Skip to main content

চট্টগ্রাম বিভাগের গণহত্যা ও নির্যাতনের বিবরণ

 চট্টগ্রাম বিভাগের গণহত্যা ও নির্যাতনের বিবরণ


সূত্র – বাংলা একাডেমী দলিলপত্র, ১৯৭২-৭৪




গণহত্যা ও নির্যাতনের বিবরণঃ বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় গৃহীত সাক্ষাৎকার

হত্যা, ধ্বংস ও নির্যাতনের বিবরণ


।। চট্টগ্রাম বিভাগ ।।


।। ২১৮ ।।

শ্রী অমল কান্তি সেন

অধ্যাপক

সাতকানিয়া কলেজ

চট্টগ্রাম


১৯৭১ সালের ২৩ এপ্রিল পাক বাহিনী দোহাজারীতে ঘাঁটি স্থাপন করে। ২৪ এপ্রিল পাক বর্বর বাহিনী সাতকানিয়া থানার কাঞ্চনা গ্রামে সর্বপ্রথম অগ্নীসংযোগ ও হত্যাযজ্ঞ চালায়। এই সময় তাদের সাথে তাদের পথ প্রদর্শক হিসেবে ছিল অন্যান্যদের মধ্যে সাতকানিয়ার এক দুর্বৃত্ত।


১৩ ডিসেম্বরের আগ পর্যন্ত দখলদার বাহিনী এবং রাজাকারদের সাথে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছে এবং সাতকানিয়া থানার বিভিন্ন এলাকায় হিন্দু সম্প্রদায় ও মুসলিম প্রগতিবাদী শ্রেণির লোকদের নানাভাবে হয়রানি করেছে। সে কারো কারো কাছ থেকে বিভিন্ন পরিমাণ টাকা আদায় করেছে ঘরবাড়ী করার ওয়াদা দিয়ে অথবা প্রাণ রক্ষার অঙ্গীকারে।


২৪শে এপ্রিল যে কাঞ্চনা গ্রামটি ভস্মীভূত করা হয়েছে, সে দিন আমি সেখানে উপস্থিত ছিলাম। ঘরে মূল্যবান জিনিস ছিল, তা প্রথমে লুট করা হয়েছে। ঘর থেকে পালিয়ে লোকজন যখন এদিক সেদিক যাচ্ছিল, তখন তাদের কাছে যা পাওয়া গেছে তাও লুট করে নিয়েছে। এই ভাবে বেশীর ভাগ লোককে সর্বস্বান্ত করা হয়েছে। তখন বৃষ্টির দিন, তখনো পোড়া বাড়িতে ঘর তৈরী করার অনুমতি দেয় নি শান্তি কমিটির লোক। কাঞ্চনাতে আক্রমণ চালাবার দিন অন্যান্য ১১ জনের মধ্যে চট্টলার সু-সন্তান, সাতকানিয়ার গৌরব রায় সাহেব কামিনী কুমার ঘোষ এম.এ.বি.এল মহাশয়কে হত্যা করে পাক বর্বর বাহিনী।


আমাদের চেমশা গ্রামে অগ্নীসংযোগ করা হয়েছে ২৫শে মে। এই দিন পাক বাহিনী দোহাজারী ঘাঁটি থেকে সকাল ৮টা নাগাত সাতকানিয়ার ভূতপূর্ব এম.এন.এ আবু সালেহর বাড়ীতে আগুন দেয় এবং দোহাজারী ফেরার পথে চেমশা গ্রামের কাছাকাছি তখন কয়েকজন দুর্বৃত্ত পাক বাহিনীকে চেমশা গ্রামের হিন্দুদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়ার জন্য তাঁদেরকে অভ্যর্থনা করে। সাথে সাথে পাক বাহিনীর জীপ দিক পরিবর্তন করে চেমশা গ্রামে ঢুকে পড়ে। পাক বাহিনী গ্রামে ঢুকে দালালদের আগুন জ্বালাবার ভার দিয়ে যায় এবং তাদের সহায়তা করার জন্য সাতকানিয়ার থানার কয়েকজন পুলিশ মোতায়েন করে। এই সুযোগে দালালরা গ্রামে প্রথমে লুটতরাজ চালায় এবং পরে গ্রামের অধিকাংশ বাড়ীতে অগ্নীসংযোগ করে। আমার প্রতিবেশী হিসেবে একজন গরীব লোক ছিল, সে রিক্সা চালিয়ে জীবিকা অর্জন করতো। তার বাড়ীও সেই দিন রেহাই পায় নাই। কিন্তু সবচেয়ে দুঃখের বিষয় এই যে, আমার প্রতিবেশী সোনা দাস কে তারা ধরে নিয়ে যায়। পরে জানতে পারি তাকে নাকি হত্যা করা হয়েছে। আজও তার কোন খবর নাই।


আমার এক ভাই বিমল কান্তি সেন সাতকানিয়া কলেজে বি.এ ক্লাসের ছাত্র ছিল। দেশে থাকা অসম্ভব হয়ে পড়লে সে মুক্তিবাহিনীতে শিক্ষা গ্রহন এবং সক্রিয়ভাবে স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহনের জন্য সীমান্ত পার হওয়ার সময় মিরসরাই থানাতে পাক বাহিনীও রাজাকারদের হাতে ধরা পড়ে। ৮দিন অকথ্য নির্যাতনের পর ২৩ সেপ্টেম্বর তাদের হাতে নিহত হয়।


আমাদের গ্রামে নিহত স্বপন চৌধুরী এবং দিলীপ চৌধুরীর কথা এখনো ভুলতে পারছিনা এবং কখনো ভুলতেও পারবোনা। তারা দুজনেই দাদা বলে ডাকতো এবং তাদের “অমলদা” ডাকটি আজও আমার প্রতিনিয়ত খেয়াল হয়। অসহযোগ চলাকালে তাদের ভুমিকা ছিল খাঁটি দেশ প্রেমিকের ভুমিকা।


গ্রামে গ্রামে শান্তি কমিটি গঠন হওয়ার সাথে সাথে আমাদের গ্রামেও শান্তি কমিটি গঠিত হয়। আমাদের গ্রামে রাজাকাররা বেশ কয়েকবার অত্যাচার চালিয়েছে। সাতকানিয়া দেওয়ানী আদালতের প্রবীণতম লব্ধ প্রতিষ্ঠাতা ব্যবহারজীবি যতীন্দ্র মোহন চৌধুরী বি.এল মহাশয়কে পর্যন্ত চরমভাবে অপমান করেছে। ৯ই ডিসেম্বর আমাদের গ্রামে পুনরায় এক ব্যাপক অগ্নীসংযোগ চালায় দোহাজারী ঘাঁটির রাজাকাররা।


স্বাক্ষর/-

শ্রী অমল কান্তি সেন।

১৪/০৪/৭৩


।। ২১৯ ।।

মোঃ এমদাদ মিঞা সিকদার

গ্রামঃ মনেয়াবাদ

থানাঃ সাতকানিয়া

জেলাঃ চট্টগ্রাম


আমি মুক্তি সংগ্রামে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করি। পাক হানাদার বাহিনীর হাতে কিভাবে ধৃত হয়ে গুরুতরভাবে আহত হয়েছিলাম তার সংক্ষিপ্ত বিবরণ নিন্মে লিপিবদ্ধ করলামঃ

জনসাধারণকে বিপদ হইতে রক্ষা করাই ছিল আমার মূলমন্ত্র। তাই ২৫শে মার্চের কালরাত্রিতে বিভীষিকার মধ্যে শপথ নিলাম সোনার বাংলাকে দস্যু কবল থেকে মুক্ত করবো। এই দুঃসাহসী কাজে নেমে গেলাম, স্ত্রী, পুত্র, ঘরবাড়ী পরিবার পরিজন ত্যাগ করে। নিজ জীবন বিপন্ন করে স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়লাম।


সর্বপ্রথম নিজ ছেলে নাজিমউদ্দিনকে মুক্তিবাহিনীতে ট্রেনিং-এ যাওয়ার জন্য বিদায় দিলাম। সঙ্গে সঙ্গে বাজলিয়া পুরাণঘর ইউনিয়ের শতাধিক ছেলেকে অনুপ্রেরণা যুগিয়ে দেশ মাতৃকার সংগ্রামে বন্ধুরাষ্ট্র ভারতে মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং ক্যাম্পে পাঠাতে লাগলাম। আমার নিঃস্বার্থ কর্মতৎপরতায় মুক্তিযোদ্ধাদের ভূমিকা গ্রহণে এলাকা দালালদের চরম বিপর্যয়ের হাত হতে অনেকটা রক্ষা পেয়েছিল। দেশের এই চরম মুহুর্তে নির্যাতিত লোকদের রক্ষা করেই ক্ষান্ত হই নাই। শেষ পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং সমাপনান্তে দেশে এলে তাদের সার্বিক সাহায্য করে দুষ্কৃতকারী দালাল রাজাকার ও মুজাহিদ বাহিনীর লোকজনদের খতম করা ইত্যাদির ব্যাপারে আমার গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা ছিল। ধোপাদুড়ীস্থ টি,এম আলীর গ্রুপ, কমলছড়ীর সুলতান গ্রুপ ও চিংড়িংমানস্থ জাহেদ গ্রুপের সাথে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ স্থাপন করে, উক্ত গ্রুপ্রের মুক্তিযোদ্ধাদের রসদপত্র যোগাড় করে তাঁদের সজীব রেখে, তাঁদের সক্রিয় সহযোগীতায় সেখান থেকে বান্দরবন, হিলট্র্যাক্ট ও দোহাজারীস্থ পাক হানাদের দস্যুদেরকে অতর্কিত আক্রমন চালিয়ে তাদের প্রাণ বধ করি এবং বান্দরবন রাস্তার অনেকাংশে ব্রীজ নষ্ট করে করে দিয়ে যাতায়াতে বিঘ্ন সৃষ্টি করি। শেষ পর্যন্ত আমার ষড়যন্ত্রে পাক হানাদার দস্যুগণ অতিষ্ঠ হয়ে বান্দরবন ত্যাগ করে দোহাজারী এসে সমবেত হয়। আমার এই কার্যকলাপে দালালগণ অতিষ্ঠ হয়ে আমাকে ধরিয়ে দেয়ার গোপন চক্রান্ত চালাতে থাকে। এতে আমি বিন্দুমাত্র বিচলিত হই নাই ও নিজের জীবনের প্রতি লক্ষ্য রাখি নাই এবং দেশ মাতৃকার মুক্তি সংগ্রামে বিন্দুমাত্র ত্রুটি করি নাই।


২৮/০৯/১৯৭১ ইং আনুমানিক ১০টার সময় জাহেদ গ্রুপসহ চরাত ইউনিয়নের রাজাকারদের উপর আক্রমন চালিয়ে ফেরার পথে কুখ্যাত দালালরা ক্যাপ্টেনকে ডেকে এনে আমাকে ধরিয়ে দেয়। বাজালি হাইস্কুলে একদিন এক রাত বেঁধে রেখে বাজালিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ছিদ্দিক আহমদ এম.এ সহ একযোগে নিকটবর্তী দোহাজারী মিলিটারি ক্যাম্পে চালান দেয়। সেখানে আমাকে অনবরত ৪ দিন দৈহিক নির্যাতন চালিয়ে একেবারে অকেজো করে ফেলে। শেষ পর্যন্ত আমি যখন শব্দ করতে অক্ষম তখন আমাকে গুলি করার আদেশ দেয়া হয়। কিন্তু পরিবারের অনেক কাকুতি মিনতির পর পাঁচ হাজার টাকা প্রদানে ১/১০/১৯৭১ ইং তারিখে আমাকে ফেরৎ দেয়া হয়। খোদাতায়ালার অশেষ করুণায় ও সুষ্ঠ চিকিৎসার ফলে কোন রকমে বেঁচে উঠি। বর্তমানে আমি জীবন্মৃত। চলাফেরা করা কঠিন। আমার সাথে বাজালিয়ার মতিলাল বিশ্বাস ও শিবুরাম সেনও ধরা পড়েন, তাঁদেরও আমার মত অবস্থা।


স্বাক্ষর/-

এমদাদ মিঞা সিকদার

১৪/৮/১৯৭৩


।। ২২০ ।।

মোঃ গোলাম হোসেন।

গ্রামঃ লোহাগড়া।

থানাঃ সাতকানিয়া।

জেলাঃ চট্টগ্রাম।


৫ জুন ১৯৭১ রোজ শুক্রবার। তখন ভোর ৬টা। আমি ঘুম থেকে উঠে অজু করে নামাজ শেষ করে আমার বাবার মাজার জিয়ারত করার পর বাড়ীর ভেতর ফিরে আসি। তখন একদল পাক বাহিনী একটি বাস ও একটি কার নিয়ে আমার বাড়ীর সম্মুখে এসে দাঁড়ায়। তারপর তারা নেমে এসে কয়েকজন আমাদের বাড়ীর উত্তর পাশ দিয়ে ও কয়েকজন বাড়ীর সামনে দিয়ে আমাদের সম্পূর্ণ বাড়িটা ঘেরাও করে। ঐ সময় আমার বড় ভাই জালাল উদ্দিনকে ধরে ফেলে এবং তাকে বাহির বাড়িতে বেঁধে রেখে কয়েকজন বাড়ির ভেতরে ঢুকে। বাড়ীর বাহির হতে দেয় নাই। পাক দস্যু বাহিনী আমাদের বাড়ী হতে পিতলের থালা, গহনা-পত্র সোনা রুপা, শাড়িসহ প্রায় দুই লক্ষ টাকার জিনিসপত্র নিয়ে যায়। যাওয়ার সময় আমাকে এবং আমার আরেক ভাই মোঃ আবদুল বারীকেও নিয়ে যায়। যাওয়ার সময় তারা আমাদের নিকট হতে টাকা দাবী করে। টাকা দিতে অস্বীকার করায় তারা আমাদের দোহাজারী ক্যাম্পে নিয়ে যায়। ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়ার পর আমাদের তিন জনের কাছে ২০ হাজার টাকা দাবী করে আর বলে যে টাকা দিতে না পারলে তোদেরকে কেটে হত্যা করবো। তখন আমি বললাম এত টাকা কোথায় হতে দেব স্যার? এই কথা বলার সাথে সাথে একজন নরপিশাচ আমাদের তিন জনের উপর বেদম প্রহার আরম্ভ করে। আমরা যখন প্রায় জ্ঞান শুন্য হয়ে পড়েছি তখন ঐ অবস্থায় আমাদেরকে রেখে নরপিশাচরা চলে যায়।


তার কিছুক্ষন পর আমার আর কয়েক ভাই ঐ সংবাদ পেয়ে আমার মায়ের নিকট হতে ৫ হাজার টাকা নিয়ে দোহাজারী ক্যাম্পে যায়। পাক বাহিনীর দালাল ৫ টাকা নিয়ে আমাদেরকে ছেড়ে দেবে বলে আমার ভাইদেরকে জানায়। কিন্তু সেই সময় পাক বাহিনীর দালাল এবং চেয়ারম্যানের ছেলে এসে আমাদের কাছ হতে ১০ হাজার টাকা দাবী করে। তখন আমার ভাইয়েরা তা অস্বীকার করে এবং বলে যে এখন ৫ হাজার টাকা দিবেন ও পরে ৫ হাজার টাকা দিবেন। এই চুক্তি করে যখন তারা আমাদের নিকট যাচ্ছিল ক্যাপ্টেন স্বয়ং তখন আমাদের প্রহারে লিপ্ত। তাদের দেখে ক্যাপ্টেন সে দিকে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলো কেন এসেছ? তখন আমার ভাই রশিদ আহমদ আমাদের মুক্তির কথা বলার সাথে সাথে তাকেও প্রহার আরম্ভ করলো। পাক বাহিনীর দালাল যখন চুক্তির কথা বললো তখন ক্যাপ্টেনের মেজাজ একটু ঠান্ডা হয়ে গেল। তারপর ৫ হাজার টাকা নিয়ে আমাদের মুক্ত করে দিল। তার ৩ দিন পর দালালরা এসে বাকি ৫ হাজার টাকা নিয়ে যায়।


স্বাক্ষর/-

গোলাম হোসেন।


।। ২২১ ।।

মোঃ সফিকুর রহমান।

গ্রামঃ কাঞ্চন নগর।

থানাঃ ফটিকছড়ি।

জেলাঃ চট্টগ্রাম।


১৫/১১/১৯৭১ পাক বাহিনী আমাদের এলাকায় প্রবেশ করে। তারপর লুটপাট ও নির্যাতন আরম্ভ করে। তাঁদের ভয়ে মেয়েরা যখন ধান ক্ষেতের মাঝে লুকিয়ে পড়ে তখন হানাদার বাহিনী সেখানে গিয়ে তাদের উপর নির্যাতন চালায় এবং মেয়েদের গলার হাতের সোনার অলংকার গুলি জোরপূর্বক কেড়ে নেয়। ঐ দিন প্রায় ১৫/২০জন পাক বাহিনী ছিল।


২১/১১/১৯৭১ ইং প্রায় ২০০ জন পাক বাহিনী আমাদের এলাকায় প্রবেশ করে। তার ভেতর ১০/১৫ পাক বাহিনী এসে আমাকেসহ আরো ৪০০ শত লোককে ডেকে জমায়েত করে। প্রথম অবস্থায় তারা আরো কয়েকবার আমাদের এলাকায় আসে, তখন তারা আমাদের কাউকে কিছু বলে নাই। সেই জন্য তাদের ডাকে সবাই জমা হয়। তারপর সেখান হতে বেছে বেছে প্রায় ২০০ শত জন জোয়ান ছেলেকে লাইন করে। তারপর তোমাদের ভেতর কোন মুক্তিবাহিনী বা হিন্দু আছে কিনা? এই সময় আমাদের লাইন হতে একটি ছেলেকে লাইন করে। তারপর আমাদেরকে কালেমা পড়ার নির্দেশ দেয়া হয়। তারা আমাদেরকে এ কথাই বার বার জিজ্ঞেস করেছে যে তোমাদের ভেতর কোন মুক্তিবাহিনী বা হিন্দু আছে কিনা? এই সময় আমাদের লাইন হতে একটি ছেলে হিন্দু বলে স্বীকার করে। তখন তাকে বেয়নেট দিয়ে নানা জায়গায় কেটে কেটে হত্যা করা হয়। এ সময় উত্তর দিক হতে পাকবাহিনী আরো নয়জনকে ধরে আনেঃ

১। হেদায়তুল হক

২। নুরুল ইসলাম

৩। ফকির মুহাম্মদ

৪। ইদ্রিস আলম আরো ৫ জনের নাম জানি না।

তাদেরকে আমাদের পাশে ২০ গজ দুরে গুলি করে হত্যা করে। তারপর আমাদের গুলি করার জন্য প্রস্তুত হতে বলে। এমন সময় ৭নং ইউনিয়নের রাজাকার কমান্ডার আবু তাহের মিঞা আমাদের ভুল প্রমাণ করাতে পাক বাহিনী আমাদেরকে গুলি না করে চলে যায়। ঐ দিন পাক বাহিনী প্রায় ৫০/৬০টি বাড়ী জ্বালিয়ে দেয়। বাড়ী গুলি জ্বালাবার পুর্বে তারা লুটপাট করে নেয়।


স্বাক্ষর/-

মোঃ সফিকুর রহমান।

২২/০৭/১৯৭৩


।। ২২২ ।।

জোতিন্দ্র মোহন নন্দী।

গ্রামঃ ফতেয়াবাদ।

থানাঃ হাটহাজারী।


এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে পাক ফৌজ এই এলাকায় প্রবেশ করে। এই এলাকায় কোন প্রকার প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহন করা হয়নি। ৩০শে চৈত্র বিকাল ৪টার পরে পাক ফৌজ ফতেয়াবাদ গ্রামে প্রবেশ করে। নগেন্দ্র লালের মেয়েকে গুলি করে হত্যা করে। তার বাড়ী তখনই জ্বালিয়ে দেয়। তারপর আমার বাড়িতে আসে এবং আমার বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয় এবং লুটপাট করে নেয়। আমার ভাতিজা রণজিৎ লালকে গুলি করে হত্যা করে। এই গ্রামে মোট ৮ টি বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়। মন্দির ধ্বংস করে, গুলি করে হত্যা করে মোট ৭ জনকে। আগুনে জ্বালায় একটি শিশুকে। গ্রামের সব ঘরবাড়ি রাজাকাররা লুটপাট করে এবং রাজাকারদের অত্যাচার এখানে খুব বেশি ছিল।

স্বাক্ষর/-

জোতিন্দ্র মোহন নন্দী।

১২/০৭/১৯৭৩


।। ২২৩ ।।

শ্রী বণিক চন্দ্র।

প্রধান শিক্ষক, পটিয়া হাইস্কুল।

থানাঃ পটিয়া।

জেলাঃ চট্টগ্রাম।


১৪ই মে, শুক্রবার ১০টায় পাঞ্জাবীরা পটিয়ায় এসে স্থানীয় প্রাইমারী প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে স্থায়ী আস্তানা গাড়ে এবং ঐ দিন বিকালে পার্শ্ববর্তী দক্ষিণভূর্ষী ও কেলিশহর গ্রামে কিছু কিছু বাড়ী ঘর পুঁড়িয়ে দেয়। তারপর দিনেও তারা ঐ সমস্ত গ্রামে অত্যাচার চালায়।


১৫ মে শনিবার খবর পাই পরদিন রবিবার ওরা পটিয়া সংলগ্ন সুচক্রদণ্ডী গ্রাম জ্বালিয়ে দেবে।


এই খবর পেয়ে ১৬ই মে, রবিবার ভোরে ছেলেটিকে নিয়ে পটিয়া থেকে রিক্সা করে আবার বাড়ির দিকে রওনা হই। এখানে বলে রাখা ভালো, একজন ডাকাত আমার স্ত্রী এবং ভাইয়ের কাছ থেকে ২০০০ টাকা আদায় করে নিয়ে যায়। বাড়ীতে কিছু ধান ছিল, এই ধান বিক্রি করে তারা ডাকাতদের টাকা দেয়।


অতি ভয়ে ভয়ে ১৬ ও ১৭ই মে গ্রামে কখনো নিজ ঘর, কখনো অন্য বাড়িতে গোপনে কাটাই। ১৮ই মে মঙ্গলবার আমার জীবনের কালো দিন। ঐ দিন স্থানীয় গুন্ডারা, চেয়ারম্যান ও অন্যান্য দলীয় নেতাসহ পাঞ্জাবীরা ছনহারা, চাটরা, ধাউরডেঙ্গা, মঠপাড়া ও গুয়াতলি গ্রাম আক্রমন করে। ছনহারা গ্রামে প্রথমে ঢুকে বাড়িঘর জ্বালায় এবং পলায়নরত ৩ জনকে গুলি করে হত্যা করে ও কয়েকজনকে আহত করে।


আমি নিজ নিরাপত্তার জন্য একটা চামড়ার ব্যাগে নিত্যপ্রয়োজনীয় কিছু। জামাকাপড় ও শ’তিনেক টাকা নিয়ে গ্রামের পুর্বদিকে খালের নিকট ঝোপের কাছে আশ্রয় নিই। বাড়ির স্ত্রী, পুত্র, ছেলে মেয়ে যে যেদিকে পেরেছে ছিটকিয়ে পড়ে।


এমতাবস্থায় সকাল ৮টায় ৫/৬ জন গুণ্ডা প্রকৃতির লোক আমাকে আক্রমন করে। আমার সঙ্গে যা ছিল টাকা পয়সা, জামাকাপড়, ঘড়ি কলম ইত্যাদি কেড়ে নিয়ে যায়। আমাকে হত্যা করার জন্য গ্রামের দক্ষিণ দিকে রাস্তার পাশে বসিয়ে রাখে। এরা সব আমার পার্শ্ববর্তী জালিয়া পাড়া ও সর্দার পাড়ার লোক। আমাকে হত্যা করা হবে এই খবর পেয়ে জালিয়া পাড়ার কতিপয় বৃদ্ধ নরনারী দৌড়ে এসে আমাকে এদের কবল থেকে রক্ষা করে। আমি মুক্তি পেয়ে আবার পূর্বোক্ত স্থানে আশ্রয় নিই। ঐ খালের ধারে গ্রামের আবাল বৃদ্ধ বণিতা প্রায় ২০০ নরনারী শস্য ক্ষেতে, ঝোপের আড়ালে আশ্রয় নিয়েছিল। প্রায় ১টার সময় ছনহারা গ্রাম জ্বালিয়ে পাঞ্জাবীরা আমাদের গ্রামে ঢুকে ঘরবাড়ী পোঁড়ায়, জিনিসপত্র লুট করে। ৪ জন পাঞ্জাবী আমরা যেখানে ছিলাম সেখানে এসে বিভিন্ন স্থানে লুকায়িতদের তুলে নিয়ে পুকুর পাড়ে জমা করায়। এবার ধারণা হল হয়তো আমাদেরকে এক জায়গায় এনে গুলি করে মারবে, কিন্তু সৌভাগ্যের বিষয় আমাদেরকে বসিয়ে রেখে তারা খালের কূলে কূলে দক্ষিণ দিকে চলে যায় এবং খালের ভেতর কয়েকজনকে ছেড়ে দেয় এবং ৩ জনকে তুলে নিয়ে সদর রাস্তায় গুলি করে মারে। এদের নাম সারদা চরণ দে, বয়স ৬০, যোগেন্দ্রলাল মল্লিক, বয়স ৬০ ও গৌরাঙ্গ মল্লিক, বয়স ৩০/৩৫। পাঞ্জাবীদের সঙ্গে সবসময় স্থানীয় গুণ্ডারা ছিল। তারা পার্শ্ববর্তী ধাউরডেঙ্গা গ্রামের হিন্দুদের বাড়ী ঘর পুড়িয়ে দিয়ে সেখানেও ২/৩ জনকে হত্যা করে বেলা ২ টার সময় পটিয়া ফিরর আসে। মুক্তি পেয়ে বিকালে বাড়ী ফিরে দেখি বাড়িতে পোড়া ভিটা খাঁ খাঁ করছে। সে রাত্রিতে অন্য এক বাড়ীতে (যে বাড়িটিই শুধু পোড়া যায় নি) রাত্রি কাটাই। স্ত্রী-পুত্র-কন্যা যারা দিনের বেলায় এদিক-ওদিক ছিল রাত্রে এক জায়গায় ঐ বাড়িতে আশ্রয় নিই। অবশ্য এটাও সত্য কিছু কিছু স্থানীয় মুসলমান আমাদের নিরাপত্তার জন্য এগিয়ে এসেছিল, তাই বেঁচেছি। এতে প্রমান হয় দুনিয়ার সব মানুষ পশু নয়। প্রকৃত মানুষও আছে, নচেৎ ভগবানের সৃষ্টি বিফল হতো।


স্বাক্ষর/-

শ্রী বণিক চন্দ্র।

০৯/০৫/১৯৭৩


।। ২২৪ ।।

মোঃ আবুল কাশেম।

গ্রামঃ কচুয়াই।

ডাকঘরঃ চক্রশালা।

থানাঃ পটিয়া।

জেলাঃ চট্টগ্রাম।


আমার বোন মোছাম্মৎ আছিয়া বেগম বি.এ পূর্ব হইতেই একজন আওয়ামীলীগ কর্মী ছিলেন। জুন মাসের ৬ তারিখে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার সময় ৩ জন শান্তি কমিটির লোক ও ইউনিয়ন চেয়ারম্যান এবং ক্যাপ্টেনসহ ১২জন মিলিটারি আসিয়া আমাকে এবং আমার বোনকে তল্লাশী করে। সেই সময়ে আমার বোন নামাজে রত ছিলেন। তখন বাড়ি ঘেরাও করিয়া ক্যাপ্টেন বাড়ির ভিতর ঢুকিয়া পড়ে। ক্যাপ্টেন আমার বোনকে চিনিতে না পারিয়া তাহাকে জিজ্ঞাসা করে আবুল কাশেম ও আছিয়া বেগম কোথায়? তখন আমার বোন অন্য ঘরে পলায়ন করে। তাহার পর পাক বাহিনী প্রতিটি ঘরে ঢুকিয়া প্রতি ঘর হইতেই অন্য মেয়েদের অলঙ্কার ছিনাইয়া লয়। পরে নুরুল আলমকে ধরে। তাহাকে বলে যে আছিয়া ও কাশেমকে বাহির করিয়া দাও নইলে তোমাকে গুলি করা হইবে। কিন্তু আমার ভাই আলম আমাদের কথা না বলাতে তাহাকে বন্দুক দিয়া বেদম প্রহার করে। তাহারা আমার চাচা ডাঃ ইব্রাহিমকে ধরিয়া আমাদের কথা জিজ্ঞাসা করে। আমার চাচা তখন বলিয়াছেন যে, ওরা দুই জন আমার মেয়ের বাড়ি বাঁশখালিতে বেড়াইতে গিয়াছে। পাক বাহিনী তাহাকে মারপিট করিতে থাকে এবং বলে যে তাহারা কোথাও যায় নাই। তুই লুকাইয়া রাখিয়াছিস। তাহাকে যখন প্রহার করিতে করিতে অজ্ঞান করিয়া ফেলিল তখনো তাহারা তাহাকে মারধোর করেতিছিল। এমতাবস্থায় বাড়ির অন্যান্য সকলে আসিয়া তাহাদেরকে বলিল যে কাশেম ও আছিয়া বেড়াইতে গিয়াছে। তাহাকে একা না মারিয়া আমাদের সবাইকে মারিয়া ফেলেন। তখন পাক বাহিনী তাঁহাদেরকেই মারিতে লাগিলো। এমন সময় আছিয়া তাঁহাদের দুঃখ সহ্য করিতে না পারিয়া বাহির হইয়া আসে এবং বলে যে আমি আছিয়া। তখন সবাইকে ছাড়িয়া দেয় এবং তাহাকে জিজ্ঞাসা করে যে তোমার ভাই কাশেম কোথায়? তিনি বলেন যে আমার ভাই কাশেম শহরে দোকানে থাকে, বাড়িতে আসে নাই। তারপর তাহারা ও তাহার আব্বাকে কমল মুন্সির হাটে লইয়া আসে। সেখানে তাহাকে নানা প্রকার প্রশ্ন করে। বাজারের সকলেই যখন তাহার কথা ভালো বলে তখন পাক বাহিনী দুজনকেই ছাড়িয়া দেয়। তারপর রাজাকার বাহিনী পুনরায় আমার বাড়িতে যাইয়া আমার ভাই নুরুল আলমকে মারপিট করে এবং আমার বাড়িরর সিন্দুক ভাঙ্গিয়া প্রায় দুই হাজার টাকা লইয়া যায়।


তৃতীয় বার রাজাকার বাহিনী ও শান্তি কমিটির লোকসহ ১৫/১৬ জন গিয়া বাড়ি ঘেরাও করে। সেদিন তাহারা আমার ফুফুর নিকট হইতে ৫ ভরি অলংকার ও ২৭০ টাকা এবং আমার নুরুল আলমের নিকট হইতে ২০০ টাকা কাড়িয়া লয় ও আমার বোন আছিয়াকে পুনরায় তল্লাশী করে। তারপর তাহারা আমার মামির নিকট ও ভাবির নিকট হইতে ৩ ভরি অলংকার ও কিছু টাকা লইয়া যায়।


স্বাক্ষর/-

আবুল কাশেম

১০/০৫/১৯৭৩


।। ২২৫ ।।

শ্রী নীরদ বরণ চৌধুরী।

প্রধান শিক্ষক, আজগর আলী উচ্চ বিদ্যালয়।

গ্রামঃ পশ্চিম শাকপুরা।

থানাঃ বোয়ালখালী।

জেলাঃ চট্টগ্রাম।


আমি একজন স্থানীয় উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। বিগত ২০শে এপ্রিল ১৯৭১ ইং আমাদের গ্রামে পাক বাহিনী তাদের স্থানীয় দালালদের সহযোগীতায় অগ্নীসংযোগ, নারী ধর্ষণ, লুটতরাজ গুলি বর্ষণ আরম্ভ করে। ইহাতে আমাদের গ্রামের ৫৪ জন লোক মারা যায়। সেদিন সকালে আমি কয়েকজন ছাত্র-ছাত্রী লইয়া বসিয়া দেশের এই পরিস্থিতি লইয়া আলাপ আলোচনা করিতেছিলাম। এমন সময় কয়েকজন লোক আসিয়া আমাকে বলিল যে বড়ুয়া পাড়ায় পাক সৈন্য আসিয়া ঘিরিয়া ফেলিয়াছে এবং গুলি করিয়া লোক হত্যা আরম্ভ করিয়াছে। এই কথা শুনিয়া আমি আমার পাড়ার ছেলেমেয়েদেরকে উপদেশ দিলাম যে তোমরা কৃষক সাজিয়া মাঠে নামিয়া পড়। এইভাবে আমার গ্রামের ছেলেমেয়েরা অন্য গ্রামে যাইতে পারিলো। ইতিমধ্যে আমাদের গ্রামের দালালরা পাক বাহিনীকে লইয়া অত্র গ্রামে চলিয়া আসে এবং সমস্ত ঘরবাড়ী অগ্নীসংযোগ করিয়া ভস্মীভূত করিয়া দেয়। আমাদের গ্রামের অধিকাংশ লোক আসিয়া আমাদের গ্রামে বালিকা বিদ্যালয়ে আশ্রয় লইয়াছিল। সেই নিরাশ্রয় নাম না জানা নিহতদের উক্ত সংখ্যার মধ্যে ধরা হয় নাই।


আমি তখন আমাদের বাড়ীর সম্মুখে পুর্বদিকে পুকুর পাড়ে দাঁড়াইয়া আশ্রয় প্রাপ্ত ছেলেদের উপদেশ দিতেছিলাম। দালালের ছেলেরে আমাদের লক্ষ করিয়াছিল যে আমরা কোথায় লুকাইতেছিলাম। আমরা যেখানে লুকাইয়াছিলাম সেই জঙ্গলের পশ্চিম দিক হইতে আমাদের ঘিরিয়া ফেলিয়াছে। হঠাৎ মনে হইলো সকলে এক সঙ্গে এক জায়গায় লুকানো ঠিক হইবে না। তখন আমার কথা মত যে যেখানে পারিল লুকাইয়া পড়িল। আমি ও আমার ভাই চত্ত আচার্য্য উত্তর দিকে গিয়া ছোট্ট একটি জঙ্গলে আশ্রয় নিলাম। তখন চারদিকে ভীষণ অগ্নীসংযোগ ও গুলি বর্ষণ করিতেছিল। তখন আমি আমার পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করিতে পারি নাই। পাক বাহিনী অগ্নীসংযোগ করার পূর্বে আমাদের লুণ্ঠন করে। পাক বাহিনী যখন আমাদের গ্রাম ছাড়িয়া চলিয়া গেল তখন আমরা আবার গ্রামের দিকে চলিয়া আসিলাম। এমন সময় একজন পাক দালাল আসিয়া আবার প্রচার করিলো যে পাক বাহিনী আবার এই গ্রামে আসিতেছে। এই কথা শুনিয়া আমরা আবার পালাইতে আরম্ভ করিলাম। এমন সময় দালালের লোকেরা আমদের বাড়ির পোড়া টিন গুলি লইয়া গেল। তখন আমরা বুঝিতে পারিলাম যে পাক বাহিনীর কথা বলিয়া আমাদের ধোঁকা দিতেছিল। এই ঘটনার ঠিক চার দিন পর আবার পাক বাহিনী আসিতেছে এই কথা শুনিয়া আমি এবং ভাই চিত্ত আচার্য্য আমার এক মুসলিম ছাত্রের অভিভাবকের বাড়িতে আশ্রয় লইলাম। কিন্তু অল্পক্ষনে বুঝিতে পারিলাম যে এখানে নিরাপদ নয়। ওখান হইতে আবার বাড়ির দিকে চলিয়া আসিলাম এবং পরবর্তীতে কি কার্যক্রম হইবে তাহা চিন্তা করিতে লাগিলাম।


২০শে এপ্রিল রাত্রি ১২টা। এমন সময় একজন কৃষক লোক আসিয়া খবর দিল আমাদের এখানে থাকা নিরাপদ নয়। সেই কৃষক লোককে লইয়া রাত্রি ১ টার সময় বাহির হইলাম। ঘুরিতে ঘুরিতে যখন রাত্রি শেষ হইয়া গেল তখন কৃষক লোকটি আমাদের চরখিজিরপুর গ্রামে এক খামারের মধ্যে রাখিয়া আসিল। ঐখানে থাকিয়া আবার শুনিতে আমাদের বাড়ি (২১ শে এপ্রিল) আবার আক্রমণ করিয়াছে। আমার ভাইয়েরা আশ্রয় লইয়াছিল আধ মাইল দুরে অন্য একটি খামারে। আমাদের সংবাদ পাইয়া ২২শে এপ্রিল রাত্রি ৮টার সময় আমাদিগকে সেই খামারে লইয়া যায়। সেই খামারের পাশেই কর্ণফুলী নদী। ঐ কর্ণফুলী নদীতে পাক ফৌজ গান বোট লইয়া অনবরত পাহারা দিতেছিল। ঐ খামারে থাকা নিরাপদ নয় বলিয়া আমরা আবার বাঁশখালি থানার কালিপুর গ্রামে চলিয়া গেলাম। ঐ কালিপুর গ্রামে ৮/১০ দিন ছিলাম। কালিপুর গ্রামের পাক বাহিনীর দালালদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হইয়া উঠিলাম। সেখান হইতে আবার কানুনগো পাড়ায় আশ্রয় নিলাম এবং গোপনে বাড়ির সবাইকে অখানে লইয়া আসিলাম।


আমার এক ভাই ইঞ্জিনিয়ার। সে আমেরিকান ফার্মে চাকরি করিত। সেই ফার্মের আমেরিকান সাহেব আমাদেরকে তাহার গাড়িতে করিয়া চট্টগ্রামের (মিরসরাইয়ের) জোয়ালগঞ্জ পৌছাইয়া দেয়। আমরা ঐখান দিয়া ভারত সীমান্ত পার হইয়া ত্রিপুরা শরণার্থী শিবিরে গিয়া পৌছাই।


স্বাক্ষর /-

শ্রী নিরোদ বরণ চৌধুরী।


।। ২২৬ ।।

মোঃ আমিনুল হক।

গ্রামঃ পূর্ব গোমদস্তী

থানাঃ বোয়ালখালী।

জেলাঃ চট্টগ্রাম।


গোমদস্তী রেলওয়ে স্টেশনের উত্তর দিকে আমার বাড়ি। একরাত্রিতে মুক্তিবাহিনী আসিয়া মাইন পুঁতিয়া গাড়ি উড়াই দেয়। তারপর ভোর বেলায় পাক বাহিনী আসিয়া আমাদের গ্রাম ঘেরাও করে। গ্রাম ঘেরাও করিয়া প্রায় ৭০/৮০ জন লোককে গ্রেপ্তার করে। তার ভেতর আমি ছিলাম। আমার বয়স ৫৫ বছর, আমি একজন বৃদ্ধ লোক। পাক বাহিনী যে আমার উপর এতটা অত্যাচার করিবে তাহা আমার বিশ্বাস ছিল না। তাই সকালে ঘুম হইতে উঠিয়া ওজু করিয়া নামাজ পড়িতে বসিয়াছি এমন সময় একজন রাজাকার আসিয়া আমাকে ধরিয়া ফেলিল। তাহার সাথে পাক বাহিনীও ছিল। আমাকে ধরার পর আমার বাড়ি হইতে আরো চার জনকে গ্রেফতার করে। তাহারা আমাদিগকে এখান হইতে মারধোর করার পর পটিয়া ক্যাম্পে লইয়া যায়। সেখানে নিয়া আমাদিগকে এমনভাবে বন্দুকের বাঁট দিয়া এমনভাবে প্রহার করিল যে, আর হাঁটুবার বা উঠিবার মত শক্তি ছিল না। তাহারা আমাদিগকে মুক্তিবাহিনী এবং আওয়ামীলীগের লীডারদের কথা বার বার জিজ্ঞাসা করিয়াছে, তবুও আমরা কাহারো নাম বলি নাই। তখন পাক বাহিনী আমাদিগকে সন্ধ্যার পর ছাড়িয়া দেয়। আমরা অতি কষ্টে বাড়িতে আসি।


স্বাক্ষর/-

মোঃ আমিনুল হক।

৩০/০৪/৭৩


।। ২২৭ ।।

মোঃ অলি আহমদ

গ্রামঃ পূর্ব গোমদস্তী

থানাঃ বোয়ালখালী

জেলাঃ চট্টগ্রাম।


১৩ ই অগাস্ট মুক্তিবাহিনী ও গেরিলারা ১৪ই অগাস্টের পাকিস্তান দিবস বানচাল করার জন্য বালুর ঘাট দোহাজারী রেল লাইনে গোমদস্তী রেল স্টেশনের কালুরঘাটের নিকট আউট সিগন্যালের কাছে মাইন পুঁতিয়া রাখে রাত্রি বেলায়। রাত ৪ টার সময় পাক ফৌজ পটিয়ার দিকে রেল লইয়া যাইতে ইঞ্জিন উড়িয়া যায় এবং রেল লাইন ধ্বংস হয়।


১৪ অগাস্ট সকালে পটিয়া এবং কালুরঘাট হইতে আরো মিলিটারি আসিয়া রাজাকাররা সহ আমাদের গ্রাম ঘেরাও দেয়। তাহাদের ৩ জন লোক আসিয়া আমাকে ধরিয়া আড়মোড়া করিয়া হাত বাঁধিয়া রাইফেল দিয়া মারিতে মারিতে গাড়িতে উঠায়। তখন আমি, নুর আহমদ, আবদুল মজিদ সহ ৫৭ জনকে হাত ও কোমর বাঁধা অবস্থায় গাড়িতে তোলা হইতেছে এবং গাড়িতে তুলিয়া বেদম মার মারিতেছে। পটয়ায় লইয়া যাইয়াও বেদম মার – রাইফেল দিয়া মারায় আমি অজ্ঞান হইয়া পড়িয়াছিলাম। জ্ঞান হইলে দেখি সবাইকে সারিবদ্ধভাবে গুলি করিয়া মারার অবস্থা হইয়াছে। এমন সময় কালুরঘাট হইতে মেজর রশিদ আসিয়া আমার কাছ থেকে মুচলেকা লেখাইয়া লয় যে, আমাদের গ্রামের পাশের রেল লাইন আমাদের পাহারা দিতে হইবে। কোন ক্ষতি হইলে আমাদের গুলি করে মারা হইবে। নিজের জান বাঁচানোর জন্য কাগজে সই দিয়া সন্ধ্যার একটু আগে সবাই মুক্ত হইয়া বাড়ি ফিরি। ৫মাস ভোগার পর সারিয়া উঠি কিন্তু কাজ করিয়া খাইতে পারি না।


স্বাক্ষর/-

মোঃ অলি আহমদ

২৯/০৪/৭৩


।। ২২৮ ।।

সন্তোষ কুমার

গ্রাম- পশ্চিম শাকপুরা

থানা- বোয়ালখালী

জেলা- চট্টগ্রাম।


সে দিন ছিল ২০শে এপ্রিল। আমাদের পশ্চিম শাকপুরা গ্রামের উপর চলল পাক সেনাদের রক্ত নিয়ে হোলি খেলা আর নারী নির্যাতন ও অগ্নিসংযোগ। কি বীভৎস ঘটনা। আজ সে দিনের কথা মনে পড়লে আর মুক্ত বাংলার পবিত্র মাটিতে পাক সহযোগীদের এবং দালালদের বিনা বিচারে, বিনা সাজায় আমাদের গ্রামের উপর দিয়ে যাতায়াত করতে দেখলে আমাদের গা ছম ছম করে উঠে। যারা আমাদের গ্রামে হত্যা করেছিল, বাড়ি পুড়িয়েছিল, সম্পদ লুণ্ঠন করেছিল, নিরাপরাধ গ্রামবাসির গলায় ছুরি চালিয়েছিল তারাই আবার বাংলার পবিত্র মাটিতে বাস করছে।


২০ শে এপ্রিল সূর্য উঠার আগে অন্যান্য দিনের মত কয়েকজনকে পাহারায় দিয়ে আমরা একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ সবাই হৈ চৈ করে পালাতে লাগলো। শুনতে পারলাম পাঞ্জাবীরা আসছে। তখনই তাড়াতাড়ি যে যেদিকে পারি পালাতে লাগলাম। স্থানীয় মুসলমানদের বাড়িতে গেলে তারাও তাদের বাড়ি হতে নামিয়ে দিল। আমরা তখন অন্য দিকে সরে পড়লাম। পাক সেনারা তখন চারদিক দিয়ে আমাদের গ্রাম ঘিরে ফেললো। তারপর সারাদিন চলল আমাদের গ্রামের মানুষের উপর অত্যাচার। প্রতি বাড়িতে বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিতে লাগলো, এর সোনা রুপা, রেডিও মূল্যবান জিনিস হস্তগত করতে লাগলো এবং চললো অকথ্য নির্যাতন, ধর্ষণ, হত্যা, লুণ্ঠন – সবকিছু। গ্রামের যুবক বৃদ্ধ যাকে পেল তাকেই হত্যা, স্ত্রীর সামনে স্বামীকে, মায়ের সামনে ছেলেকে হত্যা করলো। আর করলো অগ্নিসংযোগ। চারদিকে শুধু গুলির আওয়াজ আর গুলি করার সাথে সাথে পাক সেনাদের পৈশাচিক হাসি।


সারাদিন পর বিকাল সাড়ে ৪টার পর তারা গ্রাম ছেড়ে দিয়ে চলে গেল। আমরা যারা দৌড়ে পলায়ন করেছিলাম তারা আসলাম গ্রামে, দেখলাম প্রায় বাড়িতে আগুনে ভস্মীভূত দালান ঘরের টিন গুলো পড়ে আছে। কয়েকজন সবে মাত্র গুপ্তস্থান হতে বের হয়ে আসলো। কারো মুখে কোন কথা নেই। পথ দিয়ে ঘুরতে লাগলাম। দেখলাম গুলি খেয়ে রাস্তার আশেপাশে, বাড়ীর প্রাঙ্গনে, নর্দমায় পড়ে আছে মৃত দেহ। কি এক হত্যাযজ্ঞ! সবাই আমার আত্নীয় স্বজন ও গ্রামবাসী। হায় এদের কি দোষ! কোনদিন দেখিনি এভাবে হত্যা। দেখলাম বাপ ছেলে এক সাথে এক বুকে গুলি খেয়ে ঘুমিয়ে আছে।


দেখলাম কারো চোখে জল নেই, আজ সবাই পাথর হয়ে গেছে। আরো দেখলাম স্ত্রী চেয়ে রয়েছে স্বামীর দিকে, মা তাকিয়ে রয়েছে মৃত সন্তানের দিকে। স্বামী তার স্ত্রীকে ডেকে বলার সময় পায় নি, মা সন্তানকে জাগিয়ে দেয়ার সময় পায় নি, বোন ভাইকে ডাক দেবার সময় পায় নি। কি পাশবিক হত্যা, নির্যাতন ও অমানুষিক অত্যাচার। আমার ভাষা নাই, আমি লেখক নই, প্রকৃত ঘটনার কিছু মাত্র লেখার চেষ্টা করছি। আর এ ঘটনাকে ভাষায় রুপ দেয়ার ভার আপনাদের।


তারপর গ্রামের কয়েকজন মৃতদেহের কিছু কিছু সৎকার করার নিস্ফল চেষ্টা করতে লাগলাম মাত্র। গ্রামে প্রায় ১৫০ জন লোক মারা গেল। যেই আমরা গর্ত খুঁড়তে লাগলাম আর অমনি প্রতিবেশী গুণ্ডারা লুট করার জন্য এগিয়ে আসতে লাগলো আর বলতে লাগলো পাক সৈন্য আবার আসছে। পুনরায় আমরা গ্রাম হতে বের হয়ে পড়লাম। এরই মধ্যে আমরা কোন রকমে এক গর্তের ভেতরে ১০/১২ জনকে মাটি চাপা দিলাম। আর সেই মুহুর্তে আমার মনে পড়লো হাতিয়ার ঘূর্ণিঝড়ে উপদ্রুত এলাকার কথা। সেখানে আমরা ওদের দাফনের কাপড় দিয়ে দাফন করেছিলাম কিন্তু আজ আমাদের গ্রামে এদের হিন্দু ধর্মের রীতি অনুসারে কাপড় দেয়া দুরে থাক আগুন পর্যন্ত দিতে পারছিনা।


পাক সেনাদের এই অত্যাচারের পরও আমরা কোন রকমে দু’একটা বাড়ি ছিল সবাই তার মধ্যে আশ্রয় নিয়ে বেঁচে থাকার চেষ্টা করতে লাগলাম। এভাবে এগুতে লাগলাম। সেই ৪ঠা এপ্রিলের পর থেকে দিনে পাক সেনা আর রাতে মুসলিম লীগ গুণ্ডা ও প্রতিবেশীর তিন দিক থেকে আক্রমন। রাত্রে চাল ডাল কোন রকমে দু’একটা খেয়ে সন্ধ্যা হওয়ার সাথে সাথে ঝোপে বা পানিতে ডুবে থাকা, কোন রকমে বাঁচার চেষ্টা, কিন্তু দিনের পর দিন চলল লুট আর নারী ধর্ষণ। তারা ধর্মের নামে আমাদের গ্রামের মন্দির প্রতিমা ইত্যাদি ধ্বংস করে দিল আর যাকে পেল তাকে মুসলমান হতে বাধ্য করলো। মুসলমান হলে থাকতে পারবে নতুবা কেটে ফেলবো। এভাবে কয়েকজনকে কেটেও ফেলল।


এরপর ২৩শে এপ্রিল আমাদের পশ্চিম গ্রামে আবার শুরু রক্তে খেলা, আর অবশিষ্ট বাড়ি গুলোতে আগুন লাগিয়ে দিল। পাকিস্তান কায়েম রাখার জন্য। ২৩শে এপ্রিল শাকপুরা গ্রামটা সম্পূর্ন ধ্বংস করা হয়েছে। সবাই মিলে সে দিন ভারতের দিকে রওনা হলাম।


স্বাক্ষর/-

সন্তোষ কুমার।


।। ২২৯ ।।

মোক্তার মোহাম্মাদ

পোষ্ট মাষ্টার

গ্রাম- পুছড়ী

থানা- বাঁশখালি

জেলা- চট্টগ্রাম।


শনিবার ৯ ই অক্টোবর ১৯৭১ ইং রাত ১০টা। মুক্তিবাহিনী সহ গ্রাম পাহারারত ছিলাম। নাপোড়া হইতে ঘুরিয়া সেখেরখিল হইয়া জালিয়া পাড়া রওনা হইতেছি। তখন আনুমানিক রাত বারো টা। উক্ত পাড়ায় অসংখ্য গোলাগুলির শব্দ শুনিয়া দ্রুত পেছন দিকে সরিয়া নাপোড়া পুকচালিয়া পাড়ায় চলিয়া আসি এবং এই পাড়ার দক্ষিন পার্শ্বে আসিয়া দেখিতে পাইলাম জালিয়া পাড়া দাউ দাউ করিয়া জ্বলিতেছে। মানুষ চিৎকার ও কান্নাকাটি করিয়া প্রাণভয়ে পাহড়ের দিকে পালাইয়া আসিতেছে। তখন সব মুক্তিবাহিনীকে বিদায় দিয়া একা আমি রহিয়া গেলাম এবং ব্যাপার সম্পূর্ন জানিয়া সকালে তাহাদের ক্যাম্পে জানাইবো বলিয়া কথা দিলাম। দেখিতে দেখিতে আগুন আরো বাড়িয়া গেল এবং জনসাধারণকে পালাইয়া বাঁচিবার জন্য ইশারা করিলাম।


১০ তারিখ ভোর ৫ টা হইতে না হইতে শুনিতে পাইলাম চতুর্দিকে অসংখ্য গোলাগুলির আওয়াজ। তখন আমি নিজে কিভাবে প্রান বাঁচাইবো চিন্তা করিয়া দ্রুত আমার বাড়ির পাশে পাহাড়ের জঙ্গলে আত্নগোপন করিয়া পরিস্থিতি লক্ষ করিতে লাগিলাম। কিছুক্ষণের মধ্যে দেখা গেল যে নাপোড়া সেখেরখিল আগুন আগুনময়। আরো দেখিলাম পাক হানাদারেরা চতুর্দিকে লোক খোঁজাখুজি করিতেছে এবং কতগুলি লোককে বন্দী করিয়া আমার বাড়ির দক্ষিণ পার্শ্বের রাস্তা দিয়া লইয়া যাইতেছে ও প্রতিটি বাড়ি তল্লাশী করিতেছে। পলায়নমান লোক দেখিয়া তাহাদিগকে গুলি করিতেছে। তখন আমি নিজেকে নিরাপদ না মনে করিয়া আরো গভীর জঙ্গলে ঢুকিয়া পড়িলাম। গোলাগুলির শব্দ বন্ধ হওয়ার পর আনুমানিক দুপুর বারটায় ধীরে ধীরে বাড়ির দিকে চলিয়া আসিলাম। বাড়ি আসিয়া জানিতে পারিলাম পাক হানাদারেরা চলিয়া গিয়াছে এবং সাথে বন্দি করিয়া কতক লোক তাহাদের ক্যাম্পে নিয়া গিয়াছে।


১৩ই অক্টোবর বুধবার পার্শ্ববর্তী মিরাপাড়া গ্রামের একজন দালাল আমার গোয়েন্দাগিরি জানিতে পারিয়া হানাদার ক্যাম্পে (চাম্বল) নালিশ করিয়া দেয়। ফলে ১৪ই অক্টোবর বৃহষ্পতি বার আনুমানিক বেলা নয়টায় সতের জনের মত পাক বাহিনী ও ত্রিশ জনের মত রাজাকার আমার পাড়া ঘেরাও করিয়া আমাকে ধরিয়া ফেলে এবং নাপোড়া বাজারে নিয়া আসে। সেখানে আমি দেখিতে পাইলাম আরো ৪ জন সেখেরখিল নিবাসী

(১) একরাম মিয়া

(২) হাজী শফর মুল্লুক

(৩) দানু মিয়া – পিতাঃ নজর আলী

(৪) আহমদ হোসেন – পিতাঃ দানু মিয়া ও আমি সহ পাঁচ জনকে একই রশিতে বাঁধিয়া তিন মাইল রাস্তা হাঁটাইয়া লয় ওবং পথে পথে মারধোর করিতে থাকে। আনুমানিক বেলা এগারটায় তাহাদের ক্যাম্পে পৌছার সাথে সাথে সকলের চোখ কাপড় দিয়া বাঁধিয়া ফেলে এবং একেকজন করিয়া রশি হইতে খুলিয়া নিয়া ৩/৪ জন হানাদার মিলিয়া একেকজনকে বেদম প্রহার করিতে থাকে সাথে সাথে উর্দু ভাষায় কি জিজ্ঞাসা করিতেছে বা বলিয়েছে তাহা কিছুই বুঝিতে পারিতেছিনা। আমি শুধু চিৎকার করিয়া আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করিতেছি “হে আল্লাহ আমাকে রক্ষা কর। বাবা মারিও না আমি আর সহ্য করিতে পারিতেছি না” এই কথা বলার সাথে সাথে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় পা উপরের দিকে ও মাথা নিচের দিকে করিয়া ক্যাম্পের ছাদের সাথের লটকাইয়া ফেলে। ইহাতে কয়েক মিনিটের মধ্যে আমি জ্ঞান হারাইয়া ফেলি। ফলে ইহার পর আর কি ঘটিয়াছে তাহা আমি জানিনা। যখন জ্ঞান ফিরিয়া আসে তখন বুঝিতে পারিলাম ছাদের উপরিভাগে ফ্লোরের উপরের রোদ্রের গরমে ঝলসাইয়া যাইতেছি। তখন আমি পানির পিপাসায় ও ক্ষুধায় খুব কাতর হইয়া পড়িয়াছি। নড়াচড়া করিতে পারিতেছিনা। সমস্ত শরীরে ব্যাথা ও ফুলিয়া গিয়াছে। তখন পানি পানি বলিয়া চিৎকার করিয়া খাওয়ার পানি চাহিলাম। এমন সময় একজন হানাদার আসিয়া আমার চোখের বন্ধন খুলিয়া দিয়া একটি বদনায় করিয়া পানি খাওয়াইয়া দেয় ও মাথা ধরিয়া সূর্য্যের দিকে চোখ করিয়া তাকাইয়া থাকার নির্দেশ দেয়। এইভাবে কয়েক মিনিট থাকার পর যন্ত্রণায় মাথা নাড়িয়া মুখ ফিরাইলে, তখন আরেক দফা মারধোর চলিল। সূর্য্যের দিকে তাকাইয়া থাকার অপারগতায় চোখে মরিচের গুঁড়া ছিটাইয়া দেয়। ইহাতে অসহ্য যন্ত্রণায় চিৎকার করিয়া কাঁদিয়া গড়াগড়ি করিতে থাকি। অনুরোধ করিতে থাকি যে আমাকে এই রুপ কষ্ট না দিয়া একেবারে গুলি করিয়া মারিয়া ফেল নতুবা বাঁধিন খুলিয়া দাও আমি ছাদের উপর হইতে লাফাইয়া পড়ি আত্মহত্যা করি। কিন্তু পাক বাহিনীর দালাল হানাদারদিগকে বলিয়া দেয় যে আমি আর আমার ভাই নাকি মুক্তিবাহিনী এবং আমাদের নিকট ছয়টা রাইফেল আছে এবং আমাকে গুলি করিয়া মারার অনুরোধ করিতে লাগিল। আমরা নাকি বাঁচিয়া থাকিলে তাহার জীবনের আশঙ্কা আছে। এই বলিয়া সে চলিয়া যায়। ইহার পর আরেক দফা আমার উপর শারীরিক নির্যাতন চলিল। আমি মৃতপ্রায় অবস্থায় পড়িয়া থাকিয়া মৃত্যুক্ষণ গুণিতে লাগিলাম। খোদার কৃপায় এমন সময় স্থানীয় শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান হানাদারদের সুবেদারসহ তথায় আসিয়া আমাকে সনাক্ত করিয়া নিয়া জামিন দিল এবং সাথে শর্ত দিল যে মুক্তিবাহিনীর একটি নাম তালিকা ও আমার ভাই আওরঙ্গজেবকে চার দিনের মধ্যে হাজির করিয়া দিতে হইবে নতুবা বংশের একজনও জীবিত রাখিবেনা। আমি তখন বাধ্য হইয়া তাহাদের নাগপাশ হইতে মুক্তি লাভের আশায় ইহা স্বীকার করিয়া মুক্তিলাভ করি। তারপর উক্ত ক্যাম্প হইতে একখানা রিক্সা করিয়া বাড়িতে চলিয়া আসি। শরীর ও চোখের চিকিৎসায় চার দিন কাটাইয়া একটু আরোগ্য লাভ করিয়া বাড়ি হইতে পলাইয়া গিয়া নিরাপদ জায়গায় আশ্রয় লইলাম। ইহারও দু’একদিন পর হানাদাররা চাম্বল হইতে ক্যাম্প উঠাইয়া উত্তর বাঁশখালি গুনাগরি ক্যাম্পে চলিয়া যায় এবং রাজাকার বাহিনী মোতায়েন করিয়া আমাদের গ্রামে ক্যাম্প করিয়া দেয়।


স্বাক্ষর/-

মোক্তার মোহাম্মদ


।। ২৩০ ।।

শ্রী বিমল কান্তি গুহ

গ্রাম- নাপোড়া

থানা- বাঁশখালি

জেলা- চট্টগ্রাম।


৯ ই অক্টোবর পাক হানাদার বাহিনী দ্বিতীয়বার বাঁশখালিতে আসে এবং গুনাগরীতে একটি আস্তানা করে। ঐ দিন তারা লোকজনের উপর কোন অত্যাচার করে নাই। কিন্তু নাপোড়া গ্রামের লোকরা পাঞ্জাবী আসার খবর পেয়ে স্ত্রী পুত্র আত্মীয়স্বজন সবাইকে নিয়ে পাহাড়ে চলে যায় এবং সন্ধ্যার পূর্বে বাড়িতে চলে আসে।


১০ অক্টোবর তারিখে ভোর পাঁচটার সময় পাক বাহিনী আমাদের গ্রামটার পূর্ব জঙ্গলের দিক হতে আক্রমণ করে। আমাদের গ্রামের লোকরা আর জঙ্গলের দিকে পালাইতে পারে নাই। নিরীহ নিরস্ত্র জনসাধারণের উপর নির্বিচারে গুলি বর্ষণ করে। আমি যখন আমার পরিবার পরিজন নিয়ে জঙ্গলের দিকে পালাচ্ছিলাম তখন একটা গুলি আমার হাতের ব্যাগের মধ্যে পড়ে এবং ব্যাগটা ছিঁড়ে হাত থেকে পড়ে যায়। আমার সামনে একজন মহিলা দুগ্ধপোষ্য শিশুসহ গুলিবিদ্ধ হয়, কিন্তু দুরে গিয়ে দেখি আরো তিন জন গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়ে আছে। স্ত্রী, পুত্র, আত্মীয়স্বজন কে কোথায় জানিনা, দূর পাহাড়ে চলে যাই। গ্রাম তখন জ্বলছে, লুটপাট চলছে, ধোঁয়ার কুণ্ডলী পাহাড় থেকে দেখা যাচ্ছে। আমার মত অনেকেই পাহাড়ের মধ্যে ঘোরাফেরা করছে। সকলের মুখে হতাশার ছবি। সবাই বলাবলি করছে মা, বাপ, ভাই সবাই মারা গেল, অবশিষ্ট কেউ নাই, খাওয়া দাওয়া নাই, অনেক লোক একত্রিত হয়েছি। গ্রামের খবরাখবর নেয়ার চেষ্টা করছি। কেউ কেউ তাদের ছেলেমেয়ে, স্ত্রীকে জঙ্গলে খোঁজ করছে, আমিও আমার স্ত্রী, একজন ছেলেকে ও এক বছরের ভগিনীকে খোঁজ করতে লাগলাম কিন্তু কোথাও পাওয়া গেল না। অনেকে স্বান্তনা দিচ্ছে পাহাড়ের কোনখানে আছে।


তিন দিন খোঁজাখুঁজির পর রেজাকাঠা নামক স্থানে তাদের সাথে আমার সাক্ষাৎ হয়। দু’দিন ধরে তারা কিছু খায় নাই। তাদেরকে দেখে আমার ভীষণ কান্না এসে পড়লো, স্ত্রী, পুত্র নিয়ে আমি বেঁচে আছি দেখে আনন্দে কেঁদে উঠলাম, আমার ছেলেটিও কাঁদতে লাগলো। তারপর আমি ছেলেমেয়ে নিয়ে গ্রামে আসার প্রস্তুতি নিচ্ছি। গ্রামে এসে দেখি বেশ কিছু লোক আছে। বর্বর পাক বাহিনীর হাতে মারা গেছে আমার বাড়ির পাশের ৫ জন লোক। কে? কোথায়? কিভাবে মারা গেছে তা কেউ ঠিক করে বলতে পারছে না।

যেদিন আমরা নাপোড়া বাড়িতে আসলাম, সেদিন কয়েকজন পাঞ্জাবী সেনাবাহিনী দক্ষিণ হতে জনাব একরাম মিয়া, তার ভাই দানু মিয়া ও মোক্তার আহমেদকে শরে নিয়ে নাপোড়া বাজারে রেখে গ্রামের ভেতর ঢুকলো। আমি তখন বাইরে ছিলাম। দুর থেকে বর্বর হানাদারদের দেখেছিলাম। আমার স্ত্রীও বাইরে ছিল, তাকে ইশারা করে আমি নাপোড়া বাড়ির পাশ দিয়ে চলে গেলাম। আমার স্ত্রী অন্য দিক দিয়ে অন্য জায়গায় চলে গেল। পর মুহুর্তেই দুর্বৃত্তরা আমার বাড়িতে ঢুকে পড়ে অন্যান্য যারা ছিল তাদের উপর ভীষণ মারধোর করে। আমার ভাগনী বাসন্তী রাণীর কাছে লুকায়িত বিষ ছিল। তার সতীত্ব রক্ষার জন্য কোন উপায় না দেখে সে বিষ পান করলো! দু’ঘন্টার মধ্যে সে প্রাণ ত্যাগ করে। আমার ভাগনী দ্বিতীয় বিভাগে মেট্রিক পাশ করেছিল। রাত্রে এসে আমার ভাগনীকে মৃত অবস্থায় দেখে চোখের জল ধরে রাখতে পারলাম না। রাত্রিতে গ্রামের দুই একজন লোককে ডেকে বাসন্তী রাণীকে কবর দেই।


এটা ছিল আমার গ্রামের কাহিনী।


স্বাক্ষর/-

শ্রী বিমল কান্তি গুহ।


।। ২৩১ ।।

মোঃ সামসুল হক

সহকারী হিসাব রক্ষক

বাংলাদেশ রেলওয়ে

পাহাড়তলী, চট্টগ্রাম।


১০ ই নভেম্বর। সেদিন ছিল ২০ রমযান। পাহাড়তলীতে বাঙ্গালী মা বোনদের উপর বিহারী ও পাক সেনারা যে নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালাইয়াছিল দুনিয়ার স্বাধীনতার ইতিহাসে তা বিরল।


১০ ই নভেম্বর খুব সকাল বেলা পাহাড়তলীর পাঞ্জাবী লাইন, ওয়্যারলেস কলোনী, বাহাদুর শাহ কলোনীর শিশু, যুবক, যুবতী, নারী, পুরুষ, বৃদ্ধকে কলোনীর বাসা হইতে জোরপূর্বক ধরিয়া আনে এবং কাহাকে কাহাকে মিলিটারি অফিসার সাহেব ডাকে বলিয়া ধোঁকা দিয়া ওয়্যারলেস কলোনীর নিকটস্থ পাহাড়ে দল বাঁধিয়া নিয়া যায়। সেখানে জল্লাদেরা ধারালো অস্ত্র ও স্বয়ংক্রীয় অস্ত্র দিয়া দয়ামায়াহীন অবস্থায় হত্যাযজ্ঞ চালায়। সকাল হইতে বেলা ৩ টা পর্যন্ত এই হত্যাযজ্ঞ অব্যাহত থাকে।


আমরা কয়েকজন আবছার উদ্দিন, আবদুস ছোবাহান ও মোঃ ছাবেদ মিয়া হত্যাযজ্ঞ পাহাড়ের জঙ্গল হইতে দেখিতে পাই। সাথে সাথে ডবলমুরিং থানার সহিত যোগাযোগ করি। কিন্তু তাহার ছলচাতুরী করিয়া আমাদিগকে বিদায় করে।


দুপুরে মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী ও পি.ডি.বির দালালদিগকেও এই নৃশংস হত্যাযজ্ঞের কথা বলিয়াছি। সেই দিন নর ঘাতকরা এক এক বারে আনুমানিক দুইশত লোককে হত্যা করিয়া তাহাদের শরীরের কাপড়গুলি একত্রিত করিয়া পেট্রল দিয়া আগুন জ্বালাইয়া দিয়াছিল।


১০ ই নভেম্বর ৩ টার সময় একজন সামরিক অফিসার সহ অনেকেও ওয়্যারলেস কলোনী দেখিতে আসে। সাথে সাথে আমরা প্রায় তিনশত লোক তাহাদের সাথে উক্ত জায়গায় গিয়া পোঁছাই। হাজার হাজার নারী পুরুষের লাশ পড়িয়া আছে। কোথাও কোথাও মৃতদেহ গুলি একত্রিত করিয়া পেট্রোল দিয়া জ্বালাইয়াছে।


এই হত্যাযজ্ঞ দেখিয়া পাঞ্জাবী সামরিক অফিসার ও তাদের দালালরাও ঠিক থাকিতে পারে নাই। নরপশুরা আত্মীয়স্বজন কে লাশ দিতে অস্বীকার করে। পাহাড়ের উপরে নির্লজ্জ অবস্থায় অনেক যুবতী ও নারীদেহ ক্ষতবিক্ষত অবস্থায় পড়িয়া আছে। এমনিভাবে মা বোন দিগকে নির্মমভাবে হত্যা করা হইয়াছে।


স্বাক্ষর/-

মোঃ সামসুল হক।

৭/৪/৭৩


।। ২৩২ ।।

মোঃ ইদ্রিস

গ্রামঃ জোয়ার কাছাড়

থানা- ফেনী

জেলা- নোয়াখালী।


পাক বাহিনী অত্র এলাকায় প্রবেশ করিয়া দালালদের সহযোগীতায় প্রায় প্রতি গ্রামে প্রবেশ করে এবং আকস্মাৎ আওয়ামীলীগ নেতৃবৃন্দের বাড়ি আক্রমন করিয়া তাহাদের বন্দি করিয়া শিবিরে লইয়া আসে এবং প্রকাশ্যে রাস্তার উপর দাঁড় করাইয়া গুলি করিয়া হত্যা করে। ইহা ছাড়া তাহারা প্রতি গ্রাম হইতে দালালদের সহযোগীতায় রাজাকার তৈরী করে। পরে উক্ত রাজাকারদের সহযোগীতায় গ্রামে গ্রামে প্রবেশ করিয়া নিরীহ জনগণকে হঠাৎ আক্রমন করিয়া গুলি, বেয়নেট চার্জ, লাঠি চার্জ বিভিন্ন উপায়ে হত্যা করে। পাক সেনারা প্রায় ৪৯ জন লোককে হত্যা করিয়াছে।


নিহতদের মাঝে কিছু সংখ্যকের নাম উল্লেখ করা যায়, যেমনঃ

১। মোমিনুল হক

২। তারিকুন নেসা বেওয়া

৩। আমিনুল হক

৪। আবুল খায়ের

৫। হোসনে আরা বেগম

৬। মোহছেনা বেগম

৭। হাজেরা খাতুন

৮। সুলতান আহমদ

৯। মুজা মিঞা

১০। মুকবুল

১১। অহিদুর রহমান

১২। আবদুল গফুর

১৩। ওবায়দুল হক

১৪। আমিনুল হক

১৫। সামসুল হক

১৬। আব্দুস সালাম

১৭। ইয়াকুব আলি

১৮। আবদুল বারিক

১৯। জুলেখা খাতুন ইত্যাদি।

ইহা ছাড়া পাক বাহিনীরা এই এলাকায় বহু অপরিচিত লোক বন্দি করিয়া প্রকাশ্যে দাঁড় করাইয়া গুলি করিয়া হত্যা করিয়াছে। মঠবাড়িয়ার জনাব হানিবউল্লাহ পাক বাহিনীর অত্যাচার হইতে আত্নরক্ষার জন্য তাহার নিজ বাড়িতে বাঙ্কারে স্বপরিবারে আত্মগোপন করেন। কিন্তু পাক বাহিনী তাহাদের ধরিয়া ফেলে। পরে তাহাদের বেয়নেট চার্জ করিয়া হত্যা করে।


পাক বাহিনীরা এই ইউনিয়নের বহু নারীর ইজ্জত হরণ করিয়াছে। ধর্মপুর ইউনিয়নে পাক সেনারা এই এলাকার জনাব আহসান সাহেবের উপর পৈশাচিক ব্যবহার করিয়া তাহাকে গুলি করিয়া হত্যা করিয়াছে। ঘটনার বিবরণে প্রকাশ যে জনাব আহসান সাহেব মুক্তি বাহিনীদের সাহায্য করিতেন। এই জন্য স্থানীয় শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান ও মেম্বার তাহার উপর অত্যাচার করিতে থাকে। অবশেষে দালালদ্বয় তাহার নাম পাক সেনাদের নিকট জানাইলে, তিনি আত্মরক্ষার জন্য বন্ধু রাষ্ট্র ভারতে আশ্রয় গ্রহন করেন। কিন্তু দালালরা তাহাকে সেখান হইতে রাত্রিতে গোপনে ধরিয়া আনিয়া পাক সেনাদের নিকট হস্তান্তর করে। পাক সেনারা তাহার উপর প্রায় ৫ দিন ধরিয়া দৈহিক নির্যাতন চালায়। অবশেষে তিনি নিজের দোষ স্বীকার না করায় তাহাকে পাক সেনারা গুলি করিয়া হত্যা করে।


পাক সেনারা অনুরুপভাবে মজলিশপুর গ্রাম হইতে জনাব আবুল খায়ের নামক একজন মুক্তিবাহিনীর বাড়ি আকস্মাৎ আক্রমণ করিয়া তাহাকে বন্দি করিয়া পাক সেনাদের শিবিরে লইয়া আসে। পরে তাহাকে ঝুলন্ত অবস্থায় বেত্রাঘাত করিয়া তাহার নিকট হইতে মুক্তি বাহিনীদের গোপন তথ্য জানিতে চেষ্টা করে। প্রায় ৫ দিন ধরিয়া তাহার উপর দৈহিক নির্যাতন চালাইবার পর পাক সেনারা তাহার নিকট হইতে কোন সংবাদ জানিতে না পারিয়া তাহাকে জ্যান্ত কবর দিয়া হত্যা করিয়াছে।


পাক বাহিনী ধর্মপুর ইউনিয়নে রাজাকার ও দালালদের সহযোগীতায় প্রতিটি গ্রামে প্রবেশ করিয়া নিরীহ জনসাধারণের বাড়িতে অগ্নীসংযোগ করে। তাহারা এই এলাকায় প্রায় ৫ টি গ্রামে অগ্নীসংযোগ করিয়াছে। ধর্মপুর, জোয়ার কাছাড়, মঠবাড়িয়া, পদুয়া, মজলিশপুর। যে সমস্ত গ্রামে প্রবেশ করে নাই, সে সমস্ত গ্রামে বাস্তুত্যাগী জনগনের বাড়িঘরের ছাদের টালি, দরজা জানালা প্রভৃতি রাজাকার ও দালাল কর্তৃক লুণ্ঠন করিয়া লইয়া গিয়াছে। ইহা ছাড়া পাক সেনারা অত্র এলাকার বহু রমণীর শরীর হইতে সোনার গহনা ছিনাইয়া লইয়া গিয়াছে।


পাক বাহিনী এই এলাকায় গণহত্যা, নারী ধর্ষণ, অগ্নীসংযোগ ও লুটতরাজ করিয়াই ক্ষ্যান্ত হয় নাই। তাহারা ধর্মীয় স্থানের প্রতিও কলঙ্ক লেপন করিয়াছে। পাক সেনারা এই এলাকার প্রতিটি হিন্দু মন্দির ধ্বংস করিয়া ফেলিয়াছে। জোয়ার কাছাড় গ্রামে পাক সেনারা আবদুল আলিকে মসজিদে নামাজরত অবস্থায় আকস্মাৎ আক্রমন করিয়া গুলি করিয়া হত্যা করিয়াছে।


স্বাক্ষর/-

মোঃ ইদ্রিস।


।। ২৩৩ ।।

আফিজা খাতুন

গ্রাম- দঃ খানে বাড়ি

ডাকঘর- শর্শদী বাজার

জেলা- নোয়াখালী।


আমি অতিশয় দরিদ্র পরিবারে অসহায় নারী। বিগত স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় বাড়িতে ছিলাম। সংগ্রামের প্রথম দিকে এক গ্রাম হইতে অন্য গ্রামে আত্মীয় পরিজনের বাড়িতে আত্মগোপন করিয়া ছিলাম। আর্থিক অবস্থাহীন বলিয়া সীমান্ত অতিক্রম করিতে পারি নাই। বৃদ্ধ পিতা সম্পত্তিহীন কৃষক ছিল। অপরের সম্পত্তি চাষ করিয়া ও দৈনিক মজুরি দিয়া অতি কষ্টে দিন যাপন করিত।


সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম দিকে পাক বাহিনী দঃ খান বাড়ি গ্রামের নিকট অকাতরে রকেট শেলিং করতেছিল। তখন আমার পিতা জুলু কামাল মিঞা মাঠে জমি চাষ করতেছিল। অকাতরে রকেট শেলিং করিতে দেখিয়া ভয়ে জ্ঞান হারাইয়া মাঠে শাহাদাৎবরণ করেন।


পিতার অকালে মৃত্যুর পর আমার পরিবারে দুঃখের চাপ নামিয়া আসে। অন্যদিকে ফেনী থানায় পাক বাহিনীর নৃশংস অত্যাচারে অত্যাচারিত হইয়া আমার প্রায় সকল আত্মীয়স্বজন ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে আশ্রয় গ্রহন করে। আমি অর্থের অভাবে নিজ বাড়িতে বৃদ্ধ মাতা ও ছোট ভাইকে নিয়া ছিলাম।


অক্টোবর মাসে পাকবাহিনী শর্শদী বাজারে শিবির স্থাপন করে। পাক বাহিনী, রাজাকার ও দালালরা উক্ত এলাকার গ্রামের গ্রামের পর গ্রাম জ্বালাইয়া দিতে থাকে। অস্থায়ী সম্পত্তি লুটতরাজ করিয়া নিয়া যায়।


নভেম্বর মাসের প্রথম দিকে স্থানীয় রাজাকারদের সহযোগীতায় পাক বাহিনী আমার বাড়ি ঘেরাও করে। হঠাৎ আক্রমনের ফলে আমাদের পক্ষে আত্মগোপনের সুযোগ হয় নাই। আমি ভয়ে ঘরের গোলার নিচে পালাইয়া থাকি, কিন্তু রাজাকার ও পাক বাহিনীর পিশাচরা ঘরে ও বাহিরের সকল কিছু তন্ন করিয়া পরীক্ষা করে এবং আমাকে গোলার নিচ হইতে টানিয়া বাহির করে। পাক নরপশুরা আমাকে দেখিয়া আনন্দে উৎসাহিত হইয়া উঠে ও রাজাকারকে একটি ১০ টাকার (দশ) নোট হাতে দিয়া ঘর হইতে বাহির করিয়া দেয়। আমি নরপিশাচ দিগকে দেখিয়া ভয়ে চিৎকার করিতে থাকি, কিন্তু কাহাকেও সাহায্যে আসিতে দেখলাম না। আমার ভীষণ চিৎকার দেখিয়া তাহারা বেয়নেট বাহির করিলে আমি তাহাদের পায়ে জড়াইয়া ধরিলাম এবং বহু বিনয়ের সহিত আমার পিতার মৃত্যুর কথা বলিলাম। আমি আপনাদের বোন, আমার চরিত্রে আপনারা কলঙ্ক লেপন করিবেননা। আমি দরিদ্র মেয়ে। আমার মা বহুবার তাহাদিগকে অনুরোধ করিল। ক্রন্দন করিল, তোমাদের ও তো মা বোন আছে, কিন্তু নরপিশাচরা আমার মাকে পায়ে লাথি মারিয়া ঘর হইতে বাহির করিয়া দিল এবং ঘরের দরজা দিয়া ফেলিল। আমার ভীষণ চিৎকার, আকুতি মিনতি তাহাদের হৃদয়ে একটুও মায়ার সৃষ্টি করিল না। দুই জন পাক নরপিশাচ আমার উপর নির্মমভাবে অত্যাচার করিল। নরপিশাচদের অত্যাচারে আমি জ্ঞান হারাইয়া ফেলি। প্রায় ৬ ঘন্টা পরে গভীর রাত্রে জ্ঞান ফিরিয়া আসিয়াছে আর পাশে দেখি আমার অসহায় মা মাথায় পানি দিতেছে। নির্মম অত্যাচারে আমার স্বাস্থ্য খারাপ হইয়া পড়ে। আমার অসুস্থ্য শরীরের উপর এইভাবে তিন দিন অত্যাচার করে এবং প্রতিদিন আমি জ্ঞান হারাইয়া ফেলি। রাজাকার আমাদের কড়া পাহারা দিতে থাকে। তিন দিন পর একদিন গভীর রাত্রে মা ও ছোট ভাইকে নিয়া বাড়ি হইতে অন্য গ্রামে পলায়ন করি। ডিসেম্বর মাসের প্রথম দিকে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর দেশে ফিরিয়া আসি এবং জানিতে পারি মুক্তিযোদ্ধারা সেই রাজাকার ওসমান আলীকে হত্যা করিয়াছে।


টিপসহি /-

আফিসা খাতুন।


।। ২৩৪ ।।

আব্দুল গোফরান

গ্রাম- পদিপাড়া

থানা- বেগমগঞ্জ

জেলা- নোয়াখালী।


২২ শে এপ্রিল ১৯৭১ সালে মাইজদি এবং চৌমুহনী বাজারে পাক সৈন্য প্রবেশ করে। আমি তখন হোটেল জায়েদীতে কাজ করি। পাক বাহিনী যখন প্রবল বাধা সত্ত্বেও চৌমুহনী বাজারে প্রবেশ করিল, তখন আমি মন স্থির করিলাম যে, কি করিয়া এই বাজার হইতে বাহির হইয়া যাইতে পারি। যখন দেখিলাম যে পাক বাহিনী রাস্তার ভেতর নাই, তখন আল্লাহর নাম স্মরণ করিয়া এক পা দু পা করিয়া হাঁটতে আরম্ভ করিলাম। কিছু দুর যাওয়ার পর একজন পাক দস্যু আসিয়া আমাকে বলিল হ্যান্ডস আপ। হ্যান্ডস আপ অর্থ কি বুঝিতে না পারিয়া সোজা হইয়া দাঁড়াইয়া রহিলাম। পাক দস্যু আসিয়া আমাকে ভীষণভাবে আমাকে চপেটাঘাত করিল। চপেটাঘাত করিবার পর আমি মাটিতে পড়িয়া যাই। যেখানে পড়িয়া যাই ঐখান হইতে আমাকে চৌমুহনী প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের উত্তর পাশের রোডে নিয়া আসে। এখানে আনিয়া আমাকে বার বার দু প্রশ্ন করে যে, মুক্তিবাহিনী কোথায়? আমি বলি মুক্তিবাহিনী দেখি নাই। আমার জবাবে আশ্চার্যন্বিত হইয়া বলে বেটা মুক্তিবাহিনীকে মাছ ভাত দিতে পারিস আর এখন বলিস মুক্তিবাহিনী দেখি নাই। তৎক্ষণাৎ পাক নরপশু তাহার বেয়নেট বাহির করিয়া আমার ডান হাতের একটা আঙ্গুল তুলিয়া ফেলে এবং বলে এখন সত্যি কথা বল। আমি বলি না হুজুর আমি মুক্তিবাহিনী দেখি নাই। তখন আবার ডান হাতের তালু চিদ্র করিয়া দিল। এমন অবস্থাতেও আমি বলি নাই মুক্তিবাহিনী কোথায়।


স্বাক্ষর/-

আব্দুল গোফরান

২১/১/৭৩


।। ২৩৫ ।।

জামাল মিঞা পাটোয়ারী।

গ্রাম- পটিকা

থানা- বেগমগঞ্জ

জেলা- নোয়াখালী।


১২/৫/৭১ রোজ মঙ্গলবার বেলা আনুমানিক ১২ ঘটিকার সময় বাড়িতে পাক বাহিনী হামলা চালাইলে আমি তাহাদের হাতে ধরা পড়ি। কে বা কাহারা আমার মেজ ছেলে রুহুল আমিনের নাম পাক বাহিনীদের নিকট দেওয়ায়, পাক বাহিনী আমার ছেলে রুহুল আমিনকে খোঁজ করে এবং আমাকে তাহার সম্পর্কে বহু কিছু জিজ্ঞেস করে। আমি তাহার সম্পর্কে সব কিছু অস্বীকার করিলে তাহার রাইফেল দ্বারা আমাকে বেদম প্রহার করে। তাহা ছাড়া পা দ্বারা বুকে লাথি মারে। আমি তাহাদের অনুরোধ করিলে তাহারা আমার উপর আরো কঠোর নির্যাতন চালায় ও আমার ঘর দরজা পোড়াইয়া দিয়া আমাকে মৃতপ্রায় ফেলিয়া যায়। তারপর আমার বাড়ির অন্যান্য লোকজন বাড়ি আসিলে আমাকে অজ্ঞান অবস্থায় দেখিয়া ডাক্তার লইয়া আসে। ডাক্তার আমাকে ঔষধ পত্র ও ইঞ্জেকশন দেওয়ার পর জ্ঞান ফিরিয়া আসে। পাক হানাদার বাহিনী মাঝে মাঝেই আমার বাড়িতে মেঝ ছেলে রুহুল আমিনকে খোঁজ করিত।


স্বাক্ষর/-

জামাল মিঞা পাটোয়ারী।


।। ২৩৬ ।।

মোঃ আনছার আলী

গ্রাম- করিমপুর

থানা- বেগমগঞ্জ

জেলা- নোয়াখালী।


২২ শে এপ্রিল ১৯৭১ সনে মুক্তিবাহিনীর প্রতিরোধ করা সত্ত্বেও পাক বাহিনী মাইজদি ও চৌমুহনী বাজারে প্রবেশ করে। পাক বাহিনী চৌমুহনীতে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে বাজারে কারফিউ জারি করে। তখন আমরা দোকানপাট বন্ধ করিয়া ঘরের মধ্যে বসিয়া থাকি। এই সময় আমি গুলশান চায়ের দোকানে কাজ করি। যখন কারফিউ শেষ হইলো তখন আমি দোকানে চা তৈরি করিতেছি। এমন সময় পাক নরপশুরা আমাদের দোকানে প্রবেশ করিল। দোকানে আসিয়া আমাকে বলিল বেটা একটা চা দে তো। অমনি আমি একটা চা তৈরি করিয়া দেই। চা পান করার পর আমাকে বার বার প্রশ্ন করে বেটা তোরা তো মুক্তিবাহিনীকে ভাত, মাছ দিয়াছিস, বল এখন মুক্তি কাহা হায়? আমাকে পাক বাহিনী বলে ঝুট নেহি বলতা হায়। আমি বলি না হুজুর আমি মুক্তিবাহিনী দেখি নাই। এই বলার সঙ্গে সঙ্গে পাক দস্যু আমার উপর ভীষনভাবে রাগান্বিত হইয়া বলিল ভাত মাছ দিতে পারিস আর এখন বলিস মুক্তিবাহিনী দেখিস নাই। এই কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে আমার শরীরের প্রতি লক্ষ করে এবং গুলি করে। গুলি আসিয়া আমার উরাতের ভেতর প্রবেশ করে। আমি তখন জ্ঞান হারাইয়া মাটিতে পড়িয়া যাই এমন সময় দুইটা লোক আমাকে দোকানের ভেতর প্রবেশ করায়। আমাকে দেখিয়া তাহারা বলাবলি করিতে লাগিলো যে লোকটা বাঁচিতে পারে। এই লোক দুইটা আমাকে চিনিত, তাহারা আমাকে ধরিয়া বাড়িতে নিয়া যায়। কিছুক্ষণ পর ধীরে ধীরে আমার বাড়িতে লোকজন আসিতে লাগিলো। তখন আমি আমার পাড়া প্রতিবেশী নজীর উদ্দিনকে ডাকিয়া বলি ভাই আমার জমি তোমায় লিখিয়া দিবো, তুমি আমার চিকিৎসার ব্যবস্থা করিয়া দাও। এই কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে মোঃ নজির উদ্দিন চৌমুহনী বাজার হইতে ডাক্তার ডাকিয়া আমার চিকিৎসার ব্যবস্থা করিয়া দেয়। ডাক্তার চিকিৎসা করিতে করিতে আমাকে আরোগ্য করিয়া তুলিল।


স্বাক্ষর/-

মোঃ আনছার আলী।


।। ২৩৭ ।।

আহছান উল্লাহ

গ্রাম- দেয়নাথ পুর

থানা- রায়পুর

জেলা- নোয়াখালী।


মে মাসের প্রথম সপ্তাহে পাক বাহিনী রায়পুর বিনা মোকাবেলায় দখল করে। বাজারের অনতিদূরে একটি হিন্দু বর্ধিষ্ণু গ্রাম জ্বালাইয়া দেয় ও দুইটি নিরাপরাধ ব্যক্তিকে হত্যা করিয়া চলিয়া যায়।


কয়েকদিন পর আবার রায়পুর থানায় আসিয়া শিবির স্থাপন করে এবং আরম্ভ হয় নারী নির্যাতন দৈহিক পীড়ন। পাক বাহিনী স্থানীয় জামাতে ইসলামী ও মুসলিম লীগ সমর্থিত দালালদের সহায়তায় আওয়ামীলীগ কর্মী ও হিন্দুদের বাড়িঘর লুন্ঠন ও প্রজ্বলন শুরু করে। রাত্রের অন্ধকারে বাড়িতে হানা দিয়ে মা বোনদের উপর নৃশংসভাবে অত্যাচার করে। তাহাদের অত্যাচারে এই এলাকায় অগণিত মা বোনের সতীত্ব নষ্ট হয়। শেষের দিকে নিরাপরাধ লোকদের বাড়িও তাহারা জ্বালাইয়া দেয় ও লুণ্ঠন করে।


আমি একজন মিস্ত্রী। সারাদিন পরিশ্রম করিয়া কোন প্রকারে জীবিকা নির্বাহ করিতাম। পাক বাহিনী ও তাহাদের দালালরা আমার সুখের সংসারে আগুন জ্বালাইয়া দিয়াছে। পাক বাহিনী রায়পুর শিবির করার পর আমার এখানে থাকা সম্ভব হইলো না। আমার কাজ একেবারে বন্ধ হইয়া গেল। বাঁচার অন্বেষণে সুদূর পল্লী গ্রামে চলিয়া গেলাম। সেখানে কাঠ মিস্ত্রীর কাজ করিয়া জীবিকা নির্বাহ করি।


মে মাসের শেষ সপ্তাহে পাক বাহিনী ও দালালরা আমাদের গ্রাম দেয়নাথ পুর আক্রমন করে। প্রতিটি বাড়ি খুঁজিয়া যুবকদিগকে হত্যা করে ও মা বোনদের উপর পাশবিক অত্যাচার করে। আমার বাড়িতে তল্লাশী করিয়া আমাকে না পাইয়া আমার স্ত্রী আরমান নেছা বেগমের উপর অত্যাচার করে। সেই সময় আমার স্ত্রী সাত মাসের গর্ভবতী ছিল। আমাকে বাড়িতে না পাইয়া মুক্তিফৌজ সন্দেহ করিল। আমার স্ত্রীর উপর নৃশংস অত্যাচার করে। তাহাদের অত্যাচারে আমার স্ত্রী আরমান নেছা ঘটনাস্থলে শাহাদাৎ বরণ করে। এইভাবে এই এলাকায় বহু নারীকে অত্যাচার করিতে করিতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করিয়া বিদায় নেয়।


স্বাক্ষর/-

আহছান উল্লাহ।


।। ২৩৮ ।।

মোঃ বাদশাহ মিয়া

গ্রাম- লুধুয়া

থানা- রায়পুর

জেলা- নোয়াখালী।


৫ ই রমযান ১৯৭১ ইং সালে পাক বাহিনী লক্ষ্মীপুর হইতে আমাদের গ্রামের পার্শ্ববর্তী গ্রাম মীরগঞ্জে আসে। মীরগঞ্জে আসিয়া মিরগঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও মসজিদে তাহাদের শিবির স্থাপন করে। এই শিবিরে প্রায় ৩০ জন পাক নরপিশাচ এবং ৯০ জন রাজাকার ছিল।


একদিন আমি আমাদের গ্রামের পাশে সুপারি বাগানে কাজ করতেছি। এমন সময় একদল রাজাকার আসিয়া আমাকে ধরিয়া ফেলিল। রাজাকার কমান্ডার আমাকে চোখ বাঁধিয়া রাজাকার ক্যাম্পে আনিল। ক্যাম্পে আনিয়া মসজিদের সামনে যে বাঙ্কার ছিল, সেই বাঙ্কারের ভেতর হাত পা বাঁধিয়া রাখিল। রাত্রিতে আমাকে একটা রড দিয়া ভীষণ প্রহার করে এবং রাজাকার কমান্ডার বলে বেটা মুক্তিবাহিনীর লোক, বেটাকে এখন মুক্তিবাহিনীর স্বাদ মিটাইতেছি। আবার সেই রডটা আগুন দিয়া পোঁড়াইয়া আমার পায়ে ঠাসিয়া ধরিলে আমি অজ্ঞান হইয়া পড়িয়া থাকি। প্রায় ঘন্টা দেড়েক পর আমার জ্ঞান ফিরিয়া আসে। তারপর রাজাকাররা বলে তুই মুক্তিবাহিনীর লোক, তোকে আমরা আর বাঁচাইয়া রাখিবো না।


তার পরের দিন পাক বাহিনীর একজন নায়েক সুবেদার আসিয়া আমার চোখ খুলিয়া আমাকে বার বার প্রশ্ন করে মুক্তিবাহিনী কোথায় থাকে ঠিক করিয়া বল আমার কাছে বল, তোকে আমরা ছাড়িয়া দিবো। আমি তখন বলি স্যার আমি একজন নিরীহ মানুষ, মুক্তিবাহিনী কে বা কোথায় থাকে তাহা আমি জানিনা।


এই কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে পাক বাহিনী ভীষণভাবে চপেটাঘাত করে এবং বলে বেটা ঠিক কথা বল নইলে তোকে আমরা চির নির্বাসিত করিয়া দিবো। এমন সময় একজন পুলিস আসিলো বলিল স্যার এই নিরীহ জনসাধারণকে মারিয়া কোন লাভ হইবে না। তখন রাজাকার কমান্ডার নুর মোহাম্মদ বলে বেটারা মুক্তিবাহিনীকে ডাব, নারকেল দিবে। কাজেই বেটাকে ছাড়িয়া দেওয়া হইবেনা। তখন উক্ত পুলিসটি বলিল দিন বেটাকে আমি শেষ করিয়া দিয়া আসি। তখন পুলিসটি আমাকে। দুরে আনিয়া বলিল এক কাজ কর, কাজ হইলো এই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পিছনে যে পুল আছে ঐ পুলের নিচে কয়েকজন মরা মানুষ ভাসিতেছে, তুমি একটা বাঁশ আনিয়া মরা মানুষগুলি ভাসাইয়া দিয়া চলিয়া যাও। তখন আমি পুলিসটির কথা মত মরা মানুষ গুলি ভাসাইয়া দিয়া চলিয়া আসি। আজ পর্যন্ত আমার পায়ের সেই দাগ রহিয়াছে।


টিপসহি /-

বাদশাহ মিয়া।


।। ২৩৯ ।।

মোঃ আবুল কালাম

গ্রাম- উত্তর দেনাতপুর

থানা- রায়পুর

জেলা- নোয়াখালী।


ভাদ্র মাসে পাক বাহিনী আমাদের রায়পুর থানায় আসিয়া রায়পুর আলিয়া মাদ্রাসায় একটি ক্যাম্প স্থাপন করে। এই মাদ্রাসায় রাজাকার বাহিনীর জন্য একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করে।


এইখান হইতে প্রশিক্ষন প্রাপ্ত হইয়া রাজাকার বাহিনী রায়পুর থানার পার্শ্ববর্তী গ্রামে মুক্তি বাহিনী ও আওয়ামীলীগ কর্মীদের বাড়িতে যাইয়া লুটপাট আরম্ভ করে। এই ভয়ে তখন হইতে আমি আমাদের বাড়িতে রাত্রি যাপন করা নিরাপদ নয় বলে অন্য বাড়িতে রাত্রি যাপন করিতাম।


একদিন আমি আমাদের গ্রামের মোঃ রসিদ পাটোয়ারীর সাহেবের বাড়িতে ঘুমাইতেছিলাম। এমন সময় একদল রাজাকার আসিয়া আমাকে ঘুম হইতে ডাকিয়া তুলিল। তখন আমি মনে করিলাম আমার আর বাঁচার কোন পথ নাই। প্রায় ১৫ জন রাজাকার আসিয়াছিল। তার মধ্যে আমার পরিচিত ছিল চার জন।


একজন রাজাকার কমান্ডার আসিয়া আমার হাত বাঁধিয়া তাহাদের ক্যাম্পে নিয়া আসিল এবং পাক বাহিনীর হাতে অর্পন করিল। পাক বাহিনী তখন আমার চোখ বাঁধিয়া একটি অন্ধকার ঘরের মধ্যে রাখিল। প্রথম দিন আমাকে তাহারা বেত দ্বারা বেদম প্রহার করিতে থাকে। পাক বাহিনী আমাকে বলে তোদের মুক্তিবাহিনীর দল কোথায় ঠিক করিয়া বল তোকে আমরা ছাড়িয়া দিব। তখন আমি বলি না হুজুর আমি মুক্তিবাহিনীর দল দেখি নাই। এই কথা বলার সঙ্গে পাক বাহিনী তাহার পাদুকা দিয়া আমার বুকের উপর ভীষণভাবে লাথি মারিল, এই লাথি মারার সঙ্গে সঙ্গে অজ্ঞান হইয়া পড়িয়া থাকি।


দ্বিতীয় দিনে উক্ত রাজাকার কমান্ডার আসিয়া আমাকে তাহার চাকু দিয়া আমার বাম হাতের রগ কাটিয়া ফেলিল। রগ কাটার সঙ্গে সঙ্গে আমি আবার অজ্ঞান হইয়া পড়িয়া থাকি।


তৃতীয় দিনে পাক বাহিনী আমাকে তাহাদের হেডকোয়ার্টার মাইজদি পাঠাইবে এই খবর শুনিয়া একজন রাজাকার আমাকে বলিল এবং আমি তাহাকে বলিলাম ভাই আমি তোমাকে কিছু টাকা দিবো তুমি আমাকে মুক্ত করিয়া দাও। এই কথা শুনিয়া সেই রাজাকার আমার বাড়িতে সংবাদ দিল। আমার বাড়ি হইতে বড় ভাই ১৫ শত টাকা নিয়া আসিল।


পঞ্চম দিনে রাজাকার কমান্ডার আমার বড় ভাইয়ের সাথে সাক্ষাত করে এবং দাবি করে আমাকে দুই হাজার টাকা দিতে হইবে, না হইলে আমরা কালামকে মারিয়া ফেলিবো।


এই কথা শুনিয়া আমার বড় ভাই বাড়ি চলিয়া গেল। এমন সময় রাজাকার কমান্ডার আমার নাকের ভেতর সুঁচ দিয়া ছিদ্র করিয়া সুতা দিয়া আড়ার সঙ্গে বাঁধিয়া রাখিল। এই কথা শুনিয়া আমার বড় ভাই দুই হাজার টাকা সংগ্রহ করিয়া আবার ক্যাম্পে ফিরিয়া আসিল। রাজাকার কমান্ডার দেলোয়ার হোসেনকে দুই হাজার টাকা দিয়া আমাকে মুক্ত করিয়া আনিল।


স্বাক্ষর/-

মোঃ আবুল কালাম।


।। ২৪০ ।।

মোঃ নুরুল ইসলাম

গ্রাম- পশ্চিম লতিফপুর

থানা- লক্ষ্মীপুর

জেলা- নোয়াখালী।


পাক নরপশুরা এতদ অঞ্চলের চন্দ্রগঞ্জ হাইস্কুল ও প্রতাপগঞ্জ হাইস্কুলে আসিয়া শিবির স্থাপন করে। শিবির স্থাপন করার পূর্বে পার্শ্ববর্তী গ্রাম পশ্চিম লতিফপুরের উপর বেপরোয়া হামলা চালায়। কারন চন্দ্রগঞ্জ বাজারের পূর্ব পার্শ্বে একটা পাকা পুল ও রাস্তা কাটিয়া প্রতিরোধ আন্দোলন গড়িয়া তোলে। ফলে চন্দ্রগঞ্জ বাজারের পাশে সংলগ্ন গ্রাম পশ্চিম লতিফপুর গ্রামে হানা দেয়। প্রথমে পাক বাহিনীরা গ্রামে প্রবেশ করার পথে লোকজন সামনে যাহাকে পাইয়াছে তাহাদেরকে গুলি করিয়া হত্যা করে। আমাদের গ্রামে পাক বাহিনী নুরু মিঞা মুন্সীর বাড়িতে যায়। ঐ বাড়িতে ৬জন লোককে পায়। ৬জন লোককেই গুলি করিয়া হত্যা করে। তাহা ছাড়া উক্ত গ্রামে আরো বহু লোককে হত্যা করে। নিন্মে উক্ত গ্রামে মৃত ও আহত লোকদের নাম দেয়া হইলো।


মৃত ব্যক্তিদের নামঃ

১। শশীভূষণ পাল, পিতা- রাজমোহন পাল।

২। সেকান্দার মিঞা, পিতা- ইলিয়াস।

৩। মজিবুল্লাহ, পিতা- আহমদ উল্লাহ।

৪। শফিকুল্লাহ মুন্সী, পিতা- মৃতঃ ছালামত উল্লাহ।

৫। নুর মিঞা মুন্সী, পিতা- মহব্বত আলী।

৬। রহমত উল্লাহ, পিতা- নুর মিঞা মুন্সী।

৭। মখলেছুর রহমান, পিতা- মহব্বত আলী।

৮। জাফর আহমদ, পিতা- এমরান আলী।

৯। আবু তাহের, পিতা- ওবায়দুল্লাহ।

১০। করপুন নেছা, স্বামী- আব্দুল মান্নান।

১১। নজীর আহমদ, পিতা- আব্দুল হাকিম।

১২। শামসুল হক, পিতা- মুজা মিঞা।

১৩। খলিল, পিতা- হাবিবুল্লাহ।

১৪। আবদুর রহমান পাটোয়ারী, পিতা- বজলুর রহমান।


আহত ব্যক্তিদের নামঃ

১। জগবন্ধু পাল, পিতা- রতন কৃষ্ণ পাল।

২। অনুকূল চন্দ্র পাল, পিতা- দেবেন্দ্র কুমার পাল।

৩। নুর মোহাম্মদ, পিতা- আহমদ উল্লাহ।

৪। নুরুজ্জামান, পিতা- আনোয়ার আলী।

৫। আব্দুল হক, পিতা- নুরুজ্জামান।

৬। ইউছুপ মিঞা, পিতা মমহব্বত আলী।

৭। নুরুল আমিন, পিতা- জাফর আহমদ।

মৃত ব্যক্তিদের নাম আরো রহিয়াছে।


স্বাক্ষর/-

মোঃ নুরুল ইসলাম

২৬/০২/৭৩


।। ২৪১ ।।

মফিজ উল্লাহ মুন্সী

গ্রাম- পশ্চিম লতিফপুর

থানা- লক্ষ্মীপুর

জেলা- নোয়াখালী।


আমার মনে পড়ে জ্যেষ্ঠ মাসের মাঝামাঝি পাক বাহিনী তখন চৌমুহনী হইতে চন্দ্রগঞ্জ বাজারে আসে। চন্দ্রগঞ্জ বাজারে আসিয়া চন্দ্রগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়ে তাহাদের শিবির স্থাপন করে। পাক বাহিনী শিবির খুলিয়া তাহাদের দোসর বন্ধু শান্তি কমিটি গঠন করে।


শান্তি কমিটি গঠন করিয়া পাক বাহিনী চন্দ্রগঞ্জ বাজারের উত্তর পাশে গ্রাম গুলি মুক্তিবাহিনীর তল্লাশে তছনছ করিয়া তুলিল।


এইভাবে পাক বাহিনী জনসাধারণের মধ্যে এক সন্ত্রাসের সৃষ্টি করিল। তখন হইতে আমাদের গ্রামের জনসাধারণ অন্যান্য গ্রামে পলায়ন আরম্ভ করে।


জ্যেষ্ঠ মাসের ১২তারিখ পাক বাহিনী আমাদের গ্রামে প্রবেশ করে। পাক বাহিনীকে আসতে দেখিয়া আমার বাড়ির লোকজন সবাই পলায়ন করে। শুধু আমি ও আমার ভাই মোঃ আমিন উল্লাহ মুন্সী বাড়িতে ছিলাম। যখন দেখিলাম পাক বাহিনী আমাদের পাড়ার মধ্যে প্রবেশ করিয়াছে, তখন আমরা দুই জন এক পুকুরের মধ্যে ডুব দিয়া কচুরি পানা মাথায় দিয়া লুকাইয়া থাকি। পাক বাহিনী আমাদের খুঁজিয়া বাহির করিয়া প্রথমে তাহার পাদুকা দ্বারা আমার বুকে লাথি মারিল, তারপর রাইফেল দিয়া বেদম প্রহার করিল। রাইফেল দিয়া মারার পর আমার পায়ে দড়ি দিয়া এক গাছের সঙ্গে বাঁধিল। গাছের সঙ্গে বাঁধিয়া আমার পা উপরের দিকে রাখিল এবং আমাকে জিজ্ঞাসা করিল তোদের বাড়ি কোনটা? বাড়ি দেখাইয়া দেওয়ার পর আমার বাড়ি আগুন দিয়া পোঁড়াইয়া দিল। আমাকে গাছের সঙ্গে এই অবস্থায় বাঁধিয়া রাখিয়া পাক বাহিনী চলিয়া গেল। বর্তমানে আমি অদ্যাবধি মৃতপ্রায় অবস্থায় পড়িয়া আছি।


স্বাক্ষর /-

মফিজ উল্লাহ মুন্সী

২৬/০২/৭৩


।। ২৪২ ।।

জগবন্ধু পাল

গ্রাম- পশ্চিম লতিফপুর

থানা- লক্ষ্মীপুর

জেলা- নোয়াখালী।


রাজাকাররা যখন পাক বাহিনীর সাথে বিশেষভাবে সহযোগিতা করতে থাকলো এই গ্রামের নিরীহ জনসাধারণের উপর রাত্রিতে জোর তল্লাশী আরম্ভ করে। লতিফপুর গ্রামটি চন্দ্রগঞ্জ বাজারের অতি নিকটবর্তী। পাক দস্যুরা ও রাজাকাররা চন্দ্রগঞ্জ হাইস্কুলের সম্মুখে শিবির স্থাপন করেছিল। রাজাকার ও পাক হানাদাররা গ্রামের দিকে আসা মাত্রই আমরা ঘরবাড়ি ছেড়ে আমরা অন্যত্র পলায়ন করি। এইভাবে আমাদের মধ্যে সর্বময় সন্ত্রাসের সৃষ্টি করতো।


ভাদ্র মাসের মাঝামঝিতে বেশ ক’জন রাজাকার রাত্রিতে আমার বাড়িতে আসে এবং আমার বাড়ি ঘিরে ফেলে। বাড়ি ঘেরাও করে ঘর হইতে আমাকে জোর করে বাহির করে এবং বন্দুকের বাঁট দ্বারা বেদম প্রহার করে। রাজাকার আমাকে প্রশ্ন করে মুক্তিবাহিনীকে কয় হাজার টাকা দিয়ে সাহায্য করেছিস? মুক্তিবাহিনীদেরকে সাহায্যের কথা অস্বীকার করলে বা মুক্তিবাহিনী কারা তাও অস্বীকার করলে পা দ্বারা বুকে জোরে লাথি মারে। নরপশুরা যাওয়ার সময় আমার একটা চোখ নষ্ট করে দিয়ে যায়। আমার কাছ হতে বহু টাকা পয়সাও জোর করিয়া কেড়ে নেয়। বর্তমানে আমার চোখ অচল। একেবারে কিছু দেখতে পাই না। তাছাড়া বেদম প্রহারের ফলে আমার একটি হাতও ভেঙ্গে যায়। বর্তমানে পৃথিবীতে থাকা না থাকা একই অবস্থা।


মুক্তিবাহিনী, পাকবাহিনী ও রাজাকারদের সবসময় নাজেহাল করতো। ফলে পাক বাহিনী ও রাজাকাররা অতিষ্ঠ হয়ে পার্শ্ববর্তী গ্রামে লতিফপুরের বহু নিরীহ জনসাধারণকে ধরে কঠোরভাবে দৈহিক নির্যাতন চালায়। পাক বাহিনী ও রাজাকাররা আমার বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়। বর্তমানে আমি সর্বহারা।


স্বাক্ষর/-

জগবন্ধু পাল।

২৬/০২/৭৩


।। ২৪৩ ।।

মোঃ আবুল কাশেম

গ্রাম- শেখপুর

থানা- লক্ষ্মীপুর

জেলা- নোয়াখালী।


পাক বাহিনী যখন চন্দ্রগঞ্জ বাজারে আসে আমি তখন চন্দ্রগঞ্জ বাজারে ছিলাম। চন্দ্রগঞ্জ বাজারে আমার একটা দোকান আছে। সেই দোকানে আমি ছিলাম। পাক বাহিনী চন্দ্রগঞ্জ বাজারে আসিয়া চন্দ্রগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়ে তাহারা শিবির স্থাপন করে। তখন হইতে আমি মুক্তিবাহিনীকে আমি গোপনভাবে সাহায্য করি এবং মুক্তিবাহিনীর পথপ্রদর্শক হিসেবে কাজ করিতে থাকি। একদিন রাত্রিতে প্রায় ১৭ জন মুক্তিবাহিনী আসিয়া আমাকে বলিল কিভাবে আমরা নোয়াপুর পুল ধ্বংস করিতে পারি? তখন আমি মুক্তিবাহিনীকে নোয়াপুর পুলের পথ দেখাইয়া দিলাম এবং তাহাদিগকে আমার দোকানে রুটি খাওয়াইয়া বিদায় করিলাম। ঐ তারিখে তাহার নোয়াপুর পুল ধ্বংস করিয়া চলিয়া যায়।


তার ঠিক দুইদিন পর একদল রাজাকার আমার দোকানে আসিয়া বলিল কাশেম নামে কোন দোকানদার আছে নাকি? তখন আমি বলিলাম হ্যাঁ আছে। রাজাকার বলিল কাশেমকে আমাদের দরকার আছে। তুমি পলায়ন করিলে দোকান পোঁড়াইয়া দেওয়া হইবে। এই কথা শুনিয়া আমি আর দুই দিন দোকানে আসি নাই।


একদিন রাত্রে পালাইয়া দোকানে আসিলাম। তৎক্ষণাৎ একদল রাজাকার আসিয়া আমাকে ধরিয়া ফেলিল এবং আমার চোখ বাঁধিয়া রাজাকার ক্যাম্পে নিয়া আসিল।


ক্যাম্পে আনিয়া কোন কথা বলার আগে আমাকে বেত দ্বারা বেদম প্রহার করিল এবং বলিতে লাগিলো বেটা কোথায় পালাইছিলি? এখন মজা দেখাইতেছি। এই কথা বলার পর পরা আবার বেত দ্বারা বেদম প্রহার করিতে লাগিল।


তারপর আমাকে বলিল যে, নোয়াপুর পুল ধ্বংস করিয়াছিস এবং মুক্তিবাহিনীকে তোর দোকানের রুটি তৈরী করিয়া খাওয়াইছিস। এখন সত্য করিয়া বল মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্প কোথায়? আমি তখন কোন কথার জবাব দিতে পারি নাই।


তারপর আবার একটা সুঁচ দিয়া আমার ডান হাতের আঙুলের ভেতর ঢুকাইয়া দিলে আমি অজ্ঞান হইয়া পড়িয়া থাকি। এই খবর জানিতে পারিয়া আমার বাড়ি হইতে লোকজন আসিয়া একদল রাজাকারকে কিছু টাকা দিয়া আমাকে রাজাকার ক্যাম্প হইতে উদ্ধার করিল। আজ পর্যন্ত আমার ডান হাত দিয়া কোন কাজকর্ম করিতে পারিনা।


স্বাক্ষর/-

মোঃ আবুল কাশেম

২৬/০২/৭৩


।। ২৪৪ ।।

মোঃ রফিকুল্লাহ

গ্রাম- কাদির হানিফ

থানা- সুধারাম

জেলা- নোয়াখালী।


১৫ ই এপ্রিল ১৫ জন রাজাকার আমাদের গ্রামে আসে, আমি তখন আমাদের গ্রামের দক্ষিণ চরায় ধান কাটিতেছি। রাজাকার আসিয়া আমাকে বলে যে, তোমাদের গ্রাম হইতে আমাদের চাউল তুলিয়া দিতে হইবে। তখন আমি রাজাকারকে বলি না ভাই আমি গ্রাম হইতে চাউল তুলিয়া দিতে পারিবো না। তৎক্ষণাৎ আমাকে ধরিয়া মাইজদি টাউন হল শিবিরে লইয়া যায়। শিবিরে লইয়া রাজাকার কমান্ডার মীর কালা মিয়া মেকার আমাকে পাক সেনাদের হাতে অর্পন করে। ঐ হইতে পাক সেনারা আমার শরীরের উপর দৈহিক পীড়ন আরম্ভ করে। প্রথমে আমার পায়ে দড়ি বাঁধিয়া আমাকে একটা ঘরের আড়ার উপর ঝুলাইয়া রাখে এবং বার বার আমাকে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করে তুই মুক্তিবাহিনী, তোর কাছে অবশ্যই রাইফেল আছে। আমি প্রশ্নের জবাবে বলি, না হুজুর আমি কোন মুক্তি নই, আমার কাছে কোন রাইফেলও নাই। এইভাবে আমাকে ঐখানে সাত দিন বাঁধিয়া রাখে এবং দিনের শেষে বিকালে আমাকে প্রত্যেক দিন এইভাবে প্রহার করে।


১৭ই এপ্রিল তারিখে আমাকে আবার চোখ বাঁধিয়া একটি অন্ধকার ঘরের মধ্যে রাখে এবং ঐ তারিখে বেগমগঞ্জ শিবিরে লইয়া বেত দ্বারা বেদম প্রহার করিতে থাকে। এই অবস্থায় আমি অজ্ঞান হইয়া পড়ি। এই খবর শুনিয়া আমার এক আত্মীয় মোঃ সামছুল হক সাহেব আমাদের গ্রামের ও ইউনিয়নের রাজাকার কমান্ডার মোঃ মীর কালা মিয়া মেকারকে ধরিয়া ৫০০ টাকার বিনিময়ে আমাকে মাইজদি জেল খানায় লইয়া আসিল। মাইজদি জেল খানায় আসিয়া আবার পাক সেনাদের হাতে পড়ি। এই জেল খানায় আমাকে দৈনিক এক হাতে ১৫ সের আরেক হাতে ১৫ সের পানি লইয়া আধা মাইল চলিতে হইতো। এইভাবে মাইজদি জেলখানায় ৩ মাস ছিলাম। মাইজদি শহর মুক্ত হওয়ার পর আমি জেলখানা হইতে মুক্তি পাই।


টিপসহি /-

মোঃ রফিকুল্লাহ


।। ২৪৫ ।।

মোঃ ছিদ্দিক উল্লাহ

গ্রাম- কাদির হানিফ

থানা- সুধারাম

জেলা- নোয়াখালী।


২৮/৯/১৯৭১ ইং তারিখে আনুমানিক ৫০/৬০ জন রাজাকার আসিয়া দিনের বেলায় আমার বাড়ির চারদিকে ঘেরাও করিয়া ফেলে। রাজাকাররা আসা মাত্র আমি আমার ঘরের মাচার কোণায় পালাইয়া ছিলাম। তবে আমার বিশ্বাস ছিল যে, আমি কোন মুক্তি বাহিনী নই, বা কোন অন্যায় কাজও করি নাই। তবে পাক সেনা ও রাজাকার দেখিয়া ভয় পাইতাম এই কারনে যে বর্বর বাহনী ও রাজাকারদের মতলবের কোন ঠিক ছিল না এবং সন্দেহ করিয়াই নির্বিচারে গুলি করিয়া হত্যা করিত। তারপর আমাকে বাড়িঘর তন্নতন্ন করিয়া খুঁজিয়া বাহির করিল এবং বার বার প্রশ্ন করিতে লাগিলো মুক্তিবাহিনীদের থাকার জায়গা দিয়া তাহাদের সক্রিয়ভাবে সাহায্য করিয়াছিস। মুক্তিবাহিনী কোথায় আছে বাহির করিয়া না দিলে আজকে জ্যান্ত কবর দিবো। এই সমস্ত বার বার প্রশ্ন করে এবং রাইফেলের বাঁট দ্বারা সমস্ত শরীরের সব জায়গায় বেদম প্রহার করিতে থাকে। বেদম মারের চোটে আমাকে অজ্ঞান করিয়া ফেলে এবং তারপর তাহারা আমার বাড়ি হইতে চলিয়া যায়। আমার বাবা ঐ তারিখে বাড়িতে ছিলেন না। পাড়ার প্রতিবেশী মোঃ কালামিয়া, আবদুল গণি এবং আরো অনেকে তৎক্ষণাৎ আমার বাড়িতে আসে। আমাকে অজ্ঞান অবস্থায় দেখিয়া মাথায় পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি ঢালে এবং জ্ঞান ফিরিয়া আসিলে তাড়াতাড়ি মাইজদি সদর হসপিটাল লইয়া আসে এবং ভর্তি করিয়া দেয়। সদর হসপিটালেই থাকি এবং বেশ কিছুটা আরোগ্য হই। আরোগ্য হওয়ার পর বাড়ি চলিয়া আসি। বাড়ি আসিয়া দেখি কাজকর্ম সম্পূর্নভাবে করিতে পারিনা। রৌদ্রের ভেতর কিছুক্ষণ কাজ করিলে মাথা ঘুরাইয়া পড়িয়া যাই। তারপর আমার গ্রামের ডাক্তার মোঃ নবাব আলীও চিকিৎসা করিয়াছেন।

স্বাক্ষর/-

মোঃ ছিদ্দিক উল্লাহ।


।। ২৪৬ ।।

মোঃ হাবিবুর রহমান

গ্রাম- মনিপুর

থানা-পরশুরাম

জেলা- নোয়াখালী।


জুলাই মাসের ১৫ তারিখ একদল পাক বাহিনী অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত হইয়া মনিপুর গ্রামের উপর আক্রমণ চালায়। আক্রমণের প্রথম ভাগে মুক্তিবাহিনীর লোকেরা তাহাদের আক্রমণের জবাব দেয়। কিন্তু তাহাদের প্রবল আক্রমণের মুখে টিকিতে না পারিয়া ভারতের রাজনগর শিবিরে প্রস্থান করে। ক্রুদ্ধ পাক বাহিনী স্থানীয় বিশিষ্ট আওয়ামীলীগ কর্মী মি. আমান উল্লাহর বাড়ি জ্বালাইয়া দিয়া আমার বাড়ির দিকে প্রবেশ করে। পাক বাহিনীর ভয়ে গ্রামের ৫ জন সুন্দরী রমণী আমার বাসগৃহে আত্মগোপন করিয়াছিল। পাক বাহিনী তল্লাশী চালাইয়া তাহাদিগকে ধানের গোলার নিচে ও ঘরের কারের হইতে জোরপূর্বক টানিয়া বাহির করে। পাক সৈন্যরা সংখ্যায় ছিল ১২ জন। তাহারা উক্ত নারীদের উপর দীর্ঘ ৫ ঘন্টা যাবৎ অতি বর্বরভাবে অত্যাচার চালায়। তাহাদের অত্যাচারে সকলেই জ্ঞান হারাইয়া ফেলে। পরে পাক বাহিনী পরশুরামে ফিরিয়া আসে। পাক বাহিনী প্রস্থানের পর স্থানীয় জনসাধারণ মাথায় পানি ঢালিয়া রমণীদের জ্ঞান ফিরাইয়া আসে।


পাক বাহিনী যখন অসহায় নারীদের উপর অত্যাচার করিবার চেষ্টা করে, তখন তাহাদিগকে অত্যাচার হইতে বিরত থাকার জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ করা হয় এবং ধর্মেরও দোহাই দেয়া হয়। ইহাতে ক্ষুব্দ হইয়া পাক বাহিনী আমাকে কাফের বলিয়া বেদম ভাবে প্রহার করে এবং আমি জ্ঞান হারাইয়া ফেলিলে পুকুর পাড়ে ফেলিয়া রাখে।


স্বাক্ষর/-

হাবিবুর রহমান।


।। ২৪৭ ।।

হাজী ছানু মিয়া

গ্রাম- মির্জানগর

থানা- পরশুরাম

জেলা- নোয়াখালী।


পাক বাহিনী ২৫ শে মে ফেনী হইতে পরশুরাম দখল করিয়া নেওয়ার পর আমাদের ১নং মির্জানগর ইউনিয়নের বহু লোক আত্মরক্ষার জন্য ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে আশ্রয় গ্রহন করে। আমার একমাত্র ছেলে ও ছেলের বধু এবং দুই শিশু সন্তাসহ ত্রিপুরার রাজনগরে আশ্রয় নেয়। আমি ও আমার সহধর্মিণী হালিমা খাতুন বাড়িতে ছিলাম।


প্রায় ২০০ পাক বাহিনী ১০ জুলাই মির্জানগরে প্রবেশ করে এবং সেই দিন মির্জানগর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ও গ্রামের অন্যান্য স্থানে শিবির স্থাপন করিয়া থাকে। রাত্রে পাক বাহিনী গ্রামের নিরীহ নারীদের উপর অত্যাচার করে।


১৫ জুলাই অধিক রাত্রে আমার বাড়িতেও পাক বাহিনী হামলা করে।


১৫ জুলাই রাত্রে মির্জানগর গ্রামের যুবতী বৃদ্ধা কেহই পাক নরপশুদের হাত হইতে রক্ষা পায় নাই। গ্রামের হাঁস, মোরগ, খাসী, ছাগল সবই নিয়া যায়। ভারত সীমান্ত অতি নিকটে বলিয়া মুক্তিযোদ্ধারা মির্জানগরে পাক সৈন্যদের অবস্থান জানিতে পারিয়া ভোর রাত্রে প্রবল আক্রমণ চালায়। মুক্তিবাহিনীর আক্রমণের সম্মুখে টিকিতে না পারিয়া ১৬ই জুলাই সকাল ৯ টায় মির্জানগর ছাড়িয়া পরশুরাম চলিয়া যায়। নরপশুদের শিবির ছাড়িয়া যাওয়ার পর প্রায় প্রত্যেক শিবির হইতে জ্ঞানহীন অবস্থায় মা বোনদিগকে মুক্তিযোদ্ধারা উদ্ধার করে।


স্বাক্ষর/-

হাজি ছানু মিয়া।


।। ২৪৮ ।।

আব্দুল মোমেন প্রধান

প্রধান শিক্ষক

দক্ষিণ বল্লভপুর উচ্চ বিদ্যালয়,

ছাগলনাইয়া, নোয়াখালী।


১৯৭১ সালের ২৬ শে মার্চ তারিখে অত্র এলাকায় প্রবেশ করে এবং বল্লভপুর হাইস্কুলে শিবির স্থাপন করে। দক্ষিণ বল্লভপুরের রশিদ উল্লাহ সাহেব বিশিষ্ট আওয়ামীলীগ কর্মী ছিলেন। নভেম্বর মাসের ১লা তারিখে তাহার নিজ বাড়ি হইতে বন্দী করিয়া বল্লভপুর হাইস্কুলে তাহাদের শিবিরে লইয়া যায়। ঘটনার বিবরণে প্রকাশ রশিদ উল্লাহ সাহেবকে ৫ দিন অকথ্যভাবে দৈহিকভাবে নির্যাতন চালানোর পর ১৬ই নভেম্বর তারিখে বল্লভপুর হাইস্কুলের নিকটে জীবন্ত অবস্থায় মাটি চাপা দিয়ে হত্যা করে।


পাক বাহিনী বল্লভপুর গ্রামের প্রত্যেকটি বাড়িই তল্লাশী চালায় এবং প্রতিটি বাড়ি হইতেই টাকা পয়সা, সোনা গহনা ও সঙ্গে বহন করিয়া লইয়া যাইবার মত বস্তু লুণ্ঠন করিয়া লইয়া গিয়াছে। ইহার মধ্যে আওয়ামীলীগ কর্মী ও হিন্দুদের বাড়িঘরেরই বেশী ক্ষতি সাধন করিয়াছে।


ইহা ছাড়াও পাক বাহিনী উক্ত স্কুলের শহীদ মিনারটি ধ্বংস করিয়া ফেলিয়াছে এবং যাবতীয় আসবাবপত্র, লাইব্রেরীর বই – পুস্তক, ছাত্রদের খেলার সরঞ্জামাদি ও বিজ্ঞান গবেষণার যন্ত্রপাতি আগুন দ্বারা জ্বালাইয়া দেয় এবং লুণ্ঠন করিয়া লইয়া যায়। পাক বাহিনী অযথা নিরীহ লোকদের সন্দেহের বশে বন্দী করিয়া তাহাদের শিবিরে লইয়া যায় এবং অকথ্য ভাবে দৈহিক নির্যাতন চালায়।


১৮ ই সেপ্টেম্বর তারিখে আমি নিজ বাড়িতে আমি নিজ বাড়িতে অবস্থানকালে হঠাৎ দেখিতে পাইলাম ৫ জন পাক সেনা তাহাদের শিবির হইতে গ্রামের দিকে আসিতেছে। তখন আমি আত্মরক্ষার্থে বাড়ির পাশে আত্মগোপন করি। এমন সময় আমি স্বচক্ষে দেখিতে পাইলাম যে উক্ত ৫ জন পাক সেনা আমাদের গ্রাম হইতে ৩ জন যুবতী মেয়েকে বন্দী করিয়া তাহাদের শিবিরের দিকে লইয়া যাইতেছে। মেয়ে ৩টি পাক সেনাদের মরণ ছোবল হইতে ছাড়া পাইবার জন্য ভীষণ চিৎকার করিতেছে। নরপশুরা তথাপিও জোরপূর্বক তাহাদের শিবিরে লইয়া যায় এবং প্রায় তিন দিন পাশবিক অত্যাচার চালানোর পর ছাড়িয়া দেয়।


বল্লভপুর হাইস্কুলটির চতুর্পার্শ্বে প্রায় ২৫ টি বদ্ধ পরিখা রহিয়াছে। বদ্ধ পরিখা গুলিতে এখানকার স্থানীয় ও অন্যান্য এলাকা হইতে প্রায় ১৫০জন লোককে পাক সেনারা মাটি চাপা দিয়া রাখিয়াছিল।


স্বাক্ষর/-

আব্দুল মোমেন।


।। ২৪৯ ।।

নুর জাহান বেগম

গ্রাম- পূর্ব চর চান্দিয়া

থানা- সোনাগাজী

জেলা- নোয়াখালী।


আমার স্বামী মোঃ আবদুল কুদ্দুস একজন সাধারণ কৃষক। সারাদিন পরের বাড়িতে কাজ করিয়া জীবিকা নির্বাহ করে। পাক বাহিনী সোনাগাজী থানায় শিবির স্থাপন করিলে আমরা আত্মরক্ষার জন্য পার্শ্ববর্তী এলাকায় চলিয়া যাই এবং বেশ কিছু দিন আত্মগোপন করিয়া থাকি।


১৫ ই অক্টোবর তারিখে মুক্তিবাহিনী সোনাগাজী থানা দখল করিলে আমরা নিজ বাড়িতে চলিয়া আসি। কিন্তু মুক্তিবাহিনী পরবর্তী সময়ে আর সোনাগাজী থানা দখলে রাখিতে পারিল না। তাহারা পাক বাহিনীর প্রবল আক্রমণের সামনে টিকিয়া থাকিতে না পারিয়া এ এলাকা ছাড়িয়া দিয়া বিভিন্ন জায়গায় আত্মগোপন করে।


উক্ত থানায় পাক সেনারা মুক্তিবাহিনীদের বিতাড়িত করিয়া পুনরায় স্থানীয় শিবির স্থাপন করে এবং পার্শ্ববর্তী এলাকা তছনছ করিয়া লয়। তাছাড়া পাক বাহিনীরা রাজাকারদের সহায়তায় বিভিন্ন গ্রামে অগ্নিসংযোগ করে।


২৫ শে অক্টোবর তারিখে কয়েকজন পাক সেনা রাজাকারসহ আমাদের গ্রামে জোর তল্লাশী চালায়। তন্মধ্যে তিন জন পাক সেনা এক জন রাজাকার বাড়ির আনাচে-কানাচে তন্নতন্ন করিয়া মুক্তিবাহিনী ও আওয়ামীলীগ কর্মীদের খুঁজিয়া বেড়াইতেছিল। তখনোও আমি আমার মা বাপের হাত ধরিয়া পালাইয়া আসি। আমাদের বাড়ির চারদিকে খোঁজার পর আমাদের ঘরের মধ্যে প্রবেশ করার ভাব দেখিয়া আমি বাপ- মায়ের হাত ছাড়িয়া চৌকির নিচে আত্মগোপন করি। তারপর পাক বাহিনী আমাদের ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে এবং বাপ মাকে উর্দুতে প্রশ্ন করে। কিন্তু বাপ-মা তাঁহার কিছুই উত্তর না দেওয়ায় আমার বাবার উপর রাইফেল দ্বারা বেদম প্রহার করে। আমাদের ঘর তন্নতন্ন করিয়া খোঁজার পর আমাকে চৌকির নিচ হইতে টানিয়া বাহির করে। প্রথমে আমি খুব চিৎকার করিয়া উঠি, চিৎকার শুনিয়া আমার বাপ-মা তাহাদের পা জড়াইয়া ধরে এবং আমিও তাহাদের অনেক অনুনয় বিনিয় করি। কিন্তু কিছুতেই তাহারা আমাদের কথায় কর্ণপাত করে না। পরে আমার বাপ-মাকে জোর করিয়া ঘর হইতে বাহির করিয়া দরজা আটকায় ফেলে। প্রথমে আমি তাহাদেরকে পা জড়াইয়া ধরিলে লাথি মারিয়া ফালাইয়া দেয় এবং আমার উপর নির্মমভাবে পাশবিক নির্যাতন চালায়। এইভাবে ৩ জন পাক সেনা আমার উপর অকথ্য অত্যাচার করার পর আমি সম্পূর্ন জ্ঞান হারাইয়া ফেলি। তারপর আমাকে ফেলিয়া চলিয়া যায়। বাপ-মা পরে আসিয়া আমাকে মাথায় পানি ঢালিয়া জ্ঞান ফিরাইয়া আনে। এইভাবে কয়েকদিন পর ঐ তিন জন পাক সেনা আসিয়া আমাদের উপর পাশবিক অত্যাচার ও নির্যাতন চালায়। আমাদের বাড়িতে যে তিন জন পাক সেনা ও কয়েকজন রাজাকার আসিয়া অত্যাচার চালাইছে তন্মধ্যে একজন ছিল আমার পরিচিত।


টিপসহি /-

নুর জাহান বেগম।


।। ২৫০ ।।

ডাঃ মোঃ ইদ্রিস মিয়া

মেডিক্যাল অফিসার

সোনাগাজী পল্লী উন্নয়ন কেন্দ্র

বোয়ালখালী, চট্টগ্রাম।


১৩ ই এপ্রিল চট্টগ্রাম সেনানিবাস হইতে বহু পাক সৈন্য আসিয়া রাঙ্গুনিয়া দখল করে ও রাঙ্গুনিয়া কলেজে শিবির করিয়া থাকে। সেই দিন আমিও প্রথমে ভয়ে রাঙ্গুনিয়া শহর ত্যাগ করিয়া চলিয়া যাই আবার বিকালে হাসপাতালের দিকে আসি। তখন হাসপাতালে কেহই ছিল না। প্রচুর ঔষধ ও বহু জিনিসপত্র ছিল। আমি সেই রাত্রে একাই হাসপাতালে রাত্রি কাটাইলাম।


১৪ই এপ্রিল সকালে শহরের অবস্থা ভালোই দেখা গেল। পাক সেনারা তখন কাহারো উপর কোন খারাপ ব্যবহার করিতেছে না দেখিয়া আমার স্ত্রী ও ছেলেমেয়ে দিগকে গ্রাম হইতে বাসায় নিয়া আসিলাম।


কিন্তু সেই দিন গভীর রাত্রে ৪ জন সেনা আমার রাঙ্গুনিয়া পল্লী স্বাস্থ্য কেন্দ্রের বাসায় আসিয়া দরজা খুলিতে বাধ্য করে এবং তাহারা বলে যে তোমার বাসা হইতে গুলির আওয়াজ শুনা গিয়াছে। তোমার বাসায় রাইফেল আছে কিনা তাহা আমাদের পরীক্ষা করিতে হইবে বলিয়া ৪ জন পাক সৈন্য আমার বাসায় ঢুকিয়া পড়ে এবং আমার হাতের ঘড়ি ও আমার ভায়রা ভাইয়ের হাতের ঘড়ি ও ট্রানজিস্টারটি পাক সৈন্যরা হাতে নিয়া নেয়। আমার বাসায় আমার লাইসেন্সভুক্ত একটি বন্দুক ছিল তাহাও তাহারা চিনিয়া নেয়। বন্দুক লওয়ার পর আমাকে ও আমার ভায়রা ভাইকে দু’জন পাক সৈন্য বাসা হইতে বাহির করিয়া নিয়া গেল। আমাদিগকে পাক নরপশুরা হাত উপরের দিকে উঠাইতে বলিল এবং আমাদিগকে যে গুলি করিয়া হত্যা করিবে তাহা বুঝিতে আর দেরী হইলো না।

বহু অনুরোধ করিয়া বলিলাম আমরা মুসলমান, কলেমা পাঠ করিলাম, কোরআনের সুরা পাঠ করার পর রাইফেলের বাট দিয়া প্রহার করিয়া বলিল, আমাদিগকে গাড়িতে উঠাইয়া দিয়া আস। তাহাদের কথা মত পাক নরপশুদিগকে গাড়িতে উঠাইয়া দিয়া আসিলাম।


১৫ ই এপ্রিল পাক বাহিনীর লেঃ সেলিম আমার অফিসে আসে এবং সবসময়ের জন্য হাসপাতাল খোলা রাখার নির্দেশ দিল এবং আমার উপর কোন জুলুম হইবেনা বলিয়া আশ্বাস দিল।


এদিকে মুক্তিবাহিনীর আক্রমন দিন দিন বাড়তে থাকে। আহত মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা আসিয়া এখানে চিকিৎসা করিত এবং সপ্তাহে ২/৩ বার সেন্টার পরিদর্শনের নামে বনের ভেতরে মুক্তিবাহিনীর শিবিরে আহত মুক্তিযোদ্ধা ভাইদের চিকিৎসা করিতাম এবং প্রয়োজন মোতাবেক ঔষধপত্র মুক্তিবাহিনীর শিবিরে পাঠাইতাম। আমার সহিত পত্র যোগাযোগ হইতো রাঙ্গুনিয়ার মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার চেয়ারম্যান নজীর আহমদের। এভাবে স্বাধীনতা চলার সহিত আমার ও সংগ্রাম চলিতে থাকে।


১৭ ই অক্টোবর রাত্রে তারাবীর নামাজ পড়া অবস্থায় মসজিদের ভেতরে আমাকে গ্রেফতার করা হয়। আমাকে লেঃ সেলিমের শিবিরে নেয়া হয়। পরের দিন আর্মির ‘মার্শাল ল’ কোর্টে ক্যাপ্টেন ইসহাক পারভেজের নিকট হাজির করা হয়। বিচারে হাজিরের পুর্বে কোর্টের সম্মুখে একজন সুবেদার আমাকে বেদম প্রহার করে এবং ভারতের দালাল বলিয়া ক্যাপ্টেন ইসহাকের নিকট হাজির করে। সেখানে লেঃ সেলিম আমাকে লক্ষ করিয়া বলে উক্ত ডাক্তার মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা করে ও ভারতের হাসপাতাল হইতে ঔষধ পাঠায়। সেই সময় চেয়ারম্যান নজীর আহমদ লিখিত একখানা পত্র বাহির করিয়া ক্যাপ্টেন ইসহাক পারভেজের নিকট পেশ করে এবং বলে কাফের নজীর আহমদের সাথে এই ডাক্তারের যোগাযোগ আছে। সেই সময় একজন মুক্তিবাহিনী হইতে সারেণ্ডার করা যুবক রাজাকার সাক্ষী দেয়। এই পত্র আমার মারফতে নজীর আহমদ দিয়াছে। আমি সম্পূর্ণভাবে এই চিঠি সম্বন্ধে অস্বীকার করি। তখন ক্যাপ্টেন পারভেজ আসিয়া কানে গালে চড় দেয় এবং লেঃ সেলিম ও ক্যাপ্টেন পারভেজ হাত ও বুট দিয়া বেদম প্রহার করিয়া আমাকে বাহিরে ফেলিয়া দেয়। তখন আমার জ্ঞান ছিলনা, প্রায় একঘণ্টা পরে জ্ঞানহীন অবস্থায় সামরিক জেলখানায় পাঠানো হয়। সাথে সাথে আরম্ভ হয় দৈহিক নির্যাতন। প্রতিদিন সকাল বিকাল বেদম প্রহার করা হইতো এবং বলিত ভারতের সহিত এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সহিত যোগাযোগ আছে কিনা।


এভাবে ৪ দিন চলিয়া গেল, বাসায় কোন সংবাদ দিতে পারিলাম না যে, আমি এখনো বাঁচিয়া আছি। পরে একজন সিপাহীর মারফতে খবর দিলাম আমার ভায়রা ভাইয়ের নিকট। আমাদের প্রায় ৮০ জনকে ছোট একটি কক্ষে আলোহীনাবস্থায় রাখিত। দিবারাত্রে নির্দিষ্ট সময় ব্যতিত প্রস্রাব,পায়খানাও করা যাইতোনা। আমার ডায়াবেটিস রোগ, আমার কিছুক্ষন পর পর প্রস্রাব করিতে হয়, কিন্তু প্রস্রাবের কথা বলিলেও তাহারা দরজা খুলিত না। মাঝে মাঝে প্রস্রাবের চাপে জ্ঞানহীন হইয়া পড়িতাম। আমার সংবাদ পাইয়া আমার স্ত্রী, আত্মীয়স্বজন রাঙ্গুনীয়ার জনসাধারণ আমার মুক্তির জন্য বিশেষ চেষ্টা করে। পরে তিন হাজার টাকা পশ্চিম পাকিস্তানি পুলিশকে দিয়া ঈদের আগেত দিন রাত্রে নরপশুদের কবল থেকে মুক্তি পাই। কিন্তু তাহাদের নির্যাতনে আমার হাতের আঙ্গুল ভাঙ্গিয়া যায় এবং কানের পর্দা ফাটিয়া যায়।


স্বাক্ষর/-

ডাঃ মোঃ ইদ্রিস মিয়া।


।। ২৫১ ।।

মোছাঃ পিয়ারা খাতুন

গ্রাম- পূর্ব চর চান্দিয়া

থানা- সোনাগাজী

জেলা- নোয়াখালী।


আমার পিতা একজন সামান্য কৃষক, সারাদিন পরের বাড়িতে শ্রম বিক্রয় করিয়া কোন রকমে সংসার চালায়। পাক বাহিনী আমাদের সোনাগাজী থানায় শিবির স্থাপন করিলে আমরা আত্মরক্ষার জন্য অন্য এলাকায় চলিয়া যাই এবং দেড় মাসের মত আত্মগোপন করিয়া থাকি।


১৫ ই অক্টোবর তারিখে মুক্তিযোদ্ধারা সোনাগাজী থানা দখল করিলে আমরা পুনরায় নিজ বাড়িতে চলিয়া আসি। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধারা পরবর্তী সময়ে আর সোনাগাজী থানা দখলে রাখিতে পারিলো না। তারা পাক বাহিনীর প্রবল আক্রমণে টিকিয়া থাকিতে না পারিয়া পল্লী গ্রামের আনাচে কানাচে আত্মগোপন করে।


মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের বাড়িতে আশ্রয় লয় এবং আমি তাহাদের নিজ হাতে রান্না করিয়া কয়েকদিন খাওয়াই। মুক্তিযোদ্ধাদের এই রুপ আশ্রয় দেওয়ার সংবাদ কয়েকজন দালাল পাক বাহিনীর নিকট পৌছায়। পাক সেনারা উক্ত সংবাদ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কয়েকজন রাজাকার সহ ৭জন পাক সেনা রমযান মাসের ৫ তারিখে আমাদের গ্রামে আকস্মাৎ আক্রমণ করে এবং মুক্তিযোদ্ধাদের তল্লাশী করিতে থাকে। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে উক্ত দিনের পূর্বেই মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের বাড়ি ত্যাগ করিয়া অন্য গ্রামে আশ্রয় লইয়াছিল। পাক সেনারা এবং রাজাকাররা অনেক খোঁজাখুজির পর যখন মুক্তিযোদ্ধাদের না পায় তখন গ্রামে লুটতরাজ আরম্ভ করে এবং আওয়ামীলীগ কর্মী ও হিন্দুদের বাড়িতে অগ্নীসংযোগ করিতে থাকে।


পাক বাহিনীদের বিভিন্ন বাড়িতে অগ্নীসংযোগ করার ফলে প্রায় সমস্ত গ্রামে ছড়াইয়া পড়ে, তখন আমি ভয়ে আমার পিতার সঙ্গে অন্য গ্রামে পালাইবার চেষ্টা করি। কিন্তু বাড়ি হইতে বাহির হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই একজন রাজাকার আমাকে আমার পিতার হাত হইতেই চিনাইয়া লয় এবং পাক বাহিনীর নিকট সমর্পণ করে। আমার পিতাকে বেদম প্রহার করিবার পর তাহাকে একটা গাছের সহিত রশি দ্বারা বাঁধিয়া রাখে। এই দিকে আমি খুব চিৎকার আরম্ভ করি। কিন্তু নরপশুরা আমার কথায় একটুও কর্ণপাত করিল না, তাহারা হিংস্র দানবের মত আমার শরীরের উপর ঝাঁপাইয়া পড়ে। এইভাবে সাত জন পাক সেনাই আমার শরীরের উপর পাশবিক অত্যাচার চালায়। আমি অজ্ঞান হইয়া পড়িলে তাহারা আমাকে ফেলিয়া রাখিয়া যায়। প্রায় ১০ঘন্টা পর জ্ঞান ফিরিয়া পাই এবং সুস্থ্যবোধ করি। পরের দিন বেলা ১০ টার সময় আবার পুনরায় উক্ত রাজাকারের চক্রান্তে আরো তিন জন পাক সেনা আমাদের বাড়িতে আসে এবং আমার শরীরের উপর পাশবিক অত্যাচার চালায়।


টিপসহি /-

মোছাঃ পেয়ারা খাতুন।


।। ২৫২ ।।

ছালেহ্ আহমদ

গ্রাম- চর চান্দিয়া

থানা- সোনাগাজী

জেলা- নোয়াখালী।


২৫ শে মার্চের সময় একটা ধারণা ছিল যে, হানাদার বাহিনীরা এই নতুন এবং অচেনা, অজানা দেশে আসিয়া টিকিতে পারিবে না। সেই জন্য প্রথম দিকে ভারত যাই নাই। অবশ্যই প্রথম দিকেই ভারত যাইতে পারিতাম। কিন্তু যখন বাংলাদের মধ্যে রাজাকার, আলবদর ও হানাদার বাহিনী বিভিন্ন পল্লীর আনাচে-কানাচে ছড়াইয়া পড়িল তখন আমাদের ভারতে যাওয়া সম্ভব হইলো না। আমরা দেশের পরিস্থিতি ভাল না দেখিয়া দুরে এক আত্মীয় বাড়িতে আশ্রয় লই। আমাদের আত্মীয় বাড়িতে থাকার গোপন সংবাদ কয়েকজন রাজাকার জানিতে পারায় আমাদের তল্লাশের জন্য যায় এবং আমাদেরকে জুলাই মাসের ২৭ তারিখে ধরিয়া ফেলে। সেখান হইতে বন্দী করিয়া আমাদের চার জনকে সোনাগাজী থানায় লইয়া আসে। বহু ভয়ভীতি দেখায় যে, রাজাকারে নাম না দিলে স্থাবর অস্থাবর সব সম্পত্তি আমরা ভোগ করিবো। তাছাড়া থানায় লইয়া আসিয়া ১৫,০০০ টাকার বন্ড সই করিয়া লয় এই মর্মে যে আমাদের এলাকায় থাকিতে হইবে এবং রাজাকার ও শান্তি কমিটিতে নাম দিতে হইবে।


আমরা বন্ড সই করিয়াছি কিন্তু রাজাকার ও শান্তি কমিটিতে নাম দেওয়ার প্রশ্নে মুখে সবসময় অস্বীকার করিয়াছি। তারপর আমাদিগকে সোনাগাজী থানার সি এণ্ড বির গেস্ট হাউজে লইয়া আসে এবং মাথা নিচের দিকে রাখিয়া পা উপরের দিকে শুণ্য করিয়া রাখে। বেত ও বন্দুকের বাঁট দ্বারা বেদম প্রহার করে। আমরা চিৎকার বা কান্নাকাটি আরম্ভ করিলে আরো বেশি বা জোরে আঘাত করে। এইভাবে আমাদেরকে ৫/৭ দিন অত্যাচার বা শাস্তি দিতে থাকে। তাহা ছাড়া মাঝে মাঝে বুট দ্বারা লাথি মারে। তথাপি আমরা রাজাকার বা শান্তি কমিটি করিতে রাজি হই নাই।


আমরা কয়েকজন রাজাকারকে গোপনে কিছু টাকা দেওয়ার স্বীকার হইলাম। তারপর আমাদের নিকট হইতে ৫০০ টাকা আমাদেরকে জুলুম ও অত্যাচার হইতে রেহায় দেয়। তারপর আমরা আর বাড়ি ঘরে থাকিলাম না।


দেশ স্বাধীন হইলে আমরা আমাদের বাড়ি ফিরিয়া আসি। বাড়ি ফিরিয়া দেখি বাড়ির আসবাবপত্র রাজাকার ও হানাদার বাহিনীরা লুটতরাজ করিয়া লইয়া গিয়াছে।


স্বাক্ষর/-

ছালেহ্ আহমদ।


।। ২৫৩ ।।

মোঃ আব্দুল হাদি।

গ্রাম- পূর্ব চর চান্দিয়া

থানা- সোনাগাজী

জেলা- নোয়াখালী।


পাক বাহিনী যখন সোনাগাজী থানা এমনকি বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গা দখল করিয়া বসিল তখন আমি আমার পরিবার সহ সোনাগাজী থানার পূর্ব চর চান্দিয়া গ্রাম হইতে আত্মরক্ষার জন্য দূরবর্তী আত্মীয় বাড়িতে আশ্রয় লইয়া প্রায় এক মাস অতিবাহিত করি। কিন্তু মুক্তিবাহিনীরা হঠাৎ করিয়া প্রবল আক্রমণ চালাইয়া সোনাগাজী থানা শত্রুমুক্ত করে এবং পাক বাহিনী ও রাজাকারদের বিতাড়িত করে। এইভাবে মুক্তিবাহিনী প্রথমে উক্ত সোনাগাজী থানা শত্রু মুক্ত করে। তখন আমি আমার আত্মীয় বাড়ি হইতে পরিবার সহ আমার নিজ বাড়িতে আসি। বাড়িতে কয়েকদিন অবস্থানের পর পাক বাহিনী ও রাজাকার বাহিনী চারদিক হইতে সোনাগাজী থানায় মুক্তিযোদ্ধাদের ঘেরাও করে এবং প্রবল আক্রমণ চালায়। এই প্রবল আক্রমণের সম্মুখে মুক্তিবাহিনী নাজেহাল হয়ে পড়ে ও রাজাকার বাহিনী সোনাগাজী থানা দখল করে। সোনাগাজী থানা দখল করার পর থানার পার্শ্ববর্তী গ্রাম গুলি তল্লাশী চালাইয়া মুক্তিবাহিনীদের বাহির করার জন্য তাহারা ছড়াইয়া পড়ে।


৫ই রোযার দিনে রাজাকার ও পাক বাহিনী পূর্ব চর কান্দিয়া গ্রামে প্রবেশ করে। পূর্ব চর চান্দিয়া গ্রামের জনসাধারণ প্রাণের ভয়ে বাড়িঘর ছাড়িয়া পলায়ন করে। আমিও পাক বাহিনীদের আসা দেখিয়া বাড়ির পুরুষ মানুষ সব বাড়ি ছাড়িয়া আত্মরক্ষা করি। পাক হানাদার বাহিনীরা যুবক ছাত্র দেখিলে মুক্তিযোদ্ধা বলিয়া সন্দেহজনকভাবে গুলি করিয়া হত্যা করে। কিন্তু আমার বাড়ির পরিবারবর্গ বাড়ি হইতে বাহির করবার সময়টুকু পাই নাই। তাই বাড়িতে নিজের স্ত্রীকেও ফেলিয়া বাড়ি হইতে বাহির হইয়া পড়ি। তারপর বাড়ির কোন খোঁজ খবর লইতে পারি নাই। পাক হানাদার বাহিনীরা বাড়ি তল্লাশী করিয়া চলিয়া গেলে বাড়ি রওয়ানা হই। বাড়ি গিয়া দেখি যে আমার স্ত্রী অজ্ঞান অবস্থায় পড়িয়া আছে। পাশে আমার মা তাহার মাথায় পানি ঢালিতেছেন। আমিও আসিয়া মাথায় পানি ঢালি। আমার স্ত্রীর জ্ঞান ফিরিয়া আসে। তারপর আমার স্ত্রীকে অনেক কিছু জিজ্ঞাসা করি। আমার স্ত্রী আমাকে কয়েকজন রাজাকার ও ৩ জন পাক বাহিনী আমাদের বাড়ির মধ্যে ঢুকে এবং বাড়ির আনাচে-কানাচে খোঁজাখুজি আরম্ভ করে। তখন আমি আমার মার হাত ধরিয়া বাড়ির পিছনে ঝোপের আড়ালে দাঁড়াইয়া আছি। রাজাকার ও পাক হানাদার বাহিনীরা আমাদের ঘরের মধ্যে তন্নতন্ন করিয়া তল্লাশী করে ও বাড়ির পিছে যায় এবং আমার মাকে প্রথমে দেখিতে পায় এবং পরে আমাকেও দেখিয়া ফেলে। প্রথমে একজন পাক হানাদার আমার মার হাত হইতে আমাকে ছিনিয়া আনে এবং জোরপূর্বক টানিয়া ঘরের মধ্যে লইয়া যায়। আমার মা অনেক অনুরোধ ও কান্নাকাটি করিতেছেন। আমি অনেক অনুনয় বিনয় ও চিৎকার করিতেছি কিন্তু কিছুতেই পাক হানাদার বাহিনীরা আমার এবং আমার মার কোন কথায় কর্ণপাত করিল না। বরং আমার মাকে ঘর হইতে বাহির করিয়া দরজা আটকাইয়া দিল এবং দুই জন পাক হানাদার দরজায় পাহারা দিতে লাগিল। প্রথম জন আমাকে পাইয়া আনন্দে আত্মহারা হইয়া গেল এবং আমাকে অমানুষিক উপায়ে আমার শরীরের উপর দৈহিক নির্যাতন চালাইলো। এইভাবে পর পর তিন জন নরপশু আমার শরীরের উপর নির্মমভাবে নির্যাতন করে এবং পরে জ্ঞান হারাইয়া গেলে আমাকে ফেলিয়া চলিয়া যায়। এইভাবে আমাকে দুইবার আমার শরীরের উপর নির্মমভাবে পৈশাচিক উপায়ে অত্যাচার করে।


স্বাক্ষর/-

মোঃ আব্দুল হাদি।


।। ২৫৪ ।।

আলেয়া বেগম

গ্রাম- বাঘেরিয়া

থানা- সোনাগাজী

জেলা- নোয়াখালী।


পাক বাহিনী সোনাগাজী ও মতিগঞ্জে শিবির স্থাপন করিয়া স্থানীয় দালাল ও রাজাকারদের সহায়তায় আশেপাশের গ্রামগুলি আক্রমণ করিত। হঠাৎ গ্রামে প্রবেশ করিয়া ধনরত্ন লুট করিত এবং অসহায় নারীদের উপর চালাইত নির্মম অত্যাচার। পাক বাহিনীর অত্যাচারের ভয়ে উক্ত এলাকার প্রায় সকল যুবক-যুবতীগণ নিজ বাড়ি ছাড়িয়া কেহ ভারতে এবং অন্যেরা সূদুর গ্রামে আত্মীয়-পরিজনের বাড়িতে আশ্রয় গ্রহন করে।


জুন মাসে পাক বাহিনী সোনাগাজী থানা দখল করিলে আমি আমার স্বামীর বাড়ি ত্যাগ করিয়া সূদুর পল্লী গ্রামে পালাইয়া ছিলাম। আগস্ট মাসে আমি নবজাত সন্তান প্রসব করি। সন্তান প্রশবের দুই মাস পর শরীর অসুস্থ্য থাকায় পিতার বাড়ি হইতে স্বামীর বাড়ি বাঘেরিয়ায় আশ্রয় নিই। তখন আমার স্বাস্থ্য অত্যান্ত দুর্বল ছিল। আমি তখন নিয়মিত ডাক্তারের ঔষধ ব্যবহার করিতাম।


অক্টোবর ও নভেম্বর মাসে পাক বাহিনী, দালাল, রাজাকার, আল-বদর, আল-শামসের অত্যাচার খুব বৃদ্ধি পায়, পাক বাহিনীর গ্রামে প্রবেশ করার সংবাদে গ্রাম ছাড়িয়া অন্য গ্রামে আত্মগোপন করিতাম।


নভেম্বর মাসের ১৫ তারিখে পাক বাহিনী ও মিলিশিয়া আমার স্বামীর বাড়ি আক্রমণ করে। পাক বাহিনীরা আমাকে ধরিয়া ফেলে এবং হাত হইতে নবজাত সন্তানকে মাটিতে ফেলিয়া দিয়া সেখানেই পশুর মত অত্যাচার করে। তাহাদের অত্যাচারে আমি জ্ঞান হারাইয়া ফেলি। অনুমান ৪/৫ জন নরপশু আমার অসুস্থ্য দেহের উপর পাশবিক অত্যাচার করিয়া আমাকে জ্ঞানহীন অবস্থায় ফেলিয়া চলিয়া যায়। পরে আমার স্বামী অন্যান্য আত্মীয়স্বজন স্থানীয় ডাক্তারের সহায়তায় জ্ঞান ফিরাইয়া আনে।


স্বাক্ষর/-

আলেয়া বেগম।


।। ২৫৫ ।।

এডভোকেট সুরেন্দ্র চৌধুরী

জিন্দাবাজার, সিলেট।


২৬ শে মার্চ ভোর বেলা হইতেই পাক বর্বর হায়েনার দল সিলেট শহরে কারফিউ জারি করে। মাঝে মাঝে জনসাধারণের কাজকর্মের জন্য সময় দিত। কিন্তু ৪ ঠা এপ্রিল রোজ রবিবার হইতে কারফিউ আরো জোরদার করা হয়। এই সময় তাহারা এমনো করিতো যে অনবরত তিন দিন পর্যন্ত কারফিউ জারি করিয়া রাখিত।


৪ঠা এপ্রিলে তৎকালীন ন্যাশনাল ব্যাংকের সিলেট শাখার কর্মরত পুলিশের সহিত আলাপ হয়। তাহাদের মনে পুর্ব হইতেই এই সন্দেহ জাগিয়া ছিল যে হায়েনার দল ব্যাংক লুট করিতে পারে এবং তাহাদেরকে হত্যা করিতে পারে। তাই তাহারা আমাকে বলে যে যদি পাক বাহিনী আমাদের আক্রমণ করে, তাহা হইলে আমাদেরকে আশ্রয় দিবেন। আমি তখন তাহাদের এই আশ্বাস দেই যে, তোমরা যদি বিপদে পড়িয়া আমার বাসায় যাও, তাহা হইলে আমি তোমাদেরকে আশ্রয় দিবো। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ ঐ দিন বেলা ১ ঘটিকার সময় উক্ত ব্যাংক প্রহরীদেরকে বদলী করিয়া অন্য জায়গায় পাঠায় এবং সেখানে অন্য একটি প্লাটুন কাজের দায়িত্ব গ্রহন করে।


ন্যাশনাল ব্যাংক অফিসটি আমার বাড়ি হইতে প্রায় ১০০ শত গজ দুরে। ঐদিন বেলা ৩ ঘটিকার সময় পাক সৈন্য ভর্তি ৩ খানা ট্রাক ও ৪খানা জীপ ব্যাংকের সামনে দাঁড়ায়। তারপর ট্রাক হইতে প্রায় ৫০ জন পাক সৈন্য ব্যাংকের চারদিকে পজিশন নেয়। বাকি কয়েকজন উচ্চপদস্থ কর্মচারী আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করিয়া ব্যাংকের উত্তর দিকে লোহার তার নষ্ট করিয়া ফেলে। পর মূহুর্তেই তাহারা ব্যাংকের ভেতর প্রবেশ করে। উক্ত সময় প্রহরারত পুলিশগণ চিৎকার করিতে থাকে। তখন বর্বর বাহিনী প্রহরারত পুলিশদিগকে হত্যা করিয়া তাহাদের অস্ত্রগুলি নিজেদের হস্তগত করে। বিকাল ৪ ঘটিকার সময় কারফিউ জারি করিয়া ব্যাংক হইতে পার ৬-৭ বস্তা টাকা ট্রাকে উঠাইয়া লইয়া যায়। উক্ত দিনে ৪৮ ঘন্টা কারফিউ থাকায় জনগণ বাহির হইতে পারে নাই। তাই অনেকে টাকা নেওয়া সম্বন্ধে কিছুই জানেনা।


স্বাক্ষর/- সুরেন্দ্র চৌধুরী

১৩/৯/৭৩


।। ২৫৬ ।।

ডঃ আব্দুল লতিফ।

গ্রামঃ ছিরামিসি

থানাঃ বিশ্বনাথ

জেলাঃ সিলেট।


৩১ অগাস্ট রোজ মঙ্গলবার সময় ৯ঘটিকার সময় আনুমানিক ১৫ জন পাক সেনা ও সমপরিমাণ রাজাকার ছিরামিসি বাজারে আসে। তাহার পূর্বে ঐ বাজারে পাক সৈন্য আসে নাই। রাজাকার কমাণ্ডার স্কুলের শিক্ষক, পোষ্ট অফিস ও তহসীল অফিসের কর্মরত লোকজন সকলকেই ছিরামিসি হাইস্কুলে যাইবার জন্য আদেশ দিল। সেখানে শান্তি কমিটি গঠন করা হইবে। নিরীহ জনগণ ভয়ে বিদ্যালয়ে উপস্থিত হইল। কয়েক মিনিট আলাপ-আলোচনার পর পাক বাহিনী ছিরামিসি বাজারের লোকদিগকে এক দিকে এবং সরকারি কর্মচারী ও বাহির হইতে আগত লোকদের অপর পার্শ্বে বসাইল। কিছুক্ষণের মধ্যে আমাদেরকে দুইভাগে দুই জায়গায় নিয়া যায়। আমি ঐ জায়গায় প্রায় সাত বৎসর যাবৎ ডাক্তারী করিতেছি। সরকারী কর্মচারীসহ আমাদের বহিরাগত ২৬ জনকে উক্ত স্কুলের প্রধান শিক্ষকের অফিসে নিয়া শক্ত করিয়া দড়ি দিয়া বাঁধিয়া ফেলে এবং আমাদিগকে পার্শ্ববর্তী থানা জগন্নাথপুর নিয়া ছাড়িয়া দিবে বলিয়া ঘর হইতে বাহির করিয়া নৌকায় লইয়া যায়। অপরদিগকে পার্শ্ববর্তী ছিরামিসি গ্রাম ও বাজারের ৩৭ জনকে বাঁধিয়া অপর গ্রামের দিকে লইয়া যায়। আমাদের ২৬ জনকে নৌকাযোগে কচরাকেলী গ্রামে নিয়া যায়। সেখানে আমাদিগকে পুকুরের পাড়ে কিছু পানির মধ্যে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করায়। ঐ সময় আমাদের হাত পিছনের দিকে শক্তভাবে বাঁধা ছিল। দুই দিক হইতে পাক বাহিনী ও রাজাকার গুলি করিতে থাকে। আমি হাত ও পায়ে গুলিবিদ্ধ হইয়া পুকুরের পানিতে ডুব দেই। বহু কষ্টে পুকুরের অপর পাড়ে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় শহীদ লোকদের পার্শ্বে আসি। সেখানে প্রত্যেককে ভালোভাবে লক্ষ করিয়া দেখি সকলেই নরপিশাচদের গুলিতে শাহাদাৎ বরণ করিয়াছে। অপরদিকে ছিরামিসি এলাকার ৩৭ জনকে মাঠে নিয়া অনুরুপ অবস্থায় গুলি করিয়া হত্যা করিয়াছে। আমি আহত অবস্থায় অপর গ্রামে গিয়া আশ্রয় নেই। সেই দিন যাহারা শহীদ হইয়াছে তাহাদের নাম নিন্মে দেয়া হলঃ


আব্দুল বারিক মেম্বার,

আব্দুল লতিফ,

সুন্দর মিঞা,

তহসীলদার ও তাহার দুই ছেলে,

পোষ্ট মাষ্টার ছিরামিসি বাজার,

ছিরামিসি হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক,

ছিরামিসি প্রাইমারী স্কুল শিক্ষক একজন,

নজীর আহমদ,

একলাস মিঞা,

দবীর মিঞা,

রুসমত উল্লাহ,

তৈয়ুব আলী,

মোসাদ্দের আলী ও অন্যান্য।


৩১ শে অগাস্ট পাক বাহিনী ও তাহাদের অনুচরগণ ৬৩ জন নিরীহ জনগণকে হত্যা করিয়া ক্ষান্ত হয় নাই। ১লা সেপ্টেম্বর ছিরামিসি বাজার ও গ্রাম জ্বালাইয়া দেয় ও মা-বোনদের উপর পাশবিক নির্যাতন করে।


স্বাক্ষর/-

আব্দুল লতিফ


।। ২৫৭ ।।

আকাদ্দাস সিরাজুল ইসলাম

থানাঃ বিয়ানীবাজার

জেলাঃ সিলেট।


পাক বাহিনী একমাত্র বিয়ানী বাজার থানার পশ্চিম পার্শ্বের এক টিলায় ১৭২ জন নিরীহ লোককে নির্মমভাবে হত্যা করে। আজও সেখানে বহু কঙ্কাল পড়ে আছে। একমাত্র সুপাতলা গ্রামে মনোরঞ্জন ঘোষের পরিবারের ১৩ জন লোককে গুলি করিয়া হত্যা করে। নিন্মে কিছু শহীদের নাম দেওয়া হলঃ


মোঃ সিরাজ উদ্দিন-৩৮ (মাথিউরা)

মোঃ আব্দুল মান্নান-৪৭ (খাসা কসবা)

মোঃ তাহির আলী-৬০ (ফতেহপুর)

মোঃ আবুল হুসেন (নিজাম)-১৯ (ফতেহপুর)


একই পরিবারভুক্ত শহীদরা হলেনঃ


শ্রীমনোরঞ্জন ঘোষ -৪৩ (সুপাতলা),

হিরনবালা ঘোষ -৩৭ (ঐ),

মুকুল রঞ্জন ঘোষ -১৮ ছাত্র (ঐ),

অমিতা রাণী ঘোষ -৯ (ঐ),

ক্ষেত্রময়ী ঘোষ -৬৮ (ঐ),

সীতাবালা ঘোষ -৫ (ঐ),

উমানন্দ ঘোষ -৬৫ (ঐ),

চারুবালা ঘোষ -৫০ (ঐ),

মহানন্দ ঘোষ -৫০ (ঐ)

নিখিল চন্দ্র ঘোষ -১২ (ঐ),

কৃষ্ণ মোহন ঘোষ -১০ (ঐ),

বীরেন্দ্র কুমার ঘোষ -৪২ (ঐ),

নরেশ চন্দ্র ঘোষ -৫৮ (ঐ),

কমর উদ্দিন -৩৮ (মাথিউরা),

মোঃ মিছির আলী -৩০ (সুপাতলা),

মোঃ ছলু শিকদার -৪৪ (দুবাগ),

মোঃ আব্দুল হাছিম -২৫ (মাথিউরা),

মোঃ আব্দুল লতিফ -১৩ (ঐ),

গুরু প্রসন্ন দাস -৭২ (জলডুপ কিসমত),

শ্রী রাধারমন দাস -৭০ (জলডুপ-বড়গ্রাম),

শ্রীমাণ দাস -৬২ (ঐ),

মোঃ জামাল উদ্দিন -২২ (খসির কসবা),

মোঃ মকদ্দস আলী -৫০,

ইর্শাদ আলী -৩০ (সারপার),

আরব আলী -১৬ (ঐ),

মোঃ ইউসুফ আলী -৩৫ (নয়াগ্রাম),

নজির আলী -৩৬ (ঐ),

মোঃ তজিদ আলী -৩০ (পুন্নারাই),

মোঃ আইয়ুব আলী -৩৮ (ছাতলপার),

মোঃ আব্দুল রউফ -৩৫ (ইমামপুর),

মোঃ আব্দুল মুহিত -১৮ (মাইজ কাপন),

মোঃ আব্দুস সাত্তার -২০ (বাডুদা),

আব্দুল গফুর -২৫ (ঐ),

মোঃ রাতিবুর চৌঃ -২০(ঐ),

মোঃ মুস্তফা উদ্দিন -২৫ (ঐ),

মোঃ রফিক উদ্দিন চৌধুরী- ৫৫ (ঐ)

রফিক উদ্দিন- ২৫(আষ্টগরি)

আব্দুল লতিফ -৪০ (ঐ),

রাইয়ুব আলীর স্ত্রী -২২ (ঐ),

রাইয়ুব আলীর মেয়ে -৭ (আষ্টগরি),

তৈয়ব আলী -৩৫ (তাজপুর),

আঃ খালিক -১৮ (ঐ),

মুজাম্মিল আলি -৩৫ (বডুদা),

মোঃ মিছির আলী -৪৫ (ঘুঙ্গাদিয়া),

মোঃ মনোহর আলি -৪০ (ঐ),

মোঃ আকবর আলী -৩৫ (ঐ),

মোঃ গোলাম ছরওয়ার -৪০ (সারপার),

মোঃ ওয়াতির আলী -৪০ (পাথারি পাড়া),

আয়রুন বিবি -২ (ছফলা),

মো; ইয়াজ -৭২ (চুড়খাই),

মনোহর আলী (ঘুঙ্গাদিয়া) ।


স্বাক্ষর/-

আকাদ্দাস সিরাজুল ইসলাম

২৪.৯.৭৩


।। ২৫৮ ।।

আব্দুস সোবহান

সার্কেল অফিসার (উন্নয়ন)

শ্রীমঙ্গল, সিলেট।


ডাক বাংলায় থাকা অবস্থায় আমাকে নানা রকম প্রশ্ন করা হয়। আমি প্রানভয়ে সব প্রশ্নের উত্তরে কিছুই জানি না উত্তর দিতে থাকি। এতে আমার উপর অত্যাচার শুরু হয়। চড়, লাথি এবং ডাণ্ডা পিটা হয়; কিন্তু আমার কাছ থেকে না পাওয়ায় আমাকে ওয়েলফেয়ার বিল্ডিং এ স্থানান্তরিত করা হয়। সেখানে দেখতে পাই পাক জান্তারা বাঙ্গালীদের চক্রীর সাথে বেঁধে চক্র ঘুরিয়ে বেত দিতে থাকে। রাইফেলের অগ্রভাগ দিয়ে গুঁতো মারতে থাকে। রাত্রে কোথায় নিয়ে যায় এবং গুলি করে মারা শব্দ শুনা যায়। পরে জেনেছি শ্রীমঙ্গলস্থ সাধু বাবার থলি নামক স্থানে গণহত্যা করা হত। বুট দিয়ে মানুষকে লাথি দেয়া হত। জলন্ত সিগারেট দিয়ে শরীরে ফোস্কা তোলা হত। এই রকম অত্যাচারের প্রক্রিয়া দেখে আমি প্রাণভয়ে আল্লাহর কাছে প্রান ভিক্ষা করতে থাকি। কারন এ ছাড়া কোন উপায় ছিলনা।


এমনাবস্থায় ১২ মে ১৯৭১ সন পর্যন্ত থাকি এবং আমাকে নানাবিধ প্রশ্ন করা হয়। তন্মধ্যে একটা প্রশ্ন ছিল “তুম লোগ কা মেজর, কর্ণেল, ক্যাপ্টেন কিদার হ্যায়?” আমি বলতাম আমি জানিনা (অবশ্য উর্দুতে উত্তর দিতাম)। তারপর যখন আমি অসহ্য হয়ে যাই তখন আমি বললাম, হাম সরকারী দপ্তর তথ্য ইউনিয়ন কাউন্সিল কা মেকানিক হ্যায়, হাম কভি মুক্তি মে নেহি থা, ইছলিয়ে হাম কোছ নেহি জান্তা হ্যায়। এটা শোনার পর ক্যাপ্টেন তারেক আমাকে আমার উপরস্থ কর্মচারীর সার্টিফিকেট দাখিল করতে পারবো কিনা জিজ্ঞাসা করলে আমি বললাম পারবো। তখন আমাকে ২ জন সিপাহী দিয়ে সি,ও (রেভ) যিনি তখন সি,ও (ডেভ)- এর দায়িত্ব পালন করতেন তার কাছে পাঠায় এবং তার কাছ থেকে সার্টিফিকেট আনলে ১৪ ই মে ১৯৭১ ইং তারিখে আমাকে পুনরায় কাজে যোগদান করব বলে স্বীকারনামা লিখিয়ে নিয়ে ছাড়ে এবং হেঁটে হেঁটে ১০ মেইল দূরে রাজঘাট ইউনিয়নে যাওয়ার নির্দেশ দেয়। আমি প্রানভয়ে পায়ে হেঁটে রাজঘাট পৌছি। কিন্তু রাজঘাট গিয়ে আমার নিস্তার হয়নি। কারন আমাকে শ্রীমঙ্গল থেকে কোন রিলিজ সার্টিফিকেট দেয়া হয় নি। তাই আবার সিন্দুরখান ক্যাম্পে আটক করা সেখানে শ্রীমঙ্গলের সাথে যোগাযোগ করার পর আমাকে ছাড়ে।


সেখানে যাওয়ার পর দেখলাম কোথা হতে বাঙ্গালী লোক এনে বাসবাড়ী নামক স্থানে গুলি করে হত্যা করে এবং মানুষকে বেঁধে ডাণ্ডা দিয়ে পিটাতে থাকে।


এই সমস্ত অত্যাচারের মধ্যে যেটা আমার কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে তা হচ্ছে নিন্ম্রুপঃ

আমি রিলিজ হওয়ার ২ মাস পরে অর্থাৎ ১৯৭১ সনের জুন মাসের শেষ দিকে রাজঘাট থেকে শ্রীমঙ্গল যাচ্ছিলাম। আমি ক্যাপ্টেন মুতালিব সাহেবের জীপে ছিলাম এবং তার ড্রাইভার আমার সাথে ছিল। আমরা কুনদড়া বাগানে যাওয়ার পথে দেখলাম কুনদড়া বাগানের পতিবরের উত্তরের পুলের উপরে কয়েকজন মিলিটারারী এবং এই মিলিটারীরা একজন শ্রমিককে একটি গাড়ির পেছনে বেঁধে প্রায় ৩০ মাইল বেগে গাড়ি চালাচ্ছে। এই অবস্থা দেখে আমি ভীত হয়ে পড়ি এবন শ্রীমঙ্গল যাওয়ার চিন্তা ত্যাগ করি। লোকটিকে গাড়ির পিছনে বেঁধে টানায় তার শরীরের সমস্ত চামড়া উঠে যায়। এই অবস্থা দেখে আমরা আবার রাজঘাট ফিরে চলে আসি। অবশ্য শেষে শুনেছি লোকটা বেঁচেছে। লোকটাকে এভাবে অত্যাচার করার কারন পরে জেনেছি। পুর্ব রাত্রে মুক্তিবাহিনী কুলাউড়া পুল ভাঙ্গায় এ অত্যাচার তাকে করা হয়েছে। কারন সে কুলাউড়া বাগানের প্রধান নেতৃস্থানীয় শ্রমিক।


নানা স্থানে পাক সেনারা মেয়ে-ছেলেকে ধরে ধর্ষণ করেছে শুনেছি, তবে স্বচক্ষে দেখিনি। ঐ সময় পাক সেনারা শ্রীমঙ্গল শহরে নেতৃস্থানীয় লোকদের বাড়ী জ্বালাতে থাকে এবং বাড়ীস্থ সকল মালামাল লুট করতে থাকে। অবশ্য তাদের লুটের পর বাঙ্গালী লোভীরা তাদের উচ্ছিষ্ট কিছু কিছু জিনিস লুটে নেয়।.


পাক বাহিনীর অত্যাচারে লোক গ্রাম হতে গ্রামান্তরে, শহর থেকে গ্রামে গ্রামে হেঁটে স্ত্রী-পুত্রসহ পলায়ন করে। কিন্তু সেখানেও রেহাই নেই। পাক সেনারা গ্রামে ঢুকে সকল ব্যক্তিদেরকে ধরে মারধোর করত ও তাদের কাজ করাত। রাত্রে মুক্তিবাহিনী যাতে না আসে এজন্য কড়া পাহাড়া দেওয়াতো। যারা পাহারায় ছিল তারাই রক্ষা পেয়েছে, বাকী যারা পাক সেনাদের কবলে পড়েছে তারা ফিরতে পারেনি।


স্বাক্ষর/-

আব্দুস সোবাহান।


।। ২৫৯ ।।

সামসুদ্দীন আহমদ

বুকিং ক্লার্ক

শ্রীমঙ্গল রেলওয়ে ষ্টেশন

সিলেট।


২১ শে মে তারিখ শ্রীমঙ্গলের পথে গাড়িতে ব্রাক্ষ্মণবাড়ীয়া, তারপর পায়ে হাঁটিয়া প্রায় ৩৫ মেইল অতিক্রম করিয়া রেলওয়ে ষ্টেশন রশিদপুর ২২ তারিখ আশ্রয় নেই। সেখানে পৌঁছিয়াই আমরা বিপদে আসন্ন বলিয়া আভাস পাইতে থাকি। আমাকে নাকি শ্রীমঙ্গলে পাক হানাদার বাহিনী খোঁজাখুঁজি করে। আমার আর সামনে পা দেওয়া উচিৎ নহে বলিয়া রশিদপুরস্থ কর্মীবৃন্দ হুঁশিয়ার করে। এতদুর আসিয়া বাসা বা পুরাতন ভৃত্যের সন্ধান মিলিবে না বুঝিয়া অত্যান্ত ব্যতিব্যস্ত হইয়া পড়ি। একটা ট্রেন শ্রীমঙ্গল অভিমুখে যাইতেছে দেখিয়া (২৩/৫/৭১ তাং) উঠিয়া পড়ি এবং পরবর্তী স্টেশন সাতগাঁ নামিয়া পড়ি। সেখান হইতে সরাসরি আমার স্টেশন শ্রীমঙ্গলে কথা বলার সুযোগ পাইয়া সহকর্মী ও স্টেশন মাষ্টার সাহেবের সাথে কথাবার্তা বলিয়াছিলাম। আমি ও দিনের ক্লান্ত দেহে খাইয়া অনেকটা কাহিল হইয়া পড়ি এবং স্টেশন বিল্ডিং কক্ষে বিশ্রাম করিতে ছিলাম।


বেলা তখন হয়ত আড়াইটা। অতর্কিতে আমার সামনে বিভিন্ন ভারী ভারী অস্ত্রে সজ্জিত হানাদার বাহিনীর একজন ক্যাপ্টেন ও তিন জন সৈনিক উপস্থিত এবং আমার নাম ধরিয়া সন্ধান জানিতে চাহে। তখন আমার মুখে কথা সরিতে ছিল না, মনে হইতেছিল যেন আমার পায়ের নিচের মাটি সরিয়া যাইতেছে। ক্ষণেকের মধ্যে স্টেশন মাস্টার সাহেবও আসিয়া উপস্থিত এবং আমারই নাম সামসুদ্দীন আহমদ সনাক্ত করিলে ক্যাপ্টেন আমাকে তাহাদের অনুসরন করিতে বলে। কয়েক কদম যাইয়াই তাদের জীপে উঠাইয়া আমাকে একটা বড় রকমের আসামী হিসেবে ঘিরিয়া রাখে। আধ ঘন্টার মধ্যে তাহারা আমাকে শ্রীমঙ্গল ওয়াপদাস্থ তাদের সামরিক আইন হেড কোয়ার্টারে নিয়া আসে।


আমাকে প্রথম লেফটেন্যান্ট আতাহারের কাছে হাজির করিলে তিনি আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ আরম্ভ করেন। তাহার জিজ্ঞাসাবাদের সংক্ষিপ্ত বিষয় ছিল চাকুরীতে যোগদান করি নাই কেন, কয়জন অবাঙ্গালী হত্যা করিয়াছি, সদ্য ভারত হইতে মুক্তিবাহিনীর ট্রেনিং নিয়া আসলাম কিনা। মুক্তিবাহিনীর লোক কাহারা, তাহাদের কি পোষাক, তাছাড়া শ্রীমঙ্গল স্টেশনের তৎকালীন অবাঙ্গালী স্টেশন মাস্টার আখতার ও তাহার ছেলেপেলে কোথায়, তাদের আমি হত্যা করিয়াছি। আমার বিরুদ্ধে নাকি সরাসরি হত্যার অভিযোগ আছে। তাছাড়া তিনি আমাকে কয়েকজন সমাজকর্মীর না-ধাম, তাহাদের আচার-ব্যবহার জিজ্ঞাসাবাদ করিয়া আমাকে ছাড়িয়া অন্য রুমে চলিয়া যান।


একজন সৈনিক আসিয়া আমাকে কর্কশ স্বরে তাহার সহিত যাইতে বলে। আমি তৎক্ষণাৎ তাহার সহিত গেলাম। একটা রুমে নিয়া আমাকে বসিতে বলিল। চতুর্দিকে কেবল গোলাবারুদ আর অস্ত্রশস্ত্র ছাড়া আর কিছু নাই। আমাকে বিষণ্ন দেখিয়া একজন বিকট চেহারাধারী সৈনিক বলিল যে “যব এক দফে শের কা চক্কর মে আগিয়া, আর যানা কাহা হ্যায়”। কয়েক মিনিট পর আমাকে সেই বিল্ডিং হইতে ২-৩ মিনিটের রাস্তা দূরে অন্য এক বিল্ডিঙের ত্রিতলে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে আমার সুপরিচিত একজন বাঙ্গালী পুলিশের লোকের সাক্ষাৎ পাইলাম। সেই বাঙ্গালি লোকটা ২-৩ জন হানাদার বাহিনির লোক আমাকে মাটিতে বসিবার আদেশ দিয়া প্রশ্নবানে জর্জরিত করিয়া তোলে। ধমক দিতে থাকে, আর বিভিন্ন ধরনের জিজ্ঞাসাবাদ করিয়া প্রায় দুই-আড়াই ঘন্টা ব্যয় করে। সন্ধ্যা ক্রমাগত প্রায়, তখন আমাকে পার্শ্বস্থ একটা কামরায় ঢুকাইয়া বাহির হইতে তালাবদ্ধ করিয়া দিল। তখন আমার মানসিক অবস্থা কি তাহা আজ আর আমি ভাষায় প্রকাশ করিতে পারিতেছিনা। আটকাবস্থায় পড়িয়া প্রথমেই আমার স্মরণ পড়ে আমার সর্বকনিষ্ঠা মেয়ে দুলালী পারভীনের কথা। তারপর একে একে প্রতিটি সন্তান ও স্ত্রীর কথা। ক্রমে জীবনের স্মরণীয় মূহুর্তের বিভিন্ন প্রতিচ্ছবি আমার চোখের সামনে সিনেমার মত ভাসিয়া আসিতে থাকে।


আরও দুই জন ভদ্রলোককে সেখানে বন্দী হিসেবে দেখিলাম। একজনকে ভাল করিয়াই জানি, আর একজন আমার অপরিচিত। সন্ধ্যার লগ্নে আমাদের জন্য আটার রুটি ও ডাল দিয়া গেল। সাথের ঐ দুই ভদ্রলোক কয়েকদিন হইতে অভ্যস্থ বলিয়া ডাল-রুটি খাইলো। আমার দ্বারা কিছুতেই সম্ভবপর হইল না। দুই দিন পায়ে হাঁটিয়া এবং তৃতীয় দিনে আটকা অবস্থায় আমার শারীরিক অবস্থা একেবেরে শক্তিহীন হইয়া পড়ে।


রাত্র অনুমান আটটার দিকে দুজন সৈনিক আমাকে অন্য কক্ষে নিয়া যায় এবং আবার কেন চাকরীতে যোগদান করি নাই, মুক্তিবাহিনীতে যোগদান করিয়াছি, কয়েকজন অবাঙ্গালী হত্যা করিয়াছি ইত্যাদি প্রশ্ন করিয়া শাসাইতে আরম্ভ করে। জিজ্ঞাসাবাদ যাহারা করিতেছিল তাহাদের জল্লাদ বলিলেও যথেষ্ঠ হইবার নহে। লাঠি দ্বারা ধাক্কা দেয়, সত্য কথা না বলিলে জীবন এখনই শেষ করিয়া দিবে বলিয়া হুঁশিয়ার করিতে থাকে। তাহাদের মন মত কোন কথাই আমার কাছ থেকে পাইতেছে না মনে করিয়া তাহারা আমার প্রতি ভীষণ চটিয়া যায়। হাত দুই লম্বা লাঠি দ্বারা আমাকে বেদম প্রহার করিতে থাকে। জীবনে কোন কারনে, কোন অবস্থায় এমন শারীরিক-মানসিক নির্যাতন সহ্য করিতে হয় নাই। তাহাদের মারের চোটে আমি কখন কোন অবস্থায় সংঞ্জা হারাইয়া ফেলি বলিতে পারি না। ভোর বেলা দেখি আমি প্রথম যে রুমে ঢুকি সেখানেই শায়িত। মার খাওয়া জায়গা গুলো কালো ও ফুলিয়া রহিয়াছে, হাত দিয়া ছুঁইতে পারিনা। রাত্রে যে রুমে নিয়া আমাকে জিজ্ঞাসা করিল তাহার চতুর্দিকের দেয়ালে রক্তের দাগে ঐ রুমটা যে জল্লাদের নির্যাতন কক্ষ তা বুঝিতে আমার বাকী ছিল না।


প্রত্যুষে তালা খুলিয়া আমাদেরকে পায়খানা প্রস্রাব করার জন্য নিকটস্থ খালের পড়ে নিয়া গেল। সেখানে পৌঁছিয়া আমরা ৮-১০ জন কয়েদী হইলাম, তাহাদের মধ্যে অনেকেই আমার মত অচল প্রায়, কথাবার্তা বলিতে পারেনা। কথা বলাও কঠোরভাবে নিষিদ্ধ ছিল। এক সাথে সকলকে কোন পর্দার ব্যবস্থা ছাড়া লাইন করিয়া বসাইয়া দিল পায়খানা করিতে। কে পায়খানা করিল জানি না। আমারতো পায়খানা-প্রস্রাব কিছুই হইলো না। তাছাড়া আমি দুই দিনের উপবাসী। ২-৩ মিনিটের মধ্যে পায়খানা-প্রস্রাব ও খালে পানি খরচ করিয়া হাত মুখ ধুইয়া আসিতে হয়। বন্দুকধারী সৈনিক ও হাওয়ালদার দণ্ডায়মান।


আবার আসিয়া যার যার রুমে স্থান লইতে হইল। একটা পুরি ও এক কাপ চা খাইতে দেয়া হইল। দুপুরে আটার রুটি আর ডাইল। শরীরে জ্বর, কিছুই খাইতে পারি না। মুহুর্তে মূহুর্তে পরিবার-পরিজনদের কথাই মনে পড়িত। বিপদে পড়িয়া সর্বশক্তিমান আল্লাহর নামই আহার-বিহারে সম্বল করিয়া লইলাম। বিকালে আবার ডাল-রুটি। ভাতের নাকি ব্যবস্থা নাই, তাই ভাতের কথা উচ্চারণ করিবার সাহসও হইল না।


আমাদিগকে যে রুমে রাখিলো তাহার দুদিকে বন্দুকধারী সৈনিকরা পোষাক ও অস্ত্রশস্ত্র লইয়া শুইয়া থাকে। আমাদের দিকে প্রকারান্তরে খুব খেয়াল করিত। আমরা কি বলি না বলি তাহা শুনিতে চেষ্টা করিত। জানালায় এক প্রকার কালো তার জড়ানো ছিল, তাহাতে আমাদের মধ্যে হইতে যেন তাহারা টেপ করিয়া রাখিয়াছে। জনমানব শুন্য এলাকায় আমরা ছিলাম, রোজই বিভিন্ন চেহারার সৈনিক আসিয়া তালা খুলিয়া দিলে কয়েদী হিসাবে আমাদের সহিত ঠাট্টা-চাতুরী করিত। কোথায় তোমাদের শেখ সাহেব, কোথায় বঙ্গবন্ধু ইত্যাদি বলিয়া ব্যঙ্গ করিত। আর লম্বা লাঠি দ্বারা গুঁতা দিয়া জানোয়ার ইত্যাদি বলিত। কেউ কেউ ধীরস্থীর হইয়া আমাদিগকে হিন্দুর গোলাম, হিন্দুর পয়দা বলিয়া গালি দিত।


এক দিন আমাদের সাথের একজন লোক বেলা প্রায় ১১ টার সময় পায়খানা করার জন্য অস্থিরভাবে প্রহরারত সৈনিককে মিনতি করিতে লাগিল। এমন সময় একজন সুবেদার মেজর আসিল। কর্মরত সৈনিক লোকটার পায়খানার কথা জানায়। তাদের ভাষায় – তারা কি বলিল জানিনা। তাহাকে দুই তিন জনে পায়খানা করাইবার মানসে নিয়া বাহির হইল। উপর হইতে আমরা নজর করিয়া দেখিলাম যে, তাহার হাত রশি দিয়া বাঁধিয়া আগে-পিছে সৈনিক তাহাকে খাল পাড়ে নিল এবং গুলি করিয়া তাহাকে খতম করিয়া তাহারা ফেরৎ চলিয়া আসিল। এমনিভাবে প্রতিদিন ২-১ জনের মৃত্যু দেখিয়াছিলাম। ক্যাম্পের মধ্যে তাজা কুকুরে ভর্তি ছিল। এই অসংখ্য কুকুর খালের পাড়ে মানুষের তাজা রক্ত খাইয়া দিনে বেশ মোটা – তাজা হইত। আর সৈনিকরা মানুষের সাথে কুকুরও গুলি করিয়া হত্যা করিত।


দু-একদিন ফাঁক দিয়াই তাহারা ঐ জল্লাদখানায় নিয়া আবার নির্যাতন করিত। এমনিভাবে বিভিন্ন উপায়ে আমাকে শারিরীক অত্যাচার আজ চির রোগা করিয়া দিয়াছে। মারের চোটে শরীর হইতে রক্ত ছিটিয়া পড়িত। ক্ষণে ক্ষণে বেহুঁশ হইলেও তাহারা রেহাই দিত না। তিন/চার দিন তাহারা আমাকে দিয়া লিখিত জবানবন্দি নিয়াছে। ২-৩ দিন কথিত লেফটেন্যান্ট আতাহারের সাক্ষাৎ পাইয়াছি। তাহাকে সাহস করিয়া আমার মুক্তির কথা জিজ্ঞাসা করিলে ব্যঙ্গ হাসি হাসিয়া বলিত “সবুর কর, কোহি তকলিফ তো নেহি দ্যা রাহা”।


একদিন রাত্র অনুমান ৯ টার সময় দুজন বন্দুকধারী সৈনিক আসিয়া বিশেষ করিয়া আমাকে খুব শাসাইতে লাগিল। আমি নাকি মুক্তিবাহিনীর পৃষ্ঠপোষক ও কয়েকজন অবাঙ্গালী লোককে হত্যার ব্যাপারে অঙ্গাঙ্গিকভাবে জড়িত ইত্যাদি। তাহারা আমাকে ত্রিতল হইতে ছাদের উপর নিয়া গেল এবং সেখানে আমাকে ভীষণভাবে নির্যাতন চালাইয়া একেবারে অচল করিয়া ফেলে। কর্তব্যরত সৈনিক আমার প্রতি খানিক সদয় থাকাতে আমাকে আবার আমার রুমে আনিয়া রাখিয়া যায়। আমাকে মারিয়া ফেলিবে এই ভাবিয়া আমার সঙ্গী ৮-১০ জন কয়েদী আমি ফিরিয়া দেখি তাহারা কাঁদিতেছে আর কালেমা পড়িতেছে ও দরূদ পাঠ করিতেছে। আমাকে ফেরৎ পাইয়া তাহারা অনেকটা শান্তি লাভ করে। তাহারা হানাদারদের কথা বলিত না, আমার মাধ্যমেই তাহাদের হানাদারদের সাথে কথোপকথন হইত।


যেহেতু আমি নির্দোষ ছিলাম, কর্ণেল ফকরুল আলম আমাকে ডাকিয়া অনেক শাসাইলো। কয়েকদফা গালি দিয়া আমাকে মুক্তির আদেশ দিল এবং কাজে যোগ দিবার জন্য একজন সুবেদার মেজরকে হাওলা করিয়া আমাকে স্টেশন পাঠাইয়া দিলে কোন মতে নয়দিন থাকিয়া স্বাস্থ্যগত কারনে ছুটি লইয়া শ্রীমঙ্গল হইতে কাটিয়া পড়ি। পাক বাহিনীর হাতে আমি মোট ২১ দিন বন্দি ছিলাম।


স্বাক্ষর/-

সামসুদ্দিন আহমদ

১৭.১০.৭৩


।। ২৫৯ ।।


(২৫৯ নং টি দুইবার ব্যবহৃত হয়েছে)

মোঃ মাজেজুল ইসলাম

জেলা প্রশাসকের অফিস

কুমিল্লা।


সংবাদ পাইলাম জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারকে পাক বাহিনী ধরিয়া নিয়া গেছে। পরের দিন জেলা প্রশাসকের ব্যক্তিগত ড্রাইভার আমার বাসায় আসিয়া জেলা প্রশাসককে ও পুলিশ সুপারিনটেন্ডেন্ট কবির উদ্দিন সাহেবের মর্মান্তিক সংবাদ জানাইল। পরে পরস্পর জানিতে পারিলাম উভয়কে পাক সৈন্যরা গুলি করিয়া নির্মমভাবে হত্যা করে।


৯ এপ্রিল সকালে পাক বাহিনী আমাকে বাসা হইতে ধরিয়া তাহাদের শিবিরে লইয়া যায়। বহু প্রকার প্রশ্ন করে। উক্ত প্রশ্নের উত্তর দিতে না পারায় আমাকে মৃত্যুর ভয় দেখায় এবং সেনানিবাসে নিয়া যাইবার প্রস্তুতি নেয়। সেখানে তৎকালীন অবাঙালী অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকের সুপারিশক্রমে জীবন ভিক্ষা পাই এবং অফিসে কাজকর্ম করাইতে বাধ্য করে।


সার্কিট হাউজে সন্ধ্যার পর গ্রাম ও শহরের আশেপাশে হইতে মা-বোনদিগকে ধরিয়া নিয়া আসিয়া নৃশংসভাবে অত্যাচার চালাইত। রাত্রে মা-বোনদের বিকট চিৎকার শুনিতে পাইতাম। হায় আল্লাহ, ধর্মের নামে ইসলামের নামে একি অত্যাচার! পাক বাহিনীর এই নৃশংসতা দুনিয়ার অসভ্যতাকে হার মানাইছে।


স্বাক্ষর/-

মোঃ মাজেজুল ইসলাম।


।। ২৬০ ।।

গোলাম রফিক

থানা- কসবা

জেলা- কুমিল্লা।


পাক সেনারা ৩০০ জন লোককে বিভিন্ন প্রকারে ধরিয়া হত্যা করে। তন্মধ্যে এই এলাকার অন্তর্গত চারগাছ গ্রামে ঘরের মধ্যে ৩৪ জন লোককে গুলি করিয়া হত্যা করে।


ঘটনার বিবরণে প্রকাশ যে, উক্ত গ্রামের জনৈক ব্যক্তি আকতার উদ্দিনের বাড়িতে সন্ধ্যার সময় বিভিন্ন পর্যায়ের লোক মিলিত হইয়া রাজাকার ও পাক সেনাদের পৈশাচিক উপায়ে নিরীহ জনসাধারণের বাড়ীঘর লুণ্ঠন, প্রজ্বলন, ধ্বংস ও বীভৎসতার সমালোচনা করিতে থাকে। কিন্তু রাজাকার এবং পাক সেনাদের শিবির উক্ত গ্রামের সন্নিকটে অবস্থিত ছিল। ঘটনার বিবরণে আরও প্রকাশ যে, উক্ত সময়েই কয়েকজন রাজাকার এবং পাক সেনা পাহারায় রত ছিল। একজন রাজাকার গোপনে উক্ত বাড়ীর আড়ালে থাকিয়া তাহাদের নিন্দার কথা শোনে এবং সমস্ত বৃত্তান্ত পাক সেনাদের কর্ণগোচরে দেয়। সঙ্গে সঙ্গেই কয়েকজন পাক সেনা ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয় এবং অতর্কিতে ষ্টেনগান দ্বারা ঘরটি লক্ষ করিয়া আক্রমন চালায়। এই পৈশাচিক আক্রমনে যাহারা আত্মরক্ষার জন্য রাস্তায় বাহির হইয়া আসিয়াছিল তাহাদের মধ্যেও অনেকেই গুলির আঘাতে চির নিদ্রায় লুটিয়া পড়ে। মুমূর্ষ লোকদের উপরেও চললো বেয়নেট চার্জ। ফলে ঘটনাস্থলেই ৩৪ জন লোক শাহাদাৎ বরণ করেন। নিন্মে কয়েকজনের নাম উল্লেখ করা হইলোঃ

(১) অশ্বিনী পোদ্দার,

(২) মহানন্দ আচার্য্য,

(৩) আব্দুল মিছির,

(৪) মেথর ছামারিয়া,

(৫) কাঞ্চন মিঞা।


ইহা ছাড়াও অত্র এলাকার ও অন্যান্য এলাকার ৩০ জন লোককে সন্দেহবশতঃ জীবন্ত অবস্থায় মাটিচাপা দেয়া হয়। মণিঅন্ধ গ্রামের জনৈক ব্যক্তি জনাব গোলাম শফিককে ঘরের মধ্যে রশি দ্বারা বাঁধিয়া আগুন জ্বালাইয়া দেয়। ফলে ঘটনাস্থলেই গোলাম শফিক সাহেব আগুনে পুড়িয়া মারা যান।


মগুড়া ইউনিয়নের এবং অন্যান্য এলাকা হইতে বহু মেয়েকে ধরিয়া আনিয়া পাক পিশাচরা নির্যাতন ও পাশবিক অত্যাচার চালায়। পাক সেনাদের এই পৈশাচিক ব্যবহারে এই এলাকার শতকরা ৯০ জন লোক দেশ ত্যাগ করে।


স্বাক্ষর/-

মোঃ গোলাম রফিক


।। ২৬১ ।।

মোছাঃ চানুভান

গ্রাম- ফুলবাড়িয়া

থানা- ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়া

জেলা- কুমিল্লা।


আমি দরিদ্র পিতৃহীন অবিবাহিতা নারী। বিধবা মাতা একমাত্র সংসারে আপন পরিজন। আমার কোন ভাইবোন নাই।


বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন আরম্ভ হইলে পাক বাহিনী পত্তন ইউনিয়নে শিবির স্থাপন করে। জুন মাসের শেষের দিকে পাক সৈন্য ও রাজাকারদের অত্যাচার ও নৃশংসতা বৃদ্ধি পায়। স্থানীয় রাজাকাররা গ্রামের ও ইউনিয়নের বহু ধনসম্পত্তি লুণ্ঠন করে।


জুলাই মাসের ১৭ তারিখ বানু মিঞা, সোনা মিঞা ও চাঁন মিঞা গভীর রাত্রে আমার নিজ বাড়ী হইতে ধরিয়া লইয়া পাক বাহিনীর শিবিরে লইয়া যায়। আমাকে দেখিয়া পাক বাহিনীরা আনন্দে নাচিয়া ওঠে, আমার ক্রন্দন তাহাদের প্রাণে একটুও মায়ার সঞ্চার করে নাই। রাজাকাররা ধরিয়া নিবার সময় তাহাদের নিকট বহু আকুতি-মিনতি ও পায়ে জড়াইয়া পড়িয়াছি। উক্ত রাজাকারদের নিকট আমি যতই ক্রন্দন করিয়াছি, রাজাকার গুলি আমার সহিত ততবেশি অমানুষিক ব্যবহা করিয়াছে।


পাঁচদিন পাক নরপিশাচরা আমাকে তাহাদের শিবিরে ও বাঙ্কারে আটকাইয়া রাখে ও আমার দুর্বল দেহের উপর অমানুষিক অত্যাচার করে ও মুক্তিবাহিনীর সংবাদ জানি কিনা জিজ্ঞাসা করে। আমি মুক্তিবাহিনীর সম্বন্ধে জানিনা বলিলে আমার উপর ক্রুদ্ধ হইয়া প্রহার করে। এই পাঁচদিন তাহারা আমাকে গোসল করিতে পর্যন্ত দেয় নাই।


আমাকে ধরিয়া দিবার পরিবর্তে রাজাকারগণ পাক-নরপিশাচদের হইতে প্রচুর মদ ও গ্রামে গ্রামে লুণ্ঠন করিবার অনুমতি পাইয়াছিল। সৈন্যদের অত্যাচারে আমি জ্ঞান হারাইয়া ফেলিয়াছি। জ্ঞান ফিরিয়া পাইলেও দেখি ও অনুভব করি আমার দুর্বল শরীরে অত্যাচার করিতেছে। এই কথা ভাবিতে আজও ভয় হয়।


আমাকে ১৭ জুলাই গভীর রাত্রে রাজাকাররা ধরিয়া নিবার পর ১৮ জুলাই আমার মা কেশবপুর গ্রামের মুক্তিবাহিনীর কমাণ্ডার নজীর আহমদ সাহেবের নিকট আমাকে পাক শিবিরে ধরিয়া নিবার করুণ সংবাদ বলিলে উক্ত মুক্তিবাহিনীর কমাণ্ডার ২১ শে জুলাই গভীর রাত্রে বহু মুক্তিযোদ্ধা নিয়া ফুলবাড়িয়া পাক সৈন্যদের শিবির ও বাঙ্কার আক্রমণ করেন। হঠাৎ আক্রমনে পাক বাহিনী ও রাজাকাররা আত্মসমর্পন করে। আক্রমনের সময় তাহারা সকলেই আমার উপর অত্যাচার করিতেছিল। মুক্তিযোদ্ধা ভাইয়েরা আমাকে সহ ১৪ জন পাক সৈন্য ও তিন জন রাজাকারকে গ্রেফতার করিয়া ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে নিয়া যান। তাহারা আমার সম্মুখে রাজাকার ও পাক নরপিশাচদের জীবন্ত মাটি চাপা দেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আমি ত্রিপুরা রাজ্য হইতে নিজ জন্মভুমি ফুলবাড়িয়া ফিরিয়া আসি।


স্বাক্ষর/-

মোছাঃ চানুভান।


।। ২৬২ ।।

মোঃ বাদশাহ মিয়া

ম্যানেজার

শ্রীমঙ্গল সোনালী ব্যাংক

শ্রীমঙ্গল, সিলেট।


আমি আমার ছেলে-মেয়েদেরকে ঢাকায় পাঠানোর জন্য ঢাকা যাওয়ার রাস্তা ঠিক আছে কিনা দেখার জন্য ১৩ ই এপ্রিল হোণ্ডা নিয়া ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়া চলে যাই। ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়া ট্রেজারী অফিসে পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গে পাক বাহিনী বিমান থেকে শেলিং আরম্ভ করে। পাকবাহিনী ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়া ট্রেজারী অফিস ও রেলওয়ে স্টেশনের উপরেই বেশীরভাগ শেলিং করে। এই সময় ২ জন লোক মারা যায় এবং ৫-৬ জন লোক আহত হয়। ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়া থেকে রওনা হয়ে বিকালে তালশহর রেল ষ্টেশনে যখন পৌঁছাই তখন দেখতে পাই দক্ষিণে লালপুর বাজারে মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্প পাক বাহিনী বিমান আক্রমন চালাচ্ছে। প্রায় ১ ঘণ্টা এই আক্রমণ চলে, বিমান থেকে ব্যাপকভাবে শেলিং ও বোমা ফেলা হয়। খবর পাই এতে বহু মুক্তিযোদ্ধা হতাহত হয়।


রাত্রিতে আমি আশুগঞ্জ সোনালী ব্যাংকে অবস্থান করি। ১৪ এপ্রিল ৬ টার সময় থেকে আশুগঞ্জের উপর আক্রমন চলে। পাক বাহিনী হেলিকপ্টার করে আশুগঞ্জ ওয়াপদার পার্শ্বে অবতরন করে। পাক বাহিনীর এই অবস্থান সোনালী ব্যাংকের উপর থেকে নোয়াখালির একজন টেলিফোন অপারেটর দেখতে পায় এবং সঙ্গে সঙ্গে ভৈরব ব্রীজের পূর্ব তীরে অবস্থানরত মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে টেলিফোন যোগে খবর দেয়। সে নিজে দোতলার উপর থেকে লাফিয়ে পড়ে এবং আমাদেরকে বলে যে, যদি বাঁচতে চান তবে পালান।


মুক্তিবাহিনী তাদের অবস্থান গুটিয়ে সঙ্গে সঙ্গে ব্রাক্ষ্মনবাড়ীয়ার দিকে পিছু হটে যায়। পাক বাহিনী আশুগঞ্জ অবতরণ করার পর পরেই তারা সারা শহর চারিদিক থেকে ঘিরে ফেলে এবং বৃষ্টির মত গোলাবর্ষণ করতে থাকে। এই সময় সেখানে যে লোককে তারা পায় তাকেই গুলি করে হত্যা করে। আমার মনে হয় যদি পাক বাহিনীর অবস্থানের খবর টেলিফোন অপারেটর মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে না জানাত, তবে একজন মুক্তিযোদ্ধাও সেদিন পাক বাহিনীর হাত থেকে রেহাই পেত না। পাক বাহিনী পার্শ্ববর্তী গ্রাম গুলোতে অগ্নীসংযোগ করে। আমরা আগুনের লেলিহান শিখা দেখতে পাই এবং কয়েকজন আমাদের ব্যাংকের দরজা ভাঙ্গার চেষ্টা করছে, তখন আমি পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে একটা চিপা গলি দিয়ে নদীর পাড়ে চলে আসি। নদীর পাড়ে এসে আরু কয়েকজন নরনারীকে অসহায় অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখতে পাই। নদীর মাঝখানে একটা নৌকা বাঁধা ছিল। আমি সাঁতার কেটে নৌকাটাকে নদীর পাড়ে নিয়ে আসি এবং অসহায় লোকগুলিকে নৌকায় তুলে নিয়ে উত্তর দিকে পালিয়া যাই।


আমি যখন নদীর পাড়ের দিকে যাচ্ছিলাম, তখন আমি রাস্তার উপর ১৫-১৬ জন লোককে মৃত অবস্থায় দেখতে পাই এবং অনেককে গুলি লেগে আহত অবস্থায় কাতরাতে দেখি। চারদিকে শুধু গুলি আর নারী-পুরুষদের করুণ চিৎকার ভেসে আসে।


অতঃপর আমি ব্রাক্ষ্মণবাড়ীয়া চলে আসি। আমি ব্রাক্ষ্মণবাড়ীয়া পৌঁছেই দেখতে পাই যে ব্রাক্ষ্মণবাড়ীয়া থেকে মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্প তুলে নিয়ে ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়ার উত্তর দিকে তেলিয়াপাড়ার দিকে অগ্রসর হচ্ছে।


স্বাক্ষর/-

মোঃ বাদশা মিয়া

১৭.১০.৭৩ ইং


==========================


গণহত্যা ও নির্যাতনের বিবরণঃ


বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় গৃহীত সাক্ষাৎকার


Comments

Popular posts from this blog

Ahmedabad Satyagraha in Gujarat (1918)

Ahmedabad Satyagraha in Gujarat (1918) Introduction The Ahmedabad Satyagraha of 1918 marks a significant chapter in India's struggle for independence. It was a labor strike initiated by the mill workers in Ahmedabad, Gujarat, demanding an increase in wages. The strike was not just a protest against economic injustice, but it also symbolized the fight against oppressive colonial rule. The term 'Satyagraha' was coined by Mahatma Gandhi, which translates to 'insistence on truth' or 'soul force'. It was a method of non-violent resistance, and the Ahmedabad Satyagraha was one of the early instances where this method was employed in the Indian independence movement. The Satyagraha in Ahmedabad was a turning point as it marked the beginning of Gandhi's active involvement in Indian politics. It was here that Gandhi first introduced his methodology of peaceful resistance and negotiation as a means to achieve political and social change. The event holds histori...

অধ্যায় 2: বাংলায় ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন

বাংলায় ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন বাংলায় ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন সুচিপত্র ভূমিকা পলাশীর যুদ্ধ (১৭৫৭) ব্রিটিশ শাসনের প্রাথমিক বছরগুলি (1757-1857) 1857 সালের বিদ্রোহ এবং এর প্রভাব প্রয়াত ঔপনিবেশিক সময়কাল (1858-1947) বঙ্গভঙ্গ (1905) ব্রিটিশ শাসনের অবসান এবং ভারত বিভাজন (1947) উপসংহার বাংলায় ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন (1757-1947) পরিচয় বাংলায় ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন 1757 থেকে 1947 সাল পর্যন্ত প্রায় দুই শতাব্দী বিস্তৃত ছিল। এই সময়কালে উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক পরিবর্তন দেখা যায় যা এই অঞ্চলে স্থায়ী প্রভাব ফেলে। বাংলার ইতিহাসের জটিলতা এবং ঔপনিবেশিকতার বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে এর স্থানকে উপলব্ধি করার জন্য এই ঐতিহাসিক যুগকে বোঝা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ৷ ...

Comprehensive Guide on Media and Entertainment Law in Bangladesh

Comprehensive Guide on Media and Entertainment Law in Bangladesh Comprehensive Guide on Media and Entertainment Law in Bangladesh Introduction Overview of Media and Entertainment Law Definition and Scope Media and entertainment law encompasses a broad spectrum of legal issues related to the creation, production, distribution, and consumption of media and entertainment content. This includes various sectors such as film, television, music, publishing, digital media, and advertising. The scope of this law covers intellectual property rights, contracts, censorship, licensing, and regulatory compliance. It is essential for protecting the rights of creators, producers, and consumers, ensuring fair use, preventing unauthorized exploitation, and maintaining ethical standards in content creation and distribution. ...