গল্পের ভাষা কেমন হওয়া উচিত—সরল, জটিল না কৌতুকপূর্ণ? এ বিষয়ে কী বলেন রবীন্দ্রনাথ?
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (২৫ বৈশাখ ১২৬৮—২২ শ্রাবণ ১৩৪৮ বঙ্গাব্দ)
রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘মোপাসাঁর যেসব বিদেশি লেখকের কথা তোমরা প্রায়ই বলো, তাঁরা তৈরি ভাষা পেয়েছিলেন। লিখতে লিখতে ভাষা তৈরি করতে হলে তাদের কী দশা হতো জানি নে।’
গদ্য তৈরির সেই পথরেখা রবীন্দ্রনাথের একাধিক গল্পের চরিত্রদের নিজেদের লেখার মধ্যে আছে।
‘নষ্টনীড়’ গল্পে অমল যা লিখত, ‘আমার খাতা’—‘হে আমার শুভ্র খাতা, আমার কল্পনা এখনো তোমাকে স্পর্শ করে নাই। সূতিকাগৃহে ভাগ্যপুরুষ প্রবেশ করিবার পূর্বে শিশুর ললাটপত্রের ন্যায় তুমি নির্মল, তুমি রহস্যময়।’...আর ‘আষাঢ়ের চাঁদ’ রচনায় অমল লিখেছিল, ‘আজ কেন আষাঢ়ের চাঁদ সারা রাত মেঘের মধ্যে এমন করিয়া লুকাইয়া বেড়াইতেছে। যেন স্বর্গলোক হইতে সে কী চুরি করিয়া আনিয়াছে, যেন তাহার কলঙ্ক ঢাকিবার স্থান নাই।’ ইত্যাদি।
আর চারু কী লিখেছিল?
‘কোনোমতেই অমলের গণ্ডি এড়াইতে না পারিয়া অবশেষে চারু রচনার বিষয় পরির্বতন করিল। চাঁদ, মেঘ, শেফালি, বউ-কথা-কও এ সমস্ত ছাড়িয়া সে “কালীতলা” বলিয়া একটা লেখা লিখিল। তাহাদের গ্রামে ছায়ায়-অন্ধকার পুকুরটির ধারে কালীরমন্দির ছিল, সেই মন্দিরটি লইয়া তাহার বাল্যকালের কল্পনা ভয় ঔৎসুক্য, সেই সম্বন্ধে তাহার বিচিত্র স্মৃতি...এই সমস্ত লইয়া সে একটি লেখা লিখিল। তাহার আরম্ভভাগ প্রথমে অমলের লেখার ছাঁদে কাব্যাড়ম্বরপূর্ণ হইয়াছিল, কিন্তু খানিকটা অগ্রসর হইতেই তাহার লেখা সহজেই সরল এবং পল্লীগ্রামের ভাষা-ভঙ্গি-আভাসে পরিপূর্ণ হইয়া উঠিয়াছিল।’
চারুবালার সেই লেখা প্রকাশিত হলে অমলদের ধারার তীব্র সমালোচনা করে চারুবালার ভাষার অকৃত্রিম সরলতা, অনায়াস সরসতা ও চিত্ররচনানৈপুণ্যের প্রশংসা করে প্রবন্ধ প্রকাশিত হলো।
‘ছোট প্রাণ ছোট কথা’ বলতে রবীন্দ্রনাথ সেটাকেই বোঝাতে চেয়েছেন, তিনি বলেছেন, আগে তো গল্প লেখা হতো প্রতাপাদিত্যদের নিয়ে, তিনিই প্রথম সাধারণ মানুষের জীবনের কথা গল্পে এনেছেন। সেটাই ছোট ছোট দুঃখকথা। ছোট প্রাণ ছোট কথা বলেছেন বলেই রবীন্দ্রনাথ আদরনীয়। এখানেই তো রবীন্দ্রনাথ আমার কাছের।
এটা কেবল অমলের আর চারুর ব্যাপার না, এটা তখনকার প্রচলের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের নতুন পথপ্রবর্তনের চিহ্নটাই ধারণ করে আছে। চারুবালা এইখানে রবীন্দ্রনাথের মতো দুটো আবিষ্কার ও প্রবর্তন করল—এক. কাহিনি নিতে হবে নিজের জীবন নিজের গ্রাম নিজের অভিজ্ঞতার ভেতর থেকে, দুই. ভাষাটাও নিতে হবে সেই জীবন থেকেই।
রবীন্দ্রনাথ তা-ই করেছেন। ‘ছোট প্রাণ ছোট কথা’ বলতে রবীন্দ্রনাথ সেটাকেই বোঝাতে চেয়েছেন, তিনি বলেছেন, আগে তো গল্প লেখা হতো প্রতাপাদিত্যদের নিয়ে, তিনিই প্রথম সাধারণ মানুষের জীবনের কথা গল্পে এনেছেন। সেটাই ছোট ছোট দুঃখকথা।
ছোট প্রাণ ছোট কথা বলেছেন বলেই রবীন্দ্রনাথ আদরনীয়। এখানেই তো রবীন্দ্রনাথ আমার কাছের। তারপর ধরুন, ভাষাটা। রবীন্দ্রনাথের গল্পের ভাষার মধ্যে পরতে পরতে কৌতুকময়তা, একটু খেয়াল করে দেখলে বোঝা যাবে, এই যে তাঁর গল্প আমরা এতকাল পরেও পড়ি আর আমাদের ভালো লাগতে থাকে, তার কারণ এই পরিহাসবোধ। হাস্যকৌতুক–ব্যঙ্গকৌতুক তো তিনি লিখেছেনই, কিন্তু গল্পের ভাষা খেয়াল করে দেখুন না।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (২৫ বৈশাখ ১২৬৮—২২ শ্রাবণ ১৩৪৮)
‘অধ্যাপক’ গল্পের প্রথম লাইন, ‘সুবলচন্দ্রের ছেলেটির নাম সুশীলচন্দ্র। কিন্তু সকল সময়ে নামের মতো মানুষটি হয় না। সেই জন্যই সুবলচন্দ্র কিছু দুর্বল ছিলেন এবং সুশীলচন্দ্র বড়ো শান্ত ছিলেন না।’ বা ধরুন, ‘ছুটি’ গল্প কীভাবে শুরু হচ্ছে, ‘বালকদিগের সর্দার ফটিক চক্রবর্তীর মাথায় চট করিয়া একটা নূতন ভাবের উদয় হইল; নদীর ধারে একটা প্রকাণ্ড শালকাষ্ঠ মাস্তুলে রূপান্তরিত হইবার প্রতীক্ষায় পড়িয়াছিল; স্থির হইল, সেটা সকলে মিলিয়া গড়াইয়া লইয়া যাইবে।
‘যে ব্যক্তির কাঠ, আবশ্যক-কালে তাহার যে কতখানি বিস্ময় বিরক্তি এবং অসুবিধা বোধ হইবে, তাহাই উপলব্ধি করিয়া বালকেরা এ প্রস্তাবে সম্পূর্ণ অনুমোদন করিল।’
‘শেষের কবিতা’র প্রথম লাইনগুলো খেয়াল করুন, ‘অমিতর বাপ দিগ্বিজয়ী ব্যারিস্টার। যে পরিমাণ টাকা তিনি জমিয়ে গেছেন, সেটা অধস্তন তিন পুরুষকে অধঃপাতে দেবার পক্ষে যথেষ্ট। কিন্তু পৈতৃক সম্পত্তির সাংঘাতিক সংঘাতেও অমিত বিনা আপত্তিতে এ যাত্রা টিকে গেল।’
এইভাবে রসিকতার সঙ্গে যে গল্প বলে, তাকে আপনি ভালো না বেসে পারবেন?
তবে রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসগুলো খুব গুরুত্বপূর্ণ, কারণ তাতে রবীন্দ্রনাথ জাতীয়তাবাদ বা সন্ত্রাসবাদ নিয়ে তাঁর মূল্য চিন্তা প্রকাশ করেছেন বলে নয়, বরং সেটাই উপন্যাসগুলোর উচ্চকিত দুর্বলতা, ওগুলো গুরুত্বপূর্ণ কারণ রবীন্দ্রনাথ নামের একজন মহাপুরুষের অমূল্য চিন্তাভাবনাগুলো উপন্যাসগুলোয় আছে। যদি বলি, উপন্যাসগুলো অমূল্য নয়, চিন্তাটা অমূল্য। সেটা খুব প্রশংসার কথা হবে না। কিন্তু উপন্যাস বলতে আমরা যা বুঝি, ব্যক্তিমানুষের জীবনের সঙ্গে রাষ্ট্রের কিংবা ব্যবস্থার সম্পর্ক ও দ্বন্দ্ব, তা খুবই তাৎপর্যপূর্ণভাবে উঠে এসেছে ‘গোরা’ ও ‘ঘরে-বাইরে’ উপন্যাসে।
রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসগুলোতেও লেখক হিসেবে আমি পাই সমবেদনা, সহানুভূতি, সমানুভূতি। রবীন্দ্রনাথ ‘চোখের বালি’ লিখেছেন ধারাবাহিকভাবে, তার চিহ্ন ওই উপন্যাসে আছে। আমাদের টেলিভিশন ধারাবাহিকের মতোই পর্বের পর পর্ব যেন লেখা হচ্ছে, টেনে নিয়ে যাওয়ার জন্য। ‘নৌকাডুবি’র ভূমিকায় রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন ‘নৌকাডুবি’ রচনার কারণ। ‘প্রকাশকের তাগিদ।’ তিনি বলেছেন, গল্প লেখার তাঁর কোনো তাড়না ছিল না, প্রকাশকের চাপে পড়ে লিখেছেন। সাইকোলজিক্যাল একটা নিষ্ঠুর কিন্তু ঔৎসুক্যজনক ‘প্রকাণ্ড একটা ভুলের দম লাগিয়ে দেওয়া হয়েছিল।’ এই যে একটা দম বা চাবি মেরে দেওয়া হলো, আপনাকে পড়তেই হবে।
অমিতের সঙ্গে লাবণ্যর পরিচয় হয়েছিল শিলংয়ে, গাড়ির দুর্ঘটনার সূত্র ধরে। ‘চোখের বালি’র ভূমিকায়ও তিনি জানিয়েছেন, তাঁর উপন্যাসগুলো ‘মাসিক পত্রের ভোজের জোগান দেবার’ জন্য লেখা।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসের প্রধান অসুবিধা, আমার জন্য, পাত্র–পাত্রীরা বড় বেশি কথা বলে এবং খুব ভারী ভারী লম্বা লম্বা কথা বলে।
রবীন্দ্রনাথের একটা চিন্তা খুব মূল্যবান। যেটাকে সমাজতন্ত্রের পতনের কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। রবীন্দ্রনাথ মানুষকে যন্ত্র হিসেবে দেখতে বারণ করেছিলেন। তাঁর ভাষায়:
‘আজকাল য়ুরোপ মানুষের সব জিনিসকেই বিজ্ঞানের তরফ থেকে যাচাই করছে, এমনিভাবে আলোচনা চলছে যেন মানুষ-পদার্থটা কেবলমাত্র দেহতত্ত্ব কিংবা জীবতত্ত্ব, কিংবা মনস্তত্ত্ব, কিংবা বড়জোর সমাজতত্ত্ব। কিন্তু মানুষ যে তত্ত্ব নয়, মানুষ যে সব তত্ত্বকে নিয়ে তত্ত্বকে ছাড়িয়ে অসীমের দিকে আপনাকে মেলে দিচ্ছে দোহাই তোমাদের, সে কথা ভুলো না।’ এটা রবীন্দ্র উপন্যাসের পাত্রের সংলাপ বটে, কিন্তু এই প্রটাগনিস্ট আসলে রবীন্দ্রনাথেরই বক্তব্য পেশ করছে। যেমন গোরা যখন জানতে পারল, সে ব্রাহ্মণ নয়, কুড়িয়ে পাওয়া এক জাত না জানা শিশু ছিল সে, তখন তার উপলব্ধি: ‘আমার কথা কি আপনি ঠিক বুঝতে পারছেন? আমি যা দিনরাত্রি হতে চাচ্ছিলুম, অথচ হতে পারছিলুম না, আজ আমি তা–ই হয়েছি। আমি আজ ভারতবর্ষীয়।
আমার মধ্যে হিন্দু–মুসলমান–খ্রিস্টান কোনো সমাজের কোনো বিরোধ নেই। আজ এই ভারতবর্ষের সকলের জাতই আমার জাত, সকলের অন্নই আমার অন্ন। দেখুন, আমি বাংলার অনেক জেলায় ভ্রমণ করেছি, খুব নীচ পল্লীতেও আতিথ্য নিয়েছি—আমি কেবল শহরের সভায় বক্তৃতা করেছি, তা মনে করবেন না—কিন্তু কোনোমতেই সকল লোকের পাশে গিয়ে বসতে পারি নি, এত দিন আমি আমার সঙ্গে সঙ্গেই একটা অদৃশ্য ব্যবধান নিয়ে ঘুরেছি, কিছুতেই সেটাকে পেরোতে পারি নি। সেজন্যে আমার মনের ভিতরে খুব একটা শূন্যতা ছিল। এই শূন্যতাকে নানা উপায়ে কেবলই অস্বীকার করতে চেষ্টা করেছি, এই শূন্যতার উপরে নানা প্রকার কারুকার্য দিয়ে তাকেই আরও বিশেষরূপ সুন্দর করে তুলতে চেষ্টা করেছি। কেননা ভারতবর্ষকে আমি যে প্রাণের চেয়ে ভালোবাসি—আমি তাকে যে অংশটিতে দেখতে পেতুম, সে অংশের কোথাও যে আমি কিছুমাত্র অভিযোগের অবকাশ একেবারে সহ্য করতে পারতুম না। আজ সেই-সমস্ত কারুকার্য বানাবার বৃথা চেষ্টা থেকে নিষ্কৃতি পেয়ে আমি বেঁচে গেছি পরেশবাবু।
’ এটা কার উপলব্ধি, তা–ও বুঝি আমরা বুঝতে পারি।
Comments