স্বপ্নমঙ্গল যাত্রার বছর ছোঁয়া



স্বপ্নমঙ্গল যাত্রার বছর ছোঁয়া





পদ্মায় সেতু হয়েছে এক বছর হলো। গেল বছরের ২৫ জুন মহা আড়ম্বরে উদ্বোধন হয় বাঙালির স্বপ্নের পদ্মা সেতু। সেতু বিভাগের হিসাব অনুযায়ী, এক বছরে পদ্মা সেতুতে টোল আদায়ের পরিমাণ ৮০০ কোটি টাকার বেশি। ২০২২ সালের ২৬ জুন ভোর ৬টা থেকে যান চলাচল শুরু হওয়া পদ্মা সেতুতে গেল ৩১ মার্চ পর্যন্ত নয় মাসে আয় হয়েছে ৬০৩ কোটি টাকার টোল।


স্বপ্নমঙ্গল যাত্রার বছর ছোঁয়া
খান মুহাম্মদ রুমেল


এর পরের তিন মাসে (এপ্রিল-মে এবং জুনের প্রথম ২০ দিন) টোল আদায় হয়েছে প্রায় ২০০ কোটি টাকা। এ তো গেল শুধু টোল আদায়ের পরিমাণ। এ সেতুকে ঘিরে আশপাশের বহু মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। দেশের ২১টি জেলার নানা রকম আর্থিক ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও সুবিধা নিশ্চিত হয়েছে। সেসবকে টাকার অঙ্কে ধরলে মোট সংখ্যাটা কত দাঁড়ায় সেটি নিশ্চয় ভেবে দেখা যেতে পারে। ভাবা উচিত।



এর পরেও আরও বেশকিছু কথা থাকে। এই একটি সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা পর্যায় থেকে শুরু করে একেবারে উদ্বোধন পর্যন্ত নানা রকম নাটকীয় ঘটনা, নানা উত্থানপতন, রাজনৈতিক বাদানুবাদ–সব মিলিয়ে তৈরি হয়েছিল এক ভিন্ন ব্যঞ্জনা। আজ এক বছর পর পেছন ফিরে দেখা যেতে পারে সেসব দিন। স্মরণ করা যেতে পারে অনেক অনেক ঘটনা-অনুঘটনার কিছু খণ্ডচিত্র।

২৭ মে ২০২২। পদ্মা সেতু উপলক্ষে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ফেসবুক পেজে একটি আলোচনা অনুষ্ঠান হয়। অতিথি ছিলেন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক ও অর্থনীতিবিদ ড. মশিউর রহমান। সেখানে কথা বলার একপর্যায়ে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন তিনি। কান্নায় ভেঙে পড়েন! ওইদিন কেন ড. মশিউরের চোখে জল ছিল? প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে একটু পেছন ফিরতে হবে। ড. মশিউর রহমান ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর অর্থ উপদেষ্টা। পদ্মা সেতুতে কল্পিত দুর্নীতির অভিযোগ যখন তোলা হয়, তখন যারা সমালোচনাকারীদের আক্রমণের লক্ষ্য হয়েছিলেন তাদের অন্যতম ড. মশিউর রহমান। এ ছাড়া তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন ও সেতু সচিব মোশাররফ হোসেনকেও মিথ্যা অভিযোগে শরবিদ্ধ হতে হয়। তাকে জেলের ঘানি পর্যন্ত টানতে হয়েছে।

পদ্মা সেতু নিয়ে নানা মহলের সমালোচনায় বিদ্ধ ড. মশিউর রহমান সে সময় গণমাধ্যমে আর্তি জানান, ‘আমি আপনাদের কাছে সহানুভূতি চাই। আপনারা আমাকে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করুন।’ শেষমেশ বাধ্যতামূলক ছুটিতে যেতে হয় তাকে। ২০১২ সালের ৫ জানুয়ারি পদত্যাগ করতে হয় যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনকে। এরপর দফায় দফায় তাকে হাজিরা দিতে হয় দুদকে। দেড় মাস জেল খাটতে হয় সেতু সচিবকে।

২০১২ সালের ৩ ডিসেম্বর দুদক কার্যালয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে সৈয়দ আবুল হোসেন গণমাধ্যমকে বলেছিলেন: কোনো অসৎ কাজে সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন জড়িত নয়।

একটু পেছনে ফেরা যাক। পদ্মা সেতুর অর্থায়নে প্রথমে এডিবি তারপর যোগ দেয় বিশ্বব্যাংক। উন্নয়ন সংস্থাগুলো যোগ দিতে থাকে অর্থায়নে। এরপর কথিত দুর্নীতির অভিযোগ তুলে অর্থায়ন থেকে সরে যেতে থাকে সংস্থাগুলো। একটার পর একটা আবদার রক্ষা করেও বিশ্বব্যাংককে ফেরানো যায়নি পদ্মায়। পরে জানা যায়, বয়সসীমা পার হয়ে যাওয়ায় গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ থেকে ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে সরিয়ে দেয়ায় পদ্মা সেতুর অর্থায়ন থেকে সরে যায় বিশ্বব্যাংক।

২০১২ সালের ২৫ জুলাই লন্ডনে এক আলোচনা সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, যখন (পদ্মা সেতুতে) পরামর্শক নিয়োগের বিষয় এলো, তখন একটা কোম্পানির জন্য তারা (বিশ্বব্যাংক) বারবার চাপ দিচ্ছিল সরকারকে এবং যোগাযোগমন্ত্রীকে। যেন ওই কোম্পানিকে পরামর্শক নিয়োগ দেয়া হয়। এখন যদি আমি প্রশ্ন করি, বিশ্বব্যাংক কত পার্সেন্ট টাকা খেয়ে ওই কোম্পানির জন্য তদবির করেছে?

কল্পিত সব অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণ হতে বেশিদিন সময় লাগেনি। ২০১৭ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি রায় দেন কানাডার আদালত। রায়ে বলা হয়, পদ্মা সেতুতে দুর্নীতির অভিযোগ গালগল্প ছাড়া কিছুই নয়।

তবে কল্পিত অভিযোগ শুনেই সমালোচনা আর ষড়যন্ত্রে মেতে ওঠেন দেশের রাজনীতি এবং সুশীল সমাজের কিছু মানুষ। ২০১৮ সালের ২ জানুয়ারি ছাত্রদলের এক সভায় বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া তাচ্ছিল্যভরে মন্তব্য করেছিলেন: পদ্মা সেতু এই আওয়ামী লীগের আমলে হবে না। জোড়াতালি দিয়ে বানানো সেতুতে কেউ উঠবেন না।

রাজনৈতিক বিরোধিতার সুরে তাল মিলিয়ে কান নিয়ে গেছে চিলে এমন রব তোলেন কয়েকজন সুশীলও। সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)-এর সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেছিলেন, দুর্নীতি আমাদের কীভাবে পেছনে নিয়ে যাচ্ছে তার আরেকটি উদাহরণ এটি (পদ্মা সেতু)। জাতীয় উন্নয়নের ক্ষেত্রে এটি প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে।

সরকার পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ অস্বীকার করায় দুঃখ পান ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তিনি বলেছিলেন, প্রথম অভিযোগ পাওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকারের মনোভাব হলো অভিযোগ অস্বীকার করে যাওয়া। অর্থমন্ত্রী বলেছেন যে, কিছু কিছু ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। কিন্তু সত্যিকার অর্থে দাতাগোষ্ঠীর আস্থা অর্জন করতে পারেনি।

অপরদিকে দুদকের বিচার করার ক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেছিলেন, দুদকের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল কোনো প্রমাণ মেলেনি। কিন্তু কানাডার পুলিশ এসে দুর্নীতির প্রমাণ নিয়ে গেছে। এ ঘটনা নিয়ে তদন্ত করার সামর্থ্য আছে কি না দুদকের, সেটি নিয়ে আমার সন্দেহ রয়েছে। এ ঘটনা তদন্তের জন্য প্রয়োজনীয় স্বাধীনতা তাদের আছে কি না, সেটি নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।

এ ছাড়া উপরের ব্যক্তিরা পদ্মা সেতু প্রকল্পে কল্পিত দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে আগাপাশতলা তলিয়ে না দেখে দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমে নানা মন্তব্য করেন। প্রবন্ধ-নিবন্ধ লেখেন।

২০১২ সালের ১ জুলাই ভয়েস অব আমেরিকা ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যকে উদ্ধৃত করে। প্রতিবেদক আনিস আহমেদের করা রিপোর্টের শিরোনাম ছিল: ‘দুর্নীতির পরিবর্তিত সংজ্ঞা বুঝতে হবে: দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। এর পর বিস্তারিত প্রতিবেদনটি ছিল এমন: বিশ্বব্যাংক দুর্নীতির অভিযোগে পদ্মা সেতুর জন্য বাংলাদেশকে দেয়া ১২০ কোটি ডলারের ঋণ বাতিল করেছে। বিশ্বব্যাংকের এই সিদ্ধান্ত সম্পর্কে ভয়েস অব আমেরিকাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের সিনিয়র ফেলো এবং বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন যে, এ ঘটনাটি দুর্ভাগ্যজনক এবং খানিকটা অপমানজনকও বটে।

একটা ঘটনার কথা বলি। ২৫ জুন ২০২২। পদ্মা সেতু উদ্বোধনের দিনক্ষণ ঠিক হওয়ার পর নানা রকম রিপোর্ট তৈরির পরিকল্পনা করতে থাকি আমরা। সময় টেলিভিশনের সংবাদ পরিকল্পনায় প্রতিদিনই যোগ করছি নতুন নতুন রিপোর্টের আইডিয়া। এর মধ্যে একটা আইডিয়া ছিল এমন: সেতু নিয়ে যারা নানা রকম নেতিবাচক মন্তব্য করেছিলেন, বিরোধিতা করেছিলেন, তারা এখন কী ভাবছেন? সেই বিষয়ে জানতে রিপোর্ট তৈরির কাজে এক সহকর্মীকে পাঠাই এক অধ্যাপকের কাছে। সেই অধ্যাপক সুশাসন এবং দুর্নীতি নিয়ে নানান বয়ান দেন সবসময়। তার চোখে দেশে সবসময়ই একটা রসাতলে যাওয়ার অবস্থা বিরাজমান। সেই ধারাবাহিকতায় এক সময় পদ্মা সেতুতে কল্পিত দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে খুব সরব ছিলেন তিনি। নানান সভা-সেমিনারে তো সেতু নির্মাণের বিরোধিতা করে কথা বলেছেনই, পত্র-পত্রিকায় কলাম লিখেছেন কল্পিত দুর্নীতির অভিযোগের পক্ষে। সাফাই গেয়েছেন ষড়যন্ত্রকারীদের পক্ষে। এরপর যখন অভ্যন্তরীণ অর্থায়নে সেতু নির্মাণের কথা বলা হলো, তখন এটার বিপক্ষেও লেখালিখি করেছেন তিনি এবং আরও কয়েকজন। সে কারণেই তার বক্তব্য জানতে চেয়ে পাঠানো। উদ্বোধনের আগে আগে যখন তার ইন্টারভিউ করতে গিয়ে আমার সহকর্মী প্রশ্ন করলেন: আপনি কি আপনার তখনকার বক্তব্য থেকে সরে এসেছেন? তিনি বললেন, কোন বক্তব্য? আমার সহকর্মী তখন তার বিভিন্ন সময়ের লেখা এবং বক্তৃতার ক্লিপ তাকে দেখান। সব দেখে সেই অধ্যাপক বললেন, এমন কিছু লিখেছি বলে আমার মনে পড়ছে না। তাহলে কি স্যার এই লেখা আপনার নামে ছাপানো হয়েছে আপনাকে না জানিয়ে? খুব বিনয়ের সঙ্গে জানতে চাইলেন আমার সহকর্মী।

এই লেখায় খুব করে মনে পড়ছে আরও একটি ঘটনা। প্রিয় পাঠক আপনাদের কি রেনুর কথা মনে আছে? তাসলিমা বেগম রেনু। ওই যে একজন নারী তার সন্তানের স্কুলের ভর্তির খবর নিতে গিয়েছিলেন বাড্ডার একটি স্কুলে। তারপর ছেলেধরার গুজব ছড়িয়ে তাকে পিটিয়ে মেরে ফেলেছিল এক শ্রেণির সুবিধাবাদী মানুষ।

২০১৯ সালের ২০ জুলাই দুপুরটা কি মেঘলা ছিল! নাকি কাঠফাটা রোদে পুড়ছিল শহরটা আজ আর মনে নেই। তবে সেদিন বৃষ্টি ছিল না। করোনার থাবা ছিল না পৃথিবীজুড়ে। বাংলাদেশজুড়ে। সেদিনের নগরটাও ছিল অন্য আরেকটা দিনের মতোই ট্রাফিক জ্যামে ঠাসা। রাস্তার পাশে বসেছিল শরবতওয়ালা। ছিল ভবঘুরে, মাতাল মাদকাসক্ত, কঠোর শ্রমে খেটে খাওয়া কিংবা শীতাতপ কক্ষে বসে রাজা-উজির মারা ব্যস্ততা। এই শহরের কোটি মানুষ অন্যদিনের মতোই সেদিনও বের হয়েছিলেন নিজের নিজের কাজে। খুব জরুরি একটা কাজে বের হয়েছিলেন তাসলিমা বেগম রেনুও। সন্তানের স্কুলে ভর্তির খোঁজখবর নিতে গিয়েছিলেন বাড্ডার একটি প্রাইমারি স্কুলে। আর আমরা এই শহরের সভ্য মানুষেরা তাকে পিটিয়ে মেরে ফেলেছি। কি সহজে লিখে ফেললাম তিন শব্দের বাক্য: পিটিয়ে মেরে ফেলেছি। অথচ মানুষরূপী হায়েনাগুলো যখন ঝাঁপিয়ে পড়েছিল রেনুর ওপর। আঘাতের পর আঘাত করে চলেছিল তার শরীরজুড়ে। তখন কেমন লেগেছিল তার? শারীরিক ব্যথা উপেক্ষা করে চোখের সামনে ভাসছিল কি প্রিয় সন্তানের মুখ? যাকে ভর্তি করাতে তিনি গিয়েছিলেন সেই স্কুলে? শারীরিক ব্যথার পাশাপাশি তীব্র অপমানবোধ কাজ করেছে কি রেনুর মনে? যারা তাকে আঘাতের পর আঘাত করছিল, মারের পর মার দিয়ে যাচ্ছিল সেই মানুষগুলোর সামনে দিয়েই তো তিনি স্কুলে গিয়েছিলেন। চারপাশের মানুষগুলোর হঠাৎ এমন দানব হয়ে ওঠায় কেমন অনুভূতি হয়েছিল রেনুর? আজ আর জানার উপায় নেই। জানার উপায় সেদিনও ছিল না ২০১৯ সালের ২০ জুলাইয়ে। কারণ, মৃত্যু নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত তাকে আঘাত করেই চলেছিল একদল পিশাচ, যাদের আমরা মানুষ নামে ডাকি! কিছু মানুষ যখন পেটাচ্ছিল তাসলিমা বেগম রেনুকে, অনেক মানুষ তখন পাশে দাঁড়িয়ে মোবাইল ফোনে রেকর্ড করছিল সেই ভয়াবহ নারকীয় দৃশ্য। রেনুকে বাঁচানোর জন্য, হায়েনাদের নিবৃত্ত করার জন্য এগিয়ে এলেন না কেউই। একজন মানুষও সেখানে ছিলেন না!

ঘটনার দিন খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে নিথর পড়ে থাকতে দেখেছিলাম তাসলিমা বেগম রেনুকে। ছিন্নভিন্ন জামাকাপড়, থেঁতলে দেহে তখন বোঝা যাচ্ছিল মধ্যবিত্ত আভিজাত্যের ছাপ। অসংখ্য মানুষ রেনুকে ছেলেধরা সন্দেহে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল হায়েনার মতো, অথচ নিথর পড়ে থাকা দেহটার পাশে ছিল না কেউই। স্কুলের সামনে অস্থায়ী কাঁচাবাজারটা শুধু বন্ধ ছিল। আশপাশের বাকি দোকানপাট, মানুষের নিত্যদিনের ব্যস্ততা কিছুই থামেনি একটি মৃত্যুর জন্য। এক সময় পুলিশ নিয়ে যায় রেনুর মরদেহটা মেডিকেলের মর্গে। ঘটনার দুদিন পর মহাখালীতে রেনুর ভাইয়ের বাসায় গেলে দেখা হয় রেনুর পরীর মতো মেয়েটার সাথে। যাকে ভর্তি করানোর খোঁজ নিতেই তিনি সেদিন গিয়েছিলেন বাড্ডার সেই স্কুলটায়। মেয়েটা তখনও জানে না মায়ের কি নির্মম পরিণতি করেছি আমরা–এই সভ্যসমাজের মানুষেরা। মা বাইরে গিয়েছে তার জন্য চকলেট আনার জন্য–এই মিথ্যে সান্ত্বনায় মেয়েটা তখন ভুলে থাকলেও আজ চার বছরের বেশি সময় পর সে কি জানেনি মানুষ কেমন হায়েনার মতো পিটিয়ে মেরে ফেলেছে তার নির্দোষ-নিরীহ মা-কে। মাঝে মাঝে মনে হয় বাচ্চা মেয়েটার সামনে গিয়ে দাঁড়াই। কিন্তু কেন জানি সাহসে কুলোয় না। সে যদি প্রশ্ন করে বসে, কেন এমন পরিণতি বরণ করতে হলো তার মাকে। কী জবাব দেব তখন? জবাব দেয়ার মতো কোনো উত্তর আমার কাছে আছে কি? না, নেই! আর নেই বলেই অপরাধীর মতো পালিয়ে বেড়াই। আর আজকের মতো মাঝে মাঝে মনে পড়ে যায় রেনুর কথা, তার মেয়ের কথা। তার ছেলের কথা। আর মনে পড়ে রেনুর ভাইয়ের একটি ফেসবুক স্ট্যাটাসের কথা। ভাইরাল হওয়া সেই স্ট্যাটাসটা ছিল এমন: আমার বোন আমার চেয়ে বয়সে দশ বছরের ছোট হবে। রেনু ওর নাম। গতকাল গণপিটুনিতে মৃত্যু হয়েছে ওর। ছোটবেলা হতে কিছুটা নার্ভাস প্রকৃতির রেনু ছিল খুব মেধাবী। স্কুলে কখনও দ্বিতীয় হয়নি। সব সময় ফার্স্ট গার্ল। বাবা রেনুকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেছিলেন সে ডাক্তার হবে নয়তো সরকারি বিসিএস কর্মকর্তা। কিন্তু সংসার জীবনটা রেনুর সুখের হয়নি। ছোট ছোট দুটি সন্তান নিয়ে সে একাই জীবন অতিবাহিত করছিল।

সংসার ভেঙে গেছে বেশ আগেই। বাবা ও মা মারা গিয়েছেন। রেনু নিজের মতো করেই সন্তানদের ভালো স্টুডেন্ট হিসেবে গড়ে তুলতে চেয়েছিল। ছোট বাচ্চাটার মাত্র চার বছর বয়স। মৃত্যুর আগের রাতে কিছুটা অস্থির দেখাচ্ছিল রেনুকে। ছোট বাচ্চাকে স্কুলে ভর্তি করার জন্য সকালে স্কুলে যাবে।

সকাল হলে বাসার কাছে প্রাইমারি স্কুলটায় ভর্তির বিষয়ে খোঁজখবর নিতে গিয়েছিল। কিন্তু হঠাৎ করেই অপরিচিত দুটি বখাটে ছেলে তাকে অহেতুক প্রশ্ন করতে শুরু করলে সে নার্ভাস হয়ে যায়। রেনুর বেশ মানসিক অস্বস্তি হয় এ ধরনের জেরায়। সে গুছিয়ে কথা বলতে পারে না। তার মতো সাধারণ মেয়ে সারা জীবনে চাকরি সংসার সমাজ ইত্যাকার বহির্মুখী অনুষঙ্গকে আত্মস্থ করতে পারেনি।

তার অন্তর্মুখী স্বভাবের জন্য। যেমন পুলিশ, মাস্তান, ক্ষমতাবান, ডোমিনেটিং সোসাইটি, প্রভাব বিস্তারকারী মানুষজনের সামনে পড়লে সে ভাষা হারিয়ে ফেলত। কিন্তু মনে মনে সে ভাবত অন্যরা তো বেশ মানিয়ে নিয়ে চলছে ফিরছে, সে পারছে না কেন?

কেন এসব পরিস্থিতিতে পড়লে তার কথা বলার স্বাভাবিকতা হারিয়ে ফেলে সে? কেন সে পরিষ্কার করে অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে পারে না, কেন সে মানুষের প্রশ্নের (অযাচিত) পরিষ্কার জবাব দিতে পারে না। কেন সে ছোটবেলায় দোষ না করেও মায়ের কড়া ধমকে চুপ করে ছিল, কেন সে স্বামীর অন্যায়েও নিঃশব্দ ছিল, কেন সে পুলিশের নাম শুনলেই অপরাধীর মতো ভয়ে নিজের মধ্যে সেঁধিয়ে পড়ত সে নিজেও জানে না।

সে ভয় পেত চেনা পরিচিত ঢাকা শহরের এসব কিছু এইই ছিল সত্য। সেই সত্যটাই তার জীবন নিয়েছে। সেই প্রখর খরতাপের মধ্যে শত শত মানুষের কয়েকজন তাকে নৃশংসভাবে পেটাল। পিটিয়ে তার সারা শরীর থেঁতলে দিল। শেষ নিশ্বাস বের হবার আগে তখনও সে তাকিয়েছিল মানুষগুলোর দিকে। রক্তমাখা মুখ, কপালের মধ্যে রক্তভেজা চুলগুলো ঘামে, রক্তে লেপ্টে আছে, সেই অবস্থায় তাকিয়েছিল মানুষের (মানুষ???!) দিকে। হয়তো শেষ মুহূর্তেও চেষ্টা করছিল গুছিয়ে কিছু বলতে…‘ভাইগো ও ভাই, আমি এখানে এসেছিলাম আমার বাচ্চাকে স্কুলে ভর্তি করাতে।

আমি ছেলে ধরা না। আমার নাম তাসলিমা রেনু। দুটো বাচ্চা আছে আমার। আমি মরে গেলে ওদের কেউ থাকবে না। এখনো যদি আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যান আমি মরবো না। আমি সুস্থ হয়ে তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরতে চাই। বাসায় বাচ্চাগুলো আমার জন্য অপেক্ষা করে আছে।”

কিন্তু বোবার মতো রেনু তাকিয়েই ছিল ঘোরলাগা চোখে। বিবশ বিহব্বল হয়ে মাটিতে পড়ে যায় রেনু। দুটি হাত চারটি হাত লাঠি হাতে ক্রমাগত পিটিয়ে পিটিয়ে শেষ করে দিলো —শুধু রেনুর জীবনটা নয়,তার সব স্বপ্ন, তার অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যত। আমারবোন রেনুর হত্যার ভিডিও টি যারা করেছেন,যারা দেখেছেন,তাদের সবাইকে অশেষ ধন্যবাদ।

আপনারা সবাই অনেক গোছানো মানুষ। পরিপাটি ফিটফাট,নিরাপদ। রেনু,বোনটা আমার যদি এর ছিঁটেফোঁটাও স্মার্ট হতো !
এই ঘটনায় পরে রেনুর ভাগ্নে নাসির উদ্দিন বাদী পাঁচশ জনকে অজ্ঞাত আসামি করে মামলা দায়ের করেছিলেন। পরের বছর পুলিশ ১৫ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট জমা দেন। এর মধ্যে দুজন আসামি অপ্রাপ্ত বয়স্ক। আদালতে স্বীকারক্তিমূলক জবাবনবন্দিও দিয়েছেন এক নারী। রেনুর বোন এবং ভাগ্নের করা এক রিটের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত রুলও জারি করেছিলেন- কেন রেনুর পরিবারকে এক কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দেয়া হবে না- জানতে চেয়ে।

কিন্তু কেন রেনুকে এভাবে প্রাণ দিতে হলো নির্মমভাবে? এক শ্রেণির সুবিধাবাদী তখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গুজব ছড়িয়ে দিয়েছিলেন-পদ্মাসেতুতে মানুষের মাথা লাগবে। আর তাতেই দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে ছেলেধরা আতঙ্ক। অপরিচিত কাউকে দেখলেই দেশের অনেক জায়গায় ছেলেধরা সন্দেহে শুরু হয় গণপিটুনি।

পদ্মার বুকে তৈরি হওয়া সেতু দিয়ে গেলো এক বছর ধরে প্রতিদিন পারাপার হন বহু মানুষ। দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন এনে দেয়া এই সেতু এখন একটি পর্যটন স্থানও। যখনই কোনো কারণে পদ্মাসেতু পাড়ি দিই কিংবা ওই এলাকায় যাই, আমার খুব করে মনে পড়ে রেনুর কথা। রেনুর দীর্ঘশ্বাস কি মিশে আছে না পদ্মার বাতাসে বাতাসে!


হেঁটে হজে যাওয়া শখ নাকি ইবাদত?
কুমিল্লার আলিফ মাহমুদ নামে এক তরুণ ২০২৪ সালে হজ করবে। সেই নিয়ত করে হেঁটে মক্কা যাত্রা শুরু করেছে সম্প্রতি। কুমিল্লা থেকে রওনা হওয়ার মুহূর্তের দৃশ্য ভিডিও ধারণ করে তা ফেসবুকে প্রকাশ করা হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে সেই ভিডিও ভাইরাল। প্রায় সব দর্শক আলিফ মাহমুদের অভিনব হজযাত্রায় আবেগপ্রবণ হয়ে বাহবা দিচ্ছে। অল্পকিছু মানুষ এই বিষয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন। আসলে আলিফ মাহমুদের এই হজযাত্রা সম্পর্কে ইসলামি ব্যাখ্যা কী?
হেঁটে হজে যাওয়া শখ নাকি ইবাদত?
মুফতী ফয়জুল্লাহ আমান


৫ মিনিটে পড়ুন
কোনো বিষয়ে ইসলামের সমাধান জানতে হলে আমাদের কোরআন ও হাদিসকেই অনুসরণ করতে হবে। যে বিষয়ে কোরআন হাদিসে কোনো সমাধান না থাকে, সেখানে কিয়াস বা অন্য কোনো দলিলের আশ্রয় নেয়ার প্রয়োজন দেখা দেয়। কিন্তু ৮ হাজার মাইল হেঁটে হজ করার বিষয়ে কোনো যুক্তি বা কিয়াসের প্রয়োজন নেই, এ বিষয়ে কোরআন হাদিসের স্পষ্ট নির্দেশনা আছে।



আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা ইরশাদ করেন, আল্লাহ তায়ালা কাউকে তার সামর্থের অধিক কষ্টদায়ক কাজ চাপিয়ে দেন না। [সুরা বাকারা, আয়াত: ২৮৬] অন্য আয়াতে ইরশাদ করেন, আল্লাহ তায়ালা তোমাদের ধর্মের মাঝে কোনো কঠোরতা রাখেননি। [সুরা হজ, আয়াত ৭৮] অন্য আয়াতে ইরশাদ করেন, আল্লাহ তোমাদের জন্য যা সহজ তা চান, যা কষ্টদায়ক তা চান না। [সুরা বাকারা, আয়াত:১৮৬ ]

রাসুল সা. এক ব্যক্তিকে দেখলেন, সে তার ছেলেদের কাঁধে ভর দিয়ে হজ করতে যাচ্ছে। রাসুল সা. জিজ্ঞেস করলেন কী ব্যাপার? উটে সাওয়ার না হয়ে এভাবে তোমাদের কাঁধে ভর দিয়ে হাঁটছে কেন? ছেলেরা বলল, আমাদের বাবা হেঁটে হজ করার মানত করেছেন। রাসুল সা. বললেন, তাকে সওয়ার হতে বলো, তার হাঁটার প্রতি আল্লাহর কোনো প্রয়োজন নেই। [তিরমিযি শরিফ]

অন্য এক বর্ণনায় এসেছে, উকবা ইবন নাফের বোন হেঁটে হজের মানত করেন। রাসুল সা. শুনে তাকেও নিষেধ করেন, বলেন, তার কষ্ট দিয়ে আল্লাহর কোনো কাজ নেই। [বাইহাকি]

এই দুটি ঘটনা থেকে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, হেঁটে হজ করা কোনো বিরাট পুণ্যের কাজ নয়। এটা কোনো বিশেষ সাওয়াবের কাজ হলে স্বয়ং রাসুল সা. হেঁটে হজ করতেন। রাসুলের সাহাবিরা হেঁটে হজ করতেন। তারপর ১৪০০ বছর ধরে বিখ্যাত সব মনীষীরা তাদের অনুসরণ করতেন।

সাহাবিদের মাঝে কেবল হজরত হাসান ইবনু আলির ঘটনা কিছু কিতাবে উল্লেখ করা হয়েছে, তিনি হেঁটে পঁচিশ বার হজ করেছেন। কিন্তু তিনি কোত্থেকে হেঁটেছেন? কত হাজার মাইল হেঁটেছেন? তিনি কী মদিনা থেকে হেঁটে পাঁচশ’ মাইল অতিক্রম করেছেন? শিয়াদের বিখ্যাত মুহাদ্দিস মুহাম্মাদ ইবন ইয়াকুব আলকুলাইনি লিখেন, ইমাম আবু আব্দিল্লাহকে এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হলো, ইমাম হাসান হেঁটে হজ করেছেন, এর দ্বারা উদ্দেশ্য কী? তিনি কি মদিনা থেকে হেঁটে মক্কা গিয়েছেন, না কি মক্কা থেকে মিনা আরাফা মুযদালিফায় হেঁটে গিয়েছেন? আবু আব্দিল্লাহ বললেন, মদিনা থেকে হেঁটে আসেননি, মক্কা থেকে মিনায় হেঁটে গেছেন। [কুলাইনি রচিত আলকাফি ৪/৪৫৬]

মক্কা থেকে মিনা আরাফার এই সামান্য পথেও তার সাথে অনেকগুলো উট ছিল এবং সফরের সব পাথেয় ছিল। তার সাথে অনেক মানুষ ছিল। মূলত হজের সময় দূর-দূরান্তের অনেক মানুষ আহলে বাইতের সাক্ষাত লাভ করতে চাইত, তাদের সুযোগ করে দেয়ার জন্যই হজরত হাসান রা. মক্কা থেকে মিনায় হেঁটে যেতেন। এ সময় পথে অসহায় মানুষদের দান সদকা করতেন। হেঁটে হজের অর্থ কেবল এই। এটিকেই কেউ কেউ মনে করেছেন মদিনা থেকেই তিনি হেঁটেছেন। বিষয়টি মোটেও ঠিক নয়। কতিপয় বর্ণনাকারী ধারণাবশত মদিনা থেকে হেঁটে আসার কথা সংযোজন করেছেন।

কুমিল্লার আলিফ মাহমুদ নামে একটি ছেলে হেঁটে হজ করবেন বলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েছেন। তাকে অর্থ সহায়তা করছে দুলাল কাজি গ্রুপ নামের একটি ব্যবসায়িক সংস্থা। এখন সে কুমিল্লা থেকে ঢাকার পথে আছে। ঢাকা থেকে যাবে যশোর বেনাপোল। তারপর একে একে ছয়টি রাষ্ট্র পার হয়ে পৌঁছাবে সৌদি আরব। এর আগে পাকিস্তান ভারত মরক্কো ও লন্ডন থেকেও এমন পদব্রজে হজ করার নজির রয়েছে বিগত কয়েক বছর ধরে। মরক্কো থেকে যিনি হেঁটে হজ করেছেন তার ছিল অর্থ সংকট। এ ছাড়া অন্য যাদের কথা উল্লেখ করা হলো তারা অর্থ সংকট নয়, বিশেষ ফ্যান্টাসি থেকেই পদব্রজে হজ যাত্রা করেছেন। কিন্তু এই ফ্যান্টাসি ইসলামের দৃষ্টিতে কেমন তা খতিয়ে দেখতে হবে।

আলিফ মাহমুদ নামে যেই ছেলেটা ঘর ছাড়া হলো, তার আট হাজার মাইল হেঁটে আরব যাওয়া কতটুকু যুক্তিযুক্তি তা ভেবে দেখা জরুরি। বিমানের ভাড়ার চেয়ে কম খরচ হওয়ার কথা নয় এই দীর্ঘ পদযাত্রা। সে ক্ষেত্রে অর্থহীন এই কষ্ট ইসলামি শরিয়তে কোনো ভাবে কি উৎসাহ যোগ্য? ফিকহের কিতাবে হেঁটে হজ করা উত্তম না কি বাহনে চড়ে এই নিয়ে একটি আলোচনা আছে। কিন্তু এর দ্বারা উদ্দেশ্য মক্কা থেকে মিনা আরাফা পদব্রজে বা বাহনে চড়ে হজের আমল সম্পাদন করা, নিজের বাড়ি থেকে তাও ৮ হাজার মাইল দূর থেকে হেঁটে হজ সম্পাদনের বিষয়ে কিছু বলা হয়নি।

রাসুল সা. মদিনা থেকে মক্কা পদব্রজে যারা পথ অতিক্রম করতে চেয়েছেন তাদের নিষেধ করেছেন। রাসুল সা.কে যদি জিজ্ঞেস করা হতো, শখের বসে আট হাজার মাইল পথ অতিক্রম করা যাবে কি না, রাসুল কি তার অনুমতি দিতেন? বিশেষত যে দুজন সাহাবির ইতিহাস পাওয়া যায় যাদের নবীজি নিষেধ করেছেন তাদের ভাইরাল হবার কোনো উদ্দেশ্য ছিল না, তারা মানত মেনেছিলেন, মানত পুরো করা কোরআনের বিধান অনুযায়ী আবশ্যক, এত কিছু সত্ত্বেও রাসুল সা. তাদের নিষেধ করেছেন। এর কারণ ইসলাম স্বভাব ধর্ম, অস্বাভাবিক কিছুর স্থান ইসলামে নেই। প্রতিটি বিধান ভারসাম্যপূর্ণ। ভারসাম্যহীন কিছুই ইসলামে সমথির্ত নয়।

অনেকে পবিত্র কোরআনের আয়াত থেকেও দলিল দিচ্ছেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন, মানুষের কাছে হজের ঘোষণা দিয়ে দাও তারা তোমার নিকট আসবে পদব্রজে ও সর্বপ্রকার ক্ষীণকায় উটের পিঠে চড়ে দূর দূরান্তের পথ অতিক্রম করে। [সুরা হজ, আয়াত: ২৮] ‘দূর দূরান্তের পথ অতিক্রম করে’ এর ব্যাখ্যায় ইমাম কুরতুবি বলেন, উটের পিঠে দূরের পথ অতিক্রম করে আসবে। ‘ইয়াতিনা’ শব্দে যে সর্বনাম ব্যবহার করা হয়েছে তার দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে উট, মানুষ নয়। উট দূরের পথ অতিক্রম করবে। এ থেকে বোঝা যায় পদব্রজে আসবে কাছের মানুষ, আর দূরের মানুষের জন্য বাহনের কথা বলা হয়েছে।


এখন আমাদের ভাবতে হবে, দ্রুতগতির যানবাহনের এই যুগে কেউ হেঁটে গেলে ইসলামের দৃষ্টিতে তা কি বাহবা পাবার যোগ্য কোনো বিষয় হবে? মনে রাখতে হবে, ইসলাম সবসময় সামনের দিকে এগিয়ে যাবার কথাই বলে, অতীতে কোনো এক সময় কেউ হেঁটে হজ করেছে বলে সেই স্মৃতি ধরে রাখতে উৎসাহিত করেনি ইসলাম। রাসুল সা.-এর যুগে যে সব সুবিধা বা প্রযুক্তি ছিল রাসুল সা. তা গ্রহণ করেছেন, হজরত আদম আ.-এর যুগের বা প্রস্তর যুগের ঐতিহ্য অনুসরণের শিক্ষা দেননি সাহাবিদের।


একটা হচ্ছে স্বাভাবিক কষ্ট, আরেকটা হচ্ছে কৃত্রিম কষ্ট। কৃত্রিম কষ্ট বয়ে বেড়াতে উৎসাহিত করা হয়নি শরিয়তে। একটি উদাহরণ থেকে স্পষ্ট হবে বিষয়টি। কারো বাড়ি মসজিদ থেকে দূরে হলে প্রতি কদমে সে সাওয়াব পাবে। কিন্ত কারো বাড়ি যদি মসজিদের সাথেই থাকে, সে যদি বাড়ি ভেঙে মসজিদ থেকে দূরে নিয়ে যেতে চায় তবে তা প্রশংসিত হবে না। একইভাবে পায়ে হেঁটে হজের বিষয়টি আমাদের ভেবে দেখতে হবে। আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা সবাইকে সুবোধ নসিব করুন।

Comments

Popular posts from this blog

ভাড়াটিয়া-ভাড়াদার আইনের জটিলতা পার হওয়া: ভাড়াটিয়াদের জন্য একটি গাইড

একটি ভিত্তিহীন গুজব উড়িয়ে দেওয়া: বাংলাদেশী সাংবাদিকদের ফ্রেঞ্চ ভিসা প্রত্যাখ্যান করা হয়নি৷

অধ্যায় 2: বাংলায় ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন