"সপ্তম নৌবহরের যাত্রায় চাঞ্চল্য
ভারত মহাসাগরের দিকে যুক্তরাষ্ট্রের সপ্তম নৌবহর রওনা হওয়ার খবর জানাজানি হলে দিল্লি ও মুজিবনগরের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক মহলেও ব্যাপক চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে। সায়গন থেকে নিউইয়র্ক টাইমসের সংবাদদাতা ১৩ ডিসেম্বর জানান, সপ্তম নৌবহরের পরমাণুশক্তিচালিত বিমানবাহী জাহাজ এন্টারপ্রাইজ আরও কয়েকটি জাহাজ, ডেস্ট্রয়ারসহ ১০ ডিসেম্বর সায়গনের দরিয়া থেকে ভারত মহাসাগরের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেছে।
হংকং উপসাগরে এন্টারপ্রাইজের সঙ্গে কর্তব্যরত বিমানবাহী জাহাজ কন্সটেলেশনের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, বঙ্গোপসাগরে যাওয়ার চূড়ান্ত নির্দেশ না পাওয়া পর্যন্ত এন্টারপ্রাইজ এবং তার সহযোগী সব জাহাজকে সিঙ্গাপুরের কাছে মালাক্কা প্রণালিতে গিয়ে অপেক্ষা করতে বলা হয়েছে। এন্টারপ্রাইজ যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় বিমানবাহী জাহাজ।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষামন্ত্রী মেলভিন লেয়ার্ড ওয়াশিংটনে সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ঢাকা থেকে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের অপসারণের ব্যাপারে তাঁর দেশের পরিকল্পনা রয়েছে। এন্টারপ্রাইজের ভারত মহাসাগরের দিকে যাত্রা শুরু করার খবরটি নিয়ে তিনি কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকার করেন।
দিল্লিতে ভারত সরকারের একজন মুখপাত্র জানান, বঙ্গোপসাগরে সপ্তম নৌবহরের উপস্থিতি সম্পর্কে তিনি কিছুই জানেন না। ঢাকায় আটকে পড়া কয়েক শ নাগরিককে উদ্ধার করার জন্য এই শক্তি প্রদর্শন অপ্রয়োজনীয়। সপ্তম নৌবহর যাত্রা করে থাকলে মনস্তাত্ত্বিক চাপ সৃষ্টির জন্যই তা করা হচ্ছে।
পাল্টা সোভিয়েত যুদ্ধজাহাজ
নিউইয়র্ক টাইমস ওই খবরে ওয়াশিংটনের একটি খবর উদ্ধৃত করে আরও বলে, সোভিয়েত ইউনিয়নও ভারত মহাসাগরে তার নৌশক্তি জোরদার করেছে বলে জানা গেছে।
যুক্তরাজ্যের দ্য টেলিগ্রাফ পত্রিকার সংবাদদাতা জানান, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের একজন মুখপাত্র বলেছেন, ভারত মহাসাগরে একটি রাশিয়ান নৌবহর সমবেত হয়েছে। প্রায় এক ডজন যুদ্ধজাহাজ এবং আণবিক শক্তিচালিত ১০টি সাবমেরিন এ নৌবহরের অন্তর্ভুক্ত বলে ধারণা করা যাচ্ছে।
আবার সোভিয়েত ভেটো
জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে দিনের শেষে ভারত-পাকিস্তানের সংঘর্ষ নিয়ে বিতর্ক শুরু হওয়ার কথা থাকলেও রাতে সেই বিতর্ক শুরু এবং এদিন আরেকটি মার্কিন প্রস্তাবের সমাধি ঘটে। ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধবিরতির জন্য প্রস্তাবটি আনা হয়। সোভিয়েত ইউনিয়নের ভেটোয় প্রস্তাবটি বাতিল হয়ে যায়।
ভেটো প্রয়োগের আগে সোভিয়েত প্রতিনিধি ইয়াকব মালিক বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাব গ্রহণযোগ্য নয়। বিতর্ক শুরু হওয়ার পরপরই ইয়াকব মালিক বাংলাদেশ প্রতিনিধিকে আমন্ত্রণ জানাতে নিরাপত্তা পরিষদকে আহ্বান জানান। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিংও একই অনুরোধ করেন। এতে আপত্তি জানিয়ে আর্জেন্টিনার প্রতিনিধি বলেন, এ ধরনের কাজে বিপজ্জনক নজির সৃষ্টি হবে এবং বিচ্ছিন্নতাকে উৎসাহ দেওয়া হবে। এরপর ইয়াকব মালিকের অনুরোধ নাকচ করে দেন নিরাপত্তা পরিষদের সভাপতি।
নিউইয়র্ক টাইমস ওয়াশিংটন থেকে আরেক খবরে জানায়, প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন ও তাঁর প্রধান উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জার পাকিস্তানের সাহায্যার্থে যুক্তরাষ্ট্রের সমরাস্ত্র পাকিস্তানে পাঠানোর অনুমতি তৃতীয় দেশকে দিতে পারেন।
খবরে বলা হয়, পাকিস্তান সম্প্রতি ইরান, তুরস্ক, জর্ডান, সৌদি আরব ও লিবিয়ার কাছ থেকে অবিলম্বে অস্ত্রাদি চেয়েছে। প্রথম চারটি দেশে বিপুল মার্কিন অস্ত্র মজুত আছে। কংগ্রেসকে না জানিয়েই প্রেসিডেন্ট এই অস্ত্র হস্তান্তর অনুমোদন করতে পারেন। পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা দপ্তরের মুখপাত্র অবশ্য এভাবে পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহের কথা অস্বীকার করেন।
যুগোস্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট মার্শাল টিটো ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের আগে নিষ্ক্রিয় থাকা এবং ভারতের সমস্যা উপলব্ধি না করায় জাতিসংঘের কঠোর সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, নিরপেক্ষ এবং অন্য দেশগুলো যুদ্ধ ঠেকানোর যথাসাধ্য চেষ্টা না করলে উপমহাদেশের ঘটনা গুরুতর পরিস্থিতি সৃষ্টি করবে।
যৌথ বাহিনী ঢাকার উপকণ্ঠে
ঢাকায় তিন দিক থেকে বেষ্টিত দখলদার পাকিস্তানি সেনারা এদিন যৌথ বাহিনীর কামানের আওতায় চলে আসে। ভারতের ছত্রী বাহিনী সুসংগঠিত। মুক্তি বাহিনী সক্রিয়। ভৈরববাজার থেকে আগুয়ান যোদ্ধারা নরসিংদী পেরিয়ে ঢাকার উপকণ্ঠে।
আরেক দল টাঙ্গাইল-মির্জাপুর হয়ে ঢাকার কাছে। তাঁরা এদিন জয়দেবপুর মুক্ত করেন। চাঁদপুরের দিক থেকে আসা যৌথ বাহিনী মেঘনা পেরিয়ে দাউদকান্দিতে। তারা শীতলক্ষ্যা নদী পেরোনোর চেষ্টা করছে। যমুনা নদীর বাধাও অতিক্রান্ত। অবরুদ্ধ ঢাকা থেকে ভয়েস অব আমেরিকার সংবাদদাতা জানান, ভারতীয় সেনারা ঢাকা থেকে মাত্র ১১ থেকে ১২ মাইল দূরে।
ইয়াহিয়ার মনোবল চাঙা করার চেষ্টা
মুজিবনগরে একটি সূত্র এদিন জানায়, বাংলাদেশে পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাদের পরাজয় সুনিশ্চিত বুঝতে পেরে রিচার্ড নিক্সন সপ্তম নৌবহরকে আদেশ দিয়েছেন, তাদের একাংশ যেন এখনই বঙ্গোপসাগরে চলে যায়। ওয়াশিংটন মস্কোকে আশ্বাস দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধে হস্তক্ষেপ করতে চায় না। তবে এটাও চায় না যে পাকিস্তান ভেঙে পড়ুক।
এদিন বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভার এক জরুরি বৈঠকে শত্রুমুক্ত জেলাগুলোয় অবিলম্বে বেসামরিক প্রশাসন চালু করার ব্যাপারে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম।
সূত্র: ‘স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রবাসী বাঙালী’, আবদুল মতিন, র্যাডিক্যাল পাবলিকেশনস, লন্ডন, যুক্তরাজ্য; আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ভারত, ১৪ ও ১৫ ডিসেম্বর ১৯৭১; দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফ, ১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান"
Comments