ছোটবেলা থেকেই শুনে আসছি, শায়েস্তা খাঁর আমলে নাকি এক টাকায় আট মণ চাল পাওয়া যেত। আমার ব্যক্তিগত বিশ্লেষণ


আমার এই বিশ্লেষণ অনেকের কাছে বিষলেখন বলে মনে হবে।

শায়েস্তা খান ছিলেন চরম বেয়াদব খুনী আওরংযেব এর মামা। আওরংযেব নিজের বড় দুই ভাই দারা ও সুজাকে, আর ছোটভাই মুরাদকে খুন করেন বা করান, এবং নিজের বাবা ও বোনকে জেলে ভরেন। তিনি নিজের ছেলে আজিমকেও খুন করান (শায়েস্তার দুই টার্মের মাঝখানে আজিম কিছুদিন ঢাকায় সুবেদার (গভর্নর) হয়েছিলেন)। সম্রাট হবার কোনো অধিকার তার ছিলোনা। শাহজাহান বেঁচে থাকতে তো প্রশ্নই উঠে না। কিন্তু শাহজাহান মারা গেলেও উত্তরাধিকারী হতেন সুশাসক দারাশিকো, তাঁর পরে সুশাসক সুজা। আওরংযেব সম্পূর্ণ অনৈতিকভাবে পিতাকে বন্দি করে বড় ভাই, ছোট ভাইকে খুন করে সিংহাসন দখল করেন। তাঁর এই সব কুকর্মের সাথী ছিলেন তার দুষ্ট মামা শায়েস্তা খান।

শায়েস্তা ছিলেন প্রজা-নিপীড়ক চরম কৃপণ। সেকালে সমস্ত জমির মালিক ছিলেন রাষ্ট্র তথা রাজা। ৯৯% ভাগের বেশি লোক ছিল কৃষক। মাত্র গুটিকয় লোক পেশাদার সেনা বা পুলিশ হিসাবে কাজ করতেন, আর ছিল গুটিকয়েক পেশাদার কারিগর।

এখন খাজানা দিতে হত টাকায়। শায়েস্তার শয়তানি বুদ্ধি হল টাকার পরিমাণ সমান রেখে খাজনার প্রকৃত পরিমাণ বাড়ানো। ১৬৫০ সালে ১ টাকায় ২ মণ চাউল মিলত। মনে রাখবেন ৯৯% লোক চাউল বেচত, মাত্র ১% লোক চাউল কিনত। ১৬৮৪ সালে ১ টাকায় আট মণ চাউল মানে হল শায়েস্তাকে খাজানা দিতে আগে যেখানে ২ মণ চাউল দিলেই হত, এখন সেখানে ৮ মণ দিতে হচ্ছে। কিছুতেই ভুলে যাবেন না যে ৯৯% লোক চাউল বেচে, আর চাউলের দাম কমলে ৯৯% এর সর্বনাশ হয়।

সেকালে কাগজের টাকা ছিলোনা। শায়েস্তা মারা যাবার দেড়শ বছর পরে অল্পসল্প করে কাগজের টাকা চালু হয়। ১৭৯৩ সালে ইংরজেরা জমির মালিকানা প্রাইভেট করে দেয়। শায়েস্তার আমলে কোনো বেসরকারি জমি কিছু ছিলোনা, আর ভূমিহীন কেউ ছিলোনা। বাঙ্গালদেশ এখন যে অঞ্চল নিয়ে, সেখানে কিছুতেই তখন ৭০ লাখের বেশি মানুষ ছিলোনা। বর্তমান বাংলাদেশ অঞ্চলের চেয়ে অনেক বড় অঞ্চল নিয়ে শায়েস্তার সুবা (প্রদেশ)। বাংলাদেশের বর্তমান অঞ্চলে শায়েস্তার সময় মোটে ১৪ লাখ টন খাবারাহত, লোকসংখ্যা ছিল ৭০ লাখ মাত্র। আপনি ১০০০ পার্সেন্ট নিশ্চিত থাকতে পারেন যে সাধারণ লোক লতাপাতার ছনের ঘরে থাকত, আর লেংটি ছাড়া তাদের পরনে কোন কাপড় ছিলোনা। রাজাবাদশারা টাকাপয়সা খরচ করলে লোকজনের হাতে সেটা গিয়ে পড়ত। শায়েস্তা ছিলেন মহা কৃপণ। বাংলাদেশ ছাড়ার সময় সাত কোটি রুপি নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। তার মানে জানেন? একজন চাষীর এক বছরের আয় ছিলো এক টাকার কম। ৭০ লাখ লোকের কাছ থেকে ৭ কোটি টাকা নিতে গেলে মাথা পিছু ১০ টাকা নিতে হয়েছে বাইশ বছরে লোকে যা আয় করেছে, তার দশ বছরের ইনকাম শায়েস্তা বাবাজি নিয়ে গেছেন কেড়ে।

ঢাকার কি কচুর সমৃদ্ধি হয়েছে উনার আমলে? লবন বানানো হতো সরকারি জমিতে (সব জমি ছিলো সরকারি), আর লবণ বেচতেন শায়েস্তা টাকার বিনিময়ে। লবণ বিক্রির পয়সা সব সিন্দুকে ভরে রাখলে লোকে কি কলাপাতা দিয়ে কেনাবেচা করবে নাকি? দেশে মুদ্রা নাই, কারণ সব গিয়ে ঢুকেছে শায়েস্তার লুটের সিন্দুকে। টাকার অভাব এত তীব্র, দুই মণের জায়গায় আট মণ দিয়েও একটা টাকা পাওয়া যাচ্ছিলো না।

মানুষ যে কত অবিচার করতে তার একটা নজির এইটা।

নিজের বুকে হাত দিয়ে বলুনঃ

১। আপনি কি আগে এটা ভেবেছিলেন যে যদি ৯৯% লোকেই চাউল বেচে আর চালের দাম মণ প্রতি অট আনা থেকে কমে দুই আনা হয়ে যায়, তাতে জনগণের কতজনের মঙ্গল হয়?

২। আপনি কি এইটা আসলেই ভেবেছিলেন যে শায়েস্তা লবণ বিক্রির সব খুচরা পয়সা সিন্দুকে ভরে ফেলায় বাজারে মুদ্রার অভাবে টাকার দাম বেড়ে যায়, তাতে উৎপাদনের সমৃদ্ধির কোনো সম্পর্ক নাই? আপনি কি দেখেছিলেন যে কোভিড এর কারণেলোক লকডাউনে চলে যাওয়ায় মুরগির দাম ১৫০ থেকে কমে শুধু ৫০ টাকায় নেমে এসেছিল? সেটা কি উন্নতির লক্ষণ ছিলো? রুজি-রোজগার নাই, ৫০ টাকা কেজিতে দিলেও লোকে মুরগি কিনতে পারছেনা, এটা মনে আসে না? কী পরিমাণ অবিচার করলে ১৫০ টাকা কেজির মুরগি ৫০ টাকায় বিক্রি হওয়াকে উন্নতির স্বর্ণযুগ বলা যাবে?

৩। শায়েস্তা এতো কৃপণ ছিলেন যে তিনি মাত্র ২ টাকা পিস ৫০০ বান্দী কিনেছিলান (হ্যাঁ, জ্বি হ্যাঁ, তাঁর যুগে দাসপ্রথা খুব সবলভাবে চালু ছিল, আর ঢাকায় ২ টাকায় তরুণী কিনাবেচা হত)। তিনি যদি আরো বেশি মেয়ে কিনতেন, দেশে গরিব আরো কিছু মেয়ে অন্তত দুবেলা পেট ভরে ভাত খেতে পেত। নিজের মেয়ের পরীবিবির জন্য একখানা কবর বানানো ছাড়া আর কী রাজকর্ম করেছেন তিনি? খুব বেশি কিছু না।

৪। ভেবে দেখেবেন যে রাজারা যদি টাকা খরচ করেন, তাঁর দ্বারা কর্মসংস্থান তৈরি হয়, তিনি যদি ৫০ হাজার ঘোড়া পালতেন, আর ২০ হাজার হাতী, তাহলে এক লাখ লোক লাগতো ওদের পালনে। সে সামর্থ্য তাঁর ছিলো, কিন্তু তিনি কি সহিস আর মাহুতের চাকরি দিয়েছিলেন কাউকে? তিনি কি ঢাকায় বাগান বাড়ী বানিয়ে তাতে ৩০০০০ মালির চাকরি দিয়েছিলেন? কিচ্ছু না কিচ্ছু না। লোকে রাজাকে খাজানা দেয়, আবার রাজার নানা কাজ করে রাজার কাছ থেকেই টাকা পায়। শায়েস্তা কেবল নিয়েছেন, দেন নি। ভেবে দেখুন, বাংলাদেশ সরকার যদি বছরে ২ লাখ কোটি টাকা কর হিসাব জনগণের কাছ থেকে কেড়ে নেন, তারপর বাজেট করে মাত্র ২০ হাজার কোটি টাকা খরচ করেন, তাহলে কী হবে? তাহলে দেখবেন আর্মি আর পুলিশের চাকরি মাত্র কয়েকজনের আছে, শিক্ষক বলতে হাতে গোনা কয়জন, আদালতে পেশকার মুহুরি পিয়ন আরদালি কেউ নাই, এমনকি হাকিম পর্যন্ত নাই। সরকার রাস্তাঘাট কি বানাবে অই টাকা দিয়ে? সরকারী টাকায় দালান কোঠা রাস্তাঘাট কিচ্ছু হবেনা, দেখবেন সব জিনিসের দাম কমে গেছে, উৎপাদন কমে প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। শুনুনঃ প্রনোদনার টাকা সরকার যদি খরচ করে, তবেই না সেঈ টাকা পাবলিকের হাতে আসবে। সরকার খরচ না করলে সেই টাকা আসবে কোথা থেকে?

৫। শুধুমাত্র দাম দিয়ে সমৃদ্ধির বিচার যে করে সে কত বড় পন্ডিত ভেবে দেখুন। আয়ের কথা ভাবতে হবে না? একজন চাষী যদি বছরে এক টাকা বেতন পায়, তাহলে কি এক টাকায় আট মণ চাউল খুব বেশি? (মনে রাখবেন, ১৭৯৩ সালের আগে জমির কোনো ব্যক্তি মালিক ছিলো না, ফলে টাকার বিনিময়ে পরের জমিতে কাজ করার কোন সুযোগ ছিলো না। সবাই নিজের জমিতে কাজ করেছে, আর নিজের জমি মানে সরকার থেকে বিনা পয়সায় পাওয়া জমি (যার জন্য অবশ্যই খাজানা দিতে হয়েছে)।

Comments

Popular posts from this blog

ভাড়াটিয়া-ভাড়াদার আইনের জটিলতা পার হওয়া: ভাড়াটিয়াদের জন্য একটি গাইড

একটি ভিত্তিহীন গুজব উড়িয়ে দেওয়া: বাংলাদেশী সাংবাদিকদের ফ্রেঞ্চ ভিসা প্রত্যাখ্যান করা হয়নি৷

অধ্যায় 2: বাংলায় ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন