Skip to main content

দেড় ডিগ্রি বনাম দুই ডিগ্রি সেলসিয়াস




কয়েক মাস আগের কথা। আমেরিকা থেকে ফিরছি দোহা এয়ারপোর্টে যাত্রা বিরতিকালে পরিচয় হলো বাংলাদেশি একজন ব্যবসায়ীর সঙ্গে। তিনি বাংলাদেশের একটি বেসরকারি এয়ারলাইনসের মালিক। এয়ারপোর্ট লাউঞ্জে আমাকে নিয়ে ঢুকে দেশের অবস্থা নিয়ে আলাপ করলেন। আমিআইনের শাসন বিষয়ে সমালোচনা করলাম। তিনি চুপচাপ শুনলেন। শেষে সরকারের উন্নয়নকাজের প্রশংসা করলেন।ঢাকাগামী ফ্লাইটে যখন উঠতে যাব, হন্তদন্ত করে আমার হাতে একটা বই তুলে দিলেন। হোমো ডিউস: আ ব্রিফ হিস্ট্রি অব টুমোরো। মানে, মানুষ দেবতা: আগামীর সংক্ষিপ্ত ইতিহাস। অক্সফোর্ড থেকে পিএইচডি করা অধ্যাপক ইয়োভাল নোয়া হারারির বই। সেই বই পড়ে মুগ্ধ হলাম। তাঁর আরও বিখ্যাত বই সেপিয়েনস: আ ব্রিফ হিস্ট্রি অব হিউম্যানকাইন্ড সংগ্রহ করে পড়ে ফেলি এক নিশ্বাসে।

প্রথমে সেপিয়েনসের কথা বলি। এর শুরুটা যে কাউকে চমকে দেওয়ার মতো। সংক্ষেপে অনুবাদ করলে তা এমন:

সাড়ে তেরো শ কোটি বছর আগে: মহাজগতের সূচনা।

সাড়ে চার শ কোটি বছর আগে: পৃথিবী নামক গ্রহের গঠন শুরু।

দুই লাখ বছর আগে: হোমো সেপিয়েনস, (মানে আমাদের মানবগোষ্ঠীর) সূচনা।

৩০ হাজার থেকে ১৩ হাজার বছর আগে: হোমো সেপিয়েনসদের হাতে এবং অন্যান্য কারণে বাদবাকি মানবগোষ্ঠীর বিলোপ।

১২ হাজার বছর আগে: কৃষিবিপ্লবের সূচনা, উদ্ভিদ ও প্রাণিকুলকে গৃহপালিতকরণ শুরু।

২০০ বছর আগে: শিল্পবিপ্লব, প্রাণী ও উদ্ভিদের ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের শুরু।

ভবিষ্যৎ: হোমো সেপিয়েনসদের বিলুপ্তি এবং সুপার হিউম্যানদের (অতি উন্নত মানব) সূচনা?

অধ্যাপক হারারি তাঁর বই দুটোতে আগামী বিশ্বে সাধারণ মানুষের বিপর্যয়ের কথা বলেছেন। বলেছেন জিন কোড বদলে ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রয়োগ করে এক অতি উন্নত মানবজাতির উন্মেষের কথা। কিন্তু তা কল্পকাহিনির মতো করে নয়। অজস্র যৌক্তিক ব্যাখ্যা ও রেফারেন্স ব্যবহার করে।

অধ্যাপক হারারি মানবজাতির বিপর্যয়ের বিভিন্ন কারণের কথা বলেছেন। অনিবার্যভাবে বলেছেন জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াল প্রতিক্রিয়ার কথাও। হারারি থেকে শুরু করে স্টিফেন হকিং পর্যন্ত ভবিষ্যৎ চিন্তকদের বার্তা হচ্ছে: এই পৃথিবী ধ্বংস বা আমূল বদলে যেতে পারে কয়েকটি কারণে। তার মধ্যে রয়েছে পারমাণবিক যুদ্ধ, মহাজগৎ থেকে আসা বস্তুর আঘাত, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কর্তৃত্ব এবং জলবায়ুর পরিবর্তন।

আমার আজকের লেখা শুধু জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে। পৃথিবী ও মানবজাতির বিপর্যয়ের সবচেয়ে দৃশ্যমান, নিকটবর্তী এবং সর্বজনীন কারণটি হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তন। মহাজাগতিক বস্তুর আঘাত আসতে এক লাখ বছর লাগতে পারে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মানুষের ওপর কর্তৃত্ব করতে পারে এমন সম্ভাবনা এক শ বছরের মধ্যে খুব কম, আক্কেলজ্ঞান থাকলে পারমাণবিক যুদ্ধেও হয়তো জড়াতে চাইবে না সুপার পাওয়াররা।

কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তন ইতিমধ্যেই একটি বাস্তবতা। সারা বিশ্বে এর প্রভাবও পড়তে শুরু করেছে ইতিমধ্যে। জলবায়ু বিশেষজ্ঞদের বিশ্বাস, বড় ধরনের কোনো পদক্ষেপ না নিলে আগামী ৫০ বছরের মধ্যেই মহাবিপর্যয়ে পড়বে মানুষ।

২.

জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে প্রতিদিনই কোনো না কোনো প্রতিবেদন বের হচ্ছে বিশ্বের কোথাও। সেখানে অ্যান্টার্কটিকার বরফ গলা, দ্বীপরাষ্ট্রের সমুদ্রগর্ভে হারিয়ে যাওয়া, কোরাল রিফ ধ্বংস হওয়া, চরম জলবায়ু বিপর্যয় হওয়ার সংবাদ থাকে। সবচেয়ে বেশি থাকে পৃথিবীপৃষ্ঠের তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার সংবাদ। পৃথিবীর এযাবৎকালের সবচেয়ে উষ্ণ পাঁচটি বছরের মধ্যে চারটি ছিল গত পাঁচ বছরে, ২০১৩-এর পরবর্তী দশক হবে পৃথিবীর উষ্ণতম দশক।

৪ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে আছে আমাদের দেশের জন্য উদ্বেগজনক সংবাদও। সেখানে ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ইন্টিগ্রেটেড মাউন্টেন ডেভেলপমেন্ট নামের প্রতিষ্ঠানের গবেষণার ফলাফলের ভিত্তিতে বলা হয়েছে যে বৈশ্বিক উষ্ণতার কারণে ২১০০ সালের মধ্যে হিমালয়ের হিমবাহ গলে এর বিরাট একটি অংশ হয়ে উঠতে পারে নিরেট পাথরের পর্বতমালা।

গবেষণাটিতে সরাসরি বলা হয়েছে দুটো আশঙ্কার কথা। এক, বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি যদি ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে সীমাবদ্ধ রাখা যায়, তাহলেও ২১০০ সালের মধ্যে হিমালয়ের বরফ এক-তৃতীয়াংশ গলে যাবে। কিন্তু তাপমাত্রা বৃদ্ধি ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত হলে বরফ গলবে দুই-তৃতীয়াংশ। এতে এই অঞ্চলে চরম আবহাওয়া, অসময়ে তীব্র বন্যা এবং পরবর্তী সময়ে দীর্ঘস্থায়ী খরা ও অনাবৃষ্টি দেখা দিতে পারে। হিমালয়ের ওপর নির্ভরশীল বড় বড় নদীর (যেমন গঙ্গা) পানির প্রবাহ মারাত্মকভাবে হ্রাস পেতে পারে। বাংলাদেশসহ আটটি দেশের প্রায় ২০০ কোটি মানুষ এর চরম ভুক্তভোগী হতে পারে।

বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির এ ধরনের খেসারত পৃথিবীর আরও বহু অঞ্চলের মানুষকে হয়তো দিতে হবে। তাই বিশ্বমানবের এখনকার চ্যালেঞ্জ হচ্ছে ক্ষতিকর প্রভাব কতটুকু কমানো যায়, তা নিয়ে। এ জন্য সোজা একটি হিসাব বের করা হয়েছে শিল্পবিপ্লবের আগের একটি সময়ের (১৮৫০-১৯০০) গড় উষ্ণতার সঙ্গে তুলনা করে। এই সময়ের গড় তাপমাত্রার চেয়ে প্রথমবারের মতো ১ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায় ২০১৫ সালে। আমরা যদি গ্রিনহাউস (কার্বন বা মিথেন) নিঃসরণ অব্যাহত রাখি (যেমন: পেট্রল, কয়লা, প্রাকৃতিক গ্যাস ব্যবহার করে, বন উজাড় করে, গরু-ছাগল পালন করে) বর্তমান হারে, তাহলে ২১০০ সালের মধ্যে এটি বাড়তে পারে, এমনকি ৪ ডিগ্রির মতো!

৩.

৪ বা ৩ ডিগ্রি বাড়লেও যে মহাবিপর্যয় ঘটবে, তা কোনোভাবেই হতে দিতে রাজি না মানুষ। ২০১৫ সালে প্যারিস চুক্তি হওয়ার আগে থেকেই এই মতৈক্য হয়েছে যে তাপমাত্রা কোনোভাবেই শিল্পবিপ্লব যুগের আগের চেয়ে ২ ডিগ্রির বেশি বাড়তে দেওয়া যাবে না। কিন্তু তা ঠিক কতটুকুতে সীমাবদ্ধ রাখতে হবে, তা নিয়ে একমত হওয়া যায়নি প্যারিস চুক্তিতেও। এই চুক্তিতে বলা হয়েছে, তাপমাত্রা বৃদ্ধি ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশ কমে (ওয়েল বিলো টু ডিগ্রি) সীমাবদ্ধ রাখতে হবে, তবে চেষ্টা করতে হবে এটি দেড় ডিগ্রি পর্যন্ত বৃদ্ধিতে সীমাবদ্ধ রাখার।

দুই আর দেড়ে এমন কী পার্থক্য? শুধু এই প্রশ্ন নিয়েই আইপিসিসি (ইন্টার-গভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ) ২০১৮ সালে একটি বিস্তারিত গবেষণা প্রকাশ করে। যেমন: ২১০০ সালের মধ্যে তাপমাত্রা আধা ডিগ্রি কম বাড়লে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা কম বাড়বে ১০ সেন্টিমিটার, তাপমাত্রা দেড় ডিগ্রি বাড়লে আর্কটিকে সমুদ্র গ্রীষ্মকালে ১০০ বছরে একবার বরফশূন্য হবে, ২ ডিগ্রি বাড়লে হবে ১০ বছরে একবার! তাপমাত্রা দেড় বাড়লে কোরাল রিফ ৭০ শতাংশ বিলুপ্ত হবে, ২ বাড়লে হবে ৯৯ শতাংশ!

দেড় ডিগ্রি বাড়লে হবে বিপর্যয়, দুই ডিগ্রি বাড়লে মহাবিপর্যয়। পৃথিবীর রাষ্ট্রসমূহ তাই নিজেরা কতটুকু গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ কমাবে, তা নিজেরা জানিয়েছে প্যারিস চুক্তির সেক্রেটারিয়েটে। এনডিসি নামের এসব দলিল বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, রাষ্ট্রসমূহ তাদের অঙ্গীকার পুরোপুরি বাস্তবায়ন করলেও তাপমাত্রা ২১০০ সালের মধ্যে বাড়তে পারে ৩ দশমিক ৭ ডিগ্রি।

পোল্যান্ডে অনুষ্ঠিত সর্বশেষ জলবায়ু সম্মেলনে তাই জোর তাগিদ এসেছে সব দেশের অঙ্গীকার ও প্রচেষ্টা বাড়ানোর। সৌরবিদ্যুৎ, বায়ুবিদ্যুতের ওপর নির্ভর করে, বনায়ন বাড়িয়ে, খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন এনে, পরিবেশসম্মত ব্যবস্থাপনা উন্নত করে এটি করা অসম্ভব না।

না হলে কে জানে একসময় হয়তো পৃথিবীর নিম্নাঞ্চল হয়ে উঠবে পুরোপুরি বসবাস অযোগ্য, বহু প্রাণী ও উদ্ভিদ হবে চিরতরে বিলুপ্ত, টিকে থাকবে কেবল ইউরোপের উঁচু অঞ্চলের কিছু মানুষ। হোমো সেপিয়েনসরা একসময় অন্য প্রজাতির মানুষকে শেষ করেছে, তারপর প্রাণী আর উদ্ভিদ। শেষে হয়তো বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়িয়ে ব্যাপকভাবে ধ্বংস করবে নিজেদেরই।

Comments

Popular posts from this blog

Ahmedabad Satyagraha in Gujarat (1918)

Ahmedabad Satyagraha in Gujarat (1918) Introduction The Ahmedabad Satyagraha of 1918 marks a significant chapter in India's struggle for independence. It was a labor strike initiated by the mill workers in Ahmedabad, Gujarat, demanding an increase in wages. The strike was not just a protest against economic injustice, but it also symbolized the fight against oppressive colonial rule. The term 'Satyagraha' was coined by Mahatma Gandhi, which translates to 'insistence on truth' or 'soul force'. It was a method of non-violent resistance, and the Ahmedabad Satyagraha was one of the early instances where this method was employed in the Indian independence movement. The Satyagraha in Ahmedabad was a turning point as it marked the beginning of Gandhi's active involvement in Indian politics. It was here that Gandhi first introduced his methodology of peaceful resistance and negotiation as a means to achieve political and social change. The event holds histori...

অধ্যায় 2: বাংলায় ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন

বাংলায় ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন বাংলায় ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন সুচিপত্র ভূমিকা পলাশীর যুদ্ধ (১৭৫৭) ব্রিটিশ শাসনের প্রাথমিক বছরগুলি (1757-1857) 1857 সালের বিদ্রোহ এবং এর প্রভাব প্রয়াত ঔপনিবেশিক সময়কাল (1858-1947) বঙ্গভঙ্গ (1905) ব্রিটিশ শাসনের অবসান এবং ভারত বিভাজন (1947) উপসংহার বাংলায় ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন (1757-1947) পরিচয় বাংলায় ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন 1757 থেকে 1947 সাল পর্যন্ত প্রায় দুই শতাব্দী বিস্তৃত ছিল। এই সময়কালে উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক পরিবর্তন দেখা যায় যা এই অঞ্চলে স্থায়ী প্রভাব ফেলে। বাংলার ইতিহাসের জটিলতা এবং ঔপনিবেশিকতার বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে এর স্থানকে উপলব্ধি করার জন্য এই ঐতিহাসিক যুগকে বোঝা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ৷ ...

Comprehensive Guide on Media and Entertainment Law in Bangladesh

Comprehensive Guide on Media and Entertainment Law in Bangladesh Comprehensive Guide on Media and Entertainment Law in Bangladesh Introduction Overview of Media and Entertainment Law Definition and Scope Media and entertainment law encompasses a broad spectrum of legal issues related to the creation, production, distribution, and consumption of media and entertainment content. This includes various sectors such as film, television, music, publishing, digital media, and advertising. The scope of this law covers intellectual property rights, contracts, censorship, licensing, and regulatory compliance. It is essential for protecting the rights of creators, producers, and consumers, ensuring fair use, preventing unauthorized exploitation, and maintaining ethical standards in content creation and distribution. ...