মিয়ানওয়ালি কারাগারে শেখ মুজিবের সংগ্রাম



মিয়ানওয়ালি কারাগারে শেখ মুজিবের সংগ্রাম


১৯৭১ সালের ২৬ শে মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে পাক সামরিক জান্তা।এরপর বঙ্গবন্ধুকে আদমজী ক্যান্টনমেন্ট স্কুলে টানা চারদিন অবরুদ্ধ করে রাখা হয়। ৩১ মার্চ বঙ্গবন্ধু কে গোপনে সামরিক বিমানে করে পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়।বঙ্গবন্ধুকে বিমানবন্দর থেকে লাহোরের ৮০ মাইল দূরের লায়ালপুর শহরের মিনওয়ালি কারাগারে নিয়ে বন্দী করে রাখা হয়। বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময় দুর্বিষহ জীবন কাটিয়েছেন মিয়ানওয়ালি কারাগারে…

২৬ শে মার্চে গ্রেপ্তারের পর বঙ্গবন্ধু



বঙ্গবন্ধুকে একা কনডেম সেলে বন্দী করে রাখা হয়েছিল,যেখানে সূর্যের আলো প্রবেশ করতো পারতোনা।জেলে থাকা অবস্থায় দীর্ঘ দশ মাস বঙ্গবন্ধুকে কারো সাথে কথা বলতে দেওয়া হয়নি,শুধু মাত্র কারারক্ষী সর্বক্ষণ পাহারায় থাকতেন। বঙ্গবন্ধুকে ভয়ংকর অপরাধীর মতো মধ্যযুগের বর্বর কায়দায় নির্মম অত্যাচারের ব্যবস্থা করে রেখেছিল পাকিস্তানী সামরিক জান্তা। বঙ্গবন্ধুকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলিয়ে হত্যা করা ছিল পাকিস্তানী সামরিক জান্তার মূল লক্ষ্য।

গ্রীষ্মে লায়ালপুর পাকিস্তানের উষ্ণতম স্থান, গ্রীষ্মে এখানে তাপমাত্রা অনেক বেশি থাকে,শীতকালে তাপমাত্রা অনেক কমে যায় । ফলে মিনওয়ালিতে কারাগারে বন্দীদের জীবন হয়ে ওঠে দুর্বিষহ।মিনওয়ালি তীব্র শীত পড়ার জন্য বিখ্যাত ।লায়ালপুরে অবস্থিত মিয়ানওয়ালি কারাগার ছিল পাহাড়ি অঞ্চলে,হিমালয় থেকে খুব বেশি দূরে ছিল না কারাগারের অবস্থান।

অন্তরীণ থাকা অবস্থায় প্রায় দশ মাসে বঙ্গবন্ধুর সম্বল ছিল পাতলা একটি কম্বল,পুরনো তোষক, প্রায় ভঙ্গুর খাট।অনেক রাতে তীব্র শীতে বঙ্গবন্ধুর ঘুম ভেঙ্গে যেত,কিন্তু তিনি কখনো কারারক্ষীদের কাছে যেচে কিছু চাইতেন না, কারারক্ষীদের কাছে শীত নিবারণের জন্য অনুনয় বিনয় করার বাঙালি হিসেবে আত্মমর্যাদার গুরুত্ব ছিল বেশি বঙ্গবন্ধুর কাছে শীত নিবারণের চাইতে….অন্তরীত থাকাকালীন কোন পত্রিকা দেয়া হত না বঙ্গবন্ধুকে,ক পরিবারের সদস্যদের টেলিফোনে কথা বলতে দেওয়া হতো না। খাবারের মান ও ছিল একেবারে জঘন্য,এছাড়া তিনি কারো সাথে কথা বলতে পারতেন না,এমনকি প্রহরীদের উপর কড়া নিষেধাজ্ঞা ছিল তারা যাতে শেখ মুজিবের সাথে কোন প্রকার যোগাযোগ না করে।পাকিস্তানী শাসকরা বঙ্গবন্ধুকে তিলে তিলে মানসিক যন্ত্রণা দিয়ে নিঃশেষ করতে চেয়েছিল।কিন্তু বঙ্গবন্ধুর হিমালয়সম দৃঢ়চেতা মনোভাবের কাছে বারবার পরাজিত হতে হয়েছিল ইয়াহিয়া – ভূট্টো দের।

ইয়াহিয়া খান গোপনে এক সেনা ট্রাইব্যুনাল গঠন করে দেশদ্রোহিতার ৬ থেকে ১৬ ডিসেম্বরের মধ্যে চলা মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিল।পাক সামরিক জান্তার পরিকল্পনা ছিল তড়িঘড়ি করে ফাঁসি কার্যকর করে মুজিবকে খতম করা।তাই সামরিক জান্তা কারা কর্তৃপক্ষকে আদেশ দেয় জেলের সামনে কবর খুড়তে।বঙ্গবন্ধুর সেলের সামনে কবর খোঁড়া হয়েছিল।কিন্তু বঙ্গবন্ধু তা সত্ত্বেও মনোবল হারাননি, দমে যাননি।

সেলের সামনে কবর খোঁড়া হলে বঙ্গবন্ধু কারাগারের প্রিজনকে অনুরোধ করেন-

“আমাকে হত্যা করে এই কবরে না, আমার লাশটি আমার বাংলার মানুষের কাছে পৌঁছে দিও। যে বাংলার আলো-বাতাসে আমি বড় হয়েছি সেই বাংলার মাটিতে আমি চিরনিদ্রায় শায়িত থাকতে চাই”

দাঁত কামড়ে ,মাথা উচুঁ করে বুক ফুলিয়ে ইয়াহিয়া ভুট্টোর সব নির্যাতন সহ্য করেছেন,কিন্তু এদের কোন দাবির সাথে আপোষ করেননি।

১৯৭১ সালের ২০ শে ডিসেম্বর ইয়াহিয়া খান ভুট্টোকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি এবং প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্বভার অর্পণ করে ক্ষমতার মসনদ ছেড়ে দেন।

ক্ষমতা হস্তান্তরকালে ইয়াহিয়া খান ভুট্টোর কাছে প্রার্থনা করেছিল যে,

“আমার ক্ষমতা হস্তান্তরের আগে শেখ মুজিবকে হত্যা করার অনুমতি দাও। আমার জীবনে যদি কোন ভুল করে থাকি তাহলো শেখ মুজিবকে ফাঁসি কাষ্ঠে না ঝোলানো।”

কিন্তু ভুট্টো ইয়াহিয়ার ফাঁদে পা দেননি , কারণ লক্ষাধিক পাকিস্তানী সেনা ও বেসামরিক লোক বাংলাদেশে যুদ্ধবন্দী হিসেবে অবরুদ্ধ ছিল। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হলে এদের করুণ পরিণতি ভোগ করতে হতো এবং পাকিস্তানে ফিরে আসা সম্ভব হতোনা।তাই ভুট্টো বিচক্ষণতার সাথে মুজিবকে কারাগার থেকে নিরপদ স্থানে সরিয়ে নেন গোপনে।

বাংলাদেশে স্বাধীন হওয়ার পর ভুট্টো বঙ্গবন্ধুকে অন্ধকারে রেখে বারবার টোপ দিয়েছিল মুক্তির জন্য এই বলে যেকোন কিছুর মূল্যে পাকিস্তানের অখন্ডতা রক্ষার প্রচেষ্টা চালাতে ,বঙ্গবন্ধু সাথে সাথে ভুট্টোকে সাফ জানিয়ে দেন দেশের মানুষের সাথে কোন কথা বলা ছাড়া,দেশের মানুষের অবস্থা জানা ছাড়া তিনি কোন চুক্তিতে স্বাক্ষর করবেন না।পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তিদানের পূর্বে প্রেসিডেন্ট ভুট্টো ১৯৭১ সালের ২৩, ২৭ ও ২৯ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধুর সাথে আলোচনায় বসেন।পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তিদানের পূর্বে প্রেসিডেন্ট ভুট্টো বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতির পদ গ্রহণ কিংবা কনফেডারেশনের প্রস্তাব দেন। বঙ্গবন্ধু বারবার ভুট্টোর প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন।

কিন্তু বঙ্গবন্ধুর হার না মানা মনোভাবের কাছে ভুট্টো শেষ পর্যন্ত হার মানতে বাধ্য হন।

অবশেষে ৮ জানুয়ারি ১৯৭২ বঙ্গবন্ধু অফিসিয়ালি মুক্তি পান।২৭২ দিনের কারাবাসের অবসান ঘটে অবশেষে। ৮ জানুয়ারি রাতে ব্রিটেনের হিথ্রো বিমানবন্দরের উদ্দেশ্যে রওনা দেন বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান থেকে বিমানের একমাত্র যাত্রী হিসেবে…


ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস ১৯৭১ এর ৩১ শে মার্চ বঙ্গবন্ধুকে ইয়াহিয়া বন্দী করে নিয়ে যায় যে বিমানে সে বিমানে বঙ্গবন্ধু একমাত্র যাত্রী ছিলেন, ১৯৭২ এর ৮ জানুয়ারি যে বিমানে ভুট্টো তাকে উঠিয়ে দেন সে বিমানেও একমাত্র যাত্রী ছিলেন বঙ্গবন্ধু।এভাবেই বঙ্গবন্ধুর কাছে বার নত হতে হয় পাকিস্তানীদের…



লন্ডনে সংবাদ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু



বঙ্গবন্ধুর ভারতীয় বিমানে করে ভারতে আসার কথা ছিল। কিন্তু ইন্দিরা গান্ধী শত্রুর আক্রমণের আশাঙ্কায় নিরাপত্তার জন্য শেখ মুজিবকে ব্রিটিশ বিমানে ভারতে আসতে বলেন।এরপর বঙ্গবন্ধু ব্রিটেনের রাজকীয় বিমানে করে নয়াদিল্লি পৌঁছান ১৯৭২ সালের ৯ জানুয়ারি সন্ধ্যায়।১০ তারিখে ভারতীয় সরকার বঙ্গবন্ধুকে সংবর্ধনা দেয় ।এরপর এলো বাঙালি জাতির জীবনে সেই মহেন্দ্রক্ষণ।১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি ১.৪৫ মিনিটে নয়াদিল্লি থেকে বাংলাদেশে এসে পৌঁছান মহান জাতির মহান নেতা শেখ মুজিব শেখ মুজিব।

স্বদেশ প্রত্যাবর্তনে অশ্রু সিক্ত বঙ্গবন্ধু



বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনে সারা দেশে খুশির জোয়ার আসে । এজন্য দৈনিক ইত্তেফাকের সেদিনের প্রধান শিরোনাম ছিল-

“এসো বাংলার স্বাপ্নিক স্বাগতম”

দীর্ঘ দশমাস পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী অবস্থা ছিল বঙ্গবন্ধুর জীবনের শেষ কারাবাস….



পাকিস্তানে কারাবাস থেকে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করে বঙ্গবন্ধু বাঙালির স্বাধীনতাকে পূর্ণতা দিয়েছিলেন।

তথ্যসূত্র: পাকিস্তানের কারাগারে বঙ্গবন্ধু – রবার্ট পেইন

Comments

Popular posts from this blog

ভাড়াটিয়া-ভাড়াদার আইনের জটিলতা পার হওয়া: ভাড়াটিয়াদের জন্য একটি গাইড

একটি ভিত্তিহীন গুজব উড়িয়ে দেওয়া: বাংলাদেশী সাংবাদিকদের ফ্রেঞ্চ ভিসা প্রত্যাখ্যান করা হয়নি৷

অধ্যায় 2: বাংলায় ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন