Skip to main content

বিশ্বমানবতার ইতিহাসে নজিরবিহীন ঘটনা ৩ নভেম্বরের জেল হত্যা

বিশ্বমানবতার ইতিহাসে নজিরবিহীন ঘটনা ৩ নভেম্বরের জেল হত্যা



এম. নজরুল ইসলাম:



দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল। বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসে শ্রেষ্ঠ গৌরব এই স্বাধীনতায় কিন্তু পরাজিত শক্তি থেমে থাকেনি। সদ্য স্বাধীন দেশে নানা রকম চক্রান্ত চালিয়ে যেতে থাকে। অবশেষে আসে ১৯৭৫ সাল। ১৫ই আগস্ট রাতে সেনাবাহিনীর একটি অংশের সহায়তায় কিছু ‘বিপথগামী’ সেনা সদস্যকে দিয়ে সপরিবারে হত্যা করা হয় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। এরই ধারাবাহিকতায় ৩ নভেম্বর মধ্যরাতে সেই সেনা সদস্যরা ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ঢুকে নির্মমভাবে হত্যা করে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী জাতীয় চার নেতাকে। আজ আমরা পরম শ্রদ্ধায় স্মরণ করি সেই চার জাতীয় নেতা স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী ও এ এইচ এম কামরুজ্জামানকে।


একাত্তরের পরাজয় মেনে নেয়নি এবং নিজেদের অবস্থান থেকেও সরে আসেনি যে শক্তি তারাই পরবর্তীকালে সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করে এবং নানা রকম ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা এবং কারাগারে জাতীয় চার নেতাকে হত্যা ছিল সেই ষড়যন্ত্রেরই অংশ। এই হত্যাকাণ্ড শুধু বাংলাদেশের ইতিহাসে নয়, বিশ্বমানবতার ইতিহাসেও এক কলঙ্কজনক অধ্যায়। কারাগারের নিরাপত্তানীতি ভেঙে রাতের অন্ধকারে এভাবে জাতীয় নেতাকে হত্যার ঘটনা বিশ্বে বিরল।


দুঃখের বিষয়, জেলহত্যার পর দীর্ঘদিন ক্ষমতা দখলে রেখেছিল খুনিদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক পক্ষ। তারা ধামাচাপা দিয়ে রেখেছিল হত্যা মামলার বিচার। সুপরিকল্পিতভাবে অনেক আলামত নষ্ট করা হয়েছিল। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়ে সরকার গঠনের পর মামলার প্রক্রিয়া আবার চালু করা হয়। ২০০৪ সালের ২০ অক্টোবর নিম্ন আদালত থেকে মামলার রায় পাওয়া যায়। রায়ে তিনজনের মৃত্যুদণ্ডসহ ১৫ জনের সাজা হয়। এরপর মামলা যায় হাইকোর্টে, পাওয়া যায় হাইকোর্টের রায়; যদিও সাজাপ্রাপ্তদের অনেকেই এখনো পলাতক কিংবা বিদেশে অবস্থান করছেন।


প্রকাশিত বিভিন্ন তথ্য থেকে জানা যায়, ৩ নভেম্বর ভোর ৪টার সময় বঙ্গভবনে ডিআইজি প্রিজন থেকে একটি ফোন আসে। ফোনটি রশিদ রিসিভ করেন এবং একপর্যায়ে তা খোন্দকার মোশতাকের হাতে দেন। মোশতাক ফোনে শুধু ‘হ্যাঁ’ ‘হ্যাঁ’ বলতে থাকেন। এসব কথা রশিদ মাসকারেনহাসকে একটি সাক্ষাৎকারে বললেও তিনি ঘটনার অর্ধেকটা বলেছিলেন। বাস্তবে দুই মাস আগে ফারুক আর রশিদ ষড়যন্ত্র করেন যে কোনো কারণে মোশতাক নিহত হলে অথবা কোনো ধরনের পাল্টা ক্যু সংঘটিত হলে তাঁরা কারাগারে বন্দি আওয়ামী লীগের চারজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা- সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ও কামরুজ্জামানকে খতম করে দেবেন। এর ফলে আওয়ামী লীগ আর কখনো ক্ষমতায় ফিরতে পারবে না। বঙ্গভবনে যখন ডিআইজি প্রিজন ফোন করেছিলেন তখন রিসালদার মুসলেহউদ্দিন কারাগারে হাজির হয়েছিল একদল ঘাতক নিয়ে এই চার জাতীয় নেতাকে হত্যা করতে। কারাগারে যেকোনো সময় অস্ত্র নিয়ে প্রবেশ নিষিদ্ধ। তারা কারা কর্তৃপক্ষকে বলেছিল, তাদের কাছে রাষ্ট্রপতির অনুমতি আছে। ডিআইজি প্রিজন এ ব্যাপারে রাষ্ট্রপতির বক্তব্য শুনতে ফোন করেছিলেন। ৩ তারিখ ভোরে ঘাতকরা কারাগারে নিরাপত্তা হেফাজতে রক্ষিত চার জাতীয় নেতাকে নির্মমভাবে ব্রাশ ফায়ার করে হত্যা করে।


আবদুল গাফফার চৌধুরী এক নিবন্ধে লিখেছেন, ‘ধরে নিলাম বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছিল ক্ষমতা থেকে উচ্ছেদ করার জন্য। ধরে নিলাম সৈয়দ নজরুল ইসলাম, কামরুজ্জামান ও মনসুর আলীকে হত্যা করা হয়েছিল তাঁরা বঙ্গবন্ধু সরকারের মন্ত্রী ছিলেন বলে। কিন্তু তাজউদ্দীন আহমদকে তাঁর বাসা থেকে ধরে নিয়ে জেলে পুরে হত্যা করা হলো কেন? তিনি তো তখন আর মন্ত্রী ছিলেন না। এমনকি বঙ্গবন্ধুর নবগঠিত বাকশালের সাধারণ সম্পাদকের পদ গ্রহণ করেননি।’ আবদুল গাফফার চৌধুরী বলছেন, এই হত্যাকাণ্ডের ‘উদ্দেশ্যটি হলো, গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের অভ্যুদয় রোখা এবং তার রাজনৈতিক সংস্কৃতির সেক্যুলার ভিত্তিকে ধ্বংস করে দেওয়া।, ইউজিসির সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল মান্নান এক নিবন্ধে লিখেছেন, ‘জেলে আওয়ামী লীগের অনেক নেতা বন্দি থাকলেও বঙ্গবন্ধুহীন দলের নেতৃত্ব দিতে পারতেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ও কামরুজ্জামান। বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিতে পারলে বঙ্গবন্ধুহীন আওয়ামী লীগকেও আবার ক্ষমতায় আনতে পারেন তাঁরা। সে চিন্তাতেই খুনিরা ৩ নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ঢুকে জাতীয় চার নেতাকে নিমর্মভাবে হত্যা করে, যা ছিল বিশ্বের ইতিহাসে একটি নজিরবিহীন ঘটনা। এ হত্যাকাণ্ডের উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশ থেকে আওয়ামী লীগ নামক রাজনৈতিক দলটিকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া। তারা ধরে নিয়েছিল, দেশে আওয়ামী লীগ না থাকলে বাংলাদেশকে আবার পাকিস্তানে রূপান্তর করা সহজ হবে। ঘাতকরা একটি আদর্শকে হত্যা করতে চেয়েছিল।’ ‘১৫ আগস্ট ও ৩ নভেম্বরের হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে স্বাধীনতার শত্রুরা বাংলাদেশ ও আওয়ামী লীগকে ধ্বংস করতে চেয়েছিল।’ অধ্যাপক আবদুল মান্নানের এই বক্তব্যের সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত পোষণ করে বলতে চাই, জনমানুষের সমর্থনে আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় এসেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আজ বিশ্বে উন্নয়নের রোল মডেল। করোনা মহামারির মধ্যেও দেশে প্রবাসী আয়ের রেকর্ড হয়েছে। করোনা মহামারির ধাক্কা কাটিয়ে সামষ্টিক অর্থনীতির সূচকগুলোতে উন্নতি করে প্রবৃদ্ধিতে পেছনে ফেলছে প্রতিবেশী দেশগুলোকে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বলছে, মহামারির মধ্যেই চলতি অর্থবছরে মাথাপিছু জিডিপিতে ভারতকে ছাড়িয়ে যাবে বাংলাদেশ। শুধু ভারতই নয়, চলতি অর্থবছরে মাথাপিছু জিডিপির হিসাবে দক্ষিণ এশিয়ায় শীর্ষ এবং এশিয়ার মধ্যে চতুর্থ হতে চলেছে বাংলাদেশ। এসবকিছুই ঘটেছে নতুন বাংলাদেশের রূপকার বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বগুণে। তাঁর নেতৃত্বেই বাংলাদেশ আবার উদারনৈতিক ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শের ভিত্তিতে সমৃদ্ধশালী হবে, আমরা আশাবাদী।


লেখক: সর্ব ইউরোপিয়ান আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং অস্ট্রিয়া প্রবাসী মানবাধিকার কর্মী, লেখক ও সাংবাদিক


Comments

Popular posts from this blog

Ahmedabad Satyagraha in Gujarat (1918)

Ahmedabad Satyagraha in Gujarat (1918) Introduction The Ahmedabad Satyagraha of 1918 marks a significant chapter in India's struggle for independence. It was a labor strike initiated by the mill workers in Ahmedabad, Gujarat, demanding an increase in wages. The strike was not just a protest against economic injustice, but it also symbolized the fight against oppressive colonial rule. The term 'Satyagraha' was coined by Mahatma Gandhi, which translates to 'insistence on truth' or 'soul force'. It was a method of non-violent resistance, and the Ahmedabad Satyagraha was one of the early instances where this method was employed in the Indian independence movement. The Satyagraha in Ahmedabad was a turning point as it marked the beginning of Gandhi's active involvement in Indian politics. It was here that Gandhi first introduced his methodology of peaceful resistance and negotiation as a means to achieve political and social change. The event holds histori...

অধ্যায় 2: বাংলায় ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন

বাংলায় ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন বাংলায় ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন সুচিপত্র ভূমিকা পলাশীর যুদ্ধ (১৭৫৭) ব্রিটিশ শাসনের প্রাথমিক বছরগুলি (1757-1857) 1857 সালের বিদ্রোহ এবং এর প্রভাব প্রয়াত ঔপনিবেশিক সময়কাল (1858-1947) বঙ্গভঙ্গ (1905) ব্রিটিশ শাসনের অবসান এবং ভারত বিভাজন (1947) উপসংহার বাংলায় ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন (1757-1947) পরিচয় বাংলায় ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন 1757 থেকে 1947 সাল পর্যন্ত প্রায় দুই শতাব্দী বিস্তৃত ছিল। এই সময়কালে উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক পরিবর্তন দেখা যায় যা এই অঞ্চলে স্থায়ী প্রভাব ফেলে। বাংলার ইতিহাসের জটিলতা এবং ঔপনিবেশিকতার বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে এর স্থানকে উপলব্ধি করার জন্য এই ঐতিহাসিক যুগকে বোঝা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ৷ ...

ভাড়াটিয়া-ভাড়াদার আইনের জটিলতা পার হওয়া: ভাড়াটিয়াদের জন্য একটি গাইড

ভাড়াটিয়া-ভাড়াদার আইনের জটিলতা পার হওয়া: ভাড়াটিয়াদের জন্য একটি গাইড ভাড়াটিয়া-ভাড়াদার আইনের জটিলতা পার হওয়া: ভাড়াটিয়াদের জন্য একটি গাইড সূচিপত্র ভূমিকা অধ্যায় 1: ভাড়াটিয়া হিসেবে আপনার অধিকার ও দায়িত্ব বুঝুন অধ্যায় 2: বহিষ্করণ ও ভাড়াদারি শেষ অধ্যায় 3: ভাড়া ও নিরাপত্তা জমা অধ্যায় 4: রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামত অধ্যায় 5: আফজাল অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস কীভাবে ভাড়াটিয়া পরামর্শ দিতে পারে উপসংহার অতিরিক্ত সংস্থান যোগাযোগের তথ্য ভূমিকা ভাড়াটিয়া-ভাড়াদার আইন বুঝতে ভাড়াটিয়াদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই সম্পূর্ণ গাইডের উদ্দেশ্য হচ্ছে ভাড়াটিয়াদের তাদের সম্পত্তি পরিচালনা করার জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য প্রদান করা। আপনি একজন অভিজ্ঞ ভাড়াটিয়া হোক বা শুরু করছেন, এই নিবন্ধটি আপনাকে আপনার অধিকার ও দায়িত্ব, বহিষ্করণ প্রক্রিয়া, ভাড়া ও নিরাপত্তা জমা, রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামত, এবং আফজাল অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস কীভাবে বিশেষজ্ঞ আইনি পরামর্শ দিতে পারে তা ব...