রাজনীতিতে 'বাম দল', 'ডান দল' এবং 'মধ্য দল থাকতে পারে।

তবে এর কোনো নির্দিষ্ট সংজ্ঞা নেই। স্থান ও কালের প্রেক্ষিতে এই তিন মতবাদের সীমানা ও সাধারণ ধ্যানধারণা বারংবার আংশিক ভাবে পরিবর্তিত হয়ে এসেছে। এবং ভবিষ্যতেও হবে।
যখন বামপন্থা, দক্ষিণপন্থা বা মধ্যপন্থা -এর কথা বলা হয়, তখন লক্ষ্য করে দেখুন যে, প্রত্যেক শব্দের মধ্যে ‘পন্থা’ শব্দটি আছে। পন্থা শব্দের অর্থ ‘পথ’ বা রাস্তা।
এই বিভিন্ন পথ বা রাস্তার অস্তিত্ব এই কারণেই- যেমনভাবে একই গন্তব্যস্থলে বিভিন্ন রাস্তার মাধ্যমে পৌঁছানো যেতে পারে, তেমন ভাবেই কোনো পরিস্থিতির বর্ণনা, ব্যাখ্যা বা কোনো সমস্যার সমাধান একাধিক পথে হতে পারে। এটা আদর্শগত ভাবে সত্য এবং বাস্তবও তাই বলে।
বামপন্থী হলেন তাঁরা যারা বিশ্বাস করেন সকলের অর্থনৈতিক ভাবে সমান অধিকার থাকা প্রয়োজন, সমাজে শ্রেণীবিভাগ থাকা উচিত নয়, প্রথাগত ধর্ম মানুষের বিভেদের অন্যতম কারণ। বামপন্থীরা সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমেও ক্ষমতা দখল করে সমাজে সাম্য প্রতিষ্ঠা করতে চান। অনেকে কমিউনিস্ট ও বামপন্থী মিশিয়ে ফেলেন। এটুকু মনে রাখবেন- সব কমিউনিস্টই বামপন্থী, কিন্তু সব বামপন্থী কমিউনিস্ট নয়।
দক্ষিণপন্থীরা নানা বিষয়ে রক্ষণশীল। তাঁরা প্রথাগত ধর্মের প্রবল অনুরাগী ও সমর্থক। তাঁরা মনে করেন বহুদিন থেকে চলে আসা সংস্কার ও নিয়মকানুন সমাজের ভালো করে এবং তাতে সকলের উন্নতি হয়। ব্যক্তিগত ক্ষমতা ও দক্ষতার জোরে একজন মানুষ অর্থনৈতিকভাবে আত্মোন্নতি ঘটাতে পারেন। দক্ষিণপন্থীরা সাধারণভাবে ধনতন্ত্রের এবং পুঁজিবাদের সমর্থক হন। বহুদিন ধরে চলে আসা আর্থসামাজিক এবং শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে বজায় রেখে তাঁরা অগ্রসর হতে চান।
মধ্যপন্থীরা হলেন এই দুইয়ের মাঝামাঝি। যেহেতু দুই চরমের মধ্যে তাঁরা অবস্থান করেন, তাই পৃথিবীর ইতিহাসে বিভিন্ন ঘটনাবলী তথা সমস্যার প্রতি তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গি, এবং তাঁদের সাধারণ মতবাদ সবচেয়ে নমনীয় এবং পরিবর্তনশীল।
এ তো হল পন্থার কথা। এবার দলের কথা বলি।
যখন কোনো দল নিজেদের আদর্শ, লক্ষ্য ও অনুপ্রেরণা কোনো একটি পন্থার সঙ্গে সম্পূৰ্ণ বা আংশিক ভাবে সাযুজ্য রেখে নির্মাণ করে, তখন সেই দল সেই অভিমুখের নাম পায়।

নামকরণ উৎস:
টেনিস কোর্টের শপথ, চিত্রশিল্পী: জাক-লুই দেবিদ [চিত্র উৎস: উইকিমিডিয়া কমন্স]
১৭৯১ খ্রিস্টাব্দে ফরাসী বিপ্লব পরবর্তী ফ্রঁসে নতুন আইনসভা গঠিত হলে নবনির্বাচিত সদস‍্যদের মধ‍্যে কট্টর বিপ্লববাদীরা অধিবেশন কক্ষের বামদিকে বসেন, কট্টর রক্ষণশীলরা বসেন দক্ষিণ অর্থাৎ ডানদিকে।
এখান থেকেই সূত্রপাত হয় রক্ষণশীলদের “দক্ষিণপন্থী” বলা এবং বিপ্লবের সমর্থকদের “বামপন্থী” বলা। এখন চোখ খুলে একটু লক্ষ্য করলেই বোঝা যায় যে এ শব্দগুলি কতটা বিবর্তিত হয়েছে, এবং এদের অর্থ পরিবর্তিত ও পরিবর্ধিত হয়েছে।

পন্থা বর্ণালী
কে কত দক্ষিণপন্থী বা কত বামপন্থী তার ভিত্তিতে একটি কাল্পনিক বর্ণালী নির্মাণ করা হয়। অতি বাম থেকে অতি দক্ষিণপন্থীরা সাতভাগে বিভক্ত- ১. কমিউনিস্ট ২. সমাজতান্ত্রিক ৩. অহিংস উদারবাদী (গ্রিন) ৪. উদারপন্থী ৫. ধার্মিক গণতান্ত্রিক ৬. রক্ষণশীল ৭. উগ্র দক্ষিণপন্থী (১ থেকে ৭-এ ক্রমবর্ধমান দক্ষিণপন্থা)।
এই শ্রেণিবিভাগ আদর্শ একটি মডেল । বাস্তবে বর্তমানে ও অতীতে এর কিছু পরিমাণ বিচ‍্যুতি লক্ষ‍্যিত হয়।
হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক ক্লাউস ভন বেইমি ১৯৩৪ সালে এই বর্ণালীর উৎপত্তি ঘটান।

কিছু উদাহরণ:
এডলফ হিটলার [চিত্র উৎস: History on the net]
  • হিটলা এর জাতীয় সমাজতন্ত্রী দল (নাৎসী পার্টি) একটি প্রবল এবং উগ্র দক্ষিণপন্থী দল। উইনস্টন চার্চিএর নেতৃত্বাধীন রক্ষণশীল দল (কনজারভেটিভ পার্টি) ও তাই।
সোভিয়েত পতাকা [চিত্র উৎস: উইকিমিডিয়া কমন্স]
  • পূর্বতন সোভিয়েত রাশিয়ার কমিউনিস্ট পার্টি একটি বামপন্থী দল।
  • ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের উন্মেষের কালে, যারা সরাসরি সশস্ত্র বিপ্লব ও ব্রিটিশের অধীনতায় চরম আনুগত্য নীতির মাঝামাঝি নীতি- আবেদন নিবেদন নীতি গ্রহণ করেছিলেন তাঁরা মধ্যপন্থী।

কঠোর বাস্তব:
বাস্তব অনেকটাই ভিন্ন। এখানে অনেক দলই নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থে বা নেতৃবৃন্দের ব্যক্তিগত সুবিধার স্বার্থে এমন অনেক নীতি গ্রহণ করেন যা সেই রাজনৈতিক দলের মূলধারার দর্শনের পরিপন্থী। কখনো কখনো এরকমও দেখা যায় যে দুটি ভিন্ন রাজনৈতিক দল, যারা বাইরে সম্পূর্ণ আলাদা তারা হয়তো ভিতরে ভিতরে একই উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে চায়।
প্রসঙ্গত স্বাধীন তানজানিয়ার প্রথম রাষ্ট্রপতি জুলিয়াস নাইরেরে এর একটি উক্তি স্মর্তব্য-
The United States is also a one party state. With typical American extravagance they have two of them.
(অনুবাদ: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রর রাষ্ট্রব্যবস্থাও প্রকৃতপক্ষে একদলীয় রাষ্ট্রব্যবস্থা। আমেরিকান ভোগবাদের প্রকৃষ্ট উদাহরণস্বরূপ তাদের একটার জায়গায় দুটো (দল) আছে।)

Comments

Popular posts from this blog

ভাড়াটিয়া-ভাড়াদার আইনের জটিলতা পার হওয়া: ভাড়াটিয়াদের জন্য একটি গাইড

একটি ভিত্তিহীন গুজব উড়িয়ে দেওয়া: বাংলাদেশী সাংবাদিকদের ফ্রেঞ্চ ভিসা প্রত্যাখ্যান করা হয়নি৷

অধ্যায় 2: বাংলায় ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন