Skip to main content

বাংলাদেশ কি ঋণ ফাঁদে পড়তে চলেছে? আসুন জেনে নিন সত্যিটা।


২০১৮-১৯ অর্থবছরে বাংলাদেশ বৈদেশিক ঋন পরিশোধে রেকর্ড করেছে। এই সময়ে বাংলাদেশ মোট ঋন শোধ করেছে $১.৫৭ বিলিয়ন ডলার যা বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ১৩,২০০ কোটি টাকার মত।

এই ঋনের মধ্যে আসল হিসাবে শোধ করা হয়েছে $১.১৮ বিলিয়ন ডলার এবং সুদ $৩৮৭ মিলিয়ন ডলার।

বাংলাদেশের ঋন পরিশোধের হার এখনো জিডিপির ১% এর কম।

স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ বিদেশের থেকে মোট ঋন গ্রহন করেছে $৫৮.৮৩ বিলিয়ন ডলার। এই ঋনের বিপরীতে ঋন শোধ করেছে $২৩.৫৪ বিলিয়ন ডলার। ঋনের স্থিতি জুন-২০১৯ পর্যন্ত রয়েছে $৩৪.৫০ বিলিয়ন ডলার যা জিডিপির মাত্র ১০% এর সামান্য বেশি।
অত্র অঞ্চলের অন্যান্য দেশের মধ্যে ভারতের বৈদেশিক ঋনের পরিমান মার্চ ২০১৯ পর্যন্ত দাড়িয়েছে $৫৪৩ বিলিয়ন ডলার। তাদের জিডিপির হিসাবে বিদেশের কাছ থেকে ঋন গ্রহণের হার ১৯.৭%।
অন্য দেশ পাকিস্তানের মার্চ-২০১৯ পর্যন্ত বৈদেশিক ঋনের পরিমান দাড়িয়েছে $১০৫.৮ বিলিয়ন ডলার। $২৭৫ বিলিয়ন ডলারের অর্থনীতিতে এই ঋনের হার ৩৮.৪৭%।
আরেক প্রতিবেশি শ্রীলঙ্কার ক্ষেত্রে এই ঋনের পরিমান $৫৪.২৩ বিলিয়ন ডলার। শ্রীলঙ্কার জিডিপি মাত্র $৮৮.২২ বিলিয়ন ডলার। তাদের ঋনের পরিমান তাদের জিডিপির ৬১%।
অনেকে ভিয়েতনামের প্রশ্ন তুলবেন তাই তাদের টাও জানা যাক। ২০১৯ সালে ভিয়েতনামের মোট বিদেশি ঋন দাড়িয়েছে $১০৯.১৮ বিলিয়ন ডলার যা তাদের জিডিপির ৫১.৮%।
এত এত তথ্য দিলাম। এখন আসুন একটু বিশ্লেষণ করি।
যতগুলি দেশের কথা বলা হয়েছে সেসব দেশের মধ্যে দেশের অর্থনীতির আকারের তুলনায় সব থেকে বেশি ঋনগ্রস্থ দেশ হল শ্রীলঙ্কা কারন তাদের অর্থনীতির আকারের ও ৬১% হল ঋন। এর পরের অবস্থানে রয়েছে ভিয়েতনাম ৫১.৮%। এরপর পাকিস্তান ৩৮.৪৭% এরপর ভারত ১৯.৭% এবং এদের সবার থেকে কম ঋনের হার বাংলাদেশের ১০.৮৫%।
কিন্তু যখন আমরা উদ্বেগের কথা জানাই তখন পাকিস্তানের কথা এই সব দেশের আগে কেন বলা হয়? হিসাব অনুযায়ী শ্রীলঙ্কার অবস্থা পাকিস্তানের থেকেও বেশি খারাপ হওয়া সত্ত্বেও দেওলিয়া, বেইল আউট এসব শব্দ কেন পাকিস্তানের ক্ষেত্রেই ব্যাবহার করা হয়?
পাকিস্তানের থেকেও কিন্তু ভিয়েতনামের ঋনের হার অর্থনীতির আকার হিসাবে প্রায় ১৪% বেশি হওয়া সত্ত্বেও ভিয়েতনামকে নিয়ে কেন আশঙ্কা করা হয়না?
এই প্রশ্নগুলির উত্তর খোজা যাক।
প্রথমত ঋন নেয়া খারাপ নয়। এর উদাহরণ হল ভিয়েতনাম। দেশটি তাদের দেশের গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো ঢেলে সাজাতে $১০৯.১৮ বিলিয়ন ঋন নিলেও তারা যেসব অবকাঠামো এবং অন্যান্য ডেভেলপমেন্ট এই ঋনের টাকায় করে ফেলছে সেগুলা থেকে রিটার্ন আসছে খুব বেশি। ভিয়েতনামের রপ্তানি $২৭০ বিলিয়ন ডলার তার একটা উদাহরণ।
এখানে একটা উদাহরণ দেয়া যাক। মনে করুন আপনি ব্যাংক থেকে ১০ লক্ষ টাকা ঋন করে এমন একটা বিজনেসে লগ্নি করেছেন যে সেখান থেকে প্রতি মাসে বেশ ভাল একটা মুনাফা আপনি পাচ্ছেন। মুনাফার হার এতই বেশি যে ব্যাংকের ঋনের কিস্তি সুদ সমেত পরিশোধ করবার পরো আপনার হাতে ভাল অঙ্কের অর্থ থেকে যাচ্ছে।
অন্য কোন ব্যাক্তি একি ব্যাংক থেকে মাত্র ৭ লক্ষ টাকা ঋন নিয়ে কিছু সে ব্যাবসায় খাটিয়েছে কিছু অর্থ সে অপচয় করে ফেলেছে। ব্যাবসায় যে টাকা খাটিয়েছে সেটা থেকে মুনাফার পরিমাণ এতটাই কম যে সে নিজের সংসার চালিয়ে ঋনের কিস্তি দিতে সক্ষম নয়। অবস্থা এমন যে সে যদি কিস্তির সমপরিমাণ টাকা ব্যাংকে দিতে চায় তবে তার বাসায় ভাত রান্না হলেও সাথে কোন তরকারি রান্নার মত অবস্থা থাকে না।
পাকিস্তান এবং ভিয়েতনামের ভেতর ঠিক এমন ঘটনাই ঘটেছে। ভিয়েতনামের জিডিপি অনুপাতে ঋনের হার পাকিস্তানের থেকে বেশি হলেও এটা তারা এমন খাতে বিনিয়োগ করেছে যে তাদের অবকাঠামো ঘাটতি নেই। বিদ্যুৎ এর অভাব নেই। ফলে বিনিয়োগ এর ও অভাব নেই। অতিরিক্ত বিনিয়োগে অতিরিক্ত শিল্প প্রতিষ্ঠান হয়েছে। অতিরিক্ত শিল্প প্রতিষ্ঠান হবার হলে ট্যাক্স বাবদ আয় ও বৃদ্ধি পেয়েছে। তাদের ব্যালেন্স অব পেমেন্ট ও বেশ ভাল অবস্থায় আছে। ফলে ঋন বেশি হলেও কিস্তি দিতে তাদের কোন সমস্যা হচ্ছে না। বরং আমরা যেমন ব্যাবসা বাড়ানোর জন্য ব্যাংকের থেকে আরো বেশি ঋন নেবার চেষ্টা করি, তারাও সেভাবে ঋন নিতে সক্ষম। আরো দ্রুত উন্নতি করতে সক্ষম।
পাকিস্তানের ক্ষেত্রে বেশ কিছু ঝামেলা রয়েছে। সামরিক সরকার, জঙ্গীবাদ, পররাষ্ট্রনীতিতে ভুলের কারনে আমেরিকার পৃষ্টপোষকতা করে নিজ দেশে বোমা বর্ষন, টম এন্ড জেরি খেলে শত্রু ধ্বংসে গুরুত্বপূর্ণ অর্থের বেশিরভাগ সামরিক খাতে ব্যয় করা, বিদ্যুৎ এবং অন্যান্য অবকাঠামো খাতে গুরুত্ব না দেয়া, ইত্যাদি নানা কারনে তাদের ঋনের সঠিক ব্যাবহার তারা করতে পারেনি। করাচীতে দৈনিক ১২ ঘন্টা লোড শেডিং হচ্ছে। ফলে বিনিয়োগ কমছে। আয়ের উৎস সঙ্কুচিত হচ্ছে। ঋনের কিস্তি পরিশোধের ক্ষমতা হারায় ফেলছে। রপ্তানি কমে যাবার ফলে বৈদেশিক মুদ্রার প্রচন্ড সঙ্কট সৃষ্টি হচ্ছে। দারিদ্রের দুষ্টচক্রের মত সমস্যা একটার পর একটা সৃষ্টি হচ্ছে। অর্থনীতির সুস্বাস্থ নষ্ট হবার ফলে যে গুরুত্বপূর্ণ ক্ষতি হয়েছে সেটি হল সামরিক খাতে ব্যয় করার ক্ষমতাও কমে গেছে। এজন্যই আমি বলি সামরিক এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক এতটাই গভীর যে অর্থনীতিকে বঞ্চিত করলে, সে তার প্রভার সামরিক বিষয়েও ফেলবে।
এবার আসি শ্রীলঙ্কার ক্ষেত্রে। শ্রীলঙ্কার অবস্থা সব থেকে করুন হলেও তাদের আয়ের উৎস এখনো ততটা খারাপ অবস্থায় নেই। অবকাঠামো, পর্যটন থেকে শুরু করে অনেক দিক থেকেই তারা প্রতিষ্ঠিত অবস্থানে চলে গেছে। তাদের পাকিস্তানের মত জঙ্গীবাদ, নিজ দেশে নিয়মিত বোমা হামলা, দূর্নীতি ইত্যাদি তুলনামূলক কম হবার কারনে এত বেশি ঋন থাকলেও পাকিস্তানের মত উদ্বিগ্ন হবার মত পরিস্থিতি তাদের হয়নি। তারা এর থেকে একটু কষ্ট করলেই বেরিয়ে আসতে পারবে।
ভারতের কথা না বললেই ভাল। পশ্চিম আমেরিকার লোকজন ভাব নেয় এমন যে তারা হল মার্কিন নাগরিক। আর বাংলাদেশের লোকজন হল ভিক্ষুক। বিদেশের দানের টাকায়, ঋনের টাকায় চলে। অথচ অর্থনীতির আকার হিসাবে যদি বলি ভারতের ঋন প্রায় ২০% আর বাংলাদেশের ১০%। তাই ওরা আমাদের থেকে ভিক্ষার দিক থেকে দ্বিগুন এড়িয়ে।
যাহোক এটা মজা করে বললাম। আসল কথা হল, ভারতের অর্থনীতি যথেষ্ট ভাল হলেও জঙ্গীবাদ, সাম্প্রতিক কাশ্মীর ইস্যু, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়া তাদের জন্য বড় ঝুকি সৃষ্টি করতে পারে। তবে তাদের ঋনের কিস্তি পরিশোধে ব্যার্থ হবার মত অবস্থা এখনো হয়নি। এর জন্য যেটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে সেটা হল সে দেশের শিক্ষা ব্যাবস্থা। তাদের প্রচুর আইটি, প্রফেশনাল, টেকনিক্যাল প্রফেশনাল তৈরি হয় যারা সারা বিশ্বেই কাজ করে। এগুলা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। সেই সাথে ১২০ কোটির বিশাল বাজার হবার কারনে এটা বিশ্বের অধিকাংশ কোম্পানির কাছেই অবজ্ঞা করার মত বাজার নয়। যার ফলস্বরুপ বিদেশি বিনিয়োগ ও বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে বিদেশি ঋনের কথা আসলে তাদের অবস্থানে আমাদের থেকেও খারাপ।
সর্বশেষ বাংলাদেশ সম্পর্কে কিছু বলা দরকার। বাংলাদেশের এক শ্রেণীর মানুষের সামনে কিছু বলতে গেলেই উদাহরণ দিবে, সদ্যোজাত জন্মানো শিশুর মাথায় কেন ঋনের বোঝা? আমরা ঋন নিয়ে নিয়ে শেষ হয়ে যাচ্ছি। বাংলাদেশকে বিক্রি করে ঋন শোধ করতে হবে। আসলে ঋন নিয়ে তাদের কোন ধারনায় নেই। উপরের যতগুলি দেশ বললাম, আমি নিশ্চিত বলতে পারি ঋন নিয়ে এত টেনশনে পাকিস্তান, ভারত, শ্রীলঙ্কা বা ভিয়েতনাম কোন দেশের জনগণ নেই। এত টেনশন কেউ করেনা। এভাবে সদ্যোজাত বাচ্চার উদাহরণ দিয়ে যুক্তি দেয়ার চেষ্টা করেনা। আমরা করি। আমরা একটু ভিন্ন জাত কিনা।
বাংলাদেশের ঋনের পরিমান বিশ্বের অধিকাংশ দেশের তুলনায় কম। অর্থনীতিবিদদের একটা সাধারন অনুমান হল, যদি অন্যান্য সব খাত মোটামুটি ভাল পারফরম্যান্স করে তবে জিডিপি এর ৪০% পর্যন্ত ঋন নিলেও শোধ করতে তেমন বেগ পেতে হবে না আমাদের।

আসলে আমরা ঋন নেই কেন? এর উত্তর হল, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানে পরমাণু বোমা হামলার পর যুদ্ধ শেষে জাপান আমেরিকাকে বলেছিল আমাদের ঋন দাও। আমরা দেশকে পুনর্গঠিত করে ঋন শোধ করে দিব। আমেরিকার ঋনে জাপান নিজেদের অবকাঠামো সাজালো। শক্তিশালী অবকাঠামোর উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠল শক্তিশালী জাপানি কোম্পানি। তারাই পরবর্তীতে আমেরিকার বাজার দখলে নিয়েছিল। ভিয়েতনাম এর বিগত ১০ বছরে রপ্তানি $৭০ বিলিয়ন ডলার থেকে বৃদ্ধি পেয়ে $২৭০ বিলিয়ন ডলার হয়েছে। কারন তারা ঋন নিয়েই তাদের দেশের সব ঘাটতিগুলি শুধরে নিয়েছে। কিন্তু আমরা পারিনি।

বাংলাদেশের ম্যাপ হাতে নিন। এরপর চোখ বুলিয়ে অনুধাবন করার চেষ্টা করুন আমাদের ঘাটতি কি কি আছে যেগুলা খুব দ্রুত সমাধান না করলে আমরা ভিয়েতনামের মত ঝড়ের গতিতে এগোতে পারব না?
আমি কয়েকটা বলে দেই।
১. দ্বিতীয় পদ্মা সেতু
২. যমুনার উপর রেল সেতু।
৩. সারা দেশের প্রতিটি জেলা রেল নেটওয়ার্ক এর আওতায় আনা
৪. সিঙ্গেল লাইন রেলকে ডাবল লাইনে রুপান্তর
৫. বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধি পেলেও এখনো সঞ্চালন লাইনের দুর্বলতার কারনে লোড শেডিং এড়ানো যাচ্ছে না। তাই সারা দেশের সঞ্চালন লাইনের আধুনিকায়ন
৬. বিশ্ববিদ্যালয় গুলিকে আধুনিকায়ন এবং পর্যাপ্ত গবেষণার সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি
৭. বিকেন্দ্রীকরণ এবং ইকোনমিক জোন সৃষ্টি
৮. গুরুত্বপূর্ণ সড়ক গুলি ৬-৮ লেনে রুপান্তর এবং আঞ্চলিক সড়ক গুলি ৪ লেনে রুপান্তর
৯. সড়ক, ছোট ব্রিজ, কালভার্ট নির্মানের মাধ্যমে প্রতিটি গ্রামে উন্নত যোগাযোগ ব্যাবস্থা নিশ্চিতকরন।
এরকম অনেক গুলি আপনি যুক্ত করে নিতে পারেন। আর এই গুলির জন্যই আমাদের ঋন প্রয়োজন। আমরা অতিতে কোন ঋনের কিস্তি শোধ করতে একদিন অতিরিক্ত সময় ভিক্ষা চাইনি। আশাকরি ভবিষ্যতেও এমন হবার সম্ভাবনা নেই। খুব অস্বাভাবিক কিছু না হলে ইনশাআল্লাহ আমাদের ঋন ফাদে পড়ার কোন সম্ভাবনা নেই।
বড় পোস্ট। দুঃখিত

Comments

Popular posts from this blog

How to Protect Your Intellectual Property Rights in Bangladesh

Banking Litigation and Dispute Resolution