জাগদল থেকে বিএনপি: অস্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় অনেকদূর

১৯৭৮ সালে ১ সেপ্টেম্বর সেনাছাউনিতে জন্মের পর ৪৪ বছর পার করেছে বিএনপি। জাগদল নামে জন্ম হলেও বছরখানেকের মধ্যে নাম রূপান্তরিত হয়ে যায় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল অর্থাৎ বিএনপিতে। নানান চড়াই-উতরাইয়ের পর জিয়াউর রহমানের প্রতিষ্ঠিত দলটি ক্ষমতায় এসেছিল একাধিকবার। বিএনপি এখন পার করছে কঠিন সময়। এতোটা কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি দলটি আর কখনো হয়নি।

জাগদল থেকে বিএনপি: অস্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় অনেকদূর

চার দশকের বেশি সময় পার হলেও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে কোনো কাঠামোগত অবয়ব দাঁড় করাতে পারেনি বিএনপি। বলা হয়, অন্য প্রথাগত রাজনৈতিক দলগুলোর মতো করে বিএনপির ক্রমবিকাশ ঘটেনি। ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকা এক জেনারেলের হাত ধরে গঠিত দলটি গেল ১৫ বছর ধরে ক্ষমতার বাইরে রয়েছে।

প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পর ভাঙনের মুখে পড়েছিল দলটি। গেল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ভাঙতে যাচ্ছিল আরও একবার। সংবিধান অনুসারে দ্বাদশ নির্বাচনের আর বছর দেড়েক বাকি। কিন্তু সংকট কাটিয়ে দলটি কতটা ঘুরে দাঁড়াতে পারবে, তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করছেন বিশ্লেষকেরা। সম্প্রতি কোনো কর্মসূচি দিয়ে তা সফলভাবে পালন করতে পারেনি বিএনপি।

বিএনপির প্রতিষ্ঠা যেভাবে

নিজের শাসনকে বেসামরিক করতে ১৯৭৭ সালের ৩০ এপ্রিল ১৯ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেন জিয়াউর রহমান। এরপর তিনি প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত নেন। তখন তার নেতৃত্বে জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দল (জাগদল) প্রতিষ্ঠিত হয়। দলের সমন্বয়ক ছিলেন বিচারপতি আবদুস সাত্তার।

নির্বাচন ঘনিয়ে এলে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) গঠন করা হয়। আর জাগদলকে একীভূত করা হয় বিএনপির সঙ্গে। বিএনপির সমন্বয়ক ছিলেন জিয়াউর রহমান। তিনিই দলের প্রথম চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন।

প্রথম মহাসচিব ছিলেন অধ্যাপক একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী। জিয়ার এই দলে বাম, ডান, মধ্যপন্থি—সব মতাদর্শের লোকজন ছিলেন। দলের প্রথম ৪৫ শতাংশ সদস্য কেবল রাজনীতিতেই নতুন না, বয়সেও তরুণ ছিলেন। ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর বিকাল ৫টায় রমনা রেস্তোরাঁয় দলের আনুষ্ঠানিক ঘোষণাপত্র পাঠ করেন জিয়াউর রহমান। সংবাদ সম্মেলনে তিনি ঘোষণাপত্র পাঠ ছাড়াও প্রায় দুই ঘণ্টা সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন।

নতুন দলের আহ্বায়ক কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে তিনি প্রথমে ১৮ জন সদস্যের নাম এবং ১৯ সেপ্টেম্বর ওই আঠারোসহ ৭৬ সদস্য বিশিষ্ট আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করেন। ১৯৭৮ সালের ২৮ আগস্ট জাগদলের বর্ধিতসভায় ওই দলটি বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়। তারা বিএনপিতে যোগ দেয়ার ঘোষণা দেন।

বিএনপির গঠনতন্ত্র তৈরির প্রক্রিয়ায় সরাসরি যুক্ত ছিলেন ৯ জন। তাদের মধ্যে জিয়াউর রহমান ছাড়াও ছিলেন বিচারপতি আবদুস সাত্তার, নাজমুল হুদা, মওদুদ আহমদ ও ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরী।

গবেষক মহিউদ্দন আহমদ তার বইতে লিখেছেন, বিএনপি এমন একটি দল, যার জন্ম স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় হয়নি। এই অঞ্চলে সব দলের জন্ম হয়েছে ক্ষমতার বৃত্তের বাইরে, রাজপথে কিংবা আলোচনার টেবিলে। বিএনপি সেদিক থেকে ব্যতিক্রম। দলটি তৈরি হলো ক্ষমতার শীর্ষে থাকা একজন অরাজনৈতিক ব্যক্তির দ্বারা, যিনি সিদ্ধান্ত নিলেন যে তিনি রাজনীতি করবেন।

ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ বাদ দিল বিএনপি

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের শাসনতান্ত্রিক ইতিহাসে সামরিক শাসনের শুরু হয়েছে। এরপর সামরিক অভ্যুত্থানে ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর ক্ষমতায় আসেন তখনকার সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমান।১৯৭২ সালের সংবিধানের চারটি মূল ভিত্তির একটি ছিল ধর্মনিরপেক্ষতা। কিন্তু পঞ্চম সংশোধনীতে ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত্তিটি মুছে দেন তিনি।

এ সংশোধনীর মাধ্যমে ১৫ আগস্টের থেকে ১৯৭৯ সালের ৫ এপ্রিল পর্যন্ত সামরিক শাসনের সব কর্মকাণ্ডকে বৈধতা দেয়া হয়। ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ দিয়ে সেখানে ‘বিসমিল্লহির রাহমানির রাহিম’ যুক্ত করা হয়। ১৯৭৯ সালের ৬ এপ্রিল বাংলাদেশের দ্বিতীয় সংসদে তখনকার সংসদ নেতা শাহ আজিজুর রহমান পঞ্চম সংশোধনী বিলটি উত্থাপন করেন। দীর্ঘ সময় পর ২০১০ সালে উচ্চ আদালতের এক রায়ে এই পঞ্চম সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে।

এতে ধর্ম নিরপেক্ষতাকে সংবিধানের একটি মৌলিক মতবাদ হিসেবে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা মুছে ফেলাকে বাঙালি সত্ত্বায় সবচেয়ে বড় আঘাত হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। কারণ তা বাঙালি সমাজ ও সংস্কৃতির বিরুদ্ধে ছিল। বাঙালি সংস্কৃতি বহুত্ববাদী ও প্রগতিশীল হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে।

স্বাধীনতাবিরোধীদের সঙ্গে আপস

জিয়াউর রহমানের শাসন নিয়ে বিভিন্ন অভিযোগ রয়েছে। তার মধ্যে সবচেয়ে বড় অভিযোগটি হলো—যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিল কিংবা পাকিস্তান সরকারের অনুগত ছিল, বেছে বেছে তাদের মন্ত্রিসভায় তিনি স্থান দেন। তাদের মধ্যে অন্যতম শাহ আজিজুর রহমান। তাকে প্রধানমন্ত্রী ও জাতীয় সংসদ নেতা বানিয়েছিলেন তিনি।

মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের সামরিক সরকার জাতিসংঘে যে প্রতিনিধিদল পাঠিয়েছিল, তাদের সঙ্গে শাহ আজিজও ছিল। স্বাধীনতার পর দালাল আইনে তাকে গ্রেফতার করা হয়। পরে শেখ মুজিবুর রহমান সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করলে ১৯৭৩ সালে মুক্তি লাভ করেন শাহ আজিজুর রহমান।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, মন্ত্রিসভায় স্বাধীনতাবিরোধীদের স্থান দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতির দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতি করেছেন জিয়াউর রহমান।

জিয়ার হ্যাঁ-না ভোটের রাজনীতি

বেতার ও টেলিভিশন ভাষণে ১৯৭৫ সালের ১১ নভেম্বর মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান বলেন, আমি রাজনীতিবিদ নই। আমি একজন সৈনিক। রাজনীতির সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। আমাদের সরকার সম্পূর্ণ নির্দলীয় ও অরাজনৈতিক।

১৯৭৬ সালের মে মাসে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এক জনসভায় তিনি বলেন, আমি একজন শ্রমিক।

‘শ্রমিক’ ও ‘সৈনিক’ থেকে একের পর-এক সিঁড়ি বেয়ে ক্ষমতার শীর্ষে যান তিনি। সামরিক শাসক জিয়াকে চ্যালেঞ্জ করার মতো কেউ তখন সেনাবাহিনীতে ছিলেন না। রাজনৈতিক বিরোধীরাও ছিল বিভক্ত। কিন্তু তারপরেও তাকে প্রমাণ করতে হবে যে তার পেছনে বিপুল জনসমর্থন, কেবল বন্দুকের জোরে ক্ষমতায় আসেননি।

কাজেই তার প্রতি জনগণের আস্থা আছে কিনা; তা যাচাইয়ে হ্যাঁ-না ভোটের আয়োজন করেছিলেন তিনি। নির্বাচন কমিশন জানাল—দেশের ৮৮ দশমিক ৫০ শতাংশ ভোটার ভোট দিয়েছেন। তাদের মধ্যে ৯৮ দশমিক ৯ শতাংশ হ্যাঁ ভোট দিয়েছে।

ভোটার উপস্থিতির এ-হার মোটেও বিশ্বাস করার মতো ছিল না। গণভাটের মাধ্যমে রাজনৈতিক বৈধতার একটি ছাড়পত্র তৈরি করলেন জিয়া।

জিয়াউর রহমানকে হত্যা

১৯৮১ সালের ৩০ মে ভোররাতে প্রেসিডেন্ট ও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার জিয়াউর রহমানকে হত্যা করে একদল সেনাসদস্য। বিএনপির স্থানীয় নেতাদের বিরোধ মেটাতে ঘটনার আগের দিন তিনি চট্টগ্রামে যান। বিবিসি বাংলার এক খবরে বলা হয়, ৪১ বছর পার হলেও সেই হত্যাকাণ্ডের উদ্দেশ্য নিয়ে নানা প্রশ্ন রয়েছে। হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় যারা দায়ী, ঘটনার দুদিনের মধ্যে তাদের দমন করা হয়েছিল।

এতে সরাসরি জড়িতরা রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করতে চেয়েছিল কিনা; ঘটনার পরে তাদের কর্মকাণ্ডে এ-ধরনের কোনো পরিকল্পনার আভাস পাওয়া যায়নি। বিএনপি নেতারা মনে করেন, জিয়াউর রহমানকে হত্যার পেছনে বড় ধরনের পরিকল্পনা ছিল। রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করাই চূড়ান্ত লক্ষ্য ছিল।

আবার এর পেছনে রাজনৈতিক ও বিদেশি ষড়যন্ত্র থাকার অভিযোগও করেন অনেকে। জিয়াউর রহমানকে হত্যার পর তখনকার ভাইস প্রেসিডেন্ট অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি আব্দুস সাত্তার অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হন। পরে নির্বাচনের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন তিনি।


সংবাদমাধ্যমকে কর্নেল (অব.) অলি আহমেদ বলেন, জিয়াউর রহমানকে হত্যার ঘটনায় সরাসরি জড়িতদের ধরার সাথে সাথেই হত্যা করা হয়েছিল।

সে সময় সংবাদ মাধ্যমে খবর ছাপা হয়েছিল যে, চট্টগ্রাম সেনানিবাসে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সেখান থেকে পালিয়ে গিয়ে কর্নেল মতিউর রহমান এবং লেফটেন্যান্ট মেহবুবুর রহমান নিহত হন। তখন সরকারি প্রেসনোটে বলা হয়েছিল, তারা গোলাগুলিতে নিহত হন।

এছাড়া ৩১ মে জেনারেল মঞ্জুর চট্টগ্রাম সেনানিবাস থেকে পালিয়ে যাওয়ার পর একটি চা বাগান থেকে তাকে আটক করা হয়েছিল। কিন্তু আটকের পর তাকে হত্যা করা হয়। এ ঘটনাগুলো তুলে ধরে অলি আহমেদ বলেন, ঘটনার পরিকল্পনাকারী বা পেছনের কারও বিষয় যাতে প্রকাশ না পায়, সেজন্য হত্যাকাণ্ডে সরাসরি জড়িতদের হত্যা করা হয়েছিল বলে তিনি মনে করেন।

জিয়াউর রহমানের পরিবার কিংবা বিএনপির পক্ষ থেকে কখনও হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে বিচারের উদ্যোগ নেয়া হয়নি বা মামলা করা হয়নি।

জিয়ার হাত ধরেই জামায়াতের উত্থান

১৯৭২ সালের সংবিধানের ৩৮ ধারা অনুসারে, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মের অপব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়। ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর দৃশ্যপট বদলে যায়।

১৯৭৬ সালের ৩ মে তখনকার প্রেসিডেন্ট এ এস এম সায়েম একটি অধ্যাদেশ জারি করে সংবিধানের ৩৮ নম্বর অনুচ্ছেদ বাতিল করেন। এরমধ্য দিয়ে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হয়। তখন সায়েম রাষ্ট্রপতি থাকলেও ক্ষমতার কলকাঠি ছিল জিয়াউর রহমানের হাতে।

এরপর কৌশলী ভূমিকা নিয়ে রাজনীতিতে ধীরে ধীরে জামায়াতের আত্মপ্রকাশ ঘটে। ১৯৭৬ সালের ২৪ আগস্ট জামায়াতে ইসলামী এবং আরও কয়েকটি ধর্মভিত্তিক দল মিলে ইসলামিক ডেমোক্রেটিক লীগ (আইডিএল) নামে একটি রাজনৈতিক প্লাটফর্ম গঠন করে।

আইডিএলের ব্যানারে জামায়াতে ইসলামীর কয়েকজন নেতাকে ১৯৭৯ সালের নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ করে দেন জিয়াউর রহমান। সে নির্বাচনে ছয়টি আসনে জয়লাভ করে জামায়াতে ইসলামী। এভাবে স্বাধীন বাংলাদেশের সংসদে প্রথমবারের মতো ঢোকার সুযোগ পায় স্বাধীনতাবিরোধী দলটি।

পরে ১৯৭৯ সালের ২৫, ২৬ এবং ২৭ মে ঢাকার ইডেন হোটেলে সম্মেলনের মাধ্যমে কর্মক্রম শুরু করে জামায়াতে ইসলামী।

প্রেসিডেন্ট আবদুস সাত্তার

১৯৮১ সালের ১৫ নভেম্বর ৬৬ শতাংশ ভোট পেয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন সাবেক বিচারপতি আবদুস সাত্তার। তখন তার বয়স ছিল ৭৬ বছর।

প্রেসিডেন্ট পদে ৩১ প্রার্থীর মধ্যে আওয়ামী লীগের ছিলেন ড. কামাল হোসেন। বিচারপতি আবদুস সাত্তার পেয়েছিলেন ১ কোটি ৪২ লাখ ৩৩ হাজার ৯৫৮ ভোট, কামাল হোসেন পান ৫৬ লাখ ৩৬ হাজার ১১৩ ভোট।

আবদুস সাত্তারের মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ ওঠেছিল। তবে ১০ মাসের বেশি তিনি ক্ষমতায় থাকতে পারেননি। জিয়াউর রহমান যখন নিহত হন, তখন সেনাপ্রধান ছিলেন জেনারেল হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ।

সূত্রের বরাতে বিবিসি বাংলার এক খবরে বলা হয়, বিচারপতি আবদুস সাত্তার ক্ষমতায় আসার দুমাস পরেই তার সঙ্গে দেখা করে মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে ধরেন জেনারেল এরশাদ। তখন তিনি এই বার্তাও দেন—এভাবে দেশ চলতে পারে না। এরমধ্য দিয়ে ক্ষমতা দখলের পটভূমি তৈরি করেছিলেন এরশাদ।

এরশাদের ক্ষমতা দখল

১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ আবদুল সাত্তারকে হটিয়ে ক্ষমতা দখল করেন এরশাদ। এরপর দেশে রাজনীতি নিষিদ্ধ করে দ্বিতীয়বারের মতো সামরিক শাসন জারি করেন। নিজেকে সামরিক শাসক হিসেবে ঘোষণা করেন তিনি।

ক্ষমতা দখল করে তিনি একটি স্লোগানও চালু করেছিলেন। যা ছিল এমন—‘নতুন বাংলাদেশ, গড়ব মোরা...।’ নিজের স্লোগান নিয়ে তিনি একটি গানও লিখেছিলেন।

এরশাদের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবাদ করেন ছাত্ররা। ১৯৮২ সালের ১১ সেপ্টেম্বর শিক্ষা দিবসকে কেন্দ্র করে মজিদ খানের প্রস্তাবিত শিক্ষানীতি বাতিলের দাবি নিয়ে ছাত্র সংগঠনগুলো সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা শুরু করেছিল। সেই বছরের নভেম্বরে তৈরি হয়েছিল সব ছাত্র সংগঠনের ঐক্যবদ্ধ ফোরাম ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ।

পরের বছর ১৯৮৩ সালের ১৪ ও ১৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছাত্ররা সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে রাজপথে নামেন। তখন পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে অন্তত পাঁচজন নিহত হন। জেনারেল এরশাদের সামরিক শাসনে সেই প্রথম ঢাকার রাজপথে রক্ত ঝরেছিল।

এরমধ্য দিয়ে এরশাদের বিরুদ্ধে ধারাবাহিক আন্দোলন শুরু হয়। যা তার পতনের আগ পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। আন্দোলন দমনের পাশাপাশি রাজনীতিবিদ হওয়ার স্বপ্ন বাস্তবায়নে তৎপর ছিলে এরশাদ। এরপর ১৯৮৬ সালের শুরুতে বিভিন্ন দল থেকে মিজানুর রহমান চৌধুরী, শাহ আজিজ এবং মওদুদ আহমেদসহ রাজনীতিবিদদের নিয়ে জাতীয় পার্টি নামের দল গঠন করেন তিনি। সেই দল থেকে মনোনয়ন নিয়ে তিনি নির্বাচন দিয়ে প্রেসিডেন্ট হন।

রাজনীতিতে খালেদা জিয়া

জিয়াউর রহমানকে হত্যার সময় খালেদা জিয়া ছিলেন নিতান্তই একজন গৃহবধূ। দুই শিশু সন্তানকে নিয়ে ঢাকা সেনানিবাসে ছিলেন তিনি। রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি তখন বিপর্যস্ত ও দিশেহারা। জিয়াউর রহমান-পরবর্তী দলের হাল কে ধরবেন, তা নিয়েও চলতে থাকে আলোচনা। দ্বিধায় পড়ে যান বিএনপি নেতারা। দলের মধ্যে মারাত্মক কোন্দল চলছিল।

৭৮ বছর বয়সী বিচারপতি আবদুস সাত্তারকে বৃদ্ধ ও দুর্বল চিত্তের ব্যক্তি হিসেবে বিবেচনা করা হতো। রাজনৈতিকভাবে তিনি অদক্ষ হওয়ায় সামরিক বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও তাকে পছন্দ করতেন। তখন দলের একটি অংশ চেয়েছিল, নেতৃত্বের কাঠামো কাউন্সিলের মাধ্যমে ঠিক করা হোক। কিন্তু এ প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন প্রেসিডেন্ট আবদুস সাত্তার সরকারের থাকা নেতারা।

‘চলমান ইতিহাস: জীবনের কিছু সময় কিছু কথা’ বইয়ে মওদুদ আহমদ লিখেছেন, সামরিক এবং শাসকচক্রের সবচেয়ে বড় ভয় ছিল খালেদা জিয়াকে নিয়ে।

কারণ প্রেসিডেন্টপ্রার্থী হওয়ার জন্য খালেদা জিয়াই সবচেয়ে শক্তিশালী ব্যক্তি হতে পারতেন। যে কারণে তড়িঘড়ি করে প্রেসিডেন্ট পদের জন্য আবদুস সাত্তারের মনোনয়ন চূড়ান্ত করা হয়। জেনারেল এরশাদের চাওয়াও ছিল এমনটিই।

মওদুদ আহমদ লিখেছেন, খালেদা জিয়া যদি প্রতিদ্বন্দ্বী হতে চাইতেন, তাহলে অন্য কারও প্রার্থী হওয়ার তখন আর প্রশ্ন উঠতো না।

জিয়াউর রহমান যখন রাষ্ট্র ক্ষমতায় ছিলেন, তখন খালেদা জিয়াকে প্রকাশ্যে খুব একটা দেখা যেত না। যে কারণে খালেদা জিয়ার রাজনীতিতে আসার সিদ্ধান্ত অনেককেই চমকে দিয়েছিল।

আবদুস সাত্তারের বার্ধক্য ও দল পরিচালনা নিয়ে অসন্তোষের কারণে তখনকার বিএনপির একাংশ খালেদা জিয়াকে রাজনীতিতে আনার পরিকল্পনা করেন। কিন্তু রাজনীতিতে তার তেমন আগ্রহ ছিল না। এর পেছনে দুটি কারণ খুঁজে পেয়েছিলেন বিশ্লেষকেরা। প্রথমত, জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ড তার মনে গভীর দাগ কেটেছিল। তিনি মানসিকভাবে সে ধকল কাটিয়ে উঠতে পারছিলেন না।

দ্বিতীয়ত, খালেদা জিয়ার রাজনীতিতে আসার ব্যাপারে পরিবারের দিক থেকে তেমন কোনো উৎসাহ ছিল না। এছাড়া রাজনৈতিক ভাগ্য তাকে কোথায় টেনে নিয়ে যায়, সেটি নিয়েও খালেদা জিয়ার মনে চিন্তা ছিল হয়ত।

প্রয়াত সাংবাদিক মাহফুজউল্লাহ ২০১৯ সালে একটি সংবাদমাধ্যমকে বলেছিলেন, খালেদা জিয়াকে রাজনীতিতে আসার ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন কর্নেল (অব.) আকবর হোসেন, সাবেক সামরিক কর্মকর্তা নুরুল ইসলাম শিশু ও একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী। এছাড়া নজরুল ইসলাম খান এবং জমির উদ্দিন সরকারের ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ ছিল বলে উল্লেখ করেন মাহফুজউল্লাহ।

আকবর হোসেন পরবর্তীতে বিএনপি সরকারের মন্ত্রী হন। নুরুল ইসলাম শিশু ছিলেন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানে ঘনিষ্ঠ সহচর। একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী পরবর্তীতে বিএনপি সরকারের মন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতি হন।

১৯৯১ সালের নির্বাচন

জেনারেল এরশাদের পতনের পর ১৯৯১ সালের জাতীয় নির্বাচনে বিএনপি জয় লাভ করে। রাজনীতিতে যোগ দেয়ার ১০ বছরের মধ্যে তিনি দেশের প্রধানমন্ত্রী হন। এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় তাকে কয়েকবার আটক করা হয়েছিল। তবে তাকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। এ নির্বাচনে বিএনপিকে সমর্থন দিয়েছে স্বাধীনতাবিরোধী দল জামায়াতে ইসলামী। তখন তাদের মধ্যে একটি অলিখিত জোট হয়েছিল।

জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির জোটের আলোচনা হয়েছিল নির্বাচনের আগেই। জামায়াত সে সময় ১০০টি আসন চাইলে তাতে রাজি হননি খালেদা জিয়া। যে কারণে জোট আর হয়নি। পরে অঘোষিতভাবে ৩৫টি আসনে জামায়াতকে সমর্থন দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। বিনিময়ে তারাও দেশের বাকি আসনগুলোতে বিএনপির হয়ে কাজ করেছে।

২০১৮ সালের ২৯ জুলাইয়ে বিএনপিকে সেই কথাই স্মরণ করে দিয়েছিল জামায়াতে ইসলামী। নির্বাচনে জিততে বিএনপি নিজেই যথেষ্ট বলে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বক্তব্যে ক্ষোভ প্রকাশ করে এক বিবৃতিতে জামায়াতের নায়েবে আমির মিয়া গোলাম পরোয়ার বলেন, জোটের শীর্ষ নেতৃত্বের কেউ কেউ সম্প্রতি এমনও মন্তব্য করেছেন বলে পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে যে, কোন একটি দল একাই সরকার পরিবর্তন করে ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য যথেষ্ট, কারও সাহায্যের প্রয়োজন নেই।

এই জামায়াত নেতা বলেন, আর যদি তিনি এ ধরনের বক্তব্য দিয়ে থাকেন, তাহলে আমি তাদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে, ১৯৯১ সালে জামায়াত তার নিজ দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে ওঠে সমর্থন দিয়ে বিএনপিকে সরকার গঠনের সুযোগ করে দিয়েছিল। দেশ ও জাতির স্বার্থে এই ধরনের সমর্থন এবং উদারতা ইতিহাসে এক বিরল ঘটনা।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অপব্যবহার

তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা চালু হওয়ার শুরুতে বিএনপি বিরোধিতা করেছিল। কিন্তু এখন সেই ব্যবস্থা চালু করার দাবিতেই সরব রয়েছে দলটি। ১৯৯৪ সালের ২০ মার্চ মাগুরা-২ আসনের উপনির্বাচনকে কেন্দ্র করে প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি ওঠে। বিএনপি সরকারের আমলের ওই নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি ও জালিয়াতি হয়েছিল। ওই নির্বাচনের পর বিএনপি সরকারের অধীনে আর কোনো নির্বাচনে অংশ নেয়নি আওয়ামী লীগ।

বাংলাদেশের পার্লামেন্ট নির্বাচন নিয়ে অধিকাংশ সময়ই বিতর্ক দেখা গেছে। যে কারণে আন্দোলনের মুখে ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়।

২০০১ সালের ১ অক্টোবর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বিচারপতি লতিফুর রহমানের অধীন অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়। এতে ১৯৩টি আসন নিয়ে বিএনপি ক্ষমতায় আসে। কিন্তু এই তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রশ্নবিদ্ধ ছিল। তখনকার কয়েকজন উপদেষ্টার ভূমিকাও ছিল পক্ষপাতমূলক। তাদের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের বিপক্ষে কাজ করার অভিযোগ রয়েছে। লতিফুর রহমানের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ভূমিকা নিয়ে সংবাদমাধ্যমে বেশ সমালোচনাও হয়েছিল।

এরপর ২০০৬ সালের ২৭ অক্টোবর বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের মেয়াদ শেষ হলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দায়িত্ব নেয়ার কথা। সংবিধান অনুযায়ী সর্বশেষ বিদায়ী প্রধান বিচারপতির তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হওয়ার রীতি ছিল। কে এম হাসান সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি ছিলেন। তিনি হাইকোর্টের বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার আগে বিএনপি নেতা ছিলেন। আর নিজেদের পছন্দের প্রধান বিচারপতিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে পেতে সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতিদের অবসরের বয়সসীমা বাড়িয়ে সংবিধানে একটি বড় সংশোধনী আনে বিএনপি। তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে নিজেদের কবজায় রেখে নির্বাচনে সুবিধা আদায় করাই ছিল তাদের উদ্দেশ্য।

অর্থাৎ কে এম হাসান যেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হতে পারেন, সেই চিন্তা মাথায় রেখেই বিচারপতিদের বয়স বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু তাকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে মেনে নিতে নারাজ ছিল আওয়ামী লীগ। তাদের আন্দোলন অব্যাহত থাকে। কোনো সমঝোতা না-হওয়ায় রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন ২০০৬ সালের ২৯ অক্টোবর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নেন। তিনি ১০ জন উপদেষ্টা নিয়োগ দেন।

আওয়ামী লীগ ইয়াজউদ্দিনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারকেও মেনে না নিয়ে আন্দোলন অব্যাহত রাখে। এতে তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার পদ থেকে ইস্তফা দেন। ফখরুদ্দীনকে প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ করা হয়। ২০০৭ সালের ১২ জানুয়ারি ফখরুদ্দীন শপথ নেন। তিনি ১০ জন উপদেষ্টা নিয়োগ দেন। সেনাসমর্থিত এই তত্ত্বাবধায়ক সরকার দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আনতে ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর ঘোষণা দিয়ে কার্যক্রম শুরু করে।

সংবাদমাধ্যমে দেয়া সাক্ষাৎকারে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ড. হারুন-অর-রশিদ বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিএনপিই নষ্ট করেছে। পছন্দের বিচারপতিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান করতে বিচারপতিদের বয়স বাড়িয়ে দিয়েছিল।

১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন

বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর বর্জনের মুখে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়েছে। বিরোধী দলগুলোর দাবি উপেক্ষা করে সংঘাত ও সহিংসতার ভেতর দিয়ে একতরফা নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যায় তখনকার বিএনপি সরকার।

এটি কেবল একতরফাই ছিল না, বেশ সহিংসও ছিল। ১৯৯৬ সালে মার্কিন দৈনিক নিউইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, নির্বাচনের আগের দিন বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় সহিংসতায় অন্তত ১২ জন নিহত হয়েছেন। বাংলাদেশের পাঁচ কোটি ভোটারের মধ্যে বেশিরভাগই ভোট দেননি। নির্বাচনে ভোট দেয়ার হার ১০ শতাংশের কম হতে পারে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী না-থাকায় ৪৮টি আসনে ভোট গ্রহণের আগেই ক্ষমতাসীন বিএনপির প্রার্থীরা বিনাভোটে নির্বাচিত হয়ে যান।

বিতর্কিত সেই নির্বাচনে ৩০০টি আসনের মধ্যে বিএনপি পেয়েছিল ২৮৯টি। ওই সংসদে আনুষ্ঠানিক কোনো বিরোধীদল ছিল না, কিন্ত একটি আসন পেয়ে বিরোধী নেতার চেয়ারে বসেছিল শেখ মুজিবুর রহমানের স্বঘোষিত হত্যাকারীদের অন্যতম ফ্রিডম পার্টির সৈয়দ ফারুক রহমান। বাকি ১০টি আসন পান স্বতন্ত্র প্রার্থীরা।

ক্ষমতার বাইরে বিএনপি

বিবিসি বাংলার খবরে বলা হয়, ২০০৮ সালের গোড়া থেকেই সন্দেহ হতে থাকে বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেবে কিনা। কারণ নির্বাচনে অংশ নেয়ার বিষয়ে আপত্তি ছিল খালেদা জিয়ার। দুই ছেলে তারেক রহমান ও আরাফাত রহমানের মুক্তি ও বিদেশে চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে চেয়েছিলেন তিনি। ‘বাংলাদেশ: ইমার্জেন্সি অ্যান্ড দ্যা আফটারম্যাথ (২০০৭-২০০৮)’ বইতে মওদুদ আহমদ অনুমান করেছেন যে ছেলেদের মুক্তি এবং বিদেশ পাঠানোর বিনিময়ে খালেদা জিয়া হয়তো নির্বাচনে অংশগ্রহণের শর্ত মেনে নিয়েছিলেন।

২০০৮ সালের নভেম্বরের শেষের দিকে বিএনপি নিশ্চিত করে যে তারা নির্বাচনে অংশ নেবে। এরআগে নির্বাচনের তারিখ নিয়ে বিএনপির সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের মতপার্থক্য তৈরি হয়েছিল। বার্তা সংস্থা রয়টার্স তখন এক প্রতিবেদনে জানিয়েছিল, খালেদা জিয়ার দাবির প্রেক্ষিতে নির্বাচন ১১ দিন পিছিয়ে ২৯শে ডিসেম্বর নির্ধারণ করা হয়।

নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পেয়েছিল ২৩০টি আসন। বিএনপি পেয়েছিল মাত্র ৩০টি। শুধু তাই নয়, প্রাপ্ত ভোটের হারের ক্ষেত্রে বিশাল ফারাক ছিল। আওয়ামী লীগ পেয়েছিল ৪৮ দশমিক ১৩ শতাংশ ভোট এবং বিএনপি পেয়েছিল ৩২ দশমিক ৪৯ শতাংশ।

সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন তার বইতে লিখেছেন, ‘আমরা এমন রেজাল্ট আশা করিনি। আমাদের প্রাথমিক ধারণা ছিল যে মহাজোটের সাথে চারদলীয় জোটের তফাতটা হয়তো ৪০ থেকে ৫০টি আসনের হতে পারে। এরপর থেকে গেল ১৫ বছর ধরে ক্ষমতার বাইরে রয়েছে বিএনপি।

মওদুদ আহমদ তার বইয়ে লিখেছেন, বিএনপি সরকারের অপশাসন, বিএনপির নেতাদের বিরুদ্ধে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ, যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত জামায়াতের সঙ্গে মিত্রতা, বিএনপির সরকারের কিছু মন্ত্রীর সম্পৃক্ততায় জঙ্গিবাদের উত্থান, প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের সদস্যদের নামে হাওয়া ভবনের ক্ষমতা, প্রভাব ও দুর্নীতি এবং ২০০৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের বিতর্কটি সমাধানে ব্যর্থ হয়ে ইয়াজউদ্দিন আহমেদকে দায়িত্ব দেয়ায় বিএনপির কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন ভোটাররা।

নেতৃত্বের সংকট

সরকারবিরোধী সব দলকে একটি পাটাতনে নিয়ে এসে একজন নেতার নেতৃত্বে সারাদেশে আন্দোলন গড়ে তোলা, খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতে এমন ভাবমর্যাদার নেতা এই মুহূর্তে বিএনপিতে নেই। সংবাদমাধ্যমে দলটির ভাইস চেয়ারম্যান অবসরপ্রাপ্ত মেজর হাফিজ উদ্দিন আহমেদ বলেছেন, বিএনপি যদি এখন থেকে এক মঞ্চে আন্দোলন শুরু করে, তবে নেতৃত্ব হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে।

এর ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতে বিএনপিতে সারাদেশে গ্রহণযোগ্য নেতৃত্ব নেই বলে অনেকে মনে করেন। ২০১৮ সালের নির্বাচনে ড. কামাল হোসেনকে নেতৃত্বে নিয়ে বিএনপি যে লক্ষ্যে এগিয়েছিল, তাতে দলটির ক্ষতি হয়েছে বলে তিনি জানান।

তারেক রহমান ও হাওয়া ভবন

তারেক রহমান ও হাওয়া ভবন

খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতে দলের শীর্ষ নেতার আসনে তারেক রহমান। কিন্তু দলে তার নেতৃত্ব শক্ত হতে সময় লেগেছে। তারেক রহমানের একক সিদ্ধান্ত ও কর্তৃত্ব নিয়ে দলের মধ্যে আপত্তির কথা শোনা গেছে।

এমনকি বিদেশি একাধিক মহলেও তাকে নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে বলে আলোচনা আছে। দেশি-বিদেশি মহলের কাছে গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করতে পারেননি তারেক রহমান। ক্ষমতার রাজনীতির জন্য যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ নিয়ে দলটির নেতাকর্মীদের মধ্যেও হতাশা রয়েছে।

বিএনপির রাজনীতির একটি বড় ক্ষত হিসেবে বিবেচনা করা হয় হাওয়া ভবনকে। দলটির নেতাকর্মীরাও মনে করেন, এই ভবন তাদের অনেক অর্জনকে মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছে।

২০০১ সালে বিএনপি সরকার গঠন করলে তারেক রহমান ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসে। হাওয়া ভবন থেকে নেপথ্যে সরকারি কর্মকাণ্ডে নগ্নভাবে হস্তক্ষেপ শুরু করে তারেক রহমান। এই ভবন ঘিরে ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট তৈরি হয়। এভাবে তারা শত শত কোটি টাকার দুর্নীতির আখড়া খুলে বসে।
 

Comments

Popular posts from this blog

ভাড়াটিয়া-ভাড়াদার আইনের জটিলতা পার হওয়া: ভাড়াটিয়াদের জন্য একটি গাইড

একটি ভিত্তিহীন গুজব উড়িয়ে দেওয়া: বাংলাদেশী সাংবাদিকদের ফ্রেঞ্চ ভিসা প্রত্যাখ্যান করা হয়নি৷

অধ্যায় 2: বাংলায় ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন