জাপানি বিমান ছিনতাই ও জিয়াউর রহমান সরকারে ক্যু
জাপানি বিমান ছিনতাই ও জিয়াউর রহমান সরকারে ক্যু
১৯৭৭ সালে জিয়াউর রহমানের সরকারের আমলে ভারত থেকে জাপান এয়ারলাইন্সের একটি বিমান ছিনতাই করে ঢাকা নিয়ে আসা হয়েছিল। একটা শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির পর ঢাকায় নিয়ে আসা ওই জাপানি বিমান ছিনতাইয়ের ঘটনার অবসান হয়েছিল ৫ অক্টোবর। আর ওই ছিনতাই ঘটনার মধ্যেই ঘটেছিল জিয়াউর রহমান সরকারের বিরুদ্ধে বিমান বাহিনীর বিদ্রোহ। জেনারেল জিয়াউর রহমান তার পাঁচ বছরের অবৈধ শাসনামলে প্রায় ২১টি অভ্যুত্থানের মুখোমুখি হয়েছিলেন। ২১টি অভ্যুত্থান থেকে বেঁচে গেলেও ২২তম অভ্যুত্থানে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। এর অধিকাংশই ছিল ১৯৭১ সালের সেই সকল মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের সমন্বয়ে গঠিত, যারা জিয়ার পাকিস্তানি ভাবাদর্শের সাথে সম্পর্ক সহ্য করতে পারেননি। অন্যদিকে জিয়াউর রহমান প্রতিটি বিদ্রোহ দমন করেন নৃশংসভাবে। হত্যা করেন সশস্ত্র বাহিনীর অজস্র কর্মকর্তাকে।
জাপানের বিমান ছিনতাইয়ের ঘটনা জিয়াউর রহমান নিজের সুবিধা মতো নির্দেশনায় মোকাবিলা করেছিলেন। উল্লেখ্য, যশোর বিমানঘাঁটি থেকে জরুরি কাজে ঢাকায় আসা বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর সাবেক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা এয়ার কমোডর (অব.) ইশফাক ইলাহী চৌধুরী এবং ‘‘ঢাকায় জাপানি বিমান ছিনতাই ১৯৭৭’’ শিরোনামে জাপানি মন্ত্রী হাজিমে ইশিইর স্মৃতিকথা অনুসারে জানা যায়, ২৮ সেপ্টেম্বর, ১৯৭৭ সালে জাপান এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট ৮৭২-এর ডিসি-৮ বিমানটি ভারতের মুম্বাই বিমানবন্দর থেকে ছিনতাই করে তৎকালীন ঢাকা তেজগাঁও বিমানবন্দরে নিয়ে আসে জাপানের সশস্ত্র বাম সংগঠন রেড আর্মির সদস্যরা। মুম্বাই থেকে ওড়ার ১২ মিনিটের মাথায় ছিনতাই হয় বিমানটি।
জিয়াউর রহমানের অতি হস্তক্ষেপের কারণে জাপানের পরিবহন প্রতিমন্ত্রী হাজিমে ইশিইর সঙ্গে বাংলাদেশের তৎকালীন বিমানবাহিনী প্রধান এ জি মাহমুদের জিম্মি সংকট নিরসনে জটিলতা তৈরি হয়েছিল। দুই দেশের প্রতিনিধিদের মধ্যে রীতিমতো মনোমালিন্যেরও সৃষ্টি হয়। হাজিমে ইশিইর বইয়ে ‘এয়ার ভাইস মার্শাল এ জি মাহমুদ’, ‘কষ্টকর সিদ্ধান্ত’, ‘জিম্মি বিনিময়’ ও ‘ওকুদাইরার সঙ্গে আলোচনা’ শিরোনামের অধ্যায় চারটি পড়লে এমন এক বিভীষিকাময় পরিস্থিতির ছবি চোখের সামনে ভেসে ওঠে। বইটির অনুবাদক কাজুহিরো ওয়াতানাবে তার ভূমিকায় লিখেছেন-‘...জিম্মিদের কীভাবে নিরাপদে উদ্ধার করা যায়, তা নিয়ে দুই দেশের মধ্যে মতানৈক্য দেখা দিয়েছিল। এ কারণে এয়ার ভাইস মার্শাল এ জি মাহমুদ, যিনি বিমান ছিনতাইকারীদের সঙ্গে দর-কষাকষির দায়িত্বে ছিলেন এবং জাপানি প্রতিনিধিদলের প্রধান ও তৎকালীন পরিবহন প্রতিমন্ত্রী হাজিমে ইশিইর মধ্যে যে বিবাদ দেখা দিয়েছিল, সেই বর্ণনা আমরা মি. ইশিইর লেখার মধ্যে পাই।’ আসলে জাপানি জঙ্গিদের হাত থেকে জিম্মিদের মুক্তির ব্যাপারটা কোনোক্রমেই সহজ ছিল না। কী করে এই কঠিন সমস্যার সমাধান হলো, সে এক সত্যিই বিস্ময়কর ঘটনা যা থ্রিলারকেও হার মানায়।
উপর্যুপরি যখন এই নাটকীয় ঘটনা চলছে, তখনই বাংলাদেশে বিমানবাহিনীতে সংঘটিত হয় একটি সশস্ত্র অভ্যুত্থান। এর সরাসরি প্রভাব পড়ে জাপানি জঙ্গিদের ওই বিমান ছিনতাই ও জিম্মি ঘটনার ওপর। অবশেষে শ্বাসরুদ্ধকর এই জিম্মি-নাটকের অবসান ঘটে। জঙ্গিরা তাদের দাবি করা অর্থ ও তাদের দলীয় সদস্যদের নিজেদের নাগালে পাওয়ার পর জিম্মিদের মুক্ত করে দেয় কুয়েত, দামেস্ক ও শেষে আলজেরিয়া বিমানবন্দরে পর্যায়ক্রমে বিমান থামিয়ে। এভাবেই শেষ হয় জাপানি বিমান ছিনতাই ও জিম্মি-মুক্তি নাটকের।
জাপান থেকে সেদেশের নিরাপত্তাবাহিনীর সদস্যদের বাংলাদেশে পাঠানোর প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন জিয়াউর রহমান। ১ অক্টোবর ঢাকায় আসে জাপানের প্রতিনিধি দল। রেড আর্মির দাবি করা ৯ বন্দির ছয়জনকে নিয়ে বাংলাদেশে আসেন। জিম্মিদের ছেড়ে দেওয়ার বিষয়ে আলোচনা শুরু করে রেড আর্মির সদস্যরা।
এর মধ্যেই বাংলাদেশে ব্যর্থ অভ্যুত্থানের ঘটনা ঘটে। ওই ব্যর্থ অভ্যুত্থানে বিমানবাহিনীর সদস্যরা জড়িত ছিল। ফলে জিম্মি সংকট উত্তরণের চেষ্টা বিলম্বিত হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এলে ৪২ জন যাত্রী ও পাঁচজন ক্রুকে ছেড়ে দেওয়া হয়। সে সময় কারফিউ অবস্থা জারি ছিল। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান সামরিক আইন শাসক হিসেবে রাত ১০টা থেকে ভোর ৬টা পর্যন্ত কারফিউ জারি করেছিলেন। তিনি আদেশ দিয়েছিলেন, ছিনতাই করে নিয়ে আসা বিমানটিকে অবিলম্বে ঢাকা ত্যাগ করানোর। অন্যদিকে জঙ্গিদের সঙ্গে আলোচনার বিষয়ে হাজিমে ইশিই বইতে লিখেছেন, জাপানিজ রেড আর্মির জঙ্গিদের সঙ্গে মি. মাহমুদ নিজের ইচ্ছেমতো আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। জাপান সরকারের পরামর্শ তিনি আদৌ শুনতে চাননি।
অক্টোবরের ২ তারিখে ব্যর্থ অভ্যুত্থানের ঘটনার পর বদলে যেতে থাকে বাংলাদেশের পরিস্থিতি। ওই দিন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান কারফিউ জারি করে কন্ট্রোল টাওয়ারে ফোন করেন। আদেশ দেন বিমানটিকে অনতিবিলম্বে ঢাকা ত্যাগ করতে দেওয়ার জন্য। আসলে জাপানি বিমান ছিনতাই ঘটনার সঙ্গে জুড়ে আছে বাংলাদেশের এক ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থানের ঘটনা। হাজিমে ইশিই তার বইয়ে লিখেছেন, পরদিন ভোর পাঁচটার দিকে তিনি বাজুকা কামান ও মেশিনগানের শব্দ শুনতে থাকেন। কিন্তু তখনও তিনি বুঝতে পারেন নি যে কী হচ্ছিল। কিন্তু পরে তিনি জানতে পারেন যে ঢাকা বিমানবন্দর সে সময় প্রায় বিদ্রোহীদের দখলে চলে যাচ্ছিল। কিন্তু মি. মাহমুদ তাকে কিছুই বুঝতে দেননি। হাজিমে ইশিই লিখেছেন, এই ব্যর্থ অভ্যুত্থান ঘটিয়েছিল স্থল ও বিমানবাহিনীর প্রায় ১০০ জন সেপাই। এতে বিমানবাহিনীর একজন অফিসারসহ ২১ জন অফিসার ও সেনা নিহত হন। বিদ্রোহী সেনা মিলে মোট ২০০ জনের বেশি ব্যক্তিকে এই ঘটনায় বিনা বিচারে হত্যা করা হয়।
মূলত ইতিহাসের বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুর খুনি হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন যেমন, তেমনি বিদ্রোহী বিমানবাহিনীর সদস্যদের নির্মমভাবে খুন করে জাপানি বিমান ছিনতাইয়ের ঘটনাকে ভিন্নখাতে পরিচালিত করেছিলেন।
লেখক: অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
Comments