১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ ও পূর্ববঙ্গ প্রতিক্রিয়া – মুনতাসীর মামুন

১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ ও পূর্ববঙ্গ প্রতিক্রিয়া – মুনতাসীর মামুন



বঙ্গভঙ্গ
বঙ্গভঙ্গের কারণ নিয়ে ঐতিহাসিকরা যেসব আলােচনা করেছেন তাতে দু’টি বিষয়ই প্রাধান্য হয়ে উঠেছে। একদল ঐতিহাসিকের মতে, প্রশাসনিক কারণেই ঔপনিবেশিক সরকার বাংলাকে বিভক্ত করেছিলেন যে যুক্তি ঐ সময় ব্রিটিশ সিভিলিয়ানরা দেয়ার bষ্টা করেছিলেন বিভিন্নভাবে। এ প্রসঙ্গে ম্যাকলেন লিখেছেন, ১৯০৫ পর্যন্ত বঙ্গভঙ্গের পিছে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল প্রচ্ছন্ন। অন্যেরা বলছেন, ঔপনিবেশিক সরকারের উদ্দেশ্য ছিল সম্পূর্ণ রাজনৈতিক। বাংলা বিভক্ত করে রাজনৈতিক ফায়দা লাভের উদ্দেশ্যেই ব্রিটিশ সরকার ভাগ করেছিলাে বাংলাকে। যেমন, সুমিত সরকার মনে করেন, ১৯০৩ পর্যন্ত বঙ্গভঙ্গের পিছে সরকারের প্রশাসনিক পরিবর্তন-ইচ্ছাই কাজ করেছে। ডিসেম্বর ১৯০৩ থেকে ১৯ জুলাই ১৯০৫-এর মধ্যে “transfer plan was transformed into full scale partition.” এ সময়ের রাজনৈতিক অভিলাষ ছিল পূর্ব ও পশ্চিমবঙ্গের হিন্দুদের বিভক্ত করা। এবং ১৯০৩ সালের ২৮ মার্চের চিঠিতে ফ্রেজার প্রথমবারের মতাে বঙ্গভঙ্গের রাজনৈতিক ফায়দার কথা উল্লেখ করেছিলেন। এমাজউদ্দিন আহমদ এক দীর্ঘ প্রবন্ধে দেখিয়েছেন ব্রিটিশদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যই ছিল মুখ্য।৪
শেষােক্ত যুক্তিটিই বর্তমানে প্রাধান্য বিস্তার করে আছে। সুমিত সরকারের আগে, অমলেশ ত্রিপাঠীও মােটামুটি একই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন। লিখেছেন তিনি, “এ সিদ্ধান্ত আজ বােধহয় তর্কাতীত যে, রাজদ্রোহী কংগ্রেসকে ধ্বংস করার কোনােও উগ্র বাসনা থেকে বঙ্গভঙ্গ পরিকল্পনার জন্ম হয় নি। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে ইংরেজ আমলাদের প্রচণ্ড বাঙালিবিদ্বেষ, আর বাংলার ভৌগােলিক এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধিজাত অতি জরুরী সমস্যা সমাধানের চেষ্টা থেকেই এর উদ্ভব। চরমপন্থা জোরদার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাতে কংগ্রেসবিরােধী আয়তন যুক্ত হয়।”৫ এবং তারপর তিনি দেখিয়েছেন কিভাবে ইংরেজ আমলাদের বাঙালিবিদ্বেষ চরম আকার ধারণ করেছিলাে। এটিকে আমরা এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক পটভূমি হিসেবেও উল্লেখ করতে পারি।
বঙ্গ বা বাংলা বলতে, ১৯০৫-এর আগে বোেঝাত অবিভক্ত বাংলা বা বেঙ্গল প্রপার, সম্পূর্ণ বিহার, উড়িষ্যা এবং আসাম। এরকম বিস্তত একটি অঞ্চল সুষ্ঠুভাবে শাসন করা দুরূহ। প্রধানত এ চিন্তা থেকেই বঙ্গভঙ্গের পঞ্চাশ বছর আগে বাংলার আয়তন কমাবার প্রস্তাব করা হয়েছিলাে। হয়ত এটিও ভাবা হয়েছিলাে যে, এতে এ অঞ্চল, বিশেষ করে পূর্ববঙ্গ ও আসামের পশ্চাৎমুখীনতা হ্রাস পাবে।৬ অ্যান্ড্রু ফ্রেজারও তা-ই মনে করতেন। ৭
পূর্ববঙ্গ ভারতবর্ষের একটি পশ্চাৎপদ প্রদেশে পরিণত হয় অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি থেকে। মুর্শিদকুলি খাঁ অষ্টাদশ শতকের গােড়ার দিকে ঢাকা থেকে রাজধানী স্থানান্তর করেন মুর্শিদাবাদে এবং এ পরিপ্রেক্ষিতেই অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি থেকে পূর্ববঙ্গ (বা ঢাকার)-এর ক্ষয় শুরু যা থেকে এ অঞ্চলটি বিশ শতকের পূর্ব পর্যন্ত আর মুক্তি পায় নি।
১৮৫৪ সালে, প্রধানত প্রশাসনিক কারণেই বাংলায় লেঃ গভর্নরের পদ সৃষ্টি হয়। এরপর ১৮৬৭ সালে উড়িষ্যার দুর্ভিক্ষের পর বাংলার লেঃ গভর্নর এক চিঠিতে জানান যে, “বর্তমান বাংলা সরকারের মত এমন অস্বাভাবিক ব্যবস্থা ভারতে আর আছে বলে আমি জানি না, ভারতে আয়তনের দিক থেকে বৃহত্তম প্রশাসনিক ব্যবস্থা আর গুরুত্বের দিক থেকে সর্বপ্রধান হওয়া সত্ত্বেও বাংলা সরকারের কর্মক্ষমতা বােম্বাই ও মাদ্রাজ সরকার অপেক্ষা অনেক কম ও শ্লথ।”৮
১৮৭৪ সালে চিফ কমিশনারের অধীনে আসাম পরিণত হয় একটি স্বতন্ত্র প্রদেশে। ১৮৬৭ সালে ভারত সচিব লর্ড নর্থকোটের নেতৃত্বাধীন এক বিশেষ কমিটির সুপারিশে তা করা হয়েছিলাে।
১৮৯২ সালে লুসাই উপজাতিদের বিদ্রোহের কারণে আবার বাংলার সীমানা পুনর্গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছিলাে যদিও তা কার্যকর হয় নি। তবে, পূর্ববঙ্গ নিয়ে নতুন প্রদেশ গঠনের প্রস্তাবটি প্রথমে করেন চাটগাঁর কমিশনার ওল্ডহ্যাম ১৮৯৬ সালে। তিনি সরকারের কাছে এক প্রস্তাবে জানিয়েছিলেন, আসাম, চট্টগ্রাম ও ঢাকা বিভাগের অংশ নিয়ে পূর্ববাংলা নামে নতুন প্রদেশ হওয়া উচিত যার রাজধানী হবে চট্টগ্রাম অথবা ঢাকা। অন্যদিকে, এর চার বছর পর আসামের চিফ কমিশনার, আসামের সঙ্গে চট্টগ্রাম, ঢাকা ও ময়মনসিংহকে যুক্ত করার প্রস্তাব করেন। তবে ১৮৯৮ সালে দক্ষিণ লুসাইকে আসামের সঙ্গে যুক্ত করা হয়।
১৯০৫ সালের প্রস্তাবটি কার্জনের আবিষ্কৃত নয় এবং হঠাৎ করেই হয় নি, একথা উল্লেখ করেছেন অনেক ব্রিটিশ সিভিলিয়ান। হেনরি কটন উল্লেখ করেছেন, ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ অনেক দিনের আলােচনা পর্যালােচনারই ফল।১০ লােভাট ফ্রেজার মনে করেন, মধ্যপ্রদেশের চিফ কমিশনার অ্যান্ড্রু ফ্রেজারের সম্বলপুরের সরকারি ভাষা হিন্দির পরিবর্তে উড়িয়া করার প্রস্তাবের মধ্যেই নিহিত বঙ্গভঙ্গ প্রস্তাব।১১
১৯০১ সালে, আবার বাংলার সীমানা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিলাে। মধ্যপ্রদেশের চিফ কমিশনার ফ্রেজার প্রস্তাব করেছিলেন বাংলা ও মধ্যপ্রদেশের সীমানার খানিকটা অদলবদল করলে সম্বলপুরের ঝামেলাটা মিটে যায়। উড়িষ্যার এই ছিটমহলটি ছিল হিন্দি বলয়ে। পরবর্তীকালে ফ্রেজার তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন, বঙ্গভঙ্গের উদ্দেশ্য ছিল সীমানার ‘রিঅ্যাডজাস্টমেন্ট’ যার তিনটি অংশ ছিল। এর প্রথমটি ছিল—
“… constitution of a large Uriya Division by the addition to the existing Orissa Division in Bengal of the District of Sambalpur and five Feudatory states from the Central Provinces. This was a measure of great importance, though it attracted but little attention.”১২ উড়িয়া ভাষাভাষী একটি প্রদেশ হলে প্রশাসনিক সুবিধা হয়, কারণ, নতুনভাবে আবার সবাইকে ভাষা শিক্ষা করে কাজ করতে হবে না।
ফ্রেজার-বর্ণিত রিঅ্যাডজাস্টমেন্টের দ্বিতীয় অংশটিও ছিল প্রথমটির প্রায় অনুরূপ। তার ভাষায় “was the transfer to Bengal of the five Uriya feudatory states above referred to, and the transfer from Bengal to the Central Provinces of five Hindi states, on the other side of the province. This measure was dictated by something of the same feeling as led to the transfer of Sambalpur District to the Orissa Division.”১৩ | ফ্রেজার উল্লেখ করেছেন এ দুটির সঙ্গে বঙ্গবিভাগের কোনাে সম্পর্কই নেই।
ফ্রেজার উল্লেখ করেছেন, বঙ্গভঙ্গের অনেক আগেই পূর্ববঙ্গের দু’একটি জেলা আসামের অন্তর্গত ছিল। এবং প্রদেশের বাকি অংশ ট্রান্সফার করা ছিল তাঁর মতে, “exceedingly desirable, if not absolutely necessary.” কারণ, পূর্ববঙ্গ এক বিরাট, অগম্য এলাকা। একজন লেঃ গভর্নরের পক্ষে এ ভার বহন করা সম্ভব নয়। এর ফলে দেখা যায়, প্রায় ক্ষেত্রে পূর্ববঙ্গের অনেক এলাকা অবহেলিত। অন্যদিকে, আসাম এত ক্ষুদ্র যে তাকে নিয়েও আলাদা একটি প্রদেশ গঠন করা যায় না। সুতরাং পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশ হওয়া বাঞ্ছনীয়।১৪
ফ্রেজারের প্রস্তাবটি পরবর্তী দেড় বছর ধরে বিভিন্ন সিভিলিয়ানরা আলােচনা পর্যালােচনা করেন। তারপর ১৯০২ সালের ২৪ মে এ-সংক্রান্ত নথিটি কার্জনের টেবিলে পৌছালে, কার্জন আমলাতন্ত্রের দীর্ঘসূত্রিতা সম্পর্কে সেই বিখ্যাত মন্তব্যটি করেন।১৫ কিন্তু, সঙ্গে সঙ্গে সীমানাসংক্রান্ত যাবতীয় সমস্যা সমাধানেরও প্রস্তাব করেছিলেন। ১৯০৩ সালের ১৮ মার্চের নােটে এ পরিপ্রেক্ষিতে ফ্রেজার বাংলা থেকে চট্টগ্রাম, ঢাকা ও ময়মনসিংহকেও আলাদা করার প্রস্তাব করেছিলেন। কার্জন অনুমােদন করেছিলেন এ প্রস্তাব। সে পরিপ্রেক্ষিতে ১৯০৩ সালের ডিসেম্বরে প্রকাশিত হয়েছিলাে রিজলের চিঠি যেখানে আসামের সঙ্গে ঢাকা, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহকে জুড়ে প্রস্তাব করা হয়েছিলাে আলাদা একটি প্রদেশ গঠনে ।
রিজলের চিঠিটি প্রকাশিত হওয়ার পর থেকেই প্রতিবাদ শুরু হতে থাকে এবং কালক্রমে যা প্রবল আকার ধারণ করে। গভর্নর জেনারেলের নির্বাহী পরিষদের সদস্য ইবেসন তখন এক নােটে লিখেছিলেন, বিভিন্ন সংস্থা ও প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গের ব্যক্তিগত স্বার্থ অপেক্ষা প্রশাসনিক স্বার্থ অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।” এবং কার্জনকে পরামর্শ দেন সব বাদ-প্রতিবাদ উপেক্ষা করে নিজ পরিকল্পনায় অটল থাকতে। তার মতে, “বাংলার প্রশাসনিক স্বার্থ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আর আসামের জন্য তা আরও
গুরুত্বপূর্ণ। আমার মনে হয়, প্রশাসনিক প্রয়ােজনে সকল স্তরের বিরােধিতা সত্ত্বেও এ পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হওয়া উচিত।” ১৬ কার্জনও ১৯০৪ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি এক নােটে লেখেন, “যে-কোনাে ব্যক্তির (প্রশাসকের পক্ষে বাংলার প্রশাসন পরিচালনা এক অসম্ভব ব্যাপার। এ অবস্থায় প্রশাসন যে অত্যন্ত দুরূহ ব্যাপার তা অনুধাবনের জন্য শুধু তাকে জেলায় যেতে হবে।”১৭
১৯০৪ সালের ১ ফেব্রুয়ারি থেকে ২৬ এপ্রিল পর্যন্ত কর্মকর্তাদের মধ্যে এ প্রস্তাব নিয়ে আরও কিছু লেখালেখি হয়। ঢাকার কমিশনার স্যাভেজ লিখেছিলেন, পূর্ব বাংলাকে এমনভাবে প্রদেশে পরিণত করা উচিত যেখানে সম্ভব হবে একটি ব্যবস্থাপক পরিষদ গঠন করা। ফ্রেজার এ প্রদেশে ঢাকা ও চট্টগ্রামকে অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব দেন। কাজন এর সঙ্গে পাবনা, বগুড়া ও রংপুরকেও যুক্ত করার প্রস্তাব রাখেন। ১৯০৪ সালের ২২ এপ্রিল বাংলা সরকার অবশেষে সমর্থ হয় একটি পূর্ণাঙ্গ প্রস্তাব তৈরি করতে।১৮
বঙ্গভঙ্গ প্রস্তাব কিন্তু কার্যকর হয়েছিলাে ভারপ্রাপ্ত গভর্নর জেনারেল অ্যাম্পটহিলের আমলে। ১৯০৪ সালের ৩০ এপ্রিল কার্জন ইংল্যান্ড চলে যান ছুটি কাটাতে। সাময়িকভাবে কার্যভার গ্রহণ করেন অ্যাম্পটহিল । এ সময় রিজলে আবার আবির্ভূত হন দৃশ্যপটে। তিনি নতুন প্রশাসনিক বিভাগে রাজশাহী বিভাগ ও মালদা জেলাকে যুক্ত করার প্রস্তাব করেন। সবশেষে এ সম্পর্কিত প্রতিবেদন সমাপ্ত করা হয় ১৯০৪ সালের ডিসেম্বরে। কার্জন ছুটি কাটিয়ে ফিরে এসে রিজলের প্রতিবেদন গ্রহণ করে ভারত সচিবের কাছে পাঠিয়ে দেন। কার্জন সচিবকে এ প্রস্তাবের প্রশাসনিক সুবিধাগুলি তুলে ধরেন। ইন্ডিয়া অফিসের সাবেক সচিব গডলেকেও কার্জন উল্লেখ করেন যে বঙ্গভঙ্গ হচ্ছে “প্রথম শ্রেণীর এক প্রশাসনিক সংস্কার।”১৯
১৯০৫ সালের ৯ জুন ব্রিটিশ সরকার এ প্রস্তাব অনুমােদন করে এবং ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, পার্বত্য ত্রিপুরা ও আসাম নিয়ে গঠিত হয় পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশ। এই সময় এ প্রদেশের জনসংখ্যা ছিল তিন কোটি ১০ লক্ষ। সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল মুসলমান সম্প্রদায়—এক কোটি ৮০ লক্ষ। এ পরিকল্পনা কার্যকর হয় ১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবর।
পরবর্তীকালে (১৯১২ লর্ড হার্ডিঞ্জ কার্জনকে লিখেছিলেন- “বাংলা] বিভাগ ছিল একটা বিরাট প্রশাসনিক সংস্কার, প্রয়ােজনীয় ও যুক্তিসঙ্গত আর এর জন্য কৃতিত্বের একমাত্র দাবিদার আপনিই।” ২০
বঙ্গ বিভাগ করার পেছনে প্রশাসনিক যে যুক্তিগুলাে সিভিলিয়ানরা উল্লেখ করেছেন তা একেবারে যুক্তিহীন নয়। সে সময় ও বাস্তবতার কথা মনে রাখলে ঐসব যুক্তি একেবারে নাকচ করা যায় না। তবে, শেষ পর্যায়ে প্রশাসনিক সুবিধাগুলির কথা যখন তারা ভাবছিলেন তখন এর সঙ্গে রাজনৈতিক সুবিধাগুলিও স্পষ্ট হয়ে উঠতে থাকে, এবং যুক্ত হয় রাজনৈতিক আয়তন। কার্জন যখন প্রস্তাবের পক্ষে পূর্ববঙ্গ সফর শুরু করেন তখন
তিনি সম্মুখীন হন বিরুদ্ধবাদীদের। পূর্ববঙ্গে প্রস্তাবের পক্ষে যে কেউ ছিলেন না তা তাে নয়। সেই নির্বাক পক্ষভুক্ত মানুষদের কার্জন চিহ্নিত করতে পেরেছিলেন এবং এ থেকে তিনি রাজনৈতিক সুবিধা নিতে চেয়েছিলেন। ফলে, ব্রিটিশদের সনাতন নীতি ডিভাইড অ্যান্ড রুল পলিসি অনুসরণ করা হয়। বঙ্গভঙ্গের রাজনৈতিক দিকটি তখন গুরুত্বপূর্ণ। হয়ে ওঠে যদিও আমরা লক্ষ করি এ দিকটি গােপন রাখার ব্যাপারে সিভিলিয়ানরা সতর্ক ছিলেন।
সামগ্রিকভাবে ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে বাঙালি এলিটের একটি ক্ষোভ ছিলই। কংগ্রেস গঠন, বিভিন্ন সভাসমিতির কার্যকলাপ ও সংবাদ সাময়িকপত্রের মাধ্যমে ক্রমেই তা দানা বাঁধছিলাে। এ ক্ষোভ এবং তা থেকে সৃষ্ট স্বাতন্ত্রবােধের বিষয়টি ইংরেজ সিভিলিয়ানদের দৃষ্টি এড়িয়ে গিয়েছিলাে তা বলা যাবে না।
এ পরিপ্রেক্ষিতে ভ্যালেন্টিন চিরল লর্ড মিন্টোকে যে প্রতিবেদন পাঠিয়েছিলেন তা উদ্ধৃত করা যেতে পারে। প্রতিবেদনটি ১৯১০ সালের কিন্তু তার ত্রিশ বছর আগের পটভূমিকার উল্লেখ আছে সেখানে। চিরল লিখেছিলেন-“এটা নিঃসন্দেহ যে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে যে অসন্তোষ দানা বেঁধেছে তা প্রধানত কৃত্রিম, কিন্তু যা মূলত আমাকে ভীতসন্ত্রস্ত করে আর যা আমার নিকট অত্যন্ত অশুভ মনে হয় তা হল পাশ্চাত্যের প্রভাব প্রতিপত্তি, বিশেষ করে এর আত্মিক ও নৈতিক, পার্থিব ও রাজনৈতিক শ্রেষ্ঠত্বের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়া ও সর্বাত্মক বিপ্লবের আন্দোলন। মাঞ্চুরিয়ায় জাপানী বিজয় নিঃসন্দেহে এ আন্দোলনকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে, কিন্তু এর মূল প্রােথিত রয়েছে আরও গভীরে। এ আন্দোলন এশিয়াব্যাপী প্রাচ্যের নবজাগরণের কোনাে ভারতীয় অভিব্যক্তি নয়। বরং এ আন্দোলন হ’ল প্রধানত হিন্দু পুনর্জাগরণের আন্দোলন। ত্রিশ বছর পূর্বে যখন আমি ভারতে এসেছিলাম তখন লক্ষ্য করেছিলাম, নতুন আশায় উদ্বেল নতুন ভারত বুদ্ধিবৃত্তির ক্ষেত্রে হতে চেয়েছিল ইংরেজদের চেয়েও ইংরেজ মনােভাবাপন্ন।”—এখন অবস্থা তার বিপরীত এবং “এ যেন প্রাচীন স্বর্ণযুগে প্রত্যাবর্তন যখন ‘দুষ্কৃতকারী’ ইংরেজদের আগমনের পূর্ণ অগ্রগতি ও উন্নতি সর্বত্র ছড়িয়ে ছিল। বর্তমানে আমরা বাংলা, দাক্ষিণাত্য ও পাঞ্জাবের মত তিনটি ঝটিকা। কেন্দ্রে এ অবস্থার সম্মুখীন হয়েছি।”২১ এমাজউদ্দিনের মতে, এভাবে কার্জন দক্ষিণে মারাঠা ব্রাহ্মণ ও পূর্বে ভদ্রলােকদের প্রভাব ক্ষুন্ন করতে চেয়েছিলেন।২২ তবে, তিনি যে উল্লেখ করেছেন প্রথম থেকেই শুদ্ধ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থেকেই বঙ্গভঙ্গের চিন্তা করা হয়েছিলাে এ মতটি মেনে নেয়া কষ্টকর। বরং, রাজনৈতিক আয়তন যুক্তের যে ব্যাখ্যাটি (এবং সময় উল্লেখ করেছি তাই অধিক যুক্তিযুক্ত। এমাজউদ্দিন কার্জন বা ফ্রেজারের যেসব চিঠির (রাজনৈতিক সুবিধার উল্লেখ করে) উল্লেখ করেছেন সেগুলিও লেখা হয়েছে ১৯০৩ থেকে ১৯০৫-এর মধ্যে।
বঙ্গভঙ্গের রাজনৈতিক সুবিধার কথাটি স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছিলেন রিজলে, প্রথম ১৯০৪ সালে। তাঁর মতে, পূর্ববঙ্গে এ প্রতিবাদ আন্দোলনের নেতৃত্বে আছে শিক্ষিত ক্ষুদ্র একটি গােষ্ঠী এবং বাবু’রা বঙ্গভঙ্গের কারণে পেশাগত বা অর্থনেতিক কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন এ চিন্তায়ই বঙ্গভঙ্গের বিরােধিতা করা হচ্ছে। তিনি লিখেছিলেন, ঐক্যবদ্ধ
বাংলা একটি শক্তি; বিভক্ত বাংলা যা নয় … আমাদের প্রধান উদ্দেশ্য একে বিভক্ত করা এবং এভাবে আমাদের শাসনের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ বিরােধীদের দুর্বল করে তােলা।২৩ ফ্রেজার ও কার্জনও পরে এ বিষয়ে একমত হয়েছিলেন। কার্জন রিজলের নােটের পরিপ্রেক্ষিতে লিখেছিলেন, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যটি যাতে চাপা থাকে কারণ না হলে প্রতিবাদ হবে। আর আমাদের মূল উদ্দেশ্যটি ব্যাহত হবে … পরিষদ চেম্বারের অভ্যন্তরে একা একা যে কথা বলা যায় তা কোনােক্রমেই ঘরের ছাদ থেকে ঘােষণা করা যায় না।”২৪ পরে আরও স্পষ্ট করে তিনি বলেছিলেন, বাঙ্গালী বাবুরা চায় ইংরেজরা পাততাড়ি গুটিয়ে চলে যাক যাতে গভর্নর হাউস তারা দখল করতে পারে। তাদের হট্টগােলের বিপরীতে যদি আমরা নতি স্বীকার করি তাহলে আর বঙ্গ বিভক্ত করা যাবে এবং ফলাফলটি কি হবে?
“you will be cementing and solidifying, on the eastern flank of India, a force already formidable and certain to be a source of increasing trouble in the future.”২৫
ইবেৎসনও একই বিষয় উল্লেখ করেছেন তাঁর নােটে যার মূল বক্তব্য হলাে, বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার আন্দোলনকারী ক্ষুদ্র গােষ্ঠীর প্রভাব নিশ্চিহ্ন করা বাঞ্ছনীয়।
এ পরিপ্রেক্ষিতে, পূর্ববঙ্গ সফরের সময় পরিস্থিতি বুঝে কার্জন বিভক্ত ও শাসন করার নীতি প্রয়ােগ করেন। পূর্ববঙ্গের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান সম্প্রদায়ের উদ্দেশে বিভিন্ন বক্তৃতায় তিনি এ বিষয়টিই তুলে ধরেন যে, বঙ্গ বিভাগ হলে এ অঞ্চলের মুসলমানরা সুযােগ-সুবিধা পাবে বেশি। ঢাকার নবাব সলিমুল্লাহও যােগ দেন তার সঙ্গে। ফলে, মুসলমানদের সংখ্যাগরিষ্ঠ কিন্তু নীরব অংশের সমর্থন লাভ করেন কার্জন।
১৯০৪ সালের ডিসেম্বরে রিজলে সামগ্রিক পরিস্থিতির মূল্যায়ন করেন এভাবে “বাঙালি দ্রলােকরা সব সময় পূর্ববাংলার মুসলমানদের ওপর প্রভুত্ব করতে চেয়েছে। পূর্ববাংলার প্রভাবশালী মুসলমানদেরকে তাদের নিয়ন্ত্রণে আনয়নের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা এতদিন পর্যন্ত ঢাকার নবাবদের প্রভাবের দ্বারা প্রতিহত করা সম্ভব হয়েছে। পূর্বাঞ্চলে] মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশ গঠন করার প্রচেষ্টা ব্যাহত হবে। যদি ঢাকা নতুন প্রদেশের রাজধানী হয় তাহলে সে সম্ভাবনা সুদূরপরাহত হবে।”২৬
এরপর দৃঢ় মনােভাব নিয়ে বঙ্গভঙ্গ করার পথে এগিয়ে গিয়েছিলাে সরকার।

বঙ্গভঙ্গ কার্যকর হওয়ার পরপরই বিলাতি দ্রব্য বর্জনের আহ্বান জানানাে হয়েছিলাে বিয়কটা। তবে, ১৯০৩ সালে রিজলের চিঠি প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ কার্যকর হওয়া পর্যন্ত বঙ্গভঙ্গের পক্ষে এবং বিপক্ষে বাংলায় জোরালাে আন্দোলন হয়েছিলাে। এ প্রতিক্রিয়া নানাভাবে বিশ্লেষণ করা হয়েছে এবং গুরুত্ব আরােপ করা হয়েছে কলকাতাকেন্দ্রিক জনপ্রতিক্রিয়ার ওপর। যে প্রদেশকে নিয়ে হৈচৈ সে প্রদেশের জনপ্রতিক্রিয়াকে গুরুত্ব দেয়া হয় নি। প্রথম দিকে, আন্দোলনের ধারা ছিল বঙ্গভঙ্গের
পক্ষে কিন্তু পরে পূর্ববঙ্গেও বঙ্গভঙ্গের পক্ষে গড়ে উঠেছিলাে জনমত অর্থাৎ, বাংলার জনমত দ্বিখণ্ডিত হয়ে গিয়েছিলাে। জাতীয়তাবাদী ঐতিহাসিকরা একে দেখেছেন একধরনের প্রতিক্রিয়াশীল, সাম্প্রদায়িক প্রতিক্রিয়া হিসেবে। সে জনপ্রতিক্রিয়া (পক্ষেবিপক্ষে) নিয়ে তেমন আলােচনা হয় নি, তাই এখানে আমি বিশেষভাবে পূর্ববঙ্গের জনপ্রতিক্রিয়া তুলে ধরবাে ধারাবাহিকভাবে। তবে, তার আগে কলকাতাকেন্দ্রিক জনপ্রতিক্রিয়ার সংক্ষিপ্ত রূপরেখা তুলে ধরছি।
জনপ্রতিক্রিয়া প্রতিফলিত হওয়ার প্রধান মাধ্যম ছিল পত্র-পত্রিকা, তারপর বিভিন্ন সংগঠনের তরফ থেকে প্রদত্ত স্মারকলিপি এবং জনসভা।
বঙ্গভঙ্গের জনপ্রতিক্রিয়া ঐতিহাসিকরা যেভাবে তুলে ধরেছেন তা হলাে এর বিপক্ষে প্রবল জনমত গড়ে উঠেছিলাে। সমকালীন রচনা, বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা, স্মারকলিপি প্রভৃতিকে তারা এর প্রমাণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। হ্যা, পূর্ববঙ্গের কিছু মুসলমান এর বিরােধিতা করেছিলেন, কিন্তু জনমত ছিল বঙ্গভঙ্গের বিপক্ষে। এর উল্টো পিঠের চিত্র তারা চিত্রিত করেন নি বা করতে চান নি, কেননা, তাতে জাতীয়তাবাদী ভাবধারা ক্ষুন্ন হতে পারে।
প্রথমেই বলে নেওয়া ভালাে অধিকাংশ পত্র-পত্রিকার মালিক ছিলেন তখন মধ্যশ্রেণীর বা জমিদার। স্মারকলিপি প্রভৃতিও তৈরি করেছিলেন তাঁরা। স্বাভাবিকভাবেই তাদের দৃষ্টিভঙ্গিই প্রতিফলিত হয়েছে সেখানে একং সেগুলির নির্বিচার ব্যবহার তাঁদের মতামতকেই তুলে ধরেছে। দ্বিখণ্ডিত মতামত, বা কেনই-বা সে মতামত খণ্ডিত হয়েছিলাে সে প্রশ্ন অনুক্তই থেকে গেছে।
বঙ্গভঙ্গের ব্যাপারে প্রথম প্রশ্ন রেখেছিলেন চট্টগ্রামের উকিল ও আইন পরিষদের চট্টগ্রাম বিভাগের সদস্য মৌলভী সিরাজুল ইসলাম। বাংলাবিভক্তির ব্যাপারটি যখন আর গােপন ছিল না তখন ১৮৯৬ সালে চট্টগ্রাম হিতসাধিনী সভার সভাপতি মৌলভী সিরাজুল ইসলাম এক স্মারকলিপিতে উল্লেখ করেছিলেন, “আসামের সঙ্গে চট্টগ্রামের কোনাে মিল নেই।” ব্রাহ্মণবাড়ীয়া থেকে সৈয়দ শের আলী ও ১৮৫ জন একই যুক্তি দিয়ে বলেছিলেন–
“The great muhammadan community are absolutely apathetic about it except as far as their participation in the Mohsin Fund and their retention of the special inspection system for muhammadan education are concerned.”২৭
এখানে উল্লেখ্য যে, এ বক্তব্যগুলাে বঙ্গভঙ্গের অনেক আগের। এ পরিপ্রেক্ষিতে ১২ ডিসেম্বর ১৯০৩ সালে বাংলা বিভক্তিকরণ-সম্পর্কিত রিজলের চিঠি ছাপা হয়েছিলাে। ২৮
১৯০৩ সালের ডিসেম্বর থেকে ১৯০৫ সালের অক্টোবরের মধ্যে সারা বাংলায় প্রায় তিন হাজার সভা অনুষ্ঠিত হয়েছিলাে এবং এক হিসেব অনুযায়ী এসব সভায় উপস্থিত থাকতেন ৫০০ থেকে ৫০,০০০ শ্রোতা। সরকারি ভাষ্য অনুযায়ী এ সভার সংখ্যা ছিল পাঁচশাে।২৯
আগেই উল্লেখ করেছি, যারা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন তারা ছিলেন সমাজের শিক্ষিত, উচ্চশ্রেণীর, এক কথায় ভদ্রলােক বা এলিট শ্রেণীর যাদের সংখ্যা ছিল বাংলায় ১৯০০ সালে ৩ থেকে ৪ শতাংশ (১৩ থেকে ১৭ লক্ষের মতাে)।৩০
ফ্রেজার উল্লেখ করেছেন, আন্দোলন প্রধানত সংগঠিত হয়েছিলাে কলকাতা থেকে। প্রথম দিকে অনেকের যে আপত্তি ছিল তা মেটানাের পর তারা সন্তুষ্ট ছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে আন্দোলনটি ভদ্রলােকদের প্রভাব বিস্তারের হাতিয়ার হয়ে দাঁড়ায়। এক্ষেত্রে সাহায্য করে দেশীয় সংবাদপত্রের একটি অংশ।৩১
রিজলের বঙ্গভঙ্গ প্রস্তাব সংক্রান্ত চিঠিটি প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় তার পত্রিকায় লিখেছিলেন
“We object to the proposed dismemberment of Bengal and we are sure the whole country will rise as one man to protest against
it.”৩২
এরপর কলকাতার টাউনহলে অনুষ্ঠিত সভায় বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে নিন্দাপ্রস্তাব গ্রহণ করে বলা হয়েছিলাে বাঙালিদের ঐতিহাসিক, সামাজিক এবং ভাষাগত ঐক্য ও ঐতিহ্য ছিন্ন করা যাবে না কারণ তাতে বাঙালিদের পার্থিব উন্নতির পথে অন্তরায় সৃষ্টি হবে।৩৩ এসব সভাসমিতিতে তৎকালীন বাঙালি রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ প্রায় সবাই কোনাে-নাকোনােভাবে যােগ দিয়েছিলেন। এঁদের এবং জমিদার ও ব্যবসায়ীদের নেতৃস্থানীয় অনেকে আবার যুক্ত ছিলেন বিভিন্ন সংগঠনে। সুতরাং, আবার দেখি সেইসব সংগঠনের পক্ষ থেকেও স্মারকলিপি পেশ করা হচ্ছে সরকারের কাছে। বেঙ্গল ন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স, ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসােসিয়েশন, ক্যালকাটা বেলড জুট অ্যাসােসিয়েশন, ইন্ডিয়ান জুট মিলস অ্যাসােসিয়েশন, ইন্ডিয়ান মাইনিং অ্যাসােসিয়েশন প্রভৃতি সংগঠনের পক্ষ থেকে বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানাে হয়েছিলাে। প্রতিবাদলিপিতে যেসব যুক্তি জ্ঞাপন করা হয়েছিলাে তার ধরনগুলাে ছিল মােটামুটি একই রকম (দেখুন, পরবর্তী অধ্যায় ও সংকলন অংশ)। যুক্তিগুলি ছিল আসাম অনুন্নত এলাকা, তার সঙ্গে বাংলার একাংশের যুক্তকরণ আত্মহত্যারই শামিল, বাংলার শিল্প-বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হবে ইত্যাদি। উদাহরণস্বরূপ বেঙ্গল ন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্সের সেক্রেটারি সীতানাথ রায়ের বক্তব্য উদ্ধৃত করা যায়। ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসােসিয়েশনের সভায় তিনি বলেছিলেন—
“I say it is no light matter for 11 millions of people to be driven to a strange land, to uncongenial clime, to the land of kalajor or black fever and to be forced to form alliance with strange people with whom we have nothing in common.”৩৪ সরকারি নথি থেকে জানা যায়, সীতানাথ রায় ও আরাে কয়েকজন লে. গভর্নরের সঙ্গে দেখা করেছিলেন, তাঁরা বলেছিলেন, বঙ্গভঙ্গ হলে, তাঁদের সম্পত্তি দুই প্রদেশের অধীনে পড়বে যা জটিলতার সৃষ্টি করবে। তাছাড়া, তাদের অধিকাংশ জমিদারি হচ্ছে, ঢাকা, ময়মনসিংহ, ফরিদপুর, বাখরগঞ্জ এবং ত্রিপুরায়। এবং সম্প্রতি তারা সম্পত্তি কিনেছেন রাঁচি ও কলকাতায়। সরকারি নথি অনুযায়ী
“The two principal arguments based on personal interest which they used against the transfer of Dacca and Mymensigh district to Assam were first that, in view of the amount of im movable property they have in Faridpur and Backergunje, the separation of Dacca and Mymensigh from the rest of the Dacca division would be a serious inconvenience and disadvantage to them, and secondly, that they have a large commerical connection between Dacca and Calcutta in which they have their principal place of buisness.” (বর্তমান গন্থের বঙ্গভঙ্গ : সরকারী দৃষ্টিভঙ্গি দ্রষ্টব্য কিন্তু কলকাতা বা পশ্চিমবঙ্গকে তাে যুক্ত করা হচ্ছিলাে না আসামের সঙ্গে।
মুসলমানদের সংগঠন সেন্ট্রাল ন্যাশনাল মােহামেডান অ্যাসােসিয়েশনও বঙ্গভঙ্গের বিরােধিতা করে। সংগঠনের সম্পাদক সৈয়দ আমীর হােসেন চীফ সেক্রেটারিকে এক স্মারকলিপিতে জানান বাংলাভাষী জাতিকে বিচ্ছিন্ন করা যাবে না এবং এর প্রয়ােজনও নেই। চট্টগ্রাম, ঢাকা, ময়মনসিংহের লােকেরা সবসময়-~’inspiration and Quidance’-এর জন্য কলকাতার দিকে তাকিয়ে থাকে। সমস্ত ভালাে কলেজ এবং ভালাে মাদ্রাসাগুলাে কলকাতায়, যেখানে ঐসব অঞ্চল থেকে ছাত্ররা আসছে এবং দিনদিন সে সংখ্যা বাড়ছে।
“… Finally my committee beg to suggest that should be Government be determined upon the proposed transfer, a determination that my committee will very much deplore, the least in can compensate the people for their losses, is to be found a Lieutenant Governorship for the reconstituted provinces of Assam, with that of Bengal, and a Board of revenue charged with the revenue administration of the province.”৩৫
কলকাতায় বসবাসরত নেতৃস্থানীয় মুসলমানদের অনেকেও বঙ্গভঙ্গের বিরােধিতা করেছেন। এদের অনেকে ছিলেন ভূস্বামী, অনেকে আবার যুক্ত ছিলেন কংগ্রেস রাজনীতির সঙ্গে। এদের মধ্যে উল্লেখ্য হলেন—আবুল কাসেম, আবদুল হালিম গজনবী, আবদুর রসুল, লিয়াকত হােসেন, ইসমাইল হােসেন সিরাজী প্রমুখ ।
এরপর আন্দোলন যত তীব্র হয়ে ওঠে, জনসভা, স্মারকলিপির সংখ্যা ততই বাড়তে থাকে। উভয় বঙ্গেই জনসভ হতে থাকে। কলকাতার নেতৃবৃন্দ পূর্ববঙ্গ সফর করতে থাকেন। কলকাতার ভদ্রলােকদের মধ্যে বিশেষ আবেগের সৃষ্টি হয়। ১৯০৫ সালের ১০ জানুয়ারি কলকাতা টাউনহলে এক সভা হয় হেনরি কটনের সভাপতিতে, এ পরিপ্রেক্ষিতে সুরেন্দ্রনাথ ঘােষণা করেন, বঙ্গভঙ্গ এ প্রদেশে যে আন্দোলনের সৃষ্টি করবে তার আর জুড়ি পাওয়া যাবে না।৩৬
এ আন্দোলন অন্তিমে পরিণতি লাভ করে বয়কট ও স্বদেশী আন্দোলনে। আসহাবর রহমান তার এক প্রবন্ধে দেখিয়েছেন, ক্রমে “স্বদেশীয় হিন্দু চরিত্র” স্পষ্ট হয়ে উঠতে থাকে।৩৭ এবং মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যেও পরিণামে স্বাতন্ত্র চিন্তা বৃদ্ধি পেতে থাকে।
পূর্ববঙ্গেও পশ্চিমবঙ্গের আদলে আন্দোলন পরিচালিত হয়েছে। পূর্ববঙ্গের আন্দোলনের বিবরণ আমরা মূলত পাই সে সময়ে ঢাকা থেকে প্রকাশিত দু’টি সংবাদপত্রে–‘ঢাকা প্রকাশ’ ও ‘বেঙ্গল টাইমস’-এ। উল্লেখ্য যে, দুটি পত্রিকার চরিত্র ছিল ভিন্ন। ঢাকা প্রকাশ’ ব্রাহ্মদের দ্বারা প্রকাশিত হলেও আন্দোলন চলাকালীন এর মালিকানা ছিল রক্ষণশীল হিন্দু ভদ্রলােকের হাতে। বেঙ্গল টাইমস’-এর মালিক ছিলেন ‘নেটিভ’বিদ্বেষী।’ কিন্তু দুটি পত্রিকাই বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে বক্তব্য পেশ করেছে। স্বাভাবিকভাবে ‘ঢাকা প্রকাশ’-এ এই সংক্রান্ত খবরাখবর ছিল বেশি। বেঙ্গল টাইমস’-এ মূলত প্রকাশিত হতাে বঙ্গভঙ্গের পক্ষে দেয়া সরকারি যুক্তি খণ্ডন করে দীর্ঘ প্রবন্ধ। দু’টি পত্রিকার মূল যুক্তিগুলাের মধ্যে খুব একটা পার্থক্য ছিল না। মূল বক্তব্য ছিল, যা উল্লেখ করা যেতে পারে ‘বেঙ্গল টাইমস’-এর ভাষায়—
“Lord Curzon’s proposed delimination is positively abhorent, and all Bengal, Hindoos and Muhammadans except a few who will curry favour with Government because of a desire for honours and distinctions will rise in entreaty, to be spared this threatened spoliation of inherited right, which have grown into vigour and spread under a benignant paternal sway. Nor is agitation artificial.”৩৮
পূর্ববঙ্গের জনমত বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যেহেতু ঢাকা ছিল পূর্ববঙ্গের প্রধান নগর সেহেতু ঢাকাতেই এ আন্দোলন হয়েছিলাে বেশি। ঢাকা প্রকাশ’ পড়লে দেখা যায় ঐ সময় পূর্ববঙ্গের প্রায় প্রধান প্রধান নগরে বঙ্গভঙ্গবিরােধী ‘তীব্র আন্দোলন হয়েছিলাে।
প্রথমেই দেখা যাক, বঙ্গভঙ্গের বিরােধিতা করে তৎকালীন পূর্ববাংলার সংবাদ সাময়িকপত্রগুলাে কি মতামত রেখেছিলাে বা বিভিন্ন অঞ্চলে জনসভা করে বঙ্গভঙ্গ বিরােধী নেতৃবর্গ কি বলছিলেন| রিজলের খসড়া প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঢাকা তথা পূর্ববঙ্গের প্রধান বাংলা পত্রিকা ‘ঢাকা প্রকাশ’ লিখেছিলাে– | প্রাচীনকাল থেকেই বঙ্গদেশ অবিচ্ছিন্ন এবং মুসলমান সম্রাটরাও কখনাে এর সীমানা সংকোচন করেন নি। কিন্তু ব্রিটিশ সরকার এখন এই প্রদেশকে দ্বিখণ্ডিত করতে চান কারণ তারা ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ নীতির সমর্থক। বাঙালিদের কাছে পত্রিকাটি এই বলে আবেদন জানিয়েছিলাে, “ভাই বঙ্গবাসী, এই বিষম বিপ্লবকর প্রস্তাব কার্যে পরিণত হইলে, বাঙ্গালী জাতির কি সর্বনাশ সংঘটিত হইবে একবার তা নিবিষ্ট চিত্তে চিন্তা করিয়া দেখিয়াছ কি? … অতএব স্বদেশের জন্যে, স্বদেশীদের জন্যে, যে কোনাে বঙ্গ সন্তানের শ্রদ্ধা আছে তাদের প্রত্যেকের কর্তব্য, এই প্রলয়কর প্রস্তাবের তীব্র প্রতিবাদ করিয়া জাতীয় অসন্তোষ চিহ্ন ভারত গভর্ণমেন্টের নিকট স্থাপন করেন।”৩৯ শুধু তা-ই নয়, সাধারণ লােকদের অনুপ্রাণিত করে তােলার উদ্দেশ্যে পরের সপ্তাহেই পত্রিকাটি
লিখেছিলাে–“রাজপুরুষের কুটিল কটাক্ষ দেখিয়া ভীত হইও না। পুরুষ পরম্পরাগত পৈত্রিক সম্পত্তি বাঙ্গালী’ আখ্যা রক্ষার নিমিত্ত যদি আত্মােৎসর্গে বিমুখ হও, তবে ধরাপৃষ্ঠ হইতে যত শীঘ্র তােমাদের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হইয়া যায় ততই মঙ্গল।”৪০
ঢাকার প্রথম সভাটি অনুষ্ঠিত হয়েছিলাে ধানকোরার জমিদারবাড়িতে। সভায় উপস্থিত ছিলেন প্রধানত জমিদার, তালুকদার ও উকিলরা এবং প্রতিবাদ বিক্ষোভ জানাবার ও সংগঠিত করার জন্যে এ সভা একটি কমিটিও গঠন করেছিলাে। সভাশেষে কমিটির পক্ষ থেকে চীফ সেক্রেটারির কাছে দৃঢ় কিন্তু শ্রদ্ধাবনত প্রতিবাদ জানানাে হয়েছিলাে।৪১
পরবর্তীকালে প্রধানত এঁদের উদ্যোগেই দেশের বিভিন্ন অংশে জনসভা করে প্রতিবাদ জ্ঞাপনের উদ্দেশ্যে ঢাকায় একটি জনসাধারণ সভা গঠন করা হয়েছিলাে।৪২ এ সভার পক্ষ থেকে ভারত সরকারের কাছে একটি টেলিগ্রাম পাঠিয়ে শ্রদ্ধাপূর্ণ চিত্তে সরকারে প্রস্তাব কার্যকর না করার আবেদন জানানাে হয়েছিলাে। শুধু তা-ই নয়, এ প্রসঙ্গে ‘ঢাকা প্রকাশ’ মন্তব্য করেছিলাে, সমগ্র ভারতের রাজধানী হিসেবেও যদি ঢাকাকে উন্নীত করে বাংলা থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়, তা হলেও পূর্ববঙ্গবাসী তা মেনে নেবে না। কারণ আবহমান কাল থেকে তারা বাঙালি। বাঙালি আখ্যা তাদের পৈতৃক সম্পত্তি। “পিতৃপ্রদত্ত অধিকার প্রাণান্তেও পরিত্যাগ করিতে আমরা প্রস্তুত নহি। অধিবাসীবৃন্দের ন্যায্য আবেদন উপেক্ষিত হইলে, ইংরেজ রাজ্যের সমদর্শিতায় কলঙ্ক অর্জিত হইবে।”৪৩
বঙ্গবিভাগ প্রস্তাবের বিরােধিতা করার জন্য এরপর জনসাধারণ সভা ২০ পৌষ ১৩১০ (১৯০৩)-এ বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে বাকল্যান্ড বাঁধের ওপর আয়ােজন করেছিলাে এক বিরাট জনসভার। সভায় সভাপতিত্ব করেছিলেন অনারারি ম্যাজিস্ট্রেট ও জমিদার মৌলবী খলিলুর রহমান আবু জাইগম সাবির। চারটি মূল প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়েছিলাে এ সভায়। প্রথম প্রস্তাবে বলা হয়েছিলাে, যেহেতু এই অঞ্চলের সঙ্গে আসামের লােকদের শিক্ষা সংস্কৃতি সবকিছুতেই পার্থক্য আছে বা অন্যকথায় তারা অনগ্রসর সেহেতু আসামকে পূর্ববঙ্গের সঙ্গে যােগ করা অন্যায়। দীনেশচন্দ্র রায় প্রস্তাবটি উত্থাপন করলে সমর্থন করেছিলেন রাজিউদ্দিন আহমেদ।
দ্বিতীয় প্রস্তাবে বলা হয়েছিলাে, সরকারি প্রস্তাবের প্রতিবাদে মফস্বলে যেসব প্রতিবাদসভা অনুষ্ঠিত হবে সেখানে তা সংহত করে তােলার উদ্দেশ্যে এইখানে যে কমিটি নিয়ােগ করা হবে সে কমিটি থেকে সদস্য প্রেরণ করা হবে। কাজিমদ্দিন আহম্মদ সিদ্দিকী এই প্রস্তাব করেছিলেন এবং তা সমর্থন করেছিলেন রাধাবল্লভ দাস।
তৃতীয় প্রস্তাবে “গভর্ণমেন্টের উক্ত প্রস্তাবের প্রতিবাদ কাৰ্য্যের ব্যয় নির্ধারণ অর্থ সংগ্রহ এবং উক্ত বিষয়ে অন্যান্য আবশ্যক কার্য সম্পাদনার্থ” গঠন করা হয়েছিলাে একটি কমিটি। সবশেষে বাংলা বিভাগ প্রস্তাব কার্যকর করতে বাংলা সরকার যেন তাড়াহুড়া না করেন তার জন্যে প্রস্তাব গৃহীত হয়েছিলাে। প্রস্তাব দু’টি উত্থাপন করেছিলেন যথাক্রমে রাও সাহেব রতনমনি গুপ্ত এবং ডাঃ রাজকুমার চক্রবর্তী। সমর্থন করেছিলেন যথাক্রমে ডি মানুক এবং গােবিন্দলাল বসাক।
১৯০৪ সালের গােড়ার দিকে ঢাকার নবাব সলিমুল্লাহ প্রবেশ করলেন দৃশ্যে। ১১ জানুয়ারি (১৯০৪) বাংলা বিভাগ প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে আলােচনার জন্যে স্থানীয় নেতৃবৃন্দকে এক বৈঠকে আহ্বান জানিয়েছিলেন তিনি। আলােচনাকালে নবাব এবং অন্যান্য সবাই সরকারি প্রস্তাবের তীব্র প্রতিবাদ করেছিলেন। তারপর নবাব নতুন একটি প্রস্তাব দিয়েছিলেন। প্রস্তাবটি ছিল—“আসাম, ঢাকা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিভাগ, দার্জিলিং, জলপাইগুড়ি এবং কোচবিহার ব্যতীত রাজশাহী বিভাগের অবশিষ্টাংশ এবং সম্ভবত যশােহর ও খুলনা লইয়া আসাম ভিন্ন অপর কোনাে উপযুক্ত নামকরণে, অপর কোনাে নূতন প্রদেশ সৃষ্টি করিতে পারা যায় কিনা, যদি প্রস্তাবিত নূতন প্রদেশ কলিকাতা হাইকোর্টের এলাকার অধীন থাকে। এই নূতন প্রদেশের জন্যে লেজিসলেটিভ কাউন্সিলসহ একজন ছােটলাট শাসনকর্তা নিযুক্ত হন এবং ঢাকাতে রাজধানী স্থাপিত হয় …” তাহলে তারা সম্মত আছেন কিনা? উপস্থিত ব্যক্তিবর্গ মতামত জ্ঞাপনের জন্যে দশদিন সময় নিয়ে ফিরে এসেছিলেন।৪৪
পরবর্তীকালে নবাব যদিও বঙ্গভঙ্গ সমর্থন করেছিলেন কিন্তু আমরা দেখছি, প্রস্তাবটি যখন সরকারিভাবে কার্যকর হয় নি, অর্থাৎ প্রথমদিকে, এই প্রস্তাবের বিরােধিতা করেছিলেন তিনি। তাঁর নেওয়া নতুন প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা এ ধরনের একটি সিদ্ধান্তে হয়ত পৌছতে পারি যে, তিনি ঢাকাকে নতুন একটি প্রদেশের রাজধানীরূপে দেখতে চেয়েছিলেন। হয়ত ভেবেছিলেন, ঢাকার গৌরব বাড়লে তাঁর প্রভাব প্রতিপত্তি আরও বৃদ্ধি পাবে। এবং নতুন প্রদেশের জনমতও হয়ত তিনি বেশ কিছুটা নিজ নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবেন।
নবাবের উপরােক্ত প্রস্তাব আলােচনার জন্য এক সভা আহ্বান করা হয়েছিলাে ঢাকার বিশিষ্ট নাগরিক প্রভাবশালী আইনজীবী আনন্দচন্দ্র রায়ের বাসায় । বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের মধ্যে প্রায় সবাই ছিলেন হয় জমিদার, তালুকদার, নয় সরকারি কর্মচারী অথবা উকিল। দু’একজন মুসলমানও উপস্থিত ছিলেন এ সভায়। এবং তাঁরা সবাই নবাবের প্রস্তাবে অসম্মতি জানিয়েছিলেন।
ঢাকার আরেকজন প্রভাবশালী নাগরিক বলিয়াদীর জমিদার কাজেমউদ্দিন সিদ্দিকীর বাসায় মহম্মদীয়ান ফ্রেন্ডস ইউনিয়ন এসােসিয়েশনের এক সভা আহ্বান করা হয়েছিলাে ১৯০৪ সালের ২৫ জানুয়ারি। সভায় প্রস্তাবের বিরােধিতা করা হয়েছিলাে। তাদের একটি প্রধান যুক্তি ছিল—“মহসীন ফণ্ডের উপকারিতা হইতে বঞ্চিত হইলে মুসলমান সম্প্রদায়ের অনিষ্ট হইবে।”৪৫
পরের দিন নর্থব্রুক হলে একটি সভায় “মফস্বলবাসী জমিদার প্রভৃতি সৰ্বশ্রেণীর ভূম্যধিকারীবর্গ বিশেষ সম্ভ্রমের সহিত” বাংলা বিভাগ প্রস্তাবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জ্ঞাপন করেছিলেন। এই সভায় ন’টি প্রস্তাব গৃহীত হয়েছিলাে। তার মধ্যে উল্লেখ্যযােগ্য পাঁচটি প্রস্তাব ছিল—এক, এই বিভাজন বাংলা সাহিত্যের মান নীচু করবে এবং পূর্ব ও পশ্চিম বাংলার মধ্যে যে সামাজিক ঐক্য বিদ্যমান তা ছিন্ন করবে। দুই. এই অঞ্চলের জনগণ বঞ্চিত হবে লেজিসলেটিভ কাউন্সিলের সুবিধা থেকে এবং আঞ্চলিক বাজেট আলােচনায় লােকাল কাউন্সিলের একজন সদস্য নির্বাচনের সুযােগ হারাবে। তিন. বাংলাদেশের ভূমি
ব্যবস্থার জটিল আইনসমূহ, নতুন প্রদেশের নতুন কর্মচারীদের হাতে পড়ে আরও জটিল হয়ে উঠবে। চার, উপযুক্ত বিদ্যায়তনের অভাবে এ অঞ্চলে উচ্চমানের অবনতি ঘটবে এবং পাঁচ, বাংলা বিভাগ প্রস্তাবের ফলে কলকাতায় থাকছে হাই কোর্ট, অন্যদিকে প্রশাসনিক ব্যবস্থার কেন্দ্র থাকবে অন্য অঞ্চলে, ফলে বিভিন্ন অঞ্চলে জমিদারদের কর্মচারী নিয়ােগ করার ব্যাপারে অসুবিধা হবে।৪৬ মনে হয় শেষােক্ত কারণেই বিশেষ করে জমিদাররা কর্মচারী নিয়ােগ করার ব্যাপারে বঙ্গভঙ্গ মেনে নিতে পারছিলেন না। সরকারি এক চিঠিতে জানা যায় ঢাকা বিভাগের জমিদাররা স্বার্থগত কারণে এই বিভাগের বিরােধিতা করছিলেন।৪৭
এর পরদিন ঢাকার গ্র্যাজুয়েটরা নর্থব্রুক হলে বাংলা বিভাগের বিরােধিতা করে চারটি প্রস্তাব গ্রহণ করেছিলেন যার মধ্যে একটি প্রস্তাব ছিল আগের দেওয়া প্রস্তাবগুলাে থেকে একটু ভিন্নতর। ঐ প্রস্তাবের মাধ্যমে গ্র্যাজুয়েটরা আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছিলেন যে, বাংলা বিভাগের ফলে পূর্বাঞ্চলের অধিবাসীদের চাকুরি পাবার বেলায় প্রতিকূলতার সৃষ্টি হতে পারে।৪৮
ঐ একই দিন, বিকেলে, একই জায়গায় ঢাকা জিলাস্থিত বিভিন্ন গ্রামের শতাধিক প্রতিবাদ সভা হইতে নির্বাচিত অন্য এক সহস্র প্রতিনিধি” এবং “ঢাকার বিরাট সভা, জমিদার সভা, গ্রাজুয়েট সভা এবং মুসলমান প্রতিনিধি সভায় নির্বাচিত ডেলিগেটরা এক সভার আয়ােজন করে বঙ্গভঙ্গের বিরােধিতা করেছিলাে। ঐ সভা মােট বারােটি প্রস্তাব গ্রহণ করেছিলাে যা ছিল পূর্বোল্লিখিত প্রস্তাবগুলিরই রকমফের। এই সভা কলকাতার প্রতিবাদ সভায় প্রেরণের জন্যে ৪৯ সদস্যবিশিষ্ট একটি সাব-কমিটি গঠন করেছিলাে যার মধ্যে ৪৩ জন ছিলেন হিন্দু সদস্য, ৫ জন মুসলমান এবং একজন ইংরেজ।৪৯
একই সময়ে ঢাকার ইমামগঞ্জের প্রসিদ্ধ বক্তা মাস্টার হেদায়েত বক্সের উদ্যোগে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়েছিলাে ঢাকার মুসলমান সর্দারদের নিয়ে। হেদায়েত বক্স উর্দু ও বাংলায় পুরাে বিষয়টি বুঝিয়ে দিলে সবাই এর তীব্র বিরােধিতা করেছিলেন। হেদায়েত বক্স যে বিষয়টির ওপর বিশেষ জোর দিয়েছিলেন তা হলাে, আসামে বিশুদ্ধ মুসলমানের একান্তই অভাব। ঢাকা ময়মনসিংহ যদি আসামের সঙ্গে যুক্ত হয় তবে পূর্ববঙ্গের মুসলমানদের ঐ অঞ্চলের অধিবাসীদের সঙ্গে বাধ্য হয়ে বিবাহবন্ধনে মিলিত হতে হবে যার ফলে ‘শােণিত দোষের সৃষ্টি হবে মুসলমান সমাজে ।৫০
পূর্ববঙ্গে সরকারি বক্তব্যের সমর্থনে জনমত গড়ে তােলার জন্যে লর্ড কার্জনের আগমনের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা মিউনিসিপালিটি ও ডিস্ট্রিক্ট বাের্ড থেকে অভিনন্দনপত্র : দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছিলাে। কিন্তু তা নিয়েও ঝড় উঠেছিলাে বিতর্কের। “অভিনন্দনে বঙ্গ বিভাগ সম্বন্ধে প্রতিবাদ করিয়া অবশেষে নাকী লিখা হইয়াছে যে, যদি একান্তই বিভাগ করিতে হয় তবে বঙ্গের অপর কিয়দংশ লইয়া লেজিসলেটিভ কাউন্সিল সহ একজন লেপ্টেন্যান্ট গভর্ণর নিযুক্ত এবং ঢাকাতে রাজধানী স্থাপিত করা হউক।” কিন্তু শেষােক্ত এই প্রস্তাব নিয়েও দু’দিন জোর বিতর্ক চলে এবং নির্বাচিত সদস্যসংখ্যা বেশি হওয়ায় ঐ প্রস্তাব পাশ হয়ে গিয়েছিলাে। ডিস্ট্রিক্ট বাের্ডেও ঘটেছিলাে ঠিক একই
ব্যাপার। “জনসাধারণের অনভিপ্রেত মন্তব্য অভিনন্দনে সন্নিবেশিত হওয়ায় বাের্ডের আটজন সদস্য পদত্যাগ করেন।৫১
ফেব্রুয়ারির ৭ তারিখ (১৯০৪) জগন্নাথ কলেজে অনুষ্ঠিত হয়েছিলাে মুসলমানদের এক সভা। সভায় সভাপতিত্ব করেছিলেন ভারতের মােগল সম্রাটবর্গের পুরােহিত বংশদ্ভূত শতাধিক বর্ষীয় বৃদ্ধ শ্রীযুক্ত সৈয়দ গােলাম মুস্তফা আল হােসেনি।” সভায় ঠিক করা হয়েছিলাে আসন্ন বিপদ বহ্নি’ র্থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যে সবাই মসজিদে প্রার্থনা করবেন এবং এ প্রস্তাবের পক্ষে কেউ বললে “এই সভার উপস্থিত সভ্যমণ্ডলী অতি দৃঢ়তার সহিত সসম্মানে তাহার প্রতিবাদ করিবেন।”৫২
কিন্তু একই সময় দেখা যাচ্ছে খানিকটা ফাটল ধরেছিলাে মুসলমান জনমতে। নবাব সলিমুল্লাহ প্রস্তুতি গ্রহণ করছিলেন সরকার পক্ষ সমর্থনের যদিও তিনি তখনও যান নি পুরােপুরি সরকার পক্ষে। ডিস্ট্রিক্ট বাের্ডের অভিনন্দনপত্রে নতুন প্রস্তাব সংযােজিত হওয়ায় ‘ঢাকা প্রকাশ’ মন্তব্য করেছিলাে-“নবাব বাহাদুর পরিচালিত মুসলমান সম্প্রদায়ের অভিনন্দনেও এই নতুন প্রস্তাবের অনুমােদন প্রকাশিত হইবে সুতরাং বঙ্গের প্রাচীন রাজধানীর পরিণাম কিরূপ দাঁড়াইবে তাহা সহজেই অনুমেয়।” বড়লাটকে দেওয়া মুসলমান সভার অভিনন্দনপত্রে বলা হয়েছিলাে যে, বর্তমানে যেসব প্রতিবাদ আন্দোলন হচ্ছে তাতে তারা অংশ নিচ্ছেন না বটে কিন্তু বিরােধিতা করছেন। বাংলা বিভাগের। ৫৩
মার্চ মাসে (১৯০৪) জনসাধারণ সভার সভাপতি ও ঢাকা ল্যান্ড হােল্ডারস এসােসিয়েশনের সেক্রেটারি, জমিদার ও উকিল আনন্দচন্দ্র রায় বাংলার লেঃ গভর্নরকে এক দীর্ঘ স্মারকলিপি প্রেরণ করেছিলেন। এতে তিনি অবতারণা করেছিলেন ষাটটি যুক্তির।৫৪
ঢাকা ব্যতীত পূর্ববঙ্গের অন্যান্য অঞ্চলে জনমত গড়ে তুলতে প্রধানত সাহায্য করেছিলেন ঢাকার জনসাধারণ সভার নেতৃবৃন্দ। এ ছাড়া মফস্বলের জমিদার, তালুকদার। ও পেশাদার বা মধ্যশ্রেণী এর নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। ঢাকা প্রকাশ’-এ মফস্বলে অনুষ্ঠিত যেসব সভার বিবরণ পাওয়া গেছে তার সংখ্যা মােট ১৯৬! এইসব সভায় সভাপতিত্ব করেছিলেন জমিদার বা তালুকদার, প্রত্যন্ত গ্রামে স্কুলমাস্টার বা ঐ অঞ্চলের কোনাে প্রভাবশালী ব্যক্তি। প্রতিবাদ সভাগুলােতে সবাই একবাক্যে ‘বঙ্গ বিভাগ প্রস্তাবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন।
মফস্বলে, ঢাকার পর বিরাট সভা অনুষ্ঠিত হয়েছিলাে ময়মনসিংহে। “এই অধিবেশনে নগরে অনুন্য ৫০ হাজার লােকের সমাগম হইয়াছিল। ৩০/৩৫ হাজার লােক অধিবেশনে উপস্থিত হইতে সমর্থ হইয়াছিল। এই মহাসভায় একশােজন বক্তৃতা দিয়াছিলেন। উল্লেখযােগ্য বক্তারা ছিলেন, অভ্যর্থনা কমিটির সভাপতি বাবু জগৎকিশাের আচার্য চৌধুরী, সূর্যকান্ত আচার্য চৌধুরী, আনন্দমােহন বসু, এবং সুসঙ্গের মহারাজ কুমুদ চন্দ্র সিংহ।”৫৫ এ সংবাদ যে অতিরঞ্জিত সন্দেহ নেই, তবে শহরের লােক বােধহয় খানিকটা আলােড়িত হয়েছিলাে। শুধু তা-ই নয় শহরের ২৩টি মসজিদে নাকি মুসলমানরা জমায়েত হয়ে খােদার কাছে প্রার্থনা জানিয়েছিলেন যাতে এ প্রস্তাব কার্যকর না হয় ।৫৬
মফস্বলে অনেকগুলি সভাতেই সভাপতিত্ব করেছিলেন ঐসব অঞ্চলের সুপরিচিত মুসলমান ব্যক্তিবর্গ। যেমন জানুয়ারি মাসে (১৯০৪) চট্টগ্রামে এক জনসভা হয়েছিলাে। সেখানে সভাপতিত্ব করেছিলেন আনােয়ার আলী খ। সভার প্রস্তাবাবলী পাঠানাে হয়েছিলাে লর্ড কার্জনকে। বাংলা বিভাগের বিরুদ্ধে তাদের প্রধান কয়েকটি যুক্তি ছিল–
ক, যদি প্রশাসনিক কারণেই বঙ্গভঙ্গ হয় তা হলে উড়িষ্যাকে আলাদা করে নিলেই তাে হয়।
খ, চট্টগ্রাম বন্দরের উন্নতিই যদি সরকারের কাম্য তা হলে এর উন্নতি না হওয়ার কোনাে কারণ নেই। বরং বন্দরের উন্নতির জন্যে বাংলার নিজস্ব সম্পদই যথেষ্ট। সুতরাং আসামের মতাে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে পশ্চাৎপদ প্রদেশের অন্তর্গত হয়ে কি লাভ?
গ, শুধু তা-ই নয়, আসাম সরকারের এত অর্থ নেই যে তাদের শিক্ষায়তনগুলির জন্যে ভালাে শিক্ষক নিয়ােগ করবেন। সেক্ষেত্রে আসাম প্রদেশের শিক্ষার মান নেমে যাবে।৫৭
সিলেট থেকে পৌরসভার চেয়ারম্যান সরকারকে এক নােটে এই সময় জানিয়েছিলেন যে, ঢাকা এবং ময়মনসিংহের লােকেরা শিক্ষিত এবং নতুন প্রদেশ হলে সব তাদের একচেটিয়া থাকবে। শুধু তা-ই নয়, এসব অঞ্চলের লােকেরা মেঘনার পূর্বদিকের লােকদের আদিম বলে মনে করে ফলে এদের সহাবস্থান হতে পারে না। সুতরাং চট্টগ্রামকে আসামের সঙ্গে যােগ করা হােক (বন্দরের সুবিধার জন্যে)। ঢাকা ময়মনসিংহকে বাদ দিয়ে, আসাম ও পূর্ববঙ্গের অন্যান্য অঞ্চল নিয়ে লেঃ গভর্নরের অধীনে একটি নতুন প্রদেশ হতে পারে।৫৮ ফেনীর জনগণের পক্ষ থেকে আবদুল মজিদ ও অন্যান্য বাংলা বিভাগের প্রতিবাদ জানিয়ে সরকারকে স্মারকলিপি প্রেরণ করেছিলেন।৫৯ বরিশালে প্রবীণ ও নবীনরা আন্দোলন চালাবার জন্য গঠন করেছিলাে, দু’টি দল—প্রবীণদের নিয়ে গঠিত হয়েছিলাে ‘নেতৃসংঘ’ এবং যুবকদের নিয়ে কর্মসংঘ। কর্মীসংঘের উদ্যোক্তা ছিলেন অশ্বিনীকুমার রায়। এ দলের সদস্যরা বরিশাল শহরের পথে বক্তৃতা দিয়ে জনমত সংগঠিত করতেন। ৬০
১৯০৪ সালের জানুয়ারি মাসে ঢাকা জেলার বিভিন্ন গ্রাম থেকে জনসভা করে বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে কমিশনার অফিসে স্মারকলিপি প্রেরণ করা হয়েছিলাে। এ ধরনের প্রায় পঞ্চাশটি স্মারকলিপি পরীক্ষা করে দেখেছি। তাতে দেখা যাচ্ছে বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে তার দুটি যুক্তি প্রদান করেছে এবং একই ভাষা ও ভঙ্গিতে এ যুক্তিগুলি লেখা হয়েছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে বলা যেতে পারে, পত্রিকায় যে স্বতঃস্ফূর্ত জনসভার কথা উল্লেখ করা হয়েছে আসলে সব সভা ‘স্বতঃস্ফুর্ত ছিল না। বরং মনে হয় ঢাকা থেকে জনসাধারণ সভা যে স্মারকলিপি তৈরি করে পাঠিয়েছিলাে তা-ই নকল করে প্রত্যেকটি অঞ্চল থেকে আবার পাঠানাে হয়েছিলাে কমিশনার অফিসে। প্রতিটি স্মারকলিপির ভাষা ও যুক্তি ছিল এরকম—
“মহা মহিমান্বিত শ্রীল শ্রীযুক্ত বঙ্গীয় ছােটলাট বাহাদুর সমীপে।
১. ঢাকা জেলা বঙ্গদেশ হইতে পৃথক করিয়া আসামভুক্ত করিবার জন্য ভারত গভর্ণমেন্ট আপনার মতামত জানিতে চাহিয়াছেন।
২. আমরা আসাম প্রদেশভুক্ত হইতে অত্যন্ত অনিচ্ছুক।
৩. বঙ্গীয় গভর্ণমেন্টের সুশাসনে থাকিয়া আমাদের শিক্ষা ও বিচার প্রণালী নানা প্রকারে অগ্রসর হইয়াছে এবং সমস্ত ভারতবর্ষের রাজধানী কলিকাতা মহানগরীর নিকটবর্তী থাকিয়া আমাদের রীতি নীতি, সামাজিক শিক্ষা ও আচার ব্যবহার নানা প্রকারের উন্নত হইয়াছে। সম্প্রতি ঢাকা ও ময়মনসিংহ আসামভুক্ত হইলে আমাদের রাজধানীর সংস্রব ক্রমে দুর্বল হইবে ।
৪. মহামান্য হাইকোর্ট ও গভর্ণমেন্ট এক্ষণ কলিকাতায় থাকায় আমরা মামলা মােকাদ্দমা ও সৰ্ব্বপ্রকার কাজকর্ম করিতে কলিকাতায় যাইয়া থাকি, কিন্তু এ জেলা আসামভুক্ত হইলে আমাদের কতক কার্যের জন্য অন্যত্র যাইতে হইবে। ইহা আমাদের পক্ষে অত্যন্ত অসুবিধার কারণ।
৫. কলিকাতা, যশােহর, খুলনা, পাবনা, ফরিদপুর, বরিশাল প্রভৃতি পশ্চিমবঙ্গের অধিকাংশ জেলার লােকের সহিত আমাদের বিবাহাদি সামাজিক কার্য সম্পন্ন হইয়া থাকে। বঙ্গদেশের আয়তন এখন ক্ষুদ্র করিলে আমাদের পরস্পরের সামাজিক ক্রিয়ার বর্তমান প্রশস্ত স্থান ক্রমে সংকীর্ণ হইবে, ইহাতে আমাদের সামাজিক ও আর্থিক ক্ষতি হইবে।
৬, পশ্চিম ও পূর্ববঙ্গ দেশের কথাবার্তা এক ভাষায় প্রচলিত; এই সকল লােক এক গভর্ণমেন্টের অধীন থাকাই বাঞ্ছনীয়। কিন্তু বর্তমান পরিবর্তনে আমাদের জাতীয় ভাষার অবনতি হইবে এবং আসাম গভর্ণমেন্টেরও কাজকর্ম পরিচালিত হইতে সামান্য অসুবিধা হইবে না।”
এ ছাড়া আঠারােটি টেলিগ্রামও দেখেছি যা পাঠানাে হয়েছিলাে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে। বক্তব্য একটি—ঢাকাকে আসামের অন্তর্ভুক্ত করা যাবে না।
আবার ১২.১.১৯০৪-এ বাখরগঞ্জে অনুষ্ঠিত সভার সভাপতি কেদারনাথ দত্ত ঢাকার কমিশনারকে এক স্মারকলিপিতে ঢাকাকে আসামের অন্তর্ভুক্ত করার প্রতিবাদ জনিয়ে লিখেছিলেন যে, তারা শুনেছেন এর সঙ্গে বাখরগঞ্জ ও ফরিদপুরকেও নাকি অন্তর্ভুক্ত করা হবে। ফলে, তাঁরা যুক্তি দেখিয়েছেন, ঢাকার সঙ্গে তাঁদের কোনাে সম্পর্ক নেই, যা আছে তা কলিকাতার সঙ্গে। সুতরাং, ঢাকা-কে যদি আসামের অন্তর্ভুক্ত করাই হয় তবে বাখরগঞ্জ ও ফরিদপুরকে যেন বাদ দেয়া হয়। তাঁদের মতে, সামাজিক, বাণিজ্যিক, সরকারি কাজকর্মে ঢাকার সঙ্গে বাখরগঞ্জ, ফরিদপুরের সম্পর্ক খুবই ক্ষীণ। শুধু তা-ই নয়—-
“That apart from the question of proposed transfer and even if Bengal is allowed to remain intact as before, your memorialists submit that in consideration of the circumstances set forth in this memorial, it is high time for the Govt. to consider, whether the district of Backergunge and Faridpur should be allowed to remain within the division of Dacca.”৬১
সরকারি পক্ষের যুক্তি উপস্থাপনের জন্য, ১৯০৪-এর ফেব্রুয়ারিতে লর্ড কার্জন পূর্ববঙ্গ সফর করেছিলেন। কার্জনের প্রধান যুক্তি ছিল প্রশাসনিক কারণে এ বিভাগ প্রয়ােজন, এ ছাড়া তাঁর মতে, দরিদ্র রায়, দোকানদার প্রভৃতি শ্রেণীর লােকজন এখনও প্রস্তাবটি বুঝতে পারে নি এবং এই সুযােগে শিক্ষিত শ্রেণী তাদেরকে সরকারের বিরুদ্ধে উত্তোজিত করছে। ঢাকা প্রকাশ’ এ পরিপ্রেক্ষিতে লিখেছিলাে, “বলিতে ঘৃণা ও লজ্জায় মরমে মরিয়া যাইতে হয়, পূর্ববঙ্গে রাজ প্রতিনিধির বাক্যজাল বিস্তার, সত্যসত্যই, এমনই হলাহল উদগীরণ করিয়া সভ্যতার শিরে দূরপনেয় কলঙ্ক অর্জন করিয়াছে।”৬২
কার্জনের পূর্ববঙ্গ সফরের পর, পূর্ববঙ্গের জনমত স্পষ্টত দ্বিখণ্ডিত হয়ে গিয়েছিলাে। কিছু ব্যতিক্রম বাদে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বী অধস্তন মানুষ বঙ্গভঙ্গ মেনে নিতে চেয়েছিলেন। অনেকে উল্লেখ করেছেন, নওয়াব সলিমুল্লাহর নেতৃত্বে মুসলমানরা সাম্প্রদায়িক কারণে বঙ্গভঙ্গের বিরােধিতা করেছিলেন। কিন্তু পূর্ববঙ্গের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ মুসলমান, তাদের কোনাে মতামত প্রকাশিত হলেই তা সাম্প্রদায়িক হতে হবে এমন কোনাে যুক্তি নেই। এ ছাড়া, অধস্তন অন্যান্য সম্প্রদায়ের মানুষ যে বঙ্গভঙ্গ সােচ্চারে বিরােধিতা করেছিলেন, এমন কোনাে সুস্পষ্ট প্রমাণ নেই; আসল ঝোকটি ছিল আঞ্চলিকতার, শতবর্ষের অবহেলার কারণে যা আরও জোরদার হয়ে উঠেছিলাে। এবং ১৯৭১ সালেও এই আঞ্চলিক বৈষম্যই বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে ছিল একটি প্রধান যুক্তি।
বঙ্গভঙ্গ ঘঘাষণার আগে মুসলমান নেতারা বিরােধিতা করেছিলেন আসামের সঙ্গে সংযুক্তির ও কলকাতা থেকে বিভক্তির। তাদের যুক্তি ছিল, অত্যন্ত পশ্চাৎপদ পূর্ববঙ্গের সঙ্গে আরও পশ্চাৎপদ আসামকে জুড়ে দিলে প্রদেশটি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।৬৩ কিন্তু আলাদা একটি একক হিসেবে পূর্ববঙ্গ পরিগণিত হলে এবং প্রশাসনিক কেন্দ্র স্থাপিত হলে যে প্রদেশটি উন্নত হবে, এ ভাবনা তারা ভাবেন নি। বঙ্গভঙ্গের পর দেখছি তাঁরা এ যুক্তিই তুলে ধরেছিলেন।
এ পরিপ্রেক্ষিতে নিজেদের অবস্থা সুসংহত করার জন্য ১৯০৫-এর ১৬ অক্টোবর পূর্ববঙ্গ ও আসামের মুসলমান সমিতিগুলি একত্রিত হয়ে ঢাকার নর্থব্রুক হলে সভা করে গঠন করেছিলাে মােহামেডান প্রভিনসিয়াল ইউনিয়ন। কলকাতার ‘মােহামেডান লিটারেরি সােসাইটি’ও সমর্থন করেছিলাে এ উদ্যোগ।৬৪
পূর্ববঙ্গে বঙ্গভঙ্গের পক্ষে জনমত নিয়ন্ত্রণ করেছিলেন নওয়াব সালমুল্লাহ। পূর্ববঙ্গে নওয়াব পরিবারের ছিল বিস্তৃত জমিদারি এবং তিনপুরুষ ধরে তাঁদের পরিবার ছিলেন পূর্ববঙ্গের অগ্রগণ্য পরিবার। পূর্ববঙ্গের অধিকাংশ মুসলমান ও হিন্দু ছিলেন নিরক্ষর কৃষক। এদের একটি বড় অংশ, বিশেষ করে মুসলমানরা নবাবকে মনে করতেন তাদের মুখপাত্র হিসেবে। আর মুসলমান মধ্যশ্রেণী বলতেও তখন তেমন কিছু ছিল না। যদি
থাকতাে তা হলে হয়ত অন্যরকম হত। যেমন, পরবর্তীকালে মুসলমান মধ্যশ্রেণী শক্তিশালী হয়ে উঠলে, নবাব পরিবারকে কর্তৃত্ব থেকে সরে যেতে হয়েছিলাে।
অনেকে মনে করেন, ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ায় ব্রিটিশ সরকার নবাবকে ঋণমুক্ত করার ব্যবস্থা নিয়েছিলেন এবং সে কারণে, নবাব বঙ্গভঙ্গ মেনে নিয়েছিলেন। একথা হয়ত আংশিকভাবে সত্যি, কিন্তু একথাও বিবেচনা করা দরকার যে, বঙ্গভঙ্গ হওয়ার অনেক পরে ব্রিটিশ সরকার নবাবকে ঋণ দিয়েছিলেন। নবাব স্বাভাবিকভাবেই ছিলেন সরকারের অনুগত প্রজা। ঋণ না পেলেও তিনি সরকারের বিপক্ষে যেতেন কি না সন্দেহ। নবাবের বঙ্গভঙ্গ মেনে নেওয়ার পেছনে বরং আরেকটি কারণ থাকতে পারে। সেটি আঞ্চলিক। পূর্ববঙ্গ আলাদা প্রদেশ এবং ঢাকা রাজধানী হলে তাঁর কর্তৃত্ব বৃদ্ধি পাবে এধরনের মনােগত ইচ্ছা যে তার ছিল না এমন কথা বােধহয় বলা যায় না।৬৫ বঙ্গভঙ্গ হওয়ার পর ভদ্রলােকদের, প্রধানত হিন্দু ভদ্রলােকদের বয়কট বা স্বদেশী আন্দোলন সাধারণ মুসলমানদের আরও দূরে ঠেলে দিয়েছিলাে এবং নবাবের সিদ্ধান্তই যে সঠিক একথা স্পষ্ট করে তুলেছিলাে। মুসলমানদের তখনকার প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়, আবুল মনসুর আহমেদের আত্মজীবনীতে। লিখেছেন তিনি, লর্ড কার্জন ময়মনসিংহে এলে তিনি মুরব্বিদের সঙ্গে গিয়েছিলেন লাটদর্শনে। “রাস্তার গাছে গাছে বাড়িঘরের দেওয়ালে দেওয়ালে ইংরাজীতে লেখা ডিভাইড আস নট : মুরুব্বীদের জিজ্ঞাসা করিয়া জানিতে পারি ওসব স্বদেশী হিন্দুদের কাণ্ড। মুসলমানদের খেলাফে দুশমনি।” ৬৬
এখানে খাজা আতিকুল্লাহ ও ঢাকার নবাব পরিবারের কিছু প্রসঙ্গ উল্লেখ করা প্রয়ােজন। আতিকুল্লাহ বিরােধিতা করেছিলেন বঙ্গভঙ্গের এবং অনেকে তা বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন। তিনি ছিলেন সলিমুল্লাহর সৎ ভাই, মহং কোনাে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থেকে তিনি এর বিরােধিতা করেছিলেন বলে মনে হয় না। সম্পত্তি নিয়ে তার বিরােধ ছিল সলিমুল্লাহর সঙ্গে। এ ছাড়া আতিকুল্লাহ আরও জানিয়েছিলেন যে, খাজা পরিবার সবসময় হিন্দু-মুসলমান স্বার্থ সমন্বয় করেছে। আমরা বরং বলতে পারি খাজারা সবসময় পূর্ববঙ্গে থেকেছেন, ঢাকার উন্নতিকল্পে প্রচুর দানধ্যান করেছেন এবং তারা ঢাকার প্রধান হিসেবেই সম্মানিত হতে ছিলেন আগ্রহী। যদি ঐ সময় তাদের কোনাে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থেকে থাকে তবে তা সে কারণেই।
এবার হিন্দু সম্প্রদায়ের কথায় আসা যাক। এ বিষয়ে শেখর বন্দ্যোপাধ্যায় বিস্তারিতভাবে আলােচনা করেছেন। দেখিয়েছেন তিনি, পূর্ববঙ্গে হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে বর্ণগত দিক থেকে নমশূদ্ররা ছিলেন সংখ্যাগরিষ্ঠ। রাজশাহী, ঢাকা, চট্টগ্রামে হিন্দুরা ছিলেন মােট জনসংখ্যার ৩২.৬২%, নমশূদ্র ছিলেন এর মধ্যে ১৬.৭৫%। যশাের খুলনার মােট হিন্দু জনসংখ্যার ১৩.৭৮% ছিলেন নমশূদ্র। শুধু তা-ই নয়, পূর্ববঙ্গে হিন্দু চাষীদের শতকরা ৯০% ছিলেন নমশুদ্র।৬৭
নমশূদ্ৰ নেতৃবর্গ ঢাকার নবাব সলিমুল্লাহর সঙ্গে যােগাযােগ করে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে তাঁরা বঙ্গভঙ্গকে সমর্থন করবেন এবং প্রতিরােধ করবেন এর বিরুদ্ধবাদীদের; এর উদাহরণ দেখি, বাখরগঞ্জে নমশূদ্রদের এক সভায় যেখানে তারা ঘােষণা করেছিলেন ব্রাহ্মণদের ঘৃণা ও অপছন্দ এবং কায়স্থ ও বৈদ্যদের কারণে বিরাট
এই নমশূদ্র সম্প্রদায় পশ্চাৎপদ। অথচ মুসলমান ও তারাই পূর্ববঙ্গে সংখ্যাগরিষ্ঠ; সুতরাং এই সম্প্রদায়ের বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই তাদের সঙ্গে কাজ করার বরং তারা হাত মিলিয়ে কাজ করবেন তাদের মুসলমান ভাইদের সঙ্গে।৬৮ ফরিদপুরেও তারা ঘােষণা করেছিলেন বঙ্গভঙ্গ ‘সেটলড ফ্যাক্ট’ এবং তা রদ করা যাবে না।৬৯
ইংরেজ সরকারের পক্ষে জনমতের এই বিভাজন বুঝতে দেরি হয় নি এবং এ দুর্বলতাকে তারা নিজ স্বার্থে কাজে লাগিয়েছিলেন।
মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠতা এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে নমশূদ্ৰগরিষ্ঠতা পূর্ববঙ্গকে প্রদান করেছিলাে আলাদা বৈশিষ্ট্য। এবং এর সঙ্গে খানিকটা হলেও যােগ ছিল আঞ্চলিকতার প্রশ্নটি, ষষ্ঠ শতাব্দীর শেষভাগ থেকে যার সুস্পষ্ট পরিচয় পাওয়া যায়।৭০ ঊনিশ শতকে পূর্ববঙ্গ থেকে প্রকাশিত সংবাদপত্রে দেখি (হিন্দু ভদ্রলােকদের দ্বারা পরিচালিত], অভিযােগ করা হচ্ছে এ বলে যে, পূর্ববঙ্গের পশ্চাৎপদ অবস্থা নিরসনের কোনাে প্রচেষ্টা নেওয়া হচ্ছে না। পূর্ববঙ্গবাসীদের বাঙাল’ বলে ঠাট্টা করা হচ্ছে। এবং এতেও প্রকাশ করা হয়েছিলাে ক্ষোভ ৭১ হাজার বছরের আঞ্চলিক চেতনাবােধ ১৯০৩৫ সালে হঠাৎ করে একেবারে মুছে গিয়েছিলাে তা বােধহয় একেবারে মেনে নেওয়া যায় না। চট্টগ্রামের জ্যোতি’ লিখেছিলাে, প্রদেশ ভাগ হলে হয়ত রাজধানী হবে চট্টগ্রাম এবং সেটা লাভজনক। পরে অবশ্য পত্রিকাটি বিরােধিতা করেছিলাে বঙ্গভঙ্গের।৭২ এ রেশ ধরেই লিখেছিলেন গিরিশচন্দ্র সেন–বঙ্গভঙ্গ তিনি সমর্থন করেন কারণ, এর ফলে পশ্চাৎপদ পূর্ববঙ্গের উন্নতি হবে এবং একথা ভেবে তাঁর “আহলাদ হইয়াছে। পশ্চিমবঙ্গের কথা ছাড়িয়াদি, বাঙ্গালদিগের উন্নতি দর্শন অনেকের চক্ষুশূল হইতে পারে। কলিকাতা অঞ্চলে পূর্ববঙ্গ নিবাসী কৃতবিদ্য লােকেরা কোনাে অফিসে তাহাদের কর্তৃক বাধা পাইয়া সহজে প্রবেশ করিতে পারেন না। এখানকার কেরানিগিরি প্রভৃতি কাজ এক প্রকার সেখানকার লােকেরই একচেটিয়া হইয়া রহিয়াছে।”৭৩ গিরিশচন্দ্র বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে বিপিনচন্দ্র পাল প্রমুখদের প্রচারকে ‘দুঃখব্রত বলেছেন। কারণ, তিনি বিশ্বাস করতেন বাংলাবিভাগ অর্থনৈতিক দিক থেকে পূর্ববঙ্গের জন্য কল্যাণকর। গিরীশচন্দ্র আরও লিখেছিলেন “আমার জন্মস্থান ঢাকা জিলায়, সে স্থানে আমার বাসগৃহ, আমি ঢাকা নিবাসী। ঢাকা রাজধানী হইলে, ঢাকা অঞ্চলের অনেক বিষয়ে উন্নতি হইতে চলিল ইহাতে আমার দুঃখ না হইয়া বরং আনন্দ হওয়াই স্বাভাবিক।”৭৪
একই ধরনের বক্তব্য দেখি প্রতিধ্বনিত হয়েছে নওয়াব আলী চৌধুরী ও সৈয়দ শামসুল হুদা এমনকি, সলিমুল্লাহর বক্তৃতায়। ১৯০৮ সালে মাদ্রাজ কংগ্রেসে বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে প্রস্তাব পাশ হলে নওয়াব আলী চৌধুরী এক বক্তৃতায় বলেছিলেন, “পুরনাে প্রশাসনে ব্ৰহ্মপুত্র, পদ্মা, মেঘনা অববাহিকা ছিল অবহেলিত। বর্তমানে নতুন প্রশাসন চালু হওয়ায় পূর্ববঙ্গ ফিরে পেয়েছে নতুন প্রাণ। কলকাতার হাত থেকে মুক্তি পাওয়ায় যেন জীবন স্পন্দন ফিরে এসেছে। … যদি পূর্ববঙ্গে ১০০ ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট এবং সমসংখ্যক সাব-ডেপুটি, মুনসেফ এবং সাব-রেজিস্ট্রার নিযুক্ত হন, তা হলে তারা হবেন এ দেশের মাটির হিন্দু মুসলমান ছেলেমেয়েরা।” তিনি এক্ষেত্রে ইংল্যান্ড আয়ারল্যান্ডে যে সমস্যা, পূর্ববঙ্গ কলকাতার সমস্যাটিকেও সেভাবে দেখেছেন। ৭৫
১৯০৯ সালে পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশের আইনসভায় সৈয়দ শামসুল হুদা বলেছিলেন-~পার্টিশনের আগে বেশির ভাগ অর্থই খরচ করা হতাে কলকাতার নিকটবর্তী অঞ্চলসমূহে। এবং সেরা কলেজ, হাসপাতাল এবং অন্যান্য সংস্থাগুলিও স্থাপিত হয়েছিলাে ভারতবর্ষের রাজধানী বা এর আশেপাশে এবং “We have inherited a heritage of the accumulated neglect of years …”৭৬ নওয়াব সলিমুল্লাহ বলেছিলেন, পূর্ব বাংলার রাজস্ব উদ্বৃত্ত ব্যয় করা হয় অন্যখানে।৭৭
ফিরে আসি পূর্ব প্রসঙ্গে। আগেই উল্লেখ করেছি, প্রথম দিকে শহরাঞ্চলীয় মুসলমান সম্প্রদায় বঙ্গভঙ্গের বিরােধিতা তেমনভাবে করেননি, কিন্তু কার্জনের পূর্ববঙ্গ সফরের পর মুসলমান নেতৃবর্গের সুর গিয়েছিলাে বদলে। সরকারি সমর্থন এর একটি কারণ হতে পারে। এবং অচিরেই নবাব সলিমুল্লাহ হয়ে উঠেছিলেন সরকারি বক্তব্যের প্রধান সমর্থক; কিন্তু প্রথম দিকে তেমনভাবে বিরােধিতা না করার কারণ কি? হয়ত পুরাে বিষয়টি ছিল তাঁদের কাছে অস্পষ্ট। এবং নিজ সম্প্রদায়ের স্বার্থগত বিষয়টি ছিল না স্পষ্ট। এখানে আরও উল্লেখ্য যে, পূর্ববঙ্গের প্রধান হিন্দু জমিদার ও দ্রলােক নেতারাই এখানকার প্রতিবাদসভাগুলির আয়ােজন করেছিলেন এবং কৌশলগত কারণে মুসলমানদের করেছিলেন সভাপতি। এই কৌশল পরে স্বদেশী আন্দোলনের সময়ও ব্যবহৃত হয়েছিলাে এবং সংবাদপত্রসমূহ এতে যুগিয়েছিলাে সমর্থন।৭৮
বঙ্গভঙ্গ প্রশ্নে মুসলমান বুদ্ধিজীবীরাও দ্বিমত পােষণ করতেন। যেমন, ইসমাইল হােসেন সিরাজী ছিলেন বঙ্গভঙ্গের বিপক্ষে। আবার মুনশী মেহেরুল্লাহ ছিলেন বঙ্গভঙ্গের পক্ষে। ৭৯ তবে, মনে হয়, মুসলমানদের অনেকে যে বঙ্গভঙ্গ সমর্থন করেন নি তার প্রধান কারণ, তাঁদের রাজনৈতিক বিশ্বাস। পূর্ববঙ্গের দুই প্রধান সম্প্রদায়ের মধ্যশ্রেণী যখন দু’রকম কথা বলছে তখন ঢাকায় মুসলমান সমিতির একটি অধিবেশন হয়েছিলাে, তাতে সভাপতিত্ব করেছিলেন কালীপ্রসন্ন ঘােষ। ঐ অধিবেশনে সিরাজী তার বক্তৃতায় বলেছিলেন … “ভারতে হিন্দু-মুসলমান এক বৃন্তে দুটি ফুল বা একই দেহের অঙ্গান্তর মাত্র। এক দেহের উভয় অঙ্গ মধ্যে সম্প্রীতি সংস্থাপিত হইবে না, বিদ্বেষ প্রণােদিত না হইলে কেমন করিয়া একথা বিশ্বাস করা যাইতে পারে। ভারতের জীবন-শক্তি এবং বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সুখসম্পদ এই জাতির একপ্রাণতার উপরই নির্ভর করে।”৮০ সিরাজী ছিলেন কংগ্রেসে এবং পূর্ববঙ্গে সে সময় (যখন আন্দোলন তুঙ্গে এবং মুসলমানরা এর বিরােধিতা করেছে এ ধরনের ঘটনা ব্যতিক্রম মাত্র।
১৯১১ সালের ১২ ডিসেম্বর সম্রাট পঞ্চম জর্জ দিল্লি দরবারে বঙ্গভঙ্গ রদ ও কলকাতা থেকে দিল্লিতে রাজধানী স্থানান্তরের কথা ঘােষণা করেন। এ ঘােষণার জন্য মানসিকভাবে অনেকেই প্রস্তুত ছিল না, পূর্ববঙ্গ তাে নয়ই। খুবই গােপনে, সম্রাটের আগ্রহে বঙ্গভঙ্গ রদের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছিলাে। রদের প্রক্রিয়া নিয়ে একমাত্র সৈয়দ আনােয়ার হােসেনের একটি লেখাই চোখে পড়েছে। এ প্রবন্ধে তিনি বঙ্গভঙ্গ রদের
প্রক্রিয়ায় বাদানুবাদ বিষয়ে বিস্তারিত উল্লেখ করেছেন।৮১ বিষয়টি আমাদের আলােচনার বাইরে দেখে বিস্তারিত উল্লেখ করলাম না।
উপযুক্ত বিবরণের ভিত্তিতে বলা যেতে পারে, বঙ্গভঙ্গের উদ্যোগটি প্রথমে ছিল প্রশাসনিক কিন্তু এর সঙ্গে পরে যুক্ত হয় রাজনৈতিক সুবিধালাভের চিন্তা। বঙ্গভঙ্গ প্রস্তাব দেয়া থেকে বঙ্গভঙ্গ কার্যকর হওয়া পর্যন্ত সারা বাংলায় বঙ্গভঙ্গবিরােধী আন্দোলন গড়ে ওঠে। আন্দোলনের কেন্দ্র ছিল কলকাতা। আন্দোলনকারীদের কৃতিত্ব এই যে, প্রথমবারের মতাে সারা বাংলায় তারা সমভাবে একটি আন্দোলন গড়ে তােলার পদ্ধতি তৈরি করেছিলেন যা ছিল শৃঙ্খলাপূর্ণ। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন জনমত সংগঠনের একটি নেটওয়ার্ক তৈরির পদ্ধতিতে অভিজ্ঞ করে তুলেছিলাে রাজনীতিবিদদের যা তারা পরে ব্যবহার করতে পেরেছিলেন বিভিন্ন আন্দোলনে।
বঙ্গভঙ্গবিরােধী আন্দোলন সীমাবদ্ধ ছিল মূলত শহরে, বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের ভদ্রলোেকদের মধ্যে। আন্দোলন জোরদার হয়ে উঠেছিলাে ঢাকায় এবং ময়মনসিংহে বা ঢাকারই কাছাকাছি। অন্যান্য অঞ্চলেও যে বাদপ্রতিবাদ খানিকটা হয় নি তা নয়, তবে তা এ দুটি শহরের তুলনায় কিছুই নয়। নানাবিধ কারণে আলােড়িত হয়েছিলেন ভদ্রলোেকরা যার মধ্যে আবেগও ছিল একটি প্রধান উপাদান। বঙ্গভঙ্গ প্রস্তাবকে নিয়েছিলেন তাঁরা মাতৃভূমিকে দ্বিখণ্ডিত করার চক্রান্ত হিসেবে। স্বার্থগত কারণ তাে ছিলই যা বিভিন্ন সভায় নেয়া প্রস্তাবগুলিতেই ফুটে উঠেছে। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের একজন প্রধান নেতা সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন তাঁর আত্মজীবনীতে, বাংলা দুটি প্রদেশে বিভক্ত করে, বাংলাভাষীদের একটি প্রদেশে ও অন্যদের আলাদা প্রদেশে রাখলে দূর হতাে সব ধরনের প্রশাসনিক অসুবিধা ও জনমত থাকতাে শান্ত। শুধু বাংলাভাষী বলতে তিনি কাদের বুঝিয়েছেন তা অবশ্য বলেন নি। আসামে কি বাংলাভাষী ছিলেন না? এবং আসামকেতাে ১৮৭৪ সালেই চীফ কমিশনারের অধীনে নেওয়া হয়েছিলাে।
আসলে মধ্যশ্রেণী ক্রুদ্ধ হয়ে উঠেছিলাে, বিশেষ করে মধ্যশ্রেণীর নেতবর্গ, যাদের সঙ্গে ইংরেজ সরকারের আলাপ আলােচনা করতে হতাে। এ ক্রোধের কারণে, পূর্ববঙ্গের বাস্তবতা এড়িয়ে গিয়েছিলাে তাদের চোখ। সুরেন্দ্রনাথ লিখেছেন
“We felt that we had been insulted, humiliated and tricked, we felt that the whole of our future was at stake, and that it was a deliberate blow aimed as the growing solidarity and selfconsciousness of the Bengalee-speaking population.৮২
শুধু তা-ই নয়, বঙ্গভঙ্গবিরােধী তকালীন নেতাদের মনে খানিকটা সাম্প্রদায়িক চিন্তাভাবনা যে কাজ করেনি তাও নয়। হতে পারে তা ছিল সামান্য, কিন্তু তা ছিল। যেমন ১৯০৫ সালের ৭ আগস্ট কলকাতা টাউনহলে এক সভায় কাশিমবাজারের মহারাজা মনীন্দ্রচন্দ্র নন্দী বলেছিলেন—
“নতুন প্রদেশে মুসলমানরা হবে প্রভাবশালী। হিন্দুরা পরিণত হবে সংখ্যালঘুতে। স্বদেশী আমরা হয়ে উঠবাে আগন্তুক। নিজেদের জাতির ভবিষ্যৎ ভেবে আমার আশঙ্কা হচ্ছে।”৮৩
অর্থাৎ প্রবল আবেগের ভেতরেও ছিল মুসলমান আধিপত্য ও সম্প্রদায়গত স্বার্থহানির শঙ্কা।
শহর ছাড়া, মফস্বল বা গ্রামেও যে জনসভা কিছু হয় নি তা নয়। কিন্তু তাই বলে যদি আমরা ধরে নিই, সাধারণ মানুষও এতে আলােড়িত হয়েছিলাে তা হলে ভুল হবে। কারণ, তা হলে বঙ্গভঙ্গ সম্ভব হতাে না [যেমন ১৯৭১ সালে পাকিস্তান পারেনি। আর সাধারণ মানুষ কেন আলােড়িত হয় নি তার ইঙ্গিত আগেই করেছি, কারণ বঙ্গভঙ্গ প্রত্যক্ষভাবে তাদের কোনাে স্বার্থের সঙ্গে জড়িত ছিল না। জনসমর্থনের এ ধারাটি এতদিন কোনাে রচনায় গুরুত্ব পায় নি। তাই বঙ্গভঙ্গের জনপ্রতিক্রিয়াটিকে একটি দৃষ্টিকোণ থেকেই বিচার করা হয়েছে। পূর্ববঙ্গের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ বঙ্গভঙ্গ চেয়েছে কারণ তা ছিল তাদের অঞ্চলের উন্নতির জন্য সহায়ক। আসামের সঙ্গে তাদের সংযুক্তিকরণে তাদের তাই কোনাে আপত্তি ছিল না।
তবে এটা স্বীকার্য যে, ১৯০৫ পর্যন্ত বিভিন্ন আন্দোলনগুলির মধ্যে বঙ্গভঙ্গই একমাত্র আন্দোলন যার ব্যাপকতা ছিল, আন্দোলনের পক্ষে বিপক্ষে অংশগ্রহণকারী মানুষের সংখ্যাও ছিল বেশি। পরবর্তীকালে আরও ব্যাপক ভিত্তিতে গড়ে ওঠা স্বদেশী বা স্বরাজ আন্দোলনের ভিত্তি ছিল বঙ্গভঙ্গের আবেগজাত উপাদানাবলী যা ঔপনিবেশিক সরকারবিরােধী আন্দোলনে পরিণত হয়েছিলাে। বঙ্গভঙ্গের ফলে কিন্তু আবার আবির্ভাব হয়েছিলাে এক নতুন শ্রেণীর নেতাদের যারা আবার চিহ্নিত হয়ে গিয়েছিলেন হিন্দু সম্প্রদায়ের সঙ্গে।৮৪ অন্যদিকে মুসলমানরাও সম্প্রদায় হিসেবে আরও সচেতন হয়ে উঠেছিলেন এ আন্দোলনের ফলে যার পরিণতি ঘটেছিলাে মুসলিম লীগ ও অন্যান্য ঘটনাবলীতে। শহুরে মুসলমান ও হিন্দু সম্প্রদায়ের সম্পর্কে অনেকাংশে ফাটল ধরিয়েছিলাে বঙ্গভঙ্গ। এ ফাটল আর জোড়া লাগে নি। ১৯৪৭ সালে, দুই বঙ্গ একত্রে রাখার চেষ্টাও তাই ফলবতী হয় নি। ৮৫
তথ্যপঞ্জি
১. বঙ্গভঙ্গসংক্রান্ত সরকারি নথিপত্রে ইংরেজ সিভিলিয়ানদের যুক্তিগুলি উল্লিখিত হয়েছে। এ সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণের জন্য দেখুন— Further Papers Relating to the Reconstruction of the Provinces of Bengal and Assam, London, 1905. এর পর উল্লেখ করা হবে FPRPBA নামে।
২. John R. Mclane, “The Decision to Partition Bengal in 1905′, The Indian Economic and Social History Review, vol. II. No. 3. Delhi, July, 1965.
৩. Sumit Sarkar, The Swadeshi Movement, New Delhi, 1973, Chaptei
০৪. এমাজউদ্দীন আহমদ, ১৯০৫ সালের বঙ্গ বিভাগ : একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক পদক্ষেপ’, মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত, বঙ্গভঙ্গ, ঢাকা, ১৯৮১। [এরপর উল্লেখ করা হবে বঙ্গভঙ্গ নামে। বিস্তারিত বিবরণের জন্য, অমলেশ ত্রিপাঠী, ভারতের মুক্তি সংগ্রামে চরমপন্থী পর্ব (অনুবাদ : নির্মল দত্ত), কলকাতা, ১৯৮৭, তৃতীয় অধ্যায়।
Richard Paul Cronin, British Policy and Administration in Bengal 1905–1912, Calcutta, 1977. Ajit K. Neogy, Partitions of Bengal, Calcutta, 1987.
৬.বঙ্গভঙ্গের প্রশাসনিক কারণের পক্ষে লিখেছেন কে, এম, মােহসীন। দেখুন তার প্রবন্ধ, কে, এম, বঙ্গভঙ্গ বঙ্গভঙ্গ।
৭. ফ্রেজার তার আত্মজীবনীতে এ প্রসঙ্গে লিখেছেন : “The result of this was that many of the Districts of Eastern Bengal had been practically neglected. There were many reasons which led the ordinary head of a department, when he found that he could not overtake efficiently his whole charge, to give to Orissa and western Bengal such time as he had at his disposal; and the Disticts of Eastern Bengal suffered most from the undue pressure of work.” Sir Andrew H.L. Fraser, Among Indian Rajhas and Ryots, Allahabad,, 1975. PP. 323–324.
৮.উদ্ধৃত, এমাজউদ্দীন আহমদ, পূর্বোক্ত প্রবন্ধ, বঙ্গভঙ্গ।
৯. ঐ
১০. ঐ
১১. দেখুন Lovat Fraser, India under Curzon and After, London, 1911.
১২. ফ্রেজার আরও উল্লেখ করেছিলেন—”The difficulty of administering it properly was immense. Any officer transferred to that District from any other part of the central provinces had to acquire the Uriya language. The police, revenue and other department had to be manned either by men belonging to the District itself, or by Uriyas imported from the Orissa Division in Bengal, or by men unacquainted with the language and traditions of the Uriya people.” O.p.cit, p. 316. so. 9:0381
১৩. ঐ, পৃঃ ৩২১
১৪. ফ্রেজার লিখেছেন—”In Bengal, as it was constituted before the partition, there was an area of nearly two hundred thousand square miles, with seventy-eight and a half millions of people. It had been growing increasingly difficult, until it had become practically · impossible, to conduct efficiently the administration of this great province. It was not a matter only of the burden of work laid on the Lieutenant-Governor, but rather of the impossibility of efficient working of the various department of the Government. No head of a department was able efficiently to deal with the great charge committed to him.’ op.cit. p. 323. ১৫. “For 14 months it never occured to a single human being in the department to mention the matter, or to suggest that it should be mentioned. Round and round, like the diurnel revolution of the earth, went the file. stately, solemn, sure and slow.” উদ্ধৃত, সুমিত সরকারের পূর্বোক্ত গ্রন্থ, পৃঃ ১০।
১৬. এমাজউদ্দীন আহমদ, প্রাগুক্ত প্রবন্ধ, পৃঃ ১৯।
১৭. ঐ
১৮. ঐ, পৃঃ ২০।
১৯. ঐ, পৃঃ ২১।
২০. ঐ, পৃঃ ২৩।
২১. Valentine Chirol to Minto, May 23,1910, (MTP correspondence.
vol. 11, No 175) উদ্ধৃত, ঐ, পৃঃ ২৪-২৮।
২২. ঐ, পৃঃ ৩০।
২৩. ৭.২.১৯০৪ এবং ৬.১২.১৯০৪ -এর দুটি নােটে রিজলে লিখেছিলেন– “Bengal united is a power : Bengal divided will pull in several different ways. That is perfectly true and is one of the merits of the scheme.” 47″It is altogether easy to reply in a despatch which is sure to be published without disclosing the fact that in this scheme as in the matter of the amalgamation of Berar to the Central province one of our main objects in to split up and thereby weaken a solid body’ of opponents to our rule.”
উদ্ধৃত, সুমিত সরকারের প্রক্ত প্রবন্ধ, পৃঃ ১৭-১৮।
২৪. উদ্ধৃত, এমাজউদ্দীনের প্রাগুক্ত প্রবন্ধ, পৃঃ ৩৪।
২৫. ১৭ ফেব্রুয়ারি ১৯০৪, চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা আসার পথে কার্জন একটি চিঠিতে ব্রডরিককে এ
faec forczniecta—”The Bengalis, who like to think themselves a nation, and who dream of a future when the English will have been turned out, and a Bengali Babu will be installed in Government House, Calcutta of course bitterly resent any disruptions that will be likely to interfere with the realization of this dream. If we are weak enough to yield to their clamour now, we shall not be able dismember or reduce Bengal again. …”
উদ্ধৃত, আসহাবুর রহমান, বঙ্গভঙ্গ ও ভদ্রলােক শ্ৰেণী’, বঙ্গভঙ্গ, পৃঃ ৪৬।
২৬. এমাজউদ্দীনের প্রাগুক্ত প্রবন্ধে উদ্ধৃত।
২৭. Sufia Ahmed, The Muslim Community in Bengal, Dacca, 1974, p.
231.
২৮. ক্রনিন, প্রাগুক্ত, পৃঃ ১৬।
২৯. রমেশচন্দ্র মজুমদার, বাংলাদেশের ইতিহাস, ৪র্থ খণ্ড, কলকাতা, ১৯৭৫, পৃঃ ২৪।
৩০. এটি ক্ৰমফিভের হিসাব। তিনি দ্রলােকের সংজ্ঞা দিয়েছেন এভাবে—
“… a socially privileged and consciously superior group, economically dependent upon landed rent and professional and clerical employment; keeping its distance from the masses by its acceptance of high-caste proscriptions and its command of education; sharing a pride in its language, its literate culture, and its history; and maintaining its communal integration through a fairly complex institutional structure that it had proved remarkably ready to adapt and augment to its social power and political opportunities.” J. H. Broomfield, Elite Conflict in a Plural Society, California,
1968, PP. 5-7.
৩১. ফ্রেজারের প্রাগুক্ত গ্রন্থ, ফ্রেজার লিখেছেন-‘The strong agency in engineering the
opposition was a section of the Native press”. PP. 324, 327.
৩২. The Bengalee, 13.12.1903.
৩৩. “… the division of the Bengali nation into separate units and
disruption of its historical, social and linguistic ties will seriously interfere with the intellectual, social and material progress of the people.” বিস্তারিত বিবরণের জন্য FPRPBA.
৩৪. ঐ
৩৫. ঐ
৩৬. “We are not guilty of the smallest exaggerations when we say that we are on the threshold of an agitation, which, for its intensity and its universibility will be unrivalled in the annals of this province.” উদ্ধৃত, আসহাবুর রহমানের প্রাগুক্ত প্রবন্ধ।
৩৭. ঐ।
৩৮. Bengal Times, 13.1.1904.
৩৯. ঢাকা প্রকাশ, ২০.১২.১৯০৩
৪০, ঐ।
৪১. ঐ। এই সভায় সভাপতিত্ব করেছিলেন ধানকোরার জমিদার হেমচন্দ্র রায়চৌধুরী, বক্তৃতা দিয়েছিলেন রায় কালীপ্রসন্ন ঘােষ বাহাদুর যিনি একসময় ছিলেন ব্রাহ্ম আন্দোলনের নেতা এবং উকিল আনন্দচন্দ্র রায়। শেষােক্ত দু’জন ছিলেন পূর্ববঙ্গে বাংলা বিভাগ প্রস্তাবের প্রতিবাদ আন্দোলনের অগ্রণী নেতা।
৪২. ১৮৭৬ সালে শিবনাথ শাস্ত্রীর উদ্যোগে স্থাপিত হয়েছিলাে ভারত সভা। পরে এর অনুকরণে এ ধরনের সভার উৎপত্তি হয়েছিলাে বিভিন্ন অঞ্চলে। পূর্ববঙ্গের ঢাকা ও বরিশালে এ ধরনের সভার নাম দেওয়া হয়েছিলাে জনসাধারণ সভা। উকিলরা ছিলেন প্রধানত এ সভার উদ্যোগী। নবকান্ত
চট্টোপাধ্যায়, পৃ. ৯০।
৪৩, ঢাকা প্রকাশ, ১০.১.১৯০৪
৪৪. ঐ।৩১.১.১৯০৪
৪৫. ঐ
৪৬. ঐ, এই সময় প্রকাশিত বিভিন্ন প্রচার-পুস্তিকায়ও মােটামুটি এ যুক্তিগুলিই ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বলা হয়েছে। ঢাকা এবং কলকাতা থেকে প্রকাশিত এ ধরনের দুটি পুস্তিকা [লেখকের নাম নেই), The Partition of Bengal An Open Letter to Lord : Curzon, Dacca, 1904, C. N. Basu. The Partition Agitation
Exaplained, Calcutta, 1906.
৪৭. FPRPBA. P. 60.
৪৮. ঢাকা প্রকাশ, ৩১.১.১৯০৪
৪৯. ৫০. ঐ।
৪৯. ঐ,
৫০. ঐ
৫১. ঐ, ৭.২.১৯০৪
৫২. ঐ, ১৪.২.১৯০৪
৫৩. ঐ
৫৪. FPRPBA, PP. 98-105.
৫৫. ঢাকা প্রকাশ ২৪.১.১৯০৪
৫৬. ঐ ৩ মাঘ, ১৩০০।
৫৭. FPRPBA, PP. 113-117.
৫৮. ঐ, প, ৪৪-৪৬।
৫৯. ঐ পৃ. ১১৮-১১৯
৬০. শরকুমার রায়, মহাত্মা অশ্বিনীকুমার, কলকাতা, ১৩৬৪ পৃ. ১৩৯।
৬১. প্রথম বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে লিখিত আবেদনপত্র, ACC-No. 1786. 1787; বাংলাদেশ জাতীয় | অভিলেখগারে রক্ষিত।
৬২. ঢাকা প্রকাশ, ২৮.১.১৯০৪
৬৩. Sufia Ahmed, Muslim Community in Bangal, PP. 248-50.
৬৪. ঐ, পৃ. ২৫২।.
৬৫. বঙ্গভঙ্গকে সমর্থন করার কারণ জানিয়ে সলিমুল্লাহ ব্রিটিশ পার্লামেন্টের নেতা কেয়ারহার্ডিকে ৩০ অক্টোবর ১৯০৭ সনে লিখেছিলেন– “We support the partition because it is without the least doubt beneficial to our cause-it has limited the Muhammadans in one vast body and has in consequence brought us some prominence–under it, our interest will be more carefully looked after … it has given us an impetus to social and political advancements of the districts, departed and placed under a-district administration, which failed under the old systems to attract the amount of attention to local needs, comensurate with their importance,’ M.K.U, Molla, ‘Keir Hardie and the First Partition of Bengal Rajshahi University
Studies, Vol. III, January, 1970. Appendix B. P. 108.
৬৬, আবুল মনসুর আহমদ, আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর, ঢাকা, ১৯৭৩, পৃ. ২৮-২৯। ৬৭. Sekhar Bondyopadhyay, Caste and Politics in Eastern Bengal. The
Namasudras and the Anti-Partition Agitation, 1905-1911, (mimeo), Centre for Southeast Asian Studies, Calcutta University.
1941 P. 6.
৬৮. Sufia Ahmed, Muslim Community in Bengal, P. 257.
৬৯. শেখর বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রাগুক্ত, পৃ. ৬৩।
৭০. আবদুল মমিন চৌধুরী, হাজার বছরের পুরাতন বাঙালী : প্রাচীন বাংলার ব্যক্তিত্ব, সুন্দরম, ঢাকা, ৩/১, আগস্ট-অক্টোবর, ১৯৮৮ ও মুনতাসীর মামুন, উনিশ শতকে পূর্ববঙ্গের সমাজ, ঢাকা ১৯৮৫, প্রথম অধ্যায়।
৭১. দেখুন, মুনতাসীর মামুন, উনিশ শতকে বাংলাদেশের সংবাদ-সাময়িকপত্র, ঢাকা, দ্বিতীয় ও তৃতীয়
খণ্ড, ১৯৮৬, ১৯৮৮।
৭২. ক্রনিন, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৬।
৭৩. গিরিশচন্দ্র সেন, আত্মজীবন, কলকাতা ১৯০৬, পৃ. ১১৯-২০।
৭৪. ঐ।
৭৫. নওয়াব আলী চৌধুরীর ঐ বক্তৃতার কিছু উদ্ধৃত করছি—
‘The duplication of the administrative machinery has not only-raised the standard of efficiency in the Government of the reconstituted province, but, has afforded a great security of life and prosperity to the people. What was the state of affairs in the eastern part of the province, especialy in the tracts watered by the Brahamputra, the Pudda and the Megna. They were so detached and segregated from the centre of administrative influence that it was impossible, under the old system, to have hoped for any improvement, social, political educational or commercial, before many long years to come. The parition has given a new life to the people in the eastern Province. They are feeling a refreshing sense and a relief from the thraldom of … Calcutta. They find their sights more quickly recognized and their existence and importance more adequately appreciated than they could as a more appendage, as here tofore, of Western Bengal, They find that if … some 100 deputy magistrates and a like number of sub-deputies, munsiffs and subregistars have had to be appointed, these appointments went to the
children of the soil, Hindus and Mohammodans, In fact, the people feel that in neglected Eastern Bengal, the people have got what Ireland has has so strenuously been fighting for, I mean home-rule and not rule from Calcutta.’ 655, Vinod Kumar Saxena (ed), The Partition of Bengal, Select Documents, Delhi, 1987, PP, 114-115.
৭৬. Legislative Proceedings of the Council of Estern Bengal and Assam, | April, 1909, উদ্ধৃত, সুফিয়া আহমদ, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৪০।
৭৭. ঐ
৭৮. সুমিত সরকার, প্রাগুক্ত।
৭৯. আনিসুজ্জামান, মেহেরুন্নাহ ও জমিরুদ্দীন, সাহিত্য পত্রিকা, ৪ বর্ষ, ২য় সংখ্যা, শীত, ১৩৬৭।
৮০, ঢাকা প্রকাশ।
৮১. সৈয়দ আনােয়ার হােসেন, বঙ্গভঙ্গ রদের প্রক্রিয়া’, বঙ্গভঙ্গ।
৮২. Surendranath Bannerji, A Nation in Making, London, 1925, PP.
৮৩. সুফিয়া আহমদ, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৪৭।
৮৪. ক্রনিন, প্রাগুক্ত, পৃ. ২২৬।
৮৫. ব্লুমফিল্ড এ প্রসঙ্গে লিখেছিলেন-“The basic objective of British plocjes in
Bengal throughout this half-century was to combat Hindu bhadrolak excluviveness, but the tragic effect of those policies was to reinforce that very characterstic. By their actions the British gave encourayement to the separatist, of when they finally yielded power it could only be to the opposing government of a divided Bengal.” J. H. Broomfield, op cit.

পূর্ববঙ্গে প্রতিক্রিয়া

(উনিশ শতকে ঢাকা তথা পূর্ববঙ্গ থেকে যেসব পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছিলাে ‘ঢাকা প্রকাশ ছিল তার মধ্যে অন্যতম। শুধু তাই নয়, ‘ঢাকা প্রকাশ ঢাকার প্রথম বাংলা সংবাদপত্রও বটে। আরাে উল্লেখ্য, পূর্ববঙ্গ বা বাংলাদেশ থেকে ঢাকা প্রকাশ’-এর মতাে এতাে দীর্ঘদিন ধরে নিরবচ্ছিন্নভাবে আর কোন সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়নি। উনিশ শতকের ষাট দশকে প্রকাশিত হওয়ার পর পত্রিকাটি টিকেছিলাে প্রায় একশাে বছর – এ শতকের ষাট দশক পর্যন্ত। সরকার গুরুত্ব দিতেন ‘ঢাকা প্রকাশ’কে। উনিশ শতকে ‘রিপাের্ট অন নেটিভ পেপার্স’-এ পূর্ববঙ্গের পত্র পত্রিকার মধ্যে প্রায় ক্ষেত্রেই ‘ঢাকা প্রকাশ’ এর সংবাদ বা মতামত সংকলিত হতাে। ঢাকা প্রকাশ ব্রাহ্মদের উদ্যোগে প্রকাশিত হলেও তাদের মালিকানায় বেশি দিন থাকে নি। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময় পত্রিকার মালিকানা ছিল মুকুন্দ চক্রবর্তীর হাতে। “তাদের সময়ও ঢাকা প্রকাশ এর নাতি তেমন পরিবর্তিত হয়নি। ঢাকা প্রকাশ পূৰ্ব্ববৎ সনাতন ধর্মের সেবাতেই নিযুক্ত ছিল এবং রাজনৈতিক বিষয়ে মধ্যপন্থা অনুসরণ করছিলাে। এখানে ঢাকা প্রকাশ’ থেকে সংবাদ/রচনা সংকলিত হলাে।
বঙ্গের অঙ্গচ্ছেদ
পূর্ববঙ্গের বিসর্জন অশুভ ক্ষণে হােম সেক্রেটারী রিজলী সাহেবের চিত্তাকাশে বঙ্গের অঙ্গচ্ছেদরূপ কালােমেঘ সমুদিত হইয়াছিল। অশুভক্ষণে সেই মেঘের বিজলী বিকাশ রাজকীয় ঘােষণাপত্র সমাশ্রয়ে লােক নয়নে নিপতিত হইয়া ভাবী বজ্রপাতের সূচনা করিয়াছিল। তদবধি এ অঞ্চলের অধিবাসীগণ কি যে অশান্তিতে কালাতিপাত করিতেছে, ভুক্ত ভােগী ব্যতীত অপরকে তাহা বুঝাইয়া বলা কঠিন। শিক্ষিত বা অশিক্ষিত, এই শােচনীয় সমাচার যাহার কর্ণগােচর হইয়াছে, সেই আসন্ন আপদের আশঙ্কায় আতঙ্কাৰিত হইয়া উঠিয়াছে। কৃষক তনয় হইতে জমিদার কুমার সকলেই স্বদেশের গৌরব রক্ষণে বদ্ধপরিকর হইয়া সম্ভ্রমের সহিত গভর্ণমেন্টের এই অন্যায় প্রস্তাবের তীব্র প্রতিবাদ করিতেছে। এই নিমিত্ত সহরে ও মফস্বলে বহুসংখ্যক সভাসমিতির অনুষ্ঠান হইতেছে। এ পৰ্য্যন্ত যে কয়টি সভার সংবাদ আমাদের হস্তগত হইয়াছিল, স্থানান্তরে তাহা বিবৃত হইল। গবর্ণমেন্ট যদি অধিবাসীবৃন্দের আর্তনাদে কর্ণপাত না করিতে কৃত সংকল্প হইয়া থাকেন, তবে অবশ্যই স্বতন্ত্র কথা, নচেৎ, যেরূপ অনুষ্ঠান দেশবাসী আবালবৃদ্ধবনিতার অনভিপ্রেত, কোন সুশাসক তাদৃশ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করিয়া ন্যায়ের মস্তকে পদাঘাত করিতে সম্মত হইবেন ? ঢাকা ও ময়মনসিংহের পরিবর্তন প্রস্তাব পূর্ববঙ্গবাসীর নিকট এমনই বিসদৃশ বলিয়া অনুমিত হইতেছে যে এই বিপ্লবকর ব্যাপারকে সাধারণের চক্ষে অনুমােদন যােগ্য বলিয়া প্রতিপন্ন করিবার নিমিত্ত গভর্ণমেন্ট যে সকল আশ্বাসবাক্য প্রদান
করিতেছেন, তৎসমস্তই অধিবাসীবৃন্দের নিকট উপেক্ষা যােগ্য বলিয়া বিবেচিত হইতেছে। স্থির চিত্তে চিন্তা করিয়া দেখিলে কর্তৃপক্ষ অবশ্যই বুঝিতে পারিতেন, স্বর্গে থাকিয়া দাসত্ব করাও শ্রেয় ; নরকের রাজত্ব লাভও বাঞ্ছনীয় নহে। বড়ই পরিতাপের বিষয়, লর্ড কার্জনের ন্যায় বিচক্ষণ ব্যক্তিও জাতীয়ত্ব বিসর্জনে অধিবাসীবৃন্দের আর্তনাদ কাল্পনিক বলিয়া উপেক্ষা করিতেছেন।
আসামের অন্তর্ভুত হইলে ঢাকা ও ময়মনসিংহবাসীদের যে সকল সুবিধা হইবে; তাহা ক্রমান্বয়ে লিপিবদ্ধ করিতে গেলে ঢাকা প্রকাশের ক্ষুদ্র কলেবরে কুলাইয়া উঠে না। সমাজ, শিক্ষা, শাসন প্রভৃতি যে কোন বিষয় লইয়া এই পরিবর্তন প্রস্তাব কি উদ্দেশ্যে তবে এত আলােচনা আন্দোলনের পরেও গভর্ণমেন্ট এই প্রলয়কর প্রস্তাব পরিত্যাগ করিতেছেন না, সহজ বুদ্ধিতে সে তত্ত্ব নির্ণয় করা একান্তই অসম্ভব। ভাল ; এই যে, অনর্থপাতের আশঙ্কায় দরিদ্র দেশবাসীগণ উদ্বিগ্নচিত্তে শােণিতসম অর্থে টেলিগ্রাফ ইত্যাদির ব্যয় করিতে বসিয়াছে, এজন্য দায়ী হইবে কে ? গভর্ণমেন্ট ভঙ্গিতে আমাদিগকে চিরদিনের অধিকার হইতে বঞ্চিত করিবেন, আর প্রপীড়িত প্রজাগণ মুখ ফুটিয়া মর্মবেদনা জ্ঞাপন করিতে পারিবে না। অন্যকালে একথা অসম্ভব না হইলেও বিংশ শতাব্দীতে এরূপ কল্পনা করাও বাতুলতাজ্ঞাপক। কাযেই জনসাধারণের মতামত না জানিয়া যখন গভর্ণমেন্ট এই প্রলয়কর প্রস্তাবে হস্তক্ষেপ করিয়াছেন তখন অ্যথা অর্থব্যয়ের জন্য ন্যায়তঃ ও ধর্মতঃ ভারত গভর্ণমেন্টকেই দায়ী হইতে হইবে। যে দেশের লােক পেটের জ্বালায় পুড়িয়া মরে তাহাদিগের একটি কপর্দকও যদি এরূপ ভাবে ব্যয়িত হয় তবে তদপেক্ষা পরিতাপের বিষয় আর কি হইতে পারে।
ঢাকা ও ময়মনসিংহ আসামের অন্তর্ভুত হইলে এ অঞ্চলবাসীকে যে অশেষ অসুবিধা ভােগ করিতে হইবে তদ্বিষয়ে অণুমাত্র সন্দেহ নাই। শিক্ষা, সমাজ এবং শাসন প্রভৃতি সৰ্ববিষয়ে যে প্রদেশ ভারতে সর্বনিম্নস্থান অধিকার করিয়াছে, তাহার সহিত শ্রেষ্ঠতম প্রদেশের অংশবিশেষ সংযুক্ত হইলে এই বিচ্ছিন্ন বিভাগের অধঃপতন অবশ্যম্ভাবী। বিভিন্ন ভাষাবলম্বীর মধ্যে ইহা কাহারও পক্ষে সুবিধাজনক হইতে পারে না। প্রজার সুখ শান্তি বিধান যদি গভর্ণমেন্টের উদ্দেশ্য হয় তবে এই অসুবিধার আপত্তি কখনও উপেক্ষাযযাগ্য বলিয়া বিবেচিত হইতে পারে না। কিন্তু, এই অসুবিধার কথাই আমাদের আপত্তি নহে। এই বিপ্লবকর ব্যাপারে আমাদের প্রথম ও প্রধান আপত্তি জাতীয়ত্ব। বঙ্গের আমরা আদিম অধিবাসী। প্রাচীন কালে পূর্ববঙ্গই একমাত্র বঙ্গদেশ বলিয়া কীৰ্ত্তিত হইত। সুতরাং পূর্ববঙ্গবাসীর বাঙ্গালী আখ্যা চিরন্তন। আবহমান কাল হইতে আমরা পৃথিবীর ইতিহাসে যে জাতি বলিয়া পরিগণিত, সে সাধের স্মৃতি বিনা বাক্যব্যয় বিসৰ্জন করিয়া, হােম সেক্রেটারীর পরিবর্তন পিপাসা পরিতৃপ্ত করিতে হইবে, পূর্ববঙ্গে ব্যতীত ভারতের কুত্রাপি গভর্ণমেণ্ট এইরূপ বিসদৃশ ব্যবস্থাবিধানে অগ্রসর হইতেন কিনা সন্দেহ। জাতীয় তেজে যাহারা অনুপ্রাণিত ; জাতীয়ত্বের মাহাত্ম্য যাহারা সম্পূর্ণরূপে উপলব্ধি করিয়াছেন, তাহাদের নিকট এতদপেক্ষা ভীষণ ব্যাপার আর কিছু হইতে পারে কিনা, জানি না। বড়ই পরিতাপের বিষয়। স্বকীয় জাতীয়ত্বের অনুমান সঙ্কোচ দর্শনে যে জাতি ভুজঙ্গশিশুর ন্যায় গৰ্জন করিয়া উঠে, তাহাদেরই প্রতিনিধি আজ একটি প্রাচীন জাতির অস্তিত্ব অপনয়নে অগ্রসর।
প্রথমাবধিই আমরা বলিয়া আসিতেছি, সমগ্র বাঙ্গালীজাতিকে এক শাসনের অধীনে রাখিলে জাতীয় উন্নতির পথে বিষম অন্তরায় উপস্থিত হইবে । সমগ্র বাঙ্গলী সমাজ বিভিন্ন সম্প্রদায়ে বিভক্ত।
এই বিভিন্ন ভাবালম্বী ব্যক্তিবৃন্দকে যদি কখনও একতাসূত্রে সম্বন্ধ করা সম্ভবপর হয়, তবে বাঙ্গলা ভাষাই তাহার একমাত্র উপাদান। জাতীয় উন্নতি সাধন করিতে হইলে, বাঙ্গলা ভাষার পবিত্রতা রক্ষা করিতে হইবে। ঢাকা ও ময়মনসিংহ যদি আসামের অন্তর্ভূত হয়, তবে আসামী সংস্পর্শে এ অঞ্চলের বাঙ্গলা ভাষা অচিরেই রূপান্তরিত হইয়া যাইবে। বর্তমান সময়ে যাঁহারা মনে করিতেছেন, শাসন কাৰ্য্যার্থ ঢাকা ময়মনসিংহ যদি বঙ্গদেশ হইতে বিচ্যুতও হয়, তবে ঢাকা ময়মনসিংহবাসীর বাঙ্গালিত্ব ঘুচিবে কিসে, তাঁহারা যদি ভাষার দিক দিয়া চাহিয়া দেখিতেন তাহা হইলেই সহজেই বুঝিতে পারিতেন যে, ঢাকা ময়মনসিংহের ভাষা রূপান্তরিত হইলে তখন আর ইহাদিগকে বাঙ্গালী বলিয়া চিনিবার কিছুই থাকিবে না। ঈশ্বর না করুন, যদি সত্য সত্যই গবর্ণমেন্ট এই অপ্রিয় প্রস্তাব পরিবর্তন না করেন, তবে এই ভাষাগত পার্থক্যই সময়ে বাঙ্গালীর সর্বনাশের কারণ হইবে।
সহৃদয় বড়লাট বাহাদুর । বাঙ্গালী জাতির অকল্যাণ কামনা হৃদয়ে লইয়া দেব, তুমি কাৰ্য্যে হস্তক্ষেপ করিয়াছ, এমন কথা আমরা ভ্রমেও মনে স্থান দিতে পারি না। কিন্তু প্রভাে! তুমি সত্যসত্যই মহাভ্রমে নিপতিত হইয়াছ। বঙ্গের শাসনভার যদি একান্তই গুরুতর হইয়া থাকে, তবে, সমগ্র উড়িষ্যা প্রদেশ শাসনান্তরের অধীন করিয়া দাও, তাহাতে কাহারও কোন আপত্তি থাকিবে না। কিন্তু দেব! বাঙ্গালী জাতির মধ্যে বিভাগ বণ্টন ব্যাপার আনয়ন করিয়া এই দুৰ্বল জাতিকে আরও হীনবল করিও না। বাঙ্গালী সন্তান আমরা, মাতৃভূমির সহিত সম্বন্ধত্যাগ করিব একথা মনে করিতেও বুক ফাটিয়া যায়। যদি কোন বাঙ্গালী সন্তান তােমাকে অন্য ভাবে বুঝাইয়া থাকে, নিশ্চয় জানিও প্রভাে, সে ব্যক্তি স্বদেশের পরম শত্রু, স্বজাতির উচ্ছেদ সাধক। এই সমস্ত তথাকথিত প্রতিনিধির কথায় প্রত্যয় করিয়া যদি সমস্ত বাঙ্গালীর আবেদন অগ্রাহ্য কর, তবে স্পষ্টই বুঝিব বাঙ্গালীর সর্বনাশ সাধন ব্যতীত এ ব্যাপারে তােমার অপর কোন উদ্দেশ্য নাই। হিন্দুসন্তান আমরা, স্বদেশে থাকিয়া ভিক্ষা করিয়া মরিতেও প্রস্তুত আছি। তথাপি পরের দেশে যাইয়া সুখ সমৃদ্ধি বা রাজসম্মান লাভে কৃতার্থ হইতে চাহিনা। আসামে যদি আমাদের জন্য সহস্র প্রকার সুবিধা ও সুযােগের ব্যবস্থা কর। তথাপি দেব। আমরা তাহা তৃণবৎ উপেক্ষা করিব। পৃথিবীর প্রাচীনতম জাতিকে বিভাগ বণ্টন রূপ প্রহসনের আঘাতে হীনবল করিও না। তােমার চরণে দেব, সওয়া চারি কোটি বাঙ্গালীর ইহাই প্রার্থনা।
২৬ পৌষ, ১৩১৭; ১০ জানুয়ায়ী, ১৯০৪।
বঙ্গের অঙ্গচ্ছেদ।
হিন্দুর অন্তিম আশা।
….. ভাই হিন্দু সন্তান। এস সবে আজ সেই জগজ্জননীর চরণে শারণ লইয়া উপস্থিত আপদে অব্যাহতি প্রার্থনা করি। মায়ের কৃপা না হইলে এ দুর্দিনে আত্মরক্ষার
উপায়ন্তর দেখিতেছি না। এ জন্যেই বলিতেছিলাম, হিন্দু সন্তানগণের এখন আর আত্মক্ষমতার উপর নির্ভর করিয়া নিশ্চিন্ত থাকা কর্তব্য নহে। এস ভাই! আজ এ বিপদের সময় আমরা সকলে মিলিয়া মা ঢাকেশ্বরীর২৯ কৃপা প্রার্থনা করি ।….মা মঙ্গলময়ি! এ বিষম বিপদবহ্নি হইতে অভাগা সন্তানগণকে উদ্ধার কর। ঢাকাবাসী চিরদিনই তােমার কৃপাপাত্র। তুমি কৃপা না করিলে আমরা দাঁড়াইব কোথায় মা!
১০ মাঘ, ১৩১০ ২৪; জানুয়ারী ; ১৯০৪।
বড়লাটের বাগ বিস্তার
বাক্য-বিলাসী বড়লাট বাহাদুর নানা ছন্দে বাগজাল বিস্তার করিয়া ঢাকা ময়মনসিংহ ও চট্টলবাসীর কর্ণকুহর পরিতৃপ্ত কি পরিতপ্ত করিয়া গিয়াছেন, এখন, বােধ হয় সে কথা আললাচনা করিবার সময় উপস্থিত হইয়াছে। জ্যোতিপিণ্ডের প্রচণ্ড প্রভা আকস্মাৎ নয়নপথে নিপতিত হইলে কিয়ৎকাল যেমন অভিভূত হইয়া পড়িতে হয়। বচনরচনা নিপুণ বড়লাট বাহাদুরের মুখ স্থিত রচনা প্রবাহের তরঙ্গ-ভঙ্গে পড়িয়া পূৰ্ব্ববঙ্গবাসীগণ তেমনই কিয়ৎকালের নিমিত্ত স্তম্ভিত ও বিস্ময় বিমূঢ় হইয়া পড়িয়াছিলেন ; ক্ষুধার্ত ভিক্ষুক দাতা কর্ণের নিকট গলদশ্রুনয়নে ও করজোরে অন্নভিক্ষা করিয়া যদি ভস্মমুষ্টি প্রাপ্ত হয়, তবে যেমন অভাগা ভিখারী অদৃষ্টকে ধিক্কার দিয়া থাকে, জগতপূজ্য সম্রাটের প্রতিনিধিরূপে ভারতের বর্তমন ভাগ্যবিধাতার নিকট পােড়া পূর্ববঙ্গবাসী কাতর ক্রন্দনের ফলে বিভীষিকাপূর্ণ ভৎসনা বাক্য লাভ করিয়া তেমনই বীতশ্রদ্ধ ও হতবুদ্ধি হইয়া পড়িয়াছিলেন। যাহার মুখে আশ্বাস বাণী শুনিবে বলিয়া পূৰ্ব্ব বঙ্গের আধিবাসীবৃন্দ বড় আশায় বুক বাঁধিয়া ছিল, প্রকৃতির বিকৃত কালআকাক্ষিত আশ্বাসবাণী হুঙ্কারে পরিণত হইয়া বিষম বিভীষিকায় বিস্তার করিয়াছে—
বলিতে ঘৃণা ও লজ্জায় মরমে মরিয়া যাইতে হয়, পূর্ববঙ্গে রাজ প্রতিনিধির বাগ বিস্তার সত্য সত্যই, এমনিই হলাহল করিয়া সভ্যতার শিরে দুরপনেয় কলঙ্ক অর্পণ করিয়াছে।
যিনি অদ্বিতীয় বাক্যবাগীশ বলিয়া সর্বত্র সুপরিচিত, আমাদের ন্যায় ক্ষুদ্র ব্যক্তি তাহার বাক্যাবলীর সমালােচনা করিতে প্রয়াস পাইবে, ইহা “উদ্বাহুরব বামন” বৎ প্রতীয়মান হইলেও কর্তব্যের দায়ে এ সম্বন্ধে দুই চারিটি কথা না বলিয়া পারিতেছি না। সম্রাট প্রতিনিধির অত্যুচ্চ আসনে যিনি প্রতিষ্ঠিত, তাঁহার মুখারবিন্দ হইতে যে রচনারাজি নিঃসৃত হয়, তন্মধ্যে যদি অসম্বদ্ধতা, অপ্রাসঙ্গিকতা অযৌক্তিকতার লেশমাত্র বিদ্যমান থাকে, তবে তদপেক্ষা পরিতাপের আর কি হইতে পারে। বড়ই আশ্চর্যের বিষয় চট্টগ্রাম, ঢাকা বা ময়মনসিংহে প্রদত্ত বক্তৃতাত্রয়ের মধ্যে অন ? পাঠক এমন দুটি কথাও খুঁজিয়া পাইতেছেন না, যুক্তি বা প্রত্যক্ষ পদার্থের মলাইয়া দেখিলে যাহার কিঞ্চিৎ মাত্রও সারবত্ত্বা উপলব্ধি হইতে পারে। একদিন যদি বৃটিশ সাম্রাজ্যের সব্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তি হইবার আশা রাখেন বলিয়া সম্মুখে অম্লানবদনে এইরূপ অসার যুক্তিজাল বিস্তার করিয়া পূর্ববঙ্গের দেড় কোটি অধিবাসীর মনে বিভীষিকা সঞ্চারে যত্নবান হইবেন ; একথা কল্পনা করিতেও শরীর শিহরিয়া উঠে। কিন্তু কালের ক্রীড়া এমনই অদ্ভুত একদিন
কল্পনারও যাহা আগােচর ছিল, তাহা প্রত্যক্ষ পরিদৃশ্যমান।
এই সুদীর্ঘ বক্তৃতাত্রয়ের মধ্যে অন্য কোন ভাবের বিকাশ সহজ দৃষ্টিতে পরিলক্ষিত হইলেও, প্রথম হইতে শেষ পর্যন্ত বিদ্রুপাত্মক উগ্রতার রুদ্র মুর্তি পাঠকের প্রাণে যুগপৎ আতঙ্ক ও নৈরাশ্যের সঞ্চার করিয়া থাকে। আগাগােড়া সেই তর্জনী সঞ্চালিত ভৈরব গর্জন, মুখবন্ধ হইতে উপসংহার পর্যন্ত নিরীহ দেশবাসীর প্রতি প্রচণ্ড প্রভাবপ্রজ্ঞাদিত উপহাসবর্ষণ ও উপেক্ষা প্রদর্শন। চট্টগ্রামে যাহার পূর্বাভাষ, ঢাকায় তাহার ঈষৎবিকাশ এবং ময়মনসিংহে তাহা পূর্ণপ্রভায় পরিস্ফুট। এ জন্যই বুঝি বড়লাট বাহাদুর বলিয়াছেন, “এই তিন স্থানের বক্তৃতা একত্র করিয়া পাঠ না করিলে সকলে প্রকৃত উদ্দেশ্য বুঝিতে পারিবেন না”। যাহা হউক, যাহা হইবার হইয়াছে, পূর্ববঙ্গবাসীর পােড়া অদৃষ্ট পটের নিয়ােগানুসারে অমিয়ার আধার হইতে হলাহল প্রবাহ উদগীরিত হইয়া অভাগা অধিবাসীর জীবনীশক্তি সংহারে অগ্রসর হইয়াছে, এজন্য অক্ষেপ করিয়া লাভ কি। লাভ কিছু নাই তাহা বুঝি, কিন্তু কথা এই যৌক্তিকতার মর্যাদা রক্ষণই যে জাতির প্রধান ব্রত তাহাদের প্রতিভূরূপে বড়লাট বাহাদুর এ অঞ্চলবাসীর প্রতিনিধিবর্গের ন্যায্য আবেদন উপেক্ষা ও অবজ্ঞার চক্ষে অবলােকন করিবে এ কেমন ব্যাপার। যদি সত্যই সত্যই আমাদের আবেদন উপেক্ষিত হইল, তবে আমরা আমাদের পরমপূজনীয় সম্রাটের কৃপা প্রার্থী হইতে পারি না কি ? আমাদের মনে হয়, বড়লাট বােধ হয় ভুল বুঝিয়াছেন। ভীতি প্রদর্শনে কাৰ্য্যেদ্ধারের দিন এখন আর নাই। পঞ্চমবর্ষীয় শিশু হইতে অশীতিপর বৃদ্ধ পৰ্য্যন্ত দিনান্তভােজী কৃষক তনয় হইতে পৰ্য্যঙ্কবিলাসী জমিদার কুমার পর্যন্ত সকলেরই নিকট ন্যায়ের রাজ্য সুপরিচিত। কাজেই ন্যায়ের পবিত্র পতাকা উডডীন না হইলে, সহস্র গর্জনেও মানব মণ্ডলী মস্তক অবনমিত হইবে না।
পূৰ্বেই বলিয়াছি, আমাদের ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে এ বক্তৃতায় ত্রিবিধ দোষ পরিলক্ষিত হইতেছে ঃ অসম্বন্ধতা ; অপ্রাসঙ্গিকতা এবং অযৌক্তিকতা। অসম্বন্ধতার নিদর্শনস্থলে চট্টগ্রামের বক্তৃতার কটন সাহেবের উক্তির প্রতি উপেক্ষা প্রদর্শনের উল্লেখ করা যাইতে পারে। বড়লাটই বলিয়াছেন…. Unquestionably and inevitably wrote as a Bengal officer “অর্থাৎ কটন সাহেব বঙ্গদেশের সিভিলিয়ানের ন্যায় লিখিয়াছেন।” ভাল জিজ্ঞাসা এই বঙ্গবিভাগ ব্যাপার বঙ্গদেশীয় সিভিলিয়ানের চক্ষে অবলােকন করাটা দোষবহ বিবেচিত হইতে পারে কি ? বঙ্গের অংশ বিশেষ চট্টগ্রাম বিভাগ আসাম ভুক্ত করার সম্বন্ধে মন্তব্য প্রকাশকালে বঙ্গীয় সিভিলিয়ান বলিয়া যদি কটন সাহেবের ন্যায় প্রধান পরুষের মত উপেক্ষিত হইল, তবে বিভাগ ব্যাপারে স্যার জন উরবান এবং মিঃ বাের্ডিয়র প্রভৃতির মত প্রমাণস্বরূপ গৃহীত হইল কেন ? তাহারাও তাে বঙ্গীয় সিভিলিয়ান। তার পরে, বড়লাটের কথা মতে সার জন উডবারণ প্রভৃতি সিভিলিয়ানগণ বঙ্গবিভাগে মত প্রদান করিয়াছেন। কিন্তু এই বিভাগ ব্যাপার কিরূপে সম্পন্ন হইবে তৎসম্বন্ধে তাহারা কোন মত প্রদান করিয়াছেন কিনা, বড়লাট বাহাদুরতাে তৎসম্বন্ধে কিছুই বলেন নাই। বঙ্গের অংশ বিশেষ আসামভুক্ত করা সম্বন্ধে তাহারা সম্মত ছিলেন কিনা এ কথা কে বলিবে ? বঙ্গের অংশ বিশেষ আসামভুক্ত করা অথবা ঐ অংশ বিশেষ ও আসাম লইয়া নূতন প্রদেশ গঠন করা ব্যতীতও তাে অন্যরূপে এই বঙ্গ বিভাগ সম্পন্ন হইতে পরে। বঙ্গ, বিহার ও উড়িষ্যা লইয়া বাঙ্গালা প্রেসিডেন্সি গঠিত। ইহার
মধ্যে উড়িষ্যা ও বিহার ছাড়িয়। প্রকৃত বঙ্গদেশ ও আসাম লইয়া একটি নূতন প্রদেশ হইলে দোষ কি? তবে বঙ্গের অঙ্গ খণ্ড খণ্ড করা কেন? স্যার জন উডবারণ প্রমুখ ব্যক্তি যদি বাঙ্গালা প্রেসিডেন্সির বিভাগ করিতে সম্মত হইয়াই থাকেন, তবে, তাঁহারা বর্তমান প্রস্তাব অনুযায়ী বিভাগের পক্ষপাতী কিনা এ প্রশ্ন সাধারণের মনে উঠিতে পারে নাকি ? কটন সাহেব বঙ্গের অংশ বিশেষ আসামভুক্ত করার সম্বন্ধেই আপত্তি করিয়াছিলেন। হয়তাে বড়লাট যাঁহাদিগের নাম প্রমাণস্বরূপ উপস্থিত করিয়াছেন, তাঁহারাও এরূপ প্রস্তাবের পক্ষে নহেন। আর যদি তাঁহারা এ প্রস্তাবের পক্ষপাতীই হন, তবে বঙ্গীয় সিভিলিয়ান বলিয়া কটন সাহেবের মত পরিত্যক্ত হইবে, আর ধিক সেই কারণে স্যার জন উডবারণের মত গৃহীত হইবে, জনসাধারণ কিন্তু এহেন অদ্ভুত যুক্তির সারবত্তা অবধারণে একান্তই অক্ষম। এরূপ উক্তিও যদি অসম্বৰদোষ দুষ্ট না হয়, জানি না তবে, অসম্বন্ধ উক্তি কাহাকে বলে । স্থির চিত্তে পাঠ করিলে বক্তৃতাত্রয়ের মধ্যে এরূপ নিদর্শনের প্ৰাচুৰ্য্য পরিলক্ষিত হইবে। ব্যাপার দেখিয়া মনে হয়, সে সকল ব্যক্তি বড়লাটের মতাবলম্বী, জগতে তাহারাই একমাত্র ধীমান, আর সকলেই তদ্বিপরীত। বড়লাটের ন্যায় প্রধান পুরুষের মুখে এরূপ কথা শুনিলে বুদ্ধিমান ব্যক্তি বােধ হয় হাস্য সম্বরণ করিতে পারেন না। সুপ্রসিদ্ধ ইংলিসম্যান যথার্থই বলিয়াছেন “But the viceroy can afford to be illogical.”৩০
১৬ ফাল্গুন, ১৩১০; ২৮ ফেব্রুয়ারী, ১৯০৪।
শিখিলাম কি ?
সমগ্র ভারত সন্তানের প্রবল প্রতিবাদ উপেক্ষায় উড়াইয়া দিয়া পরাক্রান্ত প্রভুর অলঙ্ আদেশে চক্ষের নিমিষে দেশে যে মহাপ্রলয়ের সূত্রপাত করিল, শিক্ষিত ভারত সন্তান ইহা হইতে কি শিক্ষা লাভ করিলেন, বর্তমান সময়ে চিন্তাশীলের চিত্তে স্বতঃ এর এ প্রশ্ন উদিত হইয়া থাকিবে। যে আশায় বুক বাঁধিয়া অভাগা ভারতবাসী অমানিশার আঁধাররাশি দুহাতে সরাইতেছিল, বিধাতার ব্যবস্থায় রাতুলের ব্যর্থ বাসনার ন্যায় আজি তাহার অযােগ্যতা প্রতিপাদিত হইয়া, পরমুখাপেক্ষী ভারত তনয়কে জগত্রাসীর উপহাস বা উপেক্ষার উপযুক্ত করিয়া তুলিয়াছে। আথাে বিধিবিড়ম্বনা।
চক্ষু থাকিতে যাহারা তাহার ব্যবহারে অনভিজ্ঞ, প্রজ্ঞাবাদন হইয়াও যাহারা অজ্ঞান তিমির উদ্ভেদে অসমর্থ, আবহমানকাল ভরিয়া তাহার মােহ মদিরায় মুগ্ধ থাকিবে ইহা কখনই বিচিত্র নহে। কিন্তু অভাব অভিযােগের প্রবল পীড়নে বিমর্পিত হইয়া আপন অবস্থার কথা যাহারা ভাবিতে শিখিয়াছে, এবার তাহারা অবশ্যই বুঝিতে পারিবে একালে নয়নজলে বুক ভাসাইয়া পরাক্রান্ত প্রভুর অনুগ্রহ ভিক্ষা সম্পূর্ণ নিরর্থক। আফিসিয়াল সিক্রেট বিল বা শিক্ষাসম্বন্ধীয় আইন, এ সকলের ইতিহাস পাঠ করিয়াও যদি ভারত সন্তানের চৈতন্যোদ্রেক না হইয়া থাকে, তবে নিশ্চয় বুঝিতে হইবে হিতাহিত বুদ্ধিও ভারতসন্তানের নিকট হইতে চিরদিনের তরে বিদায় গ্রহণ করিয়াছে, উল্লিখিত আইন
দুইটি বিধিবদ্ধ হইবার সময় রাজপ্রতিনিধির আইন সভায় যে অদ্ভুত ব্যাপার পরিলক্ষিত হইয়াছে, ব্রিটিশ শাসনের ইতিহাস অনুসন্ধান করিলে, জানি না, তাহার সাদৃশ্য মিলিবে কিনা। আসন্ন আপদের আশঙ্কায় উদ্বিগ্ন সমগ্র ভারত কতই না বাদ প্রতিবাদে আলােচনা আন্দোলন উত্থাপন করিল, দীনদরিদ্র দেশবাসী, পিতৃমাতৃহীন শিশুর ন্যায় প্রভুর পদপ্রান্তে দৃষ্টি নিবন্ধ করিয়া কাতর কণ্ঠে কতই না কৃপা ভিক্ষা করিল। কিন্তু লক্ষলক্ষের অনুনয় বিনয় এবং কোটি কণ্ঠের কাতর ক্রন্দনের ফলে ভারতের ভাগ্যবিধাতার প্রবল পিপাসা মুহূর্তের তরেও প্রশমিত হইল কি ? বিজেতা বিজিত সম্বন্ধের এরূপ বিসদৃশ বিকাশ সভ্য জগতে আর কখনও পরিলক্ষিত হইয়াছে বলিয়া মনে হয় না। আজ দেড় শতাধিক বৎসর যাবৎ ভারত তনয় বৃটিশরাজের পদমূলে পুম্পাঞ্জলি প্রদান করিয়া আসিতেছে। কিন্তু এই দেড়শত বৎসরের মধ্যেও এমন একটি দৃষ্টান্ত সংঘটিত হয় নাই যেখানে সমগ্র ভারতীয় সম্প্রদায় এরূপে উপেক্ষিত, এরূপভাবে অবমানিত এবং এইরূপে তিরস্কৃত হইয়াছে। এত দেখিয়া শুনিয়াও যদি ভারত সন্তান আপনার অবস্থা বুঝিয়া চলিতে শিক্ষা না করে, তবে বুঝিতে হইবে সবুট পদপ্রথারই ভারতের সন্তানের জন্য সুসঙ্গত ব্যবস্থা।
পাঠক মনে করিবেন না আমরা বর্তমান গভর্ণমেন্টের ব্যবহারে দোষারােপ করিতেছি। আমরা বলি, ভারত সন্তানের অযােগ্যতাই এইরূপে উপেক্ষার একমাত্র কারণ। অধিকার গেল বা অধিকার পাইলাম এ সকল বিষয় লইয়া চীকার করা আমরা বিজিত জাতির অধিকার বহির্ভূত বলিয়া মনে করি। গভর্ণমেন্টের ব্যবহারেও একথা স্পষ্ট প্রমাণিত হইয়াছে। গভর্ণমেন্টের কাৰ্য্য লইয়া আলােচনা না করিয়া, যদি ভারতের বর্তমান অবস্থা ভারতবাসীর দুর্দশার প্রকৃত কারণ অনুসন্ধানে আমাদের আলােচনা বা আন্দোলন পর্যবসিত হইত তবে বােধ হয়, ভিখারীর বেশে আমাদিগকে আর কাদিতে হইত না। গভর্ণমেন্ট যে সকল বিধানাদি প্রবর্তিত করিলেন, কেহ কি বলিতে পারে যে উহার ফলে ভারত সন্তানের অস্তিত্ব ধরাপৃষ্ঠ হইতে বিলুপ্ত হইবে। ভারতবাসী পূৰ্ব্বেও যেমন ছিল পরেও তেমন থাকিবে। সাগরে যাহার শয্যা শিশিরে আর তাহার কত ভয়। তাই বলিতেছিলাম, ভাই ভারতবাসী এবারের ব্যাপার দেখিয়া বুঝিয়া লও গভর্ণমেন্টের কার্য্য লইয়া বাগ্‌বিতণ্ডা করা অপেক্ষা যাহাতে জাতির প্রকৃত উন্নতি হইতে পারে তজ্জন্য যত্ন করাই একমাত্র কর্তব্য। দেশ দিন দিন ধনশূন্য হইয়া প্রকৃতই অধঃপাতে যাইতে বসিয়াছে। অনাহারে বা অর্ধাহারে দরিদ্র দেশবাসী দিন দিনই কঙ্কালসার হইয়া পড়িতেছে। শিক্ষা ও বাণিজ্যের বিস্তারে যদি দেশে অর্থাগমের উপায় উন্মুক্ত না হয়, তবে অচিরেই যে আমাদের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হইবে, তদ্বিষয়ে অণুমাত্রও সন্দেহ নাই। ভিক্ষা দ্বারা পূৰ্ব্বসমৃদ্ধি লাভে সমর্থ হইবে এত দিন এই অলীক ধারণার বশবর্তী হইয়া ভারতসন্তান কি ফল লাভ করিয়াছে ? তাই বলিতেছিলাম, ভাই ভারতসন্তান। এখনও বুঝিয়া চলিতে শিখিলে দেশের দুর্দশা তিরােহিত হইতে পারে।
১৪ চৈত্র, ১৩১০; ২৭ মার্চ, ১৯০৪।
বঙ্গের সর্বনাশ
বঙ্গের সর্বনাশ হইয়াছে। আট কোটি বঙ্গবাসীর বক্ষস্থল পদপ্রহারে বিদীর্ণ করিয়া, কৃতান্তরূপী কার্জন বাহাদুর বঙ্গের ক্ষীণ অঙ্গষষ্টি দ্বিখণ্ডিত করিয়া ফেলিয়াছেন। সপ্তশতবৎসর ব্যাপী বৈদেশিক শাসনের নিগৃহীত হইয়াও দীনদুৰ্বল বাঙ্গালী সন্তান জাতীয়ত্বের যে অমূল্য রত্ন সযত্নে হৃদয়ের নিভৃত নিলয়ে লুকাইয়া রাখিয়াছিল, প্রবল পরাক্রমে প্রদীপ্ত হইয়া ব্রিটিশ প্রতিনিধি বাঙ্গালীর বক্ষাভ্যন্তর হইতে আজ সে রত্ন কাড়িয়া লইতেছেন। হায় হায়! বিরূপ বিধাতার এরূপ বিষম ব্যভিচার কত কাল আর বাঙ্গালী সন্তানকে নির্জীবের ন্যায় সহিয়া লইতে হইবে। কোটি কোটি অধিবাসিবৃন্দের আন্দোলন ও আর্তনাদ গৰ্ব্ববেগে উড়াইয়া দিয়া, দম্ভদৃপ্ত বড়লাট, বঙ্গবিভাগের ঘােষণাপত্র প্রচারদ্বারা, ব্রিটিশসিংহের পবিত্র নামে যে দুরপনেয় কলঙ্ক অর্পণ করিলেন, সভ্যতার শুভ্র জ্যোতিঃ যদদিন এ মরজগৎকে উদ্ভাসিত করিবে ততকাল এ কলংক অপগত হইবার নহে।
ঢাকা, চট্টগ্রাম এবং রাজসাহী বিভাগের সহিত আসামপ্রদেশ সম্মিলিত করিয়া “পূর্ববঙ্গ ও আসাম” নামে এক নূতন প্রদেশ গঠনের ঘােষণাপত্র প্রকাশিত হইয়াছে। সম্মিলিত বঙ্গের সমস্ত আশা ভরসা এতদিনে চিরতরে বিলুপ্ত হইল! আসামের চিফ কমিশনার মাননীয় মি জে বি ফুলার এই নূতন প্রদেশের লেপটেন্যান্ট গভর্ণর নিযুক্ত হইলেন। শুনিতেছি, ফুলার মহােদয় ছােটলাটরূপে শীঘ্রই ঢাকা নগরীতে আগমন করিতেছেন। তাহার আগমনােপলক্ষে নাকি নানারূপ বন্দোবস্ত হইতেছে।
যাহা হইবার হইয়া গেল! এখন এ ভীষণ দুর্দিনে বাঙ্গালীর কর্তব্য কি, তাহাই একমাত্র ভাবিবার বিষয়। আমরা বলি, ভারত গভর্ণমেন্টের মীমাংসার উপর নির্ভর করিয়া নিরাশ হওয়া কর্তব্য নহে ঃ দুই বৎসরের চেষ্টায় যে দেশ ব্যাপী আন্দোলনের সৃষ্টি হইয়াছে, উত্তরােত্তর যাহাতে তাহা বৃদ্ধিত হয় তন্নিমিত্ত যত্ন করাই এখন আমাদের একমাত্র কর্তব্য বলিয়া পরিগণিত হওয়া উচিত। বিশেষতঃ, এ অমঙ্গলের অভ্যন্তর হইতে যে অশেষ কল্যাণকর স্বদেশী আন্দোলন আবির্ভূত হইয়াছে, সেই আন্দোলন কেবল কথায় পর্যবসিত না হইয়া যাহাতে কার্যে পরিণত হইতে পারে তজ্জন্য সাধ্যানুরূপ যত্ন করা বাঙ্গালীমাত্রেরই একমাত্র কর্তব্য। বঙ্গবিভাগ হয় হউক; এই স্বদেশী আন্দোলন যদি আমরা অক্ষুন্ন রাখতে পারি, তবে সময়ে আমরা নিশ্চয়ই জননী জন্মভূমির মলিনমুখ সুপ্রসন্ন দেখিয়া কৃতার্থ হইতে পারিব।
১৮ ভাদ্র, ১৩১২; ৩ সেপ্টেম্বর, ১৯০৫।
ঢাকায় জনসাধারণের বিরাট সভা
১১ই ভাদ্র, রবিবার, ঢাকার ইতিহাসে একটী বিশেষ স্মরণীয় দিনরূপে কীৰ্ত্তিত হইবে। সেদিন যে অপূর্ব দৃশ্য দেখিয়াছিলাম, ঢাকায় আর কখনও তাহা দৃষ্টিগােচর হয় নাই। “বঙ্গবিভাগ সম্বন্ধে আমাদের কর্তব্য নির্ধারণ এবং স্বদেশীয় দ্রব্যের প্রচলণার্থ আন্দোলন” এই সংকল্প লইয়া, ঢাকা জনসাধারণ সভার সেক্রেটারী মহােদয় ঢাকাবাসীকে এক বিরাট সভায় সম্মিলিত হইবার নিমিত্ত আহ্বান করেন। স্থানীয় জগন্নাথ কলেজের বিশাল প্রাঙ্গণে সভার স্থান নির্দিষ্ট হইয়াছিল, এবং স্থানীয় শিক্ষিত ও সম্ভ্রান্ত সম্প্রদায়ের বালক, যুবক, বৃদ্ধ প্রভৃতিতে অন্যূন দশ সহস্র লােক সাগ্রহে সভায় যােগদান করিয়াছিলেন। জনসাধারণ সভার আমন্ত্রণে, কলিকাতা হইতে বঙ্গমাতার মুখোেজ্জ্বলকারী সন্তান বাবু সুরেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায়, শ্রীযুক্ত জে চৌধুরী৩২, বাবু হেরম্বচন্দ্র মৈত্র৩৩ এবং শ্রীযুক্ত আবদুল হালিম গজনভি৩৪ এনগরে শুভাগমন করিয়া সহরবাসীকে উৎসাহিত করিয়াছেন। অগণিত জনমণ্ডলী যখন কলেজের প্রকাণ্ড প্রাঙ্গণে সমবেত হইতে লাগিলেন, তখন তাহাদের উৎসাহ ও উৎকণ্ঠা যে দেখিয়াছে সেই মুগ্ধ হইয়াছে। সেই বিশাল সম্মিলনীর দিকে চাহিলে মনে হয়, সম্মুখে যেন এক সুবিস্তৃত জনসমুদ্র বিদ্যমান রহিয়াছে। জমিদার, মহাজন, অধ্যাপক, অধ্যয়নার্থী, উকীল, চিকিৎসক প্রভৃতি সবর্ব সম্প্রদায়ের লােক দ্বারাই সে সম্মিলনী গঠিত হইয়াছিল। সেদিনকার সভায় ছাত্রগণ যেরূপ শিষ্টাচার প্রদর্শন করিয়াছে, তাহা বস্তুতঃই প্রশংসাৰ্হ। এতবড় সভার কার্য যে এমন শৃঙ্খলা ও সৌষ্ঠবের সহিত সম্পন্ন হইতে পারে, অনেকেই তদ্বিষয়ে সন্দিহান ছিলেন। কিন্তু ছাত্রগণের সুব্যবস্থায় এই ১০/১২ হাজার লােকের মধ্যে এমনি শৃঙ্খলা রক্ষিত হইয়াছিল যে, সভাক্ষেত্রে জন-মানবহীন প্রান্তরের নির্জনতা অনুভূত হইয়াছে। বিদ্যার্থিবর্গের মধ্যে সেদিন যেরূপ উৎসাহ ও উদ্দীপনা দেখা গিয়াছিল, ভগবৎ কৃপায় যদি তাহা স্থায়ী হয়, তবে দেশের পক্ষে বিশেষ কল্যাণের কারণ হইবে।
প্রারম্ভে স্থানীয় দুইটী যুবককর্তৃক একটী উদ্দীপনাপূর্ণ সঙ্গীত হয়। সঙ্গীত এইরূপ ঃ
“বন্দে মাতরং”।
নমাে বঙ্গভূমি শ্যামাঙ্গিনী
যুগে যুগে জননী লােকপালিনী ।
সুদূর নীলাম্বর প্রান্ত সঙ্গে
নীলিমা তব মিশিতেছে রঙ্গে,
চুমি পদধূলি বহে নদীগুলি,
রূপসী শ্রেয়সী হিতকারিণী ।
তাল তমালদল নীরবে বন্দে,
বিহঙ্গ স্তুতি করে ললিত সুছন্দে,
আনন্দ জাগ অয়ি কাঙ্গালিনী!
১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ ও পূর্ববঙ্গে প্রতিক্রিয়া
কিসের দুঃখ মাগাে কেন এদৈন্য,
শূন্য শিল্প তব বিচূর্ণ পণ্য,
হা অন্ন, হা অন্ন, কাঁদে পুত্রগণ ?
ডাক মেঘ মন্দ্রে সুষুপ্ত সবে,
চাহ দেখি সেবা জননী-গরবে, |
জাগিবে শক্তি, উঠিবে ভক্তি
জাননা আপনার সন্তানশালিনী!
সর্বসম্মতি ক্রমে ঢাকার প্রসিদ্ধ উকীল বাবু আনন্দচন্দ্র রায় সভাপতি নির্বাচিত হইয়া সভায় কাৰ্য্য সুসম্পন্ন করিয়াছেন। সভায় সর্বসম্মতিক্রমে ছয়টী প্রস্তাব পরিগৃহী হইয়াছে।
কথা ছিল, ভাওয়ালের জ্যেষ্ঠ কুমার রণেন্দ্রনারায়ণ রায় প্রথম প্রস্তাব উপস্থিত করিবেন। কিন্তু তিনি অসুস্থ হইয়া পড়াতে, তাহারই অভিপ্রায়ানুসারে, তাহার প্রাইভেট সেক্রেটারী প্রথম প্রস্তাব উত্থাপন করিয়াছিলেন। বাবু গােবিন্দপ্রসাদ দাস এবং বাবু দীনবন্ধু মজুমদারের সমর্থন মতে প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে পরিগৃহীত হয়। প্রস্তাবটী এইরূপ ঃ
বঙ্গবিভাগ প্রশ্ন সম্বন্ধে বঙ্গবাসির অভিমত এবং স্বার্থসম্বন্ধ সমর্থন করাতে, এই সভা পার্লিয়ামেন্টের সভ্য মিঃ হারবার্ট রবার্টসের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করিতেছেন। এই প্রস্তাবের প্রতিলিপি মিঃ রবার্টস মহােদয়েরর নিকট প্রেরণ করিবার নিমিত্ত এই সভা সভাপতি মহােদয়কে অনুরােধ করিতেছেন।
দ্বিতীয় প্রস্তাব উত্থাপন করেন স্থানীয় প্রসিদ্ধ উকীল বাবু ত্রৈলােক্যনাথ বসু এম এ বি এল । প্রস্তাব উত্থাপিনকালে তিনি একটী সংক্ষিপ্ত ও সারগর্ভ বক্তৃতা প্রদান করিয়া জনসাধরণের তৃপ্তিবিধান করিয়াছিলেন। বাবু রাজেন্দ্রকুমার বসু ও বাবু বিশ্বেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনুমােদন মতে প্রস্তাব পরিগৃহীত হইয়াছে। দ্বিতীয় প্রস্তাব এইরূপ ঃ
মিঃ ব্রডরিক যখন অতিরিক্ত সংবাদ প্রদানের আবশ্যকতা স্বীকার করিয়াছেন, এবং যত শীঘ্র সম্ভব তিনি ভারত গবর্ণমেন্টকে পত্রাদি লিখিয়া, এ সম্বন্ধীয় অন্যান্য কাগজাদি মহাসভার সম্মুখে উপস্থিত করিতে প্রতিশ্রুত হইয়াছেন ; মহাসভা যখন কোন পক্ষেরই কারণাদি অবগত নহেন বলিয়া স্যার হেনরী ফাউলার মন্তব্য প্রকাশ করিয়াছেন, বিভাগের বৃহত্তম প্রস্তাব যাহা এখন অনুমােদিত হইয়াছে, ঐ প্রস্তাব আন্দোলনার্থ যখন জনসাধারণের সম্মুখে উপস্থিত করা হয় নাই; অতএব এই সভা অনুরােধ করিতেছেন যে, ভারত সচিব যদি বঙ্গবিভাগ আদেশ প্রত্যাহার না করেন, তবে অনুগ্রহপূর্বক বঙ্গবিভাগ অনুমােদনকল্পে তাঁহার আদেশ, হাউস অব কমন্সে এ বিষয়ের আন্দোলন পর্যন্ত, স্থগিত রাখুন।
দ্বিতীয় প্রস্তাব সমর্থন কালে, ময়মনসিংহের সুসন্তান মিঃ আবদুল হালিম গজনভি ওজস্বিনী ভাষায় যে একটী হৃদয়গ্রাহী বক্তৃতা করিয়াছিলেন, পাঠকবর্গের অবগতির নিমিত্ত, নিম্নে উহার সংক্ষিপ্ত মৰ্ম্ম বিবৃত হইল। মিঃ আবদুল হালিম গজনভির বক্তৃতা।
“ভাই হিন্দু মুসলমানগণ, এতদিনে বুঝিতে পারিয়াছ যে সত্য সত্যই আমাদের বিষম দুর্দিন উপস্থিত হইয়াছে। যদি যথার্থই উহা বুঝিয়া থাক, তবে এখনও নিরাশ হইও না ; কারণ এ দুর্দিনে এখনও সন্ধ্যা সমুপস্থিত হয় নাই। ভ্রাতৃগণ, অদম্য উৎসাহের সহিত কাৰ্য্যক্ষেত্রে অগ্রসর হও। হৃদয়ের সহিত কাৰ্য্য করিতে পারিলে কখনও উহা বিফল হইবে না। ছয় বৎসর পূর্বে বড়লাট লর্ড কার্জন যখন ভারতে উপস্থিত হইয়াছিলেন, তখন তিনি আমাদিগকে কত আশার কথাই না শুনাইয়াছিলেন। তিনি বলিয়াছিলেন, ভারতবাসীকে তিনি প্রাণের সহিত ভালবাসেন। ভাল, এখন আমরা তাহাকে জিজ্ঞাসা কেিত পারি কি, প্রভাে! তােমার ভালবাসা কি এইরূপ ? সােনার বাঙ্গালাকে আমাদিগের জননী জন্মভূমির দেহষষ্টিকে–খণ্ড খণ্ড করিয়া কি প্রভাে! তুমি তােমার সে ভালবাসা প্রদর্শন করিতে বসিয়াছে ?” একথা শুনিয়া সেদিন মাননীয় যােগেশ বাবু ছছাটলাটকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন, “বল, ছােট প্রভাে! কে কে তােমাকে বাঙ্গালা ভাগ করিতে বলিয়াছে ?” ছােটলাট সে কথার কোন স্পষ্ট উত্তর দিলেন না, কেবল বলিলেন, তিনি কাহারও নাম প্রকাশ করিতে পারেন না। মাননীয় অম্বিকাবাবু ছােটলাটকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন, “বল প্রভাে! তুমি ভিন্ন অপর কেহ কি কখনও বলিয়াছে যে “এই বাঙ্গালাদেশ শাসন করা একজন ছােটলাটের পক্ষে সম্ভবপর নহে?” ছােটলাট সে কথারও কোন উত্তর দেন নাই। আমরা বলি, ইতিপূৰ্ব্বে যখন কেহই এমন কথা বলেন নাই, তখন বর্তমান ছছাটলাট যদি এ দেশ শাসন করিতে একান্তই অসমর্থ হইয়া থাকেন, তবে তিনি কাৰ্যত্যাগ করিলেই পারেন। যে বােঝা তিনি বহিতে পারেন না, সে বােঝা তিনি মাথায় লইয়াছেন কেন ? যে কার্যের ভার যাহার উপর প্রদত্ত হয়, সে যদি উহা সম্পাদন করিতে না পারে, তবে তাহারই অকর্মণ্যতা প্রকাশ পাইয়া থাকে। তখন সেই কাৰ্য্য সম্পাদনের নিমিত্ত কার্যক্ষম লােকই নিযুক্ত করা হয়। কাৰ্য্যটী কিছু কাটিয়া ছাটিয়া ছােট করা হয় না। দৃষ্টান্তস্বরূপ আমাদের দেশের জমিদারী শাসনের কথা উল্লেখ করা যাইতে পারে। কোন জমিদারের নায়েব যদি তাহার এলাকাধীন স্থান সুশাসনে রাখিতে সমর্থ না হয়, তবে জমিদার কি ঐ এলাকা কাটিয়া ছাটিয়া ছােট করিয়া দেন, না ঐ কর্ম সম্পাদনের নিমিত্ত নূতন নায়েব নিযুক্ত করেন ? ছােটলাট যদি বঙ্গদেশ শাসনে অসমর্থ হইয়া থাকেন, তবে তাহার স্থানে নূতন ছােটলাট নিযুক্ত করিলেই তাে সকল গােল মিটিয়া যাইতে পারে। ভাই! তােমাদিগের এত লােককে সমবেত দেখিয়া আজ আমি আনন্দে বিহ্বল হইয়াছি। কেহ কেহ বলেন হিন্দু মুসলমানের মধ্যে শত্রুতা আছে । যাহারা এরূপ বলেন, আমি নিশ্চয় বলিতে পারি, তাহারা মিথ্যা বলিয়া থাকেন। হিন্দু মুসলমানের মধ্যে কখনও শত্রুতা হইতে পারে না ; কারণ হিন্দু ও মুসলমান, উভয়েই এক বঙ্গজননীর সন্তান। ভাই ভাই শত্রুতা হইবে কিরূপে? হিন্দু মুসলমানের জন্মভূমি বাঙ্গালাদেশ, ইংরেজের তাে জন্মভূমি বাঙ্গালা নহে ? তাই আজ আমরা হিন্দু মুসলমান সকলে বলি, তােমরা ভাগ করিতে হয় কর, আমরা কিন্তু ভাগ করিতে দিব না। ইংরেজরা পয়সাটীকে বেশ চিনেন। ততদূর থেকে ইংরেজ এসেছেন পয়সা নিতে ; সে পয়সা যদি বন্ধ করা যায়, তবে নিশ্চয়ই ভাল লাভ হইতে পারে। ভ্রাতৃগণ! এবার ইংরেজের পকেটে হাত দিতে হইবে। মিটিং তাে অনেক করা হইল; কিন্তু কিছুতেই যখন রাজপুরুষেরা শুনিতেছেন না, তখন এ ব্যবস্থাই প্রশস্ত। বলি, আমরা আমাদের ভাল বুঝি, না তােমরা
আমাদের ভাল বুঝ ? এখন হইতে আমরা স্বদেশী দ্রব্য ব্যবহার করিব। শতবৎসর পূর্বে কি দেশের কাপড়ে দেশের অভাব পূর্ণ হইত না? “হেঁড়া কাপড় পরিব, তথাপি বিদেশী কাপড় পরিব না,” সকলে এইরূপ প্রতিজ্ঞায় আবদ্ধ হউন। যদি এই প্রতিজ্ঞা স্থির রাখিতে না পারেন, তবে রাজনৈতিক আন্দোলন এই খানেই শেষ হইল বলিয়া জানিবেন। এবার দুর্গোৎসবে বা ঈদে কোন প্রকার আমাদের অনুষ্ঠান করা কর্তব্য নহে। অতএব ভ্রাতৃবৃন্দ। সকলে প্রতিজ্ঞায় আবদ্ধ হউন, এই বিপদ উত্তীর্ণ না হওয়া পর্যন্ত, আর কেহই কোন উৎসবে বা আনন্দে যােগদান করিবেন না। আজ ৩০ বৎসর হইল, আমাদের সম্মুখস্থ এই মহাপুরুষ দেশে যে পতাকা উড্ডীন করিয়াছেন, দেখিও ভ্রাতৃবৃন্দ তােমরা যেন তাহা তেমনই গৌরবের সহিত উডডীন রাখিতে সমর্থ হও। তােমরা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হইলে এ পতাকা চিরদিনই উডডীন থাকিবে।
বেঙ্গল টাইমস পত্রিকার সম্পাদক মি ক্যাম্প তৃতীয় প্রস্তাব উত্থাপন করিয়াছিলেন। সংক্ষেপে নানাবিধ যুক্তি দ্বারা মিঃ ক্যাম্প প্রথমে সভ্যগণকে এরূপ প্রস্তাবের প্রয়ােজনীয়তা বুঝাইয়া দিয়াছেন। বক্তৃতাকালে একস্থলে মিঃ ক্যাম্প বলিয়াছিলেন, “ঢাকার ন্যায় একটী সামান্য সহরে এই ব্যাপার উপলক্ষে যদি দশ সহস্র লােক প্রতিবাদ করিবার নিমিত্ত অদ্য উপস্থিত হইয়াছে, তবে এই ব্যাপারে দেশে না জানি কি ভীষণ আন্দোলনই সৃষ্ট হইয়া থাকিবে।” বাব সাধুচরণ রায়, ডাক্তার শিবচন্দ্র বসু এবং বাবু মুকুন্দবিহারী চক্রবর্তীর অনুমােদন মতে প্রস্তাব সর্বসম্মতি ক্রমে পরিগৃহীত হয়। তৃতীয় প্রস্তাবের মর্ম এইরূপঃ
১৯০৪ সনের ১৮ই মার্চ তারিখে কলিকাতা টাউনহলে সভায় জনসাধারণের যে আবেদনপত্র গৃহীত হইয়াছিল, ঐ আবেদনপত্রে জনসাধারণ প্রার্থনা করিয়াছিল যে, বঙ্গের শাসনকর্তার কার্যভার যদি কমাইতে হয়, তবে বঙ্গদেশকে প্রেসিডেনসী গভর্ণমেন্টে উন্নীত করিয়া, তাহার শাসনের নিমিত্ত একজিকিউটিভ কাউন্সিল সহ জনৈক বিলাতবাসী রাজনীতিবেত্তাকে গবর্ণররূপে নিযুক্ত করাই ঐরূপ কাৰ্য লাঘবের প্রকৃস্ট উপায়। ঐরূপ ব্যবস্থা, প্রস্তাবিত বঙ্গবিভাগ অপেক্ষা বহু পরিমাণে অল্পব্যয়সাপেক্ষ। কারণ প্রস্তাবিত বঙ্গবিভাগে রেভিনিউ বাের্ড, সেক্রেটেরিয়েট এবং অন্যান্য প্রয়ােজনীয় আফিসাদিসহ লেপ্টেন্যান্ট গভর্ণর সৃষ্টি করিতে, প্রথমতঃ এবং প্রতি বৎসরের নিমিত্ত গুরুতর ব্যয়ভার বহনের আবশ্যক হইবে। এই সভা জনসাধারণের উল্লিখিত প্রার্থনার পুনরুক্তি করিতেছেন।
তৃতীয় প্রস্তাবের সমর্থনকল্পে বাবু হেরম্বচন্দ্র মৈত্র যে বক্তৃতা করিতেছিলেন নিয়ে তাহার সংক্ষিপ্ত মৰ্ম প্রদত্ত হইল।
বাবু হেরম্বচন্দ্র মৈত্রের বক্তৃতা
তৃতীয় প্রস্তাবের সমর্থনকালে কলিকাতা সিটি কলেজের স্বনামখ্যাত অধ্যাপক বাবু হেরম্বচন্দ্র মৈত্র যে একটা সারগর্ভ বক্তৃতা প্রদান করিয়াছিলেন, তাহার সংক্ষিপ্ত মৰ্ম্ম এইরূপ :
“সমবেত সভ্য মহােদয়গণ, ঘটনাচক্রে আজ আমার কণ্ঠস্বর ভাঙ্গিয়া গিয়াছে কিন্তু ভগ্নকণ্ঠ হইলেও এই জাতীয় আন্দোলন সম্বন্ধে আমি ভগ্ন প্রাণ নহি। এই সৰ্বব্যাপী
আন্দোলনে যে আমার গভীর অনুরাগ আছে, তাহা প্রকাশ করিবার নিমিত্ত আজ আমি এইরূপ রুদ্ধকণ্ঠস্বর লইয়াও আপনাদের সমক্ষে দণ্ডায়মান হইয়াছি। এই প্রস্তাব উপলক্ষে আমার দুই একটী কথা বলিবার আছে। অনেকেই সম্যক অবগত নহেন যে, সকৌন্সিল গভর্ণর এবং লেপ্টেন্যান্ট গভর্ণরের প্রভেদ কি ? লেপ্টেন্যান্ট গভর্ণরের শাসনকার্য এক ব্যক্তি কর্তৃকই পরিচালিত হইয়া থাকে। লেপ্টেন্যান্ট গভর্ণর একাকী যাহা সঙ্গত বা অসঙ্গত মনে করেন, তদনুসারেই শাসনকার্য সম্পন্ন হয়। কিন্তু সকৌন্সিল গভর্ণরের শাসন পদ্ধতিতে একাকী কাহারও কিছু করিবার অধিকার নাই। কৌন্সিলের অধিকাংশ সদস্য এবং গভর্ণর একমত না হইলে কোন কাৰ্য্যই সম্পন্ন হইতে পারে না। কাযেই একজন কর্তৃক পরিচালিত শাসন ব্যাপার যে সকল ভ্রম প্রমাদাদিদোষ-দুষ্ট হইতে পারে , সকৌন্সিল গভর্ণরের শাসনে দ্রুপ প্রমাদের সম্ভাবনা অনেক পরিমাণে হ্রাস হইয়া থাকে। দৃষ্টান্তস্বরূপ এখানে একটী কথার উল্লেখ করিতেছি। সকলেই জানেন, বর্তমান বড়লাট বঙ্গ-বিভাগ কাৰ্য্য সত্বর সম্পাদনের নিমিত্ত কিরূপ ব্যগ্র । কিন্তু এই কাউন্সিল থাকাতে বড়লাটের ব্যগ্রতা কার্যে পরিণত হইতে পারে নাই। বিশ্বস্তভাবে শুনিয়াছি, এইরূপ সার্বজনিক প্রতিবাদের সম্মুখে সহসা এরূপ কাৰ্য্য সম্পন্ন করা সঙ্গত নহে বলিয়া কাউন্সিলের কোন সদস্য অভিমত প্রকাশ করাতে, গত বৎসর বঙ্গ বিভাগ ব্যাপার সম্পন্ন হয় নাই। ইহা হইতেই দেখা যাইতেছে লেপ্টেন্যান্ট গভর্ণরের শাসন এবং কাউন্সিলস্থ সদস্যগণের সুপরামর্শ দ্বারা পরিচালিত গভর্ণরের শাসনে পার্থক্য কত। কাজেই গভর্ণর হইলে বহু বিপদ হইতে আমরা উদ্ধার পাইতে পারিব । ভাল, যে জন্য আমরা এত অনুরােধ করিতেছি, কেন আমরা সেই গভর্ণর পাইতে পারিব না? বােম্বাই ও মাদ্রাজ যদি গভর্ণর পাইতে পারিয়াছে, তবে বঙ্গের জন্য গভর্ণরের ব্যবস্থা হইবে না কেন? শিক্ষায় বা সভ্যতায় বঙ্গদেশ তাে অপর কোন দেশ অপেক্ষা হেয় নহে। লেপ্টেন্যান্ট গভর্ণর তাে ইণ্ডিয়ান সিভিল সাব্বিসের অন্তর্গত সিভিল সার্বিসের লােক হইয়া তিনি সেই সিভিল সাব্বিসস্থ অধীন রাজপুরুষগণের বিচার করিয়া থাকেন সুতরাং এক্ষেত্রে কিরূপ ন্যায় বিচার হয় তাহা সহজেই বােধগম্য । তিলকের মােকদ্দমার বিবরণ বােধ হয় সকলেই অবগত আছেন। বােম্বাই হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি স্যার লরেন্স জেঙ্কিন্স তিলককে মুক্তিদান কালে গভর্ণমেন্টের কাৰ্য্যে তীব্র ভাষায় দোষারােপ করিয়া যেরূপ ন্যায়ের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করিয়াছিলেন, মাননীয় জেঙ্কিন্স মহােদয় সিভিল সাব্বিসের লােক হইলে তিনি তদ্রুপ করিতে পারিতেন কি ? এসকল বিবেচনা করিলে সহজে বুঝা যাইবে শাসনকর্তার পদে, সিভিল-সাব্বিসাতিরিক্ত লােকের নিযুক্তি কিরূপ মঙ্গলজনক। তৃতীয়তঃ ব্যয়ের কথা প্রস্তাবানুরূপ নূতন প্রদেশ গঠন যেরূপ বহুব্যয়সাপেক্ষ তত ব্যয় স্বীকার সমীচীন কি না। যে দেশে জলকষ্টে লােকের প্রাণবায়ু বহির্গত হইয়া যায়, ম্যালেরিয়ার প্রবল প্রকোপে নিত্য যে দেশ উৎসন্ন হইতেছে, সেই দারিদ্র পীড়িত, অনশনক্লিষ্ট দেশের টাকা এরূপ ভাবে ব্যয় করা সাজে কি ? অভাগা অধিবাসিবৃন্দের অভাবাদি দূরীকরণকালে যখন আমরা টাকা চাহিয়া থাকি তখন রাজকোষে অর্থের অভাব হইয়া থাকে। কিন্তু এরূপ অন্যায় ও সম্পূর্ণ অনাবশ্যকীয় কার্য সম্পাদনের জন্য গভর্ণমেন্টের অর্থের অভাব হয় না। নূতন প্রদেশ সৃষ্টি না করিয়া বঙ্গের জন্য সকৌন্সিল গভর্ণরের ব্যবস্থা করিলে তাে এত ব্যয় বহনের কোনই প্রয়ােজন হয় না। দ্বিতীয়তঃ যিনি গভর্ণর হইবেন তিনি সিভিল
সার্ভিসের লােক নহেন। তিনি একজন ইংলিস ষ্টেটসম্যান। ভারতের দূষিত বায়ু সংস্পর্শে তাহার বুদ্ধিবৃত্তি মলিনতা প্রাপ্ত হয় নাই । স্বাধীন জাতির স্বাধীন সাম্রাজ্যের পবিত্রতা পুষ্ট প্রশান্ত প্রাণ এবং উদার হৃদয় লইয়া তিনি এ দেশে আসিবেন। সুতরাং তাঁহার নিকট সর্বপ্রকারেই সুশাসনের প্রত্যাশা করা যাইতে পারে। এই বঙ্গদেশের জন্য গভর্ণর নিযুক্ত করা হইবে বলিয়া প্রথমতঃ ১৮৩৩ সালে এবং ১৮৫৩ সালে পার্লামেন্ট মহাসভা প্রতিশ্রুতি প্রদান করিয়াছিলেন। আজ প্রায় শত বৎসর পরে এখন বলা হইতেছে, তােমরা গভর্ণর পাইবার উপযুক্ত নও। ১৮৩৩ বা ১৮৫৩ সনে যদি আমরা গভর্ণর পাইবার উপযুক্ত বিবেচিত হইয়াছিলাম, তবে এখন আমরা অনুপযুক্ত হইলাম কিরূপে? একথা যদি সত্য হয়, তবে আমাদের এরূপ অযােগ্যতার জন্য তােমরাইতাে একমাত্র দায়ী। তােমাদের সুশাসনগুণে আমাদের তবে এই হইয়াছে যে, পূর্বে যদিও আমরা গভর্ণর পাইবার উপযুক্ত বিবেচিত হইতাম, এখন তন্নিমিত্ত অযােগ্য বিবেচিত হইতেছি । ইহাতে তােমাদের শাসন মাহাত্ম্য কীর্তিত হইতেছে না কি।
যাক এসব কথা। এখন মূল কথা হইতেছে কোন সভা সমিতি করিয়া আমরা আমাদের আবেদন গ্রহণ করাইতে পারিব না। আমরা যদি আপনার পায়ে দাড়াইতে সমর্থ হই তবেই আমরা সম্মানিত হইব। তাই বলিতেছি, ভ্রাতৃগণ, এস আজ এ শুভমুহূর্তে সকলে বিধাতার দিকে চাহিয়া প্রতিজ্ঞা করি, “আমরা আপনার পায়েই দাঁড়াইতে শিখিব”। এখন হইতে আমরা একমাত্র স্বদেশেৎপন্ন দ্রব্যজাতই ব্যবহার করিব। সকলে যদি আমরা এ পবিত্র প্রতিজ্ঞা পালন করিতে পারি, তবে নিশ্চয়ই শুভফল লাভ হইবে। আমি প্রতিজ্ঞা করিয়া যাইতেছি, কলিকাতা যাইয়াই নিজের পরিধানার্থ দেশী মিলের মােটা মার্কিন কাপড় ক্রয় করিব। অনেকে বলেন আপততঃ দেশী কাপড় তেমন প্রচুর পরিমাণে মিলিবে কোথায় ? একথা সত্য হইলেও ছয় মাসের মধ্যেই আমাদের প্রয়ােজনানুরূপ দেশীয় কলাদির আমদানি হইতে পারিবে এই সামান্য ছয়টা মাস কি আমরা কোন প্রকারে কাটাইয়া দিতে পারিব না ? ছিন্নবস্ত্র পরিধান করিয়াও তাে এই ছয়টা মাস কাটাইয়া দেওয়া যাইতে পারে। বিধাতার কৃপায় আজ সমগ্র বঙ্গে যে এক প্রাণতা পরিলক্ষিত হইতেছে ইতিপূর্বে আর কখনও তদ্রুপ দৃষ্টিগােচর হয় নাই। আজি এ দুঃখের দিনে এই একপ্রাণতাই আমাদের একমাত্র সম্বল। ভাই বঙ্গ সন্তান। যদি স্বদেশের ও স্বজাতির কল্যাণ সাধন করিতে চাও, তবে প্রাণপণে তােমাদের এই একপ্রাণ রক্ষা কর। এই একপ্রাণতার ভাব দেশে স্থায়ী হইলে নিশ্চয়ই জন্মভূমির মলিন মুখে হাসির রেখা দেখা দিবে।
চতুর্থ প্রস্তাব উত্থাপন করেন, জগন্নাথ কলেজের প্রিনসিপ্যাল বাবু ললিতমােহন চট্টোপাধ্যায়। বাবু যােগেন্দ্রনাথ রায় চৌধুরী ও বাবু সুরেন্দ্রনাথ সেন এবং শ্রীযুক্ত মৌলবী হেদায়েত বক্স এবং শ্রীযুক্ত জে, চৌধুরী বক্তৃতা করিয়া শ্ৰোতৃমণ্ডলীকে উদ্দীপিত করিয়াছিলেন। আমরা উহা প্রকাশ করিতে পারিলাম না। চতুর্থ প্রস্তাব এইরূপ ঃ
বঙ্গবিভাগ প্রস্তাব প্রত্যাহৃত না হওয়া পর্যন্ত বিলাতী দ্রব্যাদি ক্রয় করিতে বিরত থাকার নিমিত্ত টাউনহলের সভায় যে প্রস্তাব নির্ধারিত হইয়াছে, ঐ প্রস্তাব কার্যে পরিণত করিবার নিমিত্ত এ সভা স্থানীয় কয়েকজন সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিকে লইয়া একটা ডিষ্ট্ৰীক্ট ষ্টাণ্ডিং কমিটী গঠন করিতেছেন। উহারা ডিষ্ট্ৰীক্ট, সাবডিভিসন্যাল এবং ভিলেজ কমিটী গঠন
করিয়া ও জিলার বহুজনপূর্ণস্থ স্থানসমূহের দেশীয় দ্রব্যাদি উপযুক্তরূপে সরবরাহের ব্যবস্থা করিয়া এই প্রস্তাব কার্যে পরিণত করিতে চেষ্টা করিবেন।
বাবু সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তৃতা
সৰ্বশেষে বঙ্গমাতার শ্রেষ্ঠ সন্তান, উদ্যোগ ও উৎসাহের জীবন্ত-বিগ্রহ বাবু সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় জলগম্ভীরদে সভাস্থল বিকম্পিত করিয়া যেরূপ উদ্দীপনাপূর্ণ বাক্যে সমবেত সভ্যমণ্ডলীকে উৎসাহিত করিয়াছিলেন তাহার বিস্তৃত বিবরণ প্রদান করা সম্ভবপর নহে। পাঠকবর্গের অবগতির নিমিত্ত নিম্নে আমরা তাহার বক্তৃতার অতি সংক্ষিপ্ত মর্মানুবাদ প্রদান করিতেছি মাত্র। সহস্র সহস্র হস্তে নিনাদিত করতালির মধ্যে দণ্ডায়মান হইয়া সুরেন্দ্র বাবু বলিতে লাগিলেন ।
আমার সম্মুখে এই বিরাট জনসমুদ্র দেখিয়া আমি একান্তই উফুল্ল হইয়াছি। ঢাকার শিক্ষিত ও সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিবৃন্দ এরূপ বিরাট সভায় সমবেত হইয়া লর্ড কার্জনের বঙ্গবিভাগ প্রস্তাবের প্রতিবাদ করিতে দণ্ডায়মান হইয়াছে এ দৃশ্য বস্তুতই আশাপ্রদ। এই বিশাল জনমণ্ডলীকে দেখিয়া আমার বড়ই ইচ্ছা হইতেছে, এ সময় যদি কেহ লর্ড কার্জনের পক্ষ হইতে এখানে উপস্থিত থাকিয়া ঢাকাবাসীর মানসিক অবস্থার বিষয় জানিয়া যাইতেন, তাহা হইলে বড়লাট বুঝিতে পারিতেন, ঢাকার জনসাধারণ তাঁহার প্রস্তাব কি ভাবে গ্রহণ করিয়াছে। ঢাকাবাসিগণ, আপনারা বঙ্গবিভাগ প্রস্তাবের তীব্র প্রতিবাদ করিতেছেন, এবং ঢাকানগরীকে রাজধানী করা রূপ যে প্রলােভন আপনাদিগকে দেখান হইয়াছে তাহাতে আপনারা মুগ্ধ হন নাই দেখিয়া আমি একান্ত আনন্দিত হইয়াছি। আপনারা কখনও মনে করিবেন না যে ঢাকাতে নূতন প্রদেশের স্থায়ী রাজধানী প্রতিষ্ঠিত হইবে। প্রকৃতির অবস্থার দিকে চাহিলেও এরূপ ব্যাপার সম্ভবপর মনে হয় না। কারণ আপনাদের নদী দিন দিনই শুকাইয়া যাইতেছে। নদী না থাকিলে কখনই বাণিজ্যের সুবিধা হইতে পারে না। যদি ঢাকার সম্মুখস্থ নদীর এরূপ অবস্থা, তখন এক অতিমাত্রায় বাণিজ্যপ্রবণ জাতি এখানে রাজধানী স্থাপন করিয়া রাজত্ব করিবেন ইহাও কি কখন সম্ভব ? শিলং পাহাড়েই নূতন প্রদেশের প্রকৃত রাজধানী স্থাপিত হইবে এবং বাণিজ্যের জন্য চাটগাতেও রাজধানী থাকিবে। সুতরাং ঢাকাতে রাজধানী স্থাপনের যে প্রলােভন দেখান হইয়াছে, ঢাকাবাসীকে আন্দোলন হইতে নিরস্ত করাই তাহার উদ্দেশ্য।
যদি বা ঢাকায় রাজধানী হয় তাহা হইলেই বা আপনাদের কি সুবিধে হইবে ? পরন্তু আসামের অন্তর্ভূত হওয়াতে আপনাদিগকে বহু প্রকারের অসুবিধা ভােগ করিতে হইবে। আপনারা জানেন, আসাম ডিপুটী কমিশনারের দেশ। সেখানকার ডিষ্ট্ৰীক্ট অফিসারগণ আসামীকে সাত বৎসরের তরে জেলে পাঠাইতে পারেন। সংক্ষেপতঃ আসামকে যথেচ্ছাচারতন্ত্রের অধীন বলা যাইতে পারে। এমন প্রদেশের সহিত সম্মিলিত হইয়া লেপ্টেন্যান্ট গভর্ণর পাইলেও আপনাদের কোনও সুবিধা হইবে না। বর্তমান সময়ে বঙ্গের এত উন্নতি হইয়াছে কিরূপে, জানেন কি ? বঙ্গবাসীর সমৃদ্ধি বা শিক্ষা এই উন্নতির কারণ নহে, সংবাদপত্রের সৃষ্টিই এই উন্নতির মূলীভূত। বহু চেষ্টার পর বঙ্গের সংবাদপত্র দেশের
এক বিশেষ শক্তিরূপে এখন দণ্ডায়মান হইয়াছে ? ইহারই প্রভাবে এখন বঙ্গসন্তান আপনার স্বার্থ সুবিধা প্রভৃতি সম্যক উপলব্ধি করিতে সমর্থ হইয়া তৎসমূহের রক্ষণার্থ সমুচিত যত্ন করিতে শিক্ষা পাইয়াছে। শত বৎসরের চেষ্টায় আমরা এই সংবাদপত্রকে দেশের এক প্রবল শক্তিরপে পরিণত করিয়াছি। এই সংবাদপত্রের অভ্যুদয় ও উন্নতির সহিত স্বর্গীয় হরিশ্চন্দ্র মুখােপাধ্যায়৩৫ ও কৃষ্ণদাস পালের৩৬ নাম চিরদিন কীৰ্ত্তিত হইবে। আমাদের শত বৎসরের চেষ্টায় বঙ্গে যদি এই সংবাদপত্রের সৃষ্টি হইয়াছে, তবে নূতন প্রদেশে আপনারাও শত বৎসরের পরে এইরূপ সংবাদপত্রের সষ্টি কেিত পা…

Comments

Popular posts from this blog

ভাড়াটিয়া-ভাড়াদার আইনের জটিলতা পার হওয়া: ভাড়াটিয়াদের জন্য একটি গাইড

একটি ভিত্তিহীন গুজব উড়িয়ে দেওয়া: বাংলাদেশী সাংবাদিকদের ফ্রেঞ্চ ভিসা প্রত্যাখ্যান করা হয়নি৷

অধ্যায় 2: বাংলায় ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন