Skip to main content

Featured post

Bangladesh Declaration of Independence: Full Analysis with Photos (1971)

Bangladesh Declaration of Independence: Full Analysis with Photos (1971) The Juridical Birth and Enduring Resonance: An Exhaustive Analysis of the Declaration of Independence of Bangladesh By Afzal Hosen Mandal Published on: April 14, 2025 Table of Contents 1. Introduction: Situating the Declaration 2. Antecedents and Catalysts 3. The Declaratory Acts 4. Intrinsic Legal Character and Constitutional Ramifications 5. Implications for Public International Law 6. Symbolism, National Identity, and Collective Memory 7. Historical Controversies and Judicial Clarification 8. Contemporary Relevance and Unfinished Legacies ...

রসগোল্লা সৈয়দ মুজতবা আলী

রসগোল্লা-সৈয়দ মুজতবা আলী
ওই শব্দটি জানা থাকলে তড়িঘড়ি তার সন্ধান নিয়ে আর পাঁচজনের আগে সেখানে পৌঁছতে পারলে তাড়াতাড়ি নিষ্কৃতি পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। ওটাকে ফাঁকি দেবার চেষ্টা কস্মিনকালেও করবেন না। বরঞ্চ রহমত কাবুলিকে তার হক্কের কড়ি থেকে বঞ্চিত করলে করতেও পারেন কিন্তু তার দেশের ‘গুমরুক্’টিকে ফাঁকি দেবার চেষ্টা করবেন না। ‘কাবুলি-ওয়ালা ফিল্ম আমি দেখিনি। রহমতও বোধ করি সেটাতে তার গুমরুক্কে এড়াবার চেষ্টা করেনি।
কেন? ক্রমশ প্রকাশ্য।
ডাক্তার, উকিল, কসাই, ডাকাত, সম্পাদক (এবং সম্পাদকরা বলবেন, লেখক) এদের মধ্যে সক্কলের প্রথম কার জন্মগ্রহণ হয় সে কথা বলা শক্ত। যারই হোক, তিনি যে চুঙ্গিঘরের চেয়ে প্রাচীন নন সে-বিষয়ে আমার মনে কোনো সন্দেহ নেই। মানুষে মানুষে লেনদেন নিশ্চয়ই সৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয়েছিল এবং সেই মুহূর্তেই তৃতীয় ব্যক্তি বলে উঠল, ‘আমার ট্যাক্সোটা ভুলো না কিন্তু’- তা সে তৃতীয় ব্যক্তি গাঁয়ের মোড়লই হন, পঞ্চাশখানা গাঁয়ের দলপতিই হন, কিম্বা রাজা অথবা তার কর্মচারীই হন। তা তিনি নিন, আমার তাতে কোনো আপত্তি নেই, কারণ এ-যাবৎ আমি পুরনো খবরের কাগজ ছাড়া অন্য কোনও বস্তু বিক্রি করিনি। কিন্তু যেখানে দু-পয়সা লাভের কোনো প্রশ্নই ওঠে না, সেখানে যখন চুঙ্গিঘর তার না-হক্কের কড়ি না-হক চাইতে যায়, তখনই আমাদের মনে সুবুদ্ধি জাগে, ওদের ফাঁকি দেওয়া যায় কি প্রকারে।
এই মনে করুন, আপনি যাচ্ছিলেন ঢাকা। প্যাক করতে গিয়ে দেখেন, মাত্র দুটি শার্ট ধোপার মারপিট থেকে গা বাঁচিয়ে কোনো গতিকে আত্মরক্ষা করতে সমর্থ হয়েছে। ইস্টিশানে যাবার সময় কিনলেন একটি নয়া শার্ট। বাস্, আপনার হয়ে গেল। দর্শনা পৌঁছতেই পাকিস্তানি চুঙ্গিঘর হলুধবনি দিয়ে দর্শনী চেয়ে উঠবে। তার পর আপনার শার্টটির গায়ে হাত বুলুবে মস্তক আঘ্রাণ করবে এবং শেষটায ধৃতরাষ্ট যে-রকম ভীমসেনকে আলিঙ্গন করেছিলেন ঠিক সেই রকম বুকে জড়িয়ে ধরবে।
আপনার পাঁজর কখানা পটপট করতে আরম্ভ করেছে, তবু শুকনো মুখে চিঁচিঁ করে বলবেন, ওটা ত আমি নিজের ব্যবহারের জন্য সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছি। ওতে ত ট্যাক্স লাগাবার কথা নয়।’
আইন তাই বলে।
হায় রে আইন! চুঙ্গিওলা বলবে, ‘নিশ্চয় নিশ্চয়। কিন্তু ওটা যদি আপনি ঢাকাতে বিক্রি করেন?
তর্কস্থলে ধরে নিলুম, আপনার পিতামহ তর্কবাগীশ ছিলেন তাই আপনি মূর্খের ন্যায় তর্ক তুললেন, ‘পুরনো শার্টও ত ঢাকাতে বিক্রি করা যায়।’
এই করলেন ভুল। তর্কে জিতলেই যদি সংসারে জিত হত তবে সক্রেটিসকে বিষ খেতে হত না, যীশুকে ক্রুশের উপর শিব হতে হত না।
চুঙ্গিওলা জানে জীবনের প্রধান আইন, ‘চুপ করে থাক্, তর্ক করার বদভ্যাসটি ভালো না। এক্কেবারেই হয় না ওতে বুদ্ধিশক্তির চালনা-’
কী যেন এক অজানার ধেয়ানে, দীর্ঘ এরস্ট্রিপের পশ্চাতের সুদূর দিক্-চক্রবালের দিকে তাকিয়ে বলবে, ‘তা পারেন।’
তারপর কাগজ পেন্সিল নিয়ে কি সব টরে-টক্কা জানেন-আমি আর তার কী বয়ান দেব! ব্যাপারটা যখন আপনার সম্পূর্ণ হৃদয়ঙ্গম হল, তখন আপনি ক্ষীণতম কণ্ঠে বললেন, ‘কিন্তু ওই শার্টটার দামই মাত্র চার টাকা।’
চুঙ্গিওলা একখানা হলদে কাগজে চোখ বুলিয়ে নেবে। আপনি এটাতে দরখাস্ত করেছিলেন এবং নূতন শার্টটার উল্লেখ করেননি। চুঙ্গিওলার কাছে তার সরল অর্থে, আপনি এটা স্মাগল্ করে নিয়ে যাচ্ছিলেন, পাচার করতে চেয়েছিলেন, হাতে-নাতে বে-আইনি কর্ম করতে গিয়ে ধরা পড়লে তার জরিমানা দশ টাকা, জেলও হতে পারত, আফিং কিংবা ককেইন হলে- এ যাত্রা বেঁচে গেছেন।
সেই হলদে কাগজখানা অধ্যায়ন করে কোনো লাভ নেই। কারণ তার প্রথম প্রশ্ন ছিল,

১। আপনার জন্মের সময় যে কাঁচি দিয়ে নাড়ি কাটা হয়েছিল, তার সাইজ কত?
এবং শেষ প্রশ্ন,

২। আপনার মৃত্যুর সন ও তারিখ কি?
আপনি তখন শার্টটির মায়া ত্যাগ করে ঈষৎ অভিমান ভরে বললেন, ‘তা হলে ওটা আপনারা রেখে দিন।’

কিন্তু ওইটি হবার জো নেই। আপনি ঘড়ি চুরি করে পেয়েছিলেন তিন মাসের জেল। ঘড়ি ফেরত দিলেই ত আর হাকিম আপনাকে ছেড়ে দেবে না। শার্ট ফেরত দিতে চাইলেও রেহাই নেই।
তখন শার্টটা চড়বে নিলামে। এক টাকা পেলে আপনি মহাভাগ্যবান। জরিমানাটার অবশ্য নড়নচড়ন হল না।
ঢাকা থেকে ফিরে আসবার সময় ভারতীয় চুঙিওয়ালা দেখে ফেললে আপনার নুতন পেলিকান ফাউন্টেন পেনটি। কাহিনির পুনরাবৃত্তি করে লাভ নেই। আপনি ভাবলেন, ভারত এবং পাকিস্তান উভয়েই এ-কর্মে নূতন, তাই প্যাসেঞ্জারকে খামকা হয়রান করে। বিলেতে-ফিলেতে বোধ হয় চুঙ্গিঘর টুরিস্টদের নিছক মনোরঞ্জননার্থে। তবে শুনুন।
আমার এক বন্ধু প্রায়ই ইউরোপ-আমেরিকায় যান। এতই বেশি যাওয়া আসা করেন যে, তার সঙ্গে কোথাও দেখা হলে বলবার উপায় নেই, তিনি বিদেশ যাচ্ছেন না ফিরে আসছেন। ওই যে রকম ঢাকার কুট্টি গাড়ওয়ান এক ভদ্রলোককে ভি শেপের গেঞ্জি উল্টো পরে যেতে দেখে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘কর্তা আইতেছেন, না যাইতেছেন?’
তিনি নেমেছেন ইটালির ভেনিস বন্দরে জাহাজ থেকে। ঝান্ডু ব্যবসায়ী লোক। তাই চুঙ্গিঘরের সেই হলদে কাগজখানায় যাবতীয় প্রশ্নের সদুত্তর দিয়ে শেষটায় লিখেছেন, ‘এক টিন ভ্যাকুয়াম প্যাক্ট্ ভারতীয় মিষ্টান্ন। মূল্য দশ টাকা।’ অস্কার ওয়াইল্ড যখন মার্কিন মূল্লুকে বেড়াতে গিয়েছিলেন, তখন চুঙ্গিঘর পাঁচ জনের মত তাকেও শুধিয়েছিল, ‘এনিথিং টু ডিক্লেয়ার?’ তিনি আঙুল দিয়ে তার মগজের বাক্সটি বার কয়েক ট্যাপ করে উত্তর দিয়েছিলেন, ‘মাই জিনিয়াস’। আমার পরিচিতদের ভিতর ওই ঝান্ডুদাই একমাত্র লোক, যিনি মাথা ত ট্যাপ করতে করতে পারতেনই, সঙ্গে সঙ্গে হার্টটা ট্যাপ করলে কেউ কোনো আপত্তি করতে পারত না। জাহাজখানা ছিল বিরাট সাইজের- ঝাণ্ডদার বপুটি স্চক্ষে দেখেছের যারা, তারাই আমার কথায় সায় দেবেন যে, তাকে ভাসিয়ে রাখাে যে- সে জাহাজের কর্ম নয়- তাই সেদিন চুঙ্গিঘরে লেগে গিয়েছিল মোহনবাগান ভর্সস ফিল্ম স্টার- টীম ম্যাচের ভিড়। ঝাণ্ডুদা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়লেন। হঠাৎ মনে পনে পড়ল ইতালির ‘কিয়ান্তি’ জিনিসটিটি বড়ই সরেস এবং সরস। চুঙ্গিঘরের কাঠের খোয়াড়ের মুখে দাঁড়িয়েছিল এক পাহরাওয়ালা। তাকে হাজার লিরার একখানা নোট দিয়ে বুঝিয়ে কয়েক বোতল কিয়ান্তি রাস্তার ওধারে দোকান থেকে নিয়ে আসতে। পাহরাওয়াল খাঁটি খানদানি লোকের সংস্পর্শে ঠাওর করতে পেরে খাঁটি নিয়ে এল তিন মিনিটেই। পূর্বেই বলেছি ঝাণ্ডদা জন্মেছিলেন তাগড়াই হাট নিয়ে- জাহাজে পরিচিত অপরিচিত তথা চুঙ্গিঘরের পাহারাওলা সেপাই, চাপরাসি, কুলি সবাইকে ‘কিয়ান্তি’ বিলোতে লাগলেন দরাজ দিলে। মাল খালাসিতে তার পালা এসে গেছে। নিমন্ত্রিত রবাহূত সব্বাইকে দরাজ হতে দুখানা পাখির মত মেলে দয়ে বললেন, আপনারা ততক্ষণে ইচ্ছ করুন: আমি এই এলুম বলে। ‘কিয়ান্তি’ রানিকে বসিয়ে রাখা মহাপাপ।’
ঝান্ডুদার বাক্স পেটরার এত সব জাত-বেজাত হোটেলের লেবেল লাগানো থাকত যে, অগা চুঙ্গিওলাও বুঝতে পারত এগুলোর মালিক বস্তুভিটার তোয়াক্কা করেনা- তার জীবন কাটে হোটেলে হোটেলে। আজকের চুঙ্গিওলা কিন্তু সেগুলো খুটিয়ে খুটিয়ে দেখতে আরম্ভ করলে, প্রথম ভাগের ছেলে যে-রকম বানান ভুল করে করে বই পড়ে। লোকটার চেহারাও বদখাত। টিঙটিঙে রোগা, গালদুটো ভাঙা, সে-গালের হাড়দুটো চোয়ালের মত বেরিয়ে পড়েছে, চোখ দুটো গভির গর্তের ভিতর থেকে নাকটাকে প্যাসনের মত চেপে ধরেছে, নাকের তলায় টুথব্রাশের মত হিটলারি গোঁফ। পূর্বেই নিবেদন করেছি, ঝান্ডুদা ঝানু লোক, তাই তিনি মানুষকে তার চেহারা থেকে যাচাই করেন না। এবারে কিন্তু তাকেও সেআ নিয়মের ব্যভিচার করতে হল। লোকটাকে আড়চোখে দেখলেন,সন্দেহের নয়নে আমর কানে কানে বললেন,  শেক্স্পিয়ার নাকি বলেছেন, রোগা লোককে সমঝে চলবে?’ আমার বিশ্বাস, আজ যে শেক্স্পিয়ারের এত নামডাক সেটা ওই দিন থেকেই শুরু হয়- কারণ ঝান্ডদা আত্মনির্ভশীল মহাজন, কারও কাছ থেকে কখনও কানাকড়ি ধার নেন নি। তিনি ঋণ স্বিকার করাতে ওইদিন থেকে শেক্স্পিয়ারের যশ-পত্তন হয়।
চুঙ্গিওয়ালা শুধালে, ‘ওই টিনটার ভেতরে আছে?’
‘ইন্ডিয়ান সুইট্স্।’
‘ওটা খুলুন।’
‘সেটা কী করে হয়? ওটা আমি নিয়ে যাব লন্ডনে! খুললে বরবাদ হয়ে যাবেযে?’
চুঙ্গিওয়ালা যেভাবে ঝান্ডুদার দিকে তাকালে তাতে যা টিন খোলার হুকুম হল, পাঁচশো ঢ্যাঁরা পিটিয়ে কোনো বাদশাও ওরকম হুকুমজারি করতে পারতেন না।
ঝান্ডুদা মরিয়া হয়ে কাতর নয়নে বললেন, ‘ব্রাদার, এ-টিনটা আমি নিয়ে যাচ্ছি আমার এক বন্ধুর মেয়ের জন্য লন্ডনে- নেহাতই চিংড়ি মেয়ে। এটা খুললে সর্বনাশ হয়ে যাবে।’
এবারে চুঙ্গিওয়ালা যেভাবে তাকালে, তাতে আমি হাজার ঢ্যাঁঢরার শব্দ শুনতে পেলুম।’
বিরাট-লাশ ঝান্ডুদা পিঁপড়ের মত নয়ন করে সকাতরে বললেন, ‘তাহলে ওটা ডাকে করে লন্ডনে পাঠিয়ে দাও, আমি ওটাকে সেখানেই খালাস করব।’
আমরা একবাক্যে বললুম, ‘কিন্তু তাতে তো বড্ড খরচা পড়বে। পাউন্ড পাঁচেক- নিদেন।’
হ্রশ্বাস ফেলেই বললেন, ‘তা আর কি করা যায়।, কিন্তু  আশ্চর্য, চুঙ্গিওয়ালা তাতাও রাজি হয় না। আমরাও অবাক। কারণ এ-আইন তো সক্কলেই জানা।
ঝান্ডুদা একটুখানি দাঁত কিড়মিড় খেয়ে লোকটাকে আইনটার মর্ম প্রাঞ্জলভাষায় বোঝালেন। তার অর্থ, টিনের ভেতরে বাঘ-ভাল্লুক, ককেইন-হেরয়িন যা-ই থাক্ ও-মাল যখন সোজা লন্ডনে চলে যাচ্ছে তখন তাঁর পূণ্যভূমি ইত্যালি তো আর কলঙ্কিত হবে না।
আমরা সবাই কসাইটাকে বোঝাবার চেষ্টা করলুম ঝান্ডুদার প্রস্তাবটি অতিশয় সমীচীন এবং আইনসঙ্গতও বটে। আমাদের দল তখন বেশ বিরাট আকার ধারণ করেছে। ‘কিয়ান্তি’ রানির সেবকের অভাব ইতালিতে কখনও হয়নি- প্রাচুর্য থাকলে পৃতিবীতেও হত না। এক ফরাসি উকিল কাইরো থেকে পোর্ট সঈদে জাহাজ ধরে- সে পর্যন্ত বিন্ ফীজে লেকচার ঝাড়লে। চুঙ্গিওয়ালার ভাবখানা সে পৃথিবীর কোনো ভাষাই বোঝে না।
ঝান্ডুদা তখন চটেছেন। বড়িবিড় করে বললেন, ‘শালা, তবে খুলছি। কিন্তু ব্যাটা তোমাকে না খাইয়ে ছাড়ছিনে।’ তারপর ইংরেজিতে বললেন, ‘কিন্তু তোমাকে ওটা নিজে খেয়ে পরখ করে দেখতে হবে ওটা সত্যি ইন্ডিয়ান সুইট্স কিনা।
শয়তানটা চট করে কাউন্টরের নিচ থেকে টিন-কাটার বের করে দিলে।ফরাসি বিদ্রোহের গিলোটিনের অভাব হয়নি।
ঝান্ডুদা টিন-কাটার হাতে নিয়ে ফের চুঙ্গিওয়ালাকে বললেন, ‘তামাকে কিন্তু ওই মিষ্টি পরখ করতে হবে নিজে, আবার বলছি।
চুঙ্গিওয়ালা একটু শুকনো হাসি হাসলে। শীতে বেজায় ঠোঁট ফাটলে আমরা যে-রকম হাসে থাকি।
ঝান্ডুদা টিন কাটলেন।
কী আর বেরুবে? বেরল রসগোল্লা। বিয়ে-শাদীতে ঝান্ডুদা ভুরি ভুরি রসগোল্লা স্বহস্তে বিতরণ করেছেন- ব্রাহ্মণ-সন্তানও বটেন। কাঁটা চামচের তোয়ক্কা না করে রসগোল্লা হাত দিয়ে তুলে প্রথমে বিতরণ করলেন বাঙালীদের, তারপর যাবতীয় ভরতীয়দের, তারপর সবাইকে, অর্থাৎ ফরাসি জার্মানি ইত্যালির স্প্যানিয়ার্ডদের।
মাতৃভাষায় বাংলাটাই বহুত তকলিফ বরদাস্ত করেও কাবুতে আনতে পারি নি, কাজেই গণ্ডা তিনেক বাষায় তখন বাঙালির বহুযুগের সাধনার ধন রসগোল্লা যে বৈতালিক গীতি উঠেছিল তার ফটোগ্রাফ দি কী প্রকারেঃ
ফরাসিরা বলেছিল, ‘এপাতাঁ!’
‘জর্মনরা, ‘ক্লর্কে!’
ইতালিয়ানরা, ব্রাভো!’
স্প্যানিশরা, ‘দেলিচজো,দেলিচজো।’
আরবরা, ‘ইয়া সালাম, ইয়া সালাম!’
তামাম চুঙ্গিঘর তখন রসগোল্লা গিলছে। আকাশে বাতাসে রসগোল্লা। কিউবিজম বা দাদাইজমের টেকনিক দিয়েই শুধু এর ছবি আঁকা যায়। চুঙ্গিঘরের পুলিশ বরকন্দাজ, চাপরাসি-স্পাই সক্কলেই হাতে রসগোল্লা। প্রথমে ছিল ওদের হাতে ‘কিয়ান্তি’, আমাদের হাতে রসগোল্লা। এক লহমায় বদলাবদলি হয়ে গেল।
আফ্রিকার একজন ক্রিশ্চান নিগ্রো আমাকে দুঃখ করে বলেছিলেন, ‘ক্রিশ্চান মিশনারিরা যখন আমাদের দেশে এসেছিলেন তখন তাদের হাতে ছিল বাইবেল, আমাদের হাতে ছিল জমিজমা। খিচুদিন বাদে দেখি, ওদের হাতে জমিজমা আমাদের হাতে বাইবেল।’
আমাদের হাতে ‘কিয়ান্তি’।
ওদিকে দেখি , ঝান্ডুদা আপন ভুঁড়িটি কাউন্টারের উপর চেপে ধরে চুঙ্গিওয়ালা দিকে ঝুঁকে পড়ে বলছেন- বাংলাতে- ‘একটা খেয়ে দেখ।’ হাতে তাঁর একটি সরেস রসগোল্লা।
চুঙ্গিওলা ঘাড়টা একটু পেছন দিকে হটিয়ে গম্ভীররূপ ধারণ করেছে।
ঝান্ডুদা নাছোড়বান্দা। সামনের দিকে আরেকটু এগিয়ে বললেন, ‘দেখছ তো, সবাই খাচ্ছে। ককেইন নয়, আফিঙ নয়। তবু নিজেই চেখে দেখ, এ বস্তু কী!’
চুঙ্গিওলা ঘঅড়টা আরও পিছিয়ে নিল। লোকটা অতি পাষাণ্ড। একবারের তরে ‘সরি-টরি’ও বললে না।
হঠাৎ বলা নেই কওয়া নেই, ঝান্ডুদা তামাম ভুঁড়িখানা কাউন্টারের উপর চেপে ধরে ক্যাঁক করে পাকড়ালেন চুঙ্গিওলার কলার বাঁ আর হাতে থেবড়ে দিলেন একটা রসগোল্লা ওর নাকের উপর। ঝান্ডুদার তাগ সব সময়ই অতিশয় খারাপ।
আর সঙ্গে সঙ্গে মোটা গলায়, ‘শালা, তুমি খাবে না। তোমার গুষ্টি খাবে। ব্যাটা তুমি মস্কারা পেয়েছ। পই পই করে বললুম রসগোল্লা নষ্ট হয়ে যাবে, চিংড়িটা বড্ড নিরাশ হবে, তা তুমি শুনবে না’- আরও কত কী!
ততক্ষণে কিন্তু তাবৎ চুঙ্গিঘরে লেগে গেছে ধুন্দুমার! চুঙ্গিওলার গলা থেকে যে টুকু মিহি আওয়াজ বেরুচ্ছে তার থেকে বোঝা যাচ্ছে সে পরিত্রাণের জন্য চাপরাসি থেকে  আরম্ভ করে ইলদুচে মুসসোলীনি- মাঝখানে যত সব কনসাল, লিগেশন মিনিস্টার এম্বাসেডর- প্লেনিপটিনশিয়ারি- কারুরই দোহাই কড়াতে কসু করছে না। মেরি মাতা, হোলি যিসস, পোপঠাকুর তো বটেনই।
আর চিৎকার-চেঁচামেচি হবেই বা না কেন? এ যে রীতিমত বেআইনি কর্ম। সরকারি চাকুরেকে তার কর্তব্যকর্ম সমাধানে বিঘ্ণ উৎপাদন করে তাকে সাড়ে তিনমণী লাশ দিয়ে চেপে ধরে রসগোল্লা খাওয়াবার চেষ্টা করুন আর সেঁকো খাইওয়াবারই চেষ্ট করুন, কর্মটির জন্য আকছারই জেলে যেতে হয়।  ইতালিতে এর চেয়ে বহুত অল্পেই ফাঁসি হয়।
ঝান্ডুদার কোমর জাবড়ে ধরে আমরা জনপাঁচেক তাঁকে কাউন্টর থেকে টেনে নামাবার চেষ্ট করছি। তিনি পর্দার পর পর্দা চড়াচ্ছেন, খাবিনি, ও পরান আমার, খাব না, ব্যাটা-’ চুঙ্গিওলা ক্ষীণকণ্ঠে পুলিশকে ডাকছে। আওয়াজ শুনে মনে হচ্ছে আমার মাতৃভ’মি সোনার দেশে ভারতবর্ষের ট্টাঙ্ককলে যেন কথা শুনছি। কিন্তু কোথায় পুলিশ? চুঙ্গিঘরের পাইক বরকন্দাজ, ডাণ্ডাবরদার, আস্-সরদার বেবাক চাকর-নফর বিলকুল বেমালুম গায়েব!  এ কি ভানুমতি, এ কি ইন্দ্রজাল!
দেখি, ফরাসি উকিল আকাশের দিকে দুহাত তুলে অর্ধনিমীলিত চক্ষে, গদ্গদ্ কণ্ঠে বরছে, ‘ধন্য, পূণ্যভূমি ইতালি, ধন্য পূণ্যনগর ভেনিস! এ-ভূমির এমনই পূণ্য যে হিদেন রসগোল্লা পর্যন্ত এখানে মিরাক্কেল দেখাতে পারে।  কোথায় লাগে ‌মিরাক্ল্ অব মিলান’ এর কাছে- এ যে সাক্ষাৎ জাগ্রত দেবতা, পুলিশ-মুলিশ সবাইকে ঝেঁটিয়ে বার করে দিলেন এখান থেকে! ওহোহো, এর নাম হবে ‌মিরাক্ল্ দ্য রসগোল্লা।’
উকিল মানুষ সোজা কথা প্যাঁচ না মেরে বলতে পারে না। তার উচ্ছ্বাসের মূল বক্তব্য, রসগোল্লার নেমকহারাম করতে চায় না ইতালির পুলিশ-বরকান্দাজরা। তাই তারা গা-ঢাকা দিয়েছে।
আমরা সবাই একবাক্যে সায় দিলুম। কিন্তু কে এক কাষ্ঠরসিক বলে উঠলো, ‘রসগোল্লা নয়, কিয়ান্তি।’ আরও দু-চার পাষণ্ড তায় সায় দিল।
ইতোমধ্যে ঝান্ডুদাকে বহু কষ্টে কাউন্টারের এদিকে নামানো হয়েছে। চুঙ্গিওলা রুমাল দিয়ে রসগোল্লার থ্যাবড়া মুছতে যাচ্ছে দেখে তিনি চেঁচিয়ে বললেন, ‘ওটা পুঁছিসনি; আদালতে সাক্ষী দেবে- ইগজিবিট্ নাম্বার ওয়ান।’
ওদিকে তখন বেটিং লেগে গিয়েছে, ইতালিয়ানরা ‘কিয়ান্তি’ পান করে, না রসগোল্লা খেয়ে সবাই গা-ঢাকা দিয়েছে? কিন্তু ফৈসালা করবে কে? তাই এ বেটিঙে রিস্ক নেই। সবাই লেগে গিয়েছে।
কে একজন ঝান্ডুদাকে সদুপদেশ দিলেন, ‘পুলিশ-টুলিশ ফের এসে যাবে।
ততক্ষণে আপনি কেটে পড়–ন।’
তিন মিনিটের ভিতর বড়কর্তা ভিড় ঠেলে এগিয়ে এলেন। ফরাসি উকিলের বোধহয় সবচেয়ে বড় যুক্তি ঘুষ। এক বোতল ‘কিয়ন্তি’ নিয়ে তাঁর দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। ঝান্ডুদা বাধা দিয়ে বললেন, ‘নো।’
তারপর বড় সাহেবের সামনে গিয়ে বললেন, ‘সিন্নোর’, বিফোর ইউ প্রসিড, অর্থাৎ কিনা ময়না তদন্ত আরম্ভ হওয়ার পূর্বে আপনি একটি ইন্ডিয়ান সুঈটস্ চোখে দেখুন।’ বলে নিজের মুখে তুললেন একটি। আমাদের সবাইকে আরেক প্রস্থ বিতরণ করলেন।
বড়কর্তা হয়ত অনেক রকমের ঘুষ খেয়ে ওকিবহাল এবং তালেবর। কিংবা হয়ত কখনও ঘুষ খাননি। ‘না-বিইয়ে কানাইয়ের মা’ যখন হওয়া যায় এবং স্বয়ং ঈশ্বরচন্দ্র যখন এÑপ্রবাদটি ব্যবহার করে গেছেন, তখন ‘ঘুষ না খেয়েও দারোগা’ তো হওয়া যেতে পারে।
বড়কর্তা একটি মুখে তুলেই চোখ বন্ধ করে রইলেন আড়াই মিনিট। চোখ বন্ধ অবস্থায়ই আবার হাত বাড়িয়ে দিলেন। ফের। আবার।
এবার ঝান্ডুদা বললেন, ‘এক ফোঁটা কিয়ান্তি?’
কাদম্বিনীর ন্যায় গম্ভীর নিনাদে উত্তর এল, ‘না। রসগোল্লা।’
টিন তখন ভোঁ- ভোঁ।
চুঙ্গিওলা তার ফরিয়াদ জানালে।
কর্তা বললেন, ‘টিন খুলেছ তো বেশ করেছ, না হলে খাওয়া যেত কি করে? আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এখানে দাঁড়িয়ে আছেন কি করতে? আরও রসগোল্লা নিয়ে আসুন।’ আমরা সুড়সুড় করে বেরিয়ে যাবার সময় শুনতে পেলুম, বড়কর্তা চুঙ্গিওলাকে বলছেন, ‘তুমি তো একটা আস্ত গাড়ল। টিন খুললে আর ওই সরেস মাল চেখে দেখলে না?’
‘কিয়ন্তি’ না রসগোল্লা সে-বেটের সমাধান হল।
ইতালির প্রখ্যাত কবি ফিলিকাজা গেয়েছেন,
‘ইতালি, ইতালি, এত রূপ তুমি কেন ধরেছিলে, হায়!
অনন্ত ক্লেশ লেখা ও-ললাটে নিরাশার কালিমায়।’
আমিও তার স্মরণে গাইলুম,
রসের গোলক, এত রস তুমি কেন ধরেছিলে হায়!
ইতালির দেশ ধর্ম ভুলিয়া লুটাইল তব পায়!!

Comments

Popular posts from this blog

Ahmedabad Satyagraha in Gujarat (1918)

Ahmedabad Satyagraha in Gujarat (1918) Introduction The Ahmedabad Satyagraha of 1918 marks a significant chapter in India's struggle for independence. It was a labor strike initiated by the mill workers in Ahmedabad, Gujarat, demanding an increase in wages. The strike was not just a protest against economic injustice, but it also symbolized the fight against oppressive colonial rule. The term 'Satyagraha' was coined by Mahatma Gandhi, which translates to 'insistence on truth' or 'soul force'. It was a method of non-violent resistance, and the Ahmedabad Satyagraha was one of the early instances where this method was employed in the Indian independence movement. The Satyagraha in Ahmedabad was a turning point as it marked the beginning of Gandhi's active involvement in Indian politics. It was here that Gandhi first introduced his methodology of peaceful resistance and negotiation as a means to achieve political and social change. The event holds histori...

অধ্যায় 2: বাংলায় ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন

বাংলায় ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন বাংলায় ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন সুচিপত্র ভূমিকা পলাশীর যুদ্ধ (১৭৫৭) ব্রিটিশ শাসনের প্রাথমিক বছরগুলি (1757-1857) 1857 সালের বিদ্রোহ এবং এর প্রভাব প্রয়াত ঔপনিবেশিক সময়কাল (1858-1947) বঙ্গভঙ্গ (1905) ব্রিটিশ শাসনের অবসান এবং ভারত বিভাজন (1947) উপসংহার বাংলায় ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন (1757-1947) পরিচয় বাংলায় ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন 1757 থেকে 1947 সাল পর্যন্ত প্রায় দুই শতাব্দী বিস্তৃত ছিল। এই সময়কালে উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক পরিবর্তন দেখা যায় যা এই অঞ্চলে স্থায়ী প্রভাব ফেলে। বাংলার ইতিহাসের জটিলতা এবং ঔপনিবেশিকতার বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে এর স্থানকে উপলব্ধি করার জন্য এই ঐতিহাসিক যুগকে বোঝা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ৷ ...

ভাড়াটিয়া-ভাড়াদার আইনের জটিলতা পার হওয়া: ভাড়াটিয়াদের জন্য একটি গাইড

ভাড়াটিয়া-ভাড়াদার আইনের জটিলতা পার হওয়া: ভাড়াটিয়াদের জন্য একটি গাইড ভাড়াটিয়া-ভাড়াদার আইনের জটিলতা পার হওয়া: ভাড়াটিয়াদের জন্য একটি গাইড সূচিপত্র ভূমিকা অধ্যায় 1: ভাড়াটিয়া হিসেবে আপনার অধিকার ও দায়িত্ব বুঝুন অধ্যায় 2: বহিষ্করণ ও ভাড়াদারি শেষ অধ্যায় 3: ভাড়া ও নিরাপত্তা জমা অধ্যায় 4: রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামত অধ্যায় 5: আফজাল অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস কীভাবে ভাড়াটিয়া পরামর্শ দিতে পারে উপসংহার অতিরিক্ত সংস্থান যোগাযোগের তথ্য ভূমিকা ভাড়াটিয়া-ভাড়াদার আইন বুঝতে ভাড়াটিয়াদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই সম্পূর্ণ গাইডের উদ্দেশ্য হচ্ছে ভাড়াটিয়াদের তাদের সম্পত্তি পরিচালনা করার জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য প্রদান করা। আপনি একজন অভিজ্ঞ ভাড়াটিয়া হোক বা শুরু করছেন, এই নিবন্ধটি আপনাকে আপনার অধিকার ও দায়িত্ব, বহিষ্করণ প্রক্রিয়া, ভাড়া ও নিরাপত্তা জমা, রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামত, এবং আফজাল অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস কীভাবে বিশেষজ্ঞ আইনি পরামর্শ দিতে পারে তা ব...