১৯৭১ ঘাতক-দালালদের বক্তৃতা ও বিবৃতি – সাইদুজ্জামান রওশন


১৯৭১ ঘাতক-দালালদের বক্তৃতা ও বিবৃতি – সাইদুজ্জামান রওশন



ঘাতক-দালালদের পরিচিতি

  • ১. গােলাম আজম -৭১ এ পাকিস্তানী বাহিনীকে বাঙালি নিধনে সহায়তাকারী, বর্তমানে জামাতে ইসলামীর আমির। জেলবন্দি।
  • ২ মতিউর রহমান নিজামী ৭১-এ আলবদর প্রধান। বর্তমানে জামাতের সেক্রেটারী জেনারেল।
  • ৩, আব্বাস আলী খান ৭১-এ রাজাকার বাহিনীর পরিচালক। বর্তমানে জামাতের ভারপ্রাপ্ত আমির।
  • ৪, মওলানা মান্নান -৭১ এ গণহত্যার সমর্থনকারী পাক বাহিনীর সহযােগী। এরশাদ শাসনামলে ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রী। দৈনিক ইনকিলাবের মালিক।
  • ৫. হামিদুল হক চৌধুরী, পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী, অভজারভার পত্রিকার মালিক সম্পাদক ছিলেন। মৃত।
  • ৬. এ এস এম সােলায়মান, কৃষক শ্রমিক পার্টির সভাপতি।
  • ৭, হাফেজ্জী হুজুর খেলাফত আন্দোলনের নেতা ছিলেন। ৭১ এ পাক সেনাবাহিনীকে বাঙালি নিধনে উৎসাহিত করেছেন। মৃত।
  • ৮. শাহ আজিজুর রহমান ৭১ এ পাক বাহিনীর সমর্থক। জিয়া শাসনামলে প্রধানমন্ত্রী। জাতি সংঘে পাকিস্তান প্রতিনিধিদলের সদস্য। মৃত।
  • ৯, বিশুদ্ধানন্দ মহাথেরাে। পাকিস্তান বৌদ্ধ কৃষ্টি সংঘের সভাপতি। পাক বাহিনীর প্রতি সমর্থন আদায়ে মুক্তিযুদ্ধের সময় ছিল তার ব্যাপক ভূমিকা।
  • ১০, আয়েন উদ্দিন-‘৭১ এ রাজশাহী জেলা শান্তি কমিটি প্রধান। মুসলিম লীগ নেতা।
  • ১১, আবদুল মতিন। মুসলিম লীগ নেতা। শান্তি কমিটি গঠনের একজন প্রধান উদ্যোক্তা। |
  • ১২ মওলানা আব্দুর রহিম-পাকিস্তান জামাতের সহ-সভাপতি। মূত।
  • ১৩, এ এন এম ইউসুফ, ৭১ এ পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগ (কনভেনশন) সাধারণ সম্পাদক, শান্তি কমিটির সঙ্গে একাত্ম। বর্তমানে মুসলিম লীগের সহ-সভাপতি।
  • ১৪, কাজী আব্দুল কাদের -৭১ এ মুসলিম লীগের (কাইয়ুম) প্রাদেশিক প্রধান, পরবর্তীতে মুসলিম লীগ সভাপতি।
  • ১৫, আউলু -৭১ এ পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যালঘু বিষয়কমন্ত্রী।
  • ১৬, ডঃ এ এম মালেক-৭১ এ পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর। মৃত।
  • ১৭, রইসী বেগম-শেরে বাংলার কন্যা। ৭১ এ পাক বাহিনীর পক্ষে কর্মতৎপর।
  • ১৮, মাহাবুবুল হক দোলন -৭১ এ পাক বাহিনীর সমর্থক। জাতীয় পার্টি নেতা।
  • ১৯. মাহাবুবর রহমান-৭১ এ পাকিস্তান ন্যাশনাল কাউন্সিল অব ইয়ুথের সভাপতি, প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী। |
  • ২০, আবদুল খালেক-৭১ এ জামাতের সেক্রেটারী জেনারেল। জামাতের কেন্দ্রীয়
  • ২১. এ কে ফয়জুল হক শেরে বাংলার পুত্র।
  • ২২. শামসুল হুদা, সভাপতি পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগ (কনভেনশন)। জামাত নেতা।
  • ২৩. কে জি করিম -৭১ এ পাক বাহিনীর সমর্থক। ৭১ এ ঢাকা শহর মুসলিম ছাত্র। লীগের সাধারণ সম্পাদক। জাতীয় পার্টি নেতা। |
  • ২৪, আব্দুল জাহের মুহম্মদ আবু নাসের ৭১ এ ইসলামী ছাত্র সংঘের চট্টগ্রাম জেলা প্রধান।
  • ২৫, আলী আহসান মুহম্মদ মুজাহিদ-৭১ এ ইসলামী ছাত্র সংঘের ঢাকা মহানগরী প্রধান।
  • ২৬. ওবায়দুল্লাহ মজুমদার-৭১ এ মালেক মন্ত্রিসভার তথ্যমন্ত্রী।
  • ২৭, আবুল কাশেম-৭১ এ মালেক মন্ত্রিসভার অর্থমন্ত্রী। মৃত। |
  • ২৮, মুজিবুর রহমান-৭১ এ মালেক মন্ত্রী সভার তথ্যমন্ত্রী।
  • ২৯, নওয়াজেশ আহমেদ-৭১ এ মালেক মন্ত্রিসভার খাদ্য ও কৃষিমন্ত্রী।
  • ৩০, ইসলামী ছাত্র সংঘ। ৭১ এ আলবদরে রূপান্তরিত এবং এর সদস্যদের ভূমিকা ছিল বুদ্ধিজীবীদের অপহরণ ও তাদের নির্যাতন করা (বর্তমানে ইসলামী ছাত্র শিবির)
  • ৩১. এ কে এম ইউসুফ রাজাকার বাহিনীর প্রতিষ্ঠাতা। জামাত নেতা।
  • ৩২ কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটি—গণ হত্যাকারী একটি দল।
  • ৩৩, আবদুর রহমান বিশ্বাস-৭১ এ মুসলিম লীগের বরিশাল জেলা কমিটির সহ সভাপতি।
  • ৩৪, মােঃ ইউনুসঃ ৭১ এ ইসলামী ছাত্র সংঘের সেক্রেটারী জেনারেল।
  • ৩৫, খাজা খয়েরুদ্দিন ঃ ৭১ এ কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটির আহবায়ক, মুসলিম, লীগ। নেতা।
  • ৩৬, মীর কাশেম ঃ ৭১ এ চট্টগ্রাম ছাত্র সংঘের সভাপতি।
  • ৩৭ গােলাম সারওয়ার ঃ জামাত নেতা।
  • ৩৮, মওলানা নুরুজ্জামান ঃ ৭১ এ জামাত ইসলামীর প্রচার সম্পাদক।
  • ৩৯, আখতার উদ্দীন আহমেদ ঃ মালেক মন্ত্রিসভার বাণিজ্য ও শিল্প এবং আইনমন্ত্রি।
  • ৪০. মওলানা মওদুদী-জামাত ইসলামীর প্রতিষ্ঠাতা। মৃত।
  • ৪১. দৈনিক সংগ্রাম – ৭১ এ ঘাতক-দালালদের মুখপত্র।



মওলানা মওদুদী


৩ এপ্রিল বাংলাদেশের গণহত্যা ও ইন্দো-ইসরাইলী মিথ্যা প্রচারণা। হামিদুল হক চৌধুরী।| ৬ এপ্রিল টিক্কা খান চেয়েছিলেন উগ্ৰডানপন্থী দলগুলাে অর্থাৎ মুসলিম লীগ (কাউন্সিল, কাইয়ুমপন্থী এবং কনভেনশন সকলপ) পিডিপি, নেজামে ইসলাম প্রভৃতি দলগুলাে একযােগে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞে সামরিক বাহিনীকে সাহায্য করবে। কিন্তু দলগুলাের মধ্যে দেখা দিল কোন্দল। উচ্চাভিলাষী মৌলভী ফরিদ আহমদ এবং নুরুজ্জামানের নেতৃত্বের একটি দল জামাতের নেতৃত্বে কাজ করতে অস্বীকৃতি জানায়। এই সমস্যা তৈরীর পর গােলাম আজম একটি প্রতিনিধি দল নিয়ে টিকা খানের সাথে সাক্ষাৎ করেন। এই প্রতিনিধি দলের অন্যতম সদস্যের দায়িত্ব পালনে এগিয়ে আসেন পাকিস্তানের প্রাক্তন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হামিদুল হক চৌধুরী। কারণ প্রতিনিধি দলগুলাের মধ্যে মতৈক্য সৃষ্টির জন্য একজন নিরপেক্ষ ব্যক্তিত্বের প্রয়ােজন ছিল, সেই দায়িত্বই পালন করেছিলেন তিনি। টিকা খানের সাথে সাক্ষাতের পরপরই হামিদুল হক চৌধুরী বলেন “পূর্ব পাকিস্তানীরা আর যা কিছু চাক না কেন কিছুতেই দেশের ঐক্য বিনষ্ট করতে চায় না। পূর্ব পাকিস্তানীরা কি চায় একশ বিশদিন পূর্বে একটি জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচন করে পূর্ব পাকিস্তানের সকল বয়স্ক জনসাধারণ তা ঘােষণা করেছেন। ভারতীয় প্রচারণার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করা এবং তার দ্বারা একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে এদেশের অস্তিত্ব বিলােপ করে নিজস্ব সম্প্রসারণবাদী মনােভাব চরিতার্থ করা। এই উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য এবং বিশ্বকে বিভ্রান্ত করার জন্য তারা তাদের সকল প্রচার মাধ্যমের দ্বারা বিশ্ববাসীর নিকট হাজার হাজার নরহত্যা এবং বােমা বর্ষণের ফলে শহর ধ্বংসের ভিত্তিহীন অভিযােগ প্রচার করছে। প্রকৃত প্রস্তাবে ভারতীয় বেতার তার (সময়) সূচির শতকরা পঞ্চাশভাগ সময় এই উদ্দেশ্যে নিয়ােজিত করেছে। কিন্তু কতদিন যাবত এই মিথ্যার বেসাতি চলবে?


বিবৃতিতে আরাে উল্লেখ আছে ভারতীয় প্রচারণবিদরা কি করে দাবী করছেন যে, পূর্ব পাকিস্তান পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হতে চায় এবং এই ভিত্তিহীন তত্ত্বের ভিত্তিতে কি করে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের আর্থিক ও কার্যকরী সমর্থন দিতে শুরু
করেছেন। প্রকৃতপক্ষে এই ধরনের বিচ্ছিন্নতাবাদী গােষ্ঠী পাকিস্তানের চাইতে ভারতেই বেশি লক্ষ্য করা যাবে।”


তিনি আরাে বলেন-“স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ফিরিয়ে আনার জন্য এই মুহূর্তে চর্তুগুণ অধ্যাবসায় নিয়ে কাজে আত্মনিয়ােগ করা সকল শ্রেণীর মানুষের কর্তব্য। মার্চের তিন সপ্তাহব্যাপী হরতালে স্বাভাবিক জীবন যাত্রায় বিঘ্ন সৃষ্টি হয়েছে তা সারিয়ে ফেলতে হবে। প্রত্যেক নাগরিক প্রত্যেক সরকারের কাছে জীবন জীবিকা ও অধিকারের নিরাপত্তা আশা করে। যত শীঘ্রই সম্ভব বেসামরিক জনপ্রিয় সরকার কায়েমের জন্য উদ্যোগ অব্যাহত রাখতে হবে। এ প্রসঙ্গে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান যে বিবৃতি দিয়েছেন তা অভিনন্দন যােগ্য।
 দৈনিক সংগ্রাম ৭ এপ্রিল শান্তি কমিটি গঠনের পরামর্শ দিয়ে পত্রিকাটি মন্তব্য করে যে,


“বিবেক বুদ্ধিসম্পন্ন নাগরিকদের সমন্বয়ে শান্তি কমিটি গঠন এক্ষেত্রে খুবই ফলপ্রসূ হতে পারে। এ ধরনের শান্তি কমিটি যেমন দুষ্কৃতিকারীদের হাত থেকে শান্তিকামী নাগরিকদের জান-মাল রক্ষার কাজে সহায়তা করতে পারবে, অপরদিকে তেমনি দেশ ও জাতির স্বার্থ বিরােধী যে কোন মহলের যে কোন প্রচেষ্টার প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রাখাও তাদের পক্ষে সম্ভব হবে, সুতরাং প্রতিটি বিবেক বুদ্ধিসম্পন্ন নাগরিককে এ ব্যাপারে তাদের সহযােগিতার হস্ত সম্প্রসারণ করা। উচিত।”



এ এন এম ইউসুফ

১৭ এপ্রিল দালালি ক্ষেত্রে জামাতের পরই মুসলিম লীগের নাম উল্লেখ করা যায়। পূর্ব পাকিস্তানের মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে বিবৃতিতে তিনি বলেন, |

পূর্ব পাকিস্তানে ‘বাংলাদেশ সরকারের কোন অস্তিত্ব নেই। বেতারে নগ্ন প্রচারণা, পাকিস্তানে আক্রমণ পরিচালনার জন্য সেখানকার জনগণের তৎপরতা, পাকিস্তানের শান্তিপ্রিয় জনগণকে বিঘ্নিত করার জন্য লােক, অস্ত্র ও অর্থ সগ্রহের দ্বারা আন্তর্জাতিক সনদের বরখেলাপ করে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে। হস্তক্ষেপের জন্য আমরা ভারতের তৎপরতার নিন্দা করছি।”
৮ এপ্রিল মওলানা নুরুজ্জামান গােলাম সারওয়ার
একটি যুক্ত বিবৃতি। জনতাকে বিভ্রান্ত করার জন্য এই সব নেতারা মুক্তিযুদ্ধের সময় নানা ধরনের বিবৃতি প্রদান করে বেড়িয়েছেন। বিবৃতির কিছু অংশ বিশেষ,


গােলাম আজম,
৮ এপ্রিল

“ভারত পূর্ব পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করেছে। ভারতীয় বা পাকিস্তান বিরােধী এজেন্টদের বা অনুপ্রবেশকারীদের যেখানেই দেখা যাবে, সেখানেই পূর্ব পাকিস্তানের দেশ প্রেমিকরা তাদের নির্মূল করবে।” 

কাজী আবদুল কাদের ।
৮ এপ্রিল বর্বর পাকবাহিনী বাঙালি নিধনে ব্যাপকভাবে সারাদেশে তৎপর হয়ে উঠলে এই গণ হত্যাকে সমর্থন করে তিনি বলেন
 “পূর্ব পাকিস্তানে সেনাবাহিনীর সাম্প্রতিক ব্যবস্থা গ্রহণ সঠিক ও সময়ােচিত হয়েছে। রাষ্ট্রপতি হিসেবে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সঠিক পদক্ষেপই গ্রহণ করেছেন।”

এ এস এম সােলায়মান। | এই দিনে তার প্রদত্ত বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়। 
“ পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে সমাজ ও রাষ্ট্রের বিরোধীদের নির্মূল করে দেশে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার কাজে সেনাবাহিনীকে সহায়তা করার আহবান জানান।” 

গােলাম আজম
৯ এপ্রিল এই দিনে রেডিও পাকিস্তান থেকে তার একটি বেতার ভাষণ প্রচারিত হয়। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ভারতীয় লােক সভায় বাংলাদেশের শরণার্থীদের সাহায্য দেওয়ার আহ্বাসের প্রসঙ্গে তিনি বলেন-
“ভারতের প্রধানমন্ত্রীর মত দায়িত্বশীল ব্যক্তি পূর্ব পাকিস্তানীদের প্রতি যে সমর্থন ও সমবেদনা জানিয়েছেন, তাতে আমি বিস্মিত হয়েছি।” |

মুক্তি যােদ্ধাদের সম্পর্কে তিনি বলেন-
“পূর্ব পাকিস্তানে সশস্ত্র অনুপ্রবেশকারী পাঠিয়ে ভারত প্রকৃতপক্ষে আমাদের দেশপ্রেমের মূলে আঘাত হেনেছে। এ ধরনের অনুপ্রবেশ এ প্রদেশের মুসলমানদের কোন কাজেই আসবে না।”

মাহাবুবুল হক দোলন
৯ এপ্রিল পাকিস্তানী বাহিনীর সহযােগী এদেশীয় দালালদের মধ্যে দোলনের ভূমিকা অন্যতম। ২৫ মার্চের পর থেকে তিনি কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটির দালালদের সংগঠিত করতে থাকেন এবং স্বাধীনতা পর্যন্ত তা অব্যাহত রাখেন। তিনি পাকিস্তান মুসলিম লীগের (কাইয়ুম) যুগ্ম সম্পাদক হিসেবে এক বিবৃতিতে বলেন—

“পাকিস্তান যারা সৃষ্টি করেছে পাকিস্তান খণ্ড বিখণ্ডিত করার প্রচেষ্টায় তারা কোন রকমের সাড়া দিতে পারে না। সীমান্তের ওপার থেকে সশস্ত্র ভারতীয় অনুপ্রবেশের ফলে পরিস্থিতি অত্যন্ত জটিল হয়ে উঠেছে এবং সমস্যা আরও গুরুতর হয়ে উঠেছে। এই সমস্ত অনুপ্রবেশকারী ও তাদের সহযােগিতাকারী দালালদের উৎখাত করার জন্য আমাদের ঐক্যবদ্ধভাবে দাঁড়াতে হবে।”


দৈনিক সংগ্রাম।
৯ এপ্রিল এই দিনে কাশ্মীর থেকে পূর্ব পাকিস্তান শিরােনামে পত্রিকাটি একটি সম্পাদকীয় লেখে। সে সম্পাদকীয় কিছু অংশ, 
“হিন্দুস্তান পূর্ব পাকিস্তানের মুসলমানদের জন্য মায়াকান্না কেঁদে ও বন্ধু সেজে পূর্ব পাকিস্তানে ব্যাপক অনুপ্রবেশের কসরত চালিয়ে যাচ্ছে। নেহেরু তনয়া মিসেস গান্ধী মনে করছেন, তাদের এ প্রচেষ্টা সফল হলে কাশ্মীরের মত পূর্ব পাকিস্তান দখল ও সেখানে মুসলমান নিধনযজ্ঞ সম্ভব হবে।”


ইসলামী ছাত্র সংঘের।
১০ এপ্রিল এই তারিখে ছাত্র সংঘের এক যুক্ত বিবৃতিতে বলা হয়—
“দুষ্কৃতকারী ও অনুপ্রবেশকারীদের হাত থেকে পণ্য ভূমি পাকিস্তানকে রক্ষা করার জন্য ছাত্র সংঘের প্রতিটি কর্মী তাদের শেষ রক্ত বিন্দু দিয়ে যাবে। হিন্দুস্তানের ঘৃণ্য চক্রান্তের দাঁত ভাঙ্গা জবাব দেবার জন্য ছাত্র সংঘ কর্মীরা সেনাবাহিনীকে সহযােগিতা করতে সম্পূর্ণ প্রস্তুত।


মাহবুবর রহমান।
১০ এপ্রিল মাহবুবর রহমান ছিলেন একজন মুখ্য স্বাধীনতা বিরােধ। তিনি পাকিস্তান। ন্যাশনাল কাউন্সিল অব ইয়উথএর সভাপতি হিসেবে এক বিবৃতিতে বলেন-
 “ভারত ইতিপূর্বে যথেষ্ট পরিমাণে উস্কানি দিয়েছে এবং উত্তেজনার সৃষ্টি করেছে, বিশ্ব শাস্তির ক্ষেত্রে বিশ্বের জনগণের এটা আর চালিয়ে যেতে দেওয়া উচিত হবে না।” 

| “পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি নিয়ে ভারত যা করছে, তা হল জাতিসংঘ সনদ ও বআন্দউং নীতির খেলাফত এবং সেই সাথে আমাদের সার্বভৌমত্বের ওপর আক্রমণ। ভারতের বেতারে আমাদের সম্পর্কে মিথ্যা বিদ্বেষপূর্ণ এবং বিভ্রান্তিকর প্রচারণা বন্ধ। করা উচিত। কারণ এটা আমাদের দুর্ভাগ্য ও ক্ষতিই বাড়িয়ে তুলেছে।”


দৈনিক সংগ্রাম
১০ এপ্রিল। মুক্তিযুদ্ধে শুরুর প্রাক্কালে রবীন্দ্রনাথের গানটি জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে ঘােষণা করা হয়। এতে সাম মন্তব্য করে, “রবীন্দ্রনাথের বড় পরিচয় তিনি লিখেছেন


এ কে ফয়জুল হক
১১ এপ্রিল শেরে বাংলার পুত্র স্বাধীনতা যুদ্ধের নয় মাস পাকিস্তানী বাহিনীর গণহত্যার সমর্থন আদায়ের জন্য সারাদেশে ঘুরে বেড়িয়েছেন। এই দিনে তার দেয়া একটি বিবৃতির অংশ বিশেষ 
“আমি আমার পূর্ব পাকিস্তানী ভাইদের এবং প্রশাসন যন্ত্রের উপর আস্থা রাখার আবেদন জানাচ্ছি। যারা এখনও কোন কারণবশত কিংবা কোন মােহে পড়ে কাজে যােগদান করেননি, তাদের আমি শুধু বলব সময় দ্রুত বয়ে। যাচ্ছে এবং আমরা যদি আমাদের নিজেদের সঠিক পথে ফিরে যাই তাহলে। প্রত্যেকটি মিনিটের নিজস্ব একটি মূল্য রয়েছে। ঐক্যবদ্ধভাবে একই মানুষ হিসেবে দুবছর আগে আমরা যেমন ভারতের নগ্ন আক্রমণকে রুখে দাঁড়িয়েছিলাম এখনও তেমনিভাবে তাদের নগ্ন আক্রমণের মােকাবিলার জন্য আমাদের প্রস্তুত করতে হবে। আমরা আমাদের স্বার্থ ও আদর্শের জন্য সংগ্রাম করছি। ইনশাল্লাহ জয় আমাদের সুনিশ্চিত।

মতিউর রহমান নিজামী
১১ এপ্রিল মােঃ ইউনুস এই তারিখে একটি যুক্ত বিবৃতিতে বলা হয়।
“আমরা পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে ভারতের নির্লজ্জ হস্তক্ষেপের তীব্র নিন্দা করছি।……. ভারত পূর্ব পাকিস্তানে সশস্ত্র অনুপ্রবেশকারী পাঠিয়ে অভ্যন্তরীণ আইন শৃঙ্খলা সমস্যার সৃষ্টি করছে।”

শামসুল হুদা
পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগ (কনভেনশন) প্রেসিডেন্ট শামসুল হুদা ও সাধারণ সম্পাদক এ এন এম ইউসুফ এক যুক্ত বিবৃতিতে বলেন-
 “পূর্ব পাকিস্তানের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। পূর্ব পাকিস্তানের দেশপ্রেমিক জনগণকে মিথ্যা প্রচারণা ও উত্তেজনাপূর্ণ কাহিনী শুনিয়ে বিভ্রান্ত করা সম্ভব হবে না।”

কে জি করিম
১২ এপ্রিল | ঢাকা শহর মুসলিম ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে এক বিবৃতিতে তিনি বলেন “ খয়েরুদ্দিনের নেতৃত্বে যে শান্তি কমিটি গঠিত হয়েছে তার প্রতি পূর্ণ সমর্থন – 
“আমার লীগ এই শান্তি কমিটিতে যােগ দিয়ে এর মিছিলে অংশ নেবে।”

গােলাম আজম
১২ এপ্রিল তিনি একটি বেতার ভাষণে বলেন [ বেতার ভাষণটি ১২ এপ্রিল দৈনিক সংগ্রামে প্রকাশিত হয়।



“ভারত সশস্ত্র অনুপ্রবেশকারী প্রেরণ করে কার্যত পূর্ব পাকিস্তানের দেশপ্রেমকে চ্যালেঞ্জ করেছে। পূর্ব পাকিস্তানের নিরস্ত্র জনগণকে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সংঘর্ষে নিয়ােজিত করে পূর্ব পাকিস্তানকে দাসে পরিণত করতে যায়।”


শান্তি কমিটি গঠিত হবার পর এর ব্যাপক প্রশংসা করে মন্তব্য করা হয় যে

“অন্যান্য শহরেও কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটির পথ অনুসৃত হবে এবং গােটা দেশে পূর্ণ স্বাভাবিকতা ও দেশ রক্ষাবােধ দেখা দেবে। এর ফলে ভারতীয় অনুপ্রবেশকারী ও পঞ্চম বাহিনীর সব চক্রান্ত ব্যর্থ হতে বাধ্য।


শাম্ভি কমিটি
১৩ এপ্রিল ১৪ এপ্রিলের পরিবর্তে ১৩ এপ্রিল শান্তি কমিটি জোহরের নামাজের পর বায়তুল মোকাররম থেকে একটি মিছিল বের করে শহরের বিভিন্ন স্থান প্রদক্ষিণ করে। মিছিলের পুরোভাগে ছিলেন
গােলাম আজম, খাজা খয়েরুদ্দিন, শফিকুল ইসলাম, পীর মােহসেন উদ্দিন (দুদু মিয়া) সৈয়দ আজিজুল হক (নান্না মিয়া), মাহমুদ আলী, আবদুল জব্বার খদ্দর, এ. টি. সাদী প্রমুখ নেতা।
উক্ত মিছিলের শ্লোগানের কিছু নমুনা। 
ভারতের দালালি চলবে না ওয়ানডে গাদ্দারােসে করে হুঁশিয়ার, 
আমেরিকা সামরিক হুঁশিয়ার, 
সংগ্রাম না শান্তি শান্তি, শান্তি


  •  পাকিস্তানের উৎস কি লাইলাহা ইল্লাল্লাহ 
  • পাকিস্তানী ফৌজ—জিন্দাবাদ কায়েদে আজম জিন্দাবাদ। ইন্দিরা গান্ধী-মুর্দাবাদ ইয়াহিয়া খান—
  • জিন্দাবাদ টিক্কা খান জিন্দাবাদ
  • আর আল্লাহ মেহেরবানীর ধ্বংস কর হিন্দুস্তান।


 মিছিলের কিছু ফেস্টুনের ভাষা পাক-চীন জিন্দাবাদ দুষ্কৃতকারী দূর হও-মুসলিম জাহান এক হও ভারতকে খতম কর, ভারতকে ধ্বংস কর, পাকিস্তানকে রক্ষা কর। মিছিলকারীরা বহন করে ইয়াহিয়া খান, আইয়ুব খান, আল্লামা ইকবাল, লিয়াকত আলী খান, ফাতেমা জিন্নাহ, সর্দার আবদুর রব নিশতার, মির্জা গালিব, মােহাম্মদ আলী জিন্না প্রমুখের ছবি।


উক্ত মিছিল শেষে মােনাজাত পরিচালনা করেন ঘাতক গােলাম আজম। তিনি মােনাজাতে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেন, প্রার্থনায় যে সমস্ত বাক্য উচ্চারণ করেন তার দুটি নমুনা।



“পাকিস্তানের সংহতি ও অশেষ ত্যাগ তিতিক্ষার মাধ্যমে অর্জিত পাকিস্তানের বুনিয়াদ যেন অটুট থাকে।”

-“ভারতের ঘৃণ্য হামলার বিরুদ্ধে পাকিস্তান যেন উপযুক্ত জবাব দিতে পারে।”
মােনাজাত শেষে শুরু হয় মিছিলকারীদের “আসল” কাজ। মিছিলকারীরা আজিমপুর কলােনী, শাখারী বাজার, শান্তিনগর প্রভৃতি জায়গায় বাঙালিদের বাড়ি ঘর পুড়িয়ে দেয় এবং বেশ কয়েকজন বাঙালিকে হত্যা করে রাস্তার পাশে ফেলে রাখে।

দৈনিক সংগ্রাম
১৪ এপ্রিল এই তারিখে সংগ্রামের ভাষ্য—
“জয় বাংলা আন্দোলন বানচাল হয়ে যাওয়ায় পূর্ব পাকিস্তানে এখন সুদিন ফিরে এসেছে। পাকিস্তান বিপদমুক্ত হয়েছে।”


দৈনিক সংগ্রাম 
১৫ এপ্রিল এইদিনে পত্রিকাটি তার সম্পাদকীয়তে এক জায়গায় উল্লেখ করে যে,

“শেখ মুজিবের রেফারেল ছিল স্বায়ত্তশাসনের, স্বাধীনতার নয়। সরল জনতা কি করে বুঝবে যে, পাকিস্তান ও কোরআন সুন্নাহ ভেকধারী রা ভােট নিয়ে ভারতের তাঁবেদারি স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ষড়যন্ত্র চালাবে।”


শান্তি কমিটি
১৬ এপ্রিল বাঙালি হত্যাযজ্ঞের মূল নেতা জেনারেল টিক্কা খান। নূরুল আমিনের নেতৃত্বে শান্তি কমিটির সদস্যগণ গভর্নর হাউসে টিক্কা খানের সঙ্গে এক বৈঠকে মিলিত হন। বৈঠকের এক পর্যায়ে কমিটির সদস্যরা টিক্কা খানকে জানান—

“জনসাধারণ ভারতের ঘৃণ্য শয়তানী পুরােপুরি অনুধাবন করতে পেরেছেন এবং পাকিস্তানের সংহতি ও অখণ্ডতা রক্ষায় তারা সেনাবাহিনীকে মদদ জুগিয়ে যেতে অটল রয়েছে।


কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটি
২২ এপ্রিল কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটির একটি আবেদনে উল্লেখিত হয় নিম্নরূপ বক্তব্য

“সমস্ত দেশ প্রেমিক পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি রাষ্ট্রদ্রোহীদের সব রকম ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ প্রতিহত করার এবং সশস্ত্র বাহিনীকে সম্ভাব্য সকল উপায়ে সহায়তা করার জন্য আহ্বান জানান হয়।

খাজা খয়েরুদ্দিন ইস্যুকৃত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়।

“রাষ্ট্রদ্রোহীরা সম্পূর্ণভাবে হতাশ হয়ে এখন পােড়ামাটি নীতি অবলম্বন করেছে এবং তারা যােগাযােগ ব্যবস্থা ধ্বংস এবং শান্তি প্রিয় নাগরিকদের হয়রান করছে।”
এতে আরাে উল্লেখ করা হয় ।



—“সশস্ত্র বাহিনী জনগণেরই অন্তর্গত এবং নাগরিকদের জীবন ও ধন-সম্পত্তি রক্ষাই তাদের উদ্দেশ্য।
দৈনিক সংগ্রাম।


২২ এপ্রিল এই দিনে পাকিস্তানী শাসকদের প্রশংসা করে পত্রিকাটি উল্লেখ করে যে

“আল্লাহর লাখাে শুকরিয়া যে, মাননীয় প্রেসিডেন্ট যথাসময়ে হস্তক্ষেপ ও লেফটেনেন্ট জেনারেল টিক্কা খান কর্তৃক প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থা অবলম্বিত হওয়ায় আরেকবার আল্লাহর দান পাকিস্তান শত্রুর হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে।”
কলকাতায় নিযুক্ত ছিলেন তখণ জনাব হােসেন আলী, পাকিস্তানের ডেপুটি হাই কমিশনার হিসেবে। জনাব হােসেন আলী আরাে কয়েকজন সঙ্গীসহ অস্থায়ী বাংলাদেশের সরকারের পক্ষে আনুগত্য প্রকাশ করেন। এ দুঃসংবাদ, শুনে দৈনিক সংগ্রাম মন্তব্য করে,



“পাকিস্তান সরকারের প্রতিনিধিত্ব করে না এমন কিছু লােক এবং দুষ্কৃতকারীরা কোলকাতাস্থ পাকিস্তানী হাই কমিশন অফিসে যথেচ্ছ ব্যবহার করছিল। ভারত সরকারের উচিত ছিল এসব অবাঞ্চিত ব্যক্তি ও দুষ্কৃতিকারীদের হাত থেকে হাই কমিশনের পবিত্রতা ও মর্যাদা রক্ষা করা। কিন্তু ভারত সরকার এ ন্যায় নীতি বােধের পরিচয় দিতে ব্যর্থ হয়েছেন।”
এই দিনের উপসম্পাদকীয়তে উল্লেখ করা হয়-

“আজাদীর অব্যবহিত পর থেকে দেশে ইসলামী শিক্ষানীতি চালু থাকলে এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আদর্শবান শিক্ষক নিয়ােগের ব্যবস্থাসহ অন্যান্য ব্যবস্থা অবলম্বিত হলে আমাদের সমাজ কিছুতেই বর্তমান অবস্থার সম্মুখীন হত না।”


শান্তিকমিটি
২৫ এপ্রিল শান্তি কমিটির একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয় ।



“শহরে পূর্ণ স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটির পক্ষ থেকে ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকায় শান্তি স্কোয়াড যাতায়াত করছেন।”
এখানে উল্লেখ্য শান্তি স্কোয়াডের সদস্যরা মাথায় সাদা বা লাল পট্টি বেঁধে ঢাকা শহরে নির্বিচারে বাঙালি হত্যা, লুট ও অগ্নি সংযােগ করে ব্যাপকভাবে )


মওলানা মান্নান।


২৭ এপ্রিল পাক বাহিনীর গণহত্যাকে সমর্থনকারী মওলানা মান্নান। গণহত্যাকে সমর্থন করে। কয়েকবার বিবৃতিও দিয়েছেন। তিনি ছিলেন বাঙালিদের জন্যে ত্রাসস্বরূপ। এখানে তার একটি বিবৃতির অংশ বিশেষ দেয়া হল…

সশস্ত্র অনুপ্রবেশকারী ও । বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সমূলে উচ্ছেদ করার উদ্দেশ্যে পূর্ব পাকিস্তানের দেশপ্রেমিক জনগণ আজ জেহাদের জোশে আগাইয়া আসিয়াছে। জনসাধারণের সক্রিয় সহযােগিতায় আমাদের সাহসী সশস্ত্র বাহিনী সকল অঞ্চলে দখল কায়েম করিয়া সুদৃঢ়ভাবে তাদের কর্তৃত্ব কায়েম করিয়াছে।”


দৈনিক সংগ্রাম
২৯ এপ্রিল এই তারিখে পত্রিকাটির একটি হেড লাইন,

“পাকিস্তানের সংহতি রক্ষার সংগ্রামে সৌদি আরবের সমর্থন ।”
আওয়ামী লীগ সম্পর্কে মন্তব্য করে

“কেননা তারা হিন্দুস্তানি জগৎ, উন্মাতাল ও রায়দুর্লভদের চক্রান্তে মীর জফরের ভূমিকায় অবতীর্ণ পাক বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষকে হিন্দুদের গােলামে পরিণত করতে চেয়েছিল।” .


দৈনিক সংগ্রাম
৩০ এপ্রিল পাক সেনাদের প্রশংসা করে এইদিনে লেখা হয় ।

মাত্র এক মাসের ভিতর আমাদের ঐতিহ্যবাহী পাকসেনারা পূর্ব পাকিস্তানের গােটা ভূখণ্ড নাপাক হিন্দুস্থানী অনুপ্রবেশকারী ও অনুচরদের হাত থেকে মুক্ত করে এ এলাকার জনতাকে দুঃসহ এক অরাজকতার হাত থেকে মুক্তি দিয়েছে।”
উক্ত রচনায় আরাে উল্লেখ করা হয়

যারা পূর্ব পাকিস্তানকে ‘বাংলাদেশ’ করেছিল, জিন্নাহ হলকে সূর্যসেন করেছিল, রবীন্দ্রনাথকে জাতীয় কবি করেছিল আর সেই ঠাকুরের ‘আমার সােনার বাংলাকে জাতীয় সঙ্গীত করেছিল তারা। পাকিস্তানী হবার যােগ্যতা সর্বতােভাবে হারিয়েছে বলে কোন পাকিস্তানীই আজ। তাদের সমর্থন যােগাবে না।”
রইসী বেগম মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে শেরে বাংলার কন্যার ব্যাপক সাংগঠনিক তৎপরতা ছিল বর্বর পাক বাহিনীর স্বপক্ষে। এইদিনে দেয়া তার একটি বিবৃতির অংশ বিশেষ

“১৯৭১ সালের ২৬ শে মার্চ আমাদের ৭ কোটি পূর্ব পাকিস্তানীর জন্য মুক্তির দিন। এখানে আমরা এক উগ্র মতবাদ থেকে মুক্তিলাভ করেছি। এ মতবাদ ইসলাম ও পাকিস্তানী আদর্শের সম্পূর্ণ বিপরিত। পাক সীমান্তের ওপার পারের সংঘবদ্ধ সাহায্যপুষ্ট ও প্ররােচিত মুষ্টিমেয় দেশদ্রোহীর দ্বারা আমরা সন্ত্রস্ত ও ধ্বংসের
সম্মুখীন হয়েছিলাম। কিন্তু আলহামদুলিল্লাহ নির্যাতিত অসংখ্য মুসলমানের প্রার্থনা আল্লাহ শুনেছেন এবং পাকিস্তানকে আসন্ন ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করেছেন। পূর্ব পাকিস্তানের সাত কোটি মানুষের পক্ষে আমি আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর বীর সেনানীদের সালাম জানাই।” |

[সুধী পাঠক স্মরণ করুন ২৫ মার্চের সেই ভয়াল রাতের কথা ]।



“…আলহামদুলিল্লাহ শেখ মুজিবুর রহমান ও তার অনুচরেরা চিরদিনের জন্য মঞ্চ থেকে অপসারিত হয়েছে। শয়তানী চক্রকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করার শক্তি যেন আমাদের অজেয় সশস্ত্র বাহিনীকে আল্লাহ দান করেন।”

……“হিন্দুরা কিভাবে মুসলমানদের হত্যা করেছে আপনারা তাও জানেন। আপনাদের অবস্থাও সে রকম হত যদি না আমাদের সেনাবাহিনী যথা সময়ে শেখের দূরভিসন্ধি নস্যাৎ করে দিত। আল্লাহর নামে ইসলাম ও পাকিস্তানের প্রতি অনুগত ও ঐক্যবদ্ধ হউন।”


দৈনিক সংগ্রাম

“এই দিনে হিন্দুস্তানি সৈন্যের বর্বরতা।— শিরােনামে এক সম্পাদকীয় প্রকাশ করে। এতে মন্তব্য করা হয় যে, ঐ যেখানে যে অঞ্চলেই ভারতীয় সৈন্যরা। অনুপ্রবেশ করছে, সেখানকার জনগণ বাসরুদ্ধকর অবস্থায় আমাদের পাক সেনা। বাহিনীর আগমনের অপেক্ষা করছে। পাকবাহিনীর আগমনে শান্তি ও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছে।”

এতে আরাে উল্লেখ করা হয়


এক শ্রেণীর মানুষ এ দেশের কোটি কোটি মুসলমানের ভাগ্যকে ওপারের হিন্দুদের যথেচ্ছাচারের শিকারে পরিণত করতে চেয়েছিল। এ ধরনের মানসিকতা না থাকলে তারা কিছুতেই হিন্দুস্তানি সৈন্যদের ডেকে এনে এদেশের নিরীহ ও নিরস্ত্র মুসলিম জনসাধারণের উপর জঘন্য ও পাশবিক অত্যাচার চালাতে পারতাছে না, দেশের অর্থ সম্পদ লুট করে হিন্দুস্তানে। নিয়ে যেতে হিন্দুস্তানী সৈন্যদের সহযােগিতা করতাে না এবং নিজেদের দেশের ব্রিজ, কালভার্ট, রাস্তা প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ ও মূল্যবান জাতীয় সম্পদ বিনষ্ট করতে হিন্দুস্তানী সৈন্যদের সহযােগিতায় এগিয়ে আসতাে না।”
দৈনিক সংগ্রাম



৪ মে এই তারিখে জনগণের প্রতি আহ্বান জানানাে হয় মুক্তিযােদ্ধাদের ধরিয়ে দেয়ার জন্য। মুক্তিযােদ্ধাদের এখানে সমাজ বিরােধী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এতে বলা হয় “এ সমাজ বিরােধীদের দমনে সরকারকে সাহায্য করা একদিকে নিজেকে সাহায্য করা ও অপরদিকে নিজের ঈমানী দায়িত্ব পালন করার শামিল।”


শাহ আজিজুর রহমান।


৪ মে জিয়াউর রহমানের আমলে প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। তিনি ছিলেন একজন মুখ্য স্বাধীনতা বিরােধী। তার বিবৃতির কিছু অংশ পাঠ করলেই সে সম্বন্ধে আমাদের পরিষ্কার ধারণা জন্মাবে।

“প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া প্রবল উৎকণ্ঠার সঙ্গে রাজনৈতিক দলসমূহকে অধিকতর স্বাধীনতা প্রদানপূর্বক দেশে পূর্ণ এবং বাধাবিহীন গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করেন। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের অন্যতম রাজনৈতিক দল অধুনালুপ্ত আওয়ামীলীগ এই সুযােগের ভুল অর্থ করে, বল প্রয়ােগ আর শিরােচ্ছেদের মাধ্যমে নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে জয় লাভ করে। অজেয়ভাবে নিজেদের খেয়াল-খুশিমত দেশ শাসন করার দাবি করে এবং এভাবেই অহমিকা অধৈর্য এবং ঔদ্ধত্যের ফলে নিজেদের ভাসিয়ে দেয়।”……..“আমি সাম্রাজ্যবাদী ভারতের দূরভিসন্ধি নস্যাৎ করার উদ্দেশ্যে দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীকে সাহায্য করার জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।”


কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটি |
লাকসামের কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটি এই দিনে অনুষ্ঠিত একটি সভায় নিম্নে বর্ণিত সিদ্ধান্তসমূহ গ্রহণ করে।


(১) সভাপতি ও সহসভাপতির অনুপস্থিতিতে জনৈক চৌধুরীকে সর্বসম্মতিক্রমে আজকের সভার সভাপতি করা হয়।
(২) জনৈক চৌধুরীর পদত্যাগপত্র পরবর্তী সভায় পেশ করার জন্য রেখে দেয়া হল।
(৩) ক) তথাকথিত মুক্তিবাহিনী এবং তাদের তহবিল সংগ্রহ, সদস্যভুক্তি ইত্যাদি গােপন কার্যক্রমের বিস্তারিত বিবরণ ও তথ্যাদি এবং ইতিমধ্যেই অন্তর্ভুক্ত সদস্যদের বিবরণ যথাশীঘ্র কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটিকে জানানাে হােক। যারা মুক্তিবাহিনীর জন্য চাদা আদায় করছে এবং যারা চাদা প্রদান করছে তাদের একটি তালিকা কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটির কাছে পেশ করা হােক।খ) লাইসেন্স ছাড়া সমস্ত বন্দুক, রাইফেল ও অন্যান্য সাজসরঞ্জামের খোজ জানান হােক। (গ) ইউনিয়ন শান্তি কমিটি সমূহকে পুনরায় অনুরােধ করা হল—মালি, মেথর, পেশাদার ধােপী, জেলে এবং নাপিত ছাড়া সকল হিন্দুকে উৎখাত করা হােক। এ ধরনের কেস’ সমূহের একটি তালিকা পূর্ণ বিবরণসহ পেশ করা হােক। * (ঘ) পাকিস্তানে আশঙ্কামুক্ত হয়ে ও আত্মবিশ্বাসের সাথে সকল বৌদ্ধ যাতে বাস করতে পারে সেজন্য তাদের সকল সুযােগ-সুবিধা দেয়া হােক। বিভিন্ন ইউনিয়ন কাউন্সিলে বসবাসকারী বৌদ্ধদের একটি করে তালিকা সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন শান্তি কমিটি কর্তৃক পেশ করা হােক।
(৪) (ক) অধুনা লুপ্ত ঘােষিত আওয়ামী লীগের যেসব সদস্য আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করেছে তাদের নিম্নলিখিত কারণে একটি প্রথামত সম্পর্কচ্ছেদের ঘােষণা দিতে বলা হােক।(খ) অধুনালুপ্ত আওয়ামী লীগ পাকিস্তান বিভক্তির জন্য এবং কার্যত ভারতের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে যাওয়ার জন্য পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতার জন্য কাজ করে।(গ) উক্ত রাজনৈতিক দল পাকিস্তানের মুসলমানদের মধ্যে শ্রেণীভিত্তিক ঘৃণা ছড়ায়। তাদের মধ্যে জাতিসত্তাগত বা প্রদেশগত সংঘর্ষ উৎসাহিত করে এবং পাকিস্তানের সর্বাত্মক ক্ষতি করার জন্য আঞ্চলিকতাকে উৎসাহিত করে।
(৫) সংশ্লিষ্ট ইউনিয়নসমূহের সামরিক লােকদের ও প্রাক্তন সামরিক ব্যক্তিদের তালিকা পেশ করা হােক। |
(৬) সরকারী ও আধাসরকারী প্রতিষ্ঠানের অফিসারবৃন্দ ও কারখানার শ্রমিকদের স্ব স্ব কাজে যােগদানের জন্য উৎসাহিত করা হােক। |
(৭) ১৬ নং ইউনিয়ন কাউন্সিলের মােহাম্মদপুর ও ইছাপুরে বা এর আশেপাশে লুণ্ঠন ও সমাজবিরােধী তৎপরতা সম্পর্কে তদন্ত করার জন্য নিম্নলিখিত ভদ্রলােকদের নিয়ে একটি অনুসন্ধান কমিটি করা হােক। এই কমিটি ৯-৫-৭১ তারিখে বা তার পূর্বে রিপাের্ট পেশ করবেন।
দৈনিক সংগ্রাম
মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রায় এক কোটি শরণার্থী ভারতে আশ্রয় নেয়। কিন্তু পত্রিকাটি এই সত্য অস্বীকার করে মন্তব করে যে, |

“হিন্দুস্তান এখন নিজ দেশের তালাবদ্ধ মিলকারখানা বিপুল সংখ্যক শ্রমিক ও বেকার নাগরিকদের একত্র করে তাদের শরণার্থী বলে প্রচার করছে। এবং বিশ্ববাসীর দরবারে মানবতার দোহাই দিয়ে তাদের নামে সাহায্য হাসিলের চেষ্টা চালাচ্ছে।”
দৈনিক সংগ্রাম
৮ মে পত্রিকাটি ২৫ মার্চের ভয়াবহ কালাে রাত্রির গণহত্যাকে সমর্থন করে যুক্তি দাড় করায় যে

“অবৈধ্য আওয়ামী প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান গত ২৬ শে মার্চে সশস্ত্র বিদ্রোহের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা এঁটে সব আয়ােজন সম্পন্ন করেছিলেন। সামরিক সরকার তা জানতে পেরেই পঁচিশে মার্চ দিবাগত রাত্রে
আকস্মিক হামলা চালিয়ে তার সে পরিকল্পনা নস্যাৎ করে দেন এবং পাকিস্তানকে নিশ্চিত ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করেন। | একই সংখ্যায় তাজউদ্দীন সম্পর্কে মন্তব্য করে, “জনাব তাজউদ্দীন পাকিস্তানকে অস্বীকার করে ভারতের নাগরিকত্ব গ্রহণের সাথে সাথে তিনি স্বভাবতই শ্রী তাজুউদ্দীন হয়ে গেছেন।”


আবদুলমতিন–

১০ মে | ঢাকা বেতার থেকে প্রচারিত একটি কথিকায় তিনি বলেন

“ভারত অনুপ্রবেশকারী পাঠিয়ে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করছে। ভারতের এ জঘন্য দূরভিসন্ধি নস্যাৎ করতে পূর্ব পাকিস্তানের দেশপ্রেমিক জনগণ কিছুতেই পিছ পা হবে না।”


দৈনিক সংগ্রাম।


ভারতীয় সংস্কৃতি অনুপ্রবেশের উল্লেখ করে পত্রিকাটি বলে

—“শহীদ দিবসের ভাষা আন্দোলনে আত্মত্যাগী মুসলমান ছাত্রদের জন্য দোয়া কালাম পড়ে মাগফেরাত কামনার পরিবর্তে তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপনার্থে হিন্দুয়ানী কায়দা, নগ্নপদে চলা, প্রভাত ফেরী, শহীদ মিনারের পাদদেশে আল্পনা আঁকা ও চণ্ডীদেবীর মূর্তি স্থাপন ও যুবক যুবতীদের মিলে নাচ গান করা মূলত ঐ সকল পত্র-পত্রিকা, বই পুস্তক ও সাংস্কৃতিক মাধ্যমগুলাের বদৌলতেই এখানে সম্ভব হয়েছে।”
ইসলামী ছাত্রসংঘ
১৩ মে এই দিনে ছাত্র সংঘের একটি বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয় দেশের বর্তমান দুরাবস্থার জন্য ছাত্র সমাজকে দায়ী করা হয়। অথচ ছাত্রসংঘ কর্মীরাই বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দমন ও সেনাবাহিনীকে সহায়তা করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি তৎপর।
ছাত্ৰনামধারী ভারতের সাম্রাজ্যবাদের যে সমস্ত চর তথাকথিত ‘বাংলাদেশ প্রচারণা চালিয়েছিল তারা ছাত্র সমাজের কলঙ্ক। তাদের জন্য সমুদয় ছাত্র সমাজকে দায়ী করা ঠিক নয়।


দৈনিক সংগ্রাম।


১৩ মে এইদিনে ‘জয়বাংলা ধর্মমত’ শিরােনামে একটি উপসম্পাদকীয় প্রকাশিত হয়। উপসম্পাদকীয়ের কিছু অংশ।

* “এ নতুন জাতি নাম হল ‘জয়বাংলা জাত। তাদের কলেমা ও সালাম কালাম হল ‘জয়বাংলা’ তাদের দেশের নাম ‘বাংলাদেশ তাদের ধর্মের নাম বাংগালী ধর্ম। এ। ধর্ম প্রবর্তকের নাম দিয়েছে তারা বঙ্গবন্ধু।
কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটি
১৭ মে ঢাকার মােহাম্মদপুরে কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটির এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন কুখ্যাত মেজর জেনারেল ওমরাও খান। উক্ত সভায় গৃহীত প্রস্তাবের কিছু অংশ।
“নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ পরিচালিত রাষ্ট্রবিরােধী কার্যকলাপের ফলে সৃষ্ট মারাত্মক সঙ্কট থেকে দেশকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে সেনাবাহিনী কর্তৃক সময়ােচিত ব্যবস্থা গ্রহণের উচ্ছসিত প্রশংসা করা হয়। প্রস্তাবের আরাে কিছু অংশ

“পাকিস্তানের বিশ্বাসঘাতকতার বিরুদ্ধে সম্ভাব্য কঠোরতম ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে সশস্ত্র বাহিনীকে তাদের মহান কাজে সাহায্য। করার উদ্দেশ্যে পূর্ব পাকিস্তানের ইসলামী শক্তি সমূহের মধ্যে গভীর ও অচ্ছেদ্য মতৈক্য প্রতিষ্ঠা করা উচিত বলে মত প্রকাশ করা হয়। দুষ্কৃতকারীদের তন্ন তন্ন করে খুঁজে বের করা এবং প্রদেশে পূর্ণ স্বাভাবিক অবস্থা পুনঃ প্রতিষ্ঠার জন্য প্রতিটি দেশপ্রেমিক নাগরিকের দৃঢ় প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবার ওপরও গুরুত্ব আরােপ করা
২৭ মে
সভাপতির ভাষণে ওমরাও খান বলেন-

“পাকিস্তানের শত্রুদের ধরিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে সামরিক বাহিনীকে সহায়তা করার জন্য তিনি আহ্বান জানিয়ে বলেন“পাকিস্তানের শত্রুদের ধরিয়ে না দিলে বা নিশ্চিহ্ন না করলে শান্তিতে বসবাস করা যাবে না।”


দৈনিক সংগ্রাম
সাধারণ মানুষকে লােভ দেখিয়ে এই দিনে একটি খবর প্রকাশিত হয়। দুষ্কৃতকারীদের (মুক্তিযােদ্ধা) ধরিয়ে দেবার আহবান জানান হয়।


“দুষ্কৃতকারীদের ধরিয়ে দেয়ার জন্য কর্তৃপক্ষ জনগণের মধ্যে এক হাজার টাকা বিরতণ করেছেন।”
আরাে উল্লেখ করা হয় যে-

“দুষ্কৃতকারীদের ধরিয়ে দিলে বা তাদের কার্যকলাপ সম্পর্কে তথ্য জানালে কর্তৃপক্ষ উপযুক্ত পুরস্কার দেবে।”
দুষ্কৃতকারী অর্থাৎ মুক্তিযােদ্ধাদের নির্মূল করার জন্য শান্তি কমিটি গঠনের মত রাজাকার আলবদর, আলশামস প্রভৃতি সশস্ত্র বেসামরিক বাহিনী গঠনের পরামর্শ দানে পত্রিকাটি অগ্রনী ভূমিকা পালন করে। এই সংখ্যাটিতে বলা হয়,

“দেশের
অভ্যন্তরে অবস্থানকারী এসব দুষ্কৃতকারী দমনের ব্যাপারে আমরা ইতিপূর্বেও সম্পাদকীয় ও উপসম্পাদকীয় একাধিক নিবন্ধে বিভিন্ন প্রস্তাব দিয়েছি। আমাদের বিশ্বাস পাকিস্তান ও জাতীয় আদর্শে বিশ্বাসী নির্ভরযােগ্য লােকদের সমন্বয়ে একটি বেসামরিক পােষাকধারী বাহিনী গঠন করে তাদের হাতে আগ্নেয়াস্ত্র দেওয়ার ব্যবস্থা করা হলে অতি তাড়াতাড়ি এসব দুষ্কৃতকারীকে নির্মূল করা সহজ হবে।”

দৈনিক সংগ্রাম
৩০ মে ভারত সম্পর্কে ‘হিন্দুস্তানের অমার্জনীয় ভূমিকা শীর্ষক সম্পাদকীয়তে মন্তব্য করে যে,

“… সীমান্তের ওপারে বহু সংখক যুবককে দুস্কৃতির ট্রেনিংও দিচ্ছে বলে তাদের স্বীকারােক্তি থেকেই জানা যায়। রাষ্ট্রদ্রোহী এ দুষ্কৃতকারীদেরকে একটি ভ্রাম্যমাণ রেডিও স্টেশনও দিয়েছে বলে জানা গেছে। প্রকাশ ট্রাকের উপর স্থাপিত উক্ত রেডিও স্টেশনটি না-কি খবর প্রচারকালে পাক সীমান্তের কাছাকাছি স্থানে স্থানান্তরিত করা হয় এবং পাক বাহিনীর আগমন মাত্র তা হিন্দুস্তানের অভ্যন্তরে নিয়ে যাওয়া হয়।
আয়েনউদ্দিন।
৩১ মে তিনি ছিলেন বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের মুসলিম লীগ দলীয় সদস্য। রাজশাহী জেলা শান্তি কমিটি প্রধান। দৈনিক আজাদ পত্রিকায় প্রদত্ত এক সক্ষাৎকারে তিনি বলেন-(সেনাবাহিনীর প্রশংসা করে)

“তারা অসীম ধৈর্যের সাথে শত্রুর মােকাবিলা করতে সক্ষম হয়েছে। রাজশাহী জেলার সর্বত্র স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে এসেছে। প্রতি মহকুমা, থানা ও ইউনিয়নে শান্তি কমিটি গঠন করা হয়েছে”। ইয়াহিয়া খানের দেশ প্রেমিক নাগরিকদের ফিরে আসা।’ বিষয়ে প্রতারণামূলক সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে তিনি বলেন“প্রেসিডেন্টের এই বীরােচিত আহ্বানকে আমি অভিনন্দন জানাচ্ছি। একটি মুসলিম রাষ্ট্রের একজন নির্ভিক রাষ্ট্র প্রধানের এই আহ্বান বিশ্বের শান্তিকামী মানুষের মনে সাড়া জাগাতে সক্ষম হবে।”
এ এন এম ইউসুফ রাজশাহী ও নবাবগঞ্জ সফরের সময় তিনি শান্তি কমিটির সদস্যদের সাথে বিভিন্ন বৈঠকে বিভিন্ন সময়ে মিলিত হন। একটি বৈঠকে তিনি বলেন“পাকিস্তানকে রক্ষা করার জন্য রাজশাহীবাসীরা মনেপ্রাণে কাজ করে যাচ্ছে এবং সর্বত্র আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর বীরত্বপূর্ণ কার্যক্রম অভিনন্দিত হচ্ছে।”

তিনি আরাে বলেন

“জনগণের সহায়তায় সশস্ত্র বাহিনী ভেড়ামারায় স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে এনেছে বলে আমি জানতে পেরেছি।”
বিশুদ্ধানন্দ মহাথেরাে।
৩ জুন পাকিস্তান বৌদ্ধ কৃষ্টি প্রচার সংঘের সভাপতি ছিলেন একজন মুখ্য স্বাধীনতা বিরােধী। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তিনি গণহত্যার সমর্থনে দেশের বৌদ্ধ প্রধান এলাকাগুলােতে সমাবেশ করে বেড়িয়েছেন। তিনি খান চক্রের সমন্বয়ে যে বিবৃতি দিয়েছিলেন তার অংশ বিশেষ

“পাকিস্তান ৫ লক্ষ বৌদ্ধের প্রিয় জন্মভূমি হিসেবে টিকে আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে।”
তিনি আরাে উল্লেখ করেন-

“বৌদ্ধ যারা এখানে আবহমানকাল ধরে বসবাস করছে তারা দেশের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য নিজেদের শেষ রক্ত বিন্দু দানে প্রস্তুত রয়েছে।”
হাফেজ্জীহুজুর।
৩ জুন হাফেজ্জী হুজুর ছিলেন খেলাফত আন্দোলনের নেতা। এ দলের সকলেই শান্তি কমিটি অথবা রাজাকারের খাতায় নাম লিখিয়ে ছিলাে। এইদিন তিনি কয়েকজন ওলামার সাথে এক যুক্ত বিবৃতিতে বলেন-

“পাকিস্তানের বিশেষত পূর্ব পাকিস্তানের ইসলাম প্রিয় লােকদের সামরিক ট্রেনিং দানের ব্যবস্থা করার জন্য”
সামরিক সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।বিবৃতিতে তিনি আরাে বলেন

-“যাতে ভারতীয় হামলা মােকাবিলা করা যায়, সেজন্য সরকারের উচিত তার অনুগত নাগরিকদের মুজাহিদ হিসেবে গড়ে তােলা।”
মওলানা মওদুদী


এই তারিখে মওলানা মওদুদীর একটি স্মারক লিপি প্রকাশিত হয়, এতে বলা হয় যে,

“মুজিবের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন এদেশের মুসলিম জনতা কখনও সমর্থন করেনি অথবা ১লা মার্চ থেকে শুরু করা বিদ্রোহ আন্দোলনে (অসহযােগ আন্দোলন) সাধারণ মানুষ অংশ নেয়নি।
দৈনিক সংগ্রাম।
| ১০ জুন এই দিনে পত্রিকাটিতে একটি সংবাদ পরিবেশিত হয়। সংবাদটি নিম্নরূপ।

“সামরিক আইন কর্তৃপক্ষের নিকট হাজির হতে ব্যর্থ হওয়ার দরুন ৪০ নং সামরিক আইন বিধির অধীনে ঢাকার সাত মসজিদ রােডের জনাব তাজুদ্দিন আহমেদ, বাকেরগঞ্জ জেলার কোরালিয়ার জনাব তােফায়েল আহমেদ, ময়মনসিংহ জেলার লাঙ্গল শিমুলের জনাব এ এম নজরুল ইসলাম, ঢাকা জেলার ১১০ নং সিদ্ধেশরীর জনাব আবদুল মান্নান এবং পিপলসের মালিক ও ঢাকা জেলার সিদ্ধেশ্বরীর জনাব আবদুর রহমানকে ১৪ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে এবং তাদের প্রত্যেকের সম্পত্তির শতকরা ৫০ ভাগ বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে।”
| ৭ জুন
দৈনিক সংগ্রাম


১৫ জুন এইদিনের উপসম্পাদকীয়তে বলা হয় যে,



“মুসলমানদের জাতশত্রু ইহুদীরা আরব মুসলমানদের যেভাবে ব্যতিব্যস্ত করে তুলেছে তেমনি ইহুদীদের পরম বন্ধু হিন্দুরাও একই যােগসাজসে মুসলমানদের অস্তিত্ব বিলােপের কাজ করে যাচ্ছে।

প্রেসনােট।
১৬ জুন পাকিস্তানীরা ইতিহাসকে মুছে ফেলার জন্য এক ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। ইতিপূর্বে নববর্ষ পহেলা বৈশাখের ছুটি বাতিল করা হয়। কাগজ গুলােতে উল্লেখ করা হয়
“আজ বৃহস্পতিবার প্রাদেশিক সরকারের যে ছুটি ছিল, জরুরী অবস্থার দ্রুত তা বাতিল করা হয়েছে। এতে ঢাকা এবং সারা দেশে বর্ষবরণ অনুষ্ঠান বন্ধ। হয়ে যায়। আরাে উল্লেখ্য ঢাকা শহরের ২৪০টি রাস্তার নাম পরিবর্তন করে ইসলামীকরণ করা হয়, যেমন: | আদি নাম ।
পরিবর্তিত নাম
(১) লালমােহন পােদ্দার লেন— আব্দুল করিম গজনভি স্ট্রিট
(২) শাঁখারি নগর লেনগুল বদন স্ট্রিট
(৩) এলিফ্যান্ট রােড আল আরবিয়া রােড
(৪) নবীন চাদ গােস্বামী রােড বখতিয়ার খিলজী রােড
৫) বেইলী রােড বুআলী রােড
(৬) কালীচরণ সাহা রােড গাজী সালাউদ্দিন রােড
(৭) রায়েরবাজার সুলতানগঞ্জ
(৮) এস কে দাস রােড সিরাজউদ্দীন রােড
(১) মাদারটেক মাজারটেক।
(১০) শশীভূষণ চ্যাটার্জী লেন সৈয়দ সলীম ফ্রিট।
(১১) ইন্দিরা রােড আনার কলি রােড এভাবে প্রাচীন নামগুলােকে পরিবর্তন করা হয়।
দৈনিক ইত্তেফাক
১৭ জুন এই দিনে একটি খবর প্রকাশিত হয় যে, ৬৯টি বই বাজেয়াপ্ত ঘােষণা করা হয়েছে। এটা ছিল পাকিস্তানী বর্বরদের বাঙালি সংস্কৃতি ধ্বংসের একটি ষড়যন্ত্র। নিচে কয়েকটি বাজেয়াপ্ত বইয়ের নাম দেয়া হল। বইয়ের নাম।
লেখকের নাম
(১) ভাসানী যখন ইউরােপে খােন্দকার মােহাম্মদ ইলিয়াস
(২) শব্দবােধ অভিধান আশুতােষ দেব কৈলাশচন্দ্র।
(৯) ভারতে বৃটিশ শাসনের অবসান
(১০) সচিত্র ভারত রমেশচন্দ্র রায়।
(১১) বিশ্ব শান্তি রক্ষার আহ্বান এ টি এম শামসুদ্দীন
(১২) রক্তকপােত । নূরে আলম সিদ্দিকী।
(১৩) সংগ্রামী বাংলা। আবুল কালাম আজাদ।
(১৪) বাঙালী জাতীয়তাবাদের উল্লেখ । আবুল কালাম আজাদ
(১৫) হাসুবানু প্রবােধ কুমার সান্যাল।
দৈনিক সংগ্রাম
জি সি রায়


৩) আলমগীর (নাটক) বিনয়কৃষ্ণ মুখার্জী।
(৪) বাস্তুভিটা (নাটক) দিগিন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়।
(৫) পূর্ব বাংলার শস্য ও জমির জন্য সংগ্রাম এ কে আর আহমদ।
(৬) লীগ শাসনে বরিশালে ফ্যাসিস্টরাজ নুরুল ইসলাম খান। (৭) নেতাজীর পথ ও গান্ধীর মত। অমরেন্দ্রনাথ দত্ত
(৮) দি ট্রাজেডী অব জিন্নাহ


১৫ জুন পত্রিকাটি এইদিনে মন্তব্য করে যে,

“ব্রাহ্মণ্যবাদী ভারতীয় দস্যুরা মুসলমানদের দাড়ি জোর করে কেটে দিচ্ছে। যারা নামাজ পড়ে তাদের নামাজ পড়তে দেয়া হচ্ছে না। বলা হচ্ছে ভগবানকে মনে মনে ডাকলেই হবে ঘটা করবার দরকার নেই।”
গােলাম আজম
১৭ জুন এই দিনে গােলাম আজমের একটি বিবৃতি প্রকাশিত হয়। বিবৃতির অংশ বিশেষ,

“দুষ্কৃতকারীরা এখনও তাদের ধ্বংসাত্মক কাজে লিপ্ত রয়েছে। তাদের লক্ষ্যই হচ্ছে জনগণের মধ্যে আতঙ্ক ছড়ানাে এবং বিশৃঙ্খলাপূর্ণ পরিস্থিতিকে দীর্ঘায়িত করা। পূর্ব পাকিস্তানের এমন নিভৃত অঞ্চল রয়েছে যেখানে দুষ্কৃতকারীরা জনগণকে পাকিস্তান রেডিও শুনতে দেয়না। প্রকৃত অপরাধীদের যদি পাকড়াও করা হয়, তবেই পরিস্থিতি দমন করা যেতে পারে।”
গােলাম আজম।| ১৮ জুন লাহোের বিমানবন্দরে অবতরণের পর সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে এখানকার পরিস্থিতি সম্বন্ধে তিনি বলেন

‘দুষ্কৃতকারীরা এখনও ধ্বংসাত্মক কাজে লিপ্ত রয়েছে। ত্রাস সৃষ্টি এবং বিশৃখলাপূর্ণ পরিস্থিতি অব্যাহত রাখাই তাদের উদ্দেশ্য। দুষ্কৃতকারীরা নকসালপন্থী ও বামপন্থী শক্তিদ্বারা পরিচালিত হচ্ছে।”
তিনি আরাে বলেন
“জনগণ পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীকে পূর্ণ সাহায্য ও সহযােগিতা দানে ইচ্ছুক, কিন্তু জীবননাশের জন্য দুষ্কৃতকারীরা হুমকি দেওয়ায় তারা এ ব্যাপারে পূর্ণ সাহায্য। দান করতে পারছে না। প্রকৃত অপরাধীকে ধরতে পারলেই পরিস্থিতি সম্পূর্ণ করায়ত্ত করা সম্ভব হত।”

গােলাম আজম।
২০ জুন স্থান লাহাের। জামাতে ইসলামীর অফিস। ইয়াহিয়া খানের সাথে এক সাক্ষাতের পর একটি সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন

“দুষ্কৃতিকারীরা এখনও পূর্ব পাকিস্তানে তৎপর রয়েছে এবং তাদের মােকাবিলা করার জন্য জনগণকে অস্ত্র দেয়া উচিত।”
গােলামআজম।
২০ জুন গােলাম আজম লাহােরে এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন,

“পূর্ব পাকিস্তানে অধিক সংখ্যক অমুসলমানদের সহায়তায় শেখ মুজিবুর রহমানের হয়তাে বিচ্ছিন্নতায় ইচ্ছা থাকতে পারে, তবে তিনি প্রকাশ্যে কখনও স্বাধীনতার জন্য চিৎকার করেননি। অবশ্য তার ছয় দফা স্বাধীনতাকে সম্ভব করে। তুলতে পারতাে বলে তিনি উল্লেখ করেন। মওলানা ভাসানী, অধ্যাপক মােজাফফর আহমেদ, আতাউর রহমান খান এরাই মূলত প্রকাশ্যে বিচ্ছিন্নতার দাবী তােলেন। বিচ্ছিন্নতার জন্য শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করা হয়েছে। কিন্তু যারা। প্রকাশ্যে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন শুরু করেছিলেন তাদেরতাে গ্রেফতার করা হয়নি। সেনাবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানে প্রায় সকল দুষ্কৃতকারীদের উৎখাত করেছে এবং বর্তমানে এমন কোন শক্তি নাই যা সেনাবাহিনীর প্রাধান্যকে চ্যালেঞ্জ করতে। পারে।”
গােলামআজম
২০ জুন লাহােরে একটি সাংবাদিক সম্মেলনের পূর্বে তিনি জামাত কর্মীদের সমাবেশে বলেন

“দেশকে খণ্ড-বিখণ্ডিত হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করার জন্য সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণ ছাড়া আর কোন বিকল্প ব্যবস্থা ছিল না।”—তিনি উদাহরণ টেনে বলেন“পূর্ব পাকিস্তানের সাম্প্রতিক গােলযােগ ১৮৫৭ সালে বাংলায় বিদ্রোহী আন্দোলনের চেয়ে দশগুণ বেশি শক্তশালী ছিল।”


গােলামআজম।
২২ জুন একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন,

“পূর্ব পাকিস্তানের মুসলমানরা ইসলামকে কখনও পরিত্যাগ করতে পারবে না। এ কারণে তারা পাকিস্তানকেও ত্যাগ করতে
পারবে না। পূর্ব পাকিস্তান ইসলাম ও পাকিস্তানের জন্য অপরিসীম ত্যাগ স্বীকার করেছে। আরাে কোরবানী দেয়ার জন্য তারা প্রস্তুত রয়েছে।’
“একটি স্বার্থান্বেষী মহল এদেশে সব সময়ই গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে আসছে। বিগত নির্বাচনে জাতি অনেক কিছু আশা করে আসছিল। কিন্তু নির্বাচনে যারা জয়লাভ করেছিল তারা নিজেদের গণতন্ত্র প্রিয় বলে দাবী করলেও প্রকৃতপক্ষে তারা ছিল ফাসিস্ট। | প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান দেশের নিরাপত্তা ও ইসলামী আদর্শ রক্ষার্থে একটি আইনগত কাঠামাে দান করেন। কিন্তু নির্বাচনে তখন যেসব দল জয়লাভ করল তাদের আদর্শ কর্মসূচি শ্লোগান সবই আইনগত কাঠামাের পরিপন্থী ছিল, নির্বাচিত ব্যক্তিরা জাতিকে তাই দিয়েছিল যা তাদের কাছে আশা করা গিয়েছিল।”

গােলামআজম।
২৩ জুন এইদিনে তিনি এক কর্মী সভার বক্তৃতায় বলেন,

“পূর্ব পাকিস্তানীরা সর্বদাই পশ্চিম পাকিস্তানী ভাইদের সাথে একত্রে বাস করবে।”
এক সাংবাদিক সম্মেলনে সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে বলেন,

“নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের ৬ দফা কর্মসূচির উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া। যেসব দল খােলাখুলিভাবে বিচ্ছিন্নতার আন্দোলন শুরু করেছিল এবং স্বাধীন বাংলা গঠনের জন্য জনতাকে উত্তেজিত করেছিল সেসব দলকে নিষিদ্ধ ঘােষণার জন্য তিনি সরকারের প্রতি আহবান জানান।”
দৈনিক আজাদ
২৫ জুন নরঘাতক পাক বাহিনীর সাথে তাদের এদেশীয় দালাল শান্তি কমিটির যােগাযােগ কত বিস্তৃত ছিল তার একটি উল্লেখযােগ্য দৃষ্টান্ত :

“অদ্য পূর্ব পাকিস্তানের পশ্চিমাঞ্চল সফরকালে সেনাবাহিনীর চীফ অফ ষ্টাফ জেনারেল আব্দুল হামিদ খানকে বিভিন্ন শান্তি কমিটি কর্তৃক সম্পাদিত বিভিন্ন কল্যাণকর কাজ এবং বেসামরিক জনতা ও সামরিক কর্তৃপক্ষের মধ্যেকার সৌহার্দের কথা জানানাে হয়। জেনারেল হামিদ অদ্য সকালে পূর্বাঞ্চলীয় কমাণ্ডের কমাণ্ডার ও জি ও সিসহ যশাের, ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা এবং ফরিদপুর সফর করিয়া পূর্বাহ্নে ঢাকা প্রত্যাবর্তন করেন। জেনারেল হামিদকে জানান হয়, এই অঞ্চলের দেশদরদী জনগণ দেশ হইতে রাষ্ট্রদ্রোহীদের উচ্ছেদে কর্তৃপক্ষকে সক্রিয়ভাবে সহযােগিতা করিতেছে। এই সমস্ত রাষ্ট্রদ্রোহীর মধ্যে কিছু সংখ্যক লােক আত্মরক্ষার। উদ্দেশ্যে শান্তি প্রিয় লােকালয়ে আশ্রয় গ্রহণ করিলে স্থানীয় জনসাধারণ তাহাদিগকে খুঁজিয়া বাহির করিয়া শাস্তি প্রদান করে। ইহাদের শাস্তি প্রদানের জন্য দেশে বহু রাজাকার বাহিনী গঠিত হইয়াছে।”


দৈনিক পূর্বদেশ
২৫ জুন এই তারিখে দৈনিক পূর্বদেশের একটি খবরে উল্লেখ করা হয়

—“বগুড়া জেলার জয়পুরহাট মহকুমায় আব্বাস আলীর নেতৃত্বে ১৫ সদস্য বিশিষ্ট মহকুমা শান্তি কমিটি গঠিত হয়েছে। এছাড়া মহকুমার সকল ইউনিয়নে অনুরূপ শান্তি কমিটি রয়েছে বলে কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটির এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানান হয়েছে। কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটির সদস্য জনাব আবদুল মতিন মহকুমার বিভিন্ন স্থানে সফর শেষে ঢাকা ফিরে জানিয়েছেন যে, গত ২৬ এপ্রিল থেকে উক্ত এলাকা রাষ্ট্রদ্রোহী এবং ভারতীয় অনুপ্রবেশকারীদের কবলমুক্ত হয়েছে। শান্তি কমিটিগুলাে সেনাবাহিনী ও স্থানীয় প্রসাশনের সাথে পূর্ণ সহযােগিতা করছে। জয়পুরহাটে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আগমনের পর ভারতীয় অনুপ্রবেশকারীরা ও রাষ্ট্রদ্রোহীরা পালিয়ে যায় এবং তাদের মধ্যে কয়েকজন নিহত হয়। বর্তমানে এলাকায় পূর্ণ স্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করছে।”
এম এ মতিন।
২৬ জুন ২৬জুনের একটি সংবাদে প্রকাশিত হয় যে-

“আজ ঢাকা জেলা পরিষদ হলে ঢাকা সদর দক্ষিণ শান্তি কমিটির এক বৈঠক হয়েছে। কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটির সদস্য এম এ মতিন এই সভায় সভাপতিত্ব করেন। সভাপতির ভাষণে তিনি সমাজবিরােধীদের নির্মূলে আমাদের সেনাবাহিনীকে সহায়তা করার জন্য সবাইকে আহ্বান জানান।
গােলামআজম
৩০ জুন ২৮ জুন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বেতার ভাষণে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের আসন শূন্য ঘােষণা করেন। এ বক্তব্যকে সমর্থন করে তিনি বলেন,

“শাসনতন্ত্র প্রণয়ন এবং ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যাপারে প্রেসিডেন্ট যে কর্মসূচি ঘােষণা করেছেন বর্তমান পরিস্থিতিতে জাতির সামনে তাই হচ্ছে একমাত্র গ্রহণযােগ্য পথ।”
দৈনিক সংগ্রাম
১ জুলাই

“পূর্ব পাকিস্তানের একদল ছাত্র-ছাত্রী ও একটি বিশেষ রাজনৈতিক দল গত এক বৎসর ধরে ‘জয়বাংলা’ শ্লোগানে পাক বাংলার আকাশ বাতাস কলুষিত করার যে প্রচেষ্টা চালিয়েছিল তাতে কোন পাকিস্তানী শংকিত না হয়ে পারেনি।”
দৈনিক সংগ্রাম।
৪ জুলাই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশে পাকিস্তানী বাহিনীর ব্যাপক গণহত্যার খবর প্রকাশিত হতে থাকলে পত্রিকাটি সে সম্পর্কে মন্তব্য করে,

“বস্তুত ইহুদী হিন্দু আঁতাত ও মুসলিম বিদ্বেষী স্বার্থান্ধ মহল পাকিস্তান সম্পর্কে অপপ্রচার চালিয়ে সব
দিক থেকে পাকিস্তানকে ঘায়েল করে ধ্বংস করার প্রচেষ্টায় উঠে পড়ে লেগেছে। কিন্তু মিথ্যা ফানুস প্রথম দিকে কিছু চমক সৃষ্টি করতে পারলেও চূড়ান্ত বিজয় যেমন তার হয়না তেমনি পাকিস্তান বিরােধী চক্রান্তও ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে বলে আমরা বিশ্বাস করি।

দৈনিক সংগ্রাম
| ৫ জুলাই ব্রিটিশ পত্র-পত্রিকা, বিভিন্ন প্রচার মাধ্যম এবং বিশেষ করে বিবিসি মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করে। এতে পত্রিকাটি ক্ষোভ প্রকাশ করে লেখে;

“ব্রিটিশ সংবাদপত্র ও সাংবাদিকদের সাথে হিন্দুস্তানের নতুন করে আঁতাত সৃষ্টি হয়েছে। পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন ও খণ্ড-বিখণ্ড করার যে দূরভিসন্ধি হিন্দুস্তান করেছিল তার সাথে বৃটিশ পত্র-পত্রিকা ও প্রচার মাধ্যমগুলাের যােগসাজশ ছিল বহু পূর্ব থেকেই।” |
দৈনিক সংগ্রাম
৬ জুলাই এই তারিখে পত্রিকাটি মন্তব্য করে।



“এখানকার বিতাড়িত স্বাধীনতাকামী বাঙালিরা ওখানকার বঞ্চিত স্বাধীনতাকামী বাঙালিদের সাথে মিশে পশ্চিম বাংলাকেই স্বাধীন গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ করে ফেলেছে। তাই আসুন ইন্দিরা দেবী এবারে মান অভিমান ছেড়ে দিয়ে সইদের মাধ্যমে খােশামোেদ না চালিয়ে সােজাসুজি আমাদের কাছে আত্মসমর্পণ করুন। শেরােয়ানীর কাছে শাড়ীর আত্মসমর্পণে কোন লজ্জা নেই।”
দৈনিক সংগ্রাম
৮ জুলাই পত্রিকাটির সম্পাদকীয়র অংশ বিশেষ,

“বর্তমানে পাকিস্তানের তের কোটি মানুষ এ ষড়যন্ত্রের বিরদ্ধে একাত্ম হয়ে রুখে দাড়িয়েছে। হিন্দুস্তানের চক্রান্ত আজ সকলের কাছে সুস্পষ্ট। একজন পাকিস্তানী জীবিত থাকতেও এ চক্রান্তের বিরুদ্ধে লড়ে যাবে এবং বৃটেন হােক কি আমেরিকা বা জাতিসংঘ এ ব্যাপারে পৃথিবীর কোন শক্তির চাপের সামনেই তারা মাথা নত করতে প্রস্তুত নয়। তাই মরহুম কায়েদে আজমের ভাষায়-পাকিস্তান টিকে থাকার জন্যেই এসেছে এবং ইনশাল্লাহ টিকে থাকবেও।”
আবদুল খালেক
৯ জুলাই মুক্তিযােদ্ধাদেরকে দুষ্কৃতকারী এবং ডাকাত হিসেবে উল্লেখ করে তিনি বলেন

“সশস্ত্র দুষ্কৃতকারী ও ডাকাতদের নির্মূল করার জন্য জনগণ এখন স্বেচ্ছায় রেজাকার ট্রেনিং নিচ্ছেন। এসব দুতকারী ও ডাকাত সম্পূর্ণরূপে হতাশ হয়ে। গ্রামের প্রত্যন্ত এলাকায় বসবাসকারী শান্তিপ্রিয় নাগরিকদের জিনিসপত্র লুটপাট ও ডাকাতি করে জনগণের দুঃখ দুর্দশা আরাে বৃদ্ধি করেছে।”
দৈনিক সংগ্রাম ।
১২ জুলাই পত্রিকাটি মন্তব্য করে।

“যারা পূর্ব পাকিস্তানী মানুষের সর্বনাশকারী দালাল নেতাদের গালভরা বুলিতে বিভ্রান্ত হয়ে হাওয়াই বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখে, হিন্দুস্তানের মাটিতে বসে যে সব তথাকথিত নেতা ‘বাংলাদেশ’ আন্দোলন করছেন, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত না হলে যে অবিভক্ত ভারতে তাদের অস্তিত্বই থাকতাে না, একথা বােঝার জ্ঞানটুকুও তাদের থাকা উচিত।”
দৈনিক সংগ্রাম
১৪ জুলাই

“১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদের পর দুই বাংলা এক হল, রাজধানী কোলকাতায় চলে গেল। বাংলার হিন্দুরা আনন্দে লাফাতে লাগল। বাংলার মুসলমানদের টিটকারী দিয়ে তাদের কবি রবিঠাকুর ইংরেজ সম্রাটকে ভগবানের আসনে বসিয়ে ‘জনগণমন অধিনায়ক’ গান লিখল যা আজ হিন্দু ভারতের জাতীয় সঙ্গীত। যারা হিন্দু বাংলার প্রেমে রাধার ভূমিকা পালন করতে ভারতে গিয়েছে তারা শীঘ্রই ব্রাহ্মণ্যবাদের আসল রূপ স্বচক্ষে দেখে নিজেদের ভুল বুঝে প্রাণ নিয়ে স্বদেশ পাকিস্তানে ছুটে আসবেন এ বিশ্বাস আমাদের রয়েছে।”


দৈনিক সংগ্রাম
১৬ জুলাই ২৫ মার্চের রাতে-ভাষা আন্দোলনের শহীদ স্মরণে নির্মিত শহীদ মিনারটিও ভেঙে ফেলে। এ সম্পর্কে পত্রিকাটি মন্তব্য করে যে,

আইয়ুব খানের গভর্ণর আজম খান ছাত্রদের খুশী করবার জন্য যে শহীদ মিনার তৈরী করলেন তাকে পূজামণ্ডব বলা যেতে পারে কিন্তু মিনার কিছুতেই না। যা হােক সেনাবাহিনী এই কুখ্যাত মিনারটি ধ্বংস করে সেখানে মসজিদ গড়ে শহীদদের প্রতি যথার্থ সম্মান প্রদর্শনের চেষ্টা করেছেন জেনে দেশবাসী খুশি হয়েছে।”
আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে দুর্বার ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম নেত্রী ছিলেন বেগম মতিয়া চৌধুরী। তার অগ্নিঝরা বক্ততা এবং সাহসী নেতৃত্বের জন্য ছাত্র সমাজ তাকে • “অগ্নিকন্যা” উপাধিতে সম্বােধন করতে শুরু করে। মনি সিংহ ছিলেন কমিউনিস্ট


আন্দোলনের কিংবদন্তীর নায়ক এবং স্বাধীন বাংলার অস্থায়ী সরকারের অন্যতম সদস্য। উক্ত দুজনকে কটাক্ষ করে সংগ্রাম ইতিহাস কথা বলে’ শীর্ষক রচনায় মন্তব্য করে



“এসমস্ত বাংলা দরদী দলে আরাে ছিল বাপ খেদানাে ‘অগ্নিকন্যা সূর্য সন্তানেরা যারা পাকিস্তানের প্রধান দুশমন এবং ১৪ আগস্ট ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের জন্মলগ্নে বিদ্রোহী কুখ্যাত মনি সিংহের মুক্তিকে দেশের জনগণের মুক্তি বলে মনে করে।
আজ এই কুচক্রীদের দ্বারাই ভারতের মাটিতে বসে কাল্পনিক ‘স্বাধীন বাংলা সরকার স্বাধীন বাংলা রেডিওর নামে চিৎকার চলছে। তাদের কল্পনায় ‘মুজিব নগর-এর কোন মাটির ঠিকানা নেই। আছে হাওয়াই ঠিকানা। সুতরাং ভারতের এই দালালদের পাকিস্তানবাসীরা কোনদিনই ক্ষমা করবে না।”

দৈনিক সংগ্রাম ।
১৭ জুলাই এই পত্রিকাটি মহান ‘৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থানকে ‘জ্বালাও পােড়াও’ আন্দোলন হিসেবে চিহ্নিত করে। এবং ইয়াহিয়া খানের সামরিক শাসনকে যৌক্তিক দাবি করে বলে, |
“১৯৬৯ সালে চরমপন্থী নেতারা যদি জ্বালাও পােড়াও ঘেরাও আন্দোলন শুরু না করত তবে আবার দ্বিতীয়বার সামরিক শাসনের প্রয়ােজন হত না। দেশে এমন চরম বিশৃঙ্খলা শুরু হলাে যে, শেষ পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া সামরিক শাসন প্রবর্তন করে শান্তি প্রতিষ্ঠা করেন। এতে আরাে বলা হয় যে,
“কিন্তু আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ ১৯০৫ সালের ‘জয়বাংলা শ্লোগান তুলে আবার হিন্দু বাংলায় পূর্ণ সমর্থন আদায় করে সমস্ত হিন্দু ভােট পাওয়ার ব্যবস্থা করে নিল। এরা বুঝে না বুঝে আবার মীর জাফর, আবদুল রসুল, গাফফার খান ও শেখ আবদুল্লাহর মত ভুল করে বসল। এরা হিন্দুর চক্রান্ত না বুঝে প্রচার করতে লাগল যে, বাংলাদেশ বাঙালির। এ সরাসরি বিশ্বাস ঘাতকর ও বেইমানি, কারণ এতে লাভ হবে বাঙালি হিন্দুর আর সর্বনাশ হবে বাঙালি মুসলমানের তথা গােটা পাকিস্তানের। |
মওলানা ভাসানী সম্পর্কে মন্তব্য করা হল যে,

“নির্বাচনের পূর্বে ১২ নভেম্বরের সর্বনাশা ঝড়ের সুযােগে মওলানা ভাসানী সরাসরি বিচ্ছিন্নতার দাবি তুললেন। কেন যে সে আওয়াজ বন্ধ করা হল না তা অনেকের বুঝের বাইরে। সেই ভুলের জন্য আজ পূর্ব পাকিস্তান মুক্তি বাহিনীর নামে একদল দেশদ্রোহী ও ভারতের দালাল কর্তৃক স্বাধীনতা হরনে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত।”
পত্রিকাটি আরাে মন্তব্য করে যে,

“আজকাল ভারতের হাওয়াই বাণী যেভাবে বাংলাদেশের জন্য চিৎকার করছে তাতে মুসলমানের বুঝা উচিত যে, এ বাংলাদেশ তারা চায় বাঙালি হিন্দুদের জন্য বাঙালি মুসলমানদের জন্য তারা বঙ্গোপসাগরের অথই জলই নির্দিষ্ট করে রেখেছে।
আবদুর রহমান বিশ্বাস
| ১৮ জুলাই আবদুর রহমান বিশ্বাস ছিলেন বরিশাল জেলা কমিটির (মুসলীম লীগ) সহসভাপতি। জুলাই মাসে তিনি শান্তি কমিটির সভায় মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে বক্তৃতা
প্রদান করেন। উক্ত সভায় আরাে বক্তৃতা করেন এম এন এ অবসরপ্রাপ্ত মেজর আফসার উদ্দিন, সাবেক মন্ত্রী এম এম আফজাল, সাবেক এম এন এ চৌধুরী ফজলে রব খান। এইদিনে দৈনিক সংগ্রাম সংবাদটি প্রকাশ করে,

“কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটির কার্যকরী পরিষদ সদস্য ও পাকিস্তান মুসলিম লীগের সহ-সভাপতি ব্যারিস্টার আখতার উদ্দীন আহমদ বলেছেন, বর্তমান মুহূর্তে বিদেশী সাম্রাজ্যবাদের ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করে দেয়ার জন্য আমাদেরকে দলীয় মত পার্থক্য ভুলে গিয়ে একতাবদ্ধ হতে হবে। বরিশালে জেলা শান্তি কমিটি আয়ােজিত এক বিরাট সভায় বক্তৃতা প্রসঙ্গে ব্যারিস্টার আখতার উদ্দীন উপরােক্ত মন্তব্য করেন (এপিপি পরিবেশিত)। পাকিস্তানের ঐক্য ও সংহতির বিরুদ্ধে ভারত যে চক্রান্ত ও প্রচারণা চালাচ্ছে, সাহস ও আস্থার সাথে তার মােকাবেলা করার জন্য জনাব আখতার উদ্দীন জনগণের প্রতি আহবান জানান। পূর্ব পাকিস্তানে অশুভ কার্যকলাপে লিপ্ত দুষ্কৃতকারী এবং বিদেশী চরদের উৎখাত করার জন্যও তিনি আহ্বান জানান।”
দৈনিক সংগ্রাম
| ১৯ জুলাই ব্রিটিশ টেলিভিশনে বাংলাদেশে নৃশংস গণহত্যার ছবি প্রচারের পর সারা বিশ্বের মানুষ প্রতিবাদ মুখর হয়ে ওঠে। এ সম্পর্কে পত্রিকাটি মন্তব্য করে যে,

“বৃটিশ টেলিভিশন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের তথাকথিত মর্মস্পশী অবস্থা সম্পর্কে ভুয়া ছবি প্রদর্শন করছে। বৃটিশ টেলিভিশনে যে সব ছবি দেখানাে হচেছ সেগুলাে সাম্প্রতিক কালের নয় বরং সেগুলাে ঘূর্ণিঝড়ের সময়কার ছবি। বৃটিশ কর্মকর্তারা বােঝাতে চাচ্ছেন সেনাবাহিনী কর্তৃক ব্যবস্থা গ্রহণের পর পূর্ব পাকিস্তানের এই চরম বীভৎস অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। সন্দেহ নেই বৃটিশ প্রচার মাধ্যমে এ ষড়যন্ত্র হিন্দুস্তান থেকেই প্রেরণা পেয়েছে।”
– দৈনিক সংগ্রাম।
= ২৭ জুলাই এইদিনে ‘ছেলে ধরাদের বিচার চাই শীর্ষক একটি সংবাদ পরিবেশিত হয়।

“ভারতের নিয়ােজিত আওয়ামী এজেন্টদের কাজ হচ্ছে আমাদের ছেলেদের ধরে। নিয়ে ভারতের হাতে তুলে দেয়া। ভারত তাদের একদলকে পঙ্গু করে মহামারীর শিকার করে আর অনাহারে রেখে বিধের দুয়ারে দুয়ারে ভিক্ষা সংগ্রহ করছে অন্য দলকে ট্রেনিং দিয়ে তারা বিতাড়িত আওয়ামী চরদের পাকিস্তানে পুনরায় মজবুত ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য জবরদস্তিমূলক সংগ্রামে লাগিয়েছে। এভাবে আমাদের লক্ষ লক্ষ ছেলেকে তারা ধ্বংসের অতলে তলিয়ে দিয়ে তাদের ঘৃণ্য স্বার্থ । চরিতার্থ করে চলেছে।”


২ আগস্ট
গোলামআজম।
৩০ জুলাই। টিক্কা খান কর্তৃক কুখ্যাত পাঠ্যসূচি সংস্কারের প্রতি অভিনন্দন জানিয়ে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের প্রতি ইঙ্গিত করে এক বিবৃতিতে তিনি বলেন –



“শিক্ষকদের উপরেই সঠিক শিক্ষাদান নির্ভর করছে, শিক্ষকরা পাকিস্তানের আদর্শের খাটি বিশ্বাসী না হলে তাদের কাছ থেকে গঠন মূলক কিছুই আশা করা যায় না।


দৈনিক সংগ্রাম
এইদিনে পত্রিকাটি মন্তব্য করে যে বর্তমান পরিস্থিতিতে নিম্নরূপ দোয়া বাঞ্ছনীয়,

(১) হায় আল্লাহ। আপনি পাকিস্তানকে শক্তিশালী করিয়া দিন। এবং পাকিস্তান ও ইসলামের দুশমন দের পরাজিত করিয়া দিন।। ”
(২) হায় আল্লাহ। পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ দুশমন সন্ত্রাসবাদীদের জুলুমের হাত থেকে পাকিস্তানীদেরকে হেফাজত করুন। .
(৩) হায় আল্লাহ। আপনি পাকিস্তান ও ইসলামপন্থীদেরকে এমন দুষ্কর্ম হইতে বিরত রাখুন যার দরুন ইসলাম ও পাকিস্তানের ললাটে কলঙ্কের ছাপ না পড়ে। |
(৪) হায় আল্লাহ। পাকিস্তানীদের মধ্যে যারা ভুল পথে পরিচালিত হইয়াছে ইহাদের মধ্যে যাহারা প্রকৃতপক্ষে লজ্জিত ও অনুতপ্ত তাহাদের তওবা করার ও আত্মসমর্পণ করার তৌফিক দিন। |
(৫) হায় আল্লাহ। আপনি যাহাদের তওবা ও আত্মসমর্পণ পছন্দ করেন না তাহাদের নির্মূল করিয়া দিন। অথবা অন্ততঃপক্ষে তাহাদেরকে দারুল ইসলাম ও পাকিস্তান হইতে খারিজ করিয়া দিন।

মতিউর রহমান নিজামী
২ আগস্ট। | চট্টগ্রাম শহর ইসলামী ছাত্র সংঘের উদ্যোগে স্থানীয় মুসলিম ইনস্টিটিউটে আয়ােজিত এক ছাত্র সমাবেশে তিনি বলেন

-“দেশ প্রেমিক জনগণ যদি ১ মার্চ। থেকে দুস্কৃতকারীদের মােকাবিলায় এগিয়ে আসত তবে দেশে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হত না। আল্লাহ তার প্রিয় পাকিস্তানকে রক্ষা করার জন্য ঈমানদার মুসলমানদের দায়িত্ব দিয়েছিলেন। কিন্তু মুসলমানরা যখন ব্যর্থ হল তখন আল্লাহ সেনাবাহিনীর মাধ্যমে দেশকে রক্ষা করেছেন।
আব্দুল জাহের মুহম্মদ আবু নাসের
২ আগস্ট | চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ইসলামী ছাত্র সংঘের সভাপতি আব্দুল জাহের মুহম্মদ আবু নাসের বলেন

“ভারতের সকল চক্রান্ত নস্যাৎ করে পাকিস্তানকে টিকিয়ে রাখার জন্য আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাবাে।
চট্টগ্রাম ছাত্র সংঘের সভাপতি রাজাকার এবং আলবদর বাহিনীর প্রধান মীর কাসেম আলী বলেন-

“গ্রাম গঞ্জের প্রত্যেকটি এলাকায় খুঁজে খুঁজে শত্রুর শেষ চিহ্ন মুছে ফেলতে হবে।”
গােলামআজম
৩ আগস্ট মাদ্রাসা শিক্ষা সম্মেলনে গােলাম আজম বলেন,

“এই যুদ্ধ শুধু অস্ত্রের যুদ্ধ নয়, আদর্শিক যুদ্ধ। আল্লাহর দীনকে প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে এই দেশকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য যুদ্ধে আমাদের জয়ী হতেই হবে।”
আয়েনউদ্দিন
৪ আগস্ট এইদিনে দৈনিক সংগ্রামের খবরে প্রকাশিত হয়—

“রাজাকার বাহিনীর প্রথম গ্রুপের ট্রেনিং সমাপ্তি উপলক্ষে আজ স্থানীয় জিন্নাহ ইসলামিক ইনস্টিটিউটে এক সমাপনী উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠানে পবিত্র কোরান স্পর্শ করে শপথ গ্রহণ করা হয়। অনুষ্ঠানে শান্তি কমিটির সভাপতি জনাব আয়েন উদ্দিন রাজাকার বাহিনীকে যথাযথ কর্তব্য পালনে বিশ্বস্ততার সাথে পাকিস্তানের আদর্শ, সংহতি ও অখন্ডত্ব রক্ষার জন্য সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার উপদেশ দেন। অনুষ্ঠানে স্থানীয় বিশিষ্ট ব্যক্তি ও সামরিক অফিসারবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।”
দৈনিক সংগ্রাম
29. ৭ আগস্ট ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণ সম্পর্কে পত্রিকাটি মন্তব্য করে যে,

“রেসকোর্সের তথাকথিত নীতি নির্ধারণ ভাষণে দেশবাসীকে চরম অরাজকতা সৃষ্টির দিকে আহবান করেন। তিনি ঘরে ঘরে দুর্গ তৈরী করা ও লাঠি সােটা নিয়ে তৈরী থাকার আহ্বান জানিয়ে হিংসাত্মক পরিবেশ সৃষ্টি করেন।”
গােলামআজম
৮আগস্ট তার একটি বক্তৃতার অংশ বিশেষ। তিনি শেখ মুজিব এবং আওয়ামী লীগ। সম্পর্কে বলেন,

“শেখ মুজিব ও বেআইনী ঘােষিত আওয়ামী লীগ ভারতের সাথে আঁতাত করে এ অঞ্চলের জনগণের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে।”
দৈনিক সংগ্রাম
৮ আগষ্ট এদিনে পত্রিকাটি সম্পাদকীয়তে বলে,

“আওয়ামী লীগ এবং তার প্ররােচনায় বিদ্রোহকারী ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলের সশস্ত্র লােকজনরা বর্ণনাতীত নৃশংসতার মধ্য দিয়ে নারী শিশু ও পুরুষকে হত্যা করে। হত্যার পূর্বে অনেক জায়গায় মেয়েদের উলঙ্গ করে প্যারেড করানো হয় এবং মায়েদের কে সন্তানের রক্তপান করতে বাধ্য করানো হয়। কোথাও আবার মেয়েদেরকে দিয়ে কবর খুড়িয়ে নিয়ে তাদেরকে ধর্ষণ করে পরে সেই কবরে তাদের সমাধিস্থ করা হয়।”
একই দিনে একটি ক্যাপসনে ছিল যে,

“রেজাকার বাহিনীর প্রথম দলটি কোরান শরীফ নিয়ে শপথ গ্রহণ করেছেন।”
| পাকিস্তান অখণ্ডতা ও সংহতি সংরক্ষণ এ্যাকশন কমিটি।
৯ আগস্ট ঢাকার মােহাম্মদপুর শান্তি কমিটির শাখা সংগঠন ‘পাকিস্তান অখণ্ডতা ও সংহতি সংরক্ষণ এ্যাকশন কমিটির সিদ্ধান্তসমূহ। সিদ্ধান্তগুলাে গােপনে বিলিবন্টন করা এবং উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের পরিকল্পনা করা হয়। |

(১) উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা এবং বিদ্যালয়ের বাধ্যতামূলক বিষয় করা হােক। বাংলা সাইন বাের্ড, নম্বর প্লেট ও নাম অপসারণ এবং সংস্কৃত ধরনের বাংলা অক্ষরের পরিবর্তে রােমান হরফ ব্যবহার করতে হবে।


(২) যে কাফের কবি নজরুল ইসলামের ছেলেদের হিন্দু/বাংলা নাম রয়েছে তার রচনাসহ বাংলাসাহিত্য এবং সংস্কৃতির হিন্দু প্রভাবিত অংশসমূহ বর্জন করতে হবে।


(৩) পূর্ব পাকিস্তানের রেডিও টেলিভিশনের অনুষ্ঠানের শতকরা পঞ্চাশ ভাগ ব্যয় করতে হবে উর্দু অনুষ্ঠানের জন্য। |
(৪) আমাদের পবিত্র ভূমিতে পাকিস্তান বিরােধীদের আসতে দেয়া হবে না। (যেমন- ইহুদিবদী সেনারা ইসলামের শত্রু এডওয়ার্ড কেনেডি) .
(৫) বাংলাদেশের প্রতি সহানুভূতির কারণে বাঙালি সরকারী কর্মচারী, বুদ্ধিজীবী ও ব্যবসায়ীদের উপর চব্বিশ ঘণ্টা নজর রাখতে হবে এবং (পরে তাদের সামরিক বিচার করে হত্যা করতে হবে)। |
(৬) জাতির স্বার্থে উচ্চপদস্থ থেকে বাঙালি অফিসারদের দু’বছরের জন্য অপসারণ করতে হবে।
(৭) রাজাকার বাহিনীর বেতন এবং শান্তি কমিটির ব্যয় নির্বাহের জন্য হিন্দু সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করতে হবে।
(৮) কড়া প্রতিবাদ জানিয়ে ইউ এস, এস, ইউ কে আর এবং অন্যান্য শত্রু রাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করতে হবে।
(৯) বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্থদের মধ্যে বিতরণের জন্য বাস্তুহারাদের সাহায্য দ্রব্য এবং উর্দুভাষীদের খাটি পাকিস্তানীদের মধ্যে বিতরণের জন্য বার্তা পাঠান বিধ্বন্তদের সাহায্য তহবিল ব্যবহার করতে হবে।
(১০) বীর পাকিস্তানী ও আমাদের সত্যিকারের বন্ধু রাষ্ট্র চীনের সৈনিকদের নামে শহরগুলির নামকরণ করতে হবে।


(১১) বর্তমান জাতীয় পুর্নগঠনের সময় তিন মাসের জন্য বিদেশী সাংবাদিক ও অনভিপ্রেত ব্যক্তিদের বহিষ্কার করতে হবে।

গােলামআজম
১৪ আগষ্ট আজাদী দিবস উপলক্ষে তিনি একটি বিবৃতিদান করেন। এতে বলেন

“আমাদের আদর্শের প্রতি অপরাধমূলক চরম বিশ্বাসঘাতকতা আজকের জাতীয় সংকটগ্রস্ত আর আসল কারণ। পাকিস্তান রক্ষার ডাক দিয়ে তিনি আরাে বলেন-“এ চেষ্টা ব্যর্থ হলে আমরা ধ্বংস প্রাপ্ত হব এবং যতদিন আমরা বাঁচব, পঙ্গু জাতি হিসেবে বেঁচে থাকব।”
দৈনিক সংগ্রাম।
১৪ আগস্ট আজাদী দিবস উপলক্ষে বলা হয় যে,



২৫তম আজাদী দিবসে জাতি আজ কায়েদে আজম মােহাম্মদ আলী জিন্নাহ ক স্মরণ করছে।
আব্বাস আলী খান
১৪ আগস্ট আজাদী দিবসে জয়পুরহাটে রাজাকার এবং পুলিশ বাহিনীর সম্মিলিত কুচকাওয়াজে সভাপতির ভাষণে তিনি বলেন-

“রাজাকাররা বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সমূলে ধ্বংস করে দিতে জান কোরবান করতে প্রস্তুত।
গােলাম আজম।
১৪ আগস্ট আজাদী দিবস কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে এক সভার আয়োজন করে। উক্ত সভায় তিনি বলেন-

“পাকিস্তানের দুশমন দের মহল্লায় মহল্লায় তন্ন তন্ন করে খুঁজে তাদের অস্তিত্ব বিলাপে করার জন্য”


—দেশপ্রেমিক নাগরিকদের শান্তি কমিটির সাথে সহযােগিতা করার জন্য উদাত্ত আহবান জানান।
তিনি আরাে উল্লেখ করেন-

“আল্লাহ না করুন, যদি পাকিস্তান না থাকে তাহলে বাঙালি মুসলমানদের অপমানে মৃত্যু বরণ করতে হবে।”

স্বাধীনতাকামী বাঙালিদের সম্পর্কে বলেন-“কিন্তু এবার পাকিস্তানের ভেতর হাজারাে দুশমন সৃষ্টি হয়েছে। তাই এবারের সংকট কঠিন। কারণ বাইরের দুশমনের চেয়ে ঘরে ঘরে যে সব দুশমন রয়েছে তারা অনেক বেশি বিপদজনক।”
গােলামআজম।
১৪ আগস্ট আজাদী দিবসে তিনি জামাতে তালাবায়ে আরাবিয়ার ইসলামিক একাডেমী হলের সভায় এক বক্তৃতায় বলেন-

“বাংলাদেশ বাঙালিদের দ্বারা শাসিত হবে এই মতবাদ শেখ মুজিব বা শ্ৰীতাজুদ্দিনের। এই জন্যই তথাকথিত বাঙালিরা পশ্চিমবঙ্গে গিয়ে বাংলাদেশ কায়েম করছে। কিন্তু মুসলমান আল্লাহর হুকুম পালন করার সুযােগ লাভকেই সত্যিকারের আজাদী মনে করে। এ ভিত্তিতে শাসক নিজের দেশের হােক বা বিদেশী হােক তা মােটেই লক্ষণীয় নয়। |
দৈনিক সংগ্রাম।
১৬ আগস্ট দৈনিক সংগ্রামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনের অংশ বিশেষ—

“পাকিস্তানের ২৫তম আজাদী দিবস উপলক্ষে গতকাল শনিবার মােমনশাহী আল বদর বাহিনীর উদ্যোগে মিছিল ও সিম্পােজিয়াম অনুষ্ঠিত হয়। স্থানীয় মুসলিম ইনস্টিটিউটে আয়ােজিত এই সিম্পােজিয়ামে সভাপতিত্ব করেন আল বদর বাহিনীর প্রধান সংগঠক কামরুজ্জামান। এক তার বার্তায় প্রকাশ, বিভিন্ন বক্তা দেশকে ধ্বংস করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত দুশমনদের সম্পর্কে সতর্কবাণী উচ্চারণ করেন।”
গােলাম আজম
১৬ আগস্ট এইদিনে দৈনিক পাকিস্তানের একটি প্রতিবেদনে গােলাম আজমের উদ্ধৃতি দিয়ে। বলা হয়

“বিচ্ছিন্নতাবাদীদের হাত থেকে দেশকে রক্ষা করার জন্য শান্তি কমিটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। শান্তি কমিটি যদি দুনিয়াকে জানিয়ে না দিত যে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ দেশকে অখণ্ড রাখতে চায় তবে পরিস্থিতি হয়তাে অন্যদিকে মােড় নিত। তিনি আরাে বলেন“দেশকে রক্ষা করার দায়িত্ব শান্তি কমিটির। তাই দেশের মানুষকে বােঝানাের দায়িত্ব শান্তি কমিটির হাতে তুলে দিতে হবে ।
_ প্রতিবেদনে আরাে উল্লেখ করা হয়,

“পাকিস্তান টিকে থাকলে আজ হােক কাল হােক বাঙালি মুসলমানদের হক আদায় হবে। কিন্তু আজাদী ধ্বংস হলে মুসলমানদের শৃগাল কুকুরের মত মরতে হবে।”
গােলামআজম
১৮ আগস্ট দৈনিক সংগ্রামে তিনি একটি উপসম্পাদকীয় লেখেন, এতে বলা হয়।

“হিন্দুদের সাথে এক জাতি হয়ে এবং হিন্দু ভারতকে বন্ধু মনে করে অদূরদর্শিতা কতক মুসলিম নেতা বাঙালি মুসলমানদেরকে সর্বক্ষেত্রে বহু পেছনে ঠেলে দিয়েছে। এর ধাক্কা সামলিয়ে বাঙালি মুসলমানকে আবার অগ্রগতি লাভ করতে হলে মুসলিম জাতীয়তাবাদের জাগ্রত করতে হবে। আসুন আমরা অতীতের ভ্রান্তি থেকে মুক্ত হয়ে ঐ প্রতিশ্রুতি বাস্তবে রূপ দান করার দৃঢ় শপথ গ্রহণের মাধ্যমে সত্যিকারভাবে আজাদী দিবস পালন করি।”


এতে তিনি আরাে উল্লেখ করেন,

“দুনিয়ার প্রত্যেক রাষ্ট্রের নামই স্থান, ভাষা, জাতি বা ঐতিহাসিক কোন নাম থেকে নেয়া হয়। কিন্তু পাকিস্তানের নাম এ ব্যাপারে ব্যতিক্রম। এ নাম যা বিশেষ একটি উদ্দেশ্যের প্রতি সুসম্পর্ক ইঙ্গিত দান করে। এ নামের অর্থ হল পবিত্র স্থান।


মওলানা আব্দুর রহিম।
= ১৮ আগস্ট লাহােরে জামাতি ইসলামী কেন্দ্রীয় কার্যকরী কমিটির উদ্বোধনী ভাষণে বলেন—

“দলের (জামাতের একজন সদস্যও পূর্ব পাকিস্তানে বাংলাদেশ আন্দোলনের সাথে নিজেকে কোন ক্রমেই জড়িত করেনি। এর ফলে এটাই প্রমাণিত হয়েছে, সকল প্রকার তুচ্ছ মতবিরােধ বর্জিত আদর্শিক আন্দোলনের সাথেই জামাত জড়িত।
…….“ভারত দুষ্কৃতকারীদের সাহায্য করছে। তাই পাকিস্তানের উচিত কাল বিলম্ব না করে ভারত আক্রমণ করা এবং আসাম দখল করা।”

মওলানা আবদুর রহিম
| ১৯ আগষ্ট মওলানা রহিমের নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় মজলিশে শূরার প্রস্তাবে উল্লেখ করা হয়

“ভারতীয় যুদ্ধবাজ কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তানে অনুপ্রবেশকারী পাঠিয়ে লুটতরাজ, ধ্বংস সাধন, যােগাযােগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করা ও দেশে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটিয়ে বিশ্ব শান্তি চরম লংঘন এর দায়ে”—নিন্দা করা হয়।


| এ প্রস্তাবে আরাে উল্লেখ করা হয় পাকিস্তানের জনগণকে সংকটজনক পরিস্থিতির সম্পর্কে সচেতন হওয়ার এবং যুগে যুগে মুসলমানরা যে কুরবানীর নমুনা দেখিয়েছেন তা পুনরুজ্জীবিত করার আহ্বান জানান হয়। |
মওলানা আবদুর রহিম
২০ আগস্ট মওলানা রহিমের সভাপতিত্বে একটি অধিবেশন। এই অধিবেশনে বক্তৃতা করেন মওলানা মওদুদী, গােলাম আজম, আব্দুল খালেক এবং অন্যান্য আরাে কয়েকজন নেতা। উক্ত অধিবেশনের প্রস্তাবে বলা হয়-

“ভারতীয় যুদ্ধবাজ ও তাদের চোরদের যােগসাজসে পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ব্যক্তিদের দমন করার। কাজে সরকার যে সমস্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন, মজলিসে শূরা তার প্রতি পূর্ণ। সমর্থন জানাচ্ছে।”
মওলানা আবদুর রহিম।
২১ আগষ্ট ২১ তারিখের প্রস্তাবে সামরিক বিধানসমূহ কঠোরভাবে জারি করতে সরকারের আইন প্রয়ােগকারী সমস্ত এজেন্সিকে আহ্বান জানিয়ে বলা হয়—

“আইন ও শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকার ৬০ ও ৭৮ নং বিধি জারী করেন সন্দেহ।
কিন্তু প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষ উক্ত বিধিগুলাে কঠোরভাবে প্রয়ােগ করতে না পারায় সেগুলি ও অকার্যকরী হয়ে পড়েছে। পরিস্থিতির উন্নতির জন্য সরকার কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে তা জনগণকে তাদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে নিরাশ করবে এবং দেশের সংকট তাতে অব্যাহত থাকবে।

“[ ৬০ ও ৭৮ নং সামরিক বিধি ছিল গণহত্যার স্বপক্ষের আইন ]
মতিউর রহমান নিজামী
আজ ২৩ আগস্ট মওলানা মাদানী স্মরণে আলোচনা সভায় তিনি উল্লেখ করেন যে,



…. পাকিস্তানকে যারা বিচ্ছিন্ন করতে চায় তারা এদেশ থেকে ইসলামকেই উৎখাত করতে চায়।”


গােলাম আজম।
২৩ আগস্ট ইতিপূর্বে তিনি একটি বৈঠকে ভারতের বিরুদ্ধে জেহাদ এর জন্য সর্বাত্মক প্রস্তুতির আহ্বান জানান। স্বাধীনতা সংগ্রাম সম্পর্কে তিনি লাহােরে বলেন—

“পূর্ব পাকিস্তানে যা ঘটছে তা ভারত ও তার চরদের ষড়যন্ত্রেরই ফল। একমাত্র ইসলামের শক্তিই দেশের অখণ্ডতা রক্ষা করতে পারে।”
তিনি আরাে বলেন

…“যারা জামাত ইসলামীকে দেশপ্রেমিক সংস্থা নয় বলে আখ্যায়িত করেছে তারা হয় জানে না বা স্বীকার করার সাহস পায় না যে, ইসলামের আদর্শ তুলে ধরা। এবং বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিরােধিতা করার জন্যই কেবল পূর্ব পাকিস্তানে জামাতের বিপুল সংখ্যক কর্মী দুষ্কৃতকারীদের হাতে প্রাণ হারিয়েছে।”
গােলাম আজম
২৬ আগস্ট তিনি পেশােয়ারে এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন

-“পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহীদের মীর জাফরী ও ভারতের দূরভিসন্ধি হতে সশস্ত্র বাহিনী দেশকে রক্ষা করেছে। দুষ্কৃতকারী ও অনুপ্রবেশকারীদের ধ্বংস করার কাজে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ সেনাবাহিনীকে পূর্ণ সহযােগিতা করছে।”
আয়েনউদ্দিন
২৮ আগস্ট রাজশাহী কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটির এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। এই সভায় তিনি সভাপতিত্ব করেন। সভায় ঘােষণা করা হয়।

“শহীদ রাজাকারদের শােক সন্তপ্ত পরিবারবর্গকে খাস জমি অথবা দুষ্কৃতিকারীদের পরিত্যক্ত জমি থেকে দশ বিঘা করে জমি দেবার প্রস্তাব করা হয়। এছাড়া সাময়িক আর্থিক সঙ্কট উতরানাের জন্য। কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটি কর্তৃক রাজাকারদের শােক সন্তপ্ত পরিবারকে পাঁচশ টাকা ও এক বস্তা করে চাউল দেবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।”


গোলাম আজম।
২৯ আগস্ট করাচীতে তিনি সাংবাদিকদের সাথে আলাপকালে বলেন—

“পূর্ব পাকিস্তানী জনগণের মনে আস্থার ভাব সৃষ্টি করার জন্য আরাে পদক্ষেপ নেওয়া দরকার।”
করাচীতে উক্ত সফরের সময়ে লাহােরের সাপ্তাহিক জিন্দেগীতে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি প্রশ্ন করেছিলেন

“২৫ মার্চের পর পাকিস্তানী সেনাবাহিনী যে পদক্ষেপ গ্রহণ করে তাছিল এদেশের মাটি রক্ষার জন্য, এর আগেই অনুরূপ পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়ােজন ছিল না কি?‘আমি আশঙ্কা করছি, যেখানে সেনাবাহিনী এবং রাজাকার বাহিনী নেই, সেখানে অংশগ্রহণকারীদের (উপনির্বাচনে প্রার্থী) দুষ্কৃতকারীরা হত্যা করবে, তাদের বাড়ি-ঘর লুট করবে ও জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেবে। এ পরিস্থিতি থেকে উপকৃত হয়ে তারা আবার বলতে শুরু করেছে যে, তথাকথিত ‘বাংলাশে’ নাকি শিগগিরই একটি বাস্তব সত্যে পরিণত হবে।”


উক্ত সাক্ষাৎকারে জামাতের মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী তৎপরতা সম্বন্ধে প্রশ্ন করা হলে তিনি জানান

“বিচ্ছিন্নতাবাদীরা জামাতকে মনে করত পহেলা নম্বরের শত্রু। তারা তালিকা তৈরি করেছে এবং জামাতের লােকদের বেছে বেছে হত্যা করছে। তাদের বাড়ি-ঘর জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে এবং এখনও দিচ্ছে। এতদসত্ত্বেও জামাত কর্মীরা রাজাকারের দলে ভর্তি হয়ে দেশের প্রতিরক্ষায় বাধ্য, কারণ তারা জানে ‘বাংলাদেশে ইসলাম ও মুসলমানের কোন জায়গা হতে পারে না। জামাত কর্মীরা শহীদ হতে পারে কিন্তু পরিবর্তিত হতে পারে না। আপনি জেনে বিস্মিত হবেন শান্তি কমিটি সমূহে যােগদানকারী অন্যান্য দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বস্থানীয় লােকদেরই শুধু হত্যার লক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করা হয়। কিন্তু জামাতের সাধারণ কর্মীদেরও ক্ষমা করা হয় না। তিনি আরাে বলেন-“আমি চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, যশাের, কুষ্টিয়া প্রভৃতি স্থানে সফর করেছি। আল্লাহর অপার মহিমায় জামাত কর্মীদের মনোবল অটুট রয়েছে। দুষ্কৃতকারীদের তৎপরতাও অব্যাহত রয়েছে।”
মওলানা আবদুর রহিম
২ সেপ্টেম্বর করাচীতে তিনি বিভিন্ন বৈঠকে বাংলাদেশে জামাতিদের সম্পর্কে বিভিন্ন বক্তব্য রাখেন। করাচীর দৈনিক ‘জামায়ত’ পত্রিকায় ‘মওলানা রহিম’ শীর্ষক একটি উপসম্পাদকীয়তে উল্লেখ করা হয় যে-

“পাকিস্তান জামাতে ইসলামীর সহকারী আমির মওলানা আব্দুর রহিম বলেছেন, দুষ্কৃতকারী ও ধ্বংসাত্মক কাজে লিপ্ত ব্যক্তিদের গেরিলা যুদ্ধের মােকাবিলা করা সেনাবাহিনীর দ্বারা সম্ভব নয়। দুষ্কৃতকারী গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়ায় ও আস্তানা গড়ে কিন্তু সেনাবাহিনীর আগমন সংবাদ পেতেই পালিয়ে যায়। সেনাবাহিনী পৌঁছালে তাদের সামনে জনবসতি ছাড়া আর কিছুই থাকে না। সেনাবাহিনী প্রয়ােজনীয়তা অনুভব করেছেন যে, স্থানীয় অধিবাসীদের সহায়তা ছাড়া দুষ্কৃতকারীদের মােকাবিলা করা সম্ভব নয়। এই কারণেই রাজাকার ও মুজাহিদ বাহিনী গঠনের প্রতি মনােনিবেশ করা হয়েছে। এই কারণেই অধ্যাপক গােলাম আজম তার বিগত পশ্চিম পাকিস্তান সফরকালে বার বার দাবি করেছিলেন যে, দেশ প্রেমিকদের সশস্ত্র করা হােক —অন্যথায় পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি ঘটবে। সুখের বিষয় সরকার এ সঠিক পরামর্শ গ্রহণ করে পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষায় দেশ প্রেমিকদেরও শামিল করেছেন।……..
“এ পর্যায়ে মওলানা আব্দুর রহিম আরাে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। দুষ্কৃতকারীদের নির্মূল করার দায়িত্ব যেন স্থানীয় জনগণের সাথে পরিচিত মুজাহিদ বাহিনীর হাতে দেয়া হয়। মওলানা আরও বলেছেন—পূর্ব। পাকিস্তানের পুরাতন কোন কোন পুলিশের উপর কোনক্রমেই নির্ভর করা যায় না, কেননা তারা বিভিন্ন স্থানে ধ্বংসাত্মক কাজে অংশগ্রহণ করেছে। রাজাকারদের নিরুৎসাহিত করে এদের রিপাের্টের উপর নির্ভর করা আত্মহত্যার শামিল। মওলানা পূর্ব পাকিস্তানের একশ্রেণীর পুলিশের ওপর অনাস্থা প্রকাশ করার সঙ্গে সঙ্গে এও বলেছেন–এখন পর্যন্ত সরকারী দফতরসমুহে একশ্রেণীর লােকের দ্বারা। ‘বাংলাদেশ প্রােপাগাণ্ডা অব্যাহত রয়েছে। | যতদিন পর্যন্ত এরা সরকারী দফতরসমূহে এরূপ করতে থাকবে ততদিন পাকিস্তানকে রক্ষা করার সরকারী প্রচেষ্টায় সফলতা লাভ অসম্ভব হয়ে পড়বে।”

ডঃ এ,এম মালেক
৩ সেপ্টেম্বর এইদিনে পূর্ব পাকিস্তানের নতুন গভর্নর ডঃ এ এম মালেককে প্রধান বিচারপতি বি এ সিদ্দিকী শপথ গ্রহণ করান। শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের পর এক সংক্ষিপ্ত ভাষণে তিনি বলেন-

“আজকের এই দিনে পাকিস্তানের বিশেষ করে পাকিস্তানের সঙ্কটময় মুহূর্তে প্রদেশের প্রশাসনের গুরু দায়িত্ব গ্রহণ করেছি। এক মাত্র আল্লাহর অনুগ্রহে ও সকল বন্ধু বান্ধবদের সহযােগিতায় এই দায়িত্ব পালনের জন্য আমি চেষ্টা করবো।


গােলাম আজম।
| ৮ সেপ্টেম্বর মতিউর রহমান নিজামী। পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা দিবসে কার্জন হলের সভায় বলেন,

“পাকিস্তানী সৈন্যদের যদি সামরিক ট্রেনিং এর সাথে সাথে সঠিকভাবে আদর্শিক ট্রেনিং দেওয়া হতাে তবে তাদের কিছু অংশ পাকিস্তানের অস্ত্র দিয়ে পাকিস্তানকে ধ্বংস করার জন্য মাথা তুলে দাড়াতাে না।”
পাকিস্তান দিবসে মতিউর রহমান নিজামী বলেন,

“ইসলামী ছাত্র সংঘের প্রতিটি কর্মী দেশের প্রতি ইঞ্চি ভূমি রক্ষা করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা। এমন কি তা পাকিস্তানের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য হিন্দুস্তানের মূল ভূখণ্ডে আঘাত হানতেও প্রস্তুত।”
গােলামআজম
৮ সেপ্টেম্বর ইয়াহিয়া খান ঘােষণা দিলেন ৪ মাসের মধ্যে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন। এ প্রসঙ্গে মন্তব্য করতে যেয়ে তিনি দৈনিক সংগ্রামের সাথে এক সাক্ষাৎকারে বলেন-

“অক্টোবরের শেষে বন্যার পানি চলে যাবার পরপরই গ্রামাঞ্চলে ব্যাপকভাবে দুষ্কৃতকারীদের দমন করার কাজ শুরু হবে। তাদেরকে পরিপূর্ণভাবে নির্মূল করার পরই নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব। দুষ্কৃতকারী সম্পূর্ণভাবে নির্মূল না হলে নির্বাচন অনুষ্ঠান অসুবিধা বোধ কি। কারণ দুষ্কৃতকারীদের সম্পূর্ণভাবে নির্মূল না করা পর্যন্ত জনগণ নিরাপদ বধ করবে না এবং প্রার্থীদেরও নিরাপত্তা সম্ভব নয়।”
গােলাম আজম।
| ১১ সেপ্টেম্বর | মােহাম্মদ আলী জিন্নাহর মৃত্যু বার্ষিকী উপলক্ষ্যে কার্জন হলে ইসলামী ছাত্র সংঘের স্মৃতি প্রদর্শনীতে ইসলামী ছাত্র সংঘের অভিনন্দন জানিয়ে তিনি বলেন

“পাকিস্তান আন্দোলনের সময়ের মত আজকে আবার পাকিস্তানকে রক্ষা করার জন্য নতুন বাহিনীর প্রয়ােজন। ইসলামী ছাত্র সংঘের কর্মী বাহিনীই কায়েদে আজমের মহাদান পাকিস্তানকে চিরস্থায়ী করতে সক্ষম হবে।”
| দৈনিক সংগ্রামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনের অংশ। মুক্তিযুদ্ধের সময় এই পত্রিকাটির ভূমিকা কেমন ছিল এটি পড়লে তার অনেকখানি আঁচ করা যায়।

“আল বদর একটি নাম। একটি বিস্ময় ! আল বদর একটি প্রতিজ্ঞা। যেখানেই দুষ্কৃতকারী আল-বদর সেখানেই। ভারতীয় চর কিংবা দুষ্কৃতকারীদের কাছে আলবদর সাক্ষাৎ আইজরাইল।।
…….“সরল প্রাণ জনসাধারণের দুঃখ দুর্দশা ও দুর্ভাবনার চরম মুহুর্তে আল বদর বিশেষ আশ্বাস ও নিশ্চয়তা নিয়ে তাদের পাশে গিয়ে দাড়ায়। পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষা ও ইসলামের হেফাজতে আল বদর যুদ্ধের বলিষ্ঠ ভূমিকায় ভারতীয় চর অনুপ্রবেশকারী ও দুষ্কৃতকারীদের সমূলে উৎখাত করে জনজীবনে শান্তি স্বস্তি ও নিরাপত্তার কার্যকরী ও ন্যায়ানুগ পদক্ষেপ জনসাধারণকে শুধু মুখেই করেনি, বরং তাদেরকে চিরকৃতজ্ঞতা পাশে আবদ্ধ করেছে। জনজীবনে আল বদর তাই সত্য, ন্যায় ও শান্তির প্রতীক।



মতিউর রহমান নিজামী।
১৫ সেপ্টেম্বর | যশােরে রাজাকারদের সদর দফতরে সমবেত রাজাকারদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, _

“আমাদের প্রত্যেককে একটি ইসলামী রাষ্ট্রের মুসলমান সৈনিক হিসেবে পরিচিত। হওয়া উচিত এবং মজলুম কে আমাদের প্রতি আস্থা রাখার মত ব্যবহার করে। তাদের সহযােগিতার মাধ্যমে ঐ সকল ব্যক্তিকে খতম করতে হবে। যারা সশস্ত্র অবস্থায় পাকিস্তান ও ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত রয়েছে।”
মতিউর রহমান নিজামী।
১৫ সেপ্টেম্বর ফরিদপুর ছাত্র সংঘের সমাবেশে ১৫ সেপ্টেম্বর তিনি বলেন-

“ ব্রাহ্মণ্য সাম্রাজ্যবাদের দালালরা হিন্দুস্তান অন্তর্ভুক্তির আন্দোলন শুরু করেছিল। পাকিস্তানকে যারা আজিমপুরের গােরস্তান বলে আখ্যায়িত করেছিল, তাদের স্থান আজ পাক মাটিতে না হয়ে আগরতলা কিংবা কোলকাতার শ্মশানে হয়েছে।”
আলী আহসান মুহম্মদ মুজাহিদ
১৫ সেপ্টেম্বর ফরিদপুরের একই সমাবেশে তিনি বলেন।



“ঘৃণ্য শত্রু ভারতকে দখল করার প্রাথমিক পর্যায়ে আমাদেরকে আসাম দখল করতে হবে। এ জন্য আপনারা সশস্ত্র প্রস্তুতি গ্রহণ করুন।”
মতিউর রহমান নিজামী
১৬ সেপ্টেম্বর | ‘স্বাধীনতার নাম দিয়ে ব্রাহ্মণ্য সাম্রাজ্যবাদের দালালরা হিন্দুস্তান অন্তর্ভুক্তির আন্দোলন শুরু করেছিল। গােলাম আজম রাজাকারদের উদ্দেশ্যে এক ভাষণে তিনি বলেন,

“যারা পাকিস্তান ও ইসলামের দুশমন, যারা আমাদের উপর আঘাত হানে, যারা হাজার হাজার আলেমকে শহীদ করেছে। এমনকি নবীর বংশধরদের রক্তে এদেশের মাটি রঞ্জিত করেছে তাদের বিরুদ্ধে আমাদের সংগ্রাম।”


গােলাম আজম
১৭ সেপ্টেম্বর ঢাকার মােহাম্মদপুর ফিজিক্যাল ট্রেনিং কলেজ ছিল আলবদরদের হেডকোয়ার্টার। এবং রাজাকার বাহিনীর প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। প্রশিক্ষণরত রাজাকার আলবদরদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন

-“ইসলাম ও পাকিস্তানের দুশমনের আলেম, ওলেমা মাদ্রাসার ছাত্র ও ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদেরকে ব্যাপকভাবে হত্যা করে এ কথাই প্রমাণ করেছে যে, এসব লােককে খতম করলেই পাকিস্তানকে ধ্বংস করা যাবে। আলেম ও দ্বীনদারদের উপর এই হামলা আল্লাহরই রহমত, কারণ এই ৪৪
হামলা না হলে তারা আত্মরক্ষা ও পাকিস্তানের হেফাজতের জন্য রাজাকার, আলবদর, আল শামস মুজাহিদ ও পুলিশ বাহিনীতে ভর্তি হবার প্রয়ােজন বােধ করত না।



তার বক্তৃতার অন্যান্য কিছু অংশ

“রাজাকার বাহিনী কোন দলের নয়, তারা পাকিস্তানে বিশ্বাসী সকল দলের সম্পদ। কোন দলের লােক কম বা কোন দলের বেশি লােক রাজাকার বাহিনীতে থাকতে পারে, কিন্তু তােমরা দল মতের উর্ধ্বে উঠে পাকিস্তানে বিশ্বাসী সকল দলকে আপন মনে করবে। ইসলামী দল সমূহের মধ্যে যে ঐক্য সৃষ্টি হয়েছে তাও আল্লাহরই রহমত।
| বিচ্ছিন্নতাবাদীরা জামাতে ইসলামী ও নেজামী ইসলামীর মধ্যে কোন পার্থক্য দেখেনি, বরং তারা ঢালাওভাবে আলেম ও ইসলামী দলের লােকদের খতম করেছে। সুতরাং আমরা নিজেরা চেষ্টা না করে এক না হলেও দুশমনরা সমানভাবে আঘাত হেনে আমাদের এক হতে বাধ্য করেছে। এর পরও যদি কেউ বিভিন্নতা সৃষ্টির পূর্বের অভ্যাস ত্যাগ না করে তবে আল্লাহ স্বয়ং তাদের মেরামত করবেন, তােমরা তাদের প্রতি বিদ্বেষভাব পােষণ করাে না।”



মুক্তি পাগল বাঙালিদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন

“বাইরের শক্রর চেয়ে ঘরের শত্রু বেশি ক্ষতিকারক। আমাদের ঘরেই এখন অসংখ্য শত্রু তৈরি হয়েছে। এই সৃষ্টির কারণ যাই হােক সে দিকে এখন নজর দেওয়ার সুযােগ নেই। এখন ঘরে আগুন লেগেছে, কাজেই আগুন নেভানােই তােমাদের প্রথম দায়িত্ব। এ ব্যাপারে সেনাবাহিনী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে এবং রাজাকাররাও তাদের পেছড়ে এগিয়ে এসেছে।”


রাজাকারদের উৎসাহিত করার জন্য বলেন—

“বিপদের মধ্যেও তােমাদের দৃঢ় শপথে অবিচল থাকতে হবে—তবেই আল্লাহর কাছে সত্যিকারের মুজাহিদদের মর্যাদা লাভ করবে।”
| তিনি আরাে বলেন
-“তােমরা অভ্যন্তরীণ দুশমনদের দমন করার কাজে যত তাড়াতাড়ি এগিয়ে আসতে পারবে, তত তাড়াতাড়ি সেনাবাহিনী দেশকে শত্রু মুক্ত করার কাজে ফিরে যেতে পারবে।”

গােলাম আজম
১৮ সেপ্টেম্বর গভর্নর মালেক মন্ত্রী সভার সদস্যদের অভিনন্দন জানিয়ে তিনি বলেন

“সশস্ত্র বাহিনীর অভিযানের পর থেকেই কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় শান্তি কমিটি গুলিতে স্বাভাবিকতা ফিরিয়ে আনতে অক্লান্ত পরিশ্রম করছে। শান্তি কমিটি এতদিন ও
ব্যাপারে যা করতে পেরেছে, মন্ত্রিগণ তার চেয়েও অধিক কাজ করতে পারে বলে আমি আশা করি।”

এ এস এম সােলায়মান।
১৯ সেপ্টেম্বর মালেক মন্ত্রী সভার সদস্য হবার পর তিনি বলেন


“যারা পাকিস্তানকে ধ্বংস করতে চেয়েছিল তাদেরকেই সমূলে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে।”

এ এস এম সােলায়মান।
( ২০ সেপ্টেম্বর এই দিনে দৈনিক পাকিস্তানের খবরে বলা হয়

“সাড়ে সাত কোটি মানুষের ত্যাগ স্বীকারের ফলশ্রুতি হল পাকিস্তান। তাই বিশ্বের কোন জাতিই পাকিস্তানকে ভাঙতে পারবে না।…প্রথমেই আমরা মুসলমান, তারপর বাঙালি, পাঞ্জাবী, সিন্ধু ও পাঠান।”
মতিউর রহমান নিজামী।
২২ সেপ্টেম্বর এইদিনে তিনি মহসিন হল পরিদর্শনে গিয়ে বলেন, |

“পাকিস্তান, ধ্বংসের গহ্বরে নিক্ষিপ্ত হয়েছিল কিন্তু আল্লাহর অসীম রহমতের ফলে পাকিস্তান বেঁচে গেছে।—পাকিস্তানের এই ধ্বংসের গহ্বরে নিক্ষিপ্ত হবার জন্য এক শ্রেণীর ছাত্রও দায়ী।
আব্বাস আলী খান
| ২২ সেপ্টেম্বর মালেক মন্ত্রী সভার জামাতি সদস্যদের দেওয়া আলিয মাদ্রাসার সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তিনি বলেন–

“আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা এমন হবে যা বিজ্ঞানী, দার্শনিক ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার, অর্থনীতিবিদ, ও একই সাথে খাটি মুসলমান হিসেবে তৈরি করবে, এর অন্যথা আমরা মেনে নেব না।
মতিউর রহমান নিজামী।
২৩ সেপ্টেম্বর | আল-বদর ক্যাম্প ঢাকা আলিয মাদ্রাসায় ছাত্র সংঘ আয়ােজিত এক চা চক্রে তিনি বলেন

“সশস্ত্র ভারতীয় অনুপ্রবেশকারী ও তাদের এদেশীয় দালালরা যে সন্ত্রাসবাদী তৎপরতা চালাচ্ছে একমাত্র পূর্ব পাকিস্তানের দেশপ্রেমিক যুবকরাই তাদেরকে কার্যকরীভাবে মােকাবিলা করতে সক্ষম। যারা ইসলাম ভালবাসে শুধুমাত্র তারাই পাকিস্তানকে ভালবাসে। এই বারের উৎঘাটিত এই সত্যটি যাতে আমাদের রাজনৈতিক বুদ্ধিজীবীরা ভুলে যেতে না পারে সেজন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাতে


২৩ সেপ্টেম্বর
আব্বাস আলী খান। আলিয মাদ্রাসার ছাত্র শিক্ষকের সংবর্ধনার জবাবে তিনি বলেন,

“ধর্ম নিরপেক্ষ ও আদর্শহীন শিক্ষানীতিকে না পাল্টানাে হলে যুব সমাজকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করা যাবে না।”
আব্বাসআলী খান ।
| ২৪ সেপ্টেম্বর তেজগাঁও থানা শান্তি কমিটি প্রদত্ত সংবর্ধনা সভায় থানা শান্তি কমিটি প্রধান মাহাবুবুর রহমান গুরহা পঠিত মানপত্রের জবাবে তিনি বলেন—

“বাঙালি জাতীয়তাবাদের শ্লোগানে বাঙালিদের কি ফায়দা হয়েছে। পাকিস্তানকে অস্ত্রবলএ ধ্বংস করার সকল চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে ভারত এর আদর্শিক মূলে আঘাত হেনেছে। তাদের ঘৃণ্য চোরদের মধ্যে আঞ্চলিক ও ভাষাভিত্তিক জাতীয়তার শ্লোগান তুলেছে। এই সংকট মুহূর্তে প্রত্যেকটি পাকিস্তানী নাগরিককে পাকিস্তানী ও মুসলমান হিসেবে চিন্তা করতে হবে।”
| বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের উদ্দেশ্যে তিনি আরাে বলেন

“সামাজিক অর্থনৈতিক ও আবাসিক পুনর্বাসনের যেমন প্রয়ােজন রয়েছে তেমনি আজ প্রয়ােজন মানসিক পুনর্বাসনের।” । |
গােলাম আজম
২৫ সেপ্টেম্বর ঢাকায় হােটেল এম্পায়ারে ঢাকা শহর জামাতের দেয়া এক সংবর্ধনা সভায় বলেন-

“দেশের সাম্প্রতিক সংকট ও দুষ্কৃতকারীদের ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপের ফলে যে সব পাকিস্তানী প্রাণ হারিয়েছেন তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি লােকই জামাতে ইসলামীর সাথে জড়িত। জামাতে ইসলামী পাকিস্তান ও ইসলামকে এক ও অভিন্ন মনে করে। পাকিস্তান সারা বিশ্ব মুসলিমের ঘর। কাজেই পাকিস্তান যদি না থাকে, তাহলে জামাত কর্মীরা দুনিয়ায় বেঁচে থাকার কোন স্বার্থকতা মনে করে না। তাই জামাতের কর্মীরা জীবন বিপন্ন করে পাকিস্তানের অস্তিত্ব ও অখণ্ডতা রক্ষার কাজ করে যাচ্ছে। শান্তি কমিটির মাধ্যমে, রাজাকার ও আলবদরের লােক পাঠিয়ে এবং অন্যান্য উপায়ে জনসাধারণের মধ্যে আস্থা ও নিরাপত্তাবোধ সৃষ্টির কাজ করে। যাচ্ছে এবং একই উদ্দেশ্যে দু’জন সিনিয়র নেতাকে মন্ত্রিত্ব গ্রহণে বাধ্য করেছে। এই মন্ত্রিরা যেন জনগণের মনে আস্থা ফিরিয়ে আনতে সব কিছু করেন।”
আব্বাস আলী খান।
২৫ সেপ্টেম্বর গােলাম আজমের ২৫ সেপ্টেম্বরের বক্তব্যকে সমর্থন করে দলীয় প্রধানের নির্দেশ মেনে চলার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তিনি বলেন—

“প্রতি কারবালার পরই ইসলাম জীবন্ত হয়ে ওঠে। আমাদের সামনে আরও কারবালা আছে। তার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। এই অগ্নি পরীক্ষায় দমে না গিয়ে নতুন করে উদ্দীপনা নিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে শান্তি ও স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে কাজ করতে হবে।”


মওলানা মান্নান
২৭ সেপ্টেম্বর মাদ্রাসা শিক্ষক সমিতি এইদিনে তার নেতৃত্বে মাদ্রাসা শিক্ষকদের একটি প্রতিনিধিদল লেঃ জেঃ এ এ কে নিয়াজির সঙ্গে সাক্ষাৎ করে। নিয়াজীকে এক কপি। কোরান শরীফ উপহার দিয়ে তিনি বলেন

“পাকিস্তানের নিরাপত্তা ও ইসলামের গৌরব বৃদ্ধির জন্য আমরা সেনাবাহিনীকে সহযােগিতা করতে প্রস্তুত।”
এর উত্তরে নিয়াজী বলেন—“ওলামা, মাদ্রাসা শিক্ষক এবং অপরাপর দেশপ্রেমিক নাগরিকরা যােগাযােগ মাধ্যমগুলাে রক্ষা এবং রাষ্ট্র বিরােধীদের নির্মূল করতে পারে।”

আব্বাস আলী খান
| ১ অক্টোবর ডঃ মালেক মন্ত্রিসভার সদস্য পদ পাবার পর তিনি বলেন ,

“বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থাই আমাদের সকল ক্ষতির কারণ। বর্তমানের ধর্ম নিরপেক্ষ ও অর্থহীন শিক্ষা ব্যবস্থার পরিবর্তন সাধন না করা হলে আমরা কিছুতেই আমাদের ধ্বংসকে রােধ করতে পারব না।”
আখতারউদ্দীনআহমদ।
২ অক্টোবর ডঃ মালেক মন্ত্রিসভার বাণিজ্য ও শিল্প এবং আইনমন্ত্রী হিসেবে তিনি শপথ গ্রহণ করেন। মন্ত্রিত্ব প্রাপ্তির পর তিনি বলেন—“

আল্লাহ না করুক, পাকিস্তান যদি ধ্বংস হয়ে যায় তা হলে মুসলমানরা তাদের আলাদা বৈশিষ্ট হারিয়ে ফেলবে এবং হিন্দুদের দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়ে পড়বে।”


ওবায়দুল্লাহমজুমদার।
২ অক্টোবর মালেক মন্ত্রিসভার তথ্য মন্ত্রিত্ব পাবার পর বলেন

“আমি সব সময়ই পাকিস্তানী ছিলাম, সর্বদাই পাকিস্তানী এবং কখনােই পাকিস্তানী বিরােধী নই। তবে গােলযােগের সময় সৃষ্ট পরিস্থিতিতে তথায় (ভারতে) আশ্রয় গ্রহণে বাধ্য হই। তবে তথায় থাকাকালে সব সময়ই আমি সীমান্ত অতিক্রমের সুযােগ খুঁজছিলাম এবং ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর তথা অপরাপর ভারতীয়। কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি এড়িয়ে পলায়নের প্রথম সুযােগই আমি গ্রহণ করি।”
গােলাম আজম
২ অক্টোবর ঢাকায় প্রাদেশিক জামাতে মজলিশে শুরার বৈঠক উদ্বোধনের সময় তিনি বলেন



“খােদা না খাস্তা, পাকিস্তানকে রক্ষা করতে আমরা যদি ব্যর্থ হই তবে আমরা আমাদের নিজেদেরকে এবং আমাদের আদর্শকেও রক্ষা করতে পারব না। দেশের প্রতিরক্ষায় জামাত কর্মী ও সমর্থকদের অংশগ্রহণের পেছনে এই বিশ্বাসই চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করছে। এ কারণেই দেশের শত্রুরা জামাত কর্মীদের তাদের শিকারে পরিণত করেছে। কারণ তারা উপলব্ধি করেছে, জামাত কর্মীরাই তাদের পথের সবচেয়ে বড় বাধা এবং এসব জামাত কর্মীকে খতম করা ব্যতীত তাদের (দুশমন দের) হীন উদ্দেশ্য বাস্তবায়িত করা সম্ভব হবে না।”
আব্বাস আলী খান।
| ১০ অক্টোবর বগুড়া জেলা শান্তি কমিটি এবং জামাতে ইসলামীর দেয়া এক সংবর্ধনা সভায় তিনি বলেন

“পাকিস্তানের মাটি থেকে দুষ্কৃতকারী ও ভারতীয় চোরদের সম্পূর্ণভাবে উৎখাতের কাজে সহযােগিতা করার জন্য। সমবেত রাজাকারদের আহবান জানান।
এ কে এম ইউসুফ
১০ অক্টোবর খুলনায় একটি জনসভায় ভাষণদান কালে শান্তি কমিটির সদস্য এবং রাজাকারদের প্রশংসা করে বলেন

“প্রত্যন্ত অঞ্চলে সফর করে জনগণকে ভারত কর্তৃক সৃষ্ট তথাকথিত ‘বাংলাদেশের অসারতা বােঝাতে হবে। বিচ্ছিন্নতাবাদী, দুষ্কৃতকারী এবং নকশালীরা দেশের অংশে বিপর্যয় সৃষ্টিতে তৎপর রয়েছে। আপনাদের তাদেরকে সমূলে উৎখাত করতে হবে।”


আব্বাস আলী খান।
০ ১১ অক্টোবর ঢাকা বেতার কেন্দ্র থেকে ছাত্রদের উদ্দেশ্যে এক ভাষণে তিনি বলেন|

“ পাঠ্যাভাসের সাথে সাথে তােমাদের এ চেতনাটি সদা জগ্রত রাখতে হবে যে, যে কোন অবস্থায় তােমরা পূর্বসুরী ছাত্রদের আমানত এ পাকিস্তানের হেফাজত করবে। এবং কিছুতেই তার খেয়ানত হতে দেবে না।”
এ কে এম ইউসুফ
| ১২ অক্টোবর খুলনায় শান্তি কমিটি ও চাষী কল্যাণ সমিতির সংবর্ধনা সভায় বলেন-

“নদী পথে চলাচল নির্বিঘ্ন করার জন্য রাজাকার নিয়ােগের বিষয়টি মন্ত্রণালয়ের বিবেচনাধীন আছে।”—তিনি পবিত্র কোরান শরীফের আয়াত উদ্ধৃতি করে আরাে বলেন-“যারা মানুষের শান্তি ব্যাঘাত ঘটায় আল্লাহ তাদের শাস্তির ব্যবস্থা করে রেখেছেন।”
আউংশু
১৩ অক্টোবর দৈনিক পাকিস্তানের একটি খবরে বলা হয়—



“পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যালঘু বিষয়ক মন্ত্রী মিঃ আউংশু প্রু গতকাল শুক্রবার প্রদেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লােকদের নির্যাতন ও হয়রানি সংক্রান্ত ভারতীয় অভিযােগ খণ্ডন করেন।… প্রেসিডেন্ট ও গভর্নর সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লােকদের
বারবার পুরােপুরি রক্ষার আশ্বাস এবং সমান অধিকার ও সুযােগ সুবিধা দানের নিশ্চয়তা দিয়েছে।”

গােলাম আজম।
১৬ অক্টোবর স্থান বায়তুল মোকাররম। জামাতে ইসলামীর জনসভা। জনসভায় তিনি বলেন



“জামাতে ইসলামী গােটাদেশে স্বাভাবিকতা ফিরিয়ে আনার জন্য নিরলসভাবে শান্তি কমিটির মাধ্যমে কাজ করে যাচ্ছে।”
এ কে এম ইউসুফ
| ১৮ অক্টোবর মালেক মন্ত্রী সভার সদস্য (রাজস্ব মন্ত্রী) হিসেবে তিনি বলেন-

“দেশের সার্বভৌমত্বের ওপর হামলার যে কোন অপচেষ্টা নস্যাৎ করে দেওয়ার জন্য সেনাবাহিনী ও রাজাকারদের পেছনে আমাদের সাহসী জনগণ ঐক্যবদ্ধ থাকবেন।”
আবুল কাসেম।

| ২০ অক্টোবর মালেক মন্ত্রিসভায় অর্থমন্ত্রী হবার পর তিনি বলেন
-“জাতীয় জীবনের চরম সন্ধিক্ষণে প্রদেশে মন্ত্রিসভা গঠিত হয়েছে। এমন সংকটকালেও মন্ত্রিসভায় যােগদান করে যে দায়িত্ব বরণ করে নিয়েছি তা, অত্যন্ত গুরুতর ও অর্থবহ।… বহিঃশত্রুর। চক্রান্তে যখন দেশের স্বাধীনতা বিপন্ন, জনজীবন বিপর্যস্ত, প্রতিটি মানুষ দিশেহারা তখন শুধুমাত্র নীরব, নিষ্ক্রিয় দর্শকের ভূমিকা পালন করাকে জাতির প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করারই সামিল বলে গণ্য করেছি।”

জসীমউদ্দীন আহমেদ
২২ অক্টোবর মালেক মন্ত্রিসভায় তিনি আইন ও পার্লামেন্টারি মন্ত্রি হন। মন্ত্রী হবার পর তিনি বলেন



“জনগণ বেআইনী ঘােষিত আওয়ামী লীগের ৬-দফার পক্ষে পূর্ব পাকিস্তানের প্রকৃত অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ভােট দিয়েছেন। ভারতের সাহায্যে পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য নয়।”
আলী আহসান মুহম্মদ মুজাহিদ
| ২৫ অক্টোবর এইদিনে ইসলামী ছাত্র সংঘের সভাপতি এক বিবৃতিতে উল্লেখ করেন যে,

“আমরা আজ ইসলামী বিরােধী শক্তি এবং চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। এই পবিত্র দিবসে আমরা জাতির স্বার্থে এবং এদেশে ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য আত্মােৎসর্গের শপথ গ্রহণ করব।”
মওলানা ইউসুফ
২৬ অক্টোবর রাজাকার বাহিনীর প্রতিষ্ঠাতা। তিনি সিলেটে এক জনসভায় বলেন যে



“পাকিস্তান সৃষ্টির ইতিহাস সম্পর্কে অজ্ঞ আমাদের কিছুসংখ্যক তরুণ ভারতীয় মিথ্যা প্রচারণায় বিভ্রান্ত হয়ে সীমান্ত অতিক্রম করে ওপারে গিয়েছে এবং ভারতীয় চোরদের যােগসাজসে আমাদের ভু-খণ্ডের অভ্যন্তরে ঘৃণ্য নাশকতামূলক তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। এসব নাশকতামূলক কার্যকলাপ সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করে আমাদের ভূখণ্ড থেকে বাঙালি জাতীয়তাবাদকে উৎখাত করতে আপনারা গ্রামে-গঞ্জে আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে পড়ুন। তিনি মিত্র বাহিনীর উদ্দেশ্যে বলেন
“আমাদের ওপর যদি যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়া হয়, তবে বীর সেনাবাহিনী এবং বীর রাজাকাররা অবশ্যই তার পাল্টা আঘাত করবে।”

নওয়াজেশ আহমদ।
২৭ অক্টোবর। মালেক মন্ত্রী সভার খাদ্য ও কৃষি মন্ত্রী বলেন-এইদিন দৈনিক পাকিস্তানের একটি খবরে বলা হয়)।



“সরকার ইতিমধ্যেই প্রত্যাবর্তনকারীদের বাড়িঘরে ত্বরিত পুনর্বাসনের উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন।… তারা এখানে পুরাপুরি নিরাপদে থাকবেন। তিনি তাদের সীমান্তের ওপারের অসৎ উদ্দেশ্যে প্রণােদিত প্রচারণায় কর্ণপাত না করার উপদেশ দেন।


মুজিবুর রহমান
২৯ অক্টোবর। মালেক মন্ত্রিসভায় তথ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পাবার কয়েকদিন পর তিনি বলেন—

“পূর্ব। পাকিস্তানের তথ্যমন্ত্রী জনাব মুজিবুর রহমান বুদ্ধিজীবীদের বর্তমান পরিস্থিতির গুরুত্ব উপলব্ধি করে জনমত গঠন করে ভারতীয় হামলার মুখে মাতৃভূমিকে রক্ষার জন্য সেনাবাহিনীর পেছনে ঐক্যবদ্ধ হয়ে দাঁড়াবার আহবান জানিয়েছেন।”
ডঃ এ, এম মালেক
৩০ অক্টোবর লাহােরে এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন

“সেনাবাহিনীর ২৫শে মার্চের কার্যক্রমে পাকিস্তান রক্ষা পেয়েছে।”
আলী আহসান মুহম্মদ মুজাহিদ।
৭ নভেম্বর ৭ নভেম্বর ঢাকায় বদর দিবস পালিত হয়। এ উপলক্ষে বিকেলে বায়তুল মোকাররম প্রাঙ্গনে ঢাকা শহর ইসলামী ছাত্র সংঘের উদ্যোগে এক গণ জমায়েত অনুষ্ঠিত হয়। এই গণ জমায়েতে পূর্ব পাকিস্তান ইসলামী ছাত্র সংঘের সভাপতি। আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ বদর দিবস উপলক্ষে সংঘের পক্ষ থেকে ৪ দফা ঘােষণা করেন।


(১) “দুনিয়ার বুকে হিন্দু স্থানের কোন মানচিত্রে আমরা বিশ্বাস করি না। যতদিন পর্যন্ত দুনিয়ার বুক থেকে হিন্দু স্থানের নাম মুছে দেয়া না যাবে ততদিন পর্যন্ত আমরা বিশ্রাম নেব না।” ‘
(২) “আগামীকাল থেকে হিন্দু লেখকদের কোন বই অথবা হিন্দুদের দালালি করে লেখা কোন পুস্তকাদি লাইব্রেরিতে স্থান দিতে পারবেন না বা বিক্রি বা প্রচার করতে পারবেন না। যদি কেউ করেন তবে পাকিস্তানের অস্তিত্বে বিশ্বাসী স্বেচ্ছাসেবকেরা জ্বালিয়ে ভস্ম করে দেবে।”
(৩) “পাকিস্তানের অস্তিত্বে বিশ্বাসী স্বেচ্ছাসেবকদের সম্পর্কে বিরূপ প্রচার করা হচ্ছে। যারা এই প্রচার করছে তাদের সম্পর্কে হুঁশিয়ার থাকুন। |
(৪) বায়তুল মআএকআদ্দএসকএ উদ্ধারের সংগ্রাম চলবে। মুজাহিদ এই ঘােষণা বাস্তবায়িত করার জন্য ছাত্র, শিক্ষক, কৃষক শ্রমিক জনতার প্রতি আহবান জানিয়ে বলেন—“এই ঘােষণা বাস্তবায়িত করার জন্য শির উঁচু করে, বুকে কোরান নিয়ে মর্দে মােজাহিদের মত এগিয়ে চলুন। প্রয়ােজন হলে নয়াদিল্লী পর্যন্ত এগিয়ে গিয়ে আমরা বৃহত্তর পাকিস্তানের পতাকা উত্তোলন করব।”
| পূর্ব পাকিস্তান ইসলামী ছাত্র সংঘের সাধারণ সম্পাদক মীর কাশেম আলী তার বক্তৃতায় বলেন, আজকের বদর দিবসের শপথ হল



(১) ভারতের আক্রমণ রুখে দাঁড়াবাে।
(২) দুস্কৃতিকারীদের খতম করবাে।
(৩) ইসলামী সমাজ কায়েম করবাে।

উক্ত গণমায়েতের পর একটি মিছিল বের হয়। মিছিলটি নবাবপুর থেকে বাহাদুর শহ পার্কে পৌছে শেষ হয়। মিছিলের কয়েকটি শ্লোগান ছিল নিম্নরূপ :


(ক) আমাদের রক্তে পাকিস্তান টিকবে।
(খ) বীর মুজাহিদ অস্ত্র ধর, ভারতকে খতম কর।
(গ) মুজাহিদ এগিয়ে চল_কলিকাতা দখল কর।
(ঘ) বদর দিবস সফল হােক।
(ঙ) ভারতের চোরদের খতম কর। ইত্যাদি।


আবদুল খালেক।
৭ নভেম্বর এইদিনে পালন করা হয় আলবদর দিবস। নাখালপাড়ার আদর্শ শিক্ষায়তনে তেজগাঁও থানা জামাতে ইসলামী প্রধান মাহবুবুর রহমান গুহার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় জামাতের সেক্রেটারী জেনারেল বলেন—

“পাকিস্তানে অনৈসলামী মতবাদ ও জীবন ব্যবস্থা কায়েমের জন্য ইসলাম বিরােধী শক্তির সর্বতােমুখী
আন্দোলনকে ধ্বংস করে দিতে হবে। ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের কে তাদের জীবনকে বাতের শক্তির বিরুদ্ধে প্রতিবাদের মূর্তিমান প্রতীক হিসেবে কাজ করে যেতে হবে। এর জন্য আলবদর বাহিনীর মত পারস্পরিক মতভেদ ও অনৈক্য ভুলে মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ শক্তি হিসেবে দাঁড়াতে হবে।”

আব্বাস আলী খান
৮ নভেম্বর লাহােরে জামাতে ইসলামীর সংবর্ধনা সভায় তিনি বলেন



“ভারত যদি আমাদের ওপর যুদ্ধ চাপিয়ে দেয় তবে আমরা কোলকাতা ও দিল্লীতে ঈদের নামাজ পড়ব। পূর্ব পাকিস্তানের রাজাকার বাহিনী ও আল-বদর বাহিনী প্রমাণ করে দিয়েছে যে মুসলমান মৃত্যুকে ভয় করে না বরং আল্লাহকে ভয় করে।”


আয়েন উদ্দিন।
খ. ৮ নভেম্বর রাজশাহী আল-বদর প্রধানের সভাপতিত্বে স্থানীয় ভুবন মােহন পার্কে আলবদর বাহিনীর বেসামরিক বিভাগের উদ্যোগে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত সভার ভাষণে তিনি বলেন-

“বদরযুদ্ধের প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে পাকিস্তান বিরােধী চক্রান্তের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর আহবান জানান।
এ কে এম ইউসুফ
১২ নভেম্বর সাতক্ষীরার রাজাকার শিবির পরিদর্শনকালে রাজাকারদের প্রশংসা করে তিনি বলেন



“ভারতীয় চর ও অনুপ্রবেশকারীদের নির্মূল করার কাজে সাতক্ষীরার রাজাকাররা মূল্যবান ভূমিকা পালন করেছে।”
মতিউর রহমান নিজামী
১৪ নভেম্বর আলবদর সর্বাধিনায়ক দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকায় “বদর দিবস পাকিস্তান ও আলবদর” শীর্ষক একটি উপসম্পাদকীয়তে লেখেন—

“বিগত দু’বছর থেকে পাকিস্তানের একটি তরুণ কাফেলা ইসলামী পুনর্জাগরণ আন্দোলনের ছাত্র প্রতিষ্ঠান পাকিস্তান ইসলামী ছাত্রসংঘ এই ঐতিহাসিক বদর দিবস পালনের সূচনা করেছে। যারা পাকিস্তানে বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনার সাথে এই দিবস উদ্যাপিত হওয়ার পেছনে এই তরুণ কাফেলার অবদান সবচেয়ে বেশি।… হিন্দু বাহিনীর সংখ্যা শক্তি আমাদের তুলনায় পাঁচ গুণ বেশি। তাছাড়া আধুনিক সমরাস্ত্রেও তারা পাকিস্তানের চেয়ে অধিক সুসজ্জিত। দুর্ভাগ্যবশত পাকিস্তানের কিছু মুনাফিক তাদের পক্ষ অবলম্বন করে ভেতর থেকে আমাদেরকে দুর্বল করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত
হয়েছে। তাদের মােকাবিলা করে তাদের সকল ষড়যন্ত্র বানচাল করেই পাকিস্তানের আদর্শ ও অস্তিত্ব রক্ষা করতে হবে শুধু পাকিস্তান রক্ষার আত্মরক্ষামূলক প্রচেষ্টা। চালিয়েই এ পাকিস্তানকে রক্ষা করা যাবে না।
….. বদরের যুদ্ধ থেকে অনেক কিছুই আমাদের শিখবার আছে। এই যুদ্ধের সৈনিকরা কেউ পেশাদার বা বেতনভুক সৈনিক ছিলেন না। মুসলমানরা সবাই ছিলেন সৈনিক। তারা সবাই ছিলেন স্বতঃস্ফুর্ত প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ, ঈমানের তাগিদেই তারা লড়তে প্রস্তুত হয়েছিলেন বিরাট শক্তির মােকাবিলায়। বৈষয়িক কোন স্বার্থই ছিল না তাদের সামনে। মরলে শহীদ বাচলে গাজী—এই ছিল তাদের বিশ্বাসের অঙ্গ। ঈমানের পরীক্ষায় তারা ছিলেন উত্তীর্ণ। সংখ্যার চেয়ে গুণের প্রাধান্য ছিল সেখানে লক্ষণীয়। পারস্পরিক দ্বন্দ্ব কলহের লেশমাত্র ছিল না তাদের মধ্যে। এক রসুলের নেতৃত্বে তারা সবাই ছিলেন সীসা ঢালা প্রাচীরের ন্যায় ঐক্যবদ্ধ। একমাত্র আল্লাহর সাহায্য ছিল তাদের সম্বল। আর আল্লাহর সন্তোষ ছিল তাদের কাম্য। আজকের কাফেরদের পর্যদস্ত করতে হলে আমাদেরও অনুরূপ গুণাবলীর সমাবেশ অবশ্যই ঘটাতে হবে। | আমাদের পরম সৌভাগ্যই বলতে হবে, পাকসেনার সহযােগিতায় এদেশের ইসলাম প্রিয় তরুণ ছাত্র সমাজ বদর যুদ্ধের স্মৃতিকে সামনে রেখে আল বদর বাহিনী গঠন করেছে। বদরযুদ্ধে মুসলিম যােদ্ধাদের সংখ্যা ছিল তিনশত তের জন। এই স্মৃতি অবলম্বন করে তারাও তিনশত তের জন যুবকের সমন্বয়ে এক একটি ইউনিট গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বদর যযাদ্ধাদের সেই সব গুণাবলীর কথা আমরা আলােচনা করেছি, আল বদরের তরুণ মর্দে মুজাহিদদের মধ্যে ইনশাআল্লাহ সেই সব গুণাবলী আমরা দেখতে পাব।
……. পাকিস্তানের আদর্শ ও অস্তিত্ব রক্ষার দৃঢ় সংকল্প নিয়ে গঠিত আলবদরের যুবকেরা এবারের বদর দিবসে নতুন করে শপথ নিয়েছে, যাতে তেজোদ্দীপ্ত কর্মীদের তৎপরতার ফলেই বদর দিবসের কর্মসূচি দেশবাসী তথা দুনিয়ার মুসলমানদের সামনে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছে। ইনশাআল্লাহ বদর যুদ্ধের বাস্তব স্মৃতিও তারা তুলে ধরতে সক্ষম হবে। আমাদের বিশ্বাস সেদিন যুবকেরা আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর পাশাপাশি দাড়িয়ে হিন্দু বাহিনীকে পর্যুদস্ত করে হিন্দুস্তানকে খতম করে সারা বিশ্বে ইসলামের বিজয় পতাকা উড্ডীন করবে।”

এ এস এম সােলায়মান
১৫ নভেম্বর কৃষক শ্রমিক পার্টির সভাপতি করাচিতে এই দিনে উল্লেখ করেন।



“রাজাকাররা অত্যন্ত প্রশংসামূলক কাজ করছে এবং তাদেরকে জাতীয় বীর বলা উচিত।”


মতিউর রহমান নিজামী
১৬ নভেম্বর তিনি দৈনিক সংগ্রামের একটি উপসম্পাদকীয়তে মন্তব্য করেন।

“খােদাবী বিধান বাস্তবায়নে সেই পবিত্র ভূমি পাকিস্তান আল্লাহর ঘর। আল্লাহর এই পূতপবিত্র ঘরে আঘাত হেনেছেন খােদাদ্রোহী কাপুরুষের দল। এবারের শবই-কদরে সামগ্রিকভাবে ইসলাম ও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পরিচালিত উল্লেখিত যাবতীয় হামলা প্রতিহত করে, সত্যিকারের শান্তি ও কল্যাণ প্রতিষ্ঠার এই তীব্র অনুভূতি আমাদের মনে সত্যিই জাগবে কি ?
আব্বাস আলী খান
|
১৬ নভেম্বর চাঁদপুর শান্তি কমিটির সভায় শান্তি কমিটি ও রাজাকারদের ভূয়সি প্রশংসা করে তিনি বলেন–



“পাকিস্তান চিরকাল অক্ষয় হয়ে টিকে থাকবেই। এর শক্রদের সমূলে চিরতরে ধ্বংস করা আপনাদের দায়িত্ব।” =
ডঃ এ, এম, মালেক
|
২৩ নভেম্বর। করাচীতে বিমান বন্দরে সাংবাদিকদের বলেন , “দুষ্কৃতকারীদের নাশকতামূলক তৎপরতা কার্যকরভাবে রােধ করার ব্যাপারে পূর্ব পাকিস্তানে রাজাকারদের ভূমিকার প্রশংসা করেন।…

রাজাকাররা চমৎকার কাজ করছে। তারা দেশপ্রেমিক দর জান-মাল রক্ষা করছে। এবং নিজেদের। জীবনের বিনিময়ে রাষ্ট্রবিরােধী ব্যক্তিদের নাশকতামূলক তৎপরতার বিরুদ্ধে প্রহরা দিচ্ছে।” |
গােলাম আজম
২৩ নভেম্বর। | ইয়াহিয়া খান ২৩ নভেম্বর সারাদেশে জরুরী অবস্থা ঘােষণা করেন। এই ঘােষণার পর তিনি লাহােরে বলেন—

“বর্তমান মুহুর্ত সর্বাধিক আক্রমণাত্মক ভূমিকা গ্রহণ করাই হবে দেশের জন্য আত্মরক্ষার সর্বোত্তম পন্থা।”
আব্বাসআলী খান।
| ২৫ নভেম্বর। পাকবাহিনী এবং এদেশীয় দালালদের পরাজয়ের প্রাঙ্গলে এক বিবৃতিতে তিনি বলেন



“এতে আর কোন সন্দেহ নাই যে, তথাকথিত মুক্তিবাহিনীর ছদ্মাবরণে পূর্ব পাকিস্তানকে গ্রাস করার হীন মতলবে ভারতীয় সেনাবাহিনী কয়েকটি ফ্রন্টে নির্লজ্জ হামলা শুরু করেছে। সশস্ত্র বাহিনী একাই কোন যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পারে না। প্রিয় পাকিস্তানের মর্যাদা রক্ষার জন্য আমাদের জওয়ানদের হাতকে শক্তিশালী করা এ অযে প্রতিটি নাগরিকের দায়িত্ব।”


|
২৬ নভেম্বর।
বুদ্ধিজীবী ও মুক্তিযােদ্ধাদের সম্পর্কে তিনি বলেন

“রাষ্ট্রবিরােধী ও ধ্বংসাত্মক কাজে লিপ্ত ব্যক্তিদের কার্যকলাপের ব্যাপারে সতর্ক থাকবে হবে। এদেরকে নির্মূল করার ব্যাপারে আপনারা সেনাবাহিনী ও শান্তি কমিটি সমূহকে সহায়তা করুন।”


ডঃ এ এম মালেক রাওয়ালপিন্ডিতে তিনি বলেন


“পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরুর পর কতিপয় বিদ্রোহী ও ভারতীয় চর ছাড়া পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ এখন বুঝতে পেরেছে যে স্বাধীন বাংলাদেশ আন্দোলনই একটি ভাঁওতা ।।
গােলাম আজম
২৭ নভেম্বর রাওয়ালপিন্ডিতে এক সমাবেশে বলেন



“কোন জাতি যুদ্ধকালে প্রতিশােধমূলক ব্যবস্থা ছাড়াই টিকতে পেরেছে, এমন কোন নজীর ইতিহাসে খুঁজে পাওয়া যাবে না। আত্মরক্ষা নয় আক্রমণই এখন। সর্বোত্তম পন্থা।”
এ কে এম ইউসুফ
২৮ নভেম্বর | করাচিতে সাংবাদিকদের সাথে আলাপকলে বলেন
“রাজাকাররা আমাদের বীর সেনাবাহিনীর সাথে কাধে কাধ মিলিয়ে ভারতীয় হামলার মােকাবিলা করছেন।”

“বর্তমানে আলবদর ও আলশামস বাহিনীর সংখ্যা প্রায় এক লাখে দাড়িয়েছে। এছাড়া মুজাহিদ বাহিনীওতাে রয়েছে। এরা সকলেই আমাদের সেনাবাহিনীর সহায়তায় সীমান্ত রক্ষার কাজে নিয়ােজিত রয়েছে। দুষ্কৃতকারী দমনে রাজাকাররা বিশেষ সাফল্যের পরিচয় দিচ্ছে এবং এজন্যেই বর্তমানে দুস্কৃতিকারীদের কার্যকলাপে ভাটা পড়েছে।”
কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটি
২৯ নভেম্বর কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটির একটি গণমিছিল এইদিনে ঢাকা শহর প্রদক্ষিণ করে। মিছিলের পুরোভাগে ছিলেন খাজা খয়েরুদ্দিন, ব্যারিস্টার আখতার উদ্দিন, গােলাম সারওয়ার, মওলানা আশরাফ আলী, মেজর আফসার উদ্দিন প্রমুখ নেতা। মিছিলের কিছু শ্লোগানের নমুনা।


পাকিস্তানের উৎস কি লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ,
হাতে লও মেশিন গান-দখল কর হিন্দুস্থান।
বীর মুজাহিদ অস্ত্র ধর আসাম বাংলা দখল কর।
পাক-ফৌজ অস্ত্র ধর—হিন্দুস্তান দখল করা
কুটনিবুড়ি-ইন্দিরা-হুঁশিয়ার,
হুঁশিয়ার অফিস আদালতের মীরজাফররা-হুঁশিয়ার হুঁশিয়ার। ইত্যাদি ছিল শ্লোগানের ভাষা।


মিছিলে বহন করা ইন্দিরাগান্ধী, জগজীবন রাম, শরণসিং, এদের প্রতিকৃতিগুলােকে জুতাপেটা করা হয়।
নভেম্বর। নরঘাতক আল-বদররা কিভাবে হত্যার হুমকি পাঠাতাে তার একটি বিশেষ নমুনাঃ
শয়তাননিমূলঅভিযান “শয়তান,
ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুদের যে সব পাচাটা কুকুর আর ভারতীয় ইন্দিরাবাদের দালাল নানা সুতানাতায় মুসলমানদের বৃহত্তম আবাসভূমি পাকিস্তানকে ধ্বংস করার ব্যর্থ চেষ্টা করছে তুমি তাদের অন্যতম। তােমার মনােভাব, চালচলন ও কাজকর্ম কোনটাই আমাদের অজানা নেই। অবিলম্বে হুঁশিয়ার হও এবং ভারতের পদলেহন। থেকে বিরত হও, না হয় তােমার নিস্তার নেই। এই চিঠি পাওয়ার সাথে সাথে। নির্মল হওয়ার জন্য প্রস্তুত হও।”
–শনি। (এ ধরনের চিঠিগুলো নভেম্বরের শেষের দিকে ঢাকার বুদ্ধিজীবীদের কাছে পাঠানো হত)
গােলাম আজম
১ ডিসেম্বর রাওয়ালপিন্ডিতে ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে লাহােরে ফিরে এসে তিনি বলেন



“পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ কখনও তাদের দাবির প্রতি মিসেস গান্ধীর সমর্থন চায়নি।”
গােলাম আজম
৩ ডিসেম্বর এইদিনে তিনি করাচীতে পৌছে বলেন

“পররাষ্ট্র দফতরের ভার কোন পূর্ব পাকিস্তানকে দিতে হবে, কারণ এ দফতরের ভারপ্রাপ্ত পূর্ব পাকিস্তানই তথাকথিত বাংলাদেশ তামাশা ভালভাবে মােকাবিলা করতে পারবে।


মওলানা ইউসুফ
এ ৪ ডিসেম্বর পাকিস্তানী বাহিনীর সাথে এদেশীয় দালালদের কি রকম সম্পর্ক ছিল কিছু বিবৃতি পড়লেই তা টের পাওয়া যায়। এই দিনে তিনি ঢাকায় বলেন—

“সশস্ত্র বাহিনীর সাথে জনগণের সক্রিয় সহযােগিতা অপরিহার্য। আমাদের রক্তের বিনিময়ে শেষ পর্যন্ত শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করে যেতে হবে।”


আলীআহসান মােহাম্মদ মুজাহিদ
৪ ডিসেম্বর এইদিনে শুরু হয় বুদ্ধিজীবী অপহরণের জন্য আলবদরদের নানা কর্মকাণ্ড। আলবদরা এ উপলক্ষে কয়েকটি পথসভাও করে। এ সমস্ত সভায় ছাত্র সংঘের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ বুদ্ধিজীবীদের হুঁশিয়ার করে দিয়ে বিভিন্ন বক্তব্য রাখেন এবং আল বদরদের প্রস্তুত থাকতে বলা হয়—যুক্ত বিবৃতিতে ছাত্র সংঘের সভাপতি আলী আহসান মােহাম্মদ মুজাহিদ এবং সাধারণ সম্পাদক মীর কাশেম বলেন…
হিন্দুস্তানকে হুঁশিয়ার করে দিতে চাই,
পাকিস্তানকে ধ্বংস করতে এসে হিন্দুস্তান নিজেই নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।…..
পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন রণাঙ্গনে সাম্রাজ্যবাদী হিন্দুস্তানের হামলাকে সাফল্যজনকভাবে প্রতিহত করার জন্য আমরা মহান আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করার সাথে সাথে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকেও জানাচ্ছি আন্তরিক অভিনন্দন।”


“পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের গতকালের বেতার ভাষণকে অভিনন্দন জানিয়ে আমরাও ঘােষণা করছি যে, এদেশের ছাত্র জনতা ৬৫ সালের মতন এবারও ইস্পাত কঠিন শপথ নিয়ে পাকিস্তান বাহিনীর সাথে সহযােগিতা করে যাবে।


আবাসআলী খান।
| ৬ ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবী হত্যা শুরু হওয়ার চারদিন আগে তিনি এক বেতার ভাষণে বলেন গত

“বদরের যুদ্ধে মুসলিম সৈন্য সংখ্যা ছিল মাত্র ৩১৩ জন। বিপক্ষ কুরাইশদের সংখ্যা ছিল ১ হাজার। … তের কোটি মানুষ এই পূণ্যভূমি রক্ষার জন্য প্রতি মুহূর্তে প্রস্তুত আছে।… গুজব রটনাকারী, বিশৃংখলা সৃষ্টিকারী, হিন্দুস্তান অথবা কল্পনা রাজ্যের তথাকথিত বাংলাদেশের স্বপক্ষে প্রচারণাকারীরা আমাদের দুশমন। তাদের প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রাখুন। প্রথম সুযােগেই তাদের বিষদাত ভেঙে দিন। আমাদের রাজাকার, বদর, শামস্ প্রভৃতি বাহিনীগুলাের সাথে কাধে কাধ মিলিয়ে দেশরক্ষার কাজে নেমে পড়ুন। …. আল্লাহতালা আমাদের মদত দান করুন। আমিন। আল্লাহ আকবর। পাকিস্তান পায়েদাবাদ।


এ কে এম ইউসুফ
৯ ডিসেম্বর ঢাকা শহর শান্তি কমিটি সদস্য এবং অন্যান্য কর্মচারীদের উদ্দেশ্যে তিনি ঘােষণা করেন| “

গুজব ও গুজব রটনাকারীদের কথায় বিশ্বাস না করে মাতৃভূমিকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে সকলকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহবান জানান। তিনি আরাে বলেন
“বর্তমানে আমাদের সকল বিভেদ ভুলে গিয়ে শত্রুকে বিধ্বংস করে দেবার জন্য এক কাতারে দাড়াতে হবে।”

ঢাকার জামাতে ইসলামের সম্পাদক।
১২ ডিসেম্বর ঢাকার জামাতে ইসলামীর সম্পাদক কর্তৃক প্রকাশিত একটি প্রচার পত্রে বলা হয়—

“বিদেশে আমাদের বন্ধুরা আছেন। চীন ও আমেরিকা আমাদের সমর্থক বন্ধু।”


সহায়ক গ্রন্থ : (১) একাত্তরের ঢাকা : সেলিনা হােসেন (২) নিয়াজীর আত্মসমপর্ণের দলিল : মূল সিদ্দিক সালিক অনুবাদ : মাসুদুল হক (৩) জামাতের আসল চেহারা : মওলানা আবদুল আউয়াল (৪) মুক্তিযুদ্ধে দৈনিক সংগ্রামের ভূমিকাঃ আলী আকবর টাবী ৫) একাত্তরের ঘাতক ও দালালরা কে কোথায় : মুক্তিযুদ্ধ চেতনা বিকাশ কেন্দ্র (৬) স্বাধীনতাযুদ্ধ : দলিলপত্র অষ্টমখণ্ড (৭) একাত্তরের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা।

Comments

Popular posts from this blog

ভাড়াটিয়া-ভাড়াদার আইনের জটিলতা পার হওয়া: ভাড়াটিয়াদের জন্য একটি গাইড

একটি ভিত্তিহীন গুজব উড়িয়ে দেওয়া: বাংলাদেশী সাংবাদিকদের ফ্রেঞ্চ ভিসা প্রত্যাখ্যান করা হয়নি৷

অধ্যায় 2: বাংলায় ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন