Skip to main content

জুলিও কুরি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব

জুলিও কুরি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব



সুভাষ সিংহ রায়ঃ


আজ ২৩ মে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জুলিও কুরি শান্তি পদক প্রাপ্তির ৪৮তম বার্ষিকী । ১৯৭৩ সালের এই দিনে বিশ্ব শান্তি পরিষদ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বিশ্ব শান্তিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখার জন্যে ‘জুলিও কুরিও’ পদক প্রদান করে। আশির দশকের শুরুতেই ছাত্র রাজনীতির একজন কর্মী হিসেবে শ্লোগান দিতাম, ‘জুলিও কুরি শেখ মুজিব শেখ মুজিব লও লও , লও সালাম’ ; ‘শান্তির দূত শেখ মুজিব লও লও , লও সালাম।’ তখনও বঙ্গবন্ধুকে অতটা জানতে বুঝতে শিখিনি । পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধুকে বেশি করে জেনেছি বুঝেছি। মুক্তিযুদ্ধের কালপর্বে ভারত-সোভিয়েত শান্তি, মৈত্রী ও সহযোগিতা-চুক্তি ১৯৭১ এবং বাংলাদেশ-ভারত শান্তি, মৈত্রী ও সহযোগিতা-চুক্তি ১৯৭২, বাংলাদেশের মৈত্রী-সম্পর্কে এই উপমহাদেশে উত্তেজনা প্রশমন ও শান্তি স্থাপনের ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করেন বঙ্গবন্ধু। স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর জাতির স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ফ্যাসিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ পরিহার করে বন্ধুত্বের ভিত্তিতে দেশ পরিচালনা করে বিশ্বের সুনাম অর্জন করেন। আর বিশ্ব মানবতায় অবদান রাখার কারণে বিশ্ব শান্তি পরিষদ বঙ্গবন্ধুকে ‘জুলিও কুরি’ পদকে ভূষিত করে। বিশ্বশান্তি পরিষদের এ পদক ছিল জাতির পিতার কর্মের স্বীকৃতি এবং বাংলাদেশের জন্য প্রথম আন্তর্জাতিক সম্মান। ১৯৭৩ সালের ২৩ মে থেকে তিন দিনব্যাপী এশিয়া শান্তি সম্মেলন হয়েছিল । ঢাকার শেরেবাংলা নগরে ওইদিন সকাল সাড়ে ৯টায় এই সম্মেলনের উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বিশ্ব শান্তি পরিষদ এই সম্মেলনের আয়োজন করেছিল।


সম্মেলনের উদ্বোধনী অধিবেশনে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে জুলিও কুরি শান্তি পদকে ভূষিত করা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু এশিয়ার দ্বিতীয় ব্যক্তি, যিনি এই পদকের অধিকারী হলেন। এর আগে ভারতের নেহেরু আন্তর্জাতিক এই শান্তি পদক লাভ করেছিলেন ।বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী ম্যারি কুরি ও পিয়েরে কুরি দম্পতি বিশ্ব শান্তির সংগ্রামে যে অবদান রেখেছেন, তা স্মরণীয় করে রাখতে বিশ্ব শান্তি পরিষদ ১৯৫০ সাল থেকে ফ্যাসিবাদবিরোধী, সম্রাজ্জবিরধী সংগ্রামে, মানবতার কল্যাণে, শান্তির সপক্ষে বিশেষ অবদানের জন্য বরণীয় ব্যক্তি ও সংগঠনকে ‘জুলিও কুরি’ শান্তি পদকে ভূষিত করে আসছে।


সেই পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৭২ সালের ১০ অক্টোবর চিলির রাজধানী সান্তিয়াগোতে বিশ্ব শান্তি পরিষদের প্রেসিডেন্সিয়াল কমিটির সভায় বাঙালি জাতির মুক্তি আন্দোলন এবং বিশ্ব শান্তির সপক্ষে বঙ্গবন্ধুর অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ‘জুলিও কুরি’ শান্তি পদক প্রদানের জন্য শান্তি পরিষদের মহাসচিব রমেশ চন্দ্র প্রস্তাব উপস্থাপন করেন। পৃথিবীর ১৪০টি দেশের শান্তি পরিষদের ২০০ প্রতিনিধির উপস্থিতিতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে ‘জুলিও কুরি’ শান্তি পদক প্রদানের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। অধিবেশনের দ্বিতীয় দিন ২৩ মে ( ১৯৭৩ সাল ) বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের উত্তর প্লাজায় উন্মুক্ত চত্বরে সুসজ্জিত প্যান্ডেলে বিশ্ব শান্তি পরিষদ আয়োজিত অনুষ্ঠানে আন্তর্জাতিক কূটনীতিকদের বিশাল সমাবেশে বিশ্ব শান্তি পরিষদের তৎকালীন মহাসচিব রমেশ চন্দ্র বঙ্গবন্ধুকে ‘জুলিও কুরি’ শান্তি পদক প্রদান করেন। এরপর তিনি বলেন, ‘শেখ মুজিব শুধু বঙ্গবন্ধু নন, আজ থেকে তিনি বিশ্ববন্ধুও বটে।’


১৯৭৩ সালের ৫ থেকে ৯ সেপ্টেম্বর আলজেরিয়ার রাজধানী আলজিয়ার্সে অনুষ্ঠিত হয় জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের (ন্যাম) চতুর্থ শীর্ষ সম্মেলন। যাতে প্রথমবারের মতো যোগ দিয়ে ক্ষুধা ও দারিদ্রমুক্ত বিশ^ প্রতিষ্ঠার আহŸান জানিয়ে বিশ্ব নেতাদের নজর কাড়েন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ওই সম্মেলনে প্রথম বর্ণানুক্রমিকভাবে ভাষণ দেওয়ার কথা ছিল। সে হিসেবে কথা বলার ছিলো আফগানিস্তানের প্রতিনিধির। কিন্তু তিনি বলেন, আমরা বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতা শুনতে চাই। এরপর বঙ্গবন্ধু বক্তৃতা করেন। যা শুনে ফিদেল কাস্ট্রো ছুটে এসে বঙ্গবন্ধুকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলেন তাঁর অমর বাণী, ‘আমি হিমালয় দেখিনি, আপনাকে দেখেছি। আমার আর হিমালয় দেখার দরকার নেই।’ সৌদি আরবের কিং ফয়সাল যিনি মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানকে সমর্থন দিয়েছিলেন। তিনি বঙ্গবন্ধুর কাছে এসে বারবার বলেন, ‘আমি লজ্জিত, আমি লজ্জিত’।


(২)
যারা বঙ্গবন্ধুর ‘ আমার দেখা নয়াচীন ’ পাঠ করেছেন তারা খুব ভাল করেই জানেন বঙ্গবন্ধু বিশ্ব শান্তির জন্যে কি ব্যাকুলই না ছিলেন । আমরা জানি , ১৯৫২ সালের চীন ভ্রমণের এ কাহিনি তিনি রচনা করেছিলেন ১৯৫৪ সালে যখন কারাগারে। তাঁর লেখা খাতাখানার ওপর গোয়েন্দা সংস্থার সেন্সর ও কারাগার কর্তৃপক্ষের যে সিল দেওয়া আছে তা থেকেই সময়কালটা জানা যায়।৬৯ পৃষ্ঠায় আমরা দেখবো চীনের সাংহাই শহরে ভারতের ডেলিগেট মি : ফরিদী’র সাথে বঙ্গবন্ধু’র ঘনিষ্টতার বর্ণনা পেয়েছি। সেখানে মি. ফরিদীকে আওয়ামী লীগের অফিসের ঠিকানা দিয়েছিলেন । “ হঠাৎ সেপ্টেম্বর মাসে আমন্ত্রণ এলো পিকিং-এ শান্তি সম্মেলনে যোগদান করতে হবে। তথাপি দুনিয়ায় আজ যারাই শান্তি চায় তাদের শান্তি সম্মেলনে আমরা যোগদান করতে রাজি। রাশিয়া হউক, আমেরিকা হউক, ব্রিটেন হউক, চীন হউক যে-ই শান্তির জন্য সংগ্রাম করবে তাদের সাথে আমরা সহস্র কণ্ঠে আওয়াজ তুলতে রাজি আছি, ‘আমরা শান্তি চাই’। কারণ যুদ্ধে দুনিয়ার যে ক্ষতি হয় তা আমরা জানি ও উপলব্ধি করতে পারি; বিশেষ করে আমার দেশে যে- দেশকে পরের দিকে চেয়ে থাকতে হয়, কাঁচামাল চালান দিতে হয়। যে দেশের মানুষ না খেয়ে মরে, সামান্য দরকারি জিনিস জোগাড় করতে যাদের জীবন অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে, সে দেশে যুদ্ধে যে কতখানি ক্ষতি হয় তা ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষের কথা মনে করলেই বুঝতে পারবেন। কোথায় ইংরেজ যুদ্ধ করছে, আর তার জন্য আমার দেশের ৪০ লক্ষ লোক শৃগাল কুকুরের মতো না খেয়ে মরেছে। তাদের পাট, চা, তুলা অন্যান্য জিনিস বিদেশে বিক্রি না করলে দেশের জনগণের কষ্টের সীমা থাকবে না। দুর্ভিক্ষ মহামারি সমস্ত দেশকে গ্রাস করবে। তাই মানুষের মঙ্গলের জন্য, পাকিস্তানের স্বার্থের জন্য-যুদ্ধ চাই না, শান্তি চাই। ঠিক করলাম শান্তি সম্মেলনে যোগদান করতে হবে। আমাদের পূর্ব বাংলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি, জনাব আতাউর রহমান খান, ইত্তেফাক সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন, যাকে আমরা সকলে ‘মানিক ভাই’ বলি, বন্ধুবর খোন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস আর ইউসুফ হাসান এবং আমি, এই পাঁচজন যাবো ঠিক হলো। ” আমরা ইতিহাস পাঠ থেকে জেনে থাকবো তারও ২০ বছর পরে ফেব্রুয়ারি ১৯৭২ সালে কলকাতায় তাঁর সম্মানে প্রদত্ত নাগরিক সংবর্ধনায় তিনি পাকিস্তানের প্রতি দৃষ্টি রেখে বলেছিলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি না প্রতিশোধ গ্রহণে কোনো মহৎ কর্তব্য পালন করা যায়।’ ৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২ সালের সন্ধ্যায় কলকাতার রাজভবনে তাঁর সম্মানে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী প্রদত্ত ভোজসভায় তিনি একটি ঐতিহাসিক উক্তি করেছিলেন।


তিনি বলেছিলেন, ‘আমার একান্ত কামনা, উপমহাদেশে অবশেষে শান্তি ও সুস্থিরতা আসবে। প্রতিবেশীদের মধ্যে পারস্পরিক বিরোধিতার বন্ধ্যা নীতির অবসান হোক। আমাদের জাতীয় সম্পদের অপচয় না করে আমরা যেন তা আমাদের দেশের মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে ব্যবহার করি। দক্ষিণ এশিয়াকে একটি শান্তিপূর্ণ অঞ্চলে পরিণত করায় আমরা সচেষ্ট রইব, যেখানে আমরা সুপ্রতিবেশী হিসেবে পাশাপাশি বাস করতে পারি এবং যেখানে আমাদের মানুষের মঙ্গলার্থে আমরা গঠনমূলক নীতিমালা অনুসরণ করতে পারি। যদি আমরা সেই দায়িত্বে ব্যর্থ হই, ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে না।’


উপমহাদেশের উত্তেজনাময় পরিস্থিতিতে, যখন রণাঙ্গন থেকে রক্তের দাগও মুছে যায়নি, আঞ্চলিক সহযোগিতা বিকাশের এই উদাত্ত আহ্বান, যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের একজন রাষ্ট্রনায়কের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা আর পরিপক্কতার পরিচায়ক। দেশে বঙ্গবন্ধু করেছিলেন এঁকই কথার পুনরাবৃত্তি। ১৯৭৪ সালের মার্চের ৪ তারিখে তিনি কুমিল্লার দাউদকান্দিতে এক জনসভায় বলেছিলেন, ‘এই উপমহাদেশে আমরা বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, নেপাল আর শ্রীলঙ্কা মিলে শান্তিতে বসবাস করতে চাই। আমরা কারও সঙ্গে বিবাদ চাই না। আমরা স্বাধীন এবং সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে, আত্মমর্যাদার সঙ্গে একে অন্যের সঙ্গে ভ্রাতৃত্বপূর্ণ মনোভাব নিয়ে বাস করতে চাই। আমি চাই না যে আমাদের বিষয়াদিতে কেউ হস্তক্ষেপ করুক। আমরাও অন্যের বিষয়াদিতে হস্তক্ষেপ করতে আগ্রহী নই।’


(৩)
বঙ্গবন্ধু সরকার কর্তৃক জোট নিরপেক্ষ নীতি অনুসরণ এবং শান্তি ও ন্যায়ের পক্ষে অবস্থান গ্রহণের নীতির ফলে বাংলাদেশ বিশ্ব সভায় একটি ন্যায়ানুগ দেশের মর্যাদা লাভ করে। সবার প্রতি বন্ধুত্বের ভিত্তিতে বৈদেশিক নীতি ঘোষণা করে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, ‘পৃথিবীর বৃহত্তম শক্তি যে অর্থ ব্যয় করে মানুষ মারার অস্ত্র তৈরি করছে, সেই অর্থ গরিব দেশগুলোকে সাহায্য দিলে পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠা হতে পারে।’বঙ্গবন্ধুর সৃজনশীল কূটনৈতিক দক্ষতায় ১৯৭৪ সালে ১৭ সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্য পদ লাভ করে। এবং ২৭ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংঘের ২৯ তম অধিবেশনে বাংলায় ভাষণ দেন। সেখানে তিনি বিশ্ব শান্তির কথা স্পষ্ট করে বলেছিলেন। “আমাদেরকে সক্ষম করিয়া তুলিবে এবং সক্ষম করিয়া তুলিবে দারিদ্র্য, ক্ষুধা, রোগ, অশিক্ষা ও বেকারির বিরুদ্ধে লড়াই করিবার জন্য আমাদের সকল শক্তি ও সম্পদকে সমাবেশ ও কেন্দ্রীভূত করিতে। এই ধারণা হইতে জন্ম নিয়াছে শান্তির প্রতি আমাদের প্রতিশ্রুতি। এই জন্য সমঝোতার অগ্রগতি, উত্তেজনা প্রশমন, অস্ত্র সীমিতকরণ এবং শান্তিপূর্ণসহ অবস্থান নীতির সম্প্রসারণের লক্ষ্যে এশিয়া, আফ্রিকা, ইউরোপ, ল্যাটিন আমেরিকা-বিশ্বের যে কোনো অংশে যে কোনো প্রচেষ্টা গ্রহণ করা হউক না কেন, আমরা তাহাকে স্বাগত জানাই। এই নীতির প্রতি অবিচল থাকিয়া আমরা ভারত মহাসাগরীয় এলাকা সম্পর্কে শান্তি এলাকার ধারণা, যাহা এই পরিষদ অনুমোদন করিয়াছে, তাহাকে সমর্থন করি।”


চুয়াত্তর-এ সদস্যপদ প্রাপ্তির ঠিক এক সপ্তাহ পর ২৫ সেপ্টেম্বর সাধারণ পরিষদে ভাষণ দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান; যা বাংলায় ছিল। ৪৭ বছর আগের সেই ভাষণে বিশ^কে মানবিক ঐক্যবোধ ও ভ্রাতৃত্ববোধের পুনর্জাগরণে পারস্পরিক নির্ভরশীলতার স্বীকৃতি প্রদান করে মানব সভ্যতাকে বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষার যুক্তিপূর্ণ সমাধান ও জরুরি কর্মসূচি গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছিলেন জাতির জনক। তার ভাষায়, (কোট): ‘শান্তির প্রতি যে আমাদের পূর্ণ আনুগত্য, তা এই উপলব্ধি থেকে জন্মেছে যে, একমাত্র শান্তিপূর্ণ পরিবেশেই আমরা ক্ষুধা, দারিদ্র্য, রোগ-শোক, অশিক্ষা ও বেকারত্বের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার জন্য আমাদের সকল সম্পদ ও শক্তি নিয়োগ করতে সক্ষম হব।’


বঙ্গবন্ধুর জেল খানায় বসে লেখা খাতাগুলো থেকে আমরা তিনটা বই পেয়েছি । ‘ অসমাপ্ত আত্মজীবনী ’ , ‘কারাগারের রোজনামচা’ ও ‘ আমার দেখা নয়াচীন ” এই তিনটে বই থেকে আমরা কিছু জানতে পেরেছি। ‘কারাগারের রোজনামচা ’ থেকে জানতে পারি বিশ্ব রাজনীতি ও তার সাথে বাঙালির নেতা বঙ্গবন্ধুর চিন্তাভাবনা কতটা গভীরে বিস্তৃত ছিল।


বঙ্গবন্ধুর নিজের লেখা থেকেই জানতে পারি পরবর্তীতে দ্বিতীয়বার চীন সফরের অভিজ্ঞতার কথা । “ ১৯৫৭ সালে আমি পাকিস্তান পার্লামেন্টারি ডেলিগেশনের নেতা হিসেবে চীন দেশে যাই। আপনি, আপনার সরকার ও জনগণ আমাকে ও আমার দলের সদস্যদের যথেষ্ট আদর আপ্যায়ন করেছেন এবং আমাকে আপনাদের পার্লামেন্টে বক্তৃতা দিতে দিয়ে যে সম্মান দিয়েছিলেন তা আজও আমি ভুলি নাই। আমি আপনাদের উন্নতি কামনা করি। নিজের দেশে যে নীতি আপনারা গ্রহণ করেছেন আশা করি অন্য দেশে অন্য নীতি গ্রহণ করবেন না। আপনারা সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করেন আর আমার দেশে চলেছে ধনতন্ত্রবাদ, আর ধনতন্ত্রবাদের মুখপাত্রকে আপনারা দিতেছেন সার্টিফিকেট। আপনারা আমেরিকান সরকারের মতো নীতি বর্হিভূত কাজকে প্রশ্রয় দিতেছেন। দুনিয়ার শোষিত জনসাধারণ আপনাদের কাছ থেকে অনেক কিছু আশা করেছিলেন। যেমন আমেরিকানরা নিজের দেশে গণতন্ত্রে বিশ্বাস করেন, আর অন্যের দেশে নিজেদের স্বার্থ রক্ষার জন্য গণতন্ত্রকে হত্যা করে ডিক্টেটর বসাইয়া দেয়।” ( কারাগারের রোজনামচা ১৩৪ ও ১৩৫ পৃষ্ঠা) । বঙ্গবন্ধু জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ নেতা ছিলেন। ১৯৭৩-এর সেপ্টেম্বর মাসের ৫ তারিখ পর্যন্ত আলজেরিয়ার রাজধানী আলজিয়ার্সে জোট নিরপেক্ষ শীর্ষ সম্মেলনের চতুর্থ আসর বসেছিল। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সে সম্মেলনে যোগদান করে প্রমাণ করেছিলেন বিশ্বে তার অবস্থান। সম্মেলনের সভাপতি ও আলজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট বুমেদীন, একজন করে নেতা মঞ্চে এসে দাঁড়াবার পর প্রেসিডেন্ট বুমেদীন ক্ষুদ্র বক্তৃতায় তাদের পরিচয় প্রদান করছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে হলে উপস্থিত সমস্ত প্রতিনিধিরা করতালির মধ্য দিয়ে জানিয়েছিলেন উষ্ণ অভিনন্দন। পিএলও-প্রধান ইয়াসির আরাফাতের পরিচিতির সময় করতালি দীর্ঘস্থায়ী হয়েছিল। কিন্তু বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের পরিচিতির পর সম্মেলন কক্ষে এক অভূতপূর্ব দৃশ্যের অবতারণা হয়েছিল। সম্মেলন কক্ষের প্রতিটি মানুষ আসন ছেড়ে দাঁড়িয়ে করতালি দিয়ে চলেছিল, সে করতালি যেন আর থামবার না। তিন মিনিটের বেশি সময় ধরে এক নাগাড়ে করতালি পর প্রেসিডেন্ট বুমেদীনের ইশারায় সবাই আবার আসন গ্রহণ করেছিলেন।(তথ্যসূত্র: মুজিবের রক্ত লাল-এম আর আখতার মুকুল)


আজ বোঝা যায়, জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে আজ অবধি বাংলাদেশের যে ১ লাখ ৬৩ হাজার ৬১৬ জন সদস্য অংশ নিয়েছেন; তার বীজ বঙ্গবন্ধু ১৯৭৪ সালের বক্তৃতার মধ্যেই রোপন করেছিলেন। জাতির পিতা সেদিন শুধু বাংলাদেশ নয়, গোটা বিশ্বের সব দেশের কল্যাণের কথা তুলে ধরেছিলেন। বলেছিলেন ন্যায়সঙ্গত আন্তর্জাতিক অর্থ-ব্যবস্থার কথাও বলে। তার ধারণা ছিল, ন্যায়সঙ্গত অর্থ-ব্যবস্থা বাস্তবায়িত হলেই বিশ্বের সকল দেশের সাধারণ স্বার্থের ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক সহযোগিতার বাস্তব কাঠামো গড়ে উঠবে। বোধ করি বঙ্গবন্ধুর সেই দূরদর্শী চিন্তা চার দশক পরও বিশ্ব বাস্তবায়ন করতে পারেনি। এসব আমাদের গৌরবের কথা; যার সবই সম্ভব হয়েছে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালির জন্য। সত্যি বলতে কী, গড়পড়তা বাঙালির চেয়ে উঁচু বঙ্গবন্ধুর ভাবনাটা সাধারণ ছিল না। তিনি শুধু নিজ দেশের বাঙালি কিংবা এশিয়ার মানুষ নিয়ে ভাবতেন না; ভাবতেন সমকালীন মানবজাতির কল্যাণ নিয়ে। সেই কথা তিনি অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে বলে গেছেন। লিখেছেন, ‘একজন মানুষ হিসেবে সমগ্র মানবজাতি নিয়েই আমি ভাবি।...এই নিরন্তর সম্পৃক্তির উৎস ভালোবাসা, অক্ষয় ভালোবাসা, যে ভালোবাসা আমার রাজনীতি এবং অস্তিত্বকে অর্থবহ করে তোলে।’


১৯৭৩ সালের ২৩ মে থেকে তিন দিনব্যাপী এশিয়া শান্তি সম্মেলন হয়েছিল। ঢাকার শেরে বাংলা নগরে ওইদিন সকাল সাড়ে ৯টায় এই সম্মেলনের উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বিশ্ব শান্তি পরিষদ এই সম্মেলনের আয়োজন করেছিল। সম্মেলনের উদ্বোধনী অধিবেশনে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে জুলিও কুরি শান্তি পদকে ভূষিত করা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু এশিয়ার দ্বিতীয় ব্যক্তি, যিনি এই পদকের অধিকারী হলেন। এর আগে ভারতের নেহেরু আন্তর্জাতিক এই শান্তি পদক লাভ করেছিলেন।


লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক


সৌজন্যেঃ জাগোনিউজ২৪


Comments

Popular posts from this blog

অধ্যায় 2: বাংলায় ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন

বাংলায় ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন বাংলায় ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন সুচিপত্র ভূমিকা পলাশীর যুদ্ধ (১৭৫৭) ব্রিটিশ শাসনের প্রাথমিক বছরগুলি (1757-1857) 1857 সালের বিদ্রোহ এবং এর প্রভাব প্রয়াত ঔপনিবেশিক সময়কাল (1858-1947) বঙ্গভঙ্গ (1905) ব্রিটিশ শাসনের অবসান এবং ভারত বিভাজন (1947) উপসংহার বাংলায় ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন (1757-1947) পরিচয় বাংলায় ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন 1757 থেকে 1947 সাল পর্যন্ত প্রায় দুই শতাব্দী বিস্তৃত ছিল। এই সময়কালে উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক পরিবর্তন দেখা যায় যা এই অঞ্চলে স্থায়ী প্রভাব ফেলে। বাংলার ইতিহাসের জটিলতা এবং ঔপনিবেশিকতার বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে এর স্থানকে উপলব্ধি করার জন্য এই ঐতিহাসিক যুগকে বোঝা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ৷ ...

ভাড়াটিয়া-ভাড়াদার আইনের জটিলতা পার হওয়া: ভাড়াটিয়াদের জন্য একটি গাইড

ভাড়াটিয়া-ভাড়াদার আইনের জটিলতা পার হওয়া: ভাড়াটিয়াদের জন্য একটি গাইড ভাড়াটিয়া-ভাড়াদার আইনের জটিলতা পার হওয়া: ভাড়াটিয়াদের জন্য একটি গাইড সূচিপত্র ভূমিকা অধ্যায় 1: ভাড়াটিয়া হিসেবে আপনার অধিকার ও দায়িত্ব বুঝুন অধ্যায় 2: বহিষ্করণ ও ভাড়াদারি শেষ অধ্যায় 3: ভাড়া ও নিরাপত্তা জমা অধ্যায় 4: রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামত অধ্যায় 5: আফজাল অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস কীভাবে ভাড়াটিয়া পরামর্শ দিতে পারে উপসংহার অতিরিক্ত সংস্থান যোগাযোগের তথ্য ভূমিকা ভাড়াটিয়া-ভাড়াদার আইন বুঝতে ভাড়াটিয়াদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই সম্পূর্ণ গাইডের উদ্দেশ্য হচ্ছে ভাড়াটিয়াদের তাদের সম্পত্তি পরিচালনা করার জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য প্রদান করা। আপনি একজন অভিজ্ঞ ভাড়াটিয়া হোক বা শুরু করছেন, এই নিবন্ধটি আপনাকে আপনার অধিকার ও দায়িত্ব, বহিষ্করণ প্রক্রিয়া, ভাড়া ও নিরাপত্তা জমা, রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামত, এবং আফজাল অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস কীভাবে বিশেষজ্ঞ আইনি পরামর্শ দিতে পারে তা ব...

Ahmedabad Satyagraha in Gujarat (1918)

Ahmedabad Satyagraha in Gujarat (1918) Introduction The Ahmedabad Satyagraha of 1918 marks a significant chapter in India's struggle for independence. It was a labor strike initiated by the mill workers in Ahmedabad, Gujarat, demanding an increase in wages. The strike was not just a protest against economic injustice, but it also symbolized the fight against oppressive colonial rule. The term 'Satyagraha' was coined by Mahatma Gandhi, which translates to 'insistence on truth' or 'soul force'. It was a method of non-violent resistance, and the Ahmedabad Satyagraha was one of the early instances where this method was employed in the Indian independence movement. The Satyagraha in Ahmedabad was a turning point as it marked the beginning of Gandhi's active involvement in Indian politics. It was here that Gandhi first introduced his methodology of peaceful resistance and negotiation as a means to achieve political and social change. The event holds histori...