মীদের সাথে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংঘর্ষে তিন নারীসহ ১০ জন নিহত হয়। আর রাজশাহী জেলাতেও একই সংঘর্ষের শিকার হন নিরীহ গ্রামবাসী। আর সেসময়ই নিহত হন ৪ জন। ঝিনাইদহ জেলায় আইন শৃঙ্খলাবাহিনীর উপর জামায়াত-শিবির কর্মীরা হামলা চালালে ওমর ফারুক (৪০) নামে এক পুলিশ কনস্টেবল নিহত হন। আর মার্চের ৪ তারিখে হরতালের শেষদিন আইন শৃঙ্খলাবাহিনীর সাথে জামায়ত ইসলামী এবং এর ছাত্র সংগঠন-ছাত্র শিবিরের সংঘর্ষে সারাদেশে ৫ জন নিহত হয় আহত হয় আরও ১৭ জন।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল থেকে বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে মুত্যুদ-াদেশ দেয়ার পর থেকে কয়েকদিনের মধ্যে পুলিশের সঙ্গে জামায়াত-শিবিরের সংঘর্ষে সারাদেশে যানবাহন ভাঙচুরসহ বিভিন্ন সহিংসতায় বহু মানুষ নিহত ও আহত হন। এছাড়া, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান ফজলে কবির, প্রধান নির্বাচন কমিশনার রকীবউদ্দিন আহমেদ, তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু এবং প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার গ্রামের বাড়িতে পেট্রোল বোমা এবং ককটেল মারে জামায়াত-শিবির কর্মীরা। আর, সাঈদীর মামলার প্রধান সাক্ষীকেও সেসময় হত্যা করে জামায়াত-শিবির।
দশম জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে সহিংসতা (২০১৪-২০১৫)
২০১৪: ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের বিরোধিতা করে বিএনপি-জামায়াত জোটের সন্ত্রাসের রাজত্ব শুরু হয়। তারা সেসময় শত শত যানবাহন ভাংচুর করে সেগুলোতে আগুন ধরিয়ে দেয়। ওই ঘটনায় তাদের পেট্রোল বোমা, হাতে বানানো বোমা এবং অন্যান্য সহিংসতায় ২০জন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যসহ ২০০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত হয়। সহিংসতার সময় রাস্তার পাশে থাকা হাজার হাজার গাছ কেটে ফেলে জামায়াত-শিবির কর্মীরা। এছাড়া, ছোট দোকান, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এবং বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোতেও আগুন দেয় তারা। বিএনপি-জামায়াতের সন্ত্রাসীরা মসজিদ, মন্দির, প্যাগোডা ও গীর্জা ভাঙচুর এবং পবিত্র কুরআনের শত শত কপি জ্বালিয়ে দেয়। নির্বাচনের দিন, একজন প্রিসাইডিং অফিসারসহ মোট ২৬ জনকে হত্যা করে এবং সারাদেশে ৫৮২টি স্কুলে ভোটকেন্দ্রে আগুন লাগায় বিএনপি-জামায়াতপন্থীরা। এসব বাধা বিপত্তি থাকা সত্ত্বেও ওইদিন জনগণ গণতন্ত্রকে বজায় রেখে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করে।
২০১৫: ২০১৫ সালের ৪ জানুয়ারি নির্বাচনের এক বছর পূর্তির দিন আবারও জ্বালাও-পোড়াও শুরু করে সন্ত্রাসের রাজত্ব শুরু করতে চায় বিএনপি-জামায়াত জোট। ওই সময় ২৩১ জনকে হত্যা করে তারা। যাদের বেশিরভাগই পেট্রোল বোমা এবং আগুনে দগ্ধ হয়ে মারা যায়। ওই ঘটনায় আহত হয় আরো ১ হাজার ১শ’ ৮০ জন। সেসময় ২,৯০৩টি গাড়ি, ১৮টি রেলগাড়ি এবং ৮টি যাত্রীবাহী জাহাজে আগুন লাগিয়ে হামলা চালায় তারা। ওই সময় হামলার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয় সরকারি অফিসগুলো। আর, বিএনপি-জামায়াতের ভাঙচুর এবং আগুনে পুড়ে ৬টি ভূমি অফিসসহ ৭০টি সরকারি কার্যালয় নষ্ট হয়ে যায়।
আর্থিক খরচ: যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও দশম জাতীয় নির্বাচন করতে ২০১৩ সালে মাত্র ছয় মাসেই ৫০ হাজার কোটি টাকা অর্থাৎ ছয় হাজার বিলিয়ন ডলারের বেশি অর্থায়ন হয়। আর এ সময়ই সহিংসতা শুরু করে বিএনপি-জামায়াত সমর্থকরা। ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির মতে, হরতাল-অবরোধের প্রতিটি দিন দেশের ১৬০০ কোটি টাকা (অথবা ১৯২.৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার) বা জিডিপি'র ০.২ শতাংশ ব্যয় হয়। এর অর্থ ২০১৩, ২০১৪ এবং ২০১৫ সালে বিএনপি-জামায়াতের হরতাল-অবরোধে দেশের ১.৫৩ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি অর্থ ক্ষয় হয়। তবে বিএনপি-জামায়াতের সহিংসতায় যে সম্পদের ক্ষতি হয়েছে তা এরমধ্যে অন্তর্ভুক্ত নয়।
সংখ্যালঘুরা লক্ষ্যবস্তু: বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে পুলিশের জমা দেওয়া রিপোর্ট অনুযায়ী, ৫ জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচনের পর বিএনপি-জামায়াত হিন্দুদের ওপর দেশের ২১ জেলায় হামলা চালায়। আর ওই সময় মোট ১৬০টি হামলা ও অত্যাচারের ঘটনা পাওয়া গেছে। ওই সময় ৭০টি হামলায় ৪০ লাখ টাকার ক্ষতি হয়। আর বেশিরভাগ হামলার জন্যই বিএনপি-জামায়াত দায়ি বলেই মনে করা হয়। অত্যাচারের মধ্যে হিন্দু সম্প্রদায়কে আহত করা, তাদের ঘরবাড়ি, মন্দির ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে আগুন লাগিয়ে দেওয়া এবং লুটপাটও চালায় বিএনপি-জামায়াত।
২০১৪ সালের ১৫ জানুয়ারিতে হাইকোর্ট বিভাগ একটি সুয়োমোটো রুল জারি করে, যার মধ্যে বিভিন্ন পুলিশ রেঞ্জের কর্মকর্তারা অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিসের মাধ্যমে প্রতিবেদন জমা দেন। সেখানে দিনাজপুর, ময়মনসিংহ, নেত্রকোণা, শেরপুর, টাঙ্গাইল, কুমিল্লা, চাঁদপুর, বাগেরহাট, যশোর, নড়াইল, রাজশাহী, নওগাঁ, নাটোর, জয়পুরহাট, বরিশাল, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, রংপুর, গাইবান্ধা নীলফামারী ও ঠাকুরগাঁও জেলায় হিন্দুদের ওপর হামলার ঘটনা উঠে আসে।
বিএনপি একটি সন্ত্রাসী সংগঠন: কানাডার আদালত
বিএনপি-জামায়াতের সহিংস কর্মকাণ্ড যে চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে তা বিদেশি আদালত অর্থাৎ কানাডার ফেডারেল আদালতেও প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। অটোয়াতে কানাডার ফেডারেল আদালতে (সিটিজেনশিপ অ্যান্ড ইমিগ্রেশন) (২০১৭ এফসি ৯৪)- তে বলা হয়েছে যে বিএনপি প্রকৃতপক্ষে একটি সন্ত্রাসী সংগঠন। আদালত মনে করে যে, বিএনপি হচ্ছে একটি দল যারা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য পূরণে সশস্ত্র সংগ্রাম বা সহিংসতার আশ্রয় নেয়। সেখানে আরো বলা হয়েছে হাতবোমা, পিস্তল ও অস্ত্র ব্যবহার করে নেতৃস্থানীয় এবং জনগণের উপর হামলা চালায় বিএনপি। এমনকি অগ্নিসংযোগের মতোও ঘটনা ঘটায় দলটি।
আদালত বলেছেন 'বিএনপি কর্তৃক হরতালে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে খুব খারাপ প্রভাব ফেলেছে যার ফলে সেবাভিত্তিক বাধা সৃষ্টি, সম্পত্তির ব্যাপক ক্ষতি এবং জনগণের মৃত্যু এবং গুরুতর শারীরিক ক্ষতি হয়েছে। এবং সরকারকে অর্থনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে ফেলার লক্ষ্যেই হরতাল কার্যকর করতে সহিংসতার ঘটনা ঘটায় বিএনপি যা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড।'
পরিশেষে বলা যায়, প্রকৃতপক্ষে এটি বিশ্বাসযোগ্য যে, বিএনপি একটি সমসময়ই একটি সন্ত্রাসী দল। এ বিষয়ে বিবিসি, এএফপি, কমনওয়েলথ স্টাডিজ ইনস্টিটিউট, ফরেন পরিসি ম্যাগাজিন, ইকোনমিস্ট সাউথ এশিয়ান টেরোরিজম পোর্টাল এবং হিউম্যান রাইটস ওয়াচে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিএনপির হরতাল, অগ্নিসংযোগে মানুষের মৃত্যু ঘটানো, গ্রামগুলোতে ধর্মীয় সংখ্যা লঘুদের উপর হামলা, ভোটকেন্দ্রে হামলা, পথ শিশুদের দিয়ে বিস্ফোরক তৈরি এবং পেট্রোল বোমা ছোঁড়ারও কাজ করায় দলটি।
বিচারপতি ব্রাউন বলেন, "বিএনপির হরতালগুলো বাংলাদেশের অর্থনীতিতে খারাপ প্রভাব ফেলেছে এবং এর ফলশ্রুতিতে সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াও মৃত্যু এবং এর মতো গুরুতর ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন অনেকে।" তিনি আরো বলেন, এই কৌশলগুলো শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের ঊর্ধ্বে। তিনি উল্লেখ করেন যে, বিএনপি কর্মকাণ্ড নিঃসন্দেহে সহিংস।
কয়েক মাস পর কানাডার আরেকটি ফেডারেল আদালত বিএনপিকে সন্ত্রাসী সংগঠন বলে অভিহিত করে। আর বাংলাদেশে দীর্ঘমেয়াদী হরতাল কার্যকর এবং সহিংসতা ও ভাংচুরের ঘটনায় দলের ভূমিকার জন্য ১২ মে বিএনপি নেতার কানাডায় আশ্রয় প্রার্থনা প্রত্যাখ্যান করে তার বিচারিক পর্যালোচনা করার কথা বলেন ফেডারেল কোর্টের বিচারক ফোথারগিল। আদালত পূর্ববর্তী অভিবাসন কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তকে সমর্থন করে বিচারপতি বলেন, যে পিটিশনকারী যে রাজনৈতিক দলের সদস্য তারা সন্ত্রাসী কর্মকা-ে জড়িত ছিলো, জড়িত আছে বা ভবিষ্যতেও জড়িত থাকবে। বিচারপতি বলেন, বিএনপি’র হরতাল এবং এর প্রভাব বিশ্লেষণ করলেই দেখা যায় যে, অভিবাসন কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তে কোন ভুল ছিলোনা এবং ওই কমিটির সিদ্ধান্তও যথার্থ। বিচারক আরো বলেন, বিএনপির ধারাবাহিক হরতাল এবং ওই সময় সহিংসতার ফলে কানাডার অভিবাসন বিষয়ক কর্মকর্তাকে এই উপসংহারে পৌঁছতে সাহায্য করেছে যে, বিএনপি একটি সন্ত্রাসী সংগঠন। বিচারপতি ফোথারগিল শুধু জুডিশিয়াল রিভিউ আবেদন খারিজই করেননি বরং রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিলের জন্য এসএ পিটিশনের আবেদনও খারিজ করে দেন।
Comments