জেনারেল জিয়ার রাজত্ব | অধ্যাপক আবু সাঈদ

জেনারেল জিয়ার রাজত্ব | অধ্যাপক আবু সাঈদ

জেনারেল জিয়ার রাজত্ব
অধ্যাপক আবু সাঈদ

———————————————–

প্রথম অধ্যায়
জিয়াউর রহমান ও মেজর রিট্রিট
জিয়ার কথা ১. কোলকাতার হেয়ার স্কুলে জিয়াউর রহমানের ছাত্র জীবন শুরু। ১৯৪৭ সনে ভারত বিভাগের সুবাদে চাকুরীজীবী পিতা মনসুর রহমান সপরিবারে পূর্ব বাংলায় ‘অপশন’ না দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের করাচী চলে যান। জিয়ার বয়স তখন মাত্র বারাে বছর। পূর্ব বাংলায় যখন ভাষা আন্দোলন একটি বিশেষ পর্যায় অতিক্রম করছে, ‘৫২ সনের ২১শে ফেব্রুয়ারী সালাম বরকত রফিক জব্বার ভাষার লড়াইয়ে যখন বুকের রক্ত ঢেলে দিচ্ছে, সারা বাংলায় ভাষার লড়াই যখন গ্রাম পর্যন্ত প্রসারিত, তখন উঠন্ত কিশাের জিয়াউর রহমানকে এর কিছুই স্পর্শ করতে পারেনি। শ্যামলঘন বাংলাদেশের আবহাওয়া পরিবেশের বাইরে উষর রুক্ষ ধূসর করাচীর একাডেমী স্কুলে আবশ্যিক ভাষা উর্দু রপ্ত করার চেষ্টায় রত জিয়াউর রহমানের পক্ষে ভাষা আন্দোলনের চেতনা ও মর্মবাণী ধারণ করা কোনক্রমেই সম্ভব ছিলােনা। ১৯৫২ সনে ২য় বিভাগে ম্যাট্রিক পাস করে ভর্তি হন ডি,জে, কলেজে। ১৯৫৩ সালে পাকিস্তান সামরিক একাডেমীতে একজন অফিসার ক্যাডেট হিসেবে তিনি বিশেষ কমান্ডাে ট্রেনিং লাভ করেন। ঐ কলেজে ও একাডেমীতে পরিবেশগত পরিমন্ডল এমনই ছিলাে যে, “খাটি পাকিস্তানী’ না হলে ঐ কলেজে ঢােকা একজন বাঙালীর পক্ষে সম্ভব ছিলাে না। জিয়াউর রহমানের সুবিধা ছিলাে এই যে, তাকে কখনাে বাংলা বলতে হয়নি এবং বাঙালী বলে পরিচয় দেওয়াকে তার একেবারেই ছিলাে অপছন্দ। এই অপছন্দের দিকটিই তার চাকুরীর ক্ষেত্রে পদোন্নতির বিশ্বস্ত মাপকাঠি হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। একজন ‘খাটি পাকিস্তানী” হিসেবে তার গায়ে ‘বাঙালী’ বা ‘প্রাদেশিকতার গন্ধ’ না থাকায় পাকিস্তানী সামরিক অধিনায়কদের পছন্দের লােক হতে তার কোন অসুবিধা হয়নি। অনেকেই তার কথায় ও কণ্ঠস্বরে উর্দু বাচন ভঙ্গীর যে আমেজ লক্ষ্য করেন, তাদের হয়ত অজানা যে, জিয়াউর রহমান যে স্কুলে বা কলেজে অধ্যয়ন করেছেন, সে সব প্রতিষ্ঠানে বাংলা ভাষা তার পাঠক্রমে অন্তর্ভূক্ত ছিলােনা। কিশাের জীবনের মানস গঠনের প্রাক্কালে পিতার চাকুরীসূত্রে বাঙালী সমাজ হতে বিচ্ছিন্ন, আত্মীয় পরিজন হতে ছিটকে পড়া এবং বাংলাদেশের নিসর্গ চেতনার বিপরীতে একটি ভিন্ন পরিবেশ
ও পরিস্থিতির মধ্যে জিয়াউর রহমানের শৈশব জীবন শুরু। করাচী একাডেমী স্কুলে ভিন্ন ভাষা ও ভিন্ন আচরণগত দিকের সঙ্গে খাপ খাইতে গিয়ে এবং তাদের সঙ্গে তালমিলিয়ে চলার প্রতিযােগিতায় জিয়ার কিশাের জীবনে বাঙালীত্বের মানস গড়নে গড়ে ওঠেনি। তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে যখন উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভূক্ত করার বিরুদ্ধে জনমত গড়ে উঠছে এবং আন্দোলন সংগঠিত হচ্ছে – সেই সময়ে তাকে পশ্চিম পাকিস্তানের উর্দু ভাষাভাষী অঞ্চলে ছহি উর্দু শিক্ষার অনুশীলন করতে হয়েছে এবং রপ্ত করতে হয়েছে ছহি উর্দু জবান। অর্থাৎ বাঙালি হয়েও বাংলা ভাষার পাঠ তার পক্ষে গ্রহণ সম্ভব হয়নি, বাঙালির মানস চেতনার মর্মবাণী উপলদ্ধি হতে দূরে থাকতে হয়েছে। করাচী একাডেমী স্কুলের পরিমন্ডলে বাঙালী সংস্কৃতি সম্পর্কে নেতিবাচক ব্যতীত ইতিবাচক ধারণা পাওয়া সম্ভব ছিলাে না। সেই অবস্থায় জিয়াউর রহমান পরিস্থিতির সঙ্গে নিজেকে মানান সই করতে গিয়ে বেশী করে বাঙালিদের এড়িয়ে চলেছে, বাঙালি সংস্কৃতি ও জীবন চর্চার বাইরে তাকে দূরে থাকতে হয়েছে । অদৃশ্য ভিলেনের সুবিধাবাদী ভূমিকাই বেশীরভাগ ক্ষেত্রে তার ভাগ্য উন্নয়নের পশ্চাতে কাজ করেছে। সুযােগ বুঝে নিজের জুৎসই অবস্থান নিতে তার ভুল হয়নি। লক্ষ লক্ষ মানুষের গৌরবময় আত্মত্যাগ এবং রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় জিয়াউর রহমানের রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্টিত হওয়া এক বিস্ময়কর ঘটনা ! আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে, জিয়াউর রহমানের উথান আকস্মিক ঘটনাসমূহের ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার ফলশ্রুতি। মনে হতে পারে, নীরব দর্শক, ক্ষমতার পরিমন্ডল হতে দূরে থাকা নির্লিপ্ত নৈর্ব্যক্তিক জিয়াউর রহমানকে আকস্মিক ঘটনার ঘনঘটা ক্ষমতার কেন্দ্র বিন্দুতে টেনে এনেছে, এতে জিয়াউর রহমানের ভূমিকা নেই, যতটা না আছে ঘটনাসমূহের সক্রিয়তা। এক কথায় বিষয়টি এরূপ নয়। জিয়াউর রহমানের জীবনাচারণ, তার কর্মপদ্ধতি, পেশাগত প্রশিক্ষণ আচরণগত দিক বিশ্লেষণ করলে এবং ভিন্ন ভিন্ন বিভক্ত ঘটনাসমূহের যােগফল ধারণাকৃত কথার সত্যতা প্রমাণ করেনা। বরং গভীর পর্যবেক্ষণে ঘটনার পরম্পরার মধ্যে তার বিশেষ ভূমিকা-যা সূক্ষ, অথচ কার্যকর, কখনও সরব এবং নীরব উপস্থিতি ঘটনাসমূহের জন্ম দিয়েছে এবং একটি মােক্ষম সময়ে ঘটনার অঙ্গনে তিনি নায়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। স্বল্পবাক, নেপথ্যচারী এই মানুষটি ঘটনা সংঘটনের পূর্বে ‘অদৃশ্য ভিলেনের ভূমিকায় অবতীর্ণ এবং ঘটনার সফলতায় ‘নায়কের বীরােচিত ভঙ্গিমায় দর্শকদের সামনে উপস্থিত হয়েছেন; কৈশােরের পরিবেশ ও প্রাথমিক চাকুরী জীবন তাকে এই মানসিকতায় ঠেলে দিয়েছে।
কর্মজীবনের প্রাথমিক অবস্থায় এমনকি, স্বাধীনতার যুদ্ধের পূর্ব পর্যন্ত জিয়াউর বহমান তার সম সাময়িক বাঙালী অফিসারদের সচেতনভাবে এড়িয়ে চলার অভিযােগের উত্তর তার প্রাথমিক জীবন গড়নের মধ্যেই ছিলাে নিহিত। বাঙালী অফিসারদের এড়িয়ে চলার মধ্যে এটাও স্বাভাবিক কারণ হয়ে থাকবে যে, সামরিক কমান্ডে এবং সামরিক জীবনে চাকুরী এবং বৈষয়িক সুযােগ-সুবিধা প্রাপ্তির সােনার চাবি’টি ছিলাে পশ্চিম পাকিস্তানী সেনা অফিসারদের হাতে। সেই কারণে জিয়াউর রহমান তার চলনে বলনে আচার আচরণে চিন্তা চেতনায় একজন ‘শুদ্ধতম পাকিস্তানী’ হিসেবে গড়ে ওঠার সামান্য সুযােগটুকুও হাতছাড়া করেননি। পাকিস্তানী সামরিক কর্তাদের আস্থাভাজন হওয়ার ক্ষেত্রে জিয়াউর রহমানের নিরলস প্রচেষ্টার ‘দাসানুগ আচরণ’ তদানন্তিন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কর্মরত বাঙালী সামরিক অফিসারদের অনেকের নিকট দৃষ্টিকটু হলেও এ ক্ষেত্রে তাদের করার কিছুই ছিলনা। বাঙালীদের প্রতি বীতশ্রদ্ধ প্রভুভক্ত গর্বোন্ধ এই তরুণ সামরিক অফিসারটি গােপন সার্ভিস রেকর্ডের মাধ্যমে অতি স্বল্প সময়েই কর্তাব্যক্তিদের নজরে আসতে সমর্থ হন। পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক শাসকগােষ্ঠীও বাঙালি রাজনীতিবিদ, আমলা, সামরিক অফিসারদের মধ্যে হতে তাদের একান্ত অনুগত’ ‘বাধ্যানুগত’ ‘বিশ্বস্ত’ ‘বশংবদ সৃষ্টি চেষ্টায় সর্বদাই তৎপর ছিলাে। সামরিক ক্ষেত্রে জিয়াউর রহমানের এডুকেশান ব্যাকগ্রাউন্ড ও পাকিস্তানী প্রীতির দৌলতে এবং সামরিক কর্মকান্ডে তার স্বাভাবিক নিয়মনিষ্ঠ আচার আচরণ ইত্যাদি মিলিয়ে ক্যাপ্টেন জিয়া অচিরেই পাকিস্তানী সামরিক অধিনায়কদের প্রিয়ভাজন হয়ে ওঠেন। সেজন্য লক্ষ্যণীয়, ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারীর পর পরই বাঙালি রাজনৈতিক নেতা-কর্মী ছাত্রদের সম্পর্কে গােপন রিপোের্ট প্রদানের দায়িত্বে জিয়াউর রহমানকেই জেনারেল আইয়ুব খান বেছে নিতে ভুল করেনি। ১৯৫৮ সালের সামরিক শাসন জারীর পর ১২ই অক্টোবর মওলানা ভাসানী কারারুদ্ধ হলেন এবং ১৯৬২ সালের ৩রা নভেম্বর পর্যন্ত ঢাকা ধানমন্ডির আবাসিক এলাকায় ভাড়া বাড়িতে তাকে অন্তরীণ রাখা হলাে। তার স্ত্রী ও সন্তানগণ সরকারী খরচে তার সঙ্গেই থাকেন। কিন্তু ১৯৫৮ সালের ১২ই অক্টোবর শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করে দেশরক্ষা আইনে তাঁকে নিরাপত্তা বন্দী হিসেবে কারারুদ্ধ করা হয়। তার বিরুদ্ধে একের পর এক নয়টি মামলা সাজানাে হয়। সবগুলােতে বেকসুর খালাস পেয়ে ১৯৫৯ সালের ১৭ই ডিসেম্বর তিনি মুক্তি পান। তবুও তার উপর কড়া বিধি-নিষেধ আরােপিত থাকে। সামরিক শাসন জারী হওয়ায় পরপরই হাজার হাজার রাজনৈতিক নেতা কর্মীদের গ্রেফতার করা হয়। রাজনৈতিক কর্মকান্ড নিষিদ্ধ থাকে।4 ৫. এই অবস্থার মধ্যে জেনারেল আইয়ুব খান বিশ্ববাসীকে ধােকা দেবার লক্ষ্যে ১৯৫৯ ডিসেম্বর সমগ্র পাকিস্তানে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠান করেন। কেননা ঐ নির্বাচন জেনারেল আইয়ুব খানের জন্য বিশেষ জরুরী ছিলাে। সেটা হলাে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি অর্থাৎ ইউনিয়ন কাউন্সিল সদস্যদের আস্থাভােট লাভ। সামরিক আইন বিধি অনুযায়ী ভােটদাতাদের কেবলমাত্র হা বা না বলার ক্ষমতা দেয়া হয়েছিলাে। সামরিক শাসনে গণভােট-এর তালিম জিয়াউর রহমান-এর মানসপটে অংকিত হয়ে যায় । এই প্রেক্ষিতে সামরিক গােয়েন্দা দপ্তরকে আইয়ুবের পক্ষে কাজ করার দায়িত্ব অপর্ণ করা হয়। জিয়াউর রহমান এই গুরুত্বপূর্ণ সময়ে সামরিক গােয়েন্দা বাহিনীর কর্মকর্তা হয়ে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে পােস্টিং পান। সামরিক গােয়েন্দা কর্মকর্তা হিসেবে ফিল্ড মার্শাল আইয়ুবের কর্মকান্ডের সফল বাস্তবায়নে বিশেষ গুরুত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি হিসেবে ক্যাপ্টেন জিয়াউর রহমান পারঙ্গমতা প্রদর্শন করেন। ‘৫৫ সনে কমিশন প্রাপ্ত হয়ে জিয়াউর রহমান প্রায় দু বছর পাঞ্জাব রেজিমেন্টে কর্তব্যরত থাকা কালে পাঞ্জাবী সামরিক কর্তৃপক্ষের আরাে বিশ্বস্ততা অর্জন করেছিলেন। তারই ফলশ্রুতিতে ‘৫৯ সনে সামরিক গােয়েন্দা বিভাগের দায়িত্ব নিয়ে তাকে বেশ কিছুদিন দিনাজপুরে অবস্থান করতে হয় । দিনাজপুরেই অষ্টম শ্রেণীতে স্কুলগামী বেগম খালেদার সঙ্গে তার পরিচয় এবং পরিণয়। বিয়ের বেশ কিছু মাস পর তদানীন্তন শাহবাগ হােটেলে (এখন পিজি) বৌ-ভাত অনুষ্ঠিত হয়। সামরিক শাসনের অধীনে অতিথি আপ্যায়নের বিধি জিয়াউর রহমানের ক্ষেত্রে প্রযােজ্য হয়নি। ‘৫৯ সন ৬৪ সন পর্যন্ত জিয়াউর রহমান তদানন্তিন পূর্ব পাকিস্তানের গােয়েন্দা সংস্থার কর্তা ব্যক্তি হিসেবে কাজ করেন। ৬২-৬৪ সালের রাজনৈতিক ঘটনাবলীর উপর তীক্ষ দৃষ্টি রাখার জন্য বাঙালী হয়ে বাঙালীদের বিরুদ্ধে এক পােক্ত পেশাদার গােয়েন্দা ব্যক্তিত্ব হিসেবে জিয়াউর রহমান সাফল্যের পরিচয় দিয়েছেন সন্দেহ নেই। রঙিন চশমার অন্তরালে নিজের চোখকে অন্যের থেকে আড়াল করে অন্যকে দেখার মধ্যে যে চৌর্য-চাতুরতা নিহিত সে সময় হতেই জিয়ার নিকট ছিলাে ‘উপভােগ্য এবং সমগ্র জীবনে তার এই অভ্যাসের ছেদ পড়েনি। ‘৬৫ সনে পাকভারত যুদ্ধে ফার্স্ট ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ভূমিকা উল্লেখযােগ্য। ঐ রেজিমেন্টের কমান্ডার অফিসার ছিলেন কর্ণেল এ,টি, কে, হক। তার অধীনে। ক্যাপ্টেন জিয়াউর রহমান একজন কোম্পানী কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ঐ যুদ্ধে ফার্স্ট ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট বিশেষ কৃতিত্বের অধিকারী হয় এবং পদাতিক বাহিনীর উপসকে বীরত্বের জন্য পদক দেয়া হয়। জিয়া অনুসারীরা পাক ভারতের যুদ্ধে জিয়াউর রহমানের বীরত্বের কথা মাঝে মধ্যে টিভিতে প্রচার করার প্রয়াস নিলেও দুঃখজনক হলেও সত্য যে, জিয়াউর রহমান ঐ যুদ্ধে তেমন কোন কতিত্বের দাবীদার ছিলেন না। বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধের জন্য জিয়া বীরত্বপূর্ণ পদক পাননি। নিষ্ঠা ও দক্ষতার সঙ্গে কাজ করার জন্য সার্ভিস এওয়ার্ড পেয়েছিলেন মেজর জেনারেল সাদেক যিনি সেদিন ছিলেন কোয়ার্টার মাস্টার । ১০. যুদ্ধের পরে জিয়াউর রহমান মেজর পদে উন্নীত হন এবং ৬৬-এ কাকুলে পাকিস্তানের মিলিটারী একাডেমীর প্রশিক্ষক নিযুক্ত হন। ৬৭-সনে পি এস সি প্রাপ্ত হন এবং ৬৯ সনে সেকেন্ড বেঙ্গলে যােগদান করেন।। মেজর সফিউল্লাহর কারনে জিয়ার সেকেন্ড বেঙ্গলে যােগদান দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। ব্যাটেলিয়ানে থাকার চেয়ে রহস্যময়তার হাতছানি জিয়াউর রহমানকে পুনরায় টেনে নিয়ে যায় । ৬৯ সনে জার্মানীতে তিন মাসের ট্রেনিং-এ চলে যান। সি আই এ নেট ওয়ার্কের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্রিটিশ অফিসার রেভারাইন ট্রেনিং জিয়াউর রহমানের মানসে গােয়েন্দা চেতনা পূর্ণতা লাভে সহায়তা করে। ৪ ১১. প্রশিক্ষণের পর জিয়াউর রহমান পূর্ব পাকিস্তানে বদলি হন এবং ৮ম বেঙ্গলের সেকেন্ড ইন কমান্ডের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। জিয়াউর রহমানের জন্য এই বদলী তার ভবিষ্যৎ জীবন রচনার ক্ষেত্রে এবং পরবর্তীকালে রাষ্ট্রের শীর্ষস্থান দখলের ক্ষেত্রে এক অনন্য সাধারণ ভূমিকা পালন করেছে। ‘৭০ অক্টোবরে ৮ম বেঙ্গল রেজিমেন্টকে পশ্চিম পাকিস্তানে বদলী করা হয় এবং একই সঙ্গে জিয়াউর রহমানও বদলীর আদেশ প্রাপ্ত হন। ৭০-এর জাতীয় নির্বাচনের পর পরই ৮ম বেঙ্গল রেজিমেন্ট প্রায় অর্ধেক সংখ্যক সেনা অফিসার করাচীর উদ্দেশ্যে চট্টগ্রাম ত্যাগ করে। জিয়াউর রহমানের সৌভাগ্যই বলতে হবে যে, বাকী অর্ধেক অর্থাৎ মাত্র ৩০০ মত সৈন্য নিয়ে চট্টগ্রাম ত্যাগের প্রস্তুতি সম্পন্ন। সময়ে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। নির্বাচনের পর পরই পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর জেনারেলগণ এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন যে, কোনভাবেই বাঙালীদের হাতে, বিশেষ করে শেখ মুজিবের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা যাবে না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামীলীগ শুধু পূর্ব পাকিস্তানে নয়, সমগ্র পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্টতা অর্জন করে। নির্বাচনী রায় বানচাল করার লক্ষ্যে চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্র চলতে থাকে। ১৩. পাশাপাশি বাঙালী জাতির অবিসংবাদী নেতা ও জাতীয় আশা আকাঙ্ক্ষার মূর্ত প্রতীক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অত্যন্ত সতর্ক ও কৌশলের মাধ্যমে জনগণের হত অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে সমগ্র বাঙালী জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে ষড়যন্ত্র মােকাবেলায় কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। ১৪. জিয়াউর রহমান মেজর খালেদ মােশাররফ ও মেজর রফিককে বারবার নিরস্ত
করতে গিয়ে বলেছেন, ‘ঘাবড়াবার কিছু নেই। ওরা অতদূর যাবেনা। অর্থাৎ পাকিস্তানী সামরিক বাহিনী বাঙালী সেনা অফিসারদের উপর আক্রমণ করবে না। অথচ মেজর খালেদের কথা ছিলাে, ওরা আমাদের উপর আঘাত হানবেই। আমাদের উপর আঘাত আনার আগেই আমাদেরকে তাদের উপর আঘাত হানতে হবে-তা না হলে ওরা সবাই আমাদেরকে জবাই করে ফেলবে।৭ জিয়াউর রহমানের বিশ্বাসই ছিলােনা যে, সত্যি সত্যি পাকিস্তানীরা তাদের উপর আক্রমণ করতে পারে। সেজন্য ২৬শে মার্চ মেজর জিয়া চট্টগ্রাম বন্দরে এম ভি সােয়াত থেকে অস্ত্রসস্ত্র গােলাবারুদ নামানাের কাজে সাহায্য ও তদারকি করার জন্য রওনা হন। পথিমধ্যে জানতে পারেন পাকিস্তান আর্মি ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট কেন্দ্রে হামলা চালিয়ে বহু সেনা অফিসার হত্যা করেছে। তখন জিয়াউর রহমান সটকে পড়েন। জিয়াউর রহমান যখন চট্টগ্রাম হতে পটিয়ার দিকে রিট্রিট করেন সে সময় মেজর রফিক বিপদ ও ঝুঁকি সত্ত্বেও বীরত্বের সঙ্গে চট্টগ্রামে যুদ্ধ পরিচালনা করেছেন। ১৯৭১ সনে ২৫শে মার্চ জিয়াউর রহমান প্রত্যক্ষভাবে যুদ্ধে অংশগ্রহণ না করেও বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘােষণা পাঠ করে হিরাে বনে যান। জিয়ার কোন যুদ্ধ পরিকল্পনা ছিল না। ১৫. ২৪ শে মার্চ হতে পি-আই-এর বিমানে পশ্চিম পাকিস্তানী নেতারা ঢাকা ত্যাগ করতে থাকেন। জেনারেল ফরমান আলী ও জেনারেল খাদেম রাজা দুটি হেলিকপ্টারে করে ঢাকার বাইরে বিগ্রেড কমান্ডারদের, ‘অপারেশন সার্চলাইট। ‘সম্পর্কে ব্রিফ করার জন্য বেরিয়ে পড়েন। সামরিক বাহিনীর বটল গ্রীন কালারের একটি হেলিকপ্টার নিয়ে জেনারেল খাদিম রাজা চট্টগ্রাম নামলেন। বললেন ঃ জয়দেবপুর সেকেন্ড ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টে এক অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। তার জন্য ব্রিগেডিয়ার মজুমদারকে জয়দেবপুর যাওয়া। বিশেষ প্রয়ােজন। বিগ্রেডিয়ার মজুমদারকে ঢাকায় নিয়ে আসা হলাে। তাকে নজরবন্দী রাখা হলাে। চট্টগ্রামের দায়িত্ব দেয়া হলাে লেঃ কর্ণেল ফাতমীর উপর এবং বিগ্রেডিয়ার ইকবাল শাফীকে দায়িত্ব নেবার জন্য অর্ডার দেয়া হলাে। তার আসতে কয়েকদিন সময় লাগবে। কেননা তিনি তখন কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে। কিন্তু তার দায়িত্ব গ্রহণের পূর্বেই ১৭শে মার্চ অপারেশন সার্চ লাইটের গ্রীন সিগন্যাল চলে
এলাে। তখন চট্টগ্রামে ই বি আর, ই পি আর, নতুন ই বি আর সি ও পুলিশ মিলিয়ে বাঙালীর সশস্ত্র শক্তি প্রায় ২০ হাজার। অন্যদিকে চট্টগ্রামে বিশ বেলুচ রেজিমেন্টের সৈন্য সংখ্যা মাত্র ৬০০ জন। বিগ্রেডিয়ার মজুমদারকে ঢাকায় আনার পর ৮ম। ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট-এ মেজর জিয়াউর রহমান সেকেন্ড ইন কমান্ড। এত বড় সৈন্য শক্তি হাতে থাকা সত্ত্বেও স্বাধীনতা যুদ্ধে যােগদানের পূর্ব ইচ্ছা, পরিকল্পনা ও সিদ্ধান্ত এবং সমন্বয়ের অভাবে চট্টগ্রাম দখল করা ‘বীর’ জিয়াউর রহমানের পক্ষে সম্ভব হয়নি। এমনকি এই বিরাট শক্তি সমন্বয়ে যেভাবে প্রতিরােধ গড়ে ওঠার সম্ভাবনা ছিলাে তা হয়নি। ক্যাপ্টেন রফিক ও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে যে জংগী জনশক্তি তৈরী হয়েছিলাে সামরিক নেতৃত্বের অভাবে তাদের দ্বারা কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি। তবুও চট্টগ্রামের যুদ্ধ পাকিস্তানী সামরিক জেনারেলদের বিব্রত ও ব্যতিব্যস্ত করে তুলেছিলাে। রিজার্ভ পুলিশ লাইনে বিশ হাজার রাইফেল রক্ষিত ছিলাে, জনগণ তা নিজের হাতে তুলে নেয় । জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে ৮ম ইবি বি আর পাকবাহিনীর সংগে সরাসরি যুদ্ধ মােকাবিলার। সময়, সুযােগ ও সমন্বয়ের সময় পায়নি।
রাতারাতি মুক্তিবাহিনী। ১৬. স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রধান সেনাপতি কর্ণেল আতাউল গনি ওসমানী একান্ত সাক্ষাৎকারে নির্দ্বিধ চিত্তে বলেছেন, “পাকিস্তানীরা যদি তাদের আক্রমণ কেবল মাত্র নির্দিষ্ট কয়েক জন রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে সীমিত রাখতাে তাহলে বাঙালী সৈনিক ও পুলিশরা হয়তাে নিরপেক্ষ ভূমিকাই পালন করতাে। যখন পাকিস্তানী সেনাবাহিনী কর্তৃক নির্বিচারে বাঙালী বুদ্ধিজীবী ও সশস্ত্র বাহিনীর বাঙালী সদস্যদেরও হত্যা করার খবর ছড়িয়ে পড়লাে, কেবলমাত্র তখনই আমরা একদেহে প্রতিরােধ গড়ে তুললাম। পাকিস্তান সেনাবাহিনী এই আক্রমণের মাধ্যমে রাতারাতি
এভাবে মুক্তি বাহিনীর সৃষ্টি করলাে।” বস্তুতঃ বাঙালী সেনাবাহিনীকে বিভক্ত করাে ও আঘাত করাে নীতিতে পাকিস্তানী কার্যক্রম
শুরু হলে বাঙালী সেনা অফিসারগণ আত্মরক্ষামূলক যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে বাধ্য হন। কিন্তু অবস্থার প্রেক্ষিতে, সংগ্রামী জনতার চাপে ও জনগণের আকাঙ্খার সংগে সংগতি রক্ষার্থে কার্যক্ষেত্রে তাদের কিছু কিছু ক্ষেত্রে যুদ্ধে অংশগ্রহণ ব্যতীত বিশেষ কোন উপায় ছিলাে না। পাকিস্তানী সেনা কাঠামাের মধ্যে বেড়ে ওঠা বাঙালী সেনা আফসার ও অধিকাংশ সদস্যদের মনে পাকসামরিক বাহিনীর নৃশংসতা, শক্তি *নতা সম্পর্কে কোনই অস্পষ্টতা ছিলাে না, ফলে ধরতে গেলে অসম যুদ্ধের। পারণত সম্পর্কে তারা ছিলেন সতক ফলে সীমান্তের দিকে দ্রুত গতিতে ধাবিত। হতে তাদের সিদ্ধান্তে অস্পষ্টতা ছিলাে না। চট্টগ্রামের জনগণ, রাজনৈতিক নেতৃত্ব,
স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী বিএলএফ সদস্য, ইপিআর, পুলিশ, আনসার, প্রাক্তন সামরিক বাহিনীর সদস্যগণ যখন সশস্ত্র যুদ্ধে লিপ্ত তখন মেজর জিয়া যুদ্ধে ময়দান ছেড়ে ও সামরিক দায়িত্ব পালন না করে রাজনীতিবিদদের ন্যায় আচরণ প্রদর্শন করেন। কালুরঘাটে বেতার ভাষণে নিজেকে হেড অবদি স্টেট হিসেবে ঘােষণা করছেন এবং অবস্থার বাস্তবতায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের পক্ষে স্বাধীনতার ঘােষণা পাঠ করেছেন, সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান হিসেবে ঘােষণা দিয়ে পরে সেক্টর কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন। যখন কালুর ঘাটে যুদ্ধ হচ্ছে জিয়াউর রহমান তখন কক্সবাজারের ট্রেজারী হতে মাসমাহিনার প্রাপ্ত টাকার হিসাব মেলাতে ব্যস্ত। যখন কক্সবাজারে যুদ্ধ জিয়া তখন রামগড়ে, যখন রামগড়ে যুদ্ধ তখন জিয়াউর রহমান ভারতীয় সীমান্ত অভ্যন্তরে নির্বিঘ্নে অবস্থান নিয়েছেন। সেজন্য যুদ্ধের সময় জিয়াকে অনেকেই ‘মেজর রিট্রিট’ হিসেবে সম্বােধন করতেন। ১৭. ২৫মে মার্চ বেলা একটা। ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট ও ৮ম বেঙ্গল রেজিমেন্ট থেকে আরাে দুটি প্লাটুনকে সােয়াত নামের জাহাজ থেকে অস্ত্রশস্ত্র খালাসের জন্য পাঠানাে হয়। আগের দিন ৫০ জন বাঙালী সৈন্যকে নিরস্ত্র অবস্থায় অস্ত্র খালাসের জন্য পাঠানাে হয়েছিলাে। ২৬শে মার্চ সকাল ১০টা পর্যন্ত তাদের দিয়ে মাল খালাস করা হয়। তাদের খাবার দেয়া হলাে না। ক্যান্টনমেন্টে ফেরার অনুমিত দেয়া হলাে না। সােয়াত জাহাজে তাদের আটকিয়ে রাখা হলাে। বন্দী। তার পরের ঘটনা২৭শে মার্চ ১৯৭১। হতভাগ্য বন্দী বাঙালী সৈন্যদের সােয়াত জাহাজ থেকে বের করে এনে দাঁড় করানাে হলাে জেটির প্লাটফর্মে। সবাই দু’হাত তুলে আত্মসমর্পনের ভঙ্গীতে দাড়ালাে। তবু চালানাে হলাে গুলি। মুহুর্তে লুটিয়ে পড়লাে। বাঙালী সেনা সদস্যদের দেহ। থকথকে রক্তে সূর্যের বিদায় আভায় কর্ণফুলী ও ভৈরব নদীর জলরাশি উদ্বেল হয়ে উঠলে ।।
পাকিস্তানী সমর পরিকল্পনাবিদের নিষ্ঠুর নির্দেশ বাস্তবায়ন ও বাঙালী সেনা অফিসারদের দোদুল্যমানতা ও সিদ্ধান্তহীনতা এ সব হত্যাকান্ডের জন্য দায়ী। ২১শে মার্চ থেকে ২৫শে মার্চ দীর্ঘ সময়। পশ্চিম পাকিস্তানী বাহিনী বাঙালী সৈন্যদের উপর আক্রমণ করবে এ কথা জিয়াউর রহমান নিজ কানে শােনার পরও সশস্ত্র প্রতিরােধ ব্যবস্থা গ্রহণ করেন নি অথবা আক্রমণের এই পূর্ব পরিকল্পনা আন্দোলনকারী জনশক্তিকে জানাননি।
জিয়ার চালে ভুল ১৮. এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহেই স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বিদ্রোহী বাঙালী সশস্ত্র বাহিনীর অফিসার ও জোয়ানদের নিকট পরিষ্কার হয়ে আসে যে, পাকসামরিক
বাহিনীকে প্রতিরােধ ও হটিয়ে দেবার জন্য পর্যাপ্ত সৈন্যবল, অস্ত্রশস্ত্র ও লজিষ্টিক সাপাের্ট তাদের নেই। পরিকল্পনাবিহীন ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে বাঙালি সশস্ত্রবাহিনী ক্রমশই ভারত সীমান্তের দিকে দ্রুত ভীড় জমাতে থাকে। সীমান্ত অঞ্চলের সর্বত্রই ঐ একই অবস্থা লক্ষ্যণীয় ও দৃষ্টিগােচর হতে থাকে। ৪ঠা এপ্রিল। বিপর্যস্ত, বিধ্বস্ত, ক্লান্ত ও নুয়ে পড়া সামরিক অধিনায়কগণ তেলিয়াপাড়ার হেড কোয়ার্টারে সমবেত হন। কর্ণেল ওসমানী, মেজর জিয়াউর রহমান, মেজর খালেদ মােশাররফ, লেঃ কর্ণেল সালাউদ্দিন মােঃ রাজা, মেজর কাজী নুরুজ্জামান, মেজর নূরুল ইসলাম, মেজর মইনুল হােসেন চৌধুরী, লেঃ কর্ণেল আব্দুর রব কতিপয় বাঙালী সামরিক অধিনায়ক ঐদিন কর্ণেল ওসমানীকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্ব প্রদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। বাঙালী সামরিক অফিসারদের পক্ষে এই সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে পকাশ্যতঃ কোনরূপ জটিলতা না থাকলেও ভেতরে ভেতরে কোন কোন অফিসারের মধ্যে এ বিষয়ে স্পষ্টতঃই দ্বিমত ছিল।
মেজর শফিউল্লাহ মনে করেছিলেন যেহেতু এক বিস্তীর্ণ অঞ্চল তার দখলে এবং তার অধীনস্থ বাহিনী অত্যন্ত বীরত্বের সংগে পাক হানাদার বাহিনীর সংগে সংঘর্ষে প্রাথমিক সাফল্য অর্জন করেছে, সেজন্য স্বাধীনতা যুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্ব তার। উপর অর্পিত হওয়া উচিত। খালেদ মােশাররফও অত্যন্ত সাহসী, পরিকল্পিতভাবে প্রতিরােধ যুদ্ধ পরিচালনায় পারঙ্গমতা প্রদর্শন করেছেন। সে জন্য যুদ্ধের প্রধানতম দায়িত্ব তার উপর অর্পিত না হলেও সামরিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে তার একটি বিশিষ্ট ভূমিকা থাকবে এটা তার মনে স্বাভাবিক আকাঙ্খ হিসেবেই কাজ করে থাকবে। অন্যদিকে গােয়েন্দা কার্যক্রমে দক্ষ ও পটু জিয়াউর রহমানের উচ্চাভিলাষী ঘােষণায়। চট্টগ্রামের কালুরঘাটে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র হতে ইতিপূর্বেই প্রচারিত হয়ে পড়েছিলাে। জিয়াউর রহমান কোনরূপ যুদ্ধ বা সশস্ত্র প্রতিরােধে অংশগ্রহণ না করে অত্যন্ত দ্রুততার সংগে বিপ্লবী সরকারের প্রধান বলে নিজেকে ঘােষণা করেন এবং প্রায় একই সময়ে সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়করূপে নিজেকে উপস্থাপিত করেছিলেন। তেলিয়াপাড়া সামরিক নেতৃবৃন্দের বৈঠকে উপস্থিত হয়ে জিয়াউর রহমান অতি সহজেই উপলব্ধি করেন যে, সামরিক বাহিনীর সেনাপতিরূপে তার বেতার ঘােষণা তার জন্য শুভ প্রতিক্রিয়া বয়ে আনেনি। জিয়াউর রহমান অত্যন্ত স্পষ্টভাবে দেখতে পেলেন তার পক্ষে সশস্ত্র বাহিনী পরিচালনার গুরুত্বপূর্ণ অথচ আকাঙ্খত পদটি দখল করা সম্ভব হবে না। কেননা ইতিমধ্যেই মেজর সাফল্লাহ-খালেদ মােশাররফ সমঝােতামূলক ঐক্য সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন। মেজর সফিউল্লাহ ছিলেন খালেদ মােশাররফের কাছাকাছির লােক। পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন স্থানে চাকুরীরত অবস্থায় জিয়াউর রহমানের বাঙালীদের প্রতি অবজ্ঞা ও অশ্রদ্ধা এবং স্বাধীনতা যুদ্ধে তার স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ সম্পর্কে অনিশ্চয়তায় রাজনীতি সচেতন খালেদ মােশাররফের নিকট স্বাধীনতা যুদ্ধে সশস্ত্র নেততুদানে জিয়াউর রহমান ছিলেন অগ্রহণযােগ্য। সফিউল্লাহ – খালেদের সমঝােতায় ক্ষুব্ধ জিয়াউর রহমানের নিকট ঐ অবস্থায় কর্ণেল ওসমানীকে যুদ্ধ পরিচালনায় সামরিক নেতৃত্ব প্রদানের বিষয়টিতে সম্মতি জ্ঞাপন ব্যতীত অন্য কোন পথ খােলা ছিলাে না। সফিউল্লাহর চেয়েও কর্ণেল ওসমানীই ছিলেন ঐ প্রেক্ষিতে সর্বাধিক গ্রহণযােগ্য ব্যক্তিত্ব। উপরে উপরে কর্ণেল ওসমানীর প্রতি আনুগত্য দেখালেও জিয়াউর রহমানের মনে সব সময়ই একথা জাগরূক ছিলাে উঠতি সামরিক নেতৃত্বের মধ্যে তিনি সিনিয়র ও যােগ্য এবং যুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্ব তারই প্রাপ্য। তরুণ মেজরদের চাপ ছিলাে প্রচন্ড ১৯. সামরিক বাহিনীর এসব তরুণ মেজরগণ প্রায় প্রত্যেকেই যুদ্ধের প্রাথমিক অবস্থায় সামরিক নেতৃত্ব গ্রহণের বিষয়টিকেই মৌলভাবে প্রাধান্য দিয়ে এসেছেন। সামরিক প্রাধান্যের ঐক্য ফর্মুলায় শেষ পর্যন্ত কণল ওসমানীর নেতৃত্ব টেকনিক্যাল কারণে মেনে নিলেন। তাদের চাপে বলতে গেলে তাদের সন্তুষ্ট রাখার জন্য দুর্বল চিত্ত বাহ্যতঃ ‘পাপা টাইগার’ কর্ণেল ওসমানী তাদের নামে তিনটি বিগ্রেড গঠন করতে বাধ্য হন। মেজর খালেদ মােশাররফের নামে কে ফোর্স, মেজর সফিউল্লাহর নামে এস ফোর্স এবং জিয়াউর রহমানের নামে জেড ফোর্স গঠন করতে হয়। কে ফোর্স, এস ফোর্স ও জেড ফোর্স এই মেজরদের আদ্যাক্ষর নিয়ে গঠিত বিগ্রেড। ব্যক্তি বিশেষের নামে গঠিত এসব বিগ্রেড গঠন যেমন ছিল অভিনব, তেমনি সামরিক বাহিনীর ইউনিফাইড ‘কমান্ড পরিচালনায় তা ছিলাে প্রতিবন্ধক। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় গঠিত এসব বিগ্রেড বাহিনী সামরিক নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার হাতিয়ার হিসেবেই ব্যবহৃত হয়েছে যা বাংলাদেশ বা সেনাবাহিনী কারাের জন্যই মঙ্গলজনক হয়নি। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মধ্যে পরবর্তীকালে ক্যু, কাউন্টার ক্যু এবং সেনাশূঙ্খলা বিরােধী কার্যক্রম সংঘটনে প্রমাণিত হয়েছে এসব বিগ্রেড গঠনের সিদ্ধান্ত ছিল মারাত্মক রকম ভুল সিদ্ধান্ত। তাছাড়া এই তিন অধিনায়কের কারােই ইতিপূর্বে বিগ্রেড পরিচালনার কোন অভিজ্ঞতা ছিলােনা। প্রধান সেনাপতি কর্ণেল ওসমানী ‘অপারেশন প্ল্যান তৈরী করার মূল্যায়নে এইসব বিগ্রেড সম্পর্কে বলেছেন, “যে কাজের জন্য বিগ্রেড গঠন করা হয়েছিল, ৩। অর্জনের ক্ষেত্রে এ যাবত বিগ্রেডকে ব্যবহার করা যায়নি এবং অদূর ভবিষ্যতেও করা যাবে বলে মনে হয় না।”১০
ওসমানীর পদত্যাগ ঃ জিয়ার চালে আবার ভুল ১. বিরাজমান যুদ্ধ পরিস্থিতি, ওয়ার প্লান, টেকটিক্যাল এবং লজিস্টিক সাপাের্ট ইত্যাদি
বিষয়ে বিস্তারিত আলাপ-আলােচনার ভিত্তিতে ভবিষ্যৎ যুদ্ধ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন ও গ্রহণ অত্যন্ত জরুরী হয়ে পড়েছিলাে। ১৬শে মার্চে পর হতে যে স্বতঃস্ফূর্ত সশস্ত্র প্রতিরােধ যুদ্ধের জোয়ার শুরু হয়েছিলাে। বাস্তব অবস্থায় ৭ সপ্তাহের মধ্যেই তা ক্রমাগত শুকিয়ে আসছিলাে। পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর সমন্বিত তৎপরতা, আক্রমণ চালনার দক্ষতা এবং পরিচ্ছন্ন ও নির্ভল টার্গেট অর্জনে লক্ষ্যবদ্ধতা অচিরেই বাংলাদেশের প্রায় সব এলাকা থেকে বাঙালী সেনাবাহিনীকে সীমান্তের ওপারে প্রতিবেশী ভারতে তাড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়। এ কাজটি করতে তাদের সময় লেগেছিল মাত্র তিন সপ্তাহ। ভারতে তাড়িত বাঙালী সেনা সদস্যদের সংখ্যাল্পতা, বিপর্যস্ত মানসিকতা এবং অশেষ দৈহিক ক্লেশের চাপে হঠাৎ মনে হলাে বাংলাদেশের যুদ্ধ যেন থেমে গেছে! বাংলাদেশের ভেতরেও এমন একটা পরিস্থিতির উদ্ভব হতে থাকে যে, পাক বাহিনীর এ বিজয় যেন চিরস্থায়ী, বাঙালী সেনাবাহিনী, যুব-তরুণ এবং দেশপ্রেমিক রাজনীতিবিদদের দালাই লামার মতাে আমৃত্যু ভারতের মাটিতেই যেন থেকে যেতে হবে। অবস্থার এই নাজুকতায় বিভিন্ন সেক্টর কমান্ডারগণ প্রধান সেনাপতি কর্ণেল ওসমানীর দক্ষতা এবং ক্ষমতার উপর প্রশ্নবােধক চিহ্ন অংকনে কুণ্ঠিত হননি। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ ও রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম কর্তৃক রণক্লান্ত সৈনিকদের মনােবল, ভবিষ্যৎ যুদ্ধ পরিকল্পনা এবং রণকৌশল সম্পর্কে বিস্তারিত আলােচনার উদ্যোগকে প্রধান সেনাপতি প্রসন্ন চিত্তে গ্রহণ করেননি, সেক্টর কমান্ডারদের বৈঠক আহ্বানকে তিনি তার ব্যক্তিগত সনের সংগে জড়িয়ে ফেলেন। সার্বিক অবস্থার প্রেক্ষিতে তিনি পদত্যাগপত্র পেশ করেন। এই বৈঠকের দিনগুলাের মধ্যেই কলকাতার পার্কস্ট্রীটে আনু মামার বাসায় কতিপয় সেক্টরের অধিনায়কগণ বেশ কয়েকটি বৈঠকে বসে তাদের সমন্বয়ে একটি ‘যুদ্ধ কাউন্সিল গঠনের ও প্রধান সেনাপতি কর্নেল ওসমানীকে ‘দেশরক্ষামন্ত্রী পদে অধিষ্ঠিত করার প্রস্তাব বিবেচনা করেন। তরুণ অথচ এই উচ্চাকাঙ্ক্ষী অধিনায়কদের সমন্বয়ে উক্ত যুদ্ধ কাউন্সিল হতে মুক্তিযুদ্ধের সমগ্র ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব তাদের উপর দেয়া হােক এই প্রস্তাব সরাসরি বৈঠকে উত্থাপিত হয়। যুদ্ধ কাউন্সিল’ গঠনের এই প্রস্তাবের পেছনে মূল ব্যক্তি ছিলেন জিয়াউর রহমান। সেক্টর কমান্ডার খালেদ মােশাররফ দ্ব্যর্থহীন ভাষায় এই প্রস্তাবের বিরােধীতা করলে সামরিক নেতৃত্বের দ্বিধাবিভক্তির পরিণামে ‘যুদ্ধ কাউন্সিল গঠনের ? প্রস্তাবটি তেমন ‘জোর’ পায়নি। ১১-১৭২ জুলাই পর্যন্ত এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
\ \
ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদের প্রচেষ্টায় শেষ পর্যন্ত কর্ণেল ওসমানী তার পদত্যাগ পত্র প্রত্যাহার করে নেন। কর্ণেল ওসমানী তার পদত্যাগ পত্র প্রত্যাহার করে দ্বিতীয় দিন হতে অধিবেশনে যােগদান করেন। এই বৈঠকেই যুদ্ধের খুঁটিনাটি দিক, সমস্যাসমূহ, ভবিষ্যৎ কার্যক্রম সম্পর্কে বিস্তারিত আলােচনা হয়। এই বৈঠকে লেঃ কর্ণেল এম, এ, রবকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর চীফ অব স্টাফ, গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ, কে, খন্দকারকে ডেপুটি চীফ অব স্টাফ নিযুক্ত করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। বৈঠকে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল তার মধ্যে ক. বিভিন্ন সেক্টরের সীমানা নির্ধারণ, খ. গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনা, গ. নিয়মিত হিনীকে ব্যাটালিয়ন, ফোর্স ও সেক্টর টুপসের ভিত্তিতে সংগঠিত করা।।
সক্টর কমান্ডারের বিলম্বিত শপথ। ১. ২৫শে মার্চের স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিরােধ যুদ্ধের প্রাথমিক সাফল্য ও উল্লাস অপসৃত হতে
বেশী দিন লাগেনি। সীমান্তের ওপারে তাড়িত সেনাবাহিনীকে প্রথম দিকে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীবাহিনীর কমান্ডারগণ গােলাবারুদ ও যুদ্ধ রসদ দিয়ে সাহায্য সহযােগিতা করলেও মে মাসের শেষ সপ্তাহ হতে জুনের মাঝামাঝি পর্যন্ত বাঙালী সেনাবাহিনীর প্রতি বি,এস, এফের উষ্ণতা হ্রাস পেতে থাকে। ভারতীয় সমর পরিকল্পনাবিদগণ ঐ সময় ‘টোটাল ওয়ার প্ল্যান নিয়ে ব্যস্ত থাকার ফলে দিল্লীর কোন সুস্পষ্ট নির্দেশ উহ্যই থেকে যায়, ফলে ভারত থেকে পর্যাপ্ত অস্ত্র পাবার আশা ভঙ্গ হয়ে পড়লে সামরিক অধিনায়কগণ অসহায় বােধ করতে থাকেন। প্রথম দিকে রাজনৈতিক নেতত্বকে তােয়াক্কা না করার যে উগ্র মানসিকতা এই সব ‘ক্ষুদে মার্শালদের মধ্যে গড়ে উঠেছিলাে বাস্তব অবস্থার প্রেক্ষিতে তাদের এই সুপ্ত আকাক্ষা শীতল হতে থাকে। রাজনৈতিক কর্তৃত্বের অধীনে তাদের যুদ্ধ পরিচালনা করা ব্যতীত অন্য কোন বিকল্প ছিলােনা।
জাতীয়, আন্তর্জাতিক এবং বাস্তব অবস্থার কারণে অনন্যোপায় হয়ে ২৬শে মার্চের স্বাধীনতা ঘােষণার ১১৪ দিনের মাথায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অধিনায়কগণ আনুষ্ঠানিকভাবে ১৭ই জুলাই বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করে শপথ গ্রহণ করেন। ১. স্বাধীনতা যুদ্ধের শুরুতে জিয়া যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেননি। একদিকে মানসিকভাবে যুদ্ধ করার পূর্ব প্রস্তুতি যেমন তাির ছলাে না-তেমিন অস্ত্রশস্ত্র ছিলাে না। ১৫০টি থ্রি নট থ্রি রাইফেল, ১০৬ এম আর আর এবং দুটি ৩ ইঞ্চি মর্টার ছিলাে। এ সবের কোন গুলি পর্যন্ত ছিলাে না। ৮ম বেঙ্গর রেজিমেন্টের সমস্ত অস্ত্র গােলাবারুদ সব পশ্চিম পাকিস্তানে পূর্বেই পাঠানাে হয়েছিলাে।১১ সেজন্য যারা বলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ২৬শে মার্চ স্বাধীনতা ঘােষণা করেন এবং ঐ ঘােষণা পাঠের পূর্ব হতেই জিয়াউর রহমান যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েন- একথা তথ্য সমৃদ্ধ নয়। প্রচারণা ও বানােয়াট। যুদ্ধকালীন সময়েও জিয়াউর রহমানের প্রত্যক্ষ যুদ্ধে অংশগ্রহণের কোন গৌরবজনক ও বীরত্বপূর্ণ ঘটনা খুঁজে পাওয়া যায় না। ১২

Reference list for the 1st chapter:

দ্বিতীয় অধ্যায়
জিয়ার তিন চেহারা
১. স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রধান সেনাপতি কর্ণেল ওসমানীকে বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সনের ৬ই ফেব্রুয়ারী জেনারেল পদে উন্নীত করেন। ৭ই এপ্রিল জেনারেল এম,এ,জি, ওসমানী সি এন সি হতে পদত্যাগ করেন গণপরিষদ সদস্যপদ বহাল রাখার লক্ষ্যে।। ৮এপ্রিল সম্মিলিত আর্মড ফোর্সেস-এর পরিবর্তে সেনাবাহিনী, বিমান ও নৌবাহিনীর প্রধান ও নতুন চীফ অব স্টাফ নিয়ােগ করা হয়। সেনাবাহিনীর প্রধান হন কে, এম, সফিউল্লাহ। ১২ ই এপ্রিল জেনারেল ওসমানীকে মন্ত্রী নিয়ােগ করা হয়। কে, এম, সফিউল্লাহকে চীফ অব স্টাফ নিয়ােগের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে বলতে গেলে অপ্রকাশ্য অন্তর্দ্বন্দ শুরু হয়। জিয়াউর রহমান মনে করতেন সেনাবাহিনীতে তিনিই সিনিয়র অফিসার এবং দক্ষ। এ ব্যাপারে তার অনুগত অফিসার ও জে.সি.ও এন সিও-দের দিয়ে প্রচারকার্য শুরু করেন খােলাখুলিভাবে। ২. বঙ্গবন্ধুর সরকার ডেপুটি চীফ অব স্টাফ পদ সৃষ্টি করে জিয়াউর রহমানকে উক্ত পদে নিয়ােগ দান করেন। এই পদে নিয়ােগ প্রাপ্তির জন্য কর্ণেল জিয়ার তদবীরের অন্ত ছিলােনা। চট্টগ্রামের এমপিগণের নিকট ধর্ণা দিতেও তার বাধেনি। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সচিব উদীয়মান তরুণ নেতা তােফায়েল আহমদ-এর বাড়িতে তদবীরের জন্যও কয়েকবার গেছেন, ধর্ণা দিয়েছেন জনাব আবদুর রাজ্জাকের কাছেও।২
৩. স্বাধীনতা যুদ্ধে জিয়ার রেকর্ড পর্যালােচনা করে বঙ্গবন্ধু কে, এম, সফিউল্লাহকেই সেনা বাহিনীর প্রধান নিয়ােগ যুক্তিযুক্ত মনে করেছিলেন। এ সম্পর্কে একজন সামরিক অফিসারের সুচিন্তিত অভিমত হলাে, জিয়াউর রহমানকে ডিঙ্গিয়ে কে, এম, শফিউল্লাহকে সেনাবাহিনী প্রধান নিয়ােগ করা সঠিক হয়নি, যা সঠিক ছিলাে তা হচ্ছে, অতঃপর জিয়াউর রহমানকে সেনাবাহিনীতে রাখা। ৪. সেনা প্রধানের দায়িত্ব পালন ছিলাে তখনকার পরিস্থিতিতে এক দুরূহ ব্যাপার।
স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন সময়ে বিভিন্ন সেক্টর কমান্ডারদের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব যেমন ছিলাে, তেমনি পরস্পরকে টেক্কা মেরে এগিয়ে যাবার প্রবণতাও লক্ষ্যণীয়।
মেজর সফিউল্লাহ ,মেজর জিয়াউর রহমান এবং মেজর খালেদ মােশাররফের নামে ‘এস’ ‘জেড’ ও ‘কে’ ফোর্স গঠন করে মূলত বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে ব্যক্তি কেন্দ্রিক বিভক্তির সুযােগ করে দেয়া হয়। আপাতত কেন্দ্রীয় কমান্ডের আনুগত্য প্রদর্শিত হলেও এই তিন ব্রিগেডের প্রধানদের মধ্যে বিশেষ করে শফিউল্লাহ ও জিয়াউর রহমানের মধ্যে সামরিক নেতৃত্বের প্রশ্নে ঠান্ডা লড়াই সর্বদাই কাজ করেছে। এর উপর সেনা প্রধান ও উপ সেনা প্রধানের পদ সৃষ্টি সেনা শৃঙ্খলা ও প্রশাসনের বিষয়টি আরাে জটিল হয়ে পড়ে। সফিউল্লাহকে সঙ্গে সঙ্গেই কয়েকটি মৌলিক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। পাকিস্তান আমলে পূর্ব পাকিস্তানে মাত্র ১০ হাজার সেনা সদস্যের আবাসিক বাসস্থানের সুযােগ ছিলাে। কিন্তু দেশ স্বাধীন হওয়ার সময়ে সেনাবাহিনীর সংখ্যাই ছিলাে প্রায় ২০ হাজার। তার উপর পাকিস্তান প্রত্যাগত সামরিক বাহিনীর আরাে প্রায় ২৫ হাজার সদস্য সেনাবাহিনীতে যােগদান করে। এরূপ অবস্থায় রাতারাতি প্রায় ৪০/৪৫ হাজার সৈন্য বাহিনীর আবাসিক সুবিধা প্রদান শুধু মাত্র কথার কথা ছিলােনা। কিন্তু সেনা প্রধান হিসেবে এ দায়িত্ব তার এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব ছিলােনা। ঢাকা, চট্টগ্রাম, যশােহর, সৈয়দপুর, রংপুর এবং কুমিল্লায় সেনানিবাসগুলিতে তাদের আবাসিক সুবিধার ব্যবস্থা করা হয়। সে ব্যবস্থা সুব্যবস্থা নয়, সাময়িক ব্যবস্থাপত্র। এ
নিয়েও কথা ছড়ানাে হয়। ৬. সমস্যা ছিলাে ইউনিফর্মের। তদানন্তিন পূর্ব পাকিস্তানে ইউনিফর্ম তৈরীর জন্য এমনকি, বুট, বেল্ট, ফিতা ক্যাপের কারখানা পর্যন্ত ছিলােনা। সবই আসত পশ্চিম পাকিস্তান থেকে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর পাকিস্তান থেকে তখনাে এসব সংগ্রহের সুযােগ ছিলােনা। প্রতিবেশী দেশ ভারতে জলপাই রঙের যে খাকি কাপড় উৎপন্ন হতাে তার গুণগত মান উন্নত ছিলােনা। ভারতে ঐ ধরনের খাকি কাপড় বর্ডার সিকিউরিটি বা সি, আর, পি-র জন্য ব্যবহৃত হতাে। সেই বিবেচনায় ভারত থেকে সেনাবাহিনীর জন্য ইউনিফর্মের কাপড় সংগ্রহ করাও সমীচীন মনে হয়নি। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর সামনে বিষয়টি পেশ করা হলে বঙ্গবন্ধু দেশেই সামরিক বাহিনীর ক্যামােফ্লেজ ড্রেস তৈরীর জন্য রাষ্ট্রায়াত্ত দুটি কাপড়ের কলে তা উৎপাদনের নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে এও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে, যে ক্যামােফ্লেজ ড্রেস তৈরী হবে তা যেন বাংলাদেশের নিসর্গ এবং ভূ-প্রকৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্য থাকে। কিন্তু বাংলাদেশের কোন মিলেই এই ধরনের কাপড় উৎপাদনের কোন পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিলােনা। মিলে বিশেষ ধরনের সুতা তৈরী, রং মিলানাে, রঙের টেকসই এবং গুণগতমান বজায় রেখে উৎপাদন পর্যায়ে যাওয়া ছিল সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। এমনি অবস্থায় সেনাবাহিনীর মধ্যে যথাযােগ্য ইউনিফর্ম প্রদানে বিলম্বিত হয়।
স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় গেরিলা যুদ্ধ কৌশলে ইউনিফর্ম কোন ফ্যাক্টর ছিলােনা কিন্তু দেশ স্বাধীন হওয়ার পর একটি সুশৃংখল সুসজ্জিত বাহিনীর জন্য ইউনিফর্ম ছিলাে বিশেষ একটি ফ্যাক্টর।। ৭. এই অবস্থায় সেনাবাহিনীর মধ্যে ইউনিফর্ম সমস্যা ছিলাে প্রকট। এডহক ভিত্তিতে সেনা প্রধান-উপ প্রধান সবাইয়ের ঐক্যমতের সিদ্ধান্তে প্রতিরক্ষা ক্রয় বিভাগ জরুরী ভিত্তিতে ভারত থেকে কিছু খাকি কাপড় আমদানী করে। জিয়াউর রহমান এব্যাপারে দ্বৈত ভূমিকা পালন করেন। সেনা সদস্যগণ ড্রেস না পাওয়ায় তাদের জন্য দুঃখে বিচলিত হন আর যারা ড্রেস পেয়েছিলাে তাদের মধ্যে ড্রেসের গুণগত মান এবং ভারতীয় কাপড় ইত্যাদি নিয়ে প্রশ্নের উদ্রেক ঘটাতে তৎপর ছিলেন। প্রকৃত পক্ষেই সেনাবাহিনীর জন্য আবাসিক সমস্যা, তাদের ইউনিফর্ম, তাদের বুট, বেল্ট, ক্যাপ, এমনকি উপযুক্ত অস্ত্রের অভাব ছিলাে প্রকট। ৮. ১৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। মিত্র ও মুক্তিবাহিনীর নিকট পাকিস্তানী হানাদারবাহিনী সােহরাওয়ার্দী উদ্যানে আত্মসমর্পণ করে। কিন্তু পাকিস্তান সামরিক বাহিনী বাংলাদেশে যাদের অবস্থান ছিলাে প্রায় ৯৩ হাজারের মত, তাদের আত্মরক্ষার জন্য হালকা অস্ত্রশস্ত্র রাখার অনুমতি পায়। পাকিস্তানী সৈন্যদের যুদ্ধবন্দী অবস্থায় ঐ অস্ত্রসহ ভারতে নিয়ে যাওয়া হয়। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বাংলাদেশে পাকিস্তান বাহিনীর প্রায় ৮২ টি ট্যাংক ছিলাে। যুদ্ধে এর সব গুলােই প্রায় ধংস হয়ে যায়। মাত্র ৪/৫টি ট্রাংক সচল ছিলাে। ভারী অস্ত্র বলতে তেমন কিছুই ছিলােনা।
৯. অথচ পাকিস্তান হতে প্রত্যাগত সামরিক অফিসার ও সদস্যগণ বাংলাদেশে এসে প্রত্যাশিত অস্ত্র না পাওয়ায় মানসিকভাবে বিরূপ হয়ে পড়ে। সর্বদা অস্ত্র ব্যবহারকারী সেনাসদস্যদের নিকট হঠাৎ অস্ত্র না থাকার প্রতিক্রিয়া হয়েছিলাে মারাত্মক। তারা নিজেদের নেগলেক্টেড ফিল করে। জিয়াউর রহমান তার বিশ্বস্ত অনুচরদের দিয়ে সস্তা জনপ্রিয়তা অর্জনের জন্য সূক্ষ্মভাবে ভারত বিদ্বেষী প্রচারণা চালান। বিষয়টি এরূপ হয়ে দাড়ায়, সেনাপ্রধান অকেজো এবং অযােগ্য। সকল যােগ্যতার ধারক এবং আকর জিয়াউর রহমান। এই ধারণাটি সেনা সদস্যদের মাঝে ছড়িয়ে দেয়া হয়।।
১০. জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে এমন এক সময়ে হত্যা করা হলাে যখন দেশে স্থিতিশীলতা এসেছে, আইন শৃংখলা পরিস্থিতি উন্নতি হয়েছে, উৎপাদন বেড়েছে, বিনিয়ােগের প্রসার ঘটছে, দ্রব্যমূল্য হ্রাস পেয়েছে। সামরিকবাহিনীর জন্য আর্টিলারী ও আর্মড কোর গঠিত হয়েছে। ট্যাঙ্ক এসেছে। যুদ্ধ বিমান এসেছে।
নৌবাহিনীর জন্য আধুনিক যান সংগৃহীত হয়েছে। সৈন্যদের পাকিস্তানী আমলের অনুরূপ রেশন প্রদানের ব্যবস্থা হয়েছে।৪ এমনি অবস্থার প্রেক্ষিতে সেনা প্রধান জেনারেল সফিউল্লাহ সামরিক বাহিনীর পাঁচ
ডিভিশন সেনাবাহিনীর একটি পরিকল্পনা পেশ করেন। উল্লেখ্য, প্রেসিডেন্ট টিটো বাংলাদেশে আগমন করলে বঙ্গবন্ধু তার নিকট সেনাবাহিনীর উপকরণগত বিষয়ের স্বল্পতার কথা উল্লেখ করেন। প্রেসিডেন্ট টিটো এক ডিভিশন সেনাবাহিনীর জন্য সাজ-সরঞ্জাম, অস্ত্রশস্ত্র দেবার প্রতিশ্রুতি দেন এবং সে প্রতিশ্রুতি মােতাবেক অস্ত্রশস্ত্র, গােলাবরুদ, সাঁজোয়া গাড়ী আসছিলাে। এরূপ অবস্থায় জেনারেল সফিউল্লাহ ৫ ডিভিশন সেনা বাহিনীর একটি পরিকল্পনা উত্থাপন করেন। পরিকল্পনা বঙ্গবন্ধুর টেবিলে অনুমােদনের জন্য ছিলাে। পরিকল্পনাটি যাতে অনুমােদন না হয় তার জন্য বঙ্গবন্ধুর নিকট গিয়ে এর বিরুদ্ধে বিরােধীতা করছিলেন জিয়াউর রহমান।৫ কিন্তু বঙ্গবন্ধু হত্যার পর সেনা প্রধানের পদ হতে সফিউল্লাহকে বিদায়
করে জেনারেল জিয়া ঐ পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করেন। ডিভিশন প্রতিষ্ঠা করেন। ১২. পাঁচটি ডিভিশন গঠনের ক্ষেত্রে জিয়ার বিরােধীতা এবং জিয়া সেনা প্রধান হয়ে পরবর্তীকালে তা বাস্তবায়ন করার মধ্য দিয়ে একথা বুঝতে অসুবিধা হয়না যে, জিয়া ঘনিষ্টভাবে জানতেন বঙ্গবন্ধু ও সফিউল্লাহ আর বেশী দিন নেই। চক্রান্ত
চূড়ান্ত পর্যায়ে এসেছে। ১৩. জিয়াউর রহমানও ষড়যন্ত্রমূলক পরিকল্পনা নিয়ে সেনাবাহিনীর মধ্যে বিরাজিত অসন্তোষ প্রশমনে সদা সর্বদাই বাধা সৃষ্টি করে যাচ্ছিল। পাকিস্তান হতে সামরিক বাহিনীর অফিসার ও সদস্যদের প্রত্যাবর্তন এবং তাদের সেনাবাহিনীতে বহাল রাখার সিদ্ধান্ত জিয়াউর রহমানের কূট কৌশল বাস্তবায়নের সুযােগ এনে দেয়। মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণকারী অফিসারদের মধ্যে যুদ্ধকালীন সময়ে রিক্রুট কৃত অফিসার ব্যতীত প্রায় সকলেই ছিলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কমিশন প্রাপ্ত
অফিসার। ১৪. বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মুক্তিযােদ্ধা সেনা অফিসারদের দু’ বছর সিনিয়রিটি প্রদান করেন। ইতিমধ্যেই পাকিস্তান হতে বাঙালী সেনা অফিসারদের প্রত্যাবর্তন শুরু হয়। মুক্তিযােদ্ধাদের সঙ্গে পাকিস্তান ফেরৎ সেনা অফিসারদের সাথে চাকুরীর মেয়াদ, পদোন্নতির বিষয়, বেতন ভাতা ও চাকুরীতে সুযােগ সুবিধা ইত্যাদির কারণে ‘ঠান্ডা লড়াই’ শুরু হয়ে যায়। সেনাবাহিনীর পেশাগত কঠোর শৃঙ্খলাবদ্ধ জীবনে জুনিয়র-সিনিয়র সম্পর্ক একটি ছকবাধা এবং বিধি সিদ্ধ যে,এতে প্রত্যাহিক জীবনে অনেক অসুবিধার সৃষ্টি করে।
পাকিস্তান ফেরৎ অফিসারদের মধ্যে লেঃ জেনারেল খাজা ওয়াসিউদ্দিন, মেজর জেনারেল করিম ও ব্রিগেডিয়ার খলিলুর রহমান যখন পাকিস্তানি সেনা বাহিনীতে যথাক্রমে কোর কমান্ডার, ডিভিশন কমান্ডার ও ব্রিগেড কমান্ডারের দায়িত্ব ছিলেন, তখন মেজর সফিউল্লাহ ও মেজর জিয়াউর রহমান একজন কোম্পানী কমান্ডার মাত্র। ঐসব মেজর ও কোম্পানী কমান্ডার যখন স্বাধীন বাংলাদেশে সেনাবাহিনীর প্রধান ও উপ-প্রধান পদে সমাসীন সেই অবস্থায় ঐ সব প্রত্যাগত সিনিয়র অফিসারদের অবস্থান ও তাদের মানসিক প্রতিক্রিয়ার বিষয়টি সহজেই অনুমেয়।৬ ১৫. জিয়াউর রহমান পাকিস্তান প্রত্যাগত সামরিক অফিসারদের সঙ্গে দ্রুত সুসম্পর্ক স্থাপন করতে সক্ষম হন এবং তাদের একজন প্রিয়পাত্র হয়ে দাড়ান। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে পাকিস্তান প্রত্যাগত অফিসারগণই ছিলাে মেজরিটি। এই মেজরিটি অংশের এবং মুক্তিবাহিনীর মধ্যে বেশ কিছু অফিসারদের দলে টানতে জিয়াউর রহমান তেমন কোন অসুবিধার সম্মুখীন হয়নি। জিয়াউর রহমান অত্যন্ত গােপনে, অথচ ধূর্ততার সঙ্গে পাকিস্তান ফেরৎ অফিসার ও মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণকারী অফিসারদের মধ্যে ‘ঠান্ডা লড়াই’ কে ‘উত্তপ্ত করার কাজে সর্বদা নিয়ােজিত ছিলেন।৬ ১৬. আভ্যন্তরীণ আইন-শৃংখলা রক্ষার লক্ষ্যে গঠিত ‘রক্ষীবাহিনী গঠন নিয়ে সামরিক বাহিনী সদস্যদের মধ্যে ভুল বুঝাবুঝিকে জিয়াউর রহমান একে হাতিয়ার হিসেবে নির্ভুলভাবেই ব্যবহার করেছেন। ৭ ১৭. এই দৃশ্যপটের সঙ্গে জেনারেল সফিউল্লাহ বলেছেন যে, ১৫ই থেকে ১৮ই আগষ্ট পর্যন্ত তাকে বঙ্গভবনে প্রেসিডেন্টের সঙ্গে থাকতে হয়। সফিউল্লাহ বুঝতে পেরেছিলেন ট্রুপসের কাছে তাকে যেতে না দেওয়ার জন্য তাকে অহেতুক বঙ্গভবনে প্রেসিডেন্টের পাশে আটকে রাখা হয়েছে। ১৮ই আগস্ট রাতে খন্দকার মােশতাক সামরিক শাসন জারী করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানান এবং ড্রয়ার থেকে সামরিক শাসন সংক্রান্ত একটি কাগজ বের করেন। সেনা প্রধান সফিউল্লাহ যেহেতু সামরিক শাসন জারী করা হচ্ছে সেহেতু আইনগত খুটিনাটি দিকের পরীক্ষার কথা বলতে খন্দকার মােশতাক রাগান্বিত কণ্ঠে বলেন, “তিনমাস ধরে কাগজটি তৈরী করেছি। দেখার তেমন কিছু নেই।” ৮
১৮. জিয়াউর রহমান মুক্তিযােদ্ধার পােশাকে মুক্তিযুদ্ধের কৃতিত্ব নিতেন, অপরদিকে ‘পাকিস্তানী’ মানসিকতার জন্য পাকিস্তানী অফিসারদের নিকট প্রিয়পাত্র হয়ে ওঠার কৌশল গ্রহণ করেন। একই সাথে পাশাপাশি রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মনােরঞ্জন করতে তৎপর ছিলেন। বাকশাল সদস্য হবার আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। এ সবই ছিল জিয়ার ধূর্ততা, প্রতারণা ও শঠতার তিন চেহারা।।
Reference: জেনারেল জিয়ার রাজত্ব – অধ্যাপক আবু সাঈদ
ভিডিওটি ১৯৭৮ সালে খাল খননের পরিস্থিতি দেখতে এসে।

Reference list:

তৃতীয় অধ্যায়
জিয়ার পথের কাঁটা
১। খুনী রশিদ-ফারুকের হস্তক্ষেপে জেনারেল সফিউল্লাহকে সরিয়ে সেনাপ্রধান পদে জেনারেল জিয়াউর রহমানকে প্রতিষ্ঠিত করা হয়। এয়ার ভাইস মার্শাল এ,কে, খােন্দকারকে বিদায় দিয়ে ১৭ই অক্টোবর এয়ার ভাইস মার্শাল এম, জি, তােয়াবকে উক্ত পদে বসানাে হয়। ২৪ শে আগস্ট জেনারেল (অবঃ) এম,এ, জি, ওসমানীকে ‘ডিফেন্স এডভাইসার’ করা হলাে। ওসমানীর উপদেশ মতাে তিন বাহিনীর উপর, কর্তৃত্ব করার জন্য ডিফেন্স ষ্টাফ প্রধান পদ সৃষ্টি করে বিডিআর এর মহাপরিচালক মেজর জেনারেল খলিলুর রহমানকে নিয়ােগ করা হয়। কেননা, জেনারেল ওসমানী কোনদিনই জিয়াকে বিশ্বাস করেনি। সেনা প্রধান পদে তাকে বসানাে হলে তার মাথার উপরে ওসমানী ও খলিলুর রহমান এবং তার নিচেই ব্রিগেডিয়ার খালেদ মােশাররফকে চীফ অফ জেনারেল স্টাফ করে রাখা হলাে। ২. ১৭ই আগস্ট রাতে আর্মি হেড কোয়ার্টারের একসভা জেনারেল কে,এম,
সফিউল্লাহ, জিয়াউর রহমান, এয়ার ভাইস মার্শাল এ, কে, খােন্দকার, নৌবাহিনীর প্রধান এম,এইচ, খান, পুলিশের আই জি, পি এস ও ব্রিগেডিয়ার রউফ, খালেদ মােশাররফ, ডি এ এম, কর্ণেল মালেক, জি এ, ও ওয়ান লেঃ কঃ নূরুউদ্দিন আহমেদ ঐ সভায় উপস্থিত ছিলেন। সভায় সিদ্ধান্ত হলাে, সামরিকবাহিনীর ‘চেন অফ কমান্ড’ ফিরিয়ে আনা হবে। অভ্যুত্থানকারীদের শাস্তি হওয়া দরকার। সভায় প্রতিজ্ঞা করা হলাে বিষয়টি গােপনীয় থাকবে।১ কিন্তু এই গােপনীয় সিদ্ধান্তটি জানাজানি হয়ে যায়।। ৩. জিয়াউর রহমানের নিস্পৃহ এই মনােভাব দেখে সেনাবাহিনীতে ‘চেইন অফ
কমান্ড’ ঠিক করার জন্য খালেদ মােশাররফ শাফায়াত জামিল এক মত হলেন। জিয়াউর রহমান সার্বিক ব্যাপারটা পর্যবেক্ষণ করছিলেন ভিন্নভাবে। তার সামনে বাধা ফারুক-রশীদ ছিলােনা। ১৯৬৬ সালে পাকিস্তান মিলিটারী একাডেমীর প্রশিক্ষক থাকাকালে ঐ সময়ে ফারুক-রশিদ তার ছাত্র ছিলাে। পথের বাধা ছিলাে ওসমানী-খলিল, খালেদ, শাফায়াত গং। মেজরদের অপসারণ করলেই বা তাদের ক্যান্টনমেন্টে ফিরিয়ে আনলে অথবা চেইন অফ কমান্ড ঠিক হয়ে গেলে তার ক্ষমতা নিরঙ্কুশ হচ্ছে না। সেজন্য জিয়া তার নিজস্ব পরিকল্পনায় কাজ করছিলেন গােপনে। জিয়াউর রহমান সেনাপ্রধানের পদটি দখল করে এ অবস্থায় সুযােগের জন্য ওৎ পেতে থাকেন। ৪. কর্ণেল (অবঃ) আবু তাহের বসে ছিলেননা। যার যার ছক নিয়ে তারা কাজ
করছিলেন।২ ভিন্ন ভিন্নভাবে। ৫. ২রা নভেম্বর ‘৭৫ গভীর রাত। ওসমানী, খলিল, এমনকি মােশতাক জিয়া ও খালেদের দ্বন্ধের কারণে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। রশিদের আপত্তি আগ্রাহ্য হলে শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত হলাে জিয়া খালেদ দুজনকেই সরিয়ে দেয়া হবে। ২রা নভেম্বর রাত সাড়ে ১২টা ব্রিগেডিয়ার খালেদ মােশাররফ ৪র্থ বেঙ্গল রেজিমেন্ট এসে কমান্ড গ্রহণ করেন। রাত ১টায় ১ম বেঙ্গল রেজিমেন্টের একটি প্লাটুন ঝটিকার বেগে জিয়াকে গৃহবন্দী করে। তার টেলিফোনের তার ছিড়ে ফেলে। কিন্তু তাদের জানা ছিলনা টেলিফোনটি ছিল বেডরুমে। এটা তার এক্সটেনশন মাত্র। বঙ্গ ভবনে অভ্যুথানের খবর এসে পৌছে। রশিদ জিয়াকে ফোন করে। রশিদ তাকে সর্বশেষ পরিস্থিতি অবহিত করে। রশিদ জেনারেল ওসমানীকে ফোন করে। ওসমানী জিয়াকে ফোন করেন। জিয়া ফোন ধরে জানালেন, সে বন্দী। সেনা অভ্যুথানের সংবাদ শুনেই পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী রিসালদার খুনী মােসলেম উদ্দিন কয়েকজন সৈন্যসহ ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাভ্যন্তরে ঢুকতে চাইলে ডি আই জি প্রিজন তাদের বাধা দেন। তখন কেন্দ্রীয় কারাগার হতে মােসলেহ উদ্দিন টেলিফোন করে রশিদকে। রশিদ ডি,আই, জি প্রিজনকে মােসলেউদ্দিনের কথা মত কাজ করতে বলেন। ডি আই, জি প্রিজনের অস্বীকৃতিতে মােসলেউদ্দিন ক্রোধে ফেটে পড়ে। ডি, আই, জি প্রিজন প্রেসিডেন্ট মােশতাকের সাথে কথা বললে মােশতাক মােসলেহ উদ্দিনের কথামত কাজ করতে নির্দেশ দেয়। মােসলেহউদ্দীন গং জেলের মধ্যে ঢুকে সবাইকে তাজউদ্দিনের সেলে নিয়ে এসে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের সাহায্যে জাতীয় চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমদ, এম, মুনসুর আলী ও এ, এইচ এম, কামারুজ্জামানকে হত্যা করে। সম্প্রতি জাতির জনক বঙ্গ বন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বীকৃত খুনীদের অন্যতম কর্নেল (অবঃ) ফারুক বলেছে যে, ৩রা নভেম্বর জেল হত্যার জন্য খন্দকার মােশতাক আহমদ ও কর্ণেল (অবঃ) রশিদ দায়ী। খন্দকার মােশতাক প্রসঙ্গে কর্ণেল (অবঃ) ফারুক বলেছে যে, তিনি বুঝতে পেরেছিলেন একটা গন্ডগােল হচ্ছে। এ সময় সৈয়দ নজরুল ইসলাম বেঁচে থাকলে তার জন্য সমস্যা হবে। এ কারণেই মােশতাক জেল হত্যা ঘটিয়েছে। ৩
মােশতাক ও ৪ জাতীয় নেতাকে সরিয়ে দিয়ে রাজনৈতিক শূণ্যতার মধ্যে নিজেকে একক ব্যক্তিত্বরূপে থেকে যেতে চাইলে জিয়াউর রহমান নিষ্ক্রিয় থেকে খালেদ মােশাররফকে এগিয়ে দিলেন। জিয়া জানতেন, খালেদ মােশতাককে রাখবেনা। মােশতাককে সরাতে পারলে ওসমানী খলিলের খবরদারী থাকবে না। সামরিক বাহিনীতে তখন তিনি হবেন সর্বময় ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের অধিকারী। জিয়ার এটা বঝতে অসুবিধা হয়নি যে, বিরাজমান পরিস্থিতিতে মােশতাক-রশিদ ফারুক প্রথম রাউন্ডে খেলছে, তারা যখন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু হত্যার সফলতা অর্জন করে তখন সুযােগ বুঝে জিয়াউর রহমান সেনাবাহিনীর প্রধান পদটি দখল করে। খালেদ মােশাররফের অভ্যুথানের সময় জিয়াউর রহমান বন্দী হওয়ার পূর্বে প্রায় আধা ঘন্টা সময় পায়। জিয়া খালেদের অভ্যুত্থান ঠেকাতে চেষ্টা করেনি কিংবা রশিদের অনুরােধে তাদের পক্ষও নেয়নি। বরং খালেদ-জামিল বনাম রশিদ-ফারুকের সংঘাতে সে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখে। ফলে খালেদ তাকে প্রাণে মারেনি, বন্দী করেছে মাত্র। খালেদ মােশাররফ-এর ক্ষমতা দখলের পর জিয়ার পরিকল্পনা
ভেস্তে যেতে বসে। ৮. এ রকম একটা পরিস্থিতির মুখােমুখি হয়ে জিয়াউর রহমান তাৎক্ষণিকভাবে কর্ণেল (অবঃ) আবু তাহের-এর স্মরণাপন্ন হন। সি আই, এ ডকুমেন্টে পরিলক্ষিত হয় যে, জিয়া ও মেজর তাহের এর মধ্যে পূর্বে হতেই সুসম্পর্ক ছিল।৪ স্বাধীনতার পর কর্ণেল তাহের ও জিয়াউদ্দিন সেনাবাহিনী হতে পদত্যাগ করেন। জিয়াউদ্দিন সর্বহারা পার্টিতে যােগদান করে সশস্ত্র বিপ্লবের পথ বেছে নেয় । তাহের ও জিয়াউদ্দিনের চিন্তা ছিলাে অভিন্ন। জিয়াউর রহমান গােপনে সর্বহারা পার্টির নেতাদের প্রতি সমর্থন দেন এবং তাদের গ্রেফতারে নমনীয়তা প্রদর্শন করেন।৫ সেনাবাহিনী থাকাকালীন অবস্থায় তাহের ও জিয়াউদ্দিন জিয়াউর রহমানের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধিতে ব্যাপকভাবে কাজ করেন। তাদের মধ্যে সম্পর্ক ছিল ঘনিষ্ট। সৈনিকদের মধ্যে তাহেরের বৈপ্লবিক সংস্থার কার্যক্রম সম্পর্কেও জিয়ার অজানা ছিলােনা। ৯. সেজন্য বন্দী অবস্থায় কর্ণেল (অবঃ) আবু তাহেরকেই জিয়াউর রহমানের মনে
পড়েছে। কারণ তার প্রাণ বাঁচানাের জন্য কর্ণেল (অবঃ) আবু তাহের এবং জাসদ ব্যতীত অন্য কোন বিকল্প তখন তার হাতে ছিলনা।৬ তাহেরের জবানবন্দীতে একথা তাহেরও উল্লেখ করেছেন।৭ ১০. ৩রা নভেম্বর ‘৭৫ বঙ্গবন্ধু হত্যাকারী রশিদ-ফারুক গং দেশ ত্যাগ করলে
মােশতাক অসহায় হয়ে পড়ে। কোনক্রমেই মােশতাক প্রেসিডেন্ট হতে রাজি হলােনা। শাফায়াত জামিলের প্রস্তাবে প্রধান বিচারপতি আবু সাদাত মােহাম্মদ সায়েমকে প্রেসিডেন্ট বানানাে হয়।
১১. ১৯৭৫ সালের ৬ই নভেম্বর প্রধান বিচারপতি আবু সাদাত মােহাম্মদ সায়েম দেশের ৫ম প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। খালেদ মােশাররফ ইতিমধ্যেই নিজেকে মেজর জেনারেল পদে উন্নীত করে সেনা প্রধানের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ৬ই নভেম্বর। বৃহস্পতিবার। নতুন প্রেসিডেন্ট বিচারপতি আবু সাদাত মােহাম্মদ সায়েম রেডিও টেলিভিশনে ভাষণ দেন। জাতীয় সংসদ ভেংগে দেন। বললেন, তার সরকার নিরপেক্ষ, নির্দলীয় ও অন্তর্বর্তী কালীন সরকার। তিনি বলেন যে, শেখ মুজিবরের হত্যায় সেনাবাহিনী জড়িত ছিলােনা। তিনি বলেন, আইন শৃংখলা প্রতিষ্ঠা করে নিরপেক্ষ প্রশাসন গড়ে তােলা হবে। এবং পূর্ব ঘােষিত ১৯৭৭ সনের ২৮শে ফেব্রুয়ারীতে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেন। ১২. ৩ থেকে ৬ই নভেম্বর ‘৭৫। তিন দিন। জিয়াউর রহমান ৪ তারিখে সেনাবাহিনী প্রধান হতে ইস্তাফা দান করেন এবং ইস্তেফা পত্রে উল্লেখ করেন যে, তিনি রাজনীতিতে নিজেকে জড়াতে চান না। সেজন্য তিনি সেনা প্রধানের পদ থেকে পদত্যাগ করছেন।৮ পদত্যাগ পত্র দিয়ে তিনি খালেদ মােশাররফকে আশ্বস্ত করলেন। জিয়াউর রহমানের পদত্যাগ গৃহীত হলে খালেদ জিয়াউর রহমান অধ্যায় শেষ হয়েছে বলে ধরে নেন। খালেদ মােশাররফ রাজনৈতিক সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছিলেন। দেশের রেডিও টিভিতে কি ঘটছে তার খবর দেয়া হলাে না। জনমনে সন্দেহ দানা বাধতে থাকে। গুজব ছড়িয়ে দেয়া হয়, খালেদ ভারতের দালাল। ভারতের এজেন্ট হিসেবে খালেদ মােশাররফ ক্ষমতা দখল করছে। প্রমাণ হিসেবে পূর্ব ঘােষিত ৪ঠা নভেম্বর ‘মুজিব দিবস’ পালনে আওয়ামীলীগ, ন্যাপ, কম্যুনিস্ট পার্টি ছাত্র ও নেতৃবৃন্দের মিছিল কাজে লাগায়। সাম্প্রদায়িক শক্তি উঠে পড়ে লেগে যায়। বাংলাদেশে ছদ্মবেশে ভারতীয় সৈন্যও ঢুকে পড়েছে বলে গুজব ছড়িয়ে দেয়া হয়।৯
১৩. কর্ণেল (অবঃ) তাহের ১৯৭২ সালে সেনাবাহিনীর এডজুট্যান্ট জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পরে কুমিল্লায় ৪৪ পদাতিক ব্রিগেডের কমান্ডার নিয়ােগ প্রাপ্ত হন। কর্নেল তাহের ও কর্ণেল জিয়াউদ্দিন ব্রিটিশ আর্মি পদ্ধতির পরিবর্তে চাইনিজ স্টাইলে উৎপাদনমুখী পিপল আর্মি গঠনের ইচ্ছা বাস্তবায়িত না হওয়ায় তারা পদত্যাগ করে। বঙ্গবন্ধু তাহেরকে ড্রেজার অর্গনাইজেশন এর পরিচালক পদে নিয়ােগ করেন। বাংলাদেশের জন্য যা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সেখানে থেকেই কর্ণেল (অবঃ) তাহের গােপনে জাসদের সঙ্গে সম্পর্ক এবং সেনাবাহিনীর সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যােগসূত্র রক্ষা করে আসছিলেন। গােপনে সেপাইদের নিয়ে সেল গঠন করেন এবং অফিসারদের বিরুদ্ধে তাদের লেলিয়ে দেন।
১৪। ৪ এবং ৫ নভেম্বর দু’দিন। বেঙ্গল ল্যান্সার আর সেকেন্ড ফিন্ড আর্টিলারীর সৈন্যরা দেখতে পেলাে যাদের নেতৃত্বে তারা জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছে সেই সব নেতৃত্ব দেশছাড়া, ওসমানী ও মােশতাক ক্ষমতাচ্যুত। এবং জিয়া বন্দী। এসময় ১০ম ও ১৫ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে ঢাকায় আনা হলাে। ফলে বঙ্গবন্ধু হত্যার নিয়ােজিত ট্যাংক ও আর্টিলারী বাহিনীর সৈন্যরা প্রেসিডেন্ট সায়েমের বক্তৃতায় বুঝতে পারল সেনাবাহিনী নয় একটি ‘ক্ষুদ্র গােষ্ঠী’ হিসেবে তাদের জঘণ্য কৃৎকর্মের শাস্তি আসন্ন। এই অবস্থায় মরিয়া হয়ে তারা জেনারেল জিয়াকে তাদের একমাত্র পরিত্রাণ কর্তা হিসেবে বেছে নিতে দ্বিধা করেনি। অন্যদিকে ডানপন্থী মুসলিমলীগ ও ‘বামপন্থী’ জাসদ ক্যান্টনমেন্ট সহ রাজধানীতে হাজার হাজার প্রচার পত্র বিলি করে। একজন বিশ্বাসঘাতক, ভারতের এজেন্ট এবং পরাজিত শক্তির প্রতিভূ খালেদ মােশাররফকে উৎখাতের জন্য জনগণ ও সেনাবাহিনীর প্রতি আহবান জানায়। সৈন্যদের ঐক্যবদ্ধ করার জন্য কর্ণেল (অবঃ) আবু তাহের সিপাইদের জন্য ১২টি দাবী পেশ করে। এতে সাধারণ সিপাইগণের স্বার্থরক্ষার বিষয়গুলাে ছিলাে মুখ্য। (পরিশিষ্ট-২) ট্যাংক রেজিমেন্ট, আর্টিলারী বাহিনী এক যােগে অফিসারদের বিরুদ্ধে শ্লোগান দিয়ে বেরিয়ে পড়ে। অস্ত্রাগার লুণ্ঠন করে। দলে দলে বিভক্ত হয়ে ‘সিপাই সিপাই ভাই ভাই, অফিসারদের রক্ত চাই’ ‘সিপাই সিপাই ভাই ভাই সুবেদারের উপর অফিসার নাই” ইত্যাদি শ্লোগানে ক্যান্টনমেন্ট মুখরিত করে তােলে। অফিসারদের খুন করা হয়। দ্বিতীয় ফিল্ড আর্টিলারী ব্যারাকের কাছে অফিসার্স মেসে একজন তরুণ আর্মি অফিসারকে তারা হত্যা করতে এলে তারা পালিয়ে ধানক্ষেতে লুকিয়ে পড়ে। তাদের মধ্যে একজন ছিলেন বেগম খালেদা জিয়ার ছােট ভাই সেকেন্ড লেফটেনেন্ট সৈয়দ ইস্কান্দার সাঈদ। ১০ ১৬। জিয়াউর রহমানের অনুরােধে এবং বিশেষ লক্ষ্যকে সামনে রেখে কর্ণেল (অবঃ) আবু তাহের বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার মাধ্যমে সিপাহী বিপ্লবের নির্দেশ দেন। তার পূর্বে ৪ঠা নভেম্বর জিয়াউর রহমান আবারও তার জীবনকে বাঁচানাের জন্য কর্ণেল (অবঃ) আবু তাহেরের নিকট আবেদন করেন। কর্ণেল (অবঃ) আবু তাহের মেসেঞ্জারকে একথা বলে পাঠান যে, শীঘ্রই তিনি ব্যবস্থা নিচ্ছেন। জিয়া যেন সাহস সঞ্চয় করেন।এন সিও ও জেসিওদের সঙ্গে বৈঠক করে সেনাবাহিনীর সকল ইউনিটের সঙ্গে যােগাযােগ স্থাপনের পর কর্নেল (অবঃ) আবু তাহের ৬ই নভেম্বর শেষ প্রহরে বিভিন্ন সেনা প্রতিনিধিদের মাধ্যমে প্রতিটি ইউনিটকে সতর্ক থেকে পরবর্তী নির্দেশের জন্য অপেক্ষা করতে নির্দেশ দেন। ৭ই নভেম্বর রাত ১টার সময় সিপাহী বিদ্রোহ ঘটানাের নির্দেশ দেয়া হয়। এ লক্ষ্যে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়—
১, খালেদ মােশাররফ চক্রকে উৎখাত, ২. বন্দী দশা থেকে জিয়াউর রহমানের মুক্তি, ৩. রেভুলেশনারী মিলিটারী কমান্ড কাউন্সিল গঠন, ৪. রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তিপ্রদান, ৫. সকল হুলিয়া ও গ্রেফতারী পরােয়ানা প্রত্যাহার, ৬. বাকশাল ব্যতীত সকল দলকে নিয়ে অল পার্টি সরকার গঠন, ৭. বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার ১২-দফা বাস্তবায়ন।
১৭. সফল অভ্যুত্থানের এক পর্যায়ে জিয়াকে বন্দীদশা হতে মুক্ত করে সেকেন্ড ফিল্ড আর্টিলারী হেড কোয়ার্টারে নিয়ে আসা হয়। রাত তিনটায় কর্ণেল (অবঃ) আবু তাহের তার ভাই ফ্লাইট সার্জেন্ট আবু ইউসুফ খানকে সঙ্গে নিয়ে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট গমন করেন। জিয়া নাইট ড্রেস পরেছিল আর পাশে বিগ্রেডিয়ার মীর শওকতসহ কিছু অফিসার ও সৈন্যরা ছিলাে। জিয়া কর্ণেল তাহেরের সঙ্গে কোলাকুলি করেন। তার ভাইয়ের সঙ্গেও কোলাকুলি করেন। এবং অশ্ৰুচোখে তার জীবন বাঁচানাের জন্য তাকে ধন্যবাদ জানান। এমনকি জিয়া এ পর্যন্ত বলেন যে, জাসদ এবং তাদের জন্য তিনি জীবন দিতে প্রস্তুত আছেন।১১ জিয়াউর রহমানকে সঙ্গে নিয়ে কর্ণেল তাহের বাংলাদেশ বেতারে আসেন। জিয়া বেতার ভাষণে নিজেকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে ঘােষণা দেন। ঐ সময়ে ঠিক হয় জিয়া এবং তাহের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সিপাহী জনতার উদ্দেশ্যে ভাষণ দেবেন। ৮-৩০ মিনিটে খন্দকার মােশতাক রেডিওতে ভাষণ দিতে এলে তাহের তাকে বের করে দেন এই বলে যে চক্রান্তের রাজনীতির দিন শেষ হয়ে গেছে।” ১৮. কর্ণেল (অবঃ) আবু তাহের শহীদ মিনারে পূর্ব নির্ধারিত ভাষণ দেওয়ার জন্য জিয়াউর রহমানকে আনতে ক্যান্টনমেন্টে গিয়ে দেখতে পেলেন পরিস্থিতি পরিবর্তিত হয়ে গেছে। শহীদ মিনারে যাওয়ার জন্য বললে, জিয়াউর রহমান তাহেরকে অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে বলেন যে, তিনি একজন সৈনিক, পাবলিক প্লেসে মিটিং করা তার ঠিক হবেনা। জিয়া সেভ করে ড্রেস পরেছেন, মনে হলাে বন্দীস্মৃতি ভুলে গেছেন। ১৯. বেলা ১১ ঘটিকায় সেনা সদরে মিটিং অনুষ্ঠিত হয় জেঃ ওসমানী, জিয়া, তােয়াব,
এম,এইচ খান, খলিলুর রহমান, আবু তাহের এবং প্রেসিডেন্টের প্রিন্সিপাল সেক্রেটারী মাহবুব আলম চাষী উপস্থিত ছিলেন। বিচারপতি সায়েমকে প্রেসিডেন্ট রাখার বিষয়টি পুনঃসিদ্ধান্ত হয়। প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের পদটি মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের অধীনে রাখার জন্য কর্ণেল (অবঃ) আবু তাহের প্রস্তাব করলে আলােচনার এক পর্যায়ে ব্রিগেডিয়ার খলিলুর রহমান ও ওসমানী বিরোধিতা করেন। এ পর্যায়ে সেনা, বিমান, নৌবাহিনী প্রধানদের উপ-প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক পদে নিযুক্তির সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সভায় আরো স্থির হয় বাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে মুক্তি দেয়া হবে। রাজনৈতিক কার্যক্রম চলতে দেয়া হবে এবং মােশতাক এবং সায়েমের প্রদত্ত নির্বাচনী তারিখের পূর্বেই সাধারণ নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হবে। বিচারপতি সায়েম উপদেষ্টা পরিষদের সাহায্যে কেবলমাত্র অন্তবর্তীকালীন সরকার পরিচালনা করবেন। ১২ ৭ই নভেম্বর সন্ধ্যা ৭-৪৫ মিনিটে জিয়াউর রহমান বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার উত্থাপিত ১২- দফা দাবী স্বাক্ষর করেন।১৩ ২০. ৮ই নভেম্বর হতে ১১ই নভেম্বর পর্যন্ত সেনাবাহিনীতে শৃংখলা ফিরিয়ে আনার কাজে জিয়াউর রহমান বারংবার কর্ণেল (অবঃ) আবু তাহেরের সাহায্য গ্রহণ করেন। বিদ্রোহী সৈন্যরা অফিসারদের হত্যা শুরু করে এবং ৮ তারিখ পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকে। ক্যাপ্টেন সিতারা, মেজর করিম, ক্যাপ্টেন আনােয়ার, লে মুস্তাফিজ, মেজর আজিম, মেজর মহিউদ্দিন, ক্যাপ্টেন খালেক ও লেঃ সিকান্দার উত্তেজিত সিপাইদের হাতে নিহত হন। সেনানিবাসগুলিতে ক্ষমতা সংহত করার পর পরই জিয়াউর রহমান ২৪ নভেম্বর কর্ণেল (অবঃ) আবু তাহেরকে গ্রেফতার করে সরাসরি জেলে পাঠিয়ে দেয়। একই সঙ্গে রব, জলিল ও অন্যান্য জাসদ নেতাদের গ্রেফতার করা হয়। ২১. ১৯৭৪ সনের জুলাই মাস থেকে নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত, সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে উস্কানী ও বিশৃংখলামূলক কর্মকান্ড পরিচালনা এবং ১৯৭৫ সনের ৭ই নভেম্বর প্রতিষ্ঠিত সরকার উৎখাতের জন্য কর্ণেল (অবঃ) আবু তাহেরকে অভিযুক্ত করা হয়। ১৪ উল্লেখ্য যে, ২১ শে জুন ৭৬ কর্ণেল (অবঃ) তাহের-এর বিচার শুরু হয়। ১৭ই জুলাই ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান ইউসুফ হায়দার তাহেরের ফাঁসির আদেশ দেন। ২২. প্রেসিডেন্ট বিচারপতি আবু সাদাত মােহাম্মদ সায়েম তাহেরের মূত্য দন্ডাদেশ রহিত করে ক্ষমা প্রদর্শন করেনি। তাহেরকে অভিযােগপত্র পূর্বে দেয়া হয়নি। তাকে আইনজীবীর সঙ্গে পরামর্শ করতে দেয়া হয়নি। আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য সুযােগও দেয়া হয়নি। তাহের তার বিরুদ্ধে অভিযােগের সত্যতা সম্পর্কে জেনারেল ওসমানী মেঃ জেনারেল জিয়াউর রহমান, এম, জি, তোয়াব, এম, এইচ খানকে সাক্ষ্য হিসেবে ট্রাইব্যুনালে আনার দাবী জানান। তাও গৃহীত হয়নি। ১৫
বিচারপতি থাকাকালীন সময়ে সায়েম পূর্ণচন্দ্র মন্ডলের ফাঁসির আদেশ ছুঁড়ে ফেলেছিলেন এই বলে যে, কোন বন্দীকেই আত্মপক্ষ সমর্থনের প্রয়ােজনীয় সুযােগ না দিয়ে তাকে মৃত্যুদন্ডাদেশ দেয়া যাবেনা। কিন্তু বিচারপতি সায়েম যখন প্রেসিডেন্ট হলেন তখন তার প্রদত্ত রায় উল্টে দিয়ে তাহেরকে ক্ষমা প্রদর্শনের সুযােগ দিতে ব্যর্থ হলেন। ১৬ কেননা, সামরিক শাসনে সায়েম নয়, জিয়াই ছিলেন মূল প্রশাসক। ২৩. উল্লেখ্য যে, কর্ণেল (অবঃ) আবু তাহেরকে গ্রেফতারের কয়েকদিন পর তাকে রাজশাহী কারাগারে নেয়ে যাওয়া হয়। ২২ শে মে রাজশাহী হতে তাকে পুনরায় ঢাকা আনা হয়। ১৫ ই জুন ১৯৭৬ সনে বিচারের জন্য বিশেষ সামরিক আদালত গঠন করা হয়। পাকিস্তান প্রত্যাগত সামরিক অফিসার কর্ণেল ইউসুফ হায়দার চেয়ারম্যান ও প্রসিকিউটর হিসেবে এটি এম, আফজাল দায়িত্ব পালন করেন। তাহেরের ফাসির পর বিচারপতি হিসেবে পুরস্কৃত হয়ে এ,টি,এম, আফজাল বলেছেন যে, আমি তাহেরের মৃত্যুদন্ডের খবর শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেছি। তিনি দাবী করেছেন, প্রসিকিউটার হিসেবে তিনি তাহেরের মৃত্যুদন্ড দাবী করেননি।১৭ প্রকৃত প্রস্তাবে ‘লিগ্যাসী অফ ব্লাড’ বইতে এন্থনী মাসকারানহেস যথার্থই বলেছেন,
তাহেরের মৃত্যু একটি হুকুমের হত্যা। হুকুমদাতা মেজর জেনারেল জিয়া।১৮ ২৪. খালেদ মােশাররফকে দিয়ে রশীদ-ফারুককে হটিয়ে, মােশতাককে তাড়িয়ে, ওসমানী -খলিলকে সরিয়ে এবং খালেদকে হত্যা করে, সর্বোপরি কর্ণেল (অবঃ) আবু তাহেরকে ফাসি দিয়ে জিয়াউর রহমান তার ক্ষমতার সিঁড়িতে ওঠার কাটা দূর করেছেন নির্ভুল ব্লু-প্রিন্টে। এক্ষেত্রে তিনি অনন্য ও অসাধারণ।।
Reference: জেনারেল জিয়ার রাজত্ব – অধ্যাপক আবু সাঈদ
Reference list for this chapter

চতুর্থ অধ্যায়
দরখাস্তের রাজনীতিঃ চক্রান্ত
১। পাকিস্তান সেনা কাঠামাের আওতায় প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত জিয়াউর রহমান পাকিস্তানী ধ্যান-ধারণা ও আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন। পাকিস্তানী রাজনীতির প্রাসাদ চক্রান্তে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইস্কান্দার মীর্জা ১৯৫৮ সনের ৭ই অক্টোবর সামরিক আইন জারি করেন, জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ ভেংগে দেন। রাজনৈতিক দল বিলুপ্ত এবং ১৯৫৬ সনে রচিত শাসনতন্ত্রের মৃত্যু বলে ঘােষণা করেন। একই সাথে পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান জেনারেল মােহাম্মদ আইয়ুব খানকে প্রধান সামরিক প্রশাসক হিসেবে নিযুক্ত করেন। প্রধান সেনাপতি জেনারেল আইয়ুব খান ২৭শে অক্টোবর অস্ত্রের মুখে জেনারেল ইস্কান্দার মীর্জার নিকট হতে পাকিস্তানের পেসিডেন্ট পদটি গ্রহণ করে একাধারে পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান, প্রধান সামরিক প্রশাসক এবং প্রেসিডেন্ট হয়ে বসেন। বলাবাহুল্য জেনারেল আইয়ুবের এ ধরনের অগণতান্ত্রিক কর্মকান্ড পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর প্রতিটি অফিসার ও সেনা সদস্যদ্বারা ব্যাপক ভাবে সমর্থিত হয়েছিল। ‘নিজের রাষ্ট্র দখলের’ আনন্দে পাকিস্তানী অফিসার ও সেনা সদস্যগণ প্রকাশ্যতঃ গর্ববােধে উল্লাসিত হয়ে উঠেছিলাে।জেনারেল আইয়ুবের এই ধারা ও পরবর্তী পদক্ষেপের মাধ্যমে এক দশকের বেশীকাল ধরে তিনি ক্ষমতা দখল করে রেখেছিলেন।
২। জেনারেল আইয়ুবের এই পদক্ষেপগুলাে সামরিক বাহিনীর একজন অফিসার হিসেবে তদানীন্তন ক্যাপ্টেন জিয়ার মনে স্বাভাবিকভাবেই গভীর রেখাপাত করে থাকবে। জেনারেল আইয়ুব খান সামরিক শাসনের পূর্ণ ক্ষমতা গ্রহণের পর তার বিশেষভাবে প্রয়ােজন হয়ে পড়ে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের ঘটনা প্রবাহের নিখুঁত তথ্য প্রাপ্তির। জেনারেল আইয়ুবের একথাও অজানা ছিলনা যে তার কাঙ্খিত শাসন ক্ষমতার প্রতিবন্ধকতা আসবে পূর্ব পাকিস্তান থেকে। সেজন্য পূর্ব পাকিস্তানে উপর তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখা অত্যন্ত জরুরী ছিলাে। তিনি পূর্ব পাকিস্তানের বেসরকারী প্রশাসনের উচ্চপদসমূহে যেমন পরিবর্তন সাধন করেন, তেমনি গােয়েন্দা সংস্থাগুলিতে বিশ্বস্ত লােক নিয়ােগের কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। বাঙালী সেনা অফিসারদের মধ্যে জিয়াউর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের গােয়েন্দাবাহিনীতে নিয়ােগ প্রাপ্ত হন। এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্রান্তিলগ্নে জিয়াউর রহমানকে পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক গােয়েন্দা বিভাগে পাঠান যখন সামরিক শাসনের উচ্ছাস কেটে গেছে। মওলানা ভাসানী, আবুল মনসুর আহমদ, শেখ মুজিবুর রহমান, আবদুল খালেক, হামিদুল হক চৌধুরী প্রমুখ কে গ্রেফতার করা হয়েছে। গ্রেফতার করা হয়েছে হাজার হাজার রাজনৈতিক নেতা কর্মীদের। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ যাতে জেনারেল আইয়ুবকে ভবিষ্যতে চ্যালেঞ্জ করতে না পারেন তার জন্য ‘পােরাে’ জারী করে। পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতাদের যখন রাজনৈতিকভাবে ‘জবাই’ করার ব্যবস্থা জারী হয়েছে, যখন ছাত্র আন্দোলনে নতুন কৌশলে ও মাত্রায় ধূমায়িত হচ্ছে সেই মুহূর্ত পূর্ব পাকিস্তানের উপর দৃষ্টি রাখার জন্য জেনারেল আইয়ুবের প্রশাসনে বিশ্বস্ত লােক প্রয়ােজন ছিলাে। সেই প্রয়ােজনের তালিকায় জিয়াউর রহমান ছিলেন একজন খাটি বিশ্বস্ত এবং অনুগত ব্যক্তিত্ব। জিয়াউর রহমান জেনারেল আইয়ুব খানের ‘নেক নজরে’ ছিলেন। এ কারণে আইয়ুব খান তাকে পূর্ব পাকিস্তান সামরিক গােয়েন্দা বিভাগের প্রধান হিসেবে নিযুক্ত করেন।১
৩। সামরিক শাসনের আওতায় গােয়েন্দাগিরি করতে এসে সেদিনের তরুণ সামরিক অফিসার হিসেবে জিয়াউর রহমান যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেন তা তাকে পরবর্তীকালে ক্ষমতা দখল ও সামরিক শাসন পরিচালনায় যথেষ্ট সাহায্য করেছিল। সন্দেহ নেই।
৪। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয় ১৯৭৫ সনের ১৫ই আগস্ট। জেনারেল সফিউল্লাহকে হটিয়ে জিয়াউর রহমান প্রধান সেনাপতির পদ দখল করেন। ১৯৭৫ সনের ৩০শে আগষ্ট সামরিক ক্ষমতার বলে রাজনীতি ও রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ ঘােষিত হয়।
৫। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যার ৫০ দিন পর ৩রা অক্টোবর ‘৭৫ লায়লাতুল কদরের পরম পবিত্র রাতে স্বঘােষিত প্রেসিডেন্ট খুনী খন্দকার মােশতাক : আহমদ জাতির উদ্দেশ্যে রেডিও টেলিভিশনে ভাষণ প্রদান করেন। ভাষণে ১৯৭৬ সনের ১৫ই আগস্ট থেকে রাজনৈতিক তৎপরতা ও কাজকর্মের উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার এবং ১৯৭৭ সনের ২৮শে ফেব্রুয়ারী জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান করার কথা ঘােষণা করে।২
৬। ৩রা নভেম্বর খালেদ মােশাররফ সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করেন।
এবং তদানীন্তন প্রধান বিচারপতি আবু সাদাত মােহাম্মদ সায়েমকে রাষ্ট্রপতি পদে আসীন করেন। খন্দকার মােশতাক সামরিক ফরমান বলে প্রেসিডেন্ট পদটি ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। ১৯৭৫ সনের ৬ই নভেম্বর প্রেসিডেন্ট পদে আসীন হয়ে বিচারপতি সায়েম জাতির উদ্দেশে এক ভাষণ দেন। ভাষণে তিনিও জাতির সামনে দ্ব্যার্থহীনভাবে ঘোষণা করেন যে, ১৯৭৭ সনে পূর্বঘােষিত ফেব্রুয়ারী মাসেই জাতীয় সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এমনকি, সম্ভব হলে তার পূর্বেও নির্বাচন সম্পন্ন করার সংকল্প ব্যক্ত করেন। শুধু তাই নয়, ৭ই মার্চে সংঘটিত ঘটনাবলীর পরেও প্রেসিডেন্ট সায়েম পুনরায় জাতির উদ্দেশে এক ভাষণে নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা দৃঢ়তার সঙ্গেই ঘােষণা করেন। ১৯৭৫ সনের স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবসে জাতির উদ্দেশে প্রদত্ত অপর এক ভাষণে প্রেসিডেন্ট সায়েম জোর দিয়ে বলেন “বর্তমান সরকার অন্তবর্তীকালীন, অরাজনৈতিক এবং সম্পূর্ণ দল নিরপেক্ষ সরকার। সরকারের লক্ষ্য নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা”।
৭. ১৯৭৬ সনের ২৮ শে জুলাই প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক রাজনৈতিক দলবিধি জারী করেন। রাজনৈতিক দলবিধি জারী করার পূর্বেই ২৭শে জুলাই রাষ্ট্রপতি ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক বিচারপতি আবু সাদাত মােহাম্মদ সায়েম ১৫ই আগস্টের মধ্যে রাজনৈতিক তৎপরতা শুরু করার ঘােষণা দেন এবং পূর্ব ঘােষিত ১৯৭৭ সনের ফেব্রুয়ারী মাসের মধ্যে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা পুনরায় জোর দিয়ে বলেন। একই সাথে রাষ্ট্রপতি বলেন, সংসদীয় পদ্ধতিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। রাষ্ট্রপতি সায়েম বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ৩৮ জন নেতার ও উপ প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক মেজর জেনারেল জিয়ার উপস্থিতিতে একথা বলেন।৩
৮। সরকারী সংবাদ সংস্থা বাসস পরিবেশিত খবরে বলা হয়, উপস্থিত নেতৃবৃন্দ নির্বাচনের প্রস্তুতি, রাজনৈতিক তৎপরতা এবং নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্পর্কে নিজ নিজ অভিমত ব্যক্ত করেন, তা থেকে সর্বসম্মত কিছু মত বেরিয়ে এসেছে যা সুষ্ঠু রাজনৈতিক আবহাওয়া ও নির্বাচনের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির সহায়ক হবে বলে মনে করা হয়। এই সভায় নির্বাচনের মাধ্যমে অতিসত্ত্বর গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ফিরিয়ে আনার পক্ষে অভিমত ব্যক্ত করা হয়। সরকারও নিজেদের নিরপেক্ষ ও অন্তবর্তীকালীন সরকার বলে যে ঘােষণা করেছে এবং সে ঘােষণার মর্যাদা রক্ষার প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেন।৪
৯। ২৮শে জুলাই সরকারী বিজ্ঞপ্তিতে একটি ঘােষণা প্রচার করা হয় যে, রাজনৈতিক দল সমূহের গঠনতন্ত্র, তালিকা, ঘােষণা পত্র এবং কর্মসূচী সরকারের নিকট পেশ করার উদ্দেশ্যে আগামী ৩০শে জুলাই হতে ১লা সেপ্টেম্বর পর্যন্ত রাজনৈতিক দলগুলির কার্যক্রম ঘরােয়া রাজনৈতিক তৎপরাতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে। এই সরকারী বিধি ১৯৭৬ এর চতুর্দশ অনুচ্ছেদের (১) উপ অনুচ্ছেদে বর্ণিত ক্ষমতা বলে সরকার এই বিজ্ঞপ্তি জারী করেছেন।
১০. লক্ষ্য করা গেল, কড়া সামরিক শাসনের মধ্যে প্রেস সেন্সরশীপ আছে সত্বেও সরকারী প্রশ্রয়ে স্বাধীনতা বিরােধী গােষ্ঠী ঘরােয়া রাজনীতির নামে দেশের সংবিধানের মৌলনীতির বিরুদ্ধে কথা বলা শুরু করে দিয়েছে। এমনকি, প্রেস কনফারেন্স ডেকে সংবিধানের মূলনীতির বিরুদ্ধে প্রদত্ত বক্তব্য অদৃশ্য রহস্যজনক কারণে কিছু কিছু সংবাদপত্রে ছাপা হওয়া শুরু হয়েছে। কিছু কিছু রাজনৈতিক দলের বক্তব্য ও লক্ষ্য সংবিধানে উল্লেখিত গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও ধর্ম নিরপেক্ষতার আদর্শের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।৫
১১. এক সময় ছাত্রদের মধ্যে রাজনৈতিক আদর্শের ধারায় ছাত্রসংগঠন গড়ে তুলে দলীয় শক্তি বৃদ্ধির প্রাথমিক রিক্রুটমেন্ট হিসেবে ছাত্র সংগঠনকে বিবেচনা করা হতাে। ১৯৭৬ সালে সামরিক ফরমান বলে জিয়াউর রহমান ‘পলিটিক্যাল পার্টি রেগুলেশনস’ (পি পি আর) এর মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলােকে তাদের অংগ সংগঠনের নাম দলের সঙ্গে তালিকাভূক্ত করার নির্দেশ জারী করে। এর পূর্ব পর্যন্ত রাজনৈতিক দল সরাসরিভাবে অঙ্গ-সংগঠগুলােকে নিয়ন্ত্রণ করতাে না। জিয়ার আমলে পি,পি,আর-এর মাধ্যমে অঙ্গ-সংগঠনগুলােকে যুক্ত করার ফলে ছাত্র সংগঠনের সাংগঠনিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দায়-দায়িত্ব মূল দলের উপরে এস পরে। ছাত্রদের প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে টেনে আনা হয় এবং তাদের নিয়ন্ত্রণ ও ক্ষমতা দখলের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
১২. প্রথম থেকে লক্ষ্য করা গেছে যে, প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক বিচারপতি সায়েমের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে উপ-প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক, সেনা প্রধান মেজর জেনারেল জিয়া যেন সমান্তরালভাবে রাষ্ট্র পরিচালনা করছেন। অর্থ, তথ্য, শিক্ষা, বাণিজ্য এবং সামরিক শক্তির বদৌলতে জনগণ উপলদ্ধি করতে সক্ষম হলাে শাসনতান্ত্রিকভাবে প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক প্রশাসক যতই ক্ষমতাবান ব্যক্তি হন না কেন, মূল শক্তি জিয়াউর রহমান ও তার সেনাবাহিনী। তিনি ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু। বিচারপতি সায়েম তার হাতের পুতুল মাত্র। কর্ণেল তাহেরের ফাঁসির মাধ্যমে জিয়া তার ক্ষমতা জনগণের নিকট উলঙ্গভাবে প্রদর্শন করতে পেরেছে বিচারপতি সায়েম যথার্থ অর্থেই অন্তবর্তী কালীন সরকারের ভূমিকায় পার্লামেন্ট পদ্ধতির প্রতিশ্রুত নির্বাচন দেওয়ার জন্য যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণে কার্পণ্য করেননি। ১৯৭৫ সনের ২২শে নভেম্বর রাজনীতিক প্রক্রিয়া শুরু করার লক্ষে বিচারপতি আব্দুস সাত্তারকে প্রেসিডেন্টের বিশেষ সহকারী নিযুক্ত করেন যাতে রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে যােগাযোগ ও পরামর্শ করে নির্ধারিত সময়ে জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের বিষয়টি বাস্তবায়ন করতে পারেন।
১৩। ২৫ ও ২৬ নভেম্বর ‘৭৫ এ উদ্দেশ্যে প্রেসিডেন্ট ও তার সহকারীর সঙ্গে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সংলাপ শুরু হয়। এর পাশাপাশি ২৪শে নভেম্বর রাত ১২টায় আকস্মিকভাবে মেজর জেনারেল জিয়া যে ভাষণ দেন তার সঙ্গে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার কোন সামঞ্জস্য খুঁজে পাওয়া যায় না। যে সময় প্রয়ােজন রাজনৈতিক সমঝােতা ও ঐক্য – যা প্রেসিডেন্ট উদ্যোগ নিয়েছিলেন, সে সময় জিয়াউর রহমান আইয়ুব খানের মত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও দলকে দোষারােপ করে চরম ভাষায় কথা বলেন। [পরিশিষ্ট-৩]
১৪. ঘরােয়া রাজনীতির সুবাদে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কার্যক্রম পর্যালােচনা করলে স্পষ্ট প্রতীয়মান যে, দেশের প্রায় সকল রাজনৈতিক দল সরকারী নির্দেশের আওতায় একটি সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অগ্রসর হচ্ছিল। রাজনৈতিক দলবিধি অনুযায়ী পুরাে আগস্ট মাস রাজনৈতিক তৎপরতা সীমিত থাকবে ঘরােয়া বৈঠকে। রাজপথে ময়দানে জনসভা, সভা সমাবেশ নিষিদ্ধ। ইতিমধ্যেই বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, দলের গঠনতন্ত্র, মেনিফেষ্টো দলিল দস্তাবেজ সহ দলগঠনের প্রক্রিয়া অগ্রসর হয়েছে। সামরিক সরকার রাজনৈতিক দলবিধির আওতায় যে সব দলের অনুমতি দেবেন তারা সেপ্টেম্বর হতে পুরােদস্তর রাজনৈতিক দল হিসেবে রাজনৈতিক কর্মকান্ড পালন করতে এবং নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করতে পারবে। রাজনৈতিক দল বিধিতে বহু কড়াকড়ি শর্ত ছিল। বিদেশী অনুপ্রেরণায় বা অর্থে কেউ দল গঠন করতে পারবে না। দলের নেতা দেশের নিরাপত্তা বা জনশৃংখলার পক্ষে ক্ষতিকর কোন কাজ করতে পারবে না। দলের অর্থ তহবিল আয় ব্যয়ের উৎস প্রকাশ করতে হবে। কোন গােপন সংগঠন বা সশস্ত্র স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠন বা রাখা যাবেনা। এক দল আরেক দলের বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা করতে পারবে না। সরকারী অনুমতি পাওয়ার পর কোন দল এ-ব্যাপারে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করলে বা বিধি লংঘন করলে সরকার সে দলকে নিষিদ্ধ করতে পারবে।(পরিশিষ্ট-৪)
১৫. রাজনৈতিক দলবিধির শর্তাবলী কড়াকড়ি ছিলাে। ছিলাে অঘােষিত ধমক। যদিও বলা হয়েছিলাে সুষ্ঠু রাজনৈতিক প্রক্রিয়া চালু করার জন্যেই এই দলবিধি। রাজনৈতিক দল বিধিতে রাজনৈতিক দলের সংজ্ঞায় যে কথা বলা হয়েছিলাে তা ছিলাে অস্পষ্ট ও অনির্দিষ্ট। সামরিকশাসন জারীর থাকার প্রেক্ষিতে কতিপয় ধারা স্থগিত থাকলেও দেশের সংবিধানের মৌলনীতি নিয়ে স্বাধীনতার চেতনা ও মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবােধ নিয়ে তখন পর্যন্ত কোন বির্তক ছিলােনা। জাতীয়তা, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং সমাজতন্ত্র সংবিধানের এই চার মৌলনীতি তখন পর্যন্ত সংবধানে সন্নিবেশিত ছিলাে। তখন পর্যন্ত সংবিধান হতে ধর্মনিরপেক্ষতার ধারা বিলুপ্ত করা হয়নি।
১৬. এমন অবস্থায় রাজনৈতিক দলবিধি জারীর মাধ্যমে সংবিধান বর্ণিত ৪ মূলনীতি এবং রাষ্ট্র পরিচালনার নীতিমালার মধ্যেই দলগঠনের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত ছিলাে। কিন্তু লক্ষ্যণীয় এই যে, রাজনৈতিক দল গঠনকে সামনে রেখে কোন নেতা নতুন দল বা পুরনাে দলের পুনরুজ্জীবনের ক্ষেত্রে দলের আদর্শ ও উদ্দেশ্য কর্মসূচীর আকারে এমন কিছু কিছু বক্তব্য বাজারে প্রচার করেছে যা দেশের সংবিধানের মূলনীতির পরিপন্থী। সংবিধানের মূলনীতিগুলিতে স্বাধীন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আশা আকাঙ্খার প্রতীকরূপে অলংঘনীয়তার দাবীদার। সংবিধান সংশােধনের ফলে সাবেক দলগুলির পুনরুজ্জীবন সম্ভব হলেও সংবিধানে বর্ণিত জাতীয় আদর্শ পরিপন্থী কোন দল গঠন করা যায়না। রাজনৈতিক দলগুলির লক্ষ্য ও ঘােষণাপত্র, কর্মসূচীকে রাজনৈতিক দলবিধির সাথে সাথে সংবিধানে উল্লেখিত গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও ধর্ম নিরপেক্ষতার আদর্শের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হতে হবে। কিন্তু রাজনৈতিক দল বিধিতে এ বিষয়ে স্পষ্ট কোন বিধান না থাকায় স্বাধীনতা বিরােধী জামাত মুসলিম লীগ নেজামে ইসলামী ইত্যাদি দলকে মাঠে নামানাের ব্যবস্থা করা হয়েছে। যার ফলে এই সব স্বাধীনতা বিরােধী ব্যক্তিবর্গ প্রকাশ্যই যে ধরনের বক্তৃতা দিয়ে যাচ্ছে, তা সংবিধানের লংঘন।
১৭. ১০ই আগষ্ট ‘৭৬ বিকেলে পাকিস্তানী দালাল ও স্বাধীনতার বিরােধী চক্রের অন্যতম হােতা শফিকুর রহমানের বাসায় সাবেক নেজামে ইসলামী, সাবেক জামাতে ইসলামী, সাবেক পিডিপি ও সাবেক খেলাফতে রব্বানী পার্টির এক যৌথ ঘরােয়া বৈঠকে পাকিস্তানী দালাল মওলানা সিদ্দিক আহমেদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয়। সভায় ‘ইসলামী আদর্শের’ ভিত্তিতে দল গঠনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সভায় স্বাধীনতা বিরােধী সৈয়দ আজিজুল হক নান্না মিয়া ও জামাতের মওলানা আবদুর রহিমকে যুগ্ম আহবায়ক করে কমিটি গঠিত হয়। স্বাধীনতা বিরােধী শান্তি কমিটির নেতা সাদ আহমদকে আহবায়ক করে গঠনতন্ত্র ও মেনিফেস্টো কমিটি গঠন করা হয়। এর পাশাপশি আইয়ুব মােনায়েমের দালাল রসরাজ মন্ডলও তফশিলী জাতীয় ফেডারেশন পুনরুজ্জীবিত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এইভাবে রাজনৈতিক দলবিধি জরীর মাধ্যমে দেশে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি ও রাজনৈতিক দল গঠনের পথ উন্মুক্ত করে দেয়া হলাে।

আওয়ামী লীগঃ চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রের আবর্তে
১৮. জিয়াউর রহমান ও খুনী চক্রের নিকট স্বাধীনতার পক্ষের মূল দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ছিল ক্ষমতা নিরঙ্কুশ করার ক্ষেত্রে মূর্তিমান থ্রেট। জিয়াউর রহমান ও তার ‘অদৃশ্য চক্র’ আওয়ামী লীগকে ভেঙ্গে ফেলার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। আওয়ামী লীগ ভেঙ্গে ফেলার পূর্বে ১৯৭৮ সনের ৩রা জুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা গণতান্ত্রিক ঐক্য জোট ভেংগে যায়। ১৯শে জুন বায়তুল মােকাররমে এক জনসভায় গজ দলের অন্তর্ভুক্ত ন্যাপ (মােজাফফর)-এর সভাপতি অধ্যাপক মােজাফফর আহমদ বলেন, “দেশের গরীব মানুষ কেউ নৌকায় ভােট দেয়নি, তারা ভােট দিয়েছে প্রেসিডেন্ট জিয়ার ১৯ দফা সমর্থন করে”। তিনি বলেন, “প্রেসিডেন্ট তার এই কর্মসূচী বাস্তবায়নের উদ্যোগ করলে তিনি তার জীবনের বিনিময়েও সহযোগীতা করবেন।” ২১শে জুন পঙ্কজ ভট্টচার্য এবং মতিয়া চৌধুরী এক বিবৃতি দিয়ে বলেন, “ওই বক্তৃতা মােজাফফর আহমদের নিজস্ব, ন্যাপের নয়।”-এর পূর্বেই ন্যাপের ভাঙন শুরু হয়েছিল। সৈয়দ আলতাফ আর সুরঞ্জিত সেন সহ ৬ জনের প্রাথমিক সদস্যপদও বাতিল করা হয়। ন্যাপ অনিবার্য ভাঙনের দিকে এগিয়ে যায়। শুরু হয় আওয়ামী লীগ নিয়ে চক্রান্ত।
১৯. ‘৭৫ সনের ১৫ই আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়। জাতীয় দল-বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ বাতিল ঘােষিত হয়। সামরিক শাসন জারী হয়। সমস্ত রাজনৈতিক কর্মকান্ড নিষিদ্ধ। ১৯৭৬ সালের ২৮শে জুলাই সামরিক ফরমানের আওতায় সীমাবদ্ধভাবে রাজনৈতিক তৎপরতা পরিচালনার লক্ষে রাজনৈতিক দলগুলিকে রাজনৈতিক দল বিধির আওতায় অনুমতি দেবার কথা ঘােষণা করা হয়। রাজনৈতিক ‘দলবিধি’র আওতায় আওয়ামী লীগ অনুমােদন লাভ করে এবং সংগঠনকে ঘরােয়া পরিবেশের মধ্যেও গতিশীল করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। কিন্তু ১৯৭৭ সনের ফেব্রুয়ারী মাসে অনুষ্ঠিতব্য পার্লামেন্ট নির্বাচন ১৯৭৬ সনের ২১ নভেম্বর অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘােষণা করলে সামরিক শাসকগােষ্ঠী গণআন্দোলনের ভয়ে জনাব আবদুল মালেক উকিল, বেগম সাজেদা চৌধুরী, আবদুল মমিন তালুকদার, সালাহউদ্দিন ইউসুফসহ আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের ব্যাপকভাবে গ্রেফতার করে। কেননা আওয়ামী লীগ ছিলাে এমন একটি পার্টি, তৃর্ণমূল পর্যন্ত যার সংগঠন ছিল বিস্তৃত এবং যার ছিল লক্ষ লক্ষ ত্যাগী কর্মী। পার্লামেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে দাঁড়ানাের শক্তি তখন পর্যন্ত কোনাে দলের ছিলাে না। উগ্রচীন, উগ্রডান, স্বাধীনতা বিরােধী দল ও চক্র আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় আসার চাইতে নির্বাচন স্থগিতকে শ্রেয় মনে করে। এ পয়েন্টে জিয়াউর রহমান ও তাদের লক্ষ্য ছিল এক ও অভিন্ন। আওয়ামী লীগের অগ্রযাত্রাকে রুদ্ধ করতে হবে। সেজন্য ষড়যন্ত্র শুরু হয়।
২০। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করে ঘাতক দল বসে ছিলােনা। আওয়ামী লীগকে নেতৃত্ব শূন্য করার ব্লুপ্রিন্ট অনুসারে চার জাতীয় নেতা সর্বজনাব সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমদ, এম মনসুর আলী ও এ.এইচ, এম কামারুজ্জামানকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের অভ্যন্তরে হত্যা করা হয়।

২১. শুরু হয় অত্যাচার। নিপীড়ণ। নির্যাতন। গ্রাম বাংলার তৃর্ণমূল পর্যায় হতে শুরু করে সংগঠনের কেন্দ্রীয় পর্যায় পর্যন্ত আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের নির্বিচারে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠিয়ে দেয়া হয়। ৬২ হাজার নেতা-কর্মীকে ৭৫-৭৬ সনের মধ্যেই গ্রেফতার করা হয়। দৈহিক অত্যাচারে অনেককে হত্যা করা হয়। গুম করা হয় লাশ। জিয়াউর রহমানের নির্দেশিত লেলিয়ে দেয়া সাদা পােষাকধারী গােয়েন্দা বাহিনী অনেক নেতা-কর্মীকে এত নিষ্ঠুর ও নির্মমভাবে দৈহিক অত্যাচার চালায় যার ফলে অনেক নেতা-কর্মী পঙ্গু হয়ে পরেন। অনেকে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। হিটলারের গােপন বাহিনীর মতাে এদের অত্যাচারের পন্থাও ছিল ভিন্ন ও নিষ্ঠুরতায় পূর্ণ। সামরিক শাসনের নিগড়ে শৃঙ্খলিত বাংলাদেশ। মৌলিক অধিকার নেই। বিচার নেই। শাসনতন্ত্র স্থগিত। মুখ বন্ধ। টু শব্দটি করার উপায় নেই। সামরিক শাসকগােষ্ঠীর এই নির্মম নিষ্ঠুর অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা যাবে না। সামরিক ফরমানে ঘােষণা করা হয়েছে কথাবার্তা, আকার ইংগিত, চিহ্ন দ্বারা সামরিক শাসক গােষ্ঠীর বিরুদ্ধে কিছু করলে বা বললে তার শাস্তি ৫ বছর কারাদন্ড হতে মৃত্যুদন্ড পর্যন্ত। জাতির জনক টুঙ্গিপাড়ার কবরে, সেখানে চব্বিশ ঘন্টা সশস্ত্র পাহারা। কেউ গেলে ধমকে তাড়িয়ে দেয়া হয়। না মানলে গ্রেফতার করে। মােনাজাত করতে গিয়ে গ্রেফতার হন হাজী গােলাম মােরশেদ। বঙ্গবন্ধুর কবরে এই পাহারা ১৯৮০ সন পর্যন্ত বলবৎ ছিল।৯ ঢাকার ৩২নং বাড়ি ছিলাে তালাবদ্ধ। বাড়ির সামনে যেতে দেয়া হত না। বাড়ির সামনে দাঁড়ালে ধমক খেতে হতাে। কি নির্মম নিষ্ঠুর জিয়াউর রহমানের সামরিক শাসন!
২২. বিরাজমান এমনি ভয়াবহ অবস্থায় মুজিব অনুসারীদের বিভক্ত ও দুর্বল করার চক্রান্ত চলে। প্রাসাদ চক্রান্তের কুটিল খেলা আওয়ামী লীগ নেতৃত্বে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে।
১৯৭৬ সালের ২৮শে জুলাই। গণতন্ত্র, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ও গণতান্ত্রিক পরিবেশ রচনার কথা বলে সরকার সামরিক ঘােষণায় রাজনৈতিক দলবিধি জারী করলেন। বললেন, যারা বাংলাদেশে রাজনীতি করতে চায়, নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চায়, দল গঠন করতে চায় তাদের রাজনৈতিক দলবিধির আওতায় দল গঠনের অনুমতি চেয়ে দরখাস্ত জমা দিতে হবে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব নিহত। নিহত জেলখানায় চার জাতীয় নেতা। ১৯৭৫ সনের ২৫শে জানুয়ারী জাতীয় দল-বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ গঠনের পর আওয়ামী লীগের অস্তিত্ব আর ছিলাে না। আবদুস সামাদ আজাদ জিল্লুর রহমান, আব্দুর রাজ্জাক, তােফায়েল আহমদ, আমির হােসেন আমুসহ আওয়ামী লীগের শীর্ষ স্থানীয় নেতৃবৃন্দ কারাগারে। এই অবস্থায় প্রশ্ন দেখা দিলাে পিপিআর-এর অধীনে আওয়ামী লীগ দল গঠন করবে কিনা? আগস্টে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বেদনাদায়ক ঘটনাবলীকে সামনে রেখে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ গােপন বৈঠকে বসলেন। ১৯৭৩ সনে গঠিত আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির মধ্যে মাত্র ৮ জন বর্তমান। এমতাবস্থায় মহিউদ্দিন আহমদ, আসাদুজ্জামান খান, জহুরুল কাইয়ুম, আবদুল মান্নান, সালাউদ্দিন ইউসুফ, বেগম সাজেদা চৌধুরী, আবদুল মমিন তালুকদার, অধ্যাপক ইউসুফ আলী, সােহরাব হােসনে, কামরুজ্জামান ফনীভূষণ মুজমদার, লুৎফর রহমান, অধ্যাপক নূরুল ইসলাম, সৈয়দ ফজলুল হক বিএসসি, মােঃ হানিফ, সিরাজুল ইসলাম, ফজলুল হক ভূঁইয়া প্রমুখ বৈঠকে উপস্থিত হলেন। সিদ্ধান্ত গৃহীত হলাে দল গঠন করা হবে। কেননা বঙ্গবন্ধুর বিশাল কর্মী বাহিনীকে সাংগঠনিক কাঠামােয় ধরে রাখতে হবে।
২৩. ১৯৭৩ সনের বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির গঠনতন্ত্রের ক্রম অনুসারে সিনিয়র সহ-সভাপতি জনাব মহিউদ্দিন আহমদ ভারপ্রাপ্ত সভাপতি এবং বেগম সাজেদা চৌধুরীর উপর ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদিকার দায়িত্ব অর্পিত হলাে। বেগম সাজেদা চৌধুরী তখন হাসপাতালে অসুস্থ। তার মধ্যেও তাকে দায়িত্ব নিতে হল গঠনতন্ত্র মােতাবেক ও নেতৃবৃন্দের অনুরােধে। এবং সর্বোপরি দলের ধারাবাহিকতায় দল গঠনের প্রক্রিয়া এগিয়ে নিতে।

২৪. কাজী জহিরুল কাইয়ুমের বাসায় প্রায় বৈঠক হতাে। আওয়ামী লীগ বৈঠকের জন্য জায়গা পাওয়াও ছিলাে দুষ্কর। ভয়ে কেউ মুখ খুলতে না। জায়গা পাওয়া তাে দূরের কথা। আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের পেছনে ছায়ার মত গােয়েন্দা বাহিনীর লােক লেগে থাকতাে। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ কার্যনির্বাহী কমিটির ২৬শে আগস্ট ৭৬ আনুষ্ঠানিক সভায় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তার পরিবারবর্গ ও চার নেতার আত্মার মাগফেরাত কামনা করে সভার শুরু হয়। সভায় প্রথমেই সাধারণ সম্পাদিকা বেগম সাজেদা চৌধুরীর প্রস্তাবে খন্দকার মােশতাক আহমদ, তাহের উদ্দিন ঠাকুর, শাহ মােয়াজ্জেম হােসেন ও ওবায়দুর রহমানকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। দলের একটি অংশ আইনগত প্রশ্ন তুলে বহিষ্কারাদেশ না দিয়ে প্রাথমিকভাবে ‘শােকজ’ করার দাবী জানান। কিন্তু তা নাকচ হয়ে যায়।

২৫. পরবর্তী মিটিংগুলােয় ঠিক হয় পিপিআর-এর অধীনে দলের গঠনতন্ত্র ও ঘােষণাপত্র জমা দিয়ে দল গঠনের অনুমতি নিতে হবে। সিদ্ধান্ত হয় ৪ মূলনীতি অক্ষুন্ন থাকবে। মুখবন্ধে ‘বঙ্গবন্ধু’ কথাটি সন্নিবেশিত হবে।
২৬. ৯ই অক্টোবর ৭৬ সনে চার মূলনীতি বাঙালী জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র এই রাষ্ট্ৰীয় চার মূলনীতি যা ছিল স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের দর্শন তার আলােকেই ঘােষণাপত্র এবং ঘােষণাপত্রের নিরিখে গঠন ঠিকঠাক করে জমা দেয়া হয়। ঘােষণা পত্রের মুখবন্ধে ‘বঙ্গবন্ধ’-এর নাম উল্লেখ করা হলাে। এরই মধ্যে সামরিক ফরমানে বলা হলাে কোন জীবিত বা মৃত ব্যক্তির নাম উল্লেখ করে দল গঠন করা যাবে না। (পরিশিষ্ট-৫)।
২৭. কয়েক দিন পরেই আইন, বিচার ও সংসদ মন্ত্রণালয় হতে চিঠি এলাে “The very word ‘Banghbandhu’ should be omited.” ১৮ই অক্টোবর ৭৬ বেগম সাজেদা চৌধুরী এই পত্র হাতে পেলেন। আইন ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের এই ‘না-সূচক’ চিঠিতে বলা হয়েছে, আওয়ামী লীগের দাখিলকৃত দলিলপত্রের বক্তব্য ১৯৭৬ সালের রাজনৈতিক দলবিধির (১০)নং ধারার সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ। (পরিশিষ্ট-৪)।
২৮. দলে সংকট সৃষ্টি হলাে। ইতমধ্যে প্রায় এক ডজন দল অনুমতি নিয়ে নিয়েছে। মিজানুর রহমান চৌধুরীর নেতৃত্বে দলের একাংশ বললেন, নামে কী আসে যায়। বঙ্গবন্ধু তাে আমাদের হৃদয়ে আছেন। মহিউদ্দিন-সাজেদা চৌধুরী গ্রুপ বললেনঃ বঙ্গবন্ধু ব্যতীত দলের অনুমতি নেয়ার প্রয়ােজন নেই। শুরু হলাে দ্বন্দ্ব।
২৯. জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শিক্ষাবিদ আবুল ফজলকে জাতীয় অধ্যাপক এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিযুক্ত করেছিলেন। জিয়াউর রহমানের সঙ্গে শিক্ষা উপদেষ্টা হয়ে তিনি ক্ষমতায় বসেছেন। আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদিকা বেগম সাজেদা চৌধুরীকে সচিবালয়ে ডেকে নিয়ে তিনি বললেনঃ বঙ্গবন্ধু, চার নীতি বাদ দিতে চাও না কেন? বাদ দিয়ে দলের অনুমতি নাও। সাধারণ সম্পাদিকা বেগম সাজেদা চৌধুরী স্পষ্টভাবে মুখের উপর বলে এলেন ঃ আমি বিশ্বাসঘাতক নই। আবুল ফজল বললেন ঃ ঐ জন্যই তাে জিয়া তােমাকে দেখতে পারে না।
৩০।তারপরেও চাপ অব্যাহত থাকে। প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক বিচারপতি আবু সাদাত মােহাম্মদ সায়েম আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদিকা বেগম সাজেদা চৌধুরীকে বঙ্গভবনে ডেকে নিয়ে বললেনঃ তুমি আমার মেয়ের মত। আমি পরামর্শ দিচ্ছি। কেন মাত্র ৪টি অক্ষর ব-ঙ্গ-ব-ন্ধু নিয়ে জেদ ধরছে। নামটি বাদ দিয়ে অনুমতি নাও। সাজেদা চৌধুরী পার্টির পক্ষ হতে বললেনঃ ‘বঙ্গবন্ধু’ ঐ চারটি অক্ষরের মধ্যেই বাংলাদেশ নিহিত।১১
৩১. মিজান চৌধুরীর বাসায় চক্রান্ত দানা বেঁধে উঠল। জোরেশােরে বলা হতে থাকলাে ‘বঙ্গবন্ধু’ শব্দটি বাদ দিয়েই দলের অনুমতি নিতে হবে। মহিউদ্দিন আহমেদ ও সাজেদা চৌধুরী গ্রুপ বললেনঃ এটা হতে পারে না।
৩২। তখন মিটিং করার জায়গা ছিলােনা। ছিলােনা অফিস। খন্দকার হাবিবুর রহমান ৯১, নবাবপরের ৩ তলায় আওয়ামী লীগের অফিসের ব্যবস্থা করে দেন। ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদিকা উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণের লক্ষ্যে ২৫শে অক্টোবর ৯১ নবাবপুরে পার্টির কেন্দ্রীয় অফিসে প্রস্তুতি কমিটির সকল সদস্য, সাবেক আওয়ামী লীগ সাংগঠনিক জেলার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক, বা তাদের অবর্তমানে প্রতিনিধি (কেননা বহু জেলা নেতৃবৃন্দ কারাগারে ছিলেন) গণপরিষদ সদস্য, সাবেক সংসদ-সদস্যদের সমন্বয়ে বর্ধিত সভায় উপস্থিত হওয়ার জন্য অনুরােধ জানান। অন্যদিকে ২৭শে অক্টোবর মিজান চৌধুরী তার ৩২নং ধানমন্ডি রােডের ৬৬০ বি নম্বর বাসভবনে অনুরূপ সভা আহ্বান করেন।
৩৩. এই পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে ২৫শে অক্টোবর বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির এক জরুরী সভা ৯১ নবাবপুরে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি জনাব মহিউদ্দিনের আহমদ-এর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সংগঠনের নীতি আদর্শ লক্ষ্য এবং বঙ্গবন্ধুর নাম সংযুক্তকরণের পক্ষে অভিমত ব্যক্ত করে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এবং মুজিব সৈনিকদের চক্রান্ত রুখে দাঁড়ানাের আহ্বান জানান হয়। এই জরুরী সভার সিদ্ধান্ত মােতাবেক বেগম সাজেদা চৌধুরী একটি বিবৃতি প্রদান করেন— “গত ২৫ আগস্ট সাবেক বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা ও কর্মীদের সম্মেলনে যে সিদ্ধান্ত হয় তার ব্যবস্থাদি সম্পন্ন করার জন্য সাবেক বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যকরী কমিটি জনাব মিজানুর রহমান চৌধুরীকে আহবায়ক করে একটি সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটি গঠন করে। কিছুদিন থেকে আমি অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে লক্ষ্য করে আসছি যে, এই প্রস্তুতি কমিটির দায়িত্বের পরিধির ব্যাপারে বেশ ভুল বুঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছে। বাস্তব অবস্থা হচ্ছে এই প্রস্তুতি কমিটির স্বতন্ত্র অস্তিত্ব নেই। ইহা মূল কেন্দ্রীয় কার্যকরী কমিটির অধীনে একটি অস্থায়ী উপপরিষদ। কোন সাংগঠনিক সভা আহবান এবং তৎপরতা এই উপ-পরিষদের আওতায় বাইরে।”১৩
ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদিকা বেগম সাজেদা চৌধুরীর এই বিবৃতির পর অন্যান্য নেতৃবৃন্দের হস্তক্ষেপে বহু দেন দরবারের পর দু’টি সভাই বাতিল ঘােষিত হয়। ২৯শে অক্টোবর মিজানুর রহমান চৌধুরীর বাসভবনে এক বৈঠকে স্থির হয় যে, ৩১শে অক্টোবর সকাল ১০ ঘটিকায় মতিঝিলের হােটেল ইডেনে সাবেক আওয়ামী লীগের প্রাক্তন গণপরিষদ ও সংসদ সদস্য, সাংগঠনিক জেলার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকদের বর্ধিত সভা অনুষ্ঠিত হবে। কোন কারণে কর্মকর্তারা উপস্থিত হতে না পারলে সংগঠনের পরবর্তী কর্মকর্তারা যােগ দিতে পারবেন। মিজান চৌধুরীর বাসায় সংগঠনের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি জনাব মহিউদ্দিন আহমদ-এর সভাপতিত্বে এই সভা অনুষ্ঠিত হয়।
ইতিমধ্যে পার্টির মধ্যে চক্রান্তের বিষয়ে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মহিউদ্দিন আহমদ ও ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদিকা বেগম সাজেদা চৌধুরীকে আইন সংসদ বিষয়ক তদানীন্তন সচিব অবগত করান। তদানীন্তন আইন মন্ত্রণালয়ের সচিব ২৭শে অক্টোবর রাতের অন্ধকারে লুঙ্গি পরে তেজতুরী বাজারে এসে মহিউদ্দিন আহমদ ও বেগম সাজেদা চৌধুরীকে গােপনে সংবাদ দেন যে, মিজান চৌধুরী আওয়ামী লীগের দল গঠনে অনুমতি পাওয়ার জন্য গােপনে আর একটি দরখাস্ত জমা দিয়েছে।
৩৪. জনাব মহিউদ্দিন আহমদ-বেগম সাজেদা চৌধুরী হতবাক হয়ে যান। চক্রান্ত কোন পর্যায়ে গেছে জানতে পেরে কৌশল গ্রহণ করেন এবং ২৯ তারিখে মিজান চৌধুরীর বাসায় গিয়ে মিটিং করেন এবং ৩১ তারিখে আহুত সম্মেলন সাফল্যমন্ডিত করার ক্ষেত্র প্রশস্ত করেন। মহিউদ্দিন-সাজেদা চৌধুরী গ্রুপের দৃঢ় বিশ্বাস ছিলাে সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলে দলীয় নেতা-কর্মীরা সমস্ত চক্রান্ত ভেঙ্গে ফেলতে পারবে।
৩৫. ৩১শে অক্টোবর ‘৭৬। ঐতিহাসিক হােটেল ইডেন। হােটেলের মালিক দারােগা চাচা। একটি পয়সা নেননি। সম্মেলনের জায়গা দিয়েছিলেন। প্যান্ডেল করতে হবে। টাকা নেই। হাজী চাঁদ মিয়া সাধারণ সম্পাদিকাকে বললেন, “আমি আছি, আপনে আগাই যান।”- সে সময় এই ‘ছােট কথাটুকুর কি যে মূল্য ছিল’ আজকের পরিবেশে তা উপলব্ধি করা যাবে না!
প্যান্ডেল হল। মঞ্চ হল। মঞ্চে একটি শূন্য চেয়ার। যে চেয়ারে বঙ্গবন্ধু ৭৩ সনে বসেছিলেন আওয়ামী লীগের সভাপতিরূপে হাজী চাঁদ মিয়া সে চেয়ারটি রেখেছিলেন সযত্নে। সেই চেয়ার। সেই চেয়ারের দু’পাশে জাতীয় পতাকা ও দলীয় পতাকা। আর চেয়ারে স্থাপিত হলাে শিল্পী শাহাবুদ্দিনের আঁকা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিষন্ন অথচ দূত্যিময় এক ছবি। এসব দেখে মিজান গং বললেনঃ এখানে ছবি কেন? -আমাদের মারতে চাও নাকি।১৪
৩৬। সম্মেলন শুরু হলাে। রাস্তায় বিডিআর। পুলিশ। সাদা পােষাকে লােক এসে ইডেন হােটেলের মালিক চাচার নিকট জানতে চায়-হােটেল ভাড়া নেয়া হয়েছে কিনা। এসব আঁচ করতে পেরে দারােগা চাচা পূর্বেই সাদা কাগজে রেভিনিউ স্টাম্পের উপর সাধারণ সম্পাদিকা বেগম সাজেদা চৌধুরীর স্বাক্ষর করে নিয়েছিলেন। সাধারণ সম্পাদিকার রিপাের্ট নিয়ে কথা উঠলাে। কথা হয়েছিলাে ঐ রিপাের্ট অধ্যাপক ইউসুফ আলী দেখে দেবেন। রাতে মহসীন আলীর স্ত্রী এলেন। বললেন, রিপাের্ট নিয়ে চলুন আমার বাড়িতে। অধ্যাপক ইউসুফ আলী ও অন্যান্যরা ওখানে আছেন। সাধারণ সম্পাদিকা বললেন ঃ চলুন ভারপ্রাপ্ত সভাপতির ওখানে। ওনারা গেলেন। ভারপ্রাপ্ত সভাপতি জনাব মহিউদ্দিন অসুস্থ ছিলেন। বললেন ঃ রিপাের্ট আমি দেখেছি। আর কাউকে দেখানাের প্রয়ােজন নেই। রিপাের্টে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু ও চার জাতীয় নেতার হত্যাকান্ডের নিন্দা ছিলাে।
৩৭। ৩১শে অক্টোবর হােটেল ইডেনে আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মহিউদ্দিন আহমদ। সভায় রাজনৈতিক দল বিধির শর্ত মােতাবেক দলের ঘােষণাপত্র সংশােধন করে পুনরায় তা দাখিল করার জন্য সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। সভায় শুরুতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তার পরিবারবর্গ ও চার নেতার বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। জনাব মহিউদ্দিন আহমদ ভাষণ দেন। এরপর ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদিকা বেগম সাজেদা চৌধুরী গত ২৫শে আগস্ট অনুষ্ঠিত বর্ধিত সভা থেকে শুরু করে ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত সময়ের বিভিন্ন কার্যকলাপ ঘটনাবলীর রিপাের্ট পেশ করেন। প্রায় ৮০% সংসদ সদস্য, জেলা সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক উপস্থিত হন। বাইরে হাজার হাজার কর্মীকে অধীর আগ্রহে সিদ্ধান্ত জানার জন্য অপেক্ষা করতে দেখা যায়। সভায় মিজান চৌধুরী, জহিরুল কাইয়ুম, মােমিন তালুকদার, মালেক উকিল, মােল্লা জালাল, সালাউদ্দিন ইউসুফ প্রমুখ বক্তৃতা করেন। ১৬
৩৮. ২রা নভেম্বর ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদিকা এক বিবৃতিতে বললেন, ঘােষণাপত্রের প্রস্তাবনা থেকে শুধুমাত্র ‘বঙ্গবন্ধু’ শব্দ বাদ দিয়ে সংশােধিত আকারে পেশ করার যে খবর প্রকাশিত হয়েছে তা ঠিক নয়। সাজেদা চৌধুরী বলেন, ঘােষণাপত্রের পুরাে প্রস্তাবনাই বাদ দেয়া হয়েছে। কেননা বঙ্গবন্ধুর নাম বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগের পক্ষে দলীয় অনুমতি নেয়া সম্ভব নয়, বিধায় আওয়ামী লীগ প্রতিবাদ স্বরূপ মুখবন্ধ ‘ব্ল্যাংক’ রেখে ঘােষণাপত্র ও গঠনতন্ত্র জমা দিয়েছে।
৩৯. ৪ঠা নভেম্বর বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক দল হিসেবে কাজ করার অনুমতি লাভ করে। ৯১ নবাবপুরে বঙ্গবন্ধুর ছবি উঠানাে হলাে। আওয়ামী লীগের সাইনবাের্ড টানানাে হলাে। জাতীয় পতাকা ও দলীয় পতাকা উত্তোলিত হয়। সমগ্র নবাবপুর রােড স্তব্ধ। শােকাহত। নেতারা গেলেন না। কর্মীরা এলেন। এলেন মােল্লা জালাল ও ফনী মজুমদার। সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধ, মীরপুর বুদ্ধিজীবীদের স্মৃতিসৌধ এবং কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে পুষ্পমাল্য অর্পণ করা হয়। ৯১ নবাবপুরে মিলাদের আয়ােজন করা হয়েছে। বিপুল সংখ্যক আওয়ামী লীগ নেতা কর্মী এ সকল অনুষ্ঠানে যােগ দেয়।
৪০. ৪ ঠা নভেম্বর অনুমােদন লাভের পূর্বে মিজান চৌধুরী বললেন, যুবলীগ সংগঠনের দরকার নেই। দাখিলকৃত গঠণতন্ত্রে ছিল না। ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদিকা মন্ত্রণালয়ে গিয়ে নতুন করে লিখে দিয়ে এলেন “আওয়ামী লীগের একটি যুব সংগঠন থাকিবে তাহা আওয়ামী যুবলীগ নামে পরিচিত হইবে।” আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ বিভিন্ন জেলা শহরের ঘরােয়া পরিবেশে কর্মী সম্মেলনের কর্মসূচী দিলেন। ২১শে নভেম্বর প্রথম সভা হলাে ময়মনসিংহে। মঞ্চে বঙ্গবন্ধুর ছবি টানানাে হলাে। কর্মীসভা জনসভায় পরিণত হলাে। ২৫শে নভেম্বর টাঙ্গাইলে কর্মীসভার পূর্বে মিছিল সহকারে কর্মীসভার স্থানে গেলেন-মালেক উকিল, আব্দুল মান্নান, সাধারণ সম্পাদিকা বেগম সাজেদা চৌধুরী, শামসুর রহমান খান শাহজাহান, ফারুক প্রমুখ। তারা বক্তৃতা করেন। ২১শে নভেম্বর তারিখে ১৯৭৭ সনে ফেব্রুয়ারীতে অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচন বন্ধ করা হলাে। ২৯শে নভেম্বর সাধারণ সম্পাদিকাকে গ্রেফতার করা হলাে। ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আত্মগােপন করলেন। মালেক উকিল গ্রেফতার হন। গ্রেফতার হন আবদুল মমিন তালুকদার, সালাহউদ্দিন ইউসুফ প্রমুখ। ষড়যন্ত্র শুরু হলাে। শুরু হলাে ব্যাপক ধরপাকড়। কেবল মিজানুর রহমান চৌধুরী, অধ্যাপক ইউসুফ আলী, মােল্লা জালাল এদের গ্রেফতার করা হলাে না।
৪২। আওয়ামী লীগ বিভক্ত করার চক্রান্ত দ্বিতীয় পর্যায়ে শুরু হলাে। মিজান চৌধুরী মােস্লা জালাল প্রমুখ বিভিন্ন জেলায় কর্মী সমাবেশে যেতে লাগলেন। কর্মীরা প্রশ্ন করতে লাগলাে অন্য নেতারা জেলে, আপনারা বাইরে কিভাবে? কর্মীদের প্রতিরােধের মুখে ষড়যন্ত্র বেশী দূর এগুতে পারেনি। জহুরুল কাইয়ুম, ময়েজ উদ্দিন, কামরুজ্জামান, লুৎফর রহমান, ফজলুল হক বিএসসি, ফজলুল করীম, মফিজুল ইসলাম খান কামাল প্রমুখ উদ্যোগ নিয়ে বেগম জোহরা তাজুদ্দিনকে পার্টির আহবায়ক করা হয়। চক্রান্ত করা হয় সেখানেও। ‘নেপথ্য নায়ক’ বলে পার্টি কর্মীদের বিভ্রান্ত করার চেষ্টা হয়। আহবায়ক কমিটি তারপরেও দৃঢ়তার সঙ্গে কাজ করে। ১৯৭৮ সনে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পূর্বে এপ্রিল মাসে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়। আবদুল মালেক উকিল সভাপতি ও আব্দুর রাজ্জাক সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। এর পরও চক্রান্ত চলতে থাকে। সে চক্রান্ত পরবর্তী অধ্যায়ে আলােচিত হয়েছে।
একটি নামে এত ভয়
৪৩. জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ইতিহাসের পাতা হতে বিস্মৃতির অতলে ঠেলে দেবার চক্রান্ত, জারী হলাে সামরিক ফরমান। বঙ্গভবনে প্রেসিডেন্ট আবু সাদাত মােহাম্মদ সায়েম রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সঙ্গে রাজনৈতিক দলবিধি জারীর প্রাক্বালে বৈঠক করেন। বৈঠকে জিয়াউর রহমান উপস্থিত ছিলেন। তিনি আওয়ামীলীগের নেতাদের সঙ্গে আলােচনা কালে বলেন, আওয়ামীলীগের নেতৃত্বে আমি মুক্তিযুদ্ধ করেছি। আমি তাে আওয়ামীলীগেরই। আপনারা কাজ চালিয়ে যান। কিন্তু লক্ষ্যণীয় বিষয় হলাে এইযে, গঠনতন্ত্র ও মেনিফেস্টো জমা দেবার কিছুদিনের মধ্যে এক সামরিক ফরমান জারী করা হয়। সামরিক ফরমানে ঘােষণা দেওয়া হয় যে, “জীবিত বা মৃত কোন ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে কোন পারসােনালিটি ‘কাল্ট’ প্রচার ও প্রকাশ করা যাবে না।” পিপিআর-এ প্রথমে এ শর্ত ছিলােনা।
৪৫. বলাবাহুল্য আওয়ামীলীগের গঠনতন্ত্র ও দলিলাদিতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নাম উল্লেখিত ছিলাে। জিয়ার সামরিক সরকার সামরিক ফরমান জারী করে নাম-এর উপর নিষেধাজ্ঞা জারী করে। এই মর্মে আওয়ামীলীগের দলিলাদি সরকারী তরফ হতে ফেরত পাঠানাে হয়। কার্যনির্বাহী কমিটিতে ‘বঙ্গবন্ধু’ নাম থাকা না থাকার উপর আলােচনা হয়। আলােচনায় গঠনতন্ত্রে ও ঘােষণাপত্রে নাম রাখা না রাখা নিয়ে বিতর্ক অনুষ্ঠিত হয়। বিতর্কে যে সব নেতৃবৃন্দ ‘বঙ্গবন্ধু’র নাম রাখার পক্ষে অভিমত ব্যক্ত করেন তাদের কিছুদিনের মধ্যে গ্রেফতার করা হয়। এ সম্পর্কে প্রামাণ্য দলিল বিচারপতি বদরুল হায়দার চৌধুরীর লিখিত একটি পুস্তক। আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে এ-চক্রান্ত সম্পর্কে জ্ঞাত হওয়া যায়।১৭
ক্ষমতায় টিকে থাকা ও ব্যক্তি উচ্চাভিলাস চরিতার্য করার নিমিত্তে জিয়াউর রহমান ১৯৭৬ সনের প্রথমার্ধেই ৬২,০০০ (বাষট্টি) হাজার রাজনৈতিক নেতা কর্মীদের কারাগারে আটক রাখে, যার মধ্যে অধিকাংশই ছিলাে আওয়ামীলীগ যুবলীগ ছাত্রলীগ শ্রমিক লীগের নেতা ও কর্মীবৃন্দ।১৮
৪৬. জিয়াউর রহমান আওয়ামীলীগে যােগদানের এবং বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত কাজ সম্পন্ন করার জন্য আওয়ামীলীগ নেতৃবৃন্দের নিকট ইচ্ছা প্রকাশ করেন।১৯ যা ছিলাে সম্পূর্ণ প্রতারণাপূর্ণ এবং ক্ষমতা সংহত করার জন্য সময় ক্ষেপনের কৌশল।
Reference: জেনারেল জিয়ার রাজত্ব – অধ্যাপক আবু সাঈদ
Reference list:

আমি সৈনিক ও রাজনীতিবিদ নই
আমি ব্যারাকে ফিরে যাবাে।
১. রাত ১২.১মিনিট। ১৯৭৬ সনের ঐতিহাসিক ২১শে ফেব্রুয়ারী। দেশে রাজনীতি নিষিদ্ধ। চারদিকে উদ্যত সঙ্গীণ। টিভি রেডিও-তে প্রায় প্রত্যহ প্রচার হচ্ছে সামরিক এলান। কেউ সামরিক প্রশাসক ও সামরিক শাসন সম্পর্কে কথা বললে বা আকারে ইঙ্গিতে এর বিরুদ্ধোচ্চারণ রাখলেও যাবজ্জীবন কারাদন্ড, এমনকি মুত্যুদন্ড। রাত দশটা থেকে ভাের পর্যন্ত কার্ফ্যু। রাতের ঢাকা নীরব,নিশ্চুপ স্থীর।এই অবস্থার মধ্যে রাতের অন্ধকার ভেদ করে এগিয়ে এলাে ট্রাক-শ্রমিকের মিছিল। চীনপন্থী নেতা কাজী জাফর এদের নিয়ে এসেছেন টঙ্গীর শিল্প এলাকা হতে। মুখে তাদের শ্লোগান ‘জেনারেল জিয়া জিন্দাবাদ। একুশে ফেব্রুয়ারী অমর হােক’।শহীদ মিনারের কাছাকাছি আসতেই ওয়াকিটকিতে সংবাদ চলে গেলাে উপ-প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক মেজর জেনারেল জিয়ার নিকট। জিয়া হাসলেন মৃদু। সাফারী স্যুট ঠিক করে নিলেন। তারপর সামরিক প্রহরায় বের হলেন সদর্পে,শহীদ মিনারে পৌছলেন, দাঁড়ালেন চারদিকে তাকালেন। তখন শ্লোগান চলছে ‘জেনারেল জিয়া, জিন্দাবাদ’। মালা হাতে এগিয়ে গেলেন শহীদ মিনারের বেদীতে দাঁড়ালেন। আগত শ্রমিকদের মাঝে গিয়ে তাদের নিয়ে মালা প্রদান করলেন।
২. ধানমন্ডি আবাসিক এলাকা। জনাব মতিউর রহমানের বাসা। একুশে ফেব্রুয়ারী উদযাপন উপলক্ষ্যে এক বৈঠক। বৈঠকে ২১শে ফেব্রুয়ারী মহান শহীদ দিবস উদযাপন সম্পর্কে আলােচনা অনুষ্ঠিত হয়। মহান শহীদদের প্রতি বাঙালী জাতির পক্ষ হতে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ব্যক্তিদের নিয়ে কেন্দ্রীয় শহীদ দিবস উদযাপন কমিটি গঠন করার প্রস্তাব উত্থাপন হয়। দেশের সাংস্কৃতিসেবী, বুদ্ধিজীবী ও বরণ্যে ব্যক্তিদের নিয়ে কমিটি গঠন করা হয় ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য।এই কমিটির কর্মকর্তাদের গ্রেফতার করা হয়, কমিটির প্রায় সকলের বিরুদ্ধে জারী করা হয় গ্রেফতারী পরােয়ানা। জেনারেল আইয়ুব খানের আমলেও কড়া সামরিক শাসনের মধ্যে ২১শে ফেব্রুয়ারী মহান ভাষাশহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনে এরূপ গ্রেফতার ও কড়াকড়ি আরােপ করা হয়নি। জেনারেল জিয়ার আমলে কেন্দ্রীয় শহীদ দিবস উদযাপন কমিটিকে কাজ করতে দেয়া হলাে না, নেতাদের গ্রেফতার করা হলাে, জারী হলাে গ্রেফতারী পরােয়ানা। গ্রেফতারকৃতদের বিরুদ্ধে অভিযােগ ছিলাে তারা শহীদ দিবস উদযাপনের নামে সমগ্র বাংলাদেশে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির জন্য উস্কানী দিচ্ছে।
৩. এ বিষয়ে পরবর্তীকালে হাইকোর্টে এক রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, ‘১৯৭৬ সনের ২১ শে ফেব্রুয়ারী শ্রমিকদের আইন শৃংখলা অবনতিতে কোন উস্কানী প্রদান করার সুযােগ ছিলােনা। মেজর জেনারেল জিয়া নিজে শ্রমিকদের নিয়ে এসে তাদের শ্লোগানের মধ্যে শহীদ মিনারে মালা দিয়েছেন,অন্যদের করেছেন গ্রেফতার। বলা হলাে সাবেক মন্ত্রী জনাব মতিউর রহমান, খােন্দকার মােহাম্মদ ইলিয়াস এবং জনাব নূরুল ইসলামকে ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইন বলে গ্রেফতার করা হয়েছে। শনিবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক প্রেস বিজ্ঞপ্তির বরাত দিযে বাসস একথা জানায়। এরা বাংলাদেশের নিরাপত্তা ও জন নিরাপত্তার প্রতি ক্ষতিকর তৎপরতায় লিপ্ত ছিলাে। এভাবে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের রাজনীতি আগমনের দ্বৈত কৌশল!
৪. প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক বিচারপতি আবু সাদাত মােহাম্মদ
সায়েম বিচারপতি সাত্তারকে প্রতিশ্রুতি মােতাবেক দেশে সাধারণ নির্বাচন (পার্লামেন্ট) অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে রাজনৈতিক প্রক্রিয়া, দলগঠন ও তৎপরতা চালানাের সহায়তা করার লক্ষ্যে উপদেষ্টার মর্যাদায় বিশেষ সহকারী নিযুক্ত করেন। বিচারপতি আবদুস সাত্তার নির্ধারিত সময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠান বিষয়ে আন্তরিক ছিলেন না-যদিও প্রেসিডেন্ট সায়েম তাকে অত্যন্ত বিশ্বাস করে এ দায়িত্ব দিয়েছিলেন। কিন্তু বিচারপতি সাত্তার পেসিডেন্ট সায়েম কর্তৃক অর্পিত দায়িত্ব বিশ্বস্ততার সঙ্গে পালন করেন নি। তিনি জেনারেল জিয়া ও তার সহযােগী সামরিক জান্তার চক্রান্তে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেন। রাজনৈতিক তৎপরতা শুরু করার পূর্বে এবং এ বিষয়ে সামরিক ফরমান জারী করার পূর্বেই নির্বাচন স্থগিত করার চক্রান্তের রপ্রিন্ট অনুযায়ী দেশের স্বাধীনতা বিরােধী দলসমূহের এবং চৈনিক পন্থী দলসমূহের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠক করেন। নিরপেক্ষতা দেখানাের জন্য মাঝে মধ্যে এসব বৈঠকে আওয়ামীলীগের কোন কোন নেতৃবৃন্দকেও ডাকা হতাে।
৫এমনি একটি বৈঠক ডাকা হয় ২৩শে জানুয়ারী ‘৭৬ সনে। দেশের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ প্রেসিডেন্টের বিশেষ সহকারী বিচারপতি আব্দুস সাত্তারের সাথে সন্ধ্যায়
বঙ্গভবনে এক বৈঠক মিলিত হন। বাসস জানায় যে উপ-প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকদের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত এ বৈঠকে জাতীয় ঐক্য ও সংহতি সুসংহত করার জন্য নয়া ব্যবস্থাবলী পর্যালােচনা করা হয়। বৈঠকে জাতীয় জীবনের বিভিন্ন দিক সম্পর্কেও ফলপ্রসূ আলােচনা অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে উপস্থিত রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মধ্যে ছিলেন জনাব আতাউর রহমান খান, জনাব তােফাজ্জল আলী, জনাব আবদুস সবুর খান, জনাব হাসিমুদ্দিন আহমদ, ডঃ আলীম আল-রাজী, জনাব শফিউর রহমান, জনাব নুরুর রহমান, হাজী মােহাম্মদ দানেশ, জনাব সিরাজুল হােসেন খান, জনাব অলি আহাদ, ক্যাপ্টেন (অবঃ) আবদুল হালিম চৌধুরী, কাজী জাফর আহমদ, জনাব নূরুল ইসলাম চৌধুরী, সৈয়দ আজিজুল হক (নান্নামিয়া) মওলানা সিদ্দিক আহমদ, মওলানা আশরাফ আলী, মওলানা আবদুর রহিম, জনাব আবদুল মান্নান, জনাব মিজানুর রহমান চৌধুরী ও মিসেস আমেনা বেগম।৪
জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক খেলা
৬. স্বাধীনতা বিরােধী ও চৈনিকপন্থী রাজনীতিবিদগণ ভালাে করেই জানতেন
যথাসময়ে নির্বাচন হলে তাদের নেতৃত্বের মুখােশ খসে পরবে। সেজন্য তারা কৌশল হিসেবে ভারত বিরােধীতা ও আওয়ামী বাকশালীদের তাদের আক্রমণের মূল টার্গেট হিসেবে বেছে নেয়। সীমান্ত অঞ্চলের কর্মকান্ডকে তারা ফঁাপিয়ে প্রচার করতে থাকে। যদিও সরকারী পত্রিকায় বাসস পরিবেশিত খবরে বলা হয়েছে, সীমান্ত এলাকায় ‘দুস্কৃতকারীদের তৎপরতা’ সত্বেও সীমান্তের জীবন যাত্রা স্বাভাবিক। সরকারীভাবে ভারত বিরােধী প্রচারণায় ভারত তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। ভারতের প্রতিক্রিয়া এবং বাংলাদেশ পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের মুখপাত্র বালাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস)য় পরিবেশিত প্রতিক্রিয়া ও পাল্টা প্রতিক্রিয়া প্রণিধানযােগ্যসম্প্রতি বাংলাদেশের পত্র পত্রিকায় সীমান্তের ঘটনাবলী সম্পর্কে প্রকাশিত খবরে ভারত সরকারের প্রতিক্রিয়ায় পররাষ্ট্র দফতরের একজন মুখপাত্র বিস্ময় ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন বলে বাসসর খবরে উল্লেখ করা হয়। ভারতীয় পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র যে বিবৃতি দিয়েছেন তার ওপর মন্তব্য করার অনুরােধ করা হলে পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র জানান, সম্প্রতি উচ্চপর্যায়ে প্রতিনিধিদলের দিল্লী সফরের সময় উভয়পক্ষ সুপ্রতিবেশীসুলভ সম্পর্কের ব্যাপারে যে সমঝােতা হয়েছিলাে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে তা ভঙ্গ করা হয়নি।
সীমান্তের ঘটনাবলী সম্পর্কে পত্র পত্রিকায় যে খবর বেরিয়েছে তা জনসাধারণ ইতিমধ্যেই যা জানে তার অতিরিক্ত কিছু নয় বলেই মনে হয়। মুখপাত্র বলেন, প্রকৃতপক্ষে ইতিমধ্যেই বাংলাদেশ সরকার ভারত সরকারকে বিডিআর-এর ডিরেক্টর জেনারেল এবং বিএস এফ-এর ডিরেক্টর জেনারেল মধ্যে এক বৈঠক অনুষ্ঠানের কথা বলেছিলেন। ভারত বিরােধী প্রচারণা ছড়ানােয় বালাদেশ সরকার জড়িত বলে ভারতীয় পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র যে ইঙ্গিত দিয়েছে তা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। বাংলাদেশ সরকারের নীতিই হচ্ছে তার সকল প্রতিবেশীর সাথে মৈত্রীবন্ধন দৃঢ় করা। মুখপাত্র বলেন, শান্তি ও স্থিতিশীলতা যা সারাদেশে বিরাজ করছে এবং জনসমর্থন যা সরকারের পক্ষে রয়েছে এবং আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমগুলিতে যা স্বীকৃত হয়েছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ‘আভ্যন্তরীণ বাধ্যবাধকতার উল্লেখ বােধগম্য নয়। অন্য কোন কারণ অথবা উদ্দেশ্য থাকতে পারে বলে যে ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে তা সম্পূর্ণ অবাঞ্ছিত।
ভারতের প্রতিক্রিয়া
নয়াদিল্লী থেকে বাসস ও সমাচার পরিবেশিত খবরে বলা হয়, ভারতবিরােধী প্রচারণায় বাংলাদেশের পত্র পত্রিকা নতুন করে ফেটে পড়ায় ভারত বিস্ময় ও বেদনা প্রকাশ করেছে। পররাষ্ট্র দফতরের একজন সরকারী মুখপাত্র গত ২৯শে জানুয়ারী শুক্রবার বলেন, দুস্কৃতকারীদের অস্ত্র, প্রশিক্ষণ, অর্থ অথবা আশ্রয়দানের অভিযােগ সর্ববৈ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। তিনি বলেন, বিচারপতি জনাব এ সাত্তরের নেতৃত্বে। বাংলাদেশের উচ্চ পর্যায়ের এক প্রতিনিধিদলের সম্প্রতি নয়াদিল্লী সফরকালে উভয় পক্ষ যে সমঝােতায় পৌছেছিলাে এবং যাতে উভয় পক্ষ বৈরী প্রচারণা হতে বিরত থাকা এবং তাদের জনগণের প্রগতি ও কল্যাণের স্বার্থে বন্ধুত্ব ও সহযােগিতা উন্নয়নে কাজ করে যেতে সম্মত হয়েছিলাে তারই পরিপেক্ষিতে এই ভারতবিরােধী প্রচারণা পুনরুজ্জীবিত করার প্রচষ্টা একান্তভাবেই দুঃখজনক। তিনি আরাে বলেন, ভারত সরকার এই অপরিহার্য সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হচ্ছে যে, ঘরােয়া বাধ্যবাধকতা অথবা অন্য কোন কারণেই ভারতের জড়িত হওয়ার অভিযােগ করা হচ্ছে। তিনি অভিযােগ অস্বীকার করেন এবং এক শক্তিশালী, স্থিতিশীল ও সমৃদ্ধিশালী বাংলাদেশ কামনা করেন। কারণ এটা ভারতের স্বার্থেই এবং উপমহাদেশের স্থায়ী শান্তি ও সহযােগিতার একটা কাঠামাে গড়ে তােলার জন্য কাজ করে যাওয়ার ভারতীয় নীতির সঙ্গে সামঞ্চস্যপূর্ণ।৬
ভুট্টোর উপছে পরা দরদ
৭. ভারত বাংলাদেশ এই ঘটনার ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার সুযােগ নেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভূট্টো। তুরস্ক বসেই এক বিবৃতিতে তিনি বললেন ঃ ভারতবাংলাদেশ পরিস্থিতি অবনতি ঘটলে ভারত-পাকিস্তান পরিস্থিতি নয়া অবস্থার সূচনা করবে। ৭ ঐদিন জিয়াউর রহমান জনাব ভুট্টো প্রতিক্রিয়ার অনুরূপ একটি বক্তব্য। প্রদান করেন। সিলেট স্টেডিয়ামে এক জনসভায় বলেনঃ যদি বাংলাদেশে শান্তি বিঘ্নিত হয় অবশ্যই তাতে গােটা উপমহাদেশে শান্তি ও স্থিতিশীলতা বিঘ্নিত হবে।৮ শুধু তাই নয়, এই সময়কালে জিয়াউর রহমান সরকারী অর্থ ব্যয়ে, হেলিকপ্টার ব্যবহার করে, প্রশাসনকে সম্পূর্ণরূপে নিয়ন্ত্রণ করে ও সামরিক বাহিনীর সমাগ্রিক সাহায্য নিয়ে সমগ্র দেশে আওয়ামী বাকশালীদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার ও তীব্র আক্রমণ পরিচালনা করেন। একই সাথে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও জেলখানায় চার জাতীয় নেতার হত্যার প্রতিবাদে দেশের সীমান্ত এলাকায় যারা প্রতিরােধ গড়ে তুলেছিলাে তাদের প্রতিরােধকে সামনে রেখেই জিয়া এসব ঘটনাকে ফুলিয়ে ফঁাপিয়ে ‘স্বাধীনতা গেল’ ‘স্বাধীনতা গেল’ বলে সমগ্র দেশে ততালপাড় শুরু করেন।
প্রথম জনসভা ও রাজনৈতিক প্রতারণা
৮. ১লা মে ১৯৭৬। ঐতিহাসিক সােহরাওয়ার্দী উদ্যান
রাজধানীতে মেজর জেনারেল জিয়ার প্রথম জনসভা। পূর্বেই চৈনিকপন্থী রাজনৈতিক দলগুলাের নেতা ও শ্রমিকনেতাদের সর্বপ্রকার লজিস্টিক সার্পোট’ দেয়া হয়েছে। জনসভার সময় দুপুর ৩টায় ঘােষণা করা হয়েছে। প্রায় দুসপ্তাহ ধরে বিভিন্ন শ্রমিক বেল্টে প্রতিনিধি পাঠানাে হয়েছে। যােগাযােগ করা হয়েছে। জাতীয়করণকৃত শিল্পকারখানার কর্মকর্তাদের ডেকে বলে দেয়া হয়েছে উপ-প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের জনসভায় শ্রমিকদের নিয়ে আসতে হবে। তদানীন্তন এসব নির্দেশ সামরিক নির্দেশ বলেই বিবেচিত হতাে। ৫-২৩ মিনিট। মেজর জেনারেল জিয়া সামরিক বাহিনীর বিরাট বহর নিয়ে কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে সজ্জিত মঞ্চে উঠলেন। চোখে চশমা। চারদিকে তাকালেন। হাত নাড়ালেন। শ্লোগান উঠলাে ‘জেনারেল জিয়া, জিন্দাবাদ।’ সেনাবাহিনী, বিমান বাহিনী, নৌবাহিনী, বিডিআর, পুলিশ, আনছার বাহিনী এবং সামরিক ছত্রচ্ছায়ায় গঠিত ও
অর্থানুকূল্যে পরিচালিত তথাকথিত মুক্তিযােদ্ধা সংসদ এবং স্বাধীনতা বিরােধী দল সমূহের কর্মী, চৈনিকপন্থী দলসমূহের শ্রমিক সংগঠন ও কর্মী এবং ঢাকার উত্মক জনগণ জনসভায় উপস্থিত। শ্লোগান ওঠে সিপাহী জনতা ভাই ভাই।’ প্রস্তুতি চলছিল পক্ষকাল ধরে। জনসভার আয়ােজকগণ পক্ষকালের একটানা পরিশ্রমে কর্মক্লান্ত, গলদঘর্ম। অথচ মাইকে বলা হলাে ঃ একদিনের ঘােষণায় এই বিশাল জনসভা। জনসভায় জেনারেল জিয়া সামরিক পােশাক পরে, প্রথমে বগলে ব্যাটন চেপে, পরে টেবিলে ব্যাটন রেখে জনসভায় ‘উর্দুভাষী উচ্চারণে বাংলা জবানে ভাষণ দিয়ে বললেন ঃ বাংলাদেশের জনগণ বােঝে ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। বললেন ঃ যারা নতুন করে দেশ স্বাধীন করবে, প্রবাসী সরকার বানাবে এরা দেশের জনগণের বিরুদ্ধে কিছুই করতে পারবেনা। তিনি বললেনঃ ইনশাল্লাহ এদের ধংস করা হবে। তিনি বললেন, “আপনারা এদের ধংস করতে চান ? হাত তুলুন।” তিনি আরাে ওয়াদা করলেন- “জনগণের অধিকার তাদের ফিরিয়ে দিতে হবে। ন্যায় বিচার লাভের সুযােগ দিতেই হবে। কারণ ন্যায় বিচার পাওয়ার অধিকার আল্লাহ তাদের দিয়েছেন। তিনি জনগণের মৌলিক অধিকার ফিরিয়ে দেবার অঙ্গীকার করেন।৯
৯. ১লা মে জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার করার ৯ দিনের মধ্যে ৮ই মে জনগণের অধিকারকে আরাে শৃংখলিত করার লক্ষ্যে জিয়াউর রহমান সমগ্র দেশকে ৯টি জোনে বিভক্ত করে ৯জন আঞ্চলিক সামরিক আইন প্রশাসক নিযুক্ত করেন। ১৯৭৫ সালের ৮ই নভেম্বর ও ২০ শে আগষ্ট তারিখের ঘােষণা অনুসারে এবং ১৯৭৬ সালের ৯ই ফেব্রুয়ারী তারিখের আদেশ নং ১১৭-আইন রহিত করে আদেশটি জারি করা হয়। জোন-এ সমগ্র ঢাকা, টাঙ্গাইল ও ময়মনসিংহ জেলাঃ ডিরেক্টর জেনারেল, বাংলাদেশ রাইফেলস; জোন বি-ঃসমগ্র সিলেট, কুমিল্লা ও নােয়াখালী জেলাঃ কমান্ডার, ৪৪-বিগ্রেড; জোন সি- চট্টগ্রাম বন্দর এলাকা ও তৎসংলগ্ন সমুদ্র এলাকা বাদে সমগ্র চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলাঃ কমান্ডার ৬৫-বিগ্রেড; জোন-ডিঃচট্টগ্রাম বন্দর ও তৎসংলগ্ন সমুদ্র এলাকাঃ কমোেডর কমান্ডিং চট্টগ্রাম; জোন-ইঃ সমগ্র খুলনা জেলা ও তৎসংলগ্ন সমুদ্র এলাকাঃ ন্যাভল অফিসার ইনচার্জ; খুলনা জোন-এফঃ কমান্ডার, ৫৫ বিগ্রেড; জোন-জিঃ সমগ্র রাজশাহী, পাবনা ও বগুড়া জেলাঃ কমান্ডার, ৯৩ সঁজোয়া বিগ্রেড; জোন-এইচঃ সমগ্র রংপুর ও দিনাজপুর জেলার কমান্ডার ৭২-বিগ্রেড; এবং জোন-আইঃ সমগ্র কুষ্টিয়া ও ফরিদপুর জেলাঃ কমান্ডার ১০৫-বিগ্রেড। এক সরকারী তথ্য বিবরণীতে একথা বলা হয়। ১০
১০. একই সময়ে চীনপন্থী বলে পরিচিতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে ফারাক্কা ইস্যুকে সামনে রেখে উসকে দেয়া হয়। মওলানা ভাসানীর পত্রের জবাবে মিসেস গান্ধী মাওলানা ভাসানীকে একটি পত্র দেন।১১ পত্রটি নিম্নরূপপ্রিয় মওলানা সাহেব, আপনার গত ১৯৭৬ সালের ১৮ই এপ্রিল লেখা চিঠি পড়ে আমি ব্যথিত ও মর্মাহত হয়েছি। এটা কল্পনা করাও কষ্ট যে, এক ব্যক্তি যিনি সাম্রাজ্যবাদী শাসনের বিরুদ্ধে আমাদের সঙ্গে কাধে কাধ রেখে সংগ্রাম করেছেন এবং পরবর্তীকালে বাংলাদেশের নিজের জাতীয় স্বাধীনতার জন্যে দুঃখ কষ্টে শরীক হয়েছেন, তিনিই আমাদের এমন গুরুতরভাবে ভুল বুঝবেন এবং এমন কি, আমাদের সম্পর্কে আন্তরিকতার প্রশ্ন তুলবেন। বরং আমি এটাই বিশ্বাস করবাে যে, আপনি প্রকাশ্য বিবৃতিতে ভারতের বিরুদ্ধে অখন্ড ভারত প্রতিষ্ঠার জন্য আগ্রাসী উদ্দেশ্যের যে হুমকি দিযেছেন তা মুহূর্তের উত্তেজনাতেই। যে ভারত দৃষ্টান্তহীন দ্রুততার সঙ্গে বাংলাদেশ থেকে তার সেনাবাহিনীকে প্রত্যাহার করে নিয়েছে, সে তার প্রতিবেশীর বিরুদ্ধে বৈরী মনােভাব পােষণ করতে পারে বলে কোন বাংলাদেশী কি সত্যি সত্যিই বিশ্বাস করেন? ভারত সরকার ও জনগণ। এটা কামনা করেন যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সগ্রামে ও যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের পুনর্গঠনে তাদের সমর্থন ও সহযােগিতার আলােকেই তাদের দেখা হবে। আমাদের প্রয়ােজন অনেক বেশী এবং আমাদের জনগণের উপর বােঝাও অনেক। কিন্তু আমাদের উভয়দেশের জনগণের কল্যাণ পরস্পরের সাথে সম্পর্কযুক্ত। উভয়ের অভিন্ন স্বার্থেই এতদাঞ্চলে স্থিতিশীলতা এবং আমাদের দু’দেশের মধ্যে সহযােগিতা ও বন্ধুত্ব থাকা প্রয়ােজন। আপনি তাে জানেন যে, ১৫ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত ফারাক্কা বাঁধ দীর্ঘদিন ধরেই পূর্ব ভারতের প্রাণকেন্দ্র কলকাতা বন্দরকে রক্ষা করার একমাত্র উপায় বলে বিবেচিত হয়ে আসছে, কাজেই এটাও ত্যাগ করা যায় না। আপনি এটাও জানেন যে, গ্রীষ্মকালে আনুমানিক দু’মাসের মত সময়ে গঙ্গার পানি প্রবাহ কমে যায়। আমাদের উভয়ের প্রয়ােজন মেটানাের ব্যাপারে ভবিষ্যতে কোন ঘাটতি দেখা দিলে পরস্পরের মধ্যে সমঝােতা ও সহযােগিতা থাকলে অবশ্যই একটা উপায় বের করা যাবে। হুগলী নদীর নাব্যতা রক্ষার জন্য প্রয়ােজনীয় ন্যূনতম পরিমাণ পানিও আমাদের জন্য রেখে আমরা বাংলাদেশের প্রবাহ ঠিক রেখেছি।

আমার মনে হয়, আপনাকে ঘটনার একটা দিক এবং বাংলাদেশে ফারাক্কা বাঁধের। ফিডার ক্যানালের প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে অতিরঞ্জিত বিবরণ দেয়া হয়েছে। আপনি চাইলে, আমাদের হাইকমিশনার আপনাকে ঘটনার অপরদিক সম্পর্কে অবহিত করবে। প্রতিবেশীদের মধ্যে সমস্যার সৃষ্টি হওয়া স্বাভাবিক। সমঝোতা ও সহযােগিতার মনােভাব নিয়ে সমস্যার সমাধান কামনা করাটাই বড় কথা। মােকাবিলা ও বৈরীতার পক্ষ অনুসরণ করলে আমাদের উভয়ের ক্ষতি। আমি আবার। আন্তরিকতার সঙ্গে বলতে চাই যে, বাংলাদেশ তার স্বাধীনতা সুসংহত করুক ও শান্তির মধ্য দিয়ে সমৃদ্ধিশালী হােক। বন্ধুসুলভ প্রতিবেশী ও অগ্রগতির সাথী হিসেবে আমরা আমাদের অবদান রেখে যাব। আপনি হয়ত অবগত আছেন যে, খরা মওসুমে গঙ্গার পানি বরাদ্দ এবং এ সম্পর্কিত বিষয়টি নিয়ে আমাদের দু’দেশের সরকার আবার আলােচনা শুরু করেছেন। এ ব্যাপারে উভয়পক্ষের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তিদের উৎসাহ ও সমর্থনের । প্রয়ােজন রয়েছে। আপনাকে আশ্বাস দিচ্ছি যে, আমরা সঙ্গত যুক্তি ও ন্যায্য বক্তব্য মেনে নিতে রাজী আছি। কিন্তু কেউ যেন এটা আশা না করেন যে, ভারত হুমকি বা অযৌক্তিক অথবা অন্যায় দাবীর নিকট নতি স্বীকার করবে। শ্রদ্ধাসহ
ভবদীয়
ইন্দিরা গান্ধী
১১. ইন্দিরা গান্ধীর এই পত্র যখন মওলানার নিকট ভারতীয় দূতাবাসের থার্ড সেক্রেটারী হস্তান্তর করেন সেই মুহুর্তে কলকাতায় ভারত বাংলাদেশের কর্মকর্তারা দ্বিতীয় দফা কারিগরি পর্যায়ের আলােচনা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। ভারতের পররাষ্ট্র দফতরের অতিরিক্ত সচিব শ্রী জে সি আজমানী বলেন, সাত ঘন্টা নৌবিহারে তারা পর্যালােচনা করেন। সেচ বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও বিদ্যুৎ সংক্রান্ত প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা বি, এম, আব্বাস বাংলাদেশ দলের নেতৃত্ব দেন। বৈঠক চলতে থাকে।
১২. ১৬ই মে প্রস্তাবিত ফারাক্কা মিছিল পরিচালনা কমিটিতে ফারাক্কা লংমার্চ সংগঠন
পরিচালনার জন্য মওলানা ভাসানী পীর মােহসেন আলী দুদু মিয়া, মওলানা মহিউদ্দিন খান, সাবেক জমিয়ে ওলেমায়ে ইসলামী সর্বজনাব ইদু চৌধুরী, এটি বারী, এনায়েতউল্লাহ খান, শ্রী নির্মল সেন, গিয়াস শমাল চৌধুরী, কামাল লােহানী, মীর্জা গােলাম হাফিজ, বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষক সমিতির মওলানা
আবদুল সালাম ও মওলানা খন্দকার নাসির উদ্দিন, মওলানা সাইদুর রহমান, মওলানা শেখ ওবায়দুল্লাহ বিন সাঈদ জালালাবাদীকে অন্তর্ভূক্ত করেন।
১৩, স্বাধীনতা বিরােধী মুসলিম লীগ, জামাত ইসলামী, নিজামীইসলামী দলগুলােকে একদিকে, অন্য দিকে চীনপন্থী ভাসানী ন্যাপ, ইউ,পি,পি, সামাজবাদী দল-এর। নেতা-কর্মীদের ভারত বিরােধী অবস্থানে নিয়ে আসার ক্ষেত্রে মওলানার ভাসানীর। উদ্যোগ সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের বুপ্রিন্টের কার্যকর করার প্রাথমিক অথচ সচেতন উদ্যোগ।
১৪. জিয়াউর রহমান ভারত বিরােধী প্রচারণাকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলে লক্ষ্যে ব্যবহার করতে সদা সর্বদাই সচেতন ছিলেন। চীনপন্থী ও স্বাধীনতা বিরােধী জামাত ইসলামী, মুসলিমলীগ, নেজামে ইসলামী নেতা কর্মীদের নিকট ভারত বিরােধীতা তাদের নিজস্ব দলীয় দৃষ্টি কোণ হতেই সহজেই গ্রহণীয় হয়েছিলাে। চীনপন্থী রাজনৈতিক দল, গােষ্ঠি ও শক্তি তাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য অর্জনের লক্ষ্য হিসেবেই কঠোর মার্শাল-র মধ্যে সামরিক সরকার অনুসৃত নীতির পাশাপাশি ভারতের বিরুদ্ধে জনমত গঠনের কাজে ওঠে পরে লেগেছে।
১৫. পাকিস্তান ও মধ্য প্রাচ্যের তথাকথিত মুসলিম দেশগুলি সাম্প্রদায়িক রাজনীতির চারণভূমিরূপে বাংলাদেশকে পুনরায় মুসলিম বাংলার আদলে পুনর্গঠিত করার লক্ষ্যে পরাজিত স্বাধীনতা বিরােধী চক্র এই অবস্থার সুযােগ নিতে এতটুকু সময় অপব্যয় করেনি। স্বাভাবিকভাবেই ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রনীতির অধিকারী ভারতের বিরুদ্ধে তাদের অবস্থান ছিলাে দৃঢ়। ১৬. চীনপন্থীরা চীনের দিকে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির মােড় ঘােরাতে ছিলাে অত্যন্ত তৎপর। সেজন্য গণতন্ত্রের অনুপস্থিতি বা ব্যক্তি স্বাধীনতা, চলাফেরা, আইনে আশ্রয় লাভের মতাে মৌলিক এবং দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে তাদের ভূমিকা ছিলােনা- যৌথভাবে তারা তাদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হিসেবে ভারতের দিকে। কামান তাক করেছিলাে। অবস্থান ভিন্ন লক্ষ্য অভিন্ন। মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান রাষ্ট্র পরিচালনার নীতি হিসেবে ভারত বিরােধীতাকে মুখ্য ইস্যু হিসেবে দাড় করালে চীনপন্থী রাজনৈতিক দলগুলি দ্ব্যর্থহীনভাবে জিয়াউর রহমানকে সমর্থন প্রদান করে যদিও সে সময় তাদের রাজনৈতিক ক্ষমতা ও গণভিত্তি ছিলাে নগণ্য। ১৭. ভারত বিরােধীতার লক্ষ্যে সীমান্তের ছােট খাটো ঘটনাকে নিয়ে এসব দল ও রাজনীতিবিদগণ তিলকে তাল করে ছেড়েছেন। সীমান্তের তুচ্ছ ঘটনা, গরু নিয়ে যাওয়া, কাউকে অপহরণ বা পুলিশী ফাঁড়ি আক্রমণ ও দখলকে অথবা থানার পুলিশের মধ্যে থেকে কাউকে ধরে নিয়ে বংলাদেশের অভ্যন্তরেই ভিন্ন স্থানে নেওয়ার মতাে ঘটনাকেও তারা ‘বিরাট’ কিছু করে ছেড়েছে একেই স্বাধীনতা। সার্বভৌমত্ব বিপন্ন বলে তারস্বরে উচুগলায় ‘চিৎকার করেছে। অথচ বঙ্গবন্ধুর সময় এরাই কয়েক ডজন পুলিশ ফাড়ি দখল, আইন প্রয়ােগকারী সংস্থার সদস্যদের হত্যা ও খতমের রাজনীতি চালু রেখেছিলাে।
১৮, ভারত ও বাংলাদেশ সরকার সীমান্তের ঘটনাবলীতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। এজন্য দু’দেশের মধ্যে বৈঠক হয়েছে। ১৯৭৬ সনের ১১-১৩ই ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত তিন দিন ব্যাপী ঢাকায় এক বৈঠক হয়। বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় যে-যৌথ টীম সীমান্ত ঘটনা তদন্ত করবে। এবং ১৩ ই ফেব্রুয়ারী রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবনে একযুক্ত প্রেস বিবৃতি প্রদান করা হয়। বৈঠক শেষে যুক্ত প্রেস বিবৃতিতে বলা হয়, বাংলাদেশভারত যৌথটীম ময়মনসিংহ জেলার সীমান্ত এলাকায় দুস্কৃতকারীদের লুটতরাজ, অগ্নিসংযােগ এবং থানা ও স…
x

Comments

Popular posts from this blog

ভাড়াটিয়া-ভাড়াদার আইনের জটিলতা পার হওয়া: ভাড়াটিয়াদের জন্য একটি গাইড

একটি ভিত্তিহীন গুজব উড়িয়ে দেওয়া: বাংলাদেশী সাংবাদিকদের ফ্রেঞ্চ ভিসা প্রত্যাখ্যান করা হয়নি৷

অধ্যায় 2: বাংলায় ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন