স্ত্রী যতদিন তার স্বামীর আস্থাভাজন থাকবে ও স্বামীর ন্যায় সঙ্গত আদেশ পালন করবে, ততদিন স্বামী স্ত্রীকে ভরনপোষন দিবে। কিন্তু যে স্ত্রী স্বামীর সাথে যৌনমিলন অস্বীকার করবে অথবা অন্য কোন প্রকার স্বামীর অবাধ্য হবে সে স্ত্রীকে ভরণপোষন দিতে স্বামী বাধ্য থাকবে না। (মিতা খান বনাম হেমায়েত বিবি, ১৪ ডিএলআর (হাইকোর্ট), পৃষ্ঠা-৪৫৫)। তবে কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণে স্ত্রী আলাদা বসবাস করলে স্বামী ভরণপোষণ দিতে বাধ্য। (মোঃ ইব্রাহিম হোসেন সরকার বনাম মোসা. সোলেমান্নেসা (১৯৬৭, ১৯ ডি এল আর পৃষ্ঠা ৭৫১)।
স্ত্রী কখন ভরণপোষণ পাবে না-
১. স্ত্রী স্বামীর নিষেধাজ্ঞা সত্বেও যেখানে স্বামী অবস্থান করে সেখানে ভিন্ন অন্যত্র বসবাস করলে।
২. স্ত্রী বন্দিদশায় থাকলে। তবে স্বামী বন্দিদশায় থাকলে স্ত্রী ভরণপোষন হতে বঞ্চিত হবে না।
৩. স্ত্রী অন্যায়ভাবে অবাধ্য হয়ে স্বামীর অনুমতি ছাড়া অসংগত কারণে স্বামীর গৃহ ত্যাগ করলে।
৪. স্ত্রী ধর্মত্যাগ করলে
৫. স্ত্রীর অবাধ্যাচারণে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটলে।
৬. স্বামীর মৃত্যুজনিত কারণে ইদ্দত পালনরত থাকলে; তবে শর্ত হলো যে, বিধবা অন্তঃসত্তা হলে গর্ব খালাস না অবধি খোরপোষ পাবে।
৭. স্ত্রীকে অপহরণ করে নিয়ে গেলে।
স্বামী যতই গরীব হোক না কেন, তাতে স্ত্রীর অধিকার নষ্ট হয় না। স্ত্রীর খোরপোষ স্বামীর জন্য বাধ্যতামূলক। স্বামীর এ দায়িত্ব ব্যক্তিগত। তবে স্ত্রীর খোরপোষ বা ভরণপোষন শর্তসাপেক্ষে।
ভরণপোষণের শর্ত-
১. স্বামী তাঁর স্ত্রীকে ভরণপোষণ দিতে বাধ্য। স্ত্রীও ভরণপোষণ পেতে হকদার।
২. স্বামী যদি স্ত্রীর সঙ্গে অভ্যাসগতভাবে খারাপ ব্যবহার করে, গৃহত্যাগের নির্দেশ দেয়, তাড়িয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্র করে থাকে অথবা তাদের মধ্যকার আচার-আচরণ এরূপ পর্যায়ে পৌঁছায় যে, এটা নিরসন করা সম্ভব নয় বা স্বামীর গৃহে থাকলে আরও অসুবিধা এবং বিরোধের জন্ম দিবে, সে অবস্থায় স্ত্রী স্বামীর সঙ্গে বসবাস না করেও খোরপোষ দাবি করতে পারে।
৩. স্ত্রী তার আশু দেনমোহর দাবি করলে উক্ত দেনমোহর স্বামী পরিশোধ না করলে স্ত্রী তার স্বামীর কাছ থেকে পৃথক বসবাস করতে থাকলেও স্বামী তার ভরণপোষণ দিতে বাধ্য থাকবে।
ভরণপোষণ পরিশোধের নিয়ম-
১. মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ, ১৯৬১ এর ৯ ধারার বিধান অনুসারে সালিশী পরিষদ (চেয়ারম্যান/মেয়র) স্বামী কর্তৃক স্ত্রীকে উপযুক্ত খোরপোষ উল্লে¬খ করে প্রত্যয়নপত্র প্রদান করবে।
২. বিবাহ যতদিন বলবৎ থাকবে, ততদিনই স্বামী খোরপোষ দিতে বাধ্য থাকবে।
৩. খোরপোষের পরিমাণ নির্ধারণ করার সময় সালিশী পরিষদ স্ত্রীর পরিবারের সামাজিক পদমর্যাদা, স্বামীর উপার্জন এবং অন্যান্য বিষয়াবলিও বিবেচনা করে খোরপোষের পরিমাণ নির্ধারণ করবে।
৪. স্ত্রীকে এমন পরিমাণ খোরপোষ মঞ্জুর করতে হবে যা দ্বারা স্ত্রী ঠিকমত জীবনযাপন করতে পারে।
তবে কোন স্ত্রী যদি তাহার সহিত সহ-অবস্থানে এবং স্ত্রীর কর্তব্য পালনে সুনির্দিষ্ট এবং বৈধ কারণ ব্যতিতই অস্বীকার করে সেইক্ষেত্রে স্বামী স্ত্রীকে ভরনপোষণ দিতে বাধ্য নয়। (১৪ ডিএলআর, ৪১৫)।
ভরণপোষণ আদায় ও স্থানীয় সালিশী পরিষদের ভুমিকা-
১. কোনো স্বামী তার স্ত্রী/স্ত্রীগণকে সমান খোরপোষ না দিলে স্ত্রী/স্ত্রীগণ ভরণপোষণ আদায়ের জন্য মুসলিম পারিবারিক আইন বিধিমালা, ১৯৬১ এর বিধি-৫ অনুযায়ী স্থানীয় চেয়ারম্যানের নিকট আবেদন করতে পারবে। চেয়ারম্যান বিষয়টি সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণের উদ্দেশ্যে একটি সালিশী পরিষদ গঠন করবে। উক্ত সালিশী পরিষদ স্বামী কর্তৃক খোরপোষ হিসাবে দেয় টাকার পরিমাণ নির্ধারণ করতঃ একটি সার্টিফিকেট ইস্যু করতে পারবে। স্বামী অথবা স্ত্রী নির্ধারিত পদ্ধতিতে, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নির্ধারিত ফি জমা দিয়ে ইস্যুকৃত সার্টিফিকেটটি পুনঃবিবেচনার উদ্দেশ্যে সহকারী জজের নিকট আবেদন করতে পারবে এবং এক্ষেত্রে সংশ্লি¬ষ্ট সহকারী জজের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত হবে এবং এর বৈধতা সম্পর্কে কোন আদালতে প্রশ্ন উত্থাপন করা যাবে না।
২. উপরোক্তরূপে দেয় কোন অর্থ যথাসময়ে প্রদান করা না হয়ে থাকলে এটা বকেয়া রাজস্বের আকারে আদায়যোগ্য হবে।
৩. উপরোক্ত কোন শর্ত ভঙ্গ করলে, চেয়ারম্যান কর্তৃক সালিশী পরিষদের সিদ্ধান্ত না মানলে এবং আদালতের নিয়ম নির্দেশ অমান্য করলে স্ত্রী স্বামীর বিরুদ্ধে আদালতের আশ্রয় নিতে পারে।
এ আইনের ৫ ধারা বিধান মতে, কেবলমাত্র একজন স্ত্রী তার ভরণপোষণের জন্য মামলা দায়েরের অধিকারিণী নয় বরং সে তার সন্তানের জন্যও মামলা দায়ের করতে পারে। (জামিলা খাতুন বনাম রুস্তম আলী, ৪৮ ডিএলআর, আপিল বিভাগ, পৃষ্ঠা-১১০)।
স্ত্রী অতীত ভরণপোষণ পেতে হকদার নয়। কেবলমাত্র মামলা দায়েরের তারিখ থেকে বিয়েবিচ্ছেদের পর তিন মাস পর্যন্ত স্ত্রীর জন্য ভরণপোষণ মঞ্জুর করা যায়। (আব্দুল ফতে বনাম জেবুন নেসা ১৮৮১, ৬ ক্যাল. পৃষ্ঠা-৬৩১)।
যদি কোন মুসলমান স্ত্রী তার স্বামীর অন্য স্ত্রীকে তালাক না দেয়ায় স্বামীর সাথে বসবাস করতে অস্বীকার করে; সেক্ষেত্রে স্ত্রী ভরণপোষণের অধিকারিনী হয় না। ভরণপোষণ না পাবার কারণে ওই স্ত্রী বিবাহবিচ্ছেদের ডিক্রিও পেতে পারে না। (এআইআর ১৯৪৪ লাহোর ৩৩৬)।
বিয়ের পর যদি স্বামীর সাথে দৈহিক মিলন অনুষ্ঠিত না হয় তাহলে স্ত্রী ভরণপোষণ পেতে হকদার নয়। (১১ ডিএলআর ৯৩)। তবে স্ত্রীকে অবশ্যই প্রমাণ করতে হবে যে তার ভরণপোষণের জন্য স্বামী আইনত বাধ্য ছিল। (১১ ডিএলআর ১৭)।
ভরণপোষণের পরিমাণ স্বামী-স্ত্রীর সামাজিক মর্যাদা ও আর্থিক সংগতির ওপর নির্ভর করে। অনেক সময় নিকাহনামায় উল্লেখ থাকে, স্বামী মাসিক কত টাকা ভরণপোষণ হিসেবে দেবেন। সাধারণ অবস্থায় স্বামী তাঁর নিজ গৃহেই স্ত্রী বা স্ত্রীদের খাদ্য, বস্ত্র ও বাসস্থান দিয়ে থাকেন। আইনসংগত বা যুক্তিযুক্ত কারণে যখন স্ত্রী আলাদা বসবাস করেন, তখন স্বামী নগদ অর্থ দ্বারা ভরণপোষণ জোগাবেন।
ভরনপোষন না পেলে স্ত্রী বিবাহ বিচ্ছেদের ডিক্রি পেতে পারে-
মুসলিম বিবাহ-বিচ্ছেদ আইন, ১৯৩৯ অনুযায়ী স্বামী দুই বছর ধরে ভরণপোষণ প্রদানে ব্যর্থ হলে বা অবহেলা করে ভরণপোষণ না দিয়ে থাকলে স্ত্রী বিবাহ-বিচ্ছেদের ডিক্রি পাওয়ার অধিকারী হবেন। এক্ষেত্রে একটি মামলার কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। মামলাটি হলো সাফুরা খাতুন বনাম ওসমান গনি মোল্লা (১৯৫৭) ৯ ডি এল আর, ৪৫৫। এই মামলায় বলা হয়েছে যে, স্বামীর দেয়া ভরণপোষণ ছিল একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনার মতো। স্বামীর যে পরিমান ভরণপোষণ দেয়ার কথা ছিল, তার সামান্য পরিমান তাকে স্বামী পরিশোধ করত তাও আবার খুব অনিয়মিত। সুতরাং এক্ষেত্রে ধরা হবে যে, উক্ত স্বামী কাবিননামার শর্ত পালন করেননি এবং এ কারনেই স্ত্রী তালাক-ই-তৌফিজের ব্যবহার করতে পারেন এবং বিবাহ-বিচ্ছেদের আবেদন করতে পারেন।
বিয়ের প্রমাণ-
ভরণপোষণের জন্য কোনো প্রত্যয়নপত্র মঞ্জুর করার আগে পক্ষগণের (স্বামী-স্ত্রীর) ব্যক্তিগত আইনের সূত্রে বিয়ের বিষয়টি অবশ্যই সুনির্ধারিত হতে হবে। যদি বিয়েটি অস্বীকার করা হয়, তাহলে একটি বৈধ বিয়ে অনুষ্ঠিত হয়েছিল, এটি সন্তোষজনকভাবে প্রমাণিত হতে হবে এবং বিয়েটি প্রমাণের দাযিত্ব স্ত্রীর ওপর বর্তাবে। এ কারণেই বিয়ের নিবন্ধন ভরণপোষণ দাবির ক্ষেত্রে খুব প্রয়োজনীয়।
Comments