ঠান্ডা মাথার এক অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল রাষ্ট্রপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েমের কাছ থেকে ক্ষমতা হস্তগত করেন জিয়াউর রহমান। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ষড়যন্ত্রের জাল তিনি ছড়িয়েছিলেন ১৯৭১ সালেই। তার অতিরিক্ত রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষের কারণে বঙ্গবন্ধু তাকে সেনাপ্রধান করেননি। যে কারণে সুযোগ পেলেই তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করতেন।
এরপর ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করা হলে জিয়া তার সর্বগ্রাসী ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে প্রথমে সেনাপ্রধান, তারপর প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ও রাষ্ট্রপতি পদে আসীন হন।
‘বঙ্গভবনের শেষ দিনগুলি’ বইয়ে বিচারপতি সায়েম লিখেছেন, ‘১৯৭৬ সালের ২৯ নভেম্বর তিনি জিয়াউর রহমানের হাতে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের পদ ছেড়ে দেন। রাষ্ট্রপতির পদ ছেড়ে দেন কয়েক মাস পর ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল।’
ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ নিতে আইয়ুব খানকে অনুসরণ করেন জিয়াউর রহমান। ইস্কান্দার মির্জাকে আইয়ুব খান প্রেসিডেন্টের পদ থেকে সরিয়ে নিজেই পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের পদ গ্রহণ করেন। প্রথমে খন্দকার মোশতাক আহমেদকে ক্ষমতাচ্যুত করার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ৭ নভেম্বর ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসেন জিয়া।
সায়েম তার বইয়ে লিখেছেন, জিয়াউর রহমান যে সেনাপ্রধান থাকা অবস্থাতেই এবং সামরিক আইনের অধীনে প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের পদে বহাল থেকে প্রেসিডেন্ট পদের নির্বাচনে অংশ নেবেন, সে ধারণা তিনি করতে পারেননি।
একাত্তরেই শুরু জিয়ার ষড়যন্ত্র
জিয়াউর রহমানের ষড়যন্ত্রের বিষয়টি নজরে আসে ১৯৭১ সালেই। সাবেক বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক এক নিবন্ধে লিখেছেন, ১২-১৭ জুলাই কলকাতার ৮ নম্বর থিয়েটার রোডে মুজিবনগরভিত্তিক বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন সাহেবের নেতৃত্বে বাংলাদেশি ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তাদের সভা অনুষ্ঠিত হয়। কর্নেল ওসমানী সেই সভায় উপস্থিত ছিলেন না।
সভায় মেজর (সে সময়ের) জিয়া একটি ধ্বংসাত্মক প্রস্তাব সমর্থনে বক্তব্য দেন। প্রস্তাবে জিয়া মুজিবনগরভিত্তিক বাংলাদেশ সরকারের স্থলে একটি যুদ্ধকালীন কাউন্সিল গঠনের কথা বলেন। এই কূট চক্রান্তমূলক প্রস্তাব কর্নেল (সে সময়ে) ওসমানীর কাছে পেশ করা হলে তিনি রেগে উঠেছিলেন। তিনি মুজিবনগরভিত্তিক সরকারের প্রতিরক্ষামন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তফা দিয়েছিলেন, যদিও পরে সবার অনুরোধে তিনি আবার স্বপদে ফিরে আসেন।
তিনি আরও লিখেছেন, তার ক্রোধের কারণ ছিল তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন, জিয়া সমর্থিত ওই প্রস্তাবটি ছিল একটি ষড়যন্ত্রেরই অংশ, মুজিবনগরভিত্তিক সরকারকে হেয় করার জন্য। জিয়ার সমর্থিত ওই প্রস্তাবকে অনেক বোদ্ধাই তখন পাকিস্তান প্ররোচিত বলেই মনে করেছিলেন, কেননা পূর্ব বাংলার গণমানুষের ভোটে জয়ী গণপরিষদ সদস্যরাই ওই সরকার গঠন করে সারা বিশ্বের কাছে দাবি উপস্থাপন করতে পেরেছিলেন যে এটাই বাংলাদেশের গণমানুষের নির্বাচিত সরকার, আর এই সরকারকে হেয় প্রতিপন্ন করা গেলে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সমর্থন হারাবে এবং একইসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের গতি পাকিস্তানি পরিকল্পনামাফিক জিয়া-মোশতাকের মাধ্যমে প্রবাহিত হয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বপ্নকে ধুলিস্যাৎ করবে। তবে এসব সতর্কতার কারণে ওই প্রস্তাব বাস্তবায়িত হয়নি দেখেই মুক্তিযুদ্ধ রক্ষা পেয়েছিল।
“জিয়াসমর্থিত ওই প্রস্তাব এবং এর প্রতিক্রিয়ায় কর্নেল ওসমানীর পদত্যাগের কথা ভারতীয় ব্রিগেডিয়ার আর পি সিংয়ের গবেষণাধর্মী পুস্তক ‘ফ্রম ইস্ট পাকিস্তান টু বাংলাদেশ’-এ আলোচিত হয়েছে। ব্রিগেডিয়ার আর পি সিং ভারতীয় সেনাবাহিনীর হয়ে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদান রেখেছিলেন।”
উর্দি পরে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন
১৯৭৮ সালের ৩ জুনের নির্বাচনে রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন জিয়াউর রহমান। তিনি যখন এই নির্বাচন করেন, তখন তিনি সেনাপ্রধান। সে সময়ের পোস্টারেও সেনাবাহিনীর পোশাক পরা জিয়াউর রহমানকে দেখা যায়। অথচ সরকারি চাকরিতে থাকা অবস্থায় ভোটে দাঁড়ানো অবৈধ।
ওই নির্বাচনের আগে জিয়াউর রহমানের জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দলসহ (জাগদল) ছয়টি রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট গঠন করা হয়। মেজর জেনারেল পদে চাকরি করা জিয়াউর রহমানকে প্রার্থী করে এই জোট।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, ওই নির্বাচন ছিল একটি সাজানো নাটক। সে সময় নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়, কোনো কোনো কেন্দ্রে ১১০ শতাংশের বেশি ভোট পড়েছিল। জাল ভোট পড়েছে। এটিও উল্লেখ ছিল। জিয়াউর রহমানের ভূমিকা আগে থেকেই বিতর্কিত। প্রথমে তার ক্ষমতাকে অটুট রাখার জন্য হাস্যকর হ্যাঁ-না ভোটের আয়োজন করেন। এতে সব ভোটই তার পক্ষে পড়ল। তিনি আসলে সেনাপ্রধানের পদে থেকেই নির্বাচন করলেন, যা সরকারি চাকরিবিধি অনুসারে অবৈধ।’
বঙ্গবন্ধুর খুনিদের প্রতি কৃতজ্ঞতা
প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ও প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর বিভিন্নভাবে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে দেখা গেছে জিয়াউর রহমানকে। ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল জাতীয় পরিষদে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী বিল অনুমোদনের মাধ্যমে ১৫ আগস্ট নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর রাষ্ট্র ক্ষমতায় পরিবর্তন ও মুক্তিযুদ্ধের পথ থেকে বাংলাদেশকে সরিয়ে নিতে খুনিচক্র যা যা করেছিল, সবকিছুর বৈধতা দেন তিনি।
তাই খুনিরা দম্ভ করে বলছিল- তারাই ‘শেখ মুজিবকে সবংশে হত্যা করেছে।’ তারা এটাও বলত- জিয়াউর রহমান বরাবরই তাদের সঙ্গে ছিলেন।
ক্ষমতায় একচ্ছত্র আধিপত্য তৈরি করতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিতে দেখা গেছে জিয়াউর রহমানকে। ১৯৭৮ সালের ৩ জুন যখন রাষ্ট্রপতি নির্বাচন হয়, তখনও দেশে সামরিক আইন ছিল। আওয়ামী লীগের শত শত নেতাকর্মী তখন ছিলেন কারাগারে। ‘জয় বাংলা’ মুখে নেয়াও তখন অপরাধ বলে গণ্য করা হতো। ইঙ্গিতেও বলা যাবে না বঙ্গবন্ধুর নাম।
আর ১৫ আগস্ট থেকেই সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধ করে দেয়া হয়েছিল, যাতে পত্রিকাগুলোতে সঠিক খবর প্রকাশিত হতে না পারে। সরকারবিরোধী সভা, সমাবেশ কিংবা মিছিল-মিটিং করার অধিকারও ছিল না। সংবিধান থেকে বাদ দেয়া হয় ধর্মনিরপেক্ষতা। বর্জন করা হয় সমাজতন্ত্র।
১৯৭৭ সালের মে মাসের এক সরকারি আদেশে ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডে জড়িত মেজর ডালিম, মেজর শাহরিয়ার, মেজর রাশেদ চৌধুরী ও মেজর নূরকে সেনাবাহিনীর চাকরিতে ফিরিয়ে আনেন জিয়াউর রহমান। ফারুক ও রশিদ ছাড়া সবাইকে বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশ দূতাবাসে এবং মিশনে চাকরি দেন। সেনাবাহিনীতে নিজের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি বেসামরিক প্রশাসনের ওপরও গোয়েন্দা নজরদারি বাড়িয়ে দেন। কাজে লাগান সামরিক গোয়েন্দা বাহিনীকেও।
আটকে দেয়া হয় বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট নৃশংসভাবে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর বিচার বন্ধে একটি অধ্যাদেশ জারি করা হয়। তখনকার স্বঘোষিত রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমেদ এই অধ্যাদেশ জারি করেন।
পরে যখন জিয়াউর রহমান সামরিক শাসন জারি করেন, তখন সংবিধান সংশোধন করে খুনিদের রক্ষার পথটি স্থায়ী করতে চেয়েছিলেন।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার দেড় মাসের মধ্যে ২৬ সেপ্টেম্বর ‘দায়মুক্তি অধ্যাদেশ’ জারি হয়। ‘দি বাংলাদেশ গেজেট, পাবলিশড বাই অথরিটি’ লেখা অধ্যাদেশটিতে সই করেন খোন্দকার মোশতাক ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব এম এইচ রহমান।
অধ্যাদেশটির প্রথম অংশে বলা হয়, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরে বলবৎ আইনের পরিপন্থি যাই কিছুই ঘটুক না কেন, এ ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্টসহ কোনো আদালতে মামলা, অভিযোগ দায়ের বা কোনো আইনি প্রক্রিয়ায় যাওয়া যাবে না।
আর দ্বিতীয় অংশে বলা হয়, রাষ্ট্রপতি উল্লিখিত ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে যাদের প্রত্যয়ন করবেন, তাদের দায়মুক্তি দেয়া হলো। অর্থাৎ তাদের বিরুদ্ধে কোনো আদালতে মামলা, অভিযোগ দায়ের বা কোনো আইনি প্রক্রিয়ায় যাওয়া যাবে না।
অভিযোগ রয়েছে, এই অধ্যাদেশ জারির নেপথ্যে তখনকার সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানের হাত ছিল। অধ্যাদেশ জারির আগেই তিনি সেনাপ্রধান হিসেবে নিয়োগ পান। পরবর্তী সময়ে অভ্যুত্থান-পাল্টা অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল নিজেই রাষ্ট্রপতির পদে বসেন, তখন এ অধ্যাদেশটিকে আইনে পরিণত করেন। ১৯৭৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি দেশে দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে জিয়ার গড়া দল বিএনপি দুই-তৃতীয়াংশ আসনে জয়ী হয়।
রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ
১৯৭৭ সালের ১৩ অক্টোবর একটি নির্দেশ জারি করে ডেমোক্রেটিক লীগ, বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি ও জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলকে নিষিদ্ধ করে দেন জিয়া এই বলে যে, তারা ক্ষতিকর কাজে লিপ্ত হয়েছিল।
এর আগে বিদ্রোহের অভিযোগে ১ হাজার ১৪৩ সেনাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয়। তাদের বিচার হয় নামেমাত্র। অনেককে ফাঁসি দেয়ার পর বিচার হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
নিজের শাসন পাকাপোক্ত করতে আওয়ামী লীগসহ অন্য রাজনৈতিক দলের নেতাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আনা হয় ঢালাওভাবে। আগে থেকেই তাদের শায়েস্তা করার সুযোগ খুঁজছিলেন তিনি।
এভাবেই নানা ষড়যন্ত্রের মধ্য দিয়ে নিজের ক্ষমতাকে পরিপক্ক করেন জিয়াউর রহমান। একইসঙ্গে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের দেন পুরস্কার।
Comments