স্বাধীনতা সংগ্রামে আওয়ামীলীগের ভূমিকামেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি
প্রথম অধ্যায়
প্রারম্ভ
বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে ভারতীয় উপমহাদেশে জাতীয়তাবাদী চেতনার বিকাশ ঘটে এবং সামাজিক রাজনৈতিক শক্তিসমূহ নতুন আঙ্গিকে আত্মপ্রকাশ করে। ত্রিশ দশকের মধ্যভাগে সংখ্যালঘু মুসলমানরা নিখিল ভারত মুসলিম লীগের মাধ্যমে ব্রিটিশ বিরোধী রাজনীতিকে বিপুলভাবে প্রভাবান্বিত করে। ভারতীয় মুসলমানরা ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয় এবং ফলশ্রুতিতে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ১৯৪৭ সালে মুসলিম অধ্যুষিত এলাকা সমন্বয়ে পাকিস্তানের সৃষ্টি হয়। পাকিস্তান সৃষ্টির পর পূর্ব বাংলার বঞ্চিত জনগণ সীমাহীন অর্থনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্যের শিকার হওয়ার ফলে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। ক্রমশ আন্দোলন দানা বেঁধে উঠে। মুসলমান জাতীয়তাবাদের স্থলে বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনার উন্মেষ ও বিকাশ ঘটতে থাকে। সমগ্র বাঙালি জাতি পূর্ববাংলার আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে প্রবল গণআন্দোলন শুরু করে। ১৯৭১ সালে দক্ষিণ এশিয়ার রাষ্ট্রীয় কাঠামোর ভিতরে বাংলাদেশের জন্ম হয়। এবং শক্তির ভারসাম্য নতুনভাবে নির্ধারিত হয়। এভাবেই শতাব্দীর শেষার্ধে এ রাজনৈতিক নাটকের অবসান ঘটে।
পাকিস্তান সৃষ্টির পর মুহম্মদ আলী জিন্নাহর নেতৃত্বে মুসলিম লীগ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। কিন্তু সরকার পরিচালনায় ও দেশ গঠনে কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকায় মুসলিম লীগ সরকার ক্রমান্বয়ে আমলা নির্ভর হয়ে পড়ে এবং পাকিস্তানের। বিদ্যমান সমাজ শক্তিগুলোকে একীভূত করে রাষ্ট্র গঠনের দিকে ধাবিত করতে চরমভাবে ব্যর্থ হয়। স্মরণযোগ্য যে মুহম্মদ আলী জিন্নাহর আহ্বানে বাঙালি মুসলমানরা পাকিস্তান সৃষ্টিতে অংশগ্রহণ করলেও পাকিস্তান সৃষ্টির পর তাদের আশা-আকাক্ষার প্রতিফলন না ঘটায় পাকিস্তান সৃষ্টির পশ্চাতে যে দর্শন কাজ। করেছিল তার অসারতা দৃশ্যমান হয়ে উঠে। মুসলিম লীগ পরিত্যাগ করে বিভিন্ন নেতা কর্মী বিরোধী রাজনৈতিক দল গঠনে সচেষ্ট হয়। এভাবে ১৯৪৯ সালের শেষ দিকে প্রায় ২০টি বিরোধী দল আত্মপ্রকাশ করে। একমাত্র পাঞ্জাবেই ১৩টি বিরোধী রাজনৈতিক দলের আবির্ভাব হয়। ১৯৪৭ সালের জুলাই মাসে
পৃষ্ঠা-১১
হাশিম গ্রুপ সমর্থক মুসলিম লীগ কর্মীরা ঢাকায় গণ আজাদী লীগ গঠন করে। ঐ বছরেই সেপ্টেম্বর মাসে মুসলিম লীগের তরুণ প্রগতিশীল কর্মীদের প্রচেষ্টায় গণতান্ত্রিক যুবলীগ গঠিত হয়। ১৯৪৭ সালের ডিসেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগের করাচি অধিবেশনে সোহরাওয়ার্দী অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি প্রচলনের প্রস্তাব করেন। যদিও সোহরাওয়ার্দী ও মিয়া ইফতেখার উদ্দিনসহ মাত্র ১০ জন সদস্য এ প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেয়। তবুও একথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, এ প্রস্তাবের মাধ্যমে প্রকৃতপক্ষে গণ আজাদী লীগ , গণতান্ত্রিক যুবলীগ ও ঢাকার বিক্ষুব্ধ মুসলিম লীগ কর্মীদের অসাম্প্রদায়িক চেতনার বহিঃপ্রকাশ ঘটে। এসব প্রচেষ্টার পেছনে মুসলিম লীগের ধর্মভিত্তিক রাজনীতির পরিবর্তে অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতি প্রবর্তনের ইচ্ছার অভিব্যক্তি ঘটে। পরে ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে সোহরাওয়ার্দী একটি দলমত নির্বিশেষে ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয় রাজনৈতিক দল প্রবর্তনের উদ্দেশ্যে পাকিস্তান। ন্যাশনাল লীগ গঠনের প্রস্তাব করেন যে দলে সকল ধর্মের পাকিস্তানি নাগরিক সদস্য হতে পারবেন। ১৯৪৯ সালে মুসলিম লীগের অভ্যন্তরে অন্তর্দলীয় কোন্দল চরমে উঠে। প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে টাঙ্গাইল আসনে মুসলিম লীগ পদপ্রার্থী খুররম খান পন্নীর বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ মুসলিম লীগ কর্মী শামসুল হক প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। এ নির্বাচনে খুররম খান পন্নীর শোচনীয় পরাজয় মুসলিম লীগের রাজনীতির ভবিষ্যৎ ভরাডুবির দিক নির্দেশ করে। এ রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে মুসলিম লীগের অগণতান্ত্রিক কার্যক্রমের বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ ও হতাশাগ্রস্ত কর্মীরা ১৯৪৯ সালে ঢাকায় ২ দিনের অধিবেশনে মিলিত হয়। এ অধিবেশনে পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে এবং পূর্ব বাংলার মানুষের ন্যায়সঙ্গত দাবি সম্বলিত শামসুল হক রচিত মূল দাবি শিরোনামে একটি প্রচারপত্র বিতরণ করা হয়। ২৩ জুন সর্বসম্মতিক্রমে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন করা হয় এবং ৪০ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি আত্মপ্রকাশ করে।
পাকিস্তানের বিরাজমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে আর একটি মুসলিম লীগ। বিরোধী রাজনৈতিক দল গঠন তেমন উল্লেখযোগ্য বিষয় ছিল না। কিন্তু তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে মুসলিম লীগ বিরোধী রাজনৈতিক দল সমগ্র পাকিস্তানের রাজনীতিতে নতুন গতি সঞ্চার করে। নবগঠিত পূর্ব পাকিস্তান। আওয়ামী মুসলিম লীগের যে খসড়া মেনিফেস্টো রচিত হয় তাতে ১৯৪০ সালে। রচিত বেঙ্গল প্রাদেশিক মুসলিম লীগের মেনিফেস্টোর প্রতিফলন ঘটে। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের তরুণ সংগঠকরা সকলেই ছিলেন ১৯৪৮ সালে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগের সদস্য, যা মুসলিম লীগের অঙ্গ ছাত্র সংগঠনের বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এসব তরুণ প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ভাষা
পৃষ্ঠা-১২
আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করে এবং রাজনৈতিক পরিস্থিতির চূড়ান্ত পরিণতিতে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের জন্ম হয়।
নব সৃষ্ট পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চল অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু হয়ে পড়ে। ১৯৪৭ থেকে ১৯৪৯ পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানে প্রবল দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। ১৯৪৯ সালের ১৮, ১৯ এবং ২০ জুন তারিখে অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগের দ্বিতীয় কাউন্সিল অধিবেশনে দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতি মোকাবেলার ক্ষেত্রে মুসলিম লীগ সরকারের ব্যর্থতা স্বীকৃত হয়।
আওয়ামী লীগের প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয় ২৪ জুন ১৯৪৯ মওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে। ১৯৪৯ সালের অক্টোবর মাসে আর্মানিটোলা ময়দানে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের বিশাল জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। সারা পূর্ব বাংলায় চরম দুর্ভিক্ষ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এ জনসভায় বক্তৃতা করার অভিযোগে মওলানা ভাসানীসহ অনেক নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়। কৃষকের পাটের দাম হ্রাস পায় এবং অর্থনৈতিক সংকটময় পরিস্থিতির উদ্ভব হয়। লক্ষণীয় যে, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরুদ্ধে গঠিত হলেও দলের নামকরণে মুসলিম শব্দটি বর্জন করতে সমর্থ হয়নি। বস্তুত পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগও মুসলিম লীগের মতই একটি সাম্প্রদায়িক দল হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। ইতিহাসের নিরিখে এটা কিছুতেই অস্বীকার করা যাবে না যে, বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে আওয়ামী মুসলিম লীগ আর একটি সাম্প্রদায়িক ছাড়া আর কিছুই ছিল না। এ কারণে এ নতুন রাজনৈতিক দলে, তাজউদ্দিন, কমরুদ্দিন আহম্মদ, তোয়াহা ও অন্যান্য প্রগতিশীল কর্মীরা প্রথমদিকে যোগদানে অস্বীকৃতি জানান। শাসক মুসলিম লীগ তখন ধর্মকে অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করছিল। পূর্ব বাংলার জনগণও ধর্মীয় চেতনা থেকে সম্পূর্ণ পৃথক ছিল না। এ পরিস্থিতিতে সম্পূর্ণ ধর্ম নিরপেক্ষ দল যেমন গঠন সম্ভব ছিল না, ঠিক তেমনি পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের একটি ধর্মভিত্তিক দল হিসাবে মুসলিম লীগের বিরোধিতা করার ক্ষেত্রে ব্যর্থতার আশঙ্কাই ছিল বেশি।
যদিও পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠা লাভ করে, তবুও বেঙ্গল মুসলিম লীগের খাজা নাজিমুদ্দিন বিরোধী সোহরাওয়ার্দী-হাশিম গ্রুপের সমর্থকরাই অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। বিক্ষুব্ধ তরুণ কর্মীরা প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ সোহরাওয়ার্দী কর্তৃক অনুপ্রাণিত হয়। সোহরাওয়ার্দী মুসলিম লীগকে জাতীয় রাজনৈতিক দল হিসেবে ঢেলে সাজাতে চেয়েছিলেন। তিনি ১৯৪৯ সালের নভেম্বরে পাকিস্তান মুসলিম লীগের সভাপতি চৌধুরী খালেকুজ্জামানকে এক পত্রে ইচ্ছুক ব্যক্তিদের মুসলিম লীগের সদস্যপদে
পৃষ্ঠা-১৩
অন্তর্ভুক্ত করার আহ্বান জানান এবং তা না করলে তারা পৃথক দল গঠন করতে পারে এ মর্মে সতর্ক করে দেন। মুসলিম লীগকে ঢেলে সাজাতে ব্যর্থ হয়ে সোহরাওয়াদী বিরোধী রাজনৈতিক দল গঠনে সচেষ্ট হন। ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগকে ক্ষমতা থেকে অপসারণ করাই ছিল বিরোধী রাজনৈতিক দল গঠনের উদ্দেশ্য। ১৯৫০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে লাহোরে এক রাজনৈতিক কর্মী সমাবেশে তিনি নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠনের কথা ঘোষণা করেন এবং তিনি নিজেই এ দলের সভাপতি হন কিন্তু বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে, মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে গঠিত পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ তখন পর্যন্ত নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের অংশ ছিল না। পরে ১৯৫১ সালে সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে নিখিল পাকিস্তান জিন্নাহ আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হলে তখনও পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ এর অংশ ছিল না। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রকৃতঅর্থে একটি প্রাদেশিক দল হিসেবেই গড়ে উঠেছিল। ১৯৫১ সালের নভেম্বর-ডিস্বের মাসে অনুষ্ঠিত উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে প্রাদেশিক নির্বাচনের পরে সোহরাওয়ার্দী পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সঙ্গে একীভূত হওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ ততদিনে প্রাদেশিক গণপরিষদে বৃহত্তম বিরোধী দল হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে এবং ভাষা আন্দোলন ও বাংলার জনগণের ন্যায়সঙ্গত দাবি আদায়ের জন্য সোচ্চার হওয়ার কারণে একটি জনপ্রিয় দল হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। ১৯৫২ সালের ডিসেম্বর মাসে শর্ত সাপেক্ষে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ এবং নিখিল পাকিস্তান জিন্নাহ আওয়ামী মুসলিম লীগ লাহোরে এক রাজনৈতিক সমাবেশে একীভূত হয়। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ দলের নাম, মেনিফেস্টো এবং কর্মসূচি অপরিবর্তন রাখে। এ দুই দলের একীভূত হওয়ার বিষয়টি পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের কার্য নির্বাহী কমিটির ১৯৫৩ সালের ২১ এপ্রিল অনুষ্ঠিত সভায় অনুমোদন লাভ করে। এর এক বছর পরে কাউন্সিল অধিবেশনে মওলানা ভাসানী ঘোষণা করেন যে, যখন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ এবং নিখিল পাকিস্তান জিন্নাহ আওয়ামী মুসলিম লীগ একীভূত করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয় তখন তিনি জেলে ছিলেন। এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের কর্মসূচি ও মেনিফেস্টো চূড়ান্ত করার পর। সুতরাং কর্মসূচি ও মেনিফেস্টোর ক্ষেত্রে দ্বিমত দেখা দিলে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ একাই এগিয়ে যাবে। তিনি আরো ঘোষণা করেন যে, কেউ যদি আমাদের কর্মসূচির মধ্যে হস্তক্ষেপ করে তা হলে কেন্দ্রীয় দলের সঙ্গে একীভূত হওয়ার বিষয় পুনর্বিবেচনা করতে বাধ্য হবে।
পৃষ্ঠা-১৪
মওলানা ভাসানী বলেন যে, পাকিস্তানের দুই অঞ্চলের সমস্যা আলাদা এবং পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন আদায়ে বদ্ধপরিকর। এটা স্পষ্টই প্রতীয়মান হয় যে, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ ও জিন্নাহ আওয়ামী মুসলিম লীগ একীভূত হওয়ার পরও পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের গঠনতন্ত্র অবিকল ছিল এবং স্বায়ত্তশাসনের দাবি আদায়ের সংগ্রাম সব সময়েই অব্যাহত ছিল। এমনকি ষাটের দশকে সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর শেখ মুজিবের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ পুনরুজ্জীবিত হওয়ার পরও আওয়ামী লীগ এ আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়নি। মওলানা ভাসানী আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হিসেবে স্বায়ত্তশাসন আদায়ের যে সংগ্রাম শুরু করেছিলেন, পরবর্তীকালে সেই সংগ্রাম অব্যাহত থাকে। কিন্তু মওলানা ভাসানী তখন আর আওয়ামী লীগে ছিলেন না। তিনি তখন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সভাপতি। আওয়ামী লীগ শেখ মুজিবের নেতৃত্বে ৬ দফাভিত্তিক স্বায়ত্তশাসন আদায়ের জন্য মরণপণ সংগ্রাম শুরু করে। আওয়ামী লীগের পূর্ব ও পশ্চিম অংশ কখনই এক ও অভিন্ন মেনিফেস্টো অনুযায়ী পরিচালিত হয়নি। স্বভাবত পশ্চিম পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দ ৬ দফা প্রশ্নে বিরোধিতা শুরু করার ফলে আওয়ামী লীগ বিভক্ত হয়। আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের ২৩ বছরের শাসনকালে বাঙালিদের ন্যায়সঙ্গত দাবি আদায়ে সোচ্চার থাকার ফলে প্রাদেশিক দল হিসেবেই সমধিক পরিচিত লাভ করে।
পশ্চিম পাকিস্তানের প্রাক্তন সদস্যরা, বিক্ষুব্ধ মুসলিম লীগ সদস্যরা, তরুণ। আইনজীবী, ব্যবসায়ী গোষ্ঠী, জমিদার শ্রেণি ও অন্যান্য প্রভাবশালী ব্যক্তি যারা সোহরাওয়ার্দীকে সমীহ করতেন, তাঁরা আওয়ামী মুসলিম লীগে যোগ দেন। সীমান্ত প্রদেশের মানকীর পীর ও পাঞ্জাবের মামদোতের খান সাহেব এবং অন্যান্য নেতৃবৃন্দ ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের বিরোধিতা করার জন্য সোহরাওয়ার্দীকে নেতা হিসাবে গ্রহণ করেন। অপরদিকে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ এবং নিখিল পাকিস্তান জিন্নাহ আওয়ামী মুসলিম লীগ একীভূত হওয়ার ক্ষেত্রে কোনো বাধা ছিল না। এমতাবস্থায় মুসলিম লীগের ধর্মাশ্রয়ী, ধর্মনিরপেক্ষ, ডানপন্থি, বামপন্থি, জাতীয়তাবাদী, আঞ্চলিকতাবাদী ও অন্যান্য উচ্চাভিলাসী মুসলিম লীগ বিরোধী ব্যক্তিরা সকলেই আওয়ামী মুসলিম লীগে যোগদান করে।
সোহরাওয়ার্দী পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর মার্কিন ঘেঁষা পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করেন। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সেন্টো-সিয়াটো সামরিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্র গৃহীত হওয়ার পর সোহরাওয়ার্দী বলেন পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন শতকরা ৯৮ ভাগ দেওয়া হয়েছে। পাকিস্তান জোট
পৃষ্ঠা-১৫
নিরপেক্ষ গ্রুপের সদস্য হওয়া সত্ত্বেও মিশর ব্রিটেন কর্তৃক আক্রান্ত হওয়াযর পরও পাকিস্তান বৃটেনের নিন্দা জ্ঞাপন করতে অসমর্থ হয়। বিশেষ করে দীর্ঘকালব্যাপি বাঙালির প্রাণের দাবি স্বায়ত্তশাসন সম্পর্কে সোহরাওয়াদী-ভাসানী দ্বন্দ অনিবার্য হয়ে পড়ে। ১৯৫৭ সালে কাগমারী সম্মেলনের পর মওলানা ভাসানী আওয়ামী লীগের সভাপতি পদ থেকে পদত্যাগ করেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, ১৯৫৩ সালের জুলাই মাসের কাউন্সিল অধিবেশনে আওয়ামী মুসলিম লীগকে একটি অসাম্প্রদায়িক দল হিসাবে গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে আওয়ামী মুসলিম লীগে মুসলিম শব্দটি বর্জন করার প্রস্তাব উত্থাপিত হয় এবং ১৯৫৫ সালের অক্টোবর মাসে অনুষ্ঠিত কাউন্সিল অধিবেশনে আনুষ্ঠানিকভাবে মুসলিম শব্দটি বর্জন করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। আওয়ামী লীগ ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক দল হিসেবে গড়ে উঠে।
আওয়ামী লীগ পূর্ব বাংলার পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন ও জনগণের ন্যায় সঙ্গত অধিকার আদায়ের সংগ্রামে আপোষহীন ভূমিকা রাখে। আওয়ামী লীগের অনমনীয় ও দৃঢ় মনোভাবের কারণে বাঙালি জাতি ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত এ দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় নানা ঘাত-প্রতিঘাতে এগিয়ে চলে এবং স্বাধীনতার অবিনাশী চেতনার দিকে ধাবিত হয়। ষাটের দশকে শেখ মুজিব কর্তৃক ৬ দফা ঘোষণার ফলে স্বায়ত্তশাসন অর্জনের সংগ্রাম অধিকতর বেগবান হয়। সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পাকিস্তান গণপরিষদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। কিন্তু পাকিস্তানের কুচক্রী সামরিক শাসকেরা ক্ষমতা হস্তান্তরের পরিবর্তে নির্বাচনী রায় বানচাল করার হীন উদ্দেশ্যে সামরিক বাহিনী লেলিয়ে দেয় এবং ভয়াবহ গণহত্যা শুরু করে। বাঙালি জাতি স্বাধীনতা লাভের আকাঙ্ক্ষায় ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ মহান মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
পৃষ্ঠা-১৬
দ্বিতীয় অধ্যায়
আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠা ও উত্তপ্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতি
২৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসনের অবসানের পর পাক-ভারত উপমহাদেশ ভারত ও পাকিস্তানে বিভক্ত হয়। ১৪ আগস্টে পাকিস্তান নামক যে রাষ্ট্রটির সৃষ্টি হলো তার শাসনভার পড়লো মুসলিম লীগের ওপর। মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেলের আসন গ্রহণ করলেন এবং লিয়াকত আলী খান হলেন প্রধানমন্ত্রী। মুসলিম লীগের দেশ পরিচালনার কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকায় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা কুক্ষিগত হলো আমলাদের হাতে। আর মি. জিন্নাহ একনায়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন।
শেখ মুজিব পাকিস্তান অর্জনের জন্য আন্দোলন করেছিলেন। ছাত্র-যুবকদের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তিনি তখন থেকেই উপলব্ধি করেন যে, পাকিস্তানে বাঙালিদের ন্যায়সঙ্গত অধিকার অর্জিত হবে না। বাঙালি জাতিসত্তা পাকিস্তানে মুসলিম লীগের রাজনীতিতে নিরাপদ নয়। বাঙালি জাতি পাকিস্তানের বিশেষ করে পাঞ্জাবিদের শাসন-শোষণের যাঁতাকলে নিপতিত হয়েছে। জনগণকে পাঞ্জাবিদের হাত থেকে রক্ষা করতে হবে।
শেখ মুজিব ১৯৪৭ সালে বি. এ. পরীক্ষার কারণে কলকাতায় থেকে যান। ঢাকায় আসতে তাঁর বেশ কিছু দেরি হয়। ১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বরে তিনি ঢাকায় আসেন এবং ১৫০ মোগলটুলীতে ওঠেন। তাঁর পিতার ইচ্ছা ছিল পুত্র হবে একজন আইনজীবী। সে অনুযায়ী ১৯৪৭ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তি হন।
এ বছরেই টাঙ্গাইলের যুবনেতা শামসুল হকের নেতৃত্বে ঢাকায় গঠিত হয়। গণতান্ত্রিক যুবলীগ এবং শেখ মুজিব হন প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। ঢাকা আগমনের আগে শেখ মুজিব ইসলামিয়া কলেজের সিরাজদ্দৌলা হলে ছাত্র, যুবক ও রাজনেতিক কর্মীদের সংগঠিত করার উদ্যোগ নেন। এ সমাবেশে তিনি ঘোষণা করেন ‘মুসলিম লীগ’ আসলে জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তি চায় না। মুসলিম লীগ ধর্মকে হাতিয়ার করে রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করতে চায়।’ তিনি বলেন, ‘এ
পৃষ্ঠা-১৭
স্বাধীনতা সত্যিকারের স্বাধীনতা নয়। বাংলার মাটিতে নতুন করে আবার আমাদের সংগ্রাম করতে হবে।’
রাজনৈতিক দিক থেকে শেখ মুজিব যে কতো দূরদর্শী ছিলেন তা তাঁর এ বক্তব্য থেকে বোঝা যায়।
পাকিস্তান সৃষ্টির পর বড় নেতারাও কলকাতা ছেড়ে ঢাকায় চলে এলেন। পর্ব পাকিস্তানের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দীন এবং প্রাদেশিক মুসলিম লীগের কতিপয় নেতা মুসলিম লীগকে পকেট প্রতিষ্ঠানে পরিণত করে ফেললেন। শেখ মুজিব প্রতিবাদী হয়ে উঠলেন। এসব নেতাদের প্রতিক্রিয়াশীল আবরণের বিরুদ্ধে ফজলুল কাদের চৌধুরী, জহিরউদ্দীন, নূরুদ্দীন আহমেদ, আবদুর রহমান প্রমুখদের নিয়ে সংগ্রামে অবতীর্ণ হলেন।
১৯৪৭ সালের ডিসেম্বরে প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দীনের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনয়নের লক্ষ্যে আইনসভায় কতিপয় সদস্য বৈঠকে বসেন। শেখ মুজিব এ বৈঠকে নেতৃত্ব দেন। এ সময় শাহ আজিজুর রহমানের নেতৃত্বে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ খাজা নাজিমউদ্দীনের প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করলে শেখ মুজিব এর বিরুদ্ধাচরণ করেন।
১৯৪৮ সালের মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীরা বিভিন্ন দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ধর্মঘট পালন করে। শেখ মুজিব এসব ধর্মঘট পালনকারী কর্মচারীদের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেন এবং নেতৃত্ব দেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়।
মুসলিম লীগ সরকারের ইঙ্গিতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ শেখ মুজিবসহ ২৭ জন ছাত্রনেতাকে বহিষ্কার ও জরিমানা করে। পরে পরিস্থিতি শান্ত হলে এ মর্মে জানানো হয় যে, শাস্তিপ্রাপ্ত ছাত্ররা ভুল স্বীকারপূর্বক দুঃখ প্রকাশ করে। অঙ্গীকারনামা প্রদান করলে বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করা হবে।
অন্যান্য ছাত্রনেতারা আত্মসমর্পণমূলক মুচলেকা প্রদান করলেও শেখ মুজিব এ ধরনের অপমানজনক মুচলেকা দিতে অস্বীকার করেন। প্রতিবাদী শেখ মুজিব বলেন যে, চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের ন্যায্য দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়ে তিনি কোনো অপরাধ করেননি, কাজেই মুচলেকা দেওয়ার কোনো প্রশ্নই ওঠে না।
শেখ মুজিবের চরিত্রে এ অনমনীয় দৃঢ়তা সারাজীবন প্রতিফলিত হয়েছে। তিনি কখনোই মাথা নত করেননি। বন্দুকের নলের মুখেও তিনি অমিততেজ আর অসীম সাহসে গর্জে উঠেছেন। মাথা নত না করে বুক ফুলিয়ে অসীম সাহসে জনগণের পাশে তিনি দাঁড়িয়েছেন। শেখ মুজিবের এ মাথা নত না করা থেকে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম শিক্ষাগ্রহণ করতে পারে।
শেখ মুজিব বহিষ্কৃত হওয়ার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে এলেন। তিনি বললেন, “আমি আবার একদিন এ বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে আসব। তবে
পৃষ্ঠা-১৮
হয়তো ছাত্র হিসাবে নয়, সসম্মানেই আসব।” তিনি তার প্রতিজ্ঞা রক্ষা করেছিলেন। দীর্ঘ ২৪ বছর পর ১৯৭২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও ডাকসু সম্মিলিতভাবে এক বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে এবং তাঁর উপস্থিতিতে ১৯৪৯ সালের বহিষ্কার আদেশের কপি ছিড়ে ফেলা হয় এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আজীবন সদস্য পদ দিয়ে তাঁকে সম্মানিত করা হয়। শেখ মুজিব তখন ‘জাতির পিতা ও স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী।
১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দীন গণপরিষদের প্রথম অধিবেশনে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে মেনে নেবে বলে ঘোষণা দিলে তৎক্ষণাৎ শেখ মুজিব এর তীব্র প্রতিবাদ করেন। কুমিল্লার ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত উর্দু ও ইংরেজি ভাষার পাশাপাশি বাংলাকে গণপরিষদের অন্যতম ভাষা হিসাবে দাবি করেন। ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের এ প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন তৎকালীন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান ও পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দীন। খাজা নাজিমউদ্দীনের বক্তব্যে সারাদেশে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। শেখ মুজিব মুসলিম লীগের এ হীন পরিকল্পনার বিরুদ্ধে আন্দোলনের প্রস্তুতি গ্রহণের জন্য কর্ম তৎপরতা শুরু করেন। শেখ মুজিব ছাত্র ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সাথে যোগাযোগ করেন।
১৯৪৮ সালের ২ মার্চ ভাষা প্রশ্নে মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে আন্দোলনকে সংগঠিত করার লক্ষ্যে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কর্মীদের এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ফজলুল হক হলে অনুষ্ঠিত এ বৈঠকে শেখ মুজিবের প্রস্তাব অনুযায়ী সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। সংগ্রাম পরিষদ বাংলা ভাষা নিয়ে মুসলিম লীগের ষড়যন্ত্রের প্রতিবাদে ১১ মার্চ সাধারণ ধর্মঘট আহ্বান করে।
ধর্মঘট চলাকালে শেখ মুজিব সহকর্মীদের সাথে সচিবালয়ের সামনে বিক্ষোভরত অবস্থায় গ্রেফতার হন। শেখ মুজিবকে গ্রেফতারের প্রতিবাদে সারা দেশে ছাত্রসমাজ প্রতিবাদে ফেটে পড়ে। ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ সরকার ছাত্রদের আন্দোলনের চাপে শেখ মুজিবসহ গ্রেফতারকৃত সকল ছাত্র নেতৃবৃন্দকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। শেখ মুজিব ১৫ মার্চ মুক্তি লাভ করেন। ১৬ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে সভার আয়োজন করা হয়। শেখ মুজিব এ সভায় সভাপতিত্ব করেন। পুলিশ এ সভায় হামলা চালায়। পুলিশের হামলার প্রতিবাদে শেখ মুজিবের আহ্বানে ১৭ মার্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালিত হয়। ১১ সেপ্টেম্বর তাকে পুনরায় গ্রেফতার করা হয়।
১৯৪৯ সালের ২১ জানুয়ারি শেখ মুজিব কারাগার থেকে মুক্তি পান। ২৬ এপ্রিল অনুষ্ঠিত টাঙ্গাইল উপ-নির্বাচনে মুসলিম লীগ বিরোধী প্রার্থী শামসুল হককে সমর্থন করেন এবং তার পক্ষে প্রচারণা চালান। উপাচার্যের বাসভবনের সামনে অবস্থান ধর্মঘটের কারণে তিনি আবার গ্রেফতার হন।
পৃষ্ঠা-১৯
একই বছরের জুন মাসের শেষ দিকে তিনি মুক্তি লাভ করেন। জেল থেকে বেরিয়েই দেশে বিরাজমান খাদ্য সংকটের কারণে আন্দোলন সংগঠিত করেন। সেপ্টেম্বরে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের দায়ে গ্রেফতার হন এবং পরে মুক্তি লাভ করেন। অক্টোবরে অনুষ্ঠিত আওয়ামী মুসলিম লীগের সভায় নূরুল আমিনের পদত্যাগ দাবি করেন। এর অব্যবহিত পরেই অক্টোবরের শেষ দিকে মওলানা ভাসানীসহ লিয়াকত আলী খানের নিকট একটি প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য শেখ মুজিব পুনরায় গ্রেফতার হন।
বিরাজমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে পাকিস্তান সৃষ্টির মাত্র ২১ মাসের মাথায় ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ বিরোধী রাজনৈতিক দল আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হয় ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন। তখন পাকিস্তানের উভয় অংশেই মুসলিম লীগ রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত। মুসলিম লীগের অন্যায় অত্যাচার থেকে দেশবাসীকে রক্ষা করার জন্য মুসলিম লীগেরই অভ্যন্তরে একদল তরুণ রাজনৈতিক কর্মী প্রতিবাদী হয়ে উঠেছিল। মুসলিম লীগের কুশাসন ও রাষ্ট্রপরিচালনায় ব্যর্থতার বিরুদ্ধে এরা প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে ওঠে। ১৯৪৭ সালের ৬ ও ৭ সেপ্টেম্বর ঢাকা পৌরসভার ভাইস-চেয়ারম্যান খান সাহেব আবুল হাসনাতের বেচারাম দেউড়িস্থ বাসভবনে এক যুব সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এ সম্মেলনে পাকিস্তান গণতান্ত্রিক যুবলীগ গঠিত হয়। কফিলউদ্দিন চৌধুরী ও শামসুল হক যথাক্রমে সম্মেলনের অভ্যর্থনা কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তছাদুক আহমেদ চৌধুরী ২৫ সদস্য বিশিষ্ট জাতীয় কমিটির সভাপতি মনোনীত হন।
মুসলিম লীগ সরকার এদেরকে ভারতীয় চর অভিহিত করে বলে যে, এরা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। এ সময়েই কমরুদ্দীন আহমদকে আহ্বায়ক করে ‘গণ আজাদী লীগ’ গঠিত হয়। লাহোর প্রস্তাব বাস্তবায়ন ছিল গণ আজাদী লীগের লক্ষ্য। এ ছাড়া কম্যুনিস্ট পার্টি এবং তাদের সমর্থিত ছাত্র ফেডারেশনও তৎপর ছিল।
১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি ফজলুল হক হলে অনুষ্ঠিত এক ছাত্র সভায় ‘পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগ’ গঠিত হয়। মঈনউদ্দীন আহমেদ এ কমিটির আহ্বায়ক এবং অলি আহাদ ঢাকা শহর কমিটির আহ্বায়ক মনোনীত হন। পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের সাংগঠনিক কমিটিতে ছিলেন : নঈমুদ্দিন আহমেদ, আব্দুর রহমান চৌধুরী, শেখ মুজিবুর রহমান, অলি আহাদ, আজিজ আহমেদ, আবদুল মতিন, দবিরুল ইসলাম, মফিজুর রহমান, শেখ আব্দুল আজিজ, সৈয়দ নূরুল আলম ও আবদুল কুদ্দুস চৌধুরী।
পাকিস্তান সৃষ্টির পর পরই এর দুই অংশের মধ্যে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব শুরু হয়। বিশেষ করে পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বিরাজমান অর্থনৈতিক
পৃষ্ঠা-২০
বৈষম্যের কারণে সচেতন বাঙালিরা বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। সংঘাতের প্রথম কারণই সৃষ্টি হয় রাষ্ট্রভাষা নিয়ে।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আগেই হায়দ্রাবাদ অধিবেশনে মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দের ঘোষণা ছিল যে, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু ।
সুতরাং ভাষা-সংস্কৃতির প্রশ্নে বাংলা ভাষাভাষী জনগণের সঙ্গে মুসলিম এগর সংঘাত অনিবার্য হয়ে ওঠে। ১৯৪৯ সালের মে মাসে মুসলিম লীগের বিক্ষুদ্ধ তরুণ রাজনৈতিক কর্মীদের একটি সম্মেলনের আয়োজন চলছিল। আবুল হাশিমপন্থী তরুণ মুসলিম লীগ কর্মীদের দপ্তর ছিল ১৫০ মোগলটুলী, ঢাকা। টাঙ্গাইলের শামসুল হক সার্বক্ষণিকভাবে ১৫০ মোগলটুলীস্থ দপ্তরের তত্ত্বাবধানে নিয়োজিত ছিলেন। ১৯৪৯ সালের মধ্য জুনে এ কর্মী সম্মেলনের প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ও ইয়ার মোহাম্মদ যথাক্রমে এ অভ্যর্থনা কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক মনোনীত হন। মওলানা আকরম খাঁ তখন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগের সভাপতি। বিক্ষুব্ধ তরুণদের এ ধরনের রাজনৈতিক তৎপরতা ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবং বিক্ষুব্ধ তরুণেরা ক্ষমতাসীনদের রোষানলে পতিত হয়। বিক্ষুব্ধ তরুণদের মধ্যে ছিলেন শামসুল হক, শেখ মুজিব, ফজলুল কাদের চৌধুরী, আবদুর সবুর খান, কমরুদ্দীন আহমেদ, আনোয়ারা খাতুন প্রমুখ। এসব তরুণ কর্মীরা মওলানা আকরম খাঁর কাছে সংগঠনের প্রাথমিক সদস্য সংগ্রহের জন্য রশীদ বই চাইতে গেলে তাদেরকে প্রত্যাখ্যান করা হয়। এর ফলে প্রকাশ্য দ্বন্দ্ব শুরু হয়। নারায়ণগঞ্জের রহমতুল্লাহ ইনস্টিটিউটে বিক্ষুদ্ধ তরুণ কর্মীরা এক সম্মেলনের আয়োজন করে। ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ সরকার সভাস্থলে ১৪৪ ধারা জারি করে। পরিবর্তিত অবস্থায় খান সাহেব এম ওসমান আলী এম. এল. এ-কে সভাপতি মনোনীত করা হয় এবং নারায়ণগঞ্জের পরিবর্তে পাইকপাড়ায় এ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এ সভায় সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, কেন্দ্রীয় মুসলিম লীগের সভাপতি খালেকুজ্জামানের কাছে একটি প্রতিনিধিদল প্রেরণ করা হবে এবং এ ব্যাপারে অভিযোগ উত্থাপন করা হবে। একটি বড় প্রতিনিধিদল যথারীতি করাচিতে উপস্থিত হয়ে খালেকুজ্জামানের কাছে নাজিমউদ্দীন-আকরম খাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন করে। খালেকুজ্জামান ছাত্র প্রতিনিধিদের কোনো কথাই কর্ণপাত না করে নাজিমউদ্দীন-আকরম খাঁকে সমর্থন করলেন।
আর এভাবেই মুসলিম লীগের পাল্টা একটি রাজনৈতিক দল আওয়ামী মুসলিম লীগ জন্ম নেয়। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন ঢাকায় কে এম দাস লেনস্থ। রোজ গার্ডেনের হলো ঘরে সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এ সম্মেলনে ৩০০ থেকে ৩৫০ জন প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন। এতে উদ্বোধনী ভাষণ দেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ও সভাপতিত্ব করেন আতাউর রহমান খান। প্রসঙ্গত
পৃষ্ঠা-২১
উল্লেখ্য যে, শেরে বাংলা ফজলুল হক তখন পূর্ব পাকিস্তান সরকারের এটর্নি জেনারেল ছিলেন। প্রথম যে সাংগঠনিক কমিটি গঠিত হয় তা নিম্নরূপঃ
সভাপতি : মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। সহ-সভাপতি ৫ জন যথাক্রমে আতাউর রহমান খান, সাখাওয়াত হোসেন, আলী আহম্মদ, এম এল এ. আলী আমজাদ খান, আবদুস সালাম খান। শামসুল হক সাধারণ সম্পাদক মনোনীত হন। শেখ মুজিবুর রহমান যুগ্ম সম্পাদক এবং সহ-সম্পাদক পদে খন্দকার মোশতাক আহমেদ ও এ, কে. এম রফিকুল হোসেন মনোনীত হন। ইয়ার মোহাম্মদ খান কোষাধ্যক্ষের দায়িত্ব নেন। অলি আহাদ রচিত ‘জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫-৭৫’ গ্রন্থে উপরিউক্ত কমিটির উল্লেখ রয়েছে।
১৯৪৯ সালের ২৪ জুন অর্থাৎ আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠনের পরদিন ঢাকার আরমানীটোলা ময়দানে এক জনসভা অনুষ্ঠিত হয় মওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে। ইয়ার মোহাম্মদ খান, আবদুল জব্বার খদ্দর, খয়রাত হোসেন, শামসুল হক ও মওলানা ভাসানী এ জনসভায় বক্তৃতা করেন। শেখ মুজিব তখন জেলে। জেলে থাকাকালীন অবস্থাতেই তিনি দলের যুগ্ম সম্পাদক পদে অধিষ্ঠিত হন।
১৯৫০ সালের ১ জানুয়ারি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানের ঢাকা আগমন উপলক্ষে আওয়ামী মুসলিম লীগ ভুখা মিছিল বের করে। এ মিছিলে নেতৃত্বদান কালে শেখ মুজিব গ্রেফতার হন এবং প্রায় দু’বছর তাঁকে জেলে আটক রাখা হয়।
পাকিস্তানের শতকরা ৫৬ জন অধিবাসী বাঙালির মুখের ভাষা বাংলাকে অস্বীকার করে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ সরকার উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার চক্রান্তে লিপ্ত হয়। বাঙালি লেখক, বুদ্ধিজীবী, ছাত্র ও জনগণ নীরব থাকেননি। এ অশুভ ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে তাঁরা তীব্র প্রতিবাদে ফেটে পড়েন। তকালীন প্রকাশিত দৈনিক ইত্তেহাদ, মাসিক ও সাপ্তাহিক পত্রিকাগুলো জোরালো প্রবন্ধ প্রকাশ করে। বিশেষ করে দৈনিক ইত্তেহাদ ও দৈনিক আজাদে অগ্নিঝরা লেখনী প্রকাশিত হতে থাকে। পাকিস্তানের শতকরা ৭ ভাগ লোক উর্দুতে কথা বলে। তাছাড়া বাংলা ভাষার মতো তা আন্তর্জাতিক খ্যাতি অর্জন করেনি। তথাপি তারা বাংলা ভাষার প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। এ পটভূমিতে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রথম ধাপ হিসাবে বাংলা ভাষার প্রশ্নে ১৯৪৮ সালে ঢাকায় আন্দোলন শুরু হয়। আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. জিয়াউদ্দীন আহমেদ উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার সপক্ষে তার অভিমত ব্যক্ত করার সাথে সাথেই বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে প্রবল প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এক প্রবন্ধে ১৫৪ বঙ্গাব্দের ১২ শ্রাবণ সংখ্যায় দৈনিক আজাদে
পৃষ্ঠা-২২
প্রকাশিত পাকিস্তান রাষ্ট্রভাষা শীর্ষক এক প্রবন্ধে বলেন, “বাংলাদেশের কোর্ট, আদালত ও বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাভাষার পরিবর্তে উর্দু, হিন্দি অথবা অন্যকোনো ভাষা গ্রহণ করা হইলে ইহা রাজনৈতিক পরাধীনতারই নামান্তর হইবে। ড. জিয়াউদ্দীন আহমেদ পাকিস্তানের প্রদেশসমূহের বিদ্যালয়ে শিক্ষার বাহনরূপে প্রাদেশিক ভাষার পরিবর্তে উর্দু ভাষার সপক্ষে যে অভিমত প্রকাশ করিয়াছেন আমি একজন শিক্ষাবিদ রূপে উহার তীব্র প্রতিবাদ জানাইতেছি। ইহা কেবলমাত্র রাজনৈতিক শিক্ষা ও নীতি বিরোধীই নয়, প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন ও আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের নীতি বিগর্হিত বটে।” ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৪৭ সালের ১ সেপ্টেম্বর ‘তমুদুন মজলিস’ নামে একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন গঠিত হয়। ১৯৪৭ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর এ মজলিস কর্তৃক প্রকাশিত ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু’ শীর্ষক একটি পুস্তিকায় কাজী মোতাহার হোসেন, আবুল মনসুর আহমদ ও আবুল কাশেম বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে প্রতিষ্ঠা করার পক্ষে তীব্র ভাষায় বক্তব্য রাখেন এবং প্রয়োজন বোধে সারা দেশব্যাপী আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান জানান।
ইতোপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ১৯৪৮ সালের ১৫ মার্চ পূর্ব বাংলার জনগণ রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে বাংলার সপক্ষে ধর্মঘট পালন করে। সেক্রেটারিয়েট ও অন্যান্য সরকারি অফিস ও রেল কর্মচারীরা এ ধর্মঘটে যোগ দেয়। পুলিশ বহু সংখ্যক লোককে গ্রেফতার করে এবং মিছিল ছত্রভঙ্গ করার জন্য ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালের গেটের সামনে কাঁদুনে গ্যাস নিক্ষেপ করে।
এর কিছুদিন পরেই পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মহাম্মদ আলী জিন্নাহর ঢাকায় আসবার কথা। জিন্নাহর ঢাকায় সফর কালে গোলমালের আশংকায় খাজা নাজিমউদ্দীন আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। জিন্নাহ নাজিমউদ্দীনকে ভাষার প্রশ্নে ছাত্রদের সঙ্গে আলোচনা করে মীমাংসা করার নির্দেশ দেন।
নাজিমউদ্দীন সংগ্রাম পরিষদের কাছে এ মর্মে একটি অনুরোধ পত্র পাঠান যে, সরকার ছাত্রদের দাবি মেনে নিতে রাজি আছে। এ জন্যে সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে খাজা নাজিমউদ্দীন আলোচনা করতে চান। সংগ্রাম পরিষদ ১৫ মার্চ দুটো বৈঠকে খাজা নাজিমউদ্দীনের সজ্ঞে মিলিত হয়। সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে আবুল কাশেম, কমরুদ্দীন আহমেদ, মোহাম্মদ তোয়াহা ও নঈমুদ্দীন আহমেদ প্রমুখেরা উপস্থিত ছিলেন। নাজিমউদ্দীনের সঙ্গে এ বৈঠকে ছাত্র নেতাদের তুমুল বাক-বিতন্ডা হয়। ছাত্র নেতৃবৃন্দ দাবি মেনে নেওয়ার জন্য চাপ প্রয়োগ অব্যাহত রাখলেও নাজিমউদ্দিন সবগুলো দাবি মেনে নিতে রাজি ছিলেন না। প্রথম দফা বৈঠক ব্যর্থ হওয়ার পর পুনরায় বৈঠক বসে। ছাত্রদের ৮ দফা দাবির পরিপ্রেক্ষিতে নাজিমউদ্দীন ও রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের মধ্যে এক চুক্তি
পৃষ্ঠা-২৩
সম্পাদিত হয়। এ চুক্তি ঐতিহাসিক ‘ভাষা চুক্তি’ নামে পরিচিত। এ চুক্তি সরকারের পক্ষে সই করেছেন স্বয়ং নাজিমউদ্দীন এবং সংগ্রাম পরিষদের পক্ষে কমরুদ্দীন আহমেদ। শেখ মুজিব তখন জেলে। ছাত্র নেতৃবৃন্দ এ চুক্তি স্বাক্ষরের আগে জেলে গিয়ে শেখ মুজিবের সঙ্গে দেখা করে শেখ মুজিবের অনুমোদন গ্রহণ করেন।
ঐতিহাসিক সেই ভাষা চুক্তিটি ছিল নিম্নরূপঃ
১. ২৯ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৮ সাল হতে বাংলা ভাষার প্রশ্নে যাহাদেরকে গ্রেফতার করা হইয়াছে, তাহাদেরকে অবিলম্বে মুক্তিদান করা হইবে।
২. পুলিশ কর্তৃক অত্যাচারের অভিযোগ সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং তদন্ত করিয়া এক মাসের মধ্যে এ বিষয়ে একটি বিবৃতি প্রদান করিবেন।
৩. ১৯৪৮ সালের এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে পূর্ব বাংলা সরকারের ব্যবস্থাপক সভায় বেসরকারি আলোচনার জন্য যে দিন নির্ধারিত হইয়াছে, সেইদিন বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করিবার এবং তাহাকে পাকিস্তান গণপরিষদে এবং কেন্দ্রীয় সরকারের পরীক্ষা দিতে সমমর্যাদা দানের জন্য একটি বিশেষ প্রস্তাব উত্থাপন করা হইবে।
৪. এপ্রিল মাসে ব্যবস্থাপক সভায় এ মর্মে একটি প্রস্তাব উত্থাপন করা হইবে যে, প্রদেশের সরকারি ভাষা হিসাবে ইংরেজি উঠিয়া যাওয়ার পরই বাংলা তাহার স্থলে সরকারি ভাষারূপে স্বীকৃত হইবে। ইহা ছাড়া শিক্ষার মাধ্যমও হইবে বাংলা। তবে সাধারণভাবে স্কুল-কলেজগুলিতে অধিকাংশ ছাত্রের মাতৃভাষার মাধ্যমেই শিক্ষাদান করা হইবে।
৫. আন্দোলনে যাঁহারা অংশগ্রহণ করিয়াছেন, তাঁহাদের কাহারো বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হইবে না।
৬. সংবাদপত্রের ওপর হইতে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হইবে।
৭. ২৯ ফেব্রুয়ারি হইতে পূর্ব বাংলার যে সকল স্থানে ভাষা আন্দোলনের জন্য ১৪৪ ধারা জারি করা হইয়াছে সেখান হইতে তাহা প্রত্যাহার করা হইবে।
৮. সংগ্রাম পরিষদের সাথে আলোচনার পর আমি এ ব্যাপারে নিঃসন্দেহ হইয়াছি যে, এ আন্দোলন রাষ্ট্রের দুশমনদের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয় নাই(এ দফাটি নাজিমুদ্দিন নিজের হাতে লেখেন)।
শেখ মুজিব ১৫ মার্চ জেল থেকে মুক্তি পেয়ে শওকত আলীকে সঙ্গে নিয়ে ফজলুল হক হলো থেকে ১৫০ মোগলটুলীতে গিয়ে রাত্রিযাপন করেন। পরদিন ভোরে তিনি ফজলুল হক হলে ফিরে আসেন এবং একটি প্রতিবাদ সভার
পৃষ্ঠা-২৪
আয়োজন করার জন্য ছাত্রদের একত্রিত করেন। ১৬ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে যে সভা অনুষ্ঠিত হয় শেখ মুজিব সেই সভায় সভাপতিত্ব করেন এবং সভাশেষে মিছিল সহকারে গণপরিষদের দিকে যাত্রা শুরু করেন।
এ মিছিলে সন্ধ্যার দিকে পুলিশের লাঠিচার্জ শুরু হয়। ১৯ জন ছাত্র গুরুতরভাবে আহত হয়। রাতে ফজলুল হক মুসলিম হলে সংগ্রাম পরিষদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় এবং এ বৈঠকে ১৭ মার্চে দেশব্যাপী সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।
শেখ মুজিব ইতোমধ্যেই একজন সাহসী যুবনেতা হিসাবে স্বীকৃতি লাভ করেন। শেখ মুজিব, তাজউদ্দীন আহমদ, মোহাম্মদ তোয়াহা, নঈমুদ্দীন আহমেদ, শওকত আলী, শামসুল হক ও আবদুল মতিন প্রমুখ ছাত্রনেতৃবৃন্দের সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডের ফলে সারা দেশে এ আন্দোলন লেলিহান শিখার মতো ছড়িয়ে পড়ে। ভাষা আন্দোলনের এ সময়ে শেখ মুজিব নিরলস পরিশ্রম করেন।
এ বিক্ষোভ-সংক্ষুব্ধ পরিস্থিতিতে জিন্নাহ তাঁর প্রথম ও শেষ ঢাকা সফরে আসেন ১৯ মার্চ বিকেলে। ২১ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে অনুষ্ঠিত জনসভায় জিন্নাহ ঘোষণা করেন, “উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।” সভার একপ্রান্ত থেকে প্রতিবাদী কণ্ঠ ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হতে থাকে। শেখ মুজিব, তাজউদ্দিন আহমদ ও আব্দুল মতিন এ প্রতিবাদে নেতৃত্ব দেন। জিন্নাহ সাহেব এ ধারণা পোষণ করতেন যে, তার কথার প্রতিবাদ করবে এমন সাহস পাকিস্তানের কারো নেই। যদিও এ প্রতিবাদের সুর ছিল খুবই ক্ষীণ, তবুও মি. জিন্নাহর কাছে ছিল একটি নিতান্তই অপ্রত্যাশিত। তিনদিন পর ঢাকা কার্জন হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন উৎসবে মি. জিন্নাহ ভাষণদান কালে পুনরায় একই বক্তব্যের পুনরাবৃত্তি করেন। এবার হলের একপ্রান্ত থেকে অপরপ্রান্ত পর্যন্ত সোচ্চার প্রতিবাদের ধ্বনিতে জিন্নাহর কণ্ঠস্বর মিলিয়ে যায়্ জিন্নাহ কিছুক্ষণ চুপ করে দাড়িয়ে থাকেন। তারপর অপেক্ষাকৃত নরম সুরে তিনি পুনরায় তার ভাষণ শুরু করেন। এবারে তিনি বলেন যে, “পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিভিন্ন অংশগুলি একত্রে এগিয়ে যাওয়ার জন্য প্রয়োজন একটি মাত্র রাষ্ট্র ভাষার এবং আমার মতে একমাত্র উর্দুই হতে পারে সে ভাষা।” এবারও মৃদু প্রতিবাদ ও গুঞ্জন শোনা যায়।
হোসেন শহিদ সোহাওয়ার্দী দেশ বিভাগের পর ভারতে অবস্থানরত মুসলমানদের রক্ষার জন্য কলকাতায় থেকে যান। ১৯৪৮ সালে তিনি প্রথম ঢাকায় আসেন কিন্তু নারায়ণগঞ্জ স্টিমার ঘাটে অবতরণ করতে না দিয়ে তাঁকে কলকাতায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়। পরবর্তীতে ১৯৪৯ সালে সোহরাওয়ার্দী কলকাতা থেকে তার শ্বশুর স্যার আবদুর রহিমের করাচি’র বাসভবনে আসেন।
পৃষ্ঠা-২৫
তৎকালীন মুসলিম লীগ সরকার সোহরাওয়ার্দীর গণপরিষদের সদস্য পদ বাতিল করে দেয়।সোহরাওয়ার্দী বিরোধী দলীয় রাজনীতিতে প্রবেশ করেন।
রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন তখন চরমরূপ পরিগ্রহ করেছে। ১৯৫১ সালের ১৬ অক্টোবর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত খান নিহত হলে খাজা নাজিমুদ্দিন তার স্থলাভিষিক্ত হন। প্রধানমন্ত্রী নাজিমুদ্দিন তার প্রথম ঢাকা সফরকালে ১৯৫১ সালের ২৬ জানুয়ারি পল্টন ময়দানের বিশাল জনসভায় বলেন যে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু অন্য কোনো ভাষা নয়। অথচ ইনিই (নাজিমুদ্দিন) বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার অঙ্গীকারে ঐতিহাসিক ভাষা চুক্তিতে স্বাক্ষর দান। করেছিলেন। মৃত জিন্নাহর প্রেতাত্মা হয়ে নাজিমুদ্দিন জিন্নাহর বক্তব্যের পুনরাবৃত্তি করলে ঝিমিয়ে পড়া রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে হঠাৎ করে বিদ্রোহের আগুন জ্বলে ওঠে।
১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি ডাকসু’র নেতৃবৃন্দ মধুর ক্যান্টিনে এক ছাত্র সমাবেশের আয়োজন করে। ছাত্রনেতা গাজীউল হক এ সভায় অগ্নিময়ী ভাষণ দেন। সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ৩০ জানুয়ারি দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালিত হয়। ৩১ জানুয়ারি ঢাকা ডিস্টিক্ট বার লাইব্রেরি হলে সর্বদলীয় প্রতিনিধিদের এক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে পূর্ব বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে এ সংগ্রাম ছড়িয়ে পড়ে। ৩০ জানুয়ারি সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, খেলাফতে রাব্বানী পার্টি, ছাত্রলীগ ও বিশ্ববিদ্যালয় সংগ্রাম কমিটি থেকে দু’জন করে নেওয়া প্রতিনিধির সমন্বয়ে একই কমিটি গঠিত হয়। এ প্রতিনিধিদের মধ্যে ছিলেন-আবুল হাশিম, আতাউর রহমান খান, কমরুদ্দীন আহমেদ, অলি আহাদ, মোহাম্মদ তোয়াহা, আব্দুল মতিন, খালেক নেওয়াজ খান ও শামসুল হক প্রমুখ। শেখ মুজিব তখন কারাগারে আটক। ছাত্রসমাজ পরদিন ১৪৪ ধারা ভেঙে পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য বদ্ধপরিকর হয়ে ওঠে। ২১ ফেব্রুয়ারি ছাত্ররা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে জমায়েত হতে শুরু করে। এদিকে সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। রাজপথে যানবাহন চলাচল ছিল না, দোকানপাট বন্ধ ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে পুলিশের গাড়ি। বেলা ১২টার সময় সভা শুরু হলো। বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় গাজীউল হকের সভাপতিত্বে ছাত্রনেতারা বক্তব্য রাখেন। বিশ্ববিদ্যালয় ভাষা কমিটির আহ্বায়ক আবুদল মতিন উপস্থিত ছাত্রসমাজকে লক্ষ্য করে বললেন, “মায়ের অপমান সহ্য করা যায় না। মাতা এ অপমানের প্রতিশোধ নিতে ডাক দিয়েছেন। বলুন আপনারা সে ডাকে সাড়া দিয়ে। ১৪৪ ধারা ভাঙ্গবেন, না ঘরে ফিরে যাবেন।” শ্লোগানে শ্লোগানে আকাশ বাতাস বিদীর্ণ হতে লাগলো। রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’, ১৪৪ ধারা মানব না, মানব না, ‘নাজিম-নূরুল নিপাত যাক’, ‘চলো চলো অ্যাসেম্বিলিতে চলো।‘
পৃষ্ঠা-২৬
প্রসঙ্গত উলেখ্য শেখ মুজিব জেলের অভ্যন্তর থেকে গাজীউল হককে এক ঐতিহাসিক চিঠি লেখেন। এ চিঠিতে শেখ মুজিব ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে বাংলাকে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য ছাত্রসমাজকে আহ্বান জানান। ছাত্ররা দসজন দশজন করে মিছিল বের করে। বেলা ৩টায় পুলিশের গুলিবর্ষণে সালাম, বরকত ,রফিক , জব্বার, শফিকুর ও অজ্ঞাতনামা অনেকে শহিদ হন। শেখ মজিব জেল থেকে এক বিবৃতিতে ছাত্র মিছিলে পুলিশের গুলিবর্ষণের তীব্র প্রতিবাদ ও নিন্দা জানান এবং এক টানা ১৭ দিন অনশন অব্যাহত রাখেন। জেল থেকে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে যোগাযোগের অপরাধে তাকে ঢাকা থেকে ফরিদপুর কালে স্থানান্তর করা হয়। ২৬ ফেব্রুয়ারি ফরিদপুর জেল থেকে তিনি মুক্তি লাভ করেন ।ঢাকায় হত্যা তখন পাকিস্তান গনপরিশদের বৈঠক ছলছিল ।পুলিশের গুলি বর্ষণে ছাত্র হত্যার সংবাদ পৌঁছানো মাত্র গণপরিষদ সদস্য মাওলানা আবদূর রাশিদ তর্কবাগীশ তুমুল প্রতিবাদ করেন।মাওলানা তর্কবাগীশ বলেন,” আমাদের ছাত্ররা শাহাদাৎ বরন করেছেন ,আমরা আরামে পাখার হাওয়া খেতে থাকবো এটা বরদাস্ত করা যায় না । আগে চলুন কথায় হত্যাকাণ্ড হয়েছে দেখে আসি। তারপর অ্যাসেম্বলি চলবে। আর আগে আমরা এ্যাসেম্বলি চলতে দেব না।” তুমুল বাকবিতণ্ডার মাঝে অ্যাসেম্বলি মূলতবি ঘোষণা করা হয়। ২১ ফেব্রুয়ারি ছিল প্রাদেশিক ব্যবস্থাপক সভার বাজেট অধিবেশন। রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ সারা বাংলায় ধর্মঘট পালনের আহ্বান জানায়। সরকারিভাবে ২০ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা জারি করে সভা, শোভাযাত্রা, বিক্ষোভ মিছিল নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। ফলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে প্রবল উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। বিক্ষুদ্ধ ছাত্ররা ২০ ফেব্রুয়ারির মধ্যরাতে ফজলুল হক হলো ও ঢাকা হলের মাঝখানে অবস্থিত পুকুরের পূর্ব পাশে উত্তরধারের সিড়িতে এক সভায় মিলিত হন। ছাত্রনেতা গাজীউল হক, মোহাম্মদ হাবিবুর রহামন (শেলী), মোহাম্মদ সুলতান, জিল্লুর রহমান, আব্দুল মোমিন, এম. আর, আখতার মুকুল, এস. এ. বারী, এ.টি. কামরুদ্দিন আহমদ, আনোয়ারুল হক খান, আনোয়ার হোসেন ও মঞ্জুর হোসেন। উপস্থিত ছিলেন। সভায় পরদিন ২১ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভাঙার ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।
পরদিন ২১ ফেব্রুয়ারি সকাল থেকেই বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় বিপুল সংখ্যক পুলিশ মোতায়েন করা হয়। ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে নির্ধারিত কর্মসূচি অনুযায়ী পরিষদ ভবনের দিকে অগ্রসর হতে থাকলে পুলিশ কর্তৃক বাধাপ্রাপ্ত হয়। শহিদের রক্তে ঢাকার রাজপথ রঞ্জিত হয়। গুলির শব্দে ব্যবস্থাপক পরিষদ উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। কোনো কোনো সদস্য বাইরে এসে দাঁড়ান। পরিষদের ভিতরে বিক্ষুদ্ধ সদস্যরা তীব্র প্রতিবাদে ফেটে পড়েন। অধিবেশন স্থগিত রাখার দাবি জানান।
পৃষ্ঠা-২৭
মওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ। ২১ ফেব্রুয়ারির ভাষা আন্দোলন ২২ ফেব্রুয়ারি গণ-আন্দোলনে পরিণত হয়। ২১ তারিখ থেকে ২৫ তারিখ পর্যন্ত হরতাল পালিত হয়। উপায়ান্তর না দেখে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য পাকিস্তান গণপরিষদে একটি বিল আনয়নের প্রস্তাব প্রাদেশিক গণপরিষদ কর্তৃক গৃহীত হয়। ১৯৫৬ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি গৃহীত পাকিস্তানের প্রথম সংবিধানের ২১৪ নং অনুচ্ছেদে উর্দু ও বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
২১ ফেব্রুয়ারি কতিপয় ছাত্রসহ অন্যান্যদের নিহত হওয়ার খবরে সমগ্র ঢাকা নগরী বিক্ষুব্ধ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এ ভূখণ্ডের জনপদ শঙ্কিত হয়ে পড়ে। মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে মিছিলরত সংগ্রামী ছাত্রদের প্রতি গুলিবর্ষণের ফলে তাৎক্ষণিকভাবে পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদের স্থলে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটে। বস্তুত সেদিন থেকেই বাঙালির স্বতন্ত্র স্বাধীন চিন্তার সূত্রপাত হয়। শহিদের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাঙালির মোহমুক্তি ঘটে।
এ উত্তপ্ত রাজনৈতিক পটভূমিতে বাংলার জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের অঙ্গীকার নিয়ে ১৯৪৯ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগ যাত্রা শুরু করে। মওলানা ভাসানী ও সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে অব্যাহত থাকে অধিকার আদায়ের অপ্রতিরোধ্য সংগ্রাম। পরবর্তীকালে একটি অসাম্প্রদায়িক সংগঠন গড়ে তোলার স্বার্থে আওয়ামী মুসলিম লীগের ‘মুসলিম’ শব্দটি বর্জন করা হয়। বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার প্রদীপ জ্বলে ওঠে এদেশের ঘরে ঘরে।
ফেব্রুয়ারি ২১ ও ২২ তারিখ রাতে প্রায় ১ ফুট উঁচু শহিদ মিনার নির্মাণ করা হয়। মেডিকেল কলেজের ছাত্র আজমল, ইয়াহিয়া, বদরুল আলম, হায়দার, শরফুল আলম প্রমুখ প্রথম শহিদ মিনার নির্মাণে প্রচুর পরিশ্রম করেছিলেন। শহিদ শফিকুর রহমানের (পুলিশের গুলিতে যার মাথার গুলি উড়ে গিয়েছিল) বৃদ্ধ বাবা শহিদ মিনার উদ্বোধন করেন। এ শহিদ মিনার দ্বিতীয়বার উদ্বোধন করেন। আজাদ পত্রিকার সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দিন। কিন্তু ২৬ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় পাকিস্তানি সৈন্যরা শহিদ মিনারটি ভেঙে ধুলিস্মাৎ করে দেয়। পাকিস্তানি শাসক চক্র বুঝতে পেরেছিল শহিদ মিনারের অলংঘনীয় প্রত্যয়ী ভূমিকা। তাই একাত্তরের পঁচিশে মার্চের কালো রাতে হিংস্র হায়েনার মতো তারা ছুটে গিয়েছিল শহিদ মিনারে। বিজাতীয় আক্রোশে, পশু শক্তিতে শহিদ মিনার ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল এবং সেখানে একটি মসজিদ নির্মাণের ঘোষণা দিয়েছিল। কিন্তু একুশে ফেব্রুয়ারি পরাজিত হয়নি। বায়ান্নোর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের শহিদের রক্তে অমর স্মৃতি বিজড়িত শহিদ মিনার এমনই অবিনাশী শক্তির অধিকারী যে, দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে নতুন কলেবরে বলিষ্ঠ চেতনায় গড়ে উঠেছে আবার অপরাজেয় শহিদ মিনার।
পৃষ্ঠা-২৮
বায়ান্নোর একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের পূর্বপুরুষেরা রক্তদান করে বাঙালি তীয়তাবাদের যে বীজ বপন করেছিল, ধাপে ধাপে জনগণের মহান সংগ্রামের মধ্য দিয়ে সেই বীজ কালক্রমে বিশাল মহীরূহে পরিণত হয়। ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় অনিবার্যভাবে আমাদের ঘরে ঘরে এসেছে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ।
বাংলাদেশের অনাগত প্রজন্মকে একুশের অমৃত বৃক্ষ করবে নিশ্চিত চায়াদান, অন্যায়ের কাছে মাথা নত না করার সংগ্রামী চেতনা আর দুর্জয় আক্রোশ রুখে দাঁড়ানোর অমিত তেজ ও দুর্বার সাহস। আত্মদানের মহিমাময় ইতিহাস প্রজন্মের পর প্রজন্মকে বাঙালি সংস্কৃতিজাত নিজস্ব পরিচয় ও জাতিসত্তা সঞ্চারিত করবে, সমৃদ্ধ করবে সংগ্রামী চেতনায় অনাগত কাল ধরে। একুশের অন্তর্নিহিত শক্তি বাঙালিকে আত্মপরিচয়ের সন্ধান দেবে যুগে যুগে।
১৯৫৩ সালে রাজনৈতিক ঘটনাবলি দ্রুত প্রবাহিত হতে থাকে। ভাষা আন্দোলনের পর ১৯৫২ সালের ডিসেম্বর মাসে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের জন্ম হয়। প্রতিটি জেলা থেকে একটি অসাম্প্রদাযিক ছাত্র প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার জন্য চাপ অব্যাহত থাকে। এ পরিস্থিতিতে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ ‘মুসলিম’ শব্দটি বর্জন করে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ নাম ধারণ করে। কামরুজ্জামান এর সভাপতি নির্বাচিত হন। ক্ষমতাসীন সরকারের বিরোধিতা সত্ত্বেও ১৯৫৩ সালে ভাষা আন্দোলনের প্রথম বার্ষিকী উদযাপিত হয়। সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা পরিষদের আহ্বায়ক অলি আহাদ ও অন্যান্য রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ জেলে থাকায় পুনরায় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পষিদ গঠিত হয়। এর সভাপতি নির্বাচিত হন আতাউর রহমান খান। ১৯ ও ২০ ফেব্রুয়ারি শহিদের রূহের মাগফিরাত কামনা করা হয়। ২১ ফেব্রুয়ারি পূর্ব বাংলায় হরতাল পালিত হয়। ঐ দিন আরমানীটোলা মাঠে জনসভা অনুষ্ঠিত হয়।
১৯৫৩ সালের ৯ মার্চ পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকার এক আদেশবলে পূর্ব পাকিস্তান ব্যবস্থাপক পরিষদের কার্যমেয়াদ ১৯৫৪ সালের ১৪ মার্চ পর্যন্ত বৃদ্ধি করেন। পাকিস্তান গণ-পরিষদে এ ধরনের একটি বিল পাস হয়। ১৯৫৩ সালের ১ এপ্রিল চৌধুরী খালেকুজ্জামান পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর হয়ে আসেন। ১৯৪৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর জিন্নাহর মৃত্যুর পর চৌধুরী খালেকুজ্জামান নিখিল পাকিস্তান। মুসলিম লীগের সভাপতি নিযুক্ত হন।
সোহরাওয়ার্দী করাচিতে অবস্থানকালে মিস্ ফাতেমা জিন্নাহর সমর্থনে ‘জিন্নাহ আওয়ামী লীগ’ গঠন করেন। ১৯৫১ সালের ১৬ অক্টোবর লিয়াকত আলী নিহত হলে খাজা নাজিমউদ্দিন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন এবং গোলাম মোহাম্মদ গভর্নর জেনারেলের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। গোলাম মোহাম্মদ ১৯৫৩ সালের ১৭ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিনকে বরখাস্ত করেন এবং
পৃষ্ঠা-২৯
ওয়াশিংটনে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত হিসাবে কর্মরত বগুড়ার মোহাম্মদ আলীকে প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত করেন। সোহরাওয়াদী জিন্নাহ আওয়ামী লীগের বিলুপ্ত ঘটিয়ে আওয়ামী মুসলিম লীগের বিলুপ্ত ঘটিয়ে নিখিল পাকিস্তান সংগঠন গড়ে তোলেন। তিনি নিজে সভাপতি এবং মাহমুদুল হক ওসমানী সাধারণ সম্পাদক হন। খাজা নাজিমউদ্দিন মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন : স্যার জাফরুল্লাহ খান, ফজলুর রহমান, মোহাম্মদ আলী, এ, এস, পীরজাদা, খাজা শাহাবুদ্দীন, এম. এ. গুরমানী, সরদার বাহাদুর খান, ডা, এ. এম. মালিক, সরদার আবদুর রব নিশতার, ডা. মাহমুদ হোসেন ও আই, এইচ, কোরাইশী। বগুড়ার মোহাম্মদ আলী মন্ত্রিসভায় স্থান প্রাপ্তরা। হলেন—স্যার মোহাম্মদ জাফরুল্লাহ খান, মোহাম্মদ আলী, এম. এ. ব্রোহী, খান। আবদুর কাইউম খান, শোয়েব কোরাইশী ও তোফাজ্জল আলী। ১৯৫৩ সালের ৯ জুলাই পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে শেখ মুজিব দলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন এবং আসন্ন নির্বাচনে মুসলিম লীগকে পরাজিত করার লক্ষ্যে মওলানা ভাসানী, শেরে বাংলা ফজলুল হক ও সোহরাওয়ার্দীর মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠার জন্য সচেষ্ট হন।
১৯৫৩ সালের ১৭ এপ্রিল পল্টন ময়দানে এক বিশাল জনসভায় সোহরাওয়ার্দী ঘোষণা করেন যে, “রাজবন্দীদের অবিলম্বে মুক্তি না দিলে আওয়ামী লীগ প্রবল গণ-আন্দোলন শুরু করবে।” তিনি এ জনসভায় মুসলিম লীগ সরকারের কঠোর সমালোচনা করেন। শেখ মুজিব এ জনসভায় ভাষণ দিতে গিয়ে বলেন যে, “মুসলিম লীগ সরকার আমাদের স্বাধীনতা বিরোধী সাম্রাজ্যবাদী শক্তির কাছে বিক্রি করে দিয়েছে। আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য ধ্বংসের মুখে! কৃষকের মুখের হাসি মিলিয়ে গেছে। অভাবে ও ঋণে জর্জরিত কৃষকরা আজ দিশেহারা। শ্রমিকদের অধিকার হরণ করা হয়েছে। সারাদেশে পুলিশ আর মুসলিম লীগ গুণ্ডাবাহিনীর নির্যাতনের মানুষ আজ অতিষ্ঠ।‘ শেরে বাংলা ফজলুল হকও অতিথি বক্তা হিসাবে এ জনসভায় ভাষণ দেন।
১৯৫৪ সালে পূর্ব পাকিস্তান ব্যবস্থাপক পরিষদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দেওয়া হয়। এ ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই রাজনৈতিক মহলে তুমুল উত্তেজনা শুরু হয়। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যে আলোচনা ও মেরুকরণ প্রক্রিয়া শুরু হয়। ভাষা আন্দোলনের পরে ১৯৫৩ সালে শেরে বাংলা ফজলুল হক সরকারের এটর্নি জেনারেলের দায়িত্ব থেকে পদত্যাগ করেন এবং জনসভায় তার লুপ্ত কৃষক শ্রমিক পার্টিকে পুনরুজ্জীবিত ঘোষণা করেন। রংপুরের আবু হোসেন সরকার, ঢাকার আবদুল লতিফ বিশ্বাস, ফরিদপুরের ইউসুফ আলী চৌধুরী, কুমিল্লার আশরাফ উদ্দীন চৌধুরী, বরিশালের আবদুল ওহাব খান (পরবর্তীকালে স্পীকার), চট্টগ্রামের নূরুল হক চৌধুরী, নোয়াখালীর হামিদুল হক
পৃষ্ঠা-৩০
চৌধুরী, রাজশাহীর লুৎফর রহমান খান, সৈয়দ আজিজুল হক নান্না মিয়া, আবদুস সাত্তার(পরবর্তীকালে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি) এ. এস. এম. সলায়ামান নবগঠিত ‘কৃষক-শ্রমিক’ পার্টিতে যোগ দেন।
শেরে বাংলা ১৯৫৪ সালে অনুষ্ঠেয় সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রতি নির্বাচনী ঐক্যের আহ্বান জানান। আওয়ামী লীগও তাতে সমর্থন জ্ঞাপন করে। এ নির্বাচনী ঐক্যে অন্যান্য দলের মধ্যে নেজামে ইসলামও অন্তর্ভুক্ত হয়। হক-ভাসানী-সোহরাওয়ার্দী এক ও অভিন্ন কর্মসূচির ভিত্তিতে এক রাজনৈতিক মোর্চায় মিলিত হন। ১৯৫৩ সালের ৪ ডিসেম্বর শুক্রবার একুশ দফা দাবির ভিত্তিতে যুক্তফ্রন্ট গঠিত হয়। আবুল মনসুর আহমেদ যুক্তফ্রন্ট নামকরণ করেছিলেন। আওয়ামী লীগের পক্ষে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এবং কৃষক-শ্রমিক পার্টির পক্ষে শেরে বাংলা ফলজুল হক এ ঐহিতাসিক দলিলে স্বাক্ষর করেন।
যুক্তফ্রন্টের ২১ দফা কর্মসূচি ছিল নিম্নরূপঃ
১। বাংলা ভাষা হবে পাকিস্তানের অন্যতম একটি রাষ্ট্রভাষা।
২। ক্ষতিপূরণ ব্যতিরেকে যে কোনো প্রকারের জমিদারী বিলুপ্তিকরণ এবং উদ্বৃত্ত জমি ভূমিহীন কৃষকদের বন্টন করের পরিমাণ হ্রাস।
৩। পাট শিল্পকে জাতীয়করণ, পাট উৎপাদকের জন্য উপযুক্ত মূল্য নির্ধারণ। মুসলিম লীগ আমলের পাট শিল্পের দালালদের অনুসন্ধান করে তাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্তকরণ।
৪। সমবায় শিল্প প্রথা প্রতিষ্ঠা দ্বারা কুটির শিল্প ও শ্রমশিল্পের উন্নতি।
৫। লবণ শিল্পে পূর্ব পাকিস্তানের স্বনির্ভরতার জন্য এ শিল্পের পত্তন এবং পাট-দালালদের মত লবণ শিল্পের দালালদের সম্বন্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ।
৬। সর্বপ্রকার উদ্বাস্তু-বিশেষত কারিগর ও শিল্প-শ্রমিকদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা গ্রহণ।
৭। বন্যা ও দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধের জন্য সেচ-পরিকল্পনা।
৮। পূর্ববঙ্গে শিল্প প্রতিষ্ঠার দ্বারা শিল্প শ্রমিকদের আর্থিক ও সামাজিক নিরাপত্তা বিধান।
৯। বাধ্যতামূলক অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা এবং শিক্ষকদের উপযুক্ত বেতন ও ভাতার ব্যবস্থা।
১০। সরকারি ও বেসরকারি ব্যবস্থা বিলোপের দ্বারা প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা পুনর্বিন্যাস এবং মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তন।
পৃষ্ঠা-৩১
১১। ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্ত কালাকানুন বাতিল করে তাদের স্বাধীন বিশ্ববিদ্যালয় রূপান্তরকরণ।
১২। প্রশাসনিক ব্যয় সংকোচন, উচ্চ ও নিম্ন পর্যায়ের কর্মচারীদের বেতনে সমতা আনয়ন। যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রীরা ১,০০০ টাকার বেশি বেতন গ্রহণ করবেন না।
১৩। সর্বপ্রকার দুর্নীতি, আত্মীয় পোষণ, উৎকোচের অবসান এবং এ উদ্দেশ্যে ১৯৪০ সালের পরের সময়ের প্রত্যেক সরকারি অফিসার ও বাণিজ্যপতিদের সম্পত্তির হিসাব গ্রহণ।
১৪। বিভিন্ন জননিরাপত্তা আইন ও অর্ডিন্যান্স কর্তৃক ধৃত সকল বন্দীর মুক্তি এবং সভাসমিতি, প্রেস ও বাক-স্বাধীনতা দান।
১৫। বিচারব্যবস্থা ও প্রশাসনব্যবস্থা পৃথকীকরণ।
১৬। বর্ধমান ভবনকে প্রথমে ছাত্রাবাস এবং পরে বাংলাভাষা ও সাহিত্যের গবেষণাগারে পরিণতকরণ।
১৭। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলা ভাষা আন্দোলনের শহিদদের স্মৃতিতে একটি শহিদ স্তম্ভ নির্মাণ ও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারবর্গের ক্ষতিপূরণ।
১৮। ২১ ফেব্রুয়ারি ‘শহিদ দিবস’ এবং ছুটির দিন ঘোষণা।
১৯। ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে প্রতিরক্ষা, বৈদেশিক সম্পর্ক এবং মুদ্রাব্যবস্থা ছাড়া অন্য সকল বিষয়ে পূর্ববঙ্গের স্বাধিকার প্রতিষ্ঠা । প্রতিরক্ষা বিষয়েও পূর্ববঙ্গে যেমন থাকবে ‘নেভি হেড কোয়ার্টাস’, পূর্ববঙ্গকে অস্ত্র ব্যাপারে স্বনির্ভর করার জন্য তেমনি পূর্ববঙ্গে হবে ‘অস্ত্র কারখানা প্রতিষ্ঠা। আনসারদের পুরোপুরি সৈনিকরূপে স্বীকৃতি।
২০। যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা কোনো কারণেই আইনসভা বা মন্ত্রিসভা কার্যকাল বৃদ্ধি করবে না এবং যাতে নির্বাচন কমিশনারের মাধ্যমে স্বাধীন পক্ষপাতহীন নির্বাচন হতে পারে তার জন্য তারা নির্বাচনের দুমাস পূর্বে পদত্যাগ করবে।
২১। প্রত্যেকটি আইনসভা সদস্যদের শূন্যপদ শূন্য হওয়ার তিনমাসের মধ্যে উপ-নির্বাচন দ্বারা পূর্ণ করা হবে এবং যদি যুক্তফ্রন্ট মনোনীত প্রার্থী পর পর তিনটি উপনির্বাচনে পরাজিত হন তবে মন্ত্রিসভা স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করবে।
আবুল মনসুর আহমদ মওলানা ভাসানীর রূপরেখা অনুযায়ী এ ঐতিহাসিক ২১ দফার মূল খসড়া প্রণয়ন করেন। এডভোকেট কমরুদ্দীন আহমেদ আবুল
পৃষ্ঠা-৩২
মনসুর আহমদকে সক্রিয়ভাবে সহযোগিতা করেন এবং হক-ভাসানীর বৈঠকে চড়ান্তভাবে উপস্থাপিত হবার পূর্বে সোহরাওয়াদী এর চূড়ান্ত রূপদান করেন। উল্লেখ্য ১৯৫৩ সালের ১৫ নভেম্বর নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে যে ৪২ দফা কর্মসূচি গৃহীত হয়েছিল তার ওপর ভিত্তি করেই ২১ ফেব্রুয়ারির সঙ্গে সাদৃশ্য রেখে ২১ দফা প্রণীত হয়।
সোহরাওয়ার্দী ভবিষ্যদ্বাণী করেন যে, মুসলিম লীগ সরকার মাত্র ৯টি আসনে জয়ী হতে পারবে। তার এ ভবিষ্যদ্বাণী অক্ষরে অক্ষরে প্রতিফলিত হয়। এ নির্বাচনে শেখ মুজিব গোপালগঞ্জ নির্বাচনী এলাকায় ওয়াহিদুজ্জামানের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন এবং ১৩ হাজার ভোটের ব্যবধানে বিজয়ী হন। পূর্ব বাংলার তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নূরুল আমিন যুক্তফ্রন্ট প্রার্থী ২৫ বছর বয়স্ক খালেক নওয়াজের কাছে পরাজিত হন। ১৯৫৪ সালের ১১ মার্চ এ সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং ২ এপ্রিল সরকারিভাবে এ নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশ করা হয়।
ঢাকা সদরঘাটে ৫৬ সিমসন রোডে যুক্তফ্রন্টের সদর দপ্তর স্থাপিত হয়। নির্বাচনী ফলাফলে দেখা যায়, সোহরাওয়ার্দীর ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী মুসলিম লীগ মাত্র ৯টি আসন লাভ করেছে। নির্বাচনী ফলাফলে দেখা যায় ২৩৭টি আসনের মধ্যে যুক্তফ্রন্ট ২২২টি আসনে জয়লাভ করেছে। স্বতন্ত্র ৫ জন প্রার্থী ও খেলাফতে রাব্বানীর ১ জন প্রার্থী জয়লাভ করেছে।
অবশ্য পরে চট্টগ্রাম থেকে স্বতন্ত্রপ্রার্থী ফজলুল কাদের চৌধুরী মুসলিম লীগে যোগদান করেন। ফলে এরা পরিষদে গ্রুপ তৈরি করতে সক্ষম হয় এবং মুসলিম লীগ গ্রুপের নেতা নির্বাচিত হন রংপুরের পনিরউদ্দীন। অমুসলিম আসনে কংগ্রেস-২৪, তফসিলী ফেডারেশন-২৯, সংখ্যালঘু যুক্তফ্রন্ট-৯, কমিউনিস্ট-৫, গণতন্ত্রী দল-২, বৌদ্ধ-২ ও খ্রিষ্টান-১টি আসনে জয়লাভ করে। যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে অভূতপূর্ব সাংগঠনিক দক্ষতা প্রদর্শন করেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ও শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে ময়মনসিংহের নান্দাইল এলাকা ছিল পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী নূরুল আমিনের এলাকা। নির্বাচন স্ট্রাটেজি হিসাবে নান্দাইলের এক ঐতিহাসিক জনসভায় তিন নেতা শেরে বাংলা ফজলুল হক, মওলানা ভাসানী ও সোহরাওয়ার্দী ভাষণ দেন। পর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে নূরুল আমিন এ নির্বাচনে নিদারুণভাবে পরাজিত হন। ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনের পর শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক যুক্তফ্রন্ট পার্লামেন্টারী পার্টির নেতা নির্বাচিত হন। শেরে বাংলা ফজলুল হককে মন্ত্রিসভা গঠনের সুযোগ দেওয়া হয়। যদিও আওয়ামী লীগ ১৪ টি আসন লাভ করেছিল তবুও শেরে বাংলার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও বয়সের কথা বিবেচনা করে
পৃষ্ঠা-৩৩
তাঁকে পার্লামেন্টারী পার্টির নেতা মনোনীত করা হয়। শেরে বাংলা ফজলুল হক মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে শপথ গ্রহণ করলেন। মুখ্যমন্ত্রী এ. কে. ফজলুল হক যে মন্ত্রিসভা গঠন করেন তাতে বৃহৎ দল আওয়ামী লীগের কোনো প্রতিনিধিকে স্থান না দেওয়ায় যুক্তফ্রন্টে ভাঙনের সূত্রপাত হয়। যুক্তফ্রন্টের অভ্যন্তরে আওয়ামী লীগ ও কৃষক-শ্রমিক পার্টির অন্তদ্বন্দ্ব চরমে উঠে। অবশ্য অল্পদিন পরে শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক আওয়ামী লীগ থেকে কয়েকজন সদস্যকে মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত করেন। শেখ মুজিব এ সময় প্রাদেশিক মন্ত্রিসভার কনিষ্ঠ সদস্য (কৃষি ও বনমন্ত্রী) হিসাবে শপথ গ্রহণ করেন। এ সময়েই বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের। অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয় এবং পরে ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্রে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের এ অভূতপূর্ব বিজয় কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ সরকারকে দারুণভাবে আতঙ্কিত করে তোলে। পূর্ব বাংলায় শেরে বাংলা ফজলুল হকের নেতৃত্বে সরকার গঠনের ফলে পাকিস্তানিরা চক্রান্তে লিপ্ত হয়। শুরু হয় জঘন্য ষড়যন্ত্র।
গোলাম মোহাম্মদ তখন পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল। ইতিহাসে গোলাম মোহাম্মদ কুখ্যাত ষড়যন্ত্রের নায়ক হিসাবে সর্বজনবিদিত। যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভাকে অকার্যকর করার জন্য সরকারি উস্কানিতে আদমজী জুট মিলে বাঙালি অবাঙালি শ্রমিকদের ভয়াবহ দাঙ্গা বেধে যায়। এ দাঙ্গায় সহস্রাধিক বাঙালি শ্রমিক নিহত হয়। আদমজী জুট মিলের শ্রমিক ইউনিয়ের সভাপতি ছিলেন মওলানা ভাসানী। বাঙালি শ্রমিকেরা স্বাভাবিকভাবেই যুক্তফ্রন্টে ভোট দেয়। বাঙালি-বিহারী দাঙ্গাজনিত কারণে বিরাজমান অশান্ত রাজনৈতিক পরিবেশের জন্য কেন্দ্রীয় সরকার যুক্তফ্রন্ট সরকারকে দায়ী করে। শেরে বাংলাকে জরুরিভাবে পশ্চিম পাকিস্তানে তলব করা হয়।
যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা গঠনের ২৭ দিন পরে মুখ্যমন্ত্রী শেরে বাংলা ফজলুল হক কলকাতা সফরে যান। দীর্ঘদিন পরে পুরাতন বান্ধবদের সঙ্গে সাক্ষাত করা এ সফরের উদ্দেশ্য ছিল। ভাষা আন্দোলনের সময় তিনি পুলিশের লাঠিচার্জে আঘাত প্রাপ্ত হন। তাঁর এককালীন বন্ধু ডা. বিধানচন্দ্র রায়ের কাছে চিকিৎসা কাজেও তিনি কলকাতা যান। ১৯৫৪ সালের ৩০ এপ্রিল বেলা সাড়ে তিনটায়। অরিয়েন্ট এয়ার ওয়েজে শেরে বাংলা ফজলুল হক ‘দমদম এয়ারপোর্টে অবতরণ করেন। তাঁর পত্নী ও দশ বছর বয়স্ক পুত্র তার সঙ্গে ছিলেন। বিপুল জনতা শেরে বাংলাকে অভ্যর্থনা জানায়। সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে শেরে বাংলা বলেন, “এখানে আমি পুরোনো বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে দেখা করতে এসেছি। আমি কলকাতা শহরে ষাট বছরেরও বেশি সময় আমার সেরা আনন্দময় দিনগুলি
পৃষ্ঠা-৩৪
কাটিয়েছি। সে সব পুরোনো স্মৃতি পুনরুদ্ধার করতে এবং সম্ভব হলে নতুন প্রেরণার সঞ্চার করতে আমি কলকাতা এসেছি। ভবিষ্যতেও আবার আসব।”
পরদিন সকালে শেরে বাংলা রাইটার্স বিল্ডিং-এ যান এবং ডা. বিধান চন্দ্র রায়ের সঙ্গে দেখা করেন। বহু পুরোনো বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে আন্তরিক হৃদ্যতাপূর্ণ আলোচনাসহ তিনি স্বাস্থ্য পরীক্ষা করেন। স্বাস্থ্য পরীক্ষা ছাড়াও দুই বাংলার মধ্যে বিরাজমান সমস্যাবলি নিয়েও আলোচনা হয়। দুই বাংলার মধ্যে ভিসা প্রথা বিলোপ, বাণিজ্য ও যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রবর্তন, সীমান্ত সংক্রান্ত বিধি-নিষেধ শিথিলকরণ, বাস্তুহারাদের দেশে ফিরিয়ে নেওয়ার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ ইত্যাদি বিষয় আলোচনায় স্থান পায়।
কলকাতাস্থ বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান শেরে বাংলাকে সংবর্ধনা জানায়। খিদিরপুরে এমনি এক সংবর্ধনার জবাবে শেরে বাংলা বলেন, “বাংলাকে রাজনৈতিক দিক থেকে দু’ভাগ করা হয়েছে সত্যি কিন্তু ভাষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যে উভয় বাংলার মধ্যে কোনো পার্থক্য নাই। রাজনীতিকরা বাংলাকে দু’ভাগ করে এ সংস্কৃতির ঐক্যের ফাটল ধরাতে পারেনি, ভবিষ্যতেও পারবে না।“কলকাতা থেকে বিদায়ের আগে শেরে বাংলা বলেন যে, “একদল লোক বিশেষ করে প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সম্পাদক আমার কথার বিরূপ মন্তব্য করেছেন। আমি তাদের কোনো সমালোচনার জবাব দিতে চাই না, শুধু বলতে চাই নির্বাচনে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়ে তাদের পক্ষে জনসাধারণের প্রতিনিধি হয়ে কথা বলা সাজে না।” তিনি আরও বলেন, “আমি অবশ্যই একজন পাকিস্তানি এবং আমি নিঃসন্দেহে মুসলিম লীগ পন্থী থেকে উৎকৃষ্ট পাকিস্তানি। কিন্তু আমি একজন পাকিস্তানি হওয়া সত্ত্বেও পূর্ব পশ্চিম বাংলার জনসাধারণে মধ্যে কোনো রাজনৈতিক বিচ্ছেদ হয়নি এমন ভেবে তাদের সম্পর্ক উন্নত ও সৌহার্দ করার চেষ্টায় কোনো দোষ দেখতে পাই না। আমি পুনর্বার কলকাতাবাসীদের তাদের সাদর ও আন্তরিক অভ্যর্থনার জন্য ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই। আমি আশা রাখি ও বিশ্বাস করি যে, দুই বাংলা মিলেমিশে কাজ করে তাদের যুগ্ম প্রচেষ্টায় সমৃদ্ধি ও সুখের পথে উত্তরোত্তর এগিয়ে যাবে।”
শেরে বাংলা ফজলুল হকের এ কলকাতা ভ্রমণ নিয়ে কুচক্রীমহল ষড়যন্ত্রে মেতে ওঠে। পাকিস্তানের তৎকালীন সরকার যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভার মাত্র ৫৭ দিনের মাথায় পূর্ব বাংলায় ৯২ (ক) ধারায় গভর্নরের শাসন জারি করে যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভাকে ক্ষমতাচ্যুত করে। ১৯৫৪ সালের ৩১ মে তৎকালীন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী বগুড়ার মোহাম্মদ আলী জাতির উদ্দেশ্যে এক বেতার ভাষণে শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হককে রাষ্ট্রদোহী আখ্যায়িত করেন। শের বাংলা ফজলুল
পৃষ্ঠা-৩৫
হককে তাঁর কে, এম, দাস লেনের বাসায় অন্তরীণ করা হয়। শেখ মুজিবর রহমানসহ হাজার হাজার রাজনৈতিক কর্মী ও নেতৃবৃন্দকে নিরাপত্তা আইন গ্রেফতার করা হয়। এ সময় মওলানা ভাসানী ইউরোপে হেলসিংকি শহরে বিশ্ব শান্তি সম্মেলনে যোগ দেওয়ার উদ্দেশ্যে দেশের বাইরে ছিলেন। পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ইস্কান্দার মির্জা ঘোষণা করেন যে, “এদেশে মওলানা ভাসানীর মতো রাষ্ট্রদোহীদের স্থান নাই এবং মওলানা ভাসানী দেশে ফেরার পরপরই তাকে একজন হাবিলদার দিয়ে গুলি করা হবে।”
উল্লেখ্য যে, শেরে বাংলা ফজলুল হক কলকাতা থেকে ঢাকা ফিরে আসার পর গভর্নর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদ এবং প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী তাঁকে করাচিতে ডেকে পাঠান। শেরে বাংলা ২১ মে, শুক্রবার করাচি পৌঁছান। সেখানে গভর্নর জেনারেল ও শেরে বাংলার মধ্যে তর্ক-বিতর্ক চলে। শেরে বাংলা পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসন দাবি করেন। পশ্চিমা শাসকরা শেরে বাংলার প্রতি এ মর্মে দোষারোপ করে যে, ভারতের সঙ্গে হক সাহেবের যোগসাজোস রয়েছে। মার্কিন সংবাদপত্র ‘নিউইয়র্ক টাইমস’-এর জন, ডি, কালাহান নামক এক সাংবাদিক কর্তৃক প্রেরিত রিপোর্টের ভিত্তিতে শেরে বাংলার প্রতি এ দোষারোপ করা হয়। স্বাক্ষী হিসাবে মি, কালাহানকে সেখানে উপস্থিতও করা হয়। মি. কালাহানের এ রিপোর্ট পাকিস্তান অবজারভারেও প্রকাশিত হয়। মি. কালাহানের রিপোর্টটি নিম্নরূপঃ “নিউইয়র্ক ২৩ মে নিউইয়র্ক টাইমস্ পত্রিকা আজ পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী এ. কে. জফলুল হকের এক সাক্ষাৎকার ছাপিয়েছে। এতে তাঁর বরাত দিয়ে বলা হয়েছে যে, পূর্ব বাংলা একটি স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার ইচ্ছা পোষণ করে।” পত্রিকাটি করাচিস্থ সংবাদদাতা প্রেরিত এ রিপোর্টটি প্রথম পৃষ্ঠায় ফলাও করে ছাপা হয় এবং ফজলুল হকের বক্তব্য হিসাবে বলা হয়, তার মন্ত্রী সভার অন্যতম কাজ হবে স্বাধীনতার ব্যবস্থা করা। ডেসপাসে উল্লেখ করা হয় যে, পাকিস্তানের সর্ববৃহৎ প্রদেশ পূর্ব পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দ বলেছেন তারা স্বাধীন হতে আগ্রহী। নিউইয়র্ক টাইমসে এ ধরনের খবর প্রকাশিত হওয়ায় রাজনৈতিক অঙ্গনে তুমুল প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। ২৪ মে করাচি থেকে শেরে বাংলা বলেন যে, “উল্লিখিত রিপোর্টটি ইচ্ছাকৃত, মিথ্যার বেসাতি ও প্রকৃত তথ্যের বিকৃতি।”
তিনি একবিবৃতিতে বলেন যে, আসলে আমি মার্কিন সাংবাদিককে সাক্ষাৎকার দানকালে যা বলেছি তা হচ্ছে পূর্ব পাকিস্তানে পক্ষে পাকিস্তানের একটি স্বায়ত্তশাসিত ইউনিট হওয়া প্রয়োজন—এ হচ্ছে আমাদের দর্শন এবং আমরা এজন্য সংগ্রাম করবো। আমি ঘুণাক্ষরেও বলিনি যে, আমাদের আদর্শ স্বাধীনতা। অপরদিকে কালাহান বলেন যে, ফজলুল হক এ মর্মে সাক্ষাতকার প্রদান করেন যে, সহস্রাধিক মাইল ভারতীয় এলাকা দিয়ে পূর্ব ও পশ্চিম
পৃষ্ঠা-৩৬
পাকিস্তান ভৌগোলিকভাবে পৃথক থাকার কারণেই বিয়াল্লিশ মিলিয়ন বাঙালি স্বাধীনতা দাবি করছে। এসোসিয়েটেড প্রেস অব পাকিস্তান এর এক রিপোর্টে বলা হয় যে, প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী (বগুড়া), শেরে বাংলা ও কালাহানকে একত্রিত করেন এবং উক্ত রিপোর্ট সম্বলিত পত্রিকাটি উপস্থাপন করেন। শেরে বাংলা এ প্রকাশিত বিবৃতি অস্বীকার করেন এবং সাংবাদিক কালাহান প্রকাশিত রিপোর্ট প্রত্যাহারে অস্বীকৃতি জানান।
ফজলুল হক করাচি থেকে ঢাকা ফেরার পথে কলকাতায় দমদম বিমান বন্দরে একঘণ্টা অবস্থান করেন। মন্ত্রিসভার তিনজন সদস্য-আজিজুল হক, আতাউর রহমান খান ও শেখ মুজিবুর রহমান তার সঙ্গে ছিলেন।
১৯৫৪ সালের ২৩ জুলাই কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ ঘোষণা হয়। ২৭ জুলাই প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী বগুড়া বলেন, “পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী এ. কে. ফজলুল হকের বিরুদ্ধে কোনো আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে না কারণ তিনি কলকাতা প্রদত্ত বক্তব্যের জন্য অনুতপ্ত। আওয়ামী লীগ মুসলিম লীগের নেতৃবৃন্দ ২ (ক) ধারা উঠে যাবে।” পূর্ব বাংলায় তিনি গণতন্ত্রের সরকার দেখতে চান। কিন্তু মোহাম্মদ আলী করাচিতে ফিরে গিয়ে ১ আগস্ট বলেন যে, পূর্ব বাংলার গভর্নর শাসন ব্যবস্থা বলবৎ রাখা প্রয়োজন। যতোদিন পর্যন্ত পূর্ব বাংলায় স্বাভাবিক অবস্থা না হয় ততোদিন গভর্নরের শাসন ব্যবস্থা বলবৎ থাকবে। এর কিছুদিন পর গভর্নর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদ এক বিবৃতিতে বলেন যে, হক সাহেব দেশদ্রোহী নন বরং তাকে পাকিস্তানের বন্ধু বলেই মনে করেন।” ফলে কৃতজ্ঞতাবশত হক সাহেব গোলাম মোহাম্মদের ঢাকা সফর কালে তার গলায় ফুলের মালা পরিয়ে দেন। একই সাথে আওয়ামী লীগের অন্যতম নেতা আতাউর রহমান খানও ফুলের মালা দিয়ে গভর্নর জেনারেলকে বরণ করেন। কার্জন হলে গোলাম মোহাম্মদকে অভিনন্দন জানানো হয়। ১৯৫৫ সালের জুন করাচি থেকে এক ঘোষণা বলে পূর্ব বাংলা থেকে গভর্নর শাসন ব্যবস্থা প্রত্যাহার করা হয়।
শেরে বাংলা ফজলুল হককে পুনরায় মন্ত্রিসভা গঠনের আহ্বান জানানো হয়। শেরে বাংলা ফজলুল হক নিজে মন্ত্রিসভা গঠন না করে আবু হোসেন সরকারকে মন্ত্রিসভা গঠনের দায়িত্ব প্রদান করেন। আবু হোসেন সরকার আওয়ামী লীগকে বাদ দিয়ে নেজামে ইসলাম পার্টির সঙ্গে কোয়ালিশনে সরকার গঠন করেন।
মওলানা ভাসানী তখন ইউরোপে। সোহরাওয়ার্দী ডায়াবেটিকস ও লিভারের জটিলতায় অসুস্থ। শেরে বাংলা ফজলুল হক তার বাসভবনে। এ সময় বগুড়ার মোহাম্মদ আলী গভর্নর জেনারেলের ক্ষমতা হ্রাস করে সংবিধানে গণ-পরিষদের চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য পেশ করে আমেরিকায় যান।
পৃষ্ঠা-৩৭
গভর্নর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদ টের পেয়ে জেনারেল আইয়ুব খানের সহায়তায় সমগ্র পাকিস্তানের জরুরি অবস্থা জারি করেন, গণপরিষদ বাতিল করেন এবং মন্ত্রিসভা ভেঙে দেন। ১৯৫৪ সালের ২২শে সেপ্টেম্বর প্রধানমনী। গভর্নর জেনারেলের ক্ষমতা খর্ব করার জন্য সচেষ্ট হন আর গভর্নর জেনারেল ১৯৫৪ সালের ২০ সেপ্টেম্বর দৈনিক ইত্তেফাককে জন নিরাপত্তা আইনে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নিউইয়র্কে ব্যস্ততম দিন কাটাচ্ছেন এমন সময় জেনারেল আইয়ুব খান লন্ডন হয়ে সেখানে উপস্থিত হন এবং ৭ অক্টোবর, মোহাম্মদ আলীর সঙ্গে সাক্ষাত করেন। এ সময়ে সোহরাওয়ার্দী চিকিৎসার জন্য জুরিখে অবস্থান করেছিলেন। আতাউর রহমান খান মওলানা ভাসানীর নির্দেশে লন্ডন রওনা হন। ১৯৫৪ সালের ১৬ অক্টোবর মওলানা ভাসানীর সঙ্গে দেখা করে তিনি জুরিখে যান।
বগুড়ার মোহাম্মদ আলী ১৯৫৪ সালের ২৩ অক্টোবর নিউইয়র্ক থেকে করাচি ফেরেন। এরপর ২৪ অক্টোবরে গণপরিষদ মন্ত্রিসভা বাতিল করে জরুরি অবস্থা জারি করা হয় ।এদিনই ৮ সদস্য বিশিষ্ট এক নতুন মন্ত্রিসভা গঠন করা হয়। এ মন্ত্রিসভাতেও বগুড়ার মোহাম্মদ আলী প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন এবং পাকিস্তানের প্রধান সেনাপতি জেনারেল আইয়ুব খান প্রতিরক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
১৯৫৪ সালের নভেম্বরে গণপরিষদের স্পীকার তমিজউদ্দীন খান গণপরিষদ ভেঙে দেওয়া সম্বলিত গভর্নর জেনারেলের ঘোষণার বিরুদ্ধে আদালতে আর্জি পেশ করেন।
এদিকে ১৯৫৪ সালের ১২ নভেম্বর সোহরাওয়ার্দী জুরিখ থেকে লন্ডনে এসে এক সংবাদ সম্মেলনে গভর্নর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদ গৃহীত পদক্ষেপগুলো সঠিক হয়েছে বলে মতামত প্রকাশ করেন। ১৯৫৪ সালের ২ ডিসেম্বর মাহমুদুল হক ওসমানী সাংবাদিকদের বলেন যে, আগামী ১১ ডিসেম্বরের মধ্যে সোহরাওয়ার্দী দেশে ফিরবেন। সোহরাওয়ার্দী করাচি এসে পৌছলেন ১৯৫৪ সালের ১২ ডিসেম্বর। বিমান বন্দরে তাঁকে উষ্ণ সংবর্ধনা জানানো হয়। সোহরাওয়ার্দী সাংবাদিকদের কিছুই বললেন না। বিমান বন্দর থেকে বেরিয়ে আসার সময় শুধু বললেন যে, “গভর্নর জেনারেল অচিরেই রাজবন্দীদের মুক্তি দেবেন।”
১৯৫৪ সালের ১৮ ডিম্বের সোহরাওয়ার্দীর চেষ্টায় শেখ মুজিব জেল থেকে মুক্তি পেলেন। ১৯৫৪ সালের ৩০ মে ৯২ (ক) ধারা জারির পরে তিনি গ্রেফতার হয়েছিলেন।
বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলনে বাঙালি তরুণদের আত্মদানের ফলে সুপ্ত বাঙালি জাতীয়বাদী চেতনা দ্রুত বিকাশ লাভ করতে থাকে। রাজনৈতিক চেতনার এ
পৃষ্ঠা-৩৮
পটভূমিতে ১৯৫৩ সালে ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন কর্তৃক গঠিত গণতান্ত্রিক যুক্তফ্রন্ট পরিষদ জয়লাভ করে। ১৯৫৪ সালে অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনকে কেন্দ্র করে স্বৈরাচার ও প্রতিক্রিয়াশীল চক্রকে পরাজিত করার আকাক্ষা দুর্বার হতে থাকে। পূর্ব বাংলার ছাত্রসমাজ পূর্ব বাংলার মাটি থেকে মুসলিম লীগকে উৎখাত করার লক্ষ্যে সমস্ত বিরোধী দলের সমন্বয়ে একটি যুক্তফ্রন্ট গঠনের ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ছাত্রদের গণতান্ত্রিক যুক্তফ্রন্ট বিরাজমান রাজনৈতিক অনৈক্য ও বিভেদের মাঝখানে পথ প্রদর্শকের ভূমিকা পালন করে।
নেতাজী ভবনে এক সংবর্ধনার জবাবে বিরাশি বছর বয়স্ক শেরেবাংলা ফজলুল হক আবেগ আপ্লুত কণ্ঠে বলেন, বাঙালি এক অখণ্ড জাতি। তারা এক ভাষায় কথা বলে এবং একই সুসংহত দেশে বাস করে। তাদের আদর্শ এক এবং জীবনধারণের প্রণালিও এক। বাংলা অনেক বিষয়ে সারা ভারতকে পথ প্রদর্শন করেছে এবং দেশ বিভাগ সত্ত্বেও জনসাধারণ তথাকথিত নেতৃবৃন্দের উর্ধ্বে থেকে কাজ করতে পারে।…আজ আমাকে ভারতের ভবিষ্যৎ ইতিহাস গঠনে অংশগ্রহণ করতে হচ্ছে। আশা করি ভারত কথাটি ব্যবহার করায় আমাকে আপনারা ক্ষমা করবেন। আমি এর দ্বারা পাকিস্তান ও ভারত উভয়কে বুঝিয়েছি। এ বিভাগকে আমি কৃত্রিম বিভাগ বলে মনে করতে চেষ্টা করব। আমি ভারতের সেবা করব।’ ৪ মে গ্রান্ড হোটেলে অনুরূপ এক সংবর্ধনার জবাবে তিনি বলেন, পশ্চিম বঙ্গের চেয়ে পূর্ব বঙ্গে বঙ্গভাষার জন্য উৎসাহ বেশি। এমনকি বঙ্গভাষাকে রাষ্ট্রীয় ভাষায় পরিণত করার জন্য পূর্ববঙ্গে একটি ক্ষুদ্র শিশুও প্রাণ পর্যন্ত বিসর্জন দিতে প্রস্তুত। আসুন, আমরা রাজনীতি ভুলে আমাদের মহান সংহতির ধারক শ্রেষ্ঠ ভাষার ঐতিহ্যের কথা চিন্তা করি। বাংলার মঙ্গল, বাংলা ভাষার সেবা, বাঙালি জাতির উন্নতি, হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে জনসাধারণের সেবায় জীবনের অবশিষ্ট দিনগুলো নিয়োজিত করাই জীবনের একমাত্র আকাঙ্ক্ষা। জীবনের প্রান্ত সীমায় পৌছে আমার আর কোনো আশা বা আকাঙক্ষা নেই। উভয় বঙ্গের মধ্যে যে মিথ্যার প্রাচীর রচিত হয়েছে, তা অপসারিত করার কাজ আমি যদি আরম্ভ করে যেতে পারি, তাহলেই নিজেকে ধন্য মনে করব। দুই বাংলার মধ্যে যে ব্যবধান আছে তা একটি স্বপ্ন ও ধোকা মাত্র। করুণাময় খোদাতালার দরবারে আমার একটি প্রার্থনা তিনি যেন এ ব্যবধান দূর করেন। আমার এ আকাঙ্ক্ষা যেন পূর্ণ হয়। সে জন্যে আপনারা আমাকে দোয়া করুন।”
সোহরাওয়ার্দী ২০ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী বগুড়ার অধীনে আইনমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। অথচ ১৯৪৬ সালে যুক্ত বাংলায় সোহরাওয়ার্দীর অধীনে বগুড়ার মোহাম্মদ আলী অর্থমন্ত্রী ছিলেন। সোহরাওয়ার্দী আইনমন্ত্রী হওয়ার পর এক ইউনিট প্রথা ও সংখ্যাসাম্য নীতি সমর্থন করেন,
পৃষ্ঠা-৩৯
এবং গণ পরিষদের পরিবর্তে কনভেনশনের মাধ্যমে শাসনতন্ত্র প্রণয়ন উত্থাপন করেন। এ নিয়ে রাজনৈতিক মহলে তুমুল বিতর্কের সূত্রপাত হয় ।
জুন মাসে নতুন গণপরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ।পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল পদে অধিষ্ঠিত হন জেনারেল ইসকান্দার মির্জা। কৃষক-শমিক পার্টির সমর্থনে চৌধুরী মোহাম্মদ আলীর নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা গঠিত হয়।
১৯৫৫ সালের ১৫ ডিসেম্বর মওলানা ভাসানী কলকাতায় তাঁর স্বেচ্ছা নির্বাসন শেষে ঢাকা ফিরে এলেন এবং শেখ মুজিব কারাগার থেকে মুক্তি পেলেন। যুক্তফ্রন্টে আওয়ামী লীগের সদস্য সংখ্যা ছিল সর্বাধিক। তবুও আওয়ামী লীগকে বাদ দিয়ে যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রিসভা গঠন করার ফলে ভাঙন অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে। আওয়ামী লীগ বিরোধী দলের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়।।
পাঞ্জাব, সীমান্ত প্রদেশ, বেলুচিস্তান ও সিন্ধু—এ চারটি প্রদেশের সমন্বয়ে পশ্চিম পাকিস্তানকে একটি প্রদেশে পরিণত করা হয়। সংখ্যাসাম্য নীতির অর্থ ছিল জনসংখ্যার ভিত্তিতে গণ পরিষদ সদস্যের সংখ্যা নির্ধারণ না করে পূর্ব পাকিস্তান থেকে ৪০ জন (এর মধ্যে মুসলমান আসন ৩১ এবং অমুসলমান আসন ৯) এবং পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ৪০ জন গণপরিষদ সদস্য নির্বাচিত হবেন। সারা দেশে এর বিরুদ্ধে জনগণ প্রতিবাদে সোচ্চার হয়। বাঙালি বুদ্ধিজীবী ও রাজনৈতিক নেতারা জনসংখ্যার ভিত্তিতে গণপরিষদে প্রতিনিধিত্ব করার দাবি উত্থাপন করেন। ১৯৫৬ সালে ৯ জানুয়ারি গণপরিষদে নতুন শাসনতন্ত্র রচনার কাজ শুরু হয়। নতুন শাসনতন্ত্রে এক ইউনিট ও সংখ্যাসাম্য নীতি গৃহীত হয়। এর ফলে আবহমান পূর্ব বাংলা সরকারিভাবে পূর্ব পাকিস্তানে পরিণত হয় এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ পূর্ব বাংলা প্রকৃতপক্ষে সংখ্যালঘিষ্ঠে পরিণত হয়।
এদিকে মাত্র ৯ মাস মন্ত্রী থাকার পর ১৯৫৫ সালের আগস্ট মাসে সোহরাওয়ার্দী মন্ত্রিসভা থেকে বাদ পড়েন। সর্বস্তরের জনগণের এক সমাবেশে ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তোলার লক্ষ্যে সর্বদলীয় কর্মপরিষদ গঠিত হয়। আওয়ামী লীগ, গণতন্ত্রী দল, যুবলীগ, ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন এবং ছাত্রী সংসদ সমম্বয়ে এ পরিষদ গঠিত হয়। মওলানা ভাসানী এ পরিষদের চেয়ারম্যান এবং অলি আহাদ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
এ পরিষদের আহ্বানে ২৯ জানুয়ারি (১৯৫৬) দেশব্যাপী প্রতিরোধ দিবস পালিত হয় এবং ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সংবিধানের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সপ্তাহ পালিত হয়।
১৯৫৬ সালের ২৩ মার্চ থেকে নতুন শাসনতন্ত্র চালু করা হলো। ঐ দিনটিকে সারাদেশে মহা আড়ম্বরে পাকিস্তান দিবস’ হিসেবে উদ্যাপন করা
পৃষ্ঠা-৪০
হলো। শেরে বাংলা ফজলুল হক তখন পূর্ব বাংলা গভর্নর ছিলেন। নতুন শাসনতন্ত্রের অধীনে তিনি আবার আবু হোসেন সরকারকে নেতৃত্বে মন্ত্রিসভাকে শপথ গ্রহণ করালেন।
ইস্কান্দার মির্জা গোলাম মোহাম্মদের পরে পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল হন এবং চৌধুরী মোহাম্মদ আলীকে পুনরায় প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করেন। আগে গোলাম মোহাম্মদের আমলে চৌধুরী মোহাম্মদ আলী বগুড়ার মোহাম্মদ আলীকে অপসারণ করে প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন।
আর হোসেন সরকার ক্ষমতাসীন থাকাকালে পূর্ব বাংলায় প্রচণ্ড খাদ্যাভাব দেয়। খাদ্যের দাবিতে ভুখা-মিছিলের ওপর গুলিবর্ষণের ফলে আবু হোসেন সরকারের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ অনাস্থা প্রস্তাব আনে। গভর্নর ফজলুল হক ১৯৫৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর আতাউর রহমান খানকে মন্ত্রিসভা গঠনের আহ্বান আনন। ১২ সেপ্টেম্বর সোহরাওয়ার্দী পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা গঠন করেন। ১৯৫৭ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ঐতিহাসিক কাগমারী সম্মেলনে পাকিস্তানি শাসকচক্রের বিরুদ্ধে চরম হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন যে, পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসন আদায় না হলে পূর্ব বাংলা পশ্চিম পাকিস্তানকে আসসালামু আলাইকুম জানাবে। এ মঞ্চে তখন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শহীদ সোহরাওয়ার্দী উপবিষ্ট ছিলেন। বর্ষীয়ান জননেতা মওলানা ভাসানী সরাসরি স্বাধীনতার কথা না বললেও তিনি তাঁর ভাষণের মাধ্যমে স্বাধীনতার বীজ বপন করেছিলেন।
১৯৫৭ সালের ৩ এপ্রিল প্রাদেশিক পরিষদের অধিবেশনে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের দাবি উত্থাপন করেন আওয়ামী লীগ নেতা মহিউদ্দিন আহমদ। অধ্যপক মোজাফফর আহমদ, আসহাব উদ্দিন আহমদ ও শেখ মুজিব এ দাবির সমর্থনে বক্তৃতা করেন।
বৈদেশিক নীতির প্রশ্নে সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে মতপার্থক্যের কারণে মওলানা ভাসানী আওয়ামী লীগ থেকে পদত্যাগ করেন এবং ১৯৫৭ সালের ২৭ জুলাই পূর্ব পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি গঠন করেন। গভর্নর জেনারেল ইসকান্দার মির্জা ও চৌধুরী মোহাম্মদ আলীর মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা দিলে ইসকান্দার মির্জা কর্তৃক রাতারাতি গঠিত রিপাবলিকান পার্টি ও আওয়ামী লীগের কোয়ালিশন মন্ত্রিসভা গঠিত হয়। ১২ সেপ্টেম্বর সোহরাওয়ার্দী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। ইসকান্দার মির্জা সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের সমর্থন নেই এ অজুহাতে ১১ অক্টোবর (১৯৫৭) সোহরাওয়ার্দীকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করেন এবং মুসলিম লীগ নেতা আই আই চুন্দ্রীগড়কে প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত করেন। ৫৯
পৃষ্ঠা-৪১
দিন পরে ১৬ ডিসেম্বর ফিরোজ খান নুন প্রধানমন্ত্রী হন। ফিরোজ খান নুন ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্র অনুযায়ী ১৯৫৯ সালে ১৬ ফেব্রুয়ারি সাধারণ নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করেন। ১৯৫৮ সালের ১ মার্চ গভর্নর ফজলুল হক আওয়ামী লীগের আতাউর রহমান খানের মন্ত্রিসভা বাতিল করেন। সোহরাওয়াদী প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে প্রধানমন্ত্রী ফিরোজ খান নুনকে দিয়ে ফজলুল হককে পদচ্যুত করাতে সক্ষম হন। আবু হোসেন সরকার পুনরায় মন্ত্রিসভা গঠন করেন, কিন্তু ১২ ঘন্টা পরে তার মন্ত্রিসভা বরখাস্ত হয়। পুনরায় আতাউর রহমান খান মন্ত্রিসভা গঠন করেন। কিন্তু ১৯ জুন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি সমর্থন প্রত্যাহার করার ফলে আতাউর রহমান মন্ত্রিসভার পতন ঘটে। আওয়ামী লীগ-ন্যাপ সমঝোতা হলে আতাউর রহমান খান ২২ জুলাই পুনরায় মুখ্যমন্ত্রী হন।
১৯৫৮ সালের সেপ্টেম্বর প্রাদেশিক পরিষদের অধিবেশন আহবান করা হয়। আওয়ামী লীগ স্পীকার আব্দুল হাকিমকে পাগল আখ্যায়িত করে স্পীকারের। বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনলে ২১ সেপ্টেম্বর পরিষদ কক্ষে ভীষণ বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। ডেপুটি স্পীকার শাহেদ আলী এ ঘটনায় গুরুতরভাবে আহত হন এবং হাসপাতালে প্রাণত্যাগ করেন। দেশের এ নাজুক রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে পাকিস্তানের ভাগ্যাকাশে শুরু হয় দুর্যোগের ঘনঘটা। ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট তথা বাঙালির বিজয় পাকিস্তানের শাসনব্যবস্থায় বাঙালিদের অংশগ্রহণের পথ প্রশস্ত করেছিল, কিন্তু পাঞ্জাবি সামরিক-বেসামরিক আমলাদের কাছে তা মোটেই গ্রহণযোগ্য ছিল না। তারা অজুহাত খুঁজছিলেন ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করে একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার। ডেপুটি স্পীকার শাহেদ আলী হত্যাকাণ্ড ও রাজনীতিকদের দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণ একটা অজুহাত খাড়া করে দিল। পাঞ্জাবি সামরিক-বেসামরিক চক্র সামরিক শাসন জারির পায়তারা শুরু করে দিল।
চরম রাজনৈতিক অস্থিরতা ক্ষমতা, রদবদল, ব্যক্তিগত আক্রোশ ও কুৎসা রটনা, ক্ষমতার দ্বন্দ্ব, রাজনৈতিক দলগুলোর অনৈক্য ও ভাঙনের ফলে পাকিস্তানে রাজনীতিতে নেমে এল ঘোর অমানিশা। ১৯৫৮ সালের মে মাসে জেনারেল আইয়ুব খান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যান। আইয়ুব পেন্টাগনের জেনারেল নাথান টুইনিং, জেনারেল ওমর ব্রাডলী, পররাষ্ট্র সচিব জন ফস্টার ডালেস ও সিআইএ’র এ্যালান ডালেসের সঙ্গে সলা-পরামর্শ করে ১৮ মে দেশে ফিরে আসেন। এ বছরের ৭ অক্টোবর ইসকান্দার মির্জা সারাদেশে সামরিক আইন জারি করলেন, নুন-মন্ত্রিসভা ভেঙে দিলেন এবং ‘৫৬ সালের সংবিধান বাতিল ঘোষণা করলেন। পাকিস্তানে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা চিরতরে বিলুপ্ত হলো। শুরু হলো
পৃষ্ঠা-৪২
পাকিস্তানের ইতিহাসে এক অন্ধকারময় অধ্যায়। জেনারেল আইয়ুব খানকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করেন। আর ২৭ অক্টোবর আইয়ুব খান রাতের অন্ধকারে ইসকান্দার মির্জাকে ক্ষমতাচ্যুত করেন এবং দেশত্যাগে বাধ্য করেন। এভাবেই আইয়ুব খানের বহুদিনের উচ্চাভিলাষ পূর্ণ হলো । সর্বময় ক্ষমতা দখল করে আইয়ুব খান পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে আবির্ভূত হলেন। শেখ মুজিব ৮ অক্টোবর সকালে সামরিক আইন জারির কথা জানতে পারেন। মওলানা ভাসানী, শেখ মুজিব , আবুল মনসুর আহমদ ও অন্যান্য নেতাকে গ্রেফতার করা হয়। দেশের রাজনৈতিক দলগুলকে বিলুপ্ত করে দেওয়া হলো এবং সকল রাজনৈতিক কার্যকলাপ বন্ধ করে দেওয়া হলো। ১৯৫৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর আইয়ুব খান পাকিস্তানের সব ভাষার জন্যে রোমান হরফ এবং একটি সাধারণ ভাষা সষ্টির প্রস্তাব করেন। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ঢাকা থেকে এর প্রতিবাদ করা হয়। অধ্যাপক মুহম্মদ আবদুল হাই ও অপ্যাপক মুনীর চৌদুরী এর তীব্র প্রতিবাদ করেন। বাঙালি বুদ্ধিজীবীরা ভবিষ্যতের দুর্যোগময় দিনগুলোর কথা চিন্তা করে শিউরে উঠলেন।
আইয়ব খান তখন তার জাল ফেলতে শুরু করেছেন। ১৯৫৯ সালের ৭ আগস্ট তিনি দুটো আইন জারি করলেন। এর একটি হলো পোডো (পাবলিক অফিস ডিসকোয়ালিফিকেশন অর্ডার) এবং অপরটি এবডো (ইলেকটিভ বডি ডিসকোয়ালিফিকেশন অর্ডার)। ১৯৫৯ সালের ২৬ অক্টোবর আইয়ুব খান নিজেকে ফিল্ড মার্শাল হিসেবে ঘোষণা করলেন এবং পরদিন ২৭ অক্টোবর তিনি পালন করলেন তাঁর বিপ্লবের প্রথম বার্ষিকী। ক্ষমতা দখলের প্রথম বার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে তিনি বেসিক ডেমোক্রেসি বা বুনিয়াদী গণতন্ত্র নামে একটি পরিকল্পনা ঘোষণা করেন। আইয়ুব খানের আসল উদ্দেশ্য জনগণের কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল। পোডো এবং এবডো দিয়ে সোহরাওয়ার্দী, মওলানা ভাসানীসহ সকল রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে রাজনীতি থেকে দূরে রাখার আইন প্রণয়ন ও বুনিয়াদী গণতন্ত্র চালুর ফলে সার্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে সংসদীয় গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ অন্ধকারময় হলো। বুনিয়াদী গণতন্ত্র প্রবর্তনের ফলে উভয় প্রদেশে ৮০ হাজার মৌলিক গণতন্ত্রী নির্বাচিত হতে পারবেন এবং ৮০ হাজার মৌলিক গণতন্ত্রী সদস্য দেশের প্রেসিডেন্ট, জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য নির্বাচিত করেন।
ময়মনসিংহের ছাত্ররা আইয়ুব খানের সামরিক শাসন জারির সঙ্গে সঙ্গে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে। প্রাক্তন ছাত্রনেতা কাজী আবদুল বারির নেতৃত্বে ছাত্ররা প্রাতবাদ মিছিল বের করে। এ অপরাধে কাজী আব্দুল বারিকে গ্রেফতার করা হয়।
পৃষ্ঠা-৪৩
এবং সামরিক আদালতে ১০টি বেত্ৰদণ্ড প্রদানের শাস্তি দেওয়া হয়। এমনভাবে এ দণ্ড কার্যকর করা হয় যে, তিনি সারা জীবনের জন্যে বধির হয়ে যান।
১৯৬১ সালে যখন রবীন্দ্র জন্ম শতবার্ষিকী উদযাপিত হচ্ছিল, তখন পূর্বপাকিস্তানে রবীন্দ্র জন্ম শতবার্ষিকী যেন উদযাপিত না হতে পারে সেই লক্ষ্যে ষড়যন্ত্র চালানো হয়। খাজা শাহাবউদ্দিনের জামাতা মুসা আহম্মদ তখন পূর্ব পাকিস্তানের তথ্য সচিব। বাংলা একাডেমিতে এ বছর রবীন্দ্র জন্ম-শতবার্ষিকী উপলক্ষে কোনো অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়নি। কিন্তু বিচারপতি মাহবুব মোর্শেদ ও অধ্যাপক খান সরওয়ার মুরশিদ-এর নেতৃত্বে গঠিত রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী কমিটি সপ্তাহকালব্যাপী অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। এভাবেই আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনের প্রথম প্রকাশ ঘটে। এ সময় পূর্ব বাংলার অর্থনীতিবিদদের আলোচনা মধ্য দিয়ে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে অর্থনেতিক বৈষম্য ও পশ্চিম পাকিস্তান কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তানকে শোষণের স্বরূপ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। পূর্ব বাংলার অর্থনীতিবিদরা পাকিস্তানের দুই অংশের জন্য। পৃথক অর্থনীতি প্রবর্তনের প্রয়োজনীয়তার কথা প্রচার করতে থাকেন। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক রেহমান সোবহান ‘টু ইকোনোমি থিউরি’ প্রচার করেন। ১৯৬০ সালের ১১ জানুয়ারি আইয়ুব খানের পরিকল্পনা অনুযায়ী মৌলিক গণতন্ত্রী সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো। এ নির্বাচনে ৮০ হাজার মৌলিক গণতন্ত্রী নির্বাচিত হলেন। নিন্দুকেরা বলল ৮০ হাজার ফেরেশতা পয়দা করা হলো। ১৯৬০ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হলো। আইয়ুব খান প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী। এ নির্বাচনের তাঁর কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন না। ৮০ হাজার মৌলিক গণতন্ত্রীর ‘হ্যা অথবা না’ সূচক ভোটের মাধ্যমে প্রহসনমূলক নির্বাচনের শতকরা ৯৫ ভাগ ভোট পেলেন আইয়ুব খান। ১৭ ফেব্রুয়ারি তিনি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ গ্রহণ করলেন।
১৯৬২ সালের ৩০ জানুয়ারি করাচিতে সোহরাওয়ার্দীকে গ্রেফতার করা হয়। পরদিন ১ ফেব্রুয়ারি প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ঢাকা আসেন। সোহরাওয়ার্দী গ্রেফতারের খবরে ঢাকায় ছাত্র-জনতার মধ্যে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিক্ষুব্ধ ছাত্ররা আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে রাজপথে মিছিল বের করে। দীর্ঘ কয়েক বছরের জোরপূর্বক স্তব্ধ করে দেওয়া রাজনৈতিক চেতনা। বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গনে ও রমনার রাজপথে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে।
২৭ এপ্রিল শেরে বাংলা ফজলুল হক পরলোকগমন করেন। সোহরাওয়ার্দী ৬ মাস ২০ দিন কারাগারে থাকার পর ১৬ সেপ্টেম্বর ঢাকায় আসেন। ঢাকাবাসী সোহরাওয়ার্দীকে এক অভূতপূর্ব সংবর্ধনা জানায়। প্রকৃতপক্ষে মরহুম ফজলুল
পৃষ্ঠা-৪৪
হকের শোভাযাত্রা ও সোহরাওয়ার্দীকে নিয়ে যে শোভাযাত্রা বেরিয়েছিল,তার মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতির মনোভাব স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
১৯৬২ সালে হামুদুর রহমান শিক্ষা কমিশন রিপোর্টের বিরুদ্ধে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্রসমাজ প্রবল আন্দোলনের কর্মসূচি গ্রহণ করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ‘৬২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বরকে শিক্ষা দিবস হিসেবে পালন করে। আইয়ুব খান চরম দমন নীতির আশ্রয় গ্রহণ করেন। বিক্ষোভরত মিছিলের গুলিবর্ষণের ফলে ওয়াজিউল্লাহ, বাবুল ও মুস্তাফিজ শহিদ হন। ‘৬২-৬৩ সালে ছাত্র-বিক্ষোভ ও আন্দোলনের ফলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৭ দিনের বেশি ক্লাশ হয়নি।
কথিত আছে প্রেসিডেন্ট ইসকান্দার মির্জার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক সভায় আইয়ুব খান প্রধান বিচারপতি মোহাম্মদ মুনীরকে এক নতুন সংবিধান কীভাবে সমর্থিত করা যায় সে বিষয়ে পরামর্শ দিতে বলেন। বিচারপতি মনীরের জবাব ছিল চমকপ্রদ ও হাস্যকর। তিনি বলেন, এটি অতি সামান্য ব্যাপার। প্রাচীন কালে গ্রিক রাষ্ট্রগুলোতে গণকণ্ঠের সমর্থনেই সংবিধান গৃহীত হতো। এখন পাকিস্তানেও সেভাবে করা যেতে পারে। আইয়ুব খান বিচারপতি মুনীরকে গণকণ্ঠের সমর্থন কথাটি বিশ্লেষণ করতে অনুরোধ করলে বিচারপতি মুনীর বলেন খসড়া সংবিধান তৈরি হলে তা প্রথমে সংবাদপত্রে প্রকাশ করতে হবে। তারপর আইয়ুব খান করাচির নিশতার পার্কে, ঢাকার পল্টন ময়দানে, লাহোরের মুচিগেটে এবং পেশোয়ারের চক ইয়াদগারে জনসভা করে সংবাদপত্রে প্রকাশিত সংবিধানের উপর জনসমর্থন চাইবেন। বিচারপতি আরো বললেন, এক্ষেত্রে অবশ্যই জনগণ তাদের সমর্থন সোচ্চারে ঘোষণা করবে আইউব খানের অট্টহাসিটি ছিল সর্বোচ্চ গ্রামে। পরবর্তীকালে আইয়ুব খান সংবিধান অনুমোদনের এ পথ অনুসরণ না করলেও প্রধান বিচারপতি গুরুত্ব সহকারেই এ পরামর্শ দিয়েছিলেন।
১৯৬২ সালের আইয়ুব খান যে সংবিধান দিলেন, তার ফলে আইয়ুব খানের আজীবন প্রেসিডেন্ট থাকার পথ পরিষ্কার হয়ে গেল। কারণ এ সংবিধান অনুযায়ী ৮০ হাজার মৌলিক গণতন্ত্রী সদস্য রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করবেন। আর নানা সুযোগ-সুবিধা, আর্থিক আনুকূল্যে ও সামাজিক আধিপত্য প্রদানের মাধ্যমে এসব সুযোগসন্ধানী মৌলিক গণতন্ত্রী সদস্যদের মাথা ক্রয় করা ছিল পানির মতো সহজ।
একথা অনস্বীকার্য যে, ভাষা আন্দোলনই বাঙালি রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও বুদ্ধিজীবীদের চোখ খুলে দিয়েছিল। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে বাঙালির জয়লাভের
পৃষ্ঠা-৪৫
মূল কারণ ছিল বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির মর্যাদা রক্ষা ও পূর্ব বাংলার পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের দাবি। ‘পূর্ব বাংলার উপরে পশ্চিম পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক শাসন ও শোষণের অবসান চাই’-এর ধ্বনি মূর্ত হয়েছিল নির্বাচন রায়ের মাধ্যমে। পশ্চিম পাকিস্তানের এ উপনিবেশবাদ থেকে মুক্তির উদ্দেশ্যে শেখ মুজিব আওয়ামী লীগের মাধ্যমে ব্যাপক গণআন্দোলন শুরু করেন। জনমতকে জাগ্রত করার উদ্দেশ্যে সে সময় আওয়ামী লীগ একটি পুস্তিকা প্রকাশ করেছিল। এ পুস্তিকাটির নাম ছিল ‘কেন পূর্ববঙ্গের অটোনমি চাই।’ এ পুস্তিকার খসড়া তৈরি করেছিলেন স্বয়ং শেখ মুজিব। এ পুস্তিকার আংশিক উদ্ধৃতি এখানে প্রণিধানযোগ্য।… “পাকিস্তান একটি অখণ্ড ভৌগোলিক অঞ্চল নয়। এ রাষ্ট্রের দুটি অঞ্চল বিমানপথে এক হাজার মাইল এবং জলপথে তিন হাজার মাইল ব্যবধানে অবস্থিত। কানাডা ও ব্রিটেনের মধ্যে যে ব্যবধান, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের ব্যবধান তার চেয়েও বেশি। ….. পূর্ববঙ্গ পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। এক হাজার মাইল দূরে প্রতিষ্ঠিত সরকারি সিদ্ধান্তে তাই অবিচার হতে বাধ্য। পাকিস্তানের দু ভূখণ্ডের অর্থনীতির ভিত্তি সম্পূর্ণ পৃথক।… প্রায় সমস্ত জিনিসই প্রথমে করাচিতে আমদানি করা হয়। তারপরে আবার রফতানি করা হয় পূর্ব পাকিস্তানে। তার ফলে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে মাল রফতানি করার জন্য অতিরিক্ত দাম ধার্য করে। সেজন্য বিদেশি জিনিসপত্র পূর্ববঙ্গের বাজারে অত্যন্ত চড়া দামে বিক্রি হয়।… জোর-জুলুম করে অথবা পিস্তল দেখিয়ে কোনো দেশে ঐক্য স্থাপন করা সম্ভব নয়।… পাকিস্তানে দুই ভূখণ্ডে ব্যবসা-বাণিজ্য ও আমদানির ক্ষেত্রে যে পক্ষপাতিত্ব করা হচ্ছে তার ফলে পূর্ববঙ্গের জনজীবন গুরুতরভাবে বিপন্ন হচ্ছে।”
ভাষা আন্দোলনের পটভূমিতে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ঐতিহাসিক কাগমারী সম্মেলনে স্বায়ত্তশাসনের দাবি ও পশ্চিম-পাকিস্তানকে আস্সালামু আলাইকুম জানিয়ে মওলানা ভাসানীর চরম সতর্কবাণী উচ্চারণ ও শেরে বাংলার কলকাতা সফরকালীন বক্তৃতা বাংলাদেশের স্বাধীনতা চিন্তার বহিঃপ্রকাশ। প্রকৃতপক্ষে শেখ মুজিবুর রহমান, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ও শেরে বাংলা ফজলুল হককে বাঙালি জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ইতিহাসে তিনরত্ন। হিসেবে অভিহিত করা যায়।
১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্রে পূর্ব বাংলা নামের বিলুপ্তি ঘটানোর প্রতিবাদে গণপরিষদের শেখ মুজিব দীর্ঘ জোরালো ভাষণ দিয়েছিলেন। এর আগে করাচিতে শেখ মুজিব আওয়ামী লীগ সদস্যদের এক ঘরোয়া বৈঠকে বলেন, ভারত বিভাগের ফলে পাঞ্জাব ও বাংলাকে ভাগ করা হয়েছে। পাকিস্তানের পাঞ্জাব নাম ছাড়েনি। অথচ আমাদের নাম বদলে পূর্ব পাকিস্তান রাখা হয়েছে। বাঙালি
পৃষ্ঠা-৪৬
জাতীয়তাবাদের আন্দোলনকে আমাদেরকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে । (এম,আর, আখতার মুকুলঃ আমরাই বাঙালি)।
বিদেশি সাহায্য হিসেবে প্রাপ্ত রফতানি ও কর বাবদ থেকে কোটি কোটি টাকা পশ্চিম পাকিস্তানের উন্নয়নের জন্য ব্যয় করা হয়। রাজধানী থেকে শুরু করে সামরিক বাহিনীর সদর দপ্তর ও অন্যান্য সামরিক প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হয় পশ্চিম পাকিস্তানে।
১৯৪৮ সাল থেকে ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর ৩০ কোটি টাকা করে মোট ১৮০ কোটি টাকা পূর্ব বাংলা থেকে নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের উন্নয়নের কাজে ব্যায় করা হয়েছে। ১৯৪৮ ও ১৯৪৯ এ দুই বছরে প্রাদেশিক সরকারের উন্নয়ন খাতে সরকার প্রদত্ত ঋণের ২৪ কোটি টাকার মধ্যে এক পাঞ্জাবেই বরাদ্দ হয় ১০ কোটি টাকা আর পূর্ব বাংলায় মাত্র ৮ কোটি টাকা।
১৯৪৯-৫০ ও ১৯৫০-৫১ সালের উন্নয়ন খাতে বরাদ্দকৃত অর্থের শতকরা ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত পূর্ব বাংলা যে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করেছিল তার সবটাই ব্যয় করা হয় পশ্চিম পাকিস্তানে। পঞ্চাশের দশকের রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক শোষণের পরিপ্রেক্ষিতে স্বাধীনতার চিন্তা-চেতনার জন্ম হয়। এ পটভূমিতে ষাটের দশকের প্রথমার্ধে স্বাধীনতাযুদ্ধের প্রস্তুতি চলে।
ইতোমধ্যে ১৪ মাস কারাভোগের পর ১৯৫৯ সালের ডিসেম্বরে শেখ মুজিব মুক্তিলাভ করেন। কিন্তু শেখ মুজিবকে মিথ্যা হয়রানিমূলক মামলায় আবার জড়ানো হয়। তাঁকে ক্ষমতা অপব্যবহারের অভিযোগে পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা সহ দু’বছর বিনাশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। শেখ মুজিব আপীল সাপেক্ষে জামিনের আবেদন জানালে বিচারপতি ইদ্রিস আবেদন মঞ্জুর করেন।
পৃষ্ঠা-৪৭
তৃতীয় অধ্যায়
আওয়ামী লীগের পুনরুজ্জীবন ও সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলন।
হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর বিরুদ্ধে এবডো’ আরোপের মাধ্যমে রাজনৈতিক তৎপরতা নিষিদ্ধ ছিল। তথাপি তাঁর পক্ষে আর নিষ্ক্রিয় থাকা সম্ভব ছিল না। পরিস্থিতি তাঁকে বাধ্য করে রাজনীতিতে উপস্থিত হতে। তিনি আসন্ন রাজনৈতিক পটভূমিকায় ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নির্ধারণের পরিপ্রেক্ষিতে পূর্ব বঙ্গের নেতাদেরকে এক গোপন বৈঠকের আহ্বান জানান। এ আহ্বানের ফলে আতাউর রহমান খানের বাসভবনে ১৯৬২ সালের ২৪ জানুয়ারি রাত্রে শেখ মুজিব, হামিদুল হক চৌধুরী, তোফাজ্জল হোসেন (মানিক মিয়া), আর হোসেন সরকার, মোহাম্মদ আলী, ইউসুফ আলী চৌধুরী (মোহন মিয়া) প্রমুখ উপস্থিত হয়ে আলোচনা শুরু করেন। সোহরাওয়ার্দী দলমত নির্বিশেষে সব বিভেদ-বিদ্বেষ ভুলে গিয়ে এক আদর্শের ভিত্তিতে সংগ্রাম করার আহ্বান জানালে সকল নেতাই তা সমর্থন করেন। এ বৈঠকে গোপনে তাঁদের আদর্শ ও উদ্দেশ্য প্রচার করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। বৈঠকের পরদিন সোহরাওয়ার্দী করাচি যান। কথা ছিল, সাতদিন পর তিনি ঢাকায় ফিরে এসে এ ব্যাপারে সক্রিয় উদ্যোগ গ্রহণ করবেন। কিন্তু তার আগেই ১৯৬২ সালের ৩০ জানুয়ারি তাঁকে নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার করা হয়। সোহরাওয়ার্দীকে গ্রেফতারের সঙ্গে সঙ্গে সারা দেশে আগুন জ্বলে উঠল। সরকারের টনক নড়ে গেল। প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান তখন ঢাকায়। তার উপস্থিতিতেই ছাত্ররা বিক্ষোভে ফেটে পড়ল। তরুণ ছাত্রসমাজ রাস্তায় নেমে পড়ল। এ প্রথম আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন গড়ে উঠলো এবং আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন সোহরাওয়ার্দীর যোগ্য শিষ্য অকুতোভয় নেতা শেখ মুজিবুর রহমান। সমস্ত বাধা নিষেধ উপেক্ষা করে বীর দর্পে রাজপথে নেমে পড়লেন শেখ মুজিব। আন্দোলন যাতে বেগবান না হয় সেজন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নির্দিষ্ট সময়ের এক মাস আগেই বন্ধ ঘোষণা করা হয়। ফেব্রুয়ারি ৬ তারিখে ছাত্ররা এক সভা করে এর প্রতিবাদ জানান। প্রতিবাদ সভার পর ছাত্ররা সোহরাওয়ার্দীসহ অন্যান্য রাজবন্দীর মুক্তির দাবিতে শ্লোগান দিতে দিতে মিছিল
পৃষ্ঠা-৪৮
সহকারে ঢাকা শহর পদক্ষিণ করে। শুধু তাই নয়, বিক্ষুদ্ধ ছাত্র জনতা প্রেসিডেন্ট আইয়ুবের ছবিকেও পদদলিত করে ও তাতে অগ্নি সংযোগ করে। পরদিনই ৭ ফেব্রুয়ারি গোটা দেশে পূর্ণ হরতাল পালনের আহবান জানানো হয়। শেখ মুজিব হরতালে নেতৃত্ব দিতে পারলেন না। তার আগেই অর্থাৎ ৬ ফেব্রুয়ারি গভির রাতে ‘পাকিস্তান জননিরাপত্তা অর্ডিন্যান্সে ‘ তাকে গ্রেফতার করে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয়। শেখ মুজিবের সাথে আর যাঁদের গ্রেফতার করা হয় তাঁরা হলেন – আবুল মনসুর আহমদ, সৈয়দ আলতাফ হোসেন, (পরে মোজাফফর ন্যাপের ভাইস প্রেসিডেন্ট),তাজউদ্দিন আহমদ, তফাজ্জল হোসেন ,কোরআন আলী , ফণীভূষণ মজমদ , আব্দুর রব সেরনিয়াবাত প্রমুখ
৭ ফেব্রুয়ারি গণবিক্ষোভ দানা বেঁধে উঠলসা । হলি ফ্যামিলি হাসপাতালের সামনে এক বিরাট জঙ্গী মিছিলের ওপর পুলিশ-মিলিটারী কাঁদুনে গ্যাস নিক্ষেপ ও ব্যাপক লাঠিচার্জ করে। বিক্ষোভকারীরা এর ফলে আরও বিক্ষোভে ফেটে পড়ে।তেজগাঁও এয়ারপোর্টের সামনে আইয়ুবের সম্মানে নির্মিত একটি তোরণ জনতা ভেঙ্গে ফেলে ।
১৯৬২ সালের ১ মার্চ পাকিস্তানের নয়া শাসনতন্ত্র পেশ করা হয়। আতাউর বহমান খান লিখেছেন : “এক হাজার নয়শ বাষট্টি সালের ফেব্রুয়ারি মাসের পয়লা মার্চের হিজরী মোতাবেক এক হাজার তিনশ’ একাশি সালের তেইশে রমজান আইয়ুব খান প্রণীত শাসনতন্ত্র ভূমিষ্ঠ হলো।” [স্বৈরাচারের ১০ বছর : আতাউর রহমান খান; পৃ. ১৯৮]
আল্লাহর নামে শুরু করে ও নিজের নামে শেষ করে আইয়ুব ভূমিকা দান করেনঃ “এক হাজার নয়শ বাষট্টি সালের ফেব্রুয়ারি মাসের পয়লা মার্চ তারিখে পাকিস্তানের জনগণ আমাকে যে ম্যান্ডেট দিয়েছে তারই বলে বলীয়ান হয়ে পাকিস্তানের উত্তরোত্তর অগ্রগতি লাভ, বিশ্ব দরবারে মর্যাদার আসন গ্রহণ, আন্তর্জাতিক শান্তি, মানবতার কল্যাণ সাধনে পাকিস্তানের জনগণের যথাযোগ্য সহায়তা প্রদান ইত্যাদি শুভ ইচ্ছায় প্রণোদিত হয়ে আমি মোহাম্মদ আইউব খান, হিলারে পাকিস্তান, হিলারে জুরাত, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট অদ্য তারিখে এ শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করিলাম।”
এক ব্যক্তির দেওয়া শাসনতন্ত্র! পাকিস্তানের জনগণের উল্লেখ অবান্তর। তারা কোনো ম্যান্ডেট দেয় নাই। [স্বৈরাচারের ১০ বছর ও পৃ. ১৯৮]
এ শাসনতন্ত্রের প্রধান দুটো বৈশিষ্ট্য ছিল :
১। সমস্ত ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত। দেশের সর্বময়কর্তা প্রেসিডেন্ট। তিনি সর্বাধিক ক্ষমতার অধিকারী।
পৃষ্ঠা-৪৯
২। জনগণের ওপর পূর্ণ অনাস্থা। তাদের প্রত্যক্ষ ভোটে দেশের সর্বসময় ক্ষমতাধিকারী প্রেসিডেন্টকে নির্বাচনের অধিকার জনগণের নেই। সরকার কতিপয় দালাল সৃষ্টি করে দেবে–তারাই প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করবে।
আইয়ুবের এ শাসনতন্ত্রের বর্ণনা দিতে গিয়ে আতাউর রহমান খান যথার্থী। লিখেছেনঃ “গণতন্ত্রের বহির্বাস বহাল করা হয়েছে অন্তর অসার কেন্দ্রে ও প্রদেশে পরিষদ হবে। তাদের অধিবেশনও হবে। সেখানে বক্তৃতা, তর্কবিতর্ক প্রশ্নোত্তর সবই হবে। তার জন্য আইন কানুনও প্রণীত হবে। অর্থাৎ সংবাদপত্রের খাদ্য পুরোপুরি থাকবে। পরিষদে সব বিষয়ের আলোচনা হবে। এমনকি রাষ্ট্রেরও। কিন্তু তার ওপর ভোটাভোটি চলবে না। স্থিতিশীলতা নষ্ট হয়ে যাবে । অর্থাৎ পরিষদ রবার স্ট্যাম্প, পঙ্গু ও ক্লীব। তবুও সদস্যের মান মর্যাদা আছে। পদাধিকার আছে। মন্ত্রীমন্ডলির থাকারও ব্যবস্থা আছে।…তাদের গাড়ি বাড়ি থাকবে। আরদালী চাররাশিও থাকবে। থাকবে না শুধু ক্ষমতা। ক্ষমতা থাকবে প্রেসিডেন্টের হাতে এবং তারই হুকুমে গভর্নর ও কর্মচারীরা ক্ষমতার অধিকারী হবেন।” [পূর্বোক্ত : পৃ. ১৯৮-১৯৯]।
পূর্ব বাংলার জনগণ স্বৈরাচার আইয়ুবের এ শাসনতন্ত্র মেনে নিতে পারেনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসমাজ ১৫ মার্চ এ শাসনতন্ত্রের প্রতিবাদে ধর্মঘট আহ্বান করে। মেডিক্যাল কলেজ প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত এক সভায় এ শাসনতন্ত্রের। দুটি কপি ভস্মিভূত করা হয়। আইয়ুব খান সরকার ও শাসনতন্ত্র বিরোধী কার্যকলাপে বাঙালিদের ওপর ভীষণ ক্ষেপে যান।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ২৪ মার্চ ৩-দফা দাবির ভিত্তিতে পুনরায় অনির্দিষ্টকালের জন্য ধর্মঘট শুরু করে।
১। নয়া শাসনতন্ত্র অবিলম্বে বাতিল কর।
২। দেশে পূর্ণ গণতন্ত্র কায়েম কর।
৩। সোহরাওয়ার্দী ও মুজিব সহ সকল রাজবন্দীর মুক্তি দাও।
১২ দিন ধর্মঘট পালনের পর ছাত্ররা ৪ এপ্রিল তা সাময়িকভাবে তুলে নেন। এরই মধ্যে ঘোষণা করা হয়েছিল যে, নয়া শাসনতন্ত্রের অধীনে ১৯৬২ সালের ২৮ এপ্রিল পাকিস্তান প্রথম জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। কিন্তু ছাত্রসমাজ এ শাসনতন্ত্রের বিরুদ্ধে ক্রমাগত বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে থাকে। পূর্ব পাকিস্তানের প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলের শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দও এ নির্বাচন থেকে বিরত থাকার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু প্রাক্তন মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দ আইয়ুব খানের এ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলেন। কোনো রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দিতা না থাকায় মুসলিম লীগ প্রার্থীরা নির্বাচনে জয়লাভ করেন। বগুড়ার মোহাম্মদ আলী,
পৃষ্ঠা-৫০
হাবিবুর রহমান, ফজলুল কাদের চৌধুরী, মুনেম খান ও সবুর খান প্রমুখ ব্যক্তিরা নির্বাচনে জয়লাভ করে পরবর্তীকালে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার সুযোগ পান।
১৯৬২ সালের ২৭ এপ্রিল শুক্রবার শেরে বাংলা ফজলুল হক ৮৮ বছর বয়সে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ইন্তেকাল করেন। সারা বাংলার মানুষ শোকাভিভূত হয়ে পড়ে। ৮ জুন আইয়ুব খান সামরিক আইন প্রত্যাহার করেন এবং একই দিনে জাতীয় পরিষদের সদস্যরা নতুন শাসনতন্ত্রের অধীনে শপথ গ্রহণ করেন। আইয়ুব খানের নতুন মন্ত্রিসভায় যারা স্থান পেলেন তারা হলেন : সবুর খান, ফজলুর কাদের চৌধুরী, ওয়াহিদুজ্জামান ও বগুড়ার মোহাম্মদ আলী। প্রসঙ্গত উল্লেখ যে, সামরিক শাসন প্রত্যাহার হওয়ার পর ছাত্রদের ও অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর জোরদার আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে আইয়ুব খান ১৯৬২ সালের ১০ মে The oplitical organization (Prohibition of unregulated activities ordinance of 1962. নামে এক অধ্যাদেশ জারি করেন। এ অধ্যাদেশের বলে আসন্ন জাতীয় পরিষদ অধিবেশনের পূর্ব পর্যন্ত রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়।
শেখ মুজিব ১৯৬২ সালের ১৮ জুন ভোরে মুক্তিলাভ করেন। এর কয়েকদিন আগে তাজউদ্দিন, আবুল মনসুর আহমদসহ কয়েকজন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও সাংবাদিক মুক্তি পান। শেখ মুজিব জেল থেকে বেরিয়ে এসে তুমুলভাবে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সূত্রপাত করেন। বাঙালি জাতিকে পশ্চিমা শোষণ থেকে রক্ষা করার জন্য আতাউর রহমান খান ও অন্যান্য রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা অব্যাহত রাখেন। এক কয়েকদিন পরে ২৪ জুন পূর্ব বাংলার শীর্ষস্থানীয় ৯ জন রাজনৈতিক নেতা বিবৃতি দেন যা ২৫ জুন খবরের কাগজগুলোতে প্রকাশিত হয়। এ বিবৃতি ইতিহাসে ৯ নেতার বিবৃতি নামে পরিচিত। এ বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেন শেখ মুজিবুর রহমান, আতাউর রহমান খান, হামিদুল হক চৌধুরী, আবু হোসেন সরকার, সৈয়দ আজিজুল হক, পীর মহসিন উদ্দিন আহম্মেদ, ইউসুফ আলী চৌধুরী মোহন মিয়া, নূরুল আমিন ও মোহাম্মদ আলী। বিবৃতিটি নিম্নরূপ : “সত্যিকার গণপ্রতিনিধি ছাড়া কোনো ব্যক্তির শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করার অধিকার নাই। করলে তা স্থায়ী, সহজ ও কার্যকরী হতে পারে না। জনগণ সাবভৌম-এ হচ্ছে গণতন্ত্রে সার কথা। জনগণই সমস্ত ক্ষমতার উৎস। তাদের ইচ্ছানুযায়ী সকল ক্ষমতা প্রয়োগ করতে হবে। এ ইচ্ছার স্বতঃস্ফূর্ত বাধা-বিঘ্নমুক্ত ও অবাধ বিকাশের একান্ত প্রয়োজন। শাসনতন্ত্র প্রণয়নের সময় গণ প্রতিনিধির লক্ষ্য থাকে যাতে কালের ঘাতপ্রতিঘাত সহ্য করে শাসনতন্ত্র টিকে থাকতে পারে এবং সম্ভাব্য বাধা বিপত্তি ও সংকট মুক্ত হয়ে নিজের অস্তিত্ব রক্ষা করতে পারে।
পৃষ্ঠা-৫১
শাসনতন্ত্রকে স্থায়িত্বের বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত গুণসম্পন্ন হতে হলে সমগ্র জাতিত ইচ্ছা ও বিচার বুদ্ধির প্রতিফলন অবশ্যই থাকতে হবে। এ পদ্ধতিতে প্রণীত বিধানগুলোই বর্তমান ও ভবিষ্যতে ভাবি বংশধরদের মনে অকৃত্রিম আনুগত্য ও আবেগের প্রেরণা দিতে পারে। এ আনুগত্য ও আবেগই শাসনতন্ত্রের প্রধান অবলম্বন এবং দুর্ভেদ্য বর্মবিশেষ। জনমতের ওপর নির্ভর না করে বাইরে থেকে চাপানো শাসনতন্ত্র বিপর্যয়ের মুখে জনসমর্থন লাভ করতে পারে না।
বর্তমানে শাসনতন্ত্রে এ গুণাবলির না থাকায় এটা অন্তঃসার শূন্য। যতই প্রচার করা হোক না কেন জনমতের প্রতি উপেক্ষা ও অনাস্থাই এ নয়া শাসতন্ত্রের ভিত্তিভূমি। আট কোটি (তখন যা ছিল) জনসংখ্যার মধ্যে মাত্র আশি হাজারকে দেওয়া হয়েছে ভোটের অধিকার। আবার এ অতি কম সংখ্যক ভোটারের ভোটে নির্বাচত যে পরিষদ তাকেও সত্যিকার কোনো ক্ষমতা দেওয়া হয় নাই। মাত্র তিন সপ্তাহের অভিজ্ঞতা থেকে বোঝা যাচ্ছে যে, আমূল পরিবর্তন না করলে এ শাসনতন্ত্র কাজের অনুপযোগী।
সরকারি নীতি ও কার্যকলাপ নির্ধারণ বা নিয়ন্ত্রণের কোনো ক্ষমতা সদস্যদের না থাকার ফলে শুধু মাত্র সরকারের তীব্র ও চরম সমালোচনার মাধ্যমে সদস্যরা নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণ করতে প্রলুব্ধ হবে। যোগ্য ও স্বাধীনচেতা ব্যক্তি এ ধরনের সরকারে যোগ দিতে কোনো আগ্রহ বোধ করবে না। ফলে শাসন ব্যবস্থা সম্পূর্ণরূপে নিয়ন্ত্রণ আমলাতন্ত্রের হাতের মুঠোর মধ্যে গিয়ে পড়বে।
যথাসম্ভব দ্রুত নির্বাচনের মাধ্যমে একটি বিশেষ সংস্থা গঠন করে দেশবাসী বিনা দ্বিধায় গ্রহণ করতে পারে এমন একটি শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করার আহ্বান আমরা জানাই। ছয় মাসের মধ্যে একটি সুষ্ঠু শাসনতন্ত্র প্রণয়ন সম্ভব বলে আমরা মনে করি। শাসনতন্ত্র প্রেসিডেন্সিয়াল না পার্লামেন্টারি হওয়া উচিত, সে প্রশ্নের জবাব আমরা এখন দিতে চাই না। তবে দেশের জনসংখ্যগরিষ্ঠ অংশ পার্লামেন্টারি ধরনের সরকার কায়েমের পক্ষপাতি; কেননা বহুকাল ধরে ঐ ধরনের শাসন পদ্ধতির সাথে আমাদের পরিচয় ঘটেছে এবং তার অভিজ্ঞতা অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। শাসনতন্ত্র ফেডারেল বা ইউনিটারী হবে, এ প্রশ্নের জবাবের প্রয়োজন হবে না বিচিত্র ভৌগোলিক অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে ফেডারেল শাসনতন্ত্রই গ্রহণ যোগ্য হবে; এতে সন্দেহের অবকাশ নেই। একটি জ্বলন্ত সমস্যার সমাধান করা একান্ত কর্তব্য-সেটা দুই অংশের মধ্যে ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক উন্নয়নমূলক বৈষম্য। উভয় অংশের জনগণের সদিচ্ছার অভাব নেই। তাই আমরা মনে করি গণপ্রতিনিধিদের সত্যিকার দায়িত্ব দিলে, তারা সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে, দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে কাজে মনযোগ দেবে আর অনুন্নত অঞ্চলগুলোর দিকে অধিক দৃষ্টি নিবদ্ধ করবে, এটা সুনিশ্চিত।
পৃষ্ঠা-৫২
এতকাল ধরে রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারণের ব্যাপারে জনগণের কোনো কথা বলার সুযোগ না থাকায় সংকীর্ণমনা ও শ্রেণি স্বার্থের রক্ষকদের হাতে পড়ে দুই অংশের ভেতর উন্নয়নের ক্ষেত্রে পর্বত প্রমাণ বৈষম্য সৃষ্টি হয়ে পড়েছে। নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে একবার যদি রাষ্ট্র ব্যবস্থায় জনমত প্রতিষ্ঠা লাভ করতে পারে তাহলে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির কায়েমী স্বার্থের দিন শেষ হয়ে যাবে। পূর্ব পাকিস্তান অর্থনৈতিক ব্যাপারে সত্যিকার রাজনৈতিক ক্ষমতার অংশীদার হওয়ার সুযোগ পাই নাই বললেই চলে। কারণ দুই অঞ্চলের বৈষম্য সৃষ্টি হয়েছে। আজাদী লাভের পর সমস্ত রাজনৈতিক ক্ষমতার সমাবেশ হয়েছিল মুষ্টিমেয় সরকারি অফিসারদের হাতে। তার ওপর দেশে একটিও সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠান না হওয়ার ফলে জনগণ রাষ্ট্র পরিচালনার ব্যাপারে কথা বলার সুযোগ পায় নাই। এমতাবস্থায় অন্তর্বর্তীকালে কি করণীয় সেইটাই হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য বিষয়। সামরিক শাসন উঠে যাওয়ার ফলে দেশে যে সদিচ্ছার উদ্ভব হয়েছে, তাকে জোরদার করে তোলার জন্য প্রয়োজন হচ্ছে গভীর রাজনৈতিক প্রবক্তার জনসাধারণ ও সরকারি শাসনতন্ত্রের মধ্যে ব্যবধানের প্রাচীর আর গড়ে উঠতে দেওয়া হবে না। প্রেসিডেন্ট আইয়ুবের দায়িত্ব অপরিসীম। আমরা আশা করি তিনি এটা বুঝতে অক্ষম নন।
আমাদের প্রস্তাবিত পদ্ধতি মনে একটি স্থায়ী শাসনতন্ত্র প্রণীত হওয়া সাপেক্ষে দেশের সরকার পরিচালনার কাজ চালিয়ে যেতে হবে। তাই আমাদের প্রস্তাব ওনিশ শ ছাপ্পান্ন সালের শাসনতন্ত্রের মৌলিক অধিকার সংক্রান্ত অধ্যায়গুলো নয়া শাসনতন্ত্রে সন্নিবেশিত করে জনসাধারণের মৌলিক অধিকার আদালতের এক্তিয়ার করতে হবে।
যে পরিষদ বর্তমান বিধান অনুযায়ী গঠিত হয়েছে তার ওপর সরকারের আস্থা ও বিশ্বাস স্থাপন করতে হবে। লাভজনক পদ বণ্টন করে ভাগ্যবান সদস্যদের নিয়ে পরিষদ গৃহ ভর্তি করার আসক্তি বর্জন করতে হবে। তা না হলে যে ক্ষীণমাত্রা স্বাধীনতা পরিষদের আছে তাও বিলুপ্ত হয়ে যাবে। একথা ভুললে চলবে না যে, বিশ্বাসেই বিশ্বাস বৃদ্ধি পায়। সরকারের ওপর জনগণের আস্থা যাতে ফিরে আসে তার জন্য বিনা বিচারে আটক সব রাজনৈতিক বন্দীকে মুক্তি দিতে হবে। তাদের বিরুদ্ধে গৃহীত যাবতীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা বাতিল করে দিতে হবে। রাজনৈতিক দল গড়ে ওঠার পর পথে যতকিছু বাধা অন্তরায় আছে তার অবসান ঘটাতে হবে। দেশের সকলকে সমবেতভাবে এসব সমস্যার সমাধানের কাজে এগিয়ে আসতে হবে। দেশ একটি বিরাট পরীক্ষার মুখে। এক অস্থির অবস্থায় দেশ সম্মুখের দিকে অগ্রসর হচ্ছে।
পৃষ্ঠা-৫৩
আমাদের শেষ আহ্বান আসুন, সকলে মিলে যতশীঘ্র সম্ভব শাসনত প্রণয়ন করে সমস্ত বিতর্ক বন্ধ করে দেশকে অভীষ্ট লক্ষ্যে নিয়ে যাবার এক দুর্জয় সংকল্প নিয়ে ঐক্যবদ্ধ হয়ে গঠনমুলক কাজে আত্মনিযয়োগ করি।”
৯ নেতার বিবৃতি বাংলাদেশে এক অভূতপূর্ব সাড়া জাগায়। জনতা গণতন্ত্র আদায়ের লক্ষ্যে নতুন করে ঐক্যবদ্ধ হয়। বিরোধী দলের এ নতুন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে আইয়ুব খান ও তাঁর সহযোগিরা ভীষণভাবে ক্ষুব্ধ হলেন। সবুর খান এ বিবৃতিকে ব্যবিলনের ৯ জন জ্ঞানীর বিবৃতি বলে ব্যাঙ্গ করলেন। আইয়ুব খান রাজনীতিকদের গণধিকৃত আখ্যায়িত করলেন। এতদসত্ত্বেও চট্টগ্রাম, বরিশাল , টাংগাইল, সিলেট ও অন্যান্য জায়গায় সরকার বিরোধী জনসভা হতে লাগলো। পল্টন ময়দানে এক বিশাল জনসভা অনুষ্ঠিত হলো। সোহরাওয়ার্দী তখন করাচি জেলে বন্দী। অতঃপর ৩০ জুন জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে রাজনৈতিক দল গঠন সম্পর্কে পলিটিক্যাল পার্টিস বিল-১৯৬২ নামে একটি বিল উত্থাপিত হয়। এ বিলে বলা হয় ইসলামি আদর্শ পাকিস্তানের সংহতি বিরোধী মতামত প্রচারের জন্য এবং এবডো প্রোডো আইনে অযোগ্য ঘোষিত রাজনীতিবিদেরা কোনো দল গঠন বা কোনো দলের সদস্য হতে পারবে না।
১৯৬২ সালের ৮ জুলাই পল্টন ময়দানে নূরুল আমিনের সভাপতিত্বে এক বিশাল জনসভায় শেখ মুজিব জ্বালাময়ী ভাষায় বলেন যে স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় যারা ইংরেজ প্রভুদের গোলামি করেছিল তারাই আজ দেশের বিধাতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। শেখ মুজিব সোহরাওয়ার্দী ও ভাসানীসহ সকল রাজবন্দীদের মুক্তি দাবি করেন। তিনি এবডোসহ সকল কালাকানুন বাতিল করার দাবি তুলেন। আতাউর রহমান খান ভাষণ দিতে গিয়ে বলেন যে, “এ শাসনতন্ত্র চাই না। এ শাসনতন্ত্র পুড়িয়ে ফেলতে হবে। চাঁড়ালের হাত দিয়া পোড়াও পুস্তিকা ভস্মরাশি ফেলে দাও কীর্তিনাশা জলে।”
শহীদ সোহরাওয়ার্দী ১৯ আগস্ট ১৯৬২ করাচি সেন্ট্রাল জেল থেকে মুক্তি লাভ করেন। প্রায় ৪ মাস করাচিতে বিশ্রামের পর ১৬ সেপ্টেম্বর বেলা ১টা ৪৫ মিনিটে তিনি ঢাকা বিমানবন্দরে অবতরণ করেন। ঢাকা বিমানবন্দরে সর্বস্তরের জনগণ তাঁকে এক অভূতপূর্ব সম্বোধন জানায়। লক্ষ লক্ষ মানুষের শ্লোগান শ্লোগানে বাংলার আকাশ বাতাস মুখরিত হলো। সোহরাওয়ার্দী হেসে বললেন, আমিও ৯ জন নেতার সামিল আমার নম্বর ১০।
পরদিন ১৭ সেপ্টেম্বর (১৯৬২) বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক ঐতিহাসিক স্মৃতি বিজড়িত দিন। শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট বাতিলের দাবিতে ছাত্রসমাজ এদিন হরতাল আহ্বান করেছিল। আইয়ুব খান তখন ঢাকায় উপস্থিত।
পৃষ্ঠা-৫৪
ছিলেন । তিনি ঐদিন কার্জন হলে ভাষণ দিতে গিয়েছিলেন। ছাত্র নেতা রাশেদ খান মেনন-এর নেতৃত্বে ছাত্ররা শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট বাতিল ও অন্যান্য দবির জন্য বিক্ষোভ মিছিল বের করেন। আইয়ুব খান বক্তৃতা না দিয়েই কার্জন হলো ত্যাগ করেন এবং পুলিশ বাহিনীকে ছাত্রদের শায়েস্তা করার জন্য নির্দেশ দিলেন। পুলিশ বাহিনী ও ছাত্রদের মধ্যে তুমুল সংঘর্ষ শুরু হলো। ফলে ৩ জন নিহত ও ২০০ ছাত্র জনতা আহত হলেন। বহু ছাত্র জনতাকে গ্রেফতার করা হলো এবং ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারি করা হলো। সরকারের এ নির্যাতনের প্রতিবাদে ২৯ সপ্টেম্বর সারা দেশে সাধারণ ধর্মঘট ও দমন নীতি দিবস পালিত হলো। সোহরাওয়ার্দী, শেখ মুজিব ও অন্য ৮ নেতা এ হত্যাকাণ্ড ও গ্রেফতারের নিন্দা করে বিবৃতি দিলেন। শেখ মুজিব স্বয়ং অন্যান্য নেতাকে সঙ্গে করে তৎকালীন গভর্নর গোলাম ফারুকের সঙ্গে দেখা করে এর প্রতিবাদ করলেন।
শেখ মুজিব ২৪ সেপ্টেম্বর (১৯৬২) আতাউর রহমান খান সহ পূর্ব পাকিস্তানের ১৭ জন নেতা লাহোরে গেলেন। ২৫ সেপ্টেম্বর সোহরাওয়ার্দী গণতন্ত্র পুনরুজ্জীবনের লক্ষ্যে ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট সংক্ষেপে এ. ডি. এফ, গঠনের কথা ঘোষণা করেন। ৪ অক্টোবর এন, ডি. এফ.-এর ৫৪ নেতার নাম ঘোষণা করা হয়। এদের মধ্যে উল্লেখ্য হলেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেখ মুজিব, আতাউর রহমান খান, মোহাম্মদ আলী, সৈয়দ আজিজুল হক প্রমুখ। দুদিন পর নুরুল আমিন এতে যোগ দেন। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে মওলানা মওদুদী, মিয়া মমতাজ দৌলতানা, আইয়ুব খুরো, জেড এইচ প্রসারী প্রমুখ যোগদান করেন। সোহরাওয়াদী এর পরে অক্টোবরের ৬ তারিখে ঢাকায় এলেন। পরদিন নূরুল আমিনের সভাপতিত্বে পল্টন ময়দানে ভাষণ দিতে গিয়ে সোহরাওয়াদী জনগণকে জিজ্ঞাসা করেন আপনারা গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা চান কি না। উপস্থিত লক্ষ লক্ষ মানুষ হাত তুলে জবাব দেন চাই চাই। পরবর্তীকালে খাজা নাজিমউদ্দিন চৌধুরী মোহাম্মদ আলী, ফরিদ আহমেদ, মিয়া তোফায়েল, গোলাম আযম, খান ওয়ালী খান, হাজী দানেশ, আব্দুস সামাদ আচাচাই গণতন্ত্র আদায়ের জন্য এনডিএফ-এ যোগদান করেন।
১৯৬৩ সালের ৩ সেপ্টেম্বর সারা দেশে কুখ্যাত প্রেস এন্ড পাবলিকেশন্স অডিন্যান্স জারি করা হয়। ঢাকা প্রেস ক্লাবে বিক্ষুব্ধ সাংবাদিকেরা এক প্রতিবাদ সভা বের করেন। এ সভায় সভাপতিত্ব করেন (১৮ সেপ্টেম্বর) ইত্তেফাকের মরহুম সিরাজ উদ্দিন হোসেন। বর্ষীয়ান সাংবাদিক রাজনীতিক মওলানা আকরম খাঁ, বিচারপতি মোহাম্মদ ইব্রাহিম, অবজারভার সম্পাদক আবদুস সালাম, ইত্তেফাক সম্পাদক তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া প্রমুখ ব্যক্তিগণ তেজোদীপ্ত ভাষণ দেন।
পৃষ্ঠা-৫৫
শেখ মুজিবের নেতত্বে বিরোধীদলীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ঢাকা প্রেসক্লাবে সমবেত হন। এ সভায় পূর্ব পাকিস্তান দাংগা প্রতিরোধ কমিটি গঠিত হয়। সভায় সাংবাদিকদের সহযোগিতা কামনা করা হয় এবং একটি সর্বসম্মত প্রচারপত্র প্রণয়নের দায়িত্ব প্রদান করা হয় শেখ মুজিবুর রহমানকে। শেখ মুজিব তাৎক্ষিণকভাবে ১টি প্রচারপত্র তৈরি করলেন এবং সকল সংবাদপত্রে ছাপানোর অনুরোধ করলেন। ১৯৬৪ সালের ১৭ জানুয়ারি ঢাকার সকল সংবাদপত্রে এ ঐতিহাসিক প্রচারপত্রটি ছাপা হলো। এ প্রচারপত্রটির শিরোনাম ছিল ‘পূর্ব পাকিস্তান রুখিয়া দাঁড়াও।’
‘পূর্ব পাকিস্তান রুখিয়া দাঁড়াও
সাম্প্রদায়িক দুর্বৃত্তের ঘৃণ্য ছুরি আজ ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও অন্যান্য স্থানেও শান্ত ও পবিত্র পরিবেশ কলুষিত করিয়া তুলিয়াছে। ঘাতকদের ছুরি হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে পূর্ব বাংলার মানুষের রক্তে লাল হইয়া উঠিয়াছে। দুবৃত্তদের হামলায় ঢাকায় প্রতিটি পরিবারের শান্তি ও নিরাপত্তা আজ বিপন্ন। হিন্দু মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের নিরীহ মানুষের ঘরবাড়ি পোড়ান হইতেছে, সম্পত্তি বিনষ্ট করা হইতেছে, এমন কি জনাব আমির হোসেন চৌধুরীর মতো শান্তিকামী মানুষদেরও দুবৃত্তের হাতে জীবন দিতে হইতেছে। তাদের অপরাধ কি ছিল একবার চিন্তা করিয়া দেখুন। গুণ্ডারা মুসলমান ছাত্রী নিবাসে হামলা করিয়াছে এবং হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে আমাদের মা-বোনের সম্ভ্রম আজ মুষ্টিমেয় গুণ্ডার কলুষ স্পর্শে লাঞ্ছিত হইতে চলিয়াছে। এসর্বনাশা জাতীয় দুর্দিনে আমরা মানবতার নামে, পূর্ব পাকিস্তানের সম্মান ও মর্যাদার নামে দেশবাসীর নিকট আকুল আবেদন জানাইতেছি, আসুন সর্বশক্তি লইয়া গুণ্ডাদের রুখিয়া দাঁড়াই, শহরে শান্তি ও পবিত্র পরিবেশ ফিরাইয়া আনি।
পূর্ব বাংলার মানুষের জীবনের ওপর এ পরিকল্পিত হামলার বিরুদ্ধে রুখিয়া দাঁড়াইতে আমরা পূর্ব বাংলার সকল মানুষকে আহ্বান জানাইতেছি।।
* প্রতি মহল্লায় দাংগা প্রতিরোধ কমিটি গঠন করুন।
* গুণ্ডাদের শায়েস্তা করুন, নির্মূল করুন।
* পূর্ব পাকিস্তানের মা-বোনের ইজ্জত ও নিজেদের ভবিষ্যৎকে রক্ষা করুন। দাংগা প্রতিরোধ কমিটি পূর্ব পাকিস্তান কর্তৃক প্রচারিত।
১৯৬২ সালের ১০ মে আজম খানকে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর পদ থেকে অপসারণ করা হয়। গোলাম ফারুক তার স্থলাভিষিক্ত হলেন। তিনি বাঙালির ন্যায় সংগত দাবির প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন। কিন্তু বেশিদিন তিনি গভর্নর হিসাবে থাকতে পারেননি।
পৃষ্ঠা-৫৬
১৯৬২ সালের ২৮ অক্টোবর আবদুল মুনেম খান পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর হিসাবে শপথগ্রহণ করেন।
এ সময়ে সোহরাওয়ার্দী হৃদরোগে আক্রান্ত হন। করাচির জিন্নাহ সেন্ট্রাল হাসপাতালে তাকে ভর্তি করা হয়। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অক্লান্তভাবে অংশগ্রহনের ফলে তিনি আকস্মিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। চিকিৎসকরা তাকে পূর্ণ বিশ্রামের পরামর্শ দেন। সোহরাওয়ার্দী ১৯৬৩ সালের ১৯ মার্চ সুচিকিৎসা ও বিশ্রামের জন্য বৈরুতে যান।
মওলানা ভাসানীকে এসময় মুক্তি দেওয়া হয়। ১৯৬৩ সালের ৩১ মার্চ করাচিতে মওলানা ভাসানী এক জনসভায় এনডিএফ-কে সমর্থন করেন। কিন্ত ২ এপ্রিল ঢাকায় এসে তিনি এনডিএফ-কে কয়েকটি শর্ত সাপেক্ষে সমর্থন করতে পারেন বলে জানালেন। তিনি পূর্ণগণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা এবং সিয়াটো সেন্টো বহির্ভূত স্বাধীন ও নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতির দাবি তুলেন। মওলানা ভাসানী এনডিএফ-কে Nothing Doing Front হিসাবে আখ্যায়িত করলেন। শহিদ সাহেব তখন বৈরুতে চিকিৎসাধীন। শেখ মুজিবের প্রবল আপত্তি থাকা সত্ত্বেও নূরুল আমিনকে সোহরাওয়ার্দী এনডিএফ-এর পূর্ব পাকিস্তানের প্রধান মনোনীত করেছিলেন। ভাষা আন্দোলনে নূরুল আমিনের বিতর্কিত ভূমিকার ফলে মওলানা ভাসানীর সঙ্গে পেরে উঠছিলেন না। এনডিএফ-এর এ অচল অবস্থায় শেখ মুজিব আলাপ আললাচনার জন্য সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে দেখা করতে গেলেন। সোহরাওয়ার্দী তখন বৈরুতে থেকে কিছু সময়ের জন্য লন্ডনে যান। ১৯৬৩ সালের ৮ আগস্ট রাতে শেখ মুজিব লণ্ডন যাত্রা করেন এবং ২৮ আগস্ট নেতার সঙ্গে আলোচনা শেষে দেশে ফিরে আসেন।
এ সময়ে জাতীয় পরিষদে কয়েকজন সদস্যের পদ মন্ত্রী হওয়ার ফলে শূন্য হয়ে পড়ে। এ শূন্য পদে উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনে শেখ মুজিব এনডিএফ প্রার্থীদের জন্য নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করেন। বিভিন্ন এলাকায় জনসভায় যোগ দেওয়ার পর ১৮ অক্টোবর শেখ মুজিব ঢাকায় ফিরে আসেন এবং ২০ অক্টোবর তাঁর ৩২ নম্বর ধানমণ্ডিস্থ বাসভবনে এক সাংবাদিক সম্মেলনে ভাষণ দেন। তিনি সরকারি কর্মচারীদের পক্ষপাতমূলক আচরণের জন্য কঠোর নিন্দা করে সাংবাদিকদের সুস্পষ্টভাবে বলেন যে পূর্ব বাংলার মানুষেরা পিণ্ডির উপনিবেশে পরিণত হয়েছে।
১৯৬৩ সালের ৫ ডিসেম্বর রাত ৩-২০ মিনিটে সোহরাওয়ার্দী বৈরুতে কন্টিনেন্টাল হোটেলে ৭০ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। এ নেতার মৃত্যুতে সমগ্র বাঙালি জাতি শোকাভিভূত হয়ে পড়ে। ৮ ডিসেম্বর সোহরাওয়ার্দীর মরদেহ
পৃষ্ঠা-৫৭
বৈরুত থেকে করাচি হয়ে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়। বিমানবন্দরে শোকে মুহ্যমান জনতা কান্নায় ভেঙে পড়ে এবং এক অভূতপূর্ব দৃশ্যের অবতারণা হয়। শেখ মজিবের ইচ্ছা অনুযায়ী রেসকোর্স ময়দানের এক প্রান্তে শেরে বাংলা ফজলুল হকের পাশে সমাহিত করা হয়। উল্লেখ্য যে, শেখ মুজিব সোহরাওয়ার্দি এ মৃত্যুকে হত্যাকাণ্ড হিসাবে অভিহিত করেন ১৫ ডিসেম্বর এনডিএফ-এর সভায় শেখ মুজিব বলেন যে, আমি জানি না সোহরাওয়ার্দী মারা গিয়েছেন কিনা। কিন্তু আমি মনে করি আমার নেতাকে হত্যা করা হয়েছে। আমার বাঙালি ভাইয়েরা ঐক্যবদ্ধ হউন এবং প্রতিশোধ নিন। গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে পড়ুন। যারা আমাদের নেতাকে হত্যা করেছে, তাদের বিরুদ্ধে আমাদের প্রতিশোধ নিতে হবে।’
এ বক্তৃতার জন্য পরবর্তীতে শেখ মুজিবকে বহু মামলায় জড়িয়ে ফেলা হয় এবং অযথা হয়রানি করা হয়।
১৯৬৪ সালের জানুয়ারি মাসে কাশ্মীরের এক মসজিদে রক্ষিত হযরত মুহাম্মদ (স.)-এর কেশ চুরি হয়ে যাওয়ার ফলে প্রথমে ভারতে ও পাকিস্তানে সাম্প্রদায়িক দাংগা শুরু হয়। পূর্ব বাংলায় খুলনা থেকে ঢাকা পর্যন্ত সাম্প্রদায়িক দাংগা ছড়িয়ে পড়ে। এ দাংগা প্রতিরোধে শেখ মুজিব উজ্জ্বল ভূমিকা রাখেন। পূর্ব পাকিস্তান রুখিয়া দাঁড়াও শীর্ষক প্রচারপত্র ছাপার অভিযোগে শেখ মুজিব ও তাজউদ্দিনকে গ্রেফতার করা হয়। পরে উভয়কেই জামিনে মুক্তি দেওয়া হয়। কিন্তু প্রেস এন্ড পাবলিকেশন্স অর্ডিন্যান্স ও পাকিস্তান দণ্ডবিধির বিভিন্ন অভিযোগে অভিযুক্ত করে মামলা দায়ের করা হয়।
শেখ মুজিব এ সময় আওয়ামী লীগকে পুনরুজ্জীবিত করার লক্ষ্যে সচেষ্ট হন। এনডিএফ-এর কর্মকাণ্ড স্তিমিত হয়ে পড়ে। এনডিএফকে দিয়ে দাবি আদায় সম্ভবপর নয় বলে শেখ মুজিব মনে করেন। তাই তিনি পুরাতন সহকর্মীদের নিয়ে আওয়ামী লীগকে পুনরুজ্জীবিত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ১৯৬৪ সালের ২৫ জানুয়ারি মওলানা আবদুর রশিদ তর্কবাগীশ-এর সভাপতিত্বে ৩২ নম্বর ধানমণ্ডি বাসভবনে সাবেক আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির এক বর্ধিত সভা অনুষ্ঠিত হয়। আতাউর রহমান খান ও আবুল মনসুর আহমদ আওয়ামী লীগের পুনরুজ্জীবনের বিরুদ্ধে ছিলেন বিধায় তারা এ সভায় অনুপস্থিত ছিলেন। পরদিন সংবাদপত্রে আওয়ামী লীগের পুনরুজ্জীবনের খবর প্রকাশিত হয়। ঐ সভায় দেশে পার্লামেন্টারি পদ্ধতির গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন, আঞ্চলিক সার্বভৌমত্ব, পূর্ব পাকিস্তানকে সামরিকভাবে শক্তিশালী করা,। পাকিস্তানের নৌবাহিনীর সদর দপ্তর চট্টগ্রামে স্থানান্তরিত করা ও রাজবন্দীদের মুক্তি দাবি করা হয়।
পৃষ্ঠা-৫৮
৬ মার্চ (১৯৬৪) গ্রীন রোডে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের ৩ দিনব্যাপী কাউন্সিল অধিবেশন শুরু হয়। এ কাউন্সিল অধিবেশনে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের সদস্যসহ প্রায় এক হাজার কাউন্সিলার অংশগ্রহণ করেন। এ অধিবেশনে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসাবে শেখ মুজিব মর্মস্পর্শী ভাষণ দেন। তিনি বলেন : আওয়ামী লীগের ইতিহাস আপনাদের সুগামের ইতিহাস। আপনারা জানেন, কোনো অবস্থায় কোনো পরিপ্রেক্ষিতে এভাবে এ প্রতিষ্ঠানের সৃষ্টি হয়েছিল। আপনারা জানেন, সৃষ্টি থেকে আরম্ভ করে এ পর্যন্ত কত রকম প্রতিকূল অবস্থা ও বাধা-বিপত্তির মধ্যদিয়ে আপনারা আওয়ামী লীগকে দেশের সেরা ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে পেরেছেন। কিন্তু দুঃখের বিষয়, গণতন্ত্রের মূলনীতি যে দেশ থেকে যখন তখন মুষ্টিমেয় স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ক্ষমতাসীন মহলের ইঙ্গিতে নির্বাসন দেওয়া হয়, যে দেশে কথায় কথায় বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির নেতা ও কর্মীদের জেলে আটক করা হয় সে দেশে গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য সৃষ্টি করা এক বিরাট কাজ, সুকঠিন দায়িত্ব। আসুন আজ আমরা এ শপথগ্রহণ করি যে, যতদিন না পাকিস্তানের বুক থেকে স্বার্থান্বেষী মহলের পরাজয় ঘটবে যতদিন না এদেশে গণতান্ত্রিক সরকার কায়েম করতে পারব, যতদিন না দেশকে একটি জনকল্যাণকর রাষ্ট্র হিসেবে গঠন করতে পারব, যতদিন না সমাজ থেকে শোষণের মূলোৎপাটন হবে, যতদিন না দেশের প্রত্যেক নাগরিক দল-মত-ধর্ম নির্বিশেষে অর্থনৈতিক মুক্তি ও আর্থিক প্রাচুর্যের আস্বাদ গ্রহণ করতে পারবে, যতদিন না শ্রেণিবিশেষের অত্যাচার থেকে সমগ্র দেশ ও জাতিকে মুক্তি দেওয়া হবে ততদিন আমরা সংগ্রাম চালিয়ে যাব। ন্যায় আমাদের নীতি, আমাদের আদর্শ। জয় আমাদের অনিবার্য।’
১৮ই মার্চ দাবি দিবস পালনকালে তাজউদ্দিন ও কোরবান আলীকে গ্রেফতার করা হয়। পরদিন পুলিশের নির্যাতনের প্রতিবাদে ঢাকায় হরতাল পালিত হয়। বিকেলে পলন্টন ময়দানে জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। শেখ মুজিব তাঁর ভাষণে বল…
Comments