ছোট সোনা মসজিদ ‘সুলতানি স্থাপত্যের রত্ন’ বলে আখ্যায়িত। এটি বাংলার রাজধানী গৌড়-লখনৌতির ফিরুজপুর কোয়ার্টারের তাহখানা কমপ্লেক্স থেকে অর্ধ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে এবং কোতোয়ালী দরওয়াজা থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত। বিশাল এক দিঘির দক্ষিণপাড়ের পশ্চিম প্রান্ত জুড়ে এর অবস্থান। মসজিদের কিছুদূর পশ্চিমে বাংলাদেশ সরকারের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর কর্তৃক কয়েক বছর পূর্বে নির্মিত একটি আধুনিক দ্বিতল গেস্ট হাউস রয়েছে। গেস্ট হাউস ও মসজিদের মধ্য দিয়ে উত্তর-দক্ষিণে একটি আধুনিক রাস্তা চলে গেছে। ধারনা করা হয় রাস্তাটি পুরনো আমলের এবং একসময় এটি কোতোয়ালী দরওয়াজা হয়ে দক্ষিণের শহরতলীর সঙ্গে গৌড়-লখনৌতির মূল শহরের সংযোগ স্থাপন করেছিল।
প্রধান প্রবেশপথের উপরিভাগে স্থাপিত একটি শিলালিপিঅনুযায়ী জনৈক মজলিস-ই-মাজালিস, মজলিস মনসুর ওয়ালী মুহম্মদ বিন আলী কর্তৃক মসজিদটি নির্মিত হয়। শিলালিপিতে নির্মাণের সঠিক তারিখ সম্বলিত অক্ষরগুলি মুছে গেছে। তবে এতে সুলতান আলাউদ্দীন হোসেন শাহএর নামের উল্লেখ থেকে এটা সুস্পষ্ট যে, মসজিদটি তাঁর রাজত্বকালের (হি. ৮৯৯-৯২৫/ ১৪৯৩-১৫১৯ খ্রি.) কোনো এক সময় নির্মিত।
বাংলাদেশ সরকারের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর কর্তৃক সংরক্ষিত সুলতানি আমলের সৌধগুলির মধ্যে ছোট সোনা মসজিদ সর্বোত্তম সংরক্ষণ-নিদর্শন। অলংকরণের ক্ষেত্রে যে সোনালি গিল্টির ব্যবহার থেকে এর সোনা মসজিদ নামকরণ হয়েছে তা এখন আর নেই। মসজিদ প্রাঙ্গণের চতুর্দিকে আদিতে একটি বহির্দেওয়াল ছিল। পূর্ব পশ্চিমে ৪২ মিটার এবং উত্তর দক্ষিণে ৪৩ মিটার লম্বা এ বহির্দেওয়ালের পূর্ব দিকের মধ্যবর্তী স্থানে একটি ফটক ছিল। শুধু ফটকটি ছাড়া সমগ্র বহির্দেওয়াল এখন সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। তবে স্থানে স্থানে এখনও এর চিহ্ন সুস্পষ্ট।
বর্তমানে মূল চৌহদ্দি দেওয়ালের স্থলে কাঁটাতারের বেড়া বসানো হয়েছে। স্থানীয় লোকদের থেকে জানা যায় যে, ফটকের নিকটে এবং দিঘির দক্ষিণপাড়ে আদিতে সোপানবিশিষ্ট একটি পাকা ঘাট ছিল। মসজিদটি ইট ও পাথরে নির্মিত। এ মসজিদের মূল ইমারত আয়তাকার এবং বাইরের দিকে উত্তর দক্ষিণে ২৫.১ মিটার এবং পূর্ব পশ্চিমে ১৫.৯ মিটার। চারটি দেওয়ালই বাইরের দিকে এবং কিছুটা অভ্যন্তরভাগেও গ্রানাইট পাথরখন্ডের আস্তরণ শোভিত। ১৮৯৭ সালে ভূমিকম্পের ধ্বংসলীলার পর সংস্কার কাজের সময় পশ্চিম দেওয়ালের দক্ষিণ অংশে পাথরের আস্তরণ অপসারিত হয়েছে। মসজিদের বাইরের দিকে চার কোণে চারটি বহুভুজাকৃতির বুরুজের সাহায্যে কোণগুলিকে মজবুত করা হয়েছে। এ বহুভুজ বুরুজের নয়টি পার্শত বাইরে থেকে দেখা যায়। পেছন দেওয়ালের মধ্যবর্তীস্থলে কেন্দ্রীয় মিহরাবের বাইরের দিকে আয়তাকার একটি বর্ধিত অংশ রয়েছে। কার্নিশগুলি ধনুকের মতো বাঁকানো এবং ছাদ থেকে বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের জন্য ছাদের কিনারায় পাথরের নালি বসানো আছে।
মসজিদের পূর্বদিকের সম্মুখভাগে পাঁচটি এবং উত্তর ও দক্ষিণ দেওয়ালে তিনটি করে প্রবেশদ্বার রয়েছে। পূর্ব দেওয়ালের খিলানযুক্ত প্রবেশদ্বার বরাবর পশ্চিম দেওয়ালের অভ্যন্তরে রয়েছে পাঁচটি অর্ধবৃত্তাকার মিহরাব। অধিকাংশ মিহরাবের পাথর সরিয়ে নেয়ার ফলে এখন সমগ্র পশ্চিম দেওয়াল অনাবৃত হয়ে পড়েছে; অথচ একসময় এ দেওয়ালই ছিল মসজিদের সর্বাপেক্ষা সুদৃশ্য অংশ।
মসজিদের ২১.২ মি × ১২.২ মি পরিমাপের অভ্যন্তরভাগ প্রতি সারিতে চারটি করে দুসারি প্রস্তরস্তম্ভ দ্বারা উত্তর-দক্ষিণে লম্বা তিন আইলে বিভক্ত। একটি বিস্তৃত কেন্দ্রীয় নেভ আইলগুলিকে সমান দুভাগে বিভক্ত করেছে। প্রতি ভাগে রয়েছে ৩.৫ মিটার বাহুবিশিষ্ট ছয়টি সমান বর্গাকার ইউনিট। মসজিদের অভ্যন্তরভাগে তাই মোট পনেরোটি ইউনিট রয়েছে যার মধ্যে তিনটি আয়তাকার ইউনিট চৌচালা খিলান ছাদ দ্বারা আচ্ছাদিত। বাকি বারোটি বর্গাকৃতি ইউনিটের প্রত্যেকটি উল্টানো পানপাত্র আকৃতির গম্বুজ দ্বারা আচ্ছাদিত। এগুলি সবই স্বতন্ত্র পাথরের স্তম্ভ ও ভবনের সঙ্গে যুক্তস্তম্ভ শীর্ষে বসানো বিচ্ছুরিত খিলানের উপর স্থাপিত। কিন্তু ইউনিটগুলির খিলানের মধ্যবর্তী উপরের কোণগুলি গম্বুজ বসানোর উপযোগী করার জন্য করবেল পদ্ধতিতে ইটের পেন্ডেন্টিভ দ্বারা বন্ধ করা হয়েছে। মসজিদের উত্তর-পশ্চিম কোণে উপরিভাগে দোতলার কায়দায় নির্মিত একটি রাজকীয় গ্যালারি রয়েছে। গ্যালিরিটি এখন ধ্বংসপ্রায় অবস্থায় বিদ্যমান। মসজিদের উত্তর-পশ্চিম কোণে ছিল গ্যালারির প্রবেশপথ। দরজার সঙ্গে সংযুক্ত একটি সোপানযুক্ত প্লাটফর্ম হয়ে গ্যালারিতে পৌঁছতে হতো। গ্যালারির সম্মুখভাগে রয়েছে একটি মিহরাব।
মসজিদের প্রধান প্রবেশদ্বার বরাবর পূর্বদিকের বর্হিদেয়ালে স্থাপিত এবং বর্তমানে সম্পূর্ণরূপে পুননির্মিত ফটকটির দৈর্ঘ্য ৭.৬ মিটার ও প্রস্থ ২.৪ মিটার। নির্মাণকালে সমগ্র ফটকটিতে পাথরের আস্তরণ ছিল; বর্তমানে পাথরে রং দেওয়া হয়েছে।
মসজিদের অলংকরণের ক্ষেত্রে খোদাইকৃত পাথর, ইটের বিন্যাস, পোড়ামাটির ফলকের গিল্টি ও চকচকে টালি ব্যবহূত হয়েছে। তবে এগুলির মধ্যে প্রাধান্য পেয়েছে খোদাইকৃত পাথর। ক্রাইটন ও কানিংহাম মসজিদটির ছাদের উপর পনেরোটি গম্বুজ ও খিলান ছাদের সবগুলিই গিল্টি করা দেখতে পান। কিন্তু বর্তমানে গিল্টির কোনো চিহ্ন নেই। পাথর খোদাইয়ের নকশার ধরন নির্বাচন করা হয়েছে সংশ্লিষ্ট পরিসরের উপযোগিতা অনুযায়ী। যেমন, প্যানেলের কিনারগুলিতে করা হয়েছে লতাপাতার নকশা এবং এদের অভ্যন্তরভাগে হিন্দু আমলের শিকল ও ঘণ্টার মোটিফ অনুসরণে বিভিন্ন ধরনের ঝুলন্তরীতি অনুসরণ করা হয়েছে। খিলানের স্প্যান্ড্রিল ও ফ্রেমের উপরের স্থানগুলি আকর্ষণীয় অলংকরণরীতিতে ভিন্ন ভিন্ন ভাবে খোদাই করা গোলাপ দিয়ে ভরাট করা হয়েছে। গম্বুজও খিলান ছাদের অভ্যন্তরভাগ পোড়ামাটির ফলক দিয়ে অলংকৃত; তবে খিলান ছাদের অলংকরণ করা হয়েছে স্থানীয় কুঁড়েঘরের বাঁশের ফ্রেমের অনুকরণে। সবচেয়ে লক্ষণীয় অলংকরণ হলো কোণের বুরুজের খোদাইকৃত পাথরের বেষ্টনী এবং দ্বারপথ ও ফ্রেমের উপরে বসানো পাথরের কার্নিশ ও অলংকরণ রেখা। উল্লেখ্য যে, সম্মুখের সবগুলি খিলানপথ ও মিহরাবের খিলানগুলি ছিল খাঁজবিশিষ্ট এবং এগুলি অনেকাংশে এ মসজিদের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করেছিল।
মসজিদের প্রবেশদ্বারের মতোই পূর্বদিকের ফটকে একসময় বিভিন্ন নকশা খোদাইকৃত প্রস্তর ফলকের আস্তরণ ছিল। কিন্তু এখানে সেখানে বিক্ষিপ্ত কিছু গোলাপ নকশা ছাড়া এসব অলংকরণের তেমন কিছুই এখন আর নেই।
ফটকের ১৪.৫ মিটার পূর্ব দিকে একটি পাথরের প্লাটফর্ম রয়েছে যার আয়তন উত্তর দক্ষিণে ৪.২ মিটার, পূর্ব পশ্চিমে ৬.২ মিটার এবং উচ্চতা ১ মিটার। এর চার কোণে রয়েছে একটি করে প্রস্তর স্তম্ভ। প্লাটফর্মের উপরে উত্তর দক্ষিণে লম্বা পাশাপাশি দুটি সমাধি রয়েছে। সমাধি দুটিতেই ভিত থেকে চতুষ্পার্শ্বে কালো পাথরে নির্মিত কয়েকটি ঊর্ধ্বমুখী আয়তাকার ধাপ আছে এবং এ ধাপসমূহের পরিধি উপরের দিকে ক্রমশ হ্রাস হয়ে এসেছে। দুটি সমাধিতে রয়েছে কুরআনের আয়াত ও আল্লাহর কয়েকটি নাম সম্বলিত অগ্রভাগ সরু পিপাকৃতির পাথরের সমাধিফলক। এখানে কারা সমাহিত আছেন তা সঠিক জানা যায় নি। কানিংহাম সমাধি দুটিকে মসজিদের নির্মাতা ওয়ালী মুহম্মদ ও তার পিতা আলীর বলে মনে করেন।
মসজিদ প্রাঙ্গণের অভ্যন্তরে দক্ষিণ-পূর্ব কোণে দুটি আধুনিক কবর রয়েছে। কবর দুটি উত্তর-দক্ষিণে ৪.১ মিটার, পূর্ব-পশ্চিমে ৪.৭- মিটার এবং ১.৩ মিটার উঁচু ইটের প্রাচীর দ্বারা বেষ্টিত। কবর দ’ুটি ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর (মৃ ১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১) ও মেজর নাজমুল হক টুলুর (মৃ ২৭ সেপ্টেম্বর ১৯৭১)। এঁরা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকালে নবাবগঞ্জ শহরের নিকট পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে শহীদ হন।
ছোট সোনা মসজিদের দৃষ্টিনন্দন রূপ অনেকটা হ্রাস পেলেও অদ্যাবধি এটি গৌড়-লখনৌতির সবচেয়ে আকর্ষণীয় ইমারত এবং এ এলাকায় আগত দর্শণার্থীদের জন্য সর্বাধিক কাঙ্খিত নিদর্শন l১৪৯৪-১৫১৯) কোন এক সময় নির্মিত।
কিভাবে যাওয়া যায়:
চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে প্রায় ৩৫ কি.মি.। বাস অথবা সিএনজি-তে যাওয়া যায়। প্রায় ৪৫ মি. থেকে ১ ঘন্টা সময় লাগে l
Comments