প্রযুক্তির দিক দিয়ে পৃথিবী এখন তার শ্রেষ্ঠ সময় অতিবাহিত করছে। অতীতের তুলনায় আজ আমরা অনেক আধুনিক এবং উন্নত। পৃথিবীতে এখন যা কিছু আবিষ্কার হচ্ছে ও হয়েছে তার সূত্রপাত ঘটেছে অনেক অনেক আগে।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, পৃথিবীতে যা কিছু আবিষ্কার হবার তা অনেক আগেই হয়ে গেছে। বিশেষজ্ঞদের এই মতামত একেবারেই হেয় করার মতো নয়। কারণ পৃথিবীতে প্রাচীন এমন কিছু নিদর্শন পাওয়া যায়, যা প্রমাণ করে একবিংশ শতাব্দীতে এসে পৃথিবী আধুনিক হয়নি। বরং পৃথিবীতে আধুনিকতা ছিলো বহু আগে থেকেই। আজ আমি প্রাচীনকালে আবিষ্কৃত কিছু প্রযুক্তি সম্পর্কে এখানে সংক্ষিপ্ত একটি আলোচনা করবো। তো চলুন শুরু করা যাকঃ

১. দ্য বাগদাদ ব্যাটারিঃ ব্যাটারিকে আধুনিক যুগের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি আবিষ্কার হিসেবে মনে করা হলেও আসল ঘটনাটি কিন্তু একেবারেই ভিন্ন। বিজ্ঞানীদের মতে, প্রথম ব্যাটারি আবিষ্কার হয় ইরাকে। তাও খৃষ্টপূর্ব ২৫০ বছর আগে। যার নাম দেয়া হয় ‘বাগদাদ ব্যাটারি’। ১৯৩৮ সালে বাগদাদ সংলগ্ন খুজুত রাবু এলাকায় প্রথম ওই ‘বাগদাদ ব্যাটারি’র সন্ধান পাওয়া যায়।

বাগদাদ ব্যাটারি কাদামাটি দিয়ে তৈরি একটি জাগের মতো দেখতে হলেও তা আসলে লোহার দণ্ড দিয়ে তৈরি। দণ্ডটির চারপাশ কপার সিলিন্ডার দিয়ে বেষ্টিত। গবেষণা অনুযায়ী লোহার দণ্ডটি যখন ভিনেগার অথবা ইলেকট্রিক তরল দ্বারা পরিপূর্ণ থাকে তখন প্রায় ০.৮-২ ভোল্ট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে সক্ষম হয়।

কাজের দিক দিয়ে বাগদাদ ব্যাটারি এবং বর্তমান যুগে ব্যবহৃত ব্যাটারির মধ্যে খুব বেশি পার্থক্য নেই। তবে ওই ভোল্টের ব্যাটারি দিয়ে ঠিক কোন কাজ করা হতো সে বিষয় সঠিক কোনো তথ্য জানা যায়নি। তবে ধারণা করা হয় বাগদাদ ব্যাটারি তাড়িতলেপন (ইলেকট্রোপ্লেটিং) এর কাজে ব্যবহার করা হতো।

২. চীনা ভূমিকম্প শনাক্তকরণ যন্ত্রঃ ১৮৪১ সালে স্কটিশ পদার্থবিদ আধুনিক ভূকম্পলিক যন্ত্র আবিষ্কার করেন। কিন্তু এর পরেও তিনি প্রথম আবিষ্কারক হিসেবে খ্যাতি লাভ করতে পারেননি। কারণ চীন এরো আগে প্রায় ১৩২ খৃষ্টাব্দেই একটি যন্ত্র আবিষ্কার করে যা ভূমিকম্প শনাক্ত করতে পারে। হ্যান রাজবংশের জ্যাং চেং প্রথম ভূমিকম্প শনাক্তকরণ যন্ত্রটি আবিষ্কার করেন। চীনা সভ্যতার মতে, ভূমিকম্প হলো স্বর্গ হতে প্রেরিত বার্তা। যা পৃথিবীর যেকোনো জায়গা থেকে শনাক্ত করা সম্ভব।

ভূমিকম্প শনাক্তকরণ যন্ত্রটি বৃহৎ আকারের ব্রোঞ্জের পাত্রের মতো। যার ব্যাস প্রায় ছয় ফুট। পাত্রটির প্রধান দিকে আটটি ড্রাগন রয়েছে। প্রতিটি ড্রাগনেরই মুখ খোলা। এই যন্ত্রটি ঠিক কিভাবে ব্যবহৃত হতো সেই ব্যাপারে সঠিক কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। কিন্তু সত্যি যদি যন্ত্রটি ভূমিকম্প শনাক্ত করতে সক্ষম হতো; তাহলে এখনো কেন এর পরিপূর্ণ কোনো ব্যবহার মানবসভ্যতায় আসেনি-তা বেশ রহস্যজনক।

৩. ন্যানোটেকনোলোজিঃ বর্তমান সময় ন্যানোটেকনোলোজি হলো সবচেয়ে আধুনিক প্রযুক্তির মধ্যে একটি। কিন্তু যদি বলা হয়, যে প্রযুক্তিকে বিশ্ব বর্তমানে অত্যাধুনিক বলছে; তা আসলে ১ হাজার ৬শ’ বছর আগেই ব্যবহার করা হয়েছে তাহলে?

১৯৫০ সালে ব্রিটিশ মিউজিয়াম একটি ‘লাইকারগেস কাপ’ এর সন্ধান পায়। কিন্তু সেই সময় এর কার্যকারিতার ব্যাপারে কেউ অবগত ছিলো না। পাত্রটি বিশেষত্ব হলো এটি নিজের রং বদলাতে পারে। পাত্রটিকে ঘোরালে লাল-সবুজ রংয়ে পরিবর্তিত হয়।

১৯৯০ সাল পর্যন্ত পাত্রের রং বদলানোর রহস্য সবার কাছেই অজানা ছিলো। কালক্রমে প্রযুক্তি আরো উন্নত হয়েছে। পাত্রের একটি ভাঙ্গা কাঁচের টুকরা মাইক্রোসকোপিক স্কেলের নিচে নেয়া হয়। এরপর রং পরিবর্তনের রহস্যের উদঘাটন হয়।

সোনা এবং রূপার ছোট ছোট টুকরো (প্রায় ৫০ ন্যানোমিটার) দিয়ে মূলত পাত্রটি তৈরি করা হয়েছে। পাত্রটি শুধু রং পরিবর্তন করতেই সক্ষম ছিলো না। পাত্রটিতে যে রংয়ের পানীয় ঢালা হতো, পাত্রটি সেই রংয়ে পরিবর্তন হওয়ার ক্ষমতা রাখতো। যা ছিলো সময়ের চেয়েও আধুনিক।

৪. দ্যা নিমরুদ লেন্স: নিমরুদ লেন্সের সঠিক ব্যবহার সম্পর্কে এখনো নির্দিষ্ট কোনো ধারণা পাওয়া যায়নি। নিমরুদ লেন্সটি মূলত ছোট আকৃতির একটি লেন্স যা প্রাকৃতিক স্ফটিকের (ন্যাচারাল ক্রিস্টাল) তৈরি। প্রায় তিন হাজার বছর আগে তৈরি নিমরুদ লেন্স একটি ডিস্ক তৈরির কাজে ব্যবহৃত হয়। যা প্রায় তিনগুণ বড় অপটিক্যাল লেন্সের সমান।

হস্তনির্মিত বস্তু নিমরুদ লেন্সটি খৃষ্টপূর্ব ৭৫০ বছর আগেই আবিষ্কার হয় বলে ধারণা করা যায়। অনেকেই মনে করেন এই লেন্সটি ম্যাগনিফাইং গ্লাস হিসেবে ব্যবহার করা হতো। আবার অনেকেই মনে করেন এটি প্রাচীন দূরবীন হিসেবে ব্যবহৃত হতো।

৫. অ্যান্টিকিথিরা মেকানিজমঃ বর্তমান যুগে আপনি যে কোনো গন্তব্য স্থানে পৌঁছারোর জন্য জিপিএসের ব্যবহার করে থাকেন। কিন্তু একটি সময় ছিলো যখন এই সব প্রযুক্তির কোনো ব্যবহার ছিলো না। প্রাচীন নাবিকেরা চাঁদ, তারা, সূর্য দেখে সব হিসাবনিকাশ করেই পথ নির্ধারণ করতো। কিন্তু অ্যান্টিকিথিরা মেকানিজম আবিষ্কার হওয়ার পর ঘটনা যেনো পাল্টে গেলো।

অ্যান্টিকিথিরা মেকানিজম অবিশ্বাস্যভাবে জটিল এবং অত্যাধুনিক একটি মেশিন। এই মেশিনটি নাক্ষত্রিক চলাফেরা শনাক্ত করতে সক্ষম ছিলো। প্রায় ১ হাজার বছর পূর্বে এই মেশিনটি আবিষ্কার করা হয়। যা দেখতে অনেকটা ঘড়ির মতো। এই মেশিনটি চাঁদ, সূর্যের গতিবিধি শনাক্ত করতে পারতো বলে জানা যায়। অ্যান্টিকিথিরা মেকানিজম মেশিনটির সন্ধান প্রথম গ্রিসের রোডস দ্বীপে পাওয়া যায়। এই আবিষ্কারটি ছিলো মূলত সেই সময়ের জন্য মাইলফলক।

৬. প্লাস্টিক সার্জারিঃ প্রায় ৮০০ খ্রিষ্টপূর্বে প্রাচীন ভারতে গাল ও কপালের চামড়া দিয়ে নাকের আঁকার প্রদান করা হতো যা বর্তমানের আধুনিক যুগের প্লাস্টিক সার্জারির মতোই। আধুনিক যুগে প্রথম প্লাস্টিক সার্জারি এর ব্যবহার দেখা যায় ১৯১৭ সালে বিশ্বযুদ্ধের আহত সৈনিক এর মুখের আঘাতের চিকিৎসায়। কিন্তু আমরা দেখতে পারছি প্লাস্টিক সার্জারি এর ব্যবহার ছিলো সেই প্রাচীন কাল থেকেই, এটি খুব সাম্প্রতিক কোনো আবিষ্কার বা প্রযুক্তি নয়।

৭. ফ্লেইমথ্রোয়ারঃ আপনারা অনেকেই ফ্লেইমথ্রোয়ার বা অগ্নি-বর্ষক যন্ত্র দেখে থাকতে পারেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সিনেমা গুলোতে। কিন্তু এই ফ্লেইমথ্রোয়ার এর ব্যবহার ছিলো ৪২৪ খ্রিস্টপূর্বে! ডেলিয়ামের যুদ্ধে গ্রীকরা এই প্রযুক্তি ব্যবহার করেছিলো। কি অবাক হচ্ছেন? হবারই কথা! তারা যুদ্ধ জাহাজের এক কোণায় কপার টিউব রাখতো যার ভেতরে থাকতো দাহ্য তরল পদার্থের মিশ্রণ।

এগুলোর টিউবের মুখ দিয়ে আগুন ছোঁড়া হতো শত্রুর জাহাজে। টিউবগুলো ছিলো আকারে অনেক বড় এবং বহন করা কষ্টসাধ্য ছিলো। কি উপাদান ব্যবহার করতো তা অজানা ছিলো অন্যান্য জাতি গুলোর কাছে এর ফলে কালের বিবর্তনে এই প্রযুক্তিটি হারিয়ে যায়। ১৯ শতকে জার্মানিতে ফ্লেইমথ্রোয়ার আবারো আবিষ্কৃত হয় যুদ্ধে মানুষকে হত্যা করার জন্য এবং এগুলো ছিলো আকারে ছোট ও বহনযোগ্য।

৮. ঘড়িঃ সকালের মিষ্টি ঘুম ভাঙ্গার জন্য একটি অ্যালার্ম ঘড়িই যথেষ্ট। শুনলে অবাক হবেন খ্রিষ্টপূর্ব ৪০০ তে গ্রীক দার্শনিক প্লেটো “ওয়াটার ক্লক” ব্যবহার করতো যা তাকে তার লেকচার দেয়ার সময়কে স্মরণ করিয়ে দিতে সাহায্য করতো। এর পরবর্তীতে এই পানির শক্তির সাহায্যে চালিত ঘড়িগুলো রোম এবং মধ্যপ্রাচ্যে আবিষ্কৃত হয়।

মধ্যপ্রাচ্যের উসমানীয় সাম্রাজ্যে নামাযের সময় মনে করিয়ে দেয়ার জন্য এই পানি শক্তি চালিত ঘড়ি ব্যবহার করা হতো। চীনে ৮ম শতাব্দীতে যান্ত্রিক ঘড়ির প্রচলন শুরু হয় যা ইউরোপে ১৪ শতাব্দীতে পুনরায় প্রচলিত হয়। এই যান্ত্রিক ঘড়ি গুলোকে বলা হয় স্ট্রাইকিং ঘড়ি(striking clock)। ইউরোপে ক্লক টাওয়ার এর প্রচলন দেখা যায় এবং ১৫ শতকে এসে এই ঘড়ি গুলো মানুষের ব্যক্তিগত ব্যবহারে ব্যবহৃত হওয়া শুরু করে।

৯. পানি ও পয় নিষ্কাশনঃ আধুনিক শহরের কথা বললে উন্নতমানের পয় নিষ্কাশন ব্যবস্থা, পাবলিক টয়লেটের ব্যবস্থার কথা চলে আসবে। ১৯ শতকের মাঝামাঝিতে ইউরোপে এই নিষ্কাশন ব্যবস্থা চালু হয়। কিন্তু জেনে অবাক হবেন, বহু প্রাচীন সভ্যতায় এই নিষ্কাশন ব্যবস্থার দেখা মেলে।

খ্রিষ্টপূর্ব ২৬০০ এর ইন্দাস ভেলীর মহেঞ্জোদারোতে পাবলিক টয়লেট এবং আধুনিক মানের নিষ্কাশন ব্যবস্থা ছিলো। ব্যাবীলন, প্রাচীন চীন, রোমে এরূপ পাবলিক টয়লেট এবং পয় নিষ্কাশন ব্যবস্থা দেখা যায়। এমনকি বাংলাদেশের প্রাচীন সভ্যতা কুমিল্লার ময়নামতি এবং নওগাঁর পাহাড়পুরেও প্রত্নতাত্ত্বিকরা পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা আবিষ্কার করেছেন! তাই দেখতেই পারছেন পানি ও পয় নিষ্কাশন ব্যবস্থা আধুনিক মনে হলেও এর ব্যবহার কত আগে থেকেই হচ্ছে।

১০. স্বয়ংক্রিয় দরজাঃ বর্তমানে এই দরজা ঢাকার অনেক শপিংমলে দেখা যায়। দরজার সামনে উপস্থিত হওয়া মাত্রই নিজে নিজে দরজা খুলে যায় আবার দরজা দিয়ে প্রবেশ করা হয়ে গেলে দরজা বন্ধ হয়ে যায় নিজে নিজে। ১৯৫৪ সালে আমেরিকায় প্রথম সস্বয়ংক্রিয় দরজার আবিষ্কার হয়।

এবার আসুন দেখি প্রাচীন আমলের স্বয়ংক্রিয় দরজার তথ্য, ৫০ বিসিতে কিং আলেকজান্ডার এই ধরনের স্বয়ংক্রিয় দরজা প্রস্তুত করান। সাধারনত মন্দির বা গুরুত্বপুর্ন ভবন সমুহে প্রবেশ করার জন্য এই দরজা প্রস্তুত করা হতো । পানির চাপ ও লোহার চেইন, ভারী পাথর ইত্যাদি ব্যবহার করা হতো , আর দরজার সামনে এক পাপোস ধরনের পাথরের টুকরোকে সেন্সর হিসেবে ব্যবহার করা হতো। এটার উপর মানুষ এসে দাড়ালেই যন্ত্র তার কাজ করা শুরু করে দিতো।

বিভিন্ন ওয়েবসাইট থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে লিখিত। আশাকরি আপনার ভাল লেগেছে। কোনো ত্রুটি পরিলক্ষিত হলে দয়াকরে জানাবেন, যত দ্রত সম্ভব আপডেট করা হবে। ধন্যবাদ সবাইকে॥

Comments

Popular posts from this blog

ভাড়াটিয়া-ভাড়াদার আইনের জটিলতা পার হওয়া: ভাড়াটিয়াদের জন্য একটি গাইড

একটি ভিত্তিহীন গুজব উড়িয়ে দেওয়া: বাংলাদেশী সাংবাদিকদের ফ্রেঞ্চ ভিসা প্রত্যাখ্যান করা হয়নি৷

অধ্যায় 2: বাংলায় ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন