অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশে বারবার নির্যাতনের শিকার সংখ্যালঘুরা

অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশে বারবার নির্যাতনের শিকার সংখ্যালঘুরা



একটি অসাম্প্রদায়িক চেতনা নিয়ে জন্ম বাংলাদেশের। আর এই জন্মটা হয় দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্যদিয়ে। তবে ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার মধ্যদিয়ে দেশ আবার অন্ধকার পথে পরিচালিত হয়। জিয়াউর রহমানের শাসনামলে দেশে পুনর্বাসিত হয় স্বাধীনতাবিরোধীরা। পরবর্তী সময়ে বিএনপি ও মানবতাবিরোধী অপরাধীদের দল জামায়াত মিলে দেশে সংখ্যালঘুদের ওপর বিভিন্ন সময় বর্বর নির্যাতন চালিয়েছে। অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশকে রক্তাক্ত করেছে তারা।


অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশে বিএনপি-জামায়াতের হাতে বারবার নির্যাতনের শিকার হয়েছে সংখ্যালঘুরা। ফাইল ছবি
অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশে বিএনপি-জামায়াতের হাতে বারবার নির্যাতনের শিকার হয়েছে সংখ্যালঘুরা। ফাইল ছবি
তবে গেল ১৫ বছরে সংখ্যালঘুদের ক্ষমতায়িত করেছে সরকার। বাংলাদেশের সংখ্যালঘু পরিস্থিতি নিয়ে সেমিনারে এমন দাবি করেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ও এমপাওয়ারমেন্ট থ্রু ল অব দ্য কমন পিপলের (এলকপ) চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান।



রাজধানীর একটি হোটেলে ‘দ্য সিচুয়েশন অব মাইনরিটি ইন বাংলাদেশ: ইস্যুজ অ্যান্ড আউটলুক’ শীর্ষক এ আন্তর্জাতিক সেমিনার আয়োজন করা হয়।

সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন এলকপের রিসার্চ কনসালটেন্ট আরেফিন মিজান। মূল প্রবন্ধের ওপর আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্ত, বাংলাদেশ খ্রিস্টান অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট নির্মল রোজারিও, বাংলাদেশ বৌদ্ধিস্ট ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ভ্যান থিরো সুনন্দ প্রিয়, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জিব ধ্রং। এতে ধন্যবাদ প্রস্তাব জ্ঞাপন করেন এলকপের নির্বাহী পরিচালক ব্যারিস্টার তাপস কান্তি বাউল।

সেমিনারের মূল প্রবন্ধে বলা হয়, ১৯৯১ ও ২০০১ সালের নির্বাচনের আগে-পরে যেভাবে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর বর্বর নির্যাতন ও অত্যাচার করা হয়েছে। এ অবস্থায় দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কায় রয়েছেন সংখ্যালঘুরা।

১৯৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধে জন্ম নেয়া বাংলাদেশের মূলভিত্তি ছিল অসাম্প্রদায়িক চেতনা। কিন্তু জিয়া-এরশাদের সেনা শাসনামলে রাজনীতিতে ধর্মীয় প্রভাব বাড়তে থাকে। এর ভুক্তভোগী হয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৯১ নির্বাচনের পর তৎকালীন বিএনপির আমলে বাবরি মসজিদ ভাঙার জের ধরে ১৯৯২ এ ভয়াবহ নির্যাতনের শিকার হয় হিন্দু সম্প্রদায়ার জনগোষ্ঠী।

আরও পড়ুন: জিয়ার কোর্ট মার্শাল থেকে বিএনপির আগুন-সন্ত্রাস, বিচার মিলবে কবে?

জ্বালাও পোড়াও খুন ধর্ষণ নৃশংসতায় বাধ্য হয়ে দেশ ছেড়েছেন অনেকে। ২০০১ এর নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত জোট আবারও ক্ষমতায় আসার পর ১৫০ দিনে সারা দেশে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা-ধর্ষণের মতো ১৮ হাজার অপরাধ সংঘটিত হয়েছে।

পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদে ভিত্তিতে সেমিনারের মূল প্রবন্ধে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়।

সেমিনারে আরও বলা হয়, বর্তমানে সময়ে সবচেয়ে ভালো আছেন সংখ্যালঘুরা। গেল ১৫ বছরে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে নাসিরনগর, রামু, কুমিল্লায় দুর্গাপূজায় হামলা চালানো হয়। ধর্মীয় উসকানি দিতে ভুল তথ্য ছড়িয়ে ব্যবহার করা হয়েছে সামাজিক মাধ্যম। যেগুলোর বিষয়ে দ্রুত ব্যবস্থা নিয়েছে সরকার।

সেমিনারে দেশে সংখ্যালঘুদের সংখ্যা কমার বিষয়েও উদ্বেগ জানানো হয়। বক্তারা বলেন, দেশের মোট জনসংখ্যা বাড়লেও ধারাবাহিকভাবে কমেছে সংখ্যালঘুর সংখ্যা। ১৯৭৪ সালে হিন্দু ১৩ দশমিক ৫ থেকে ২০২২ এ এসে দাঁড়িয়েছে ৭ দশমিক নয় পাঁচ শতাংশে। ২০১১ এর আগের দুই দশকের তুলনায় ১১ থেকে ২২ এই দশবছরে সংখ্যালঘু কমার হার ছিল নিম্নগামী।

সবচেয়ে বেশি কমেছে ১৯৯১ ও ২০০১ সালের নির্বাচন পরবর্তী সরকারের সময়। ১৯৯১, ২০০১ এর নির্বাচনের ভয়াবহতা তুলে ধরে দ্বাদশ নির্বাচন নিয়ে নিরাপত্তার শঙ্কা জানান সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নেতারা।

মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান বলেন,
আইনবহির্ভূত শাসকের শোষণ থেকে সংখ্যালঘুরা বের হয়ে এসে নিজেদের মতামত তুলে ধরতে পেরেছে।





সেমিনারে বলা হয় ১৮৫৮ থেকে ১৯৪৭, ব্রিটিশ শাসনামলে উপমহাদেশে চলে 'ডিভাইড অ্যান্ড রুল' পলিসি। আর সেই কারণেই দেশভাগ পূর্ববর্তী সময়ে ধর্মের নামে দাঙ্গার ঘটনা ঘটতো।

২০০১ সালের নির্বাচনের পর বিএনপির বর্বরতা



২০০১ সালে নির্বাচন পরবর্তী সময়ে বিএনপি ও তার সহযোগী জামায়াত সহিংসতা, ধর্ষণ ও হত্যার মধ্য দিয়ে ভীতির রাজনীতির প্রদর্শনী শুরু করে। এ ধারাবাহিকতায় ২০১৩ সালে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার বানচাল করতে তাণ্ডব চালিয়ে মানুষ হত্যা করে বিএনপির সহযোগী জামায়াত। পরবর্তীতে ২০১৪ সালের নির্বাচনকে বানচাল করতে আগুন-সন্ত্রাসের মাধ্যমে মানুষ হত্যায় মেতে ওঠে তারা।

আরও পড়ুন: হাতে রক্তের দাগ নিয়েও মানবাধিকার প্রোপাগান্ডায় মরিয়া বিএনপি

এ অবস্থায় ফেরা যাক ২২ বছর আগের এক নির্বাচন পরবর্তী সময়ে, চোখে ধরা দেয় ভয়াবহ তাণ্ডবলীলার নারকীয় চিত্র।

পূর্ণিমা রানী। ২০০১ এর জাতীয় নির্বাচনে কাজ করেছিলেন আওয়ামী লীগ প্রার্থীর পোলিং এজেন্ট হিসেবে। সেই দায়ে নির্বাচন পরবর্তী সময়ে তার জীবনে নেমে আসে ঘোর অমানিশার নরক। বিএনপি কর্মীরা তাকে বাড়ি থেকে তুলে দলবদ্ধ ধর্ষণ করে। তবে স্রোতের বিপরীতে লড়াই করে ঘুরে দাঁড়িয়েছিলেন পূর্ণিমা। পড়াশোনা করে শক্তি সঞ্চয় করে দাঁড়িয়েছেন অসহায় মানুষের পাশে।

তবে সবাই কি আর উদাহরণযোগ্য হতে পারেন? পারেন না বলেই বাংলার বাতাসে কান পাতলে এখনও কানে আসে, দুই দশক আগের ভয়াবহ নির্যাতনের বোবাকান্না।

তথ্য বলছে, ২০০১ সালের নির্বাচনের পরে ১৮ হাজারের বেশি সহিংসতার ঘটনা ঘটে। হামলায় জড়িত ২৬ হাজার ৩৫২ জনের মধ্যে বিএনপির অনেক মন্ত্রী এবং সংসদ সদস্য জড়িত ছিলেন।

বিএনপির বিজয়ের পর আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরাতো হামলা নির্যাতনের শিকার হনই, তবে সবচেয়ে বেশি নিপীড়ন-নির্যাতন নেমে আসে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের ওপর। ধর্ষণ, বসতঘরে হামলা, ভাঙচুর, আগুন, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দখল, ধ্বংস করা, দেশত্যাগে বাধ্য করাসহ নানা রকম জুলুম নির্যাতন হয় তাদের ওপর।

বিশেষ করে দেশের দক্ষিণ এবং পশ্চিমাঞ্চলে নির্যাতনের মাত্রা ছিল সবচেয়ে বেশি। ভোলা জেলার শুধু একটি উপজেলা চরফ্যাশনেই ৩০০ হিন্দু পরিবার হামলা নির্যাতনের শিকার হয়। বরিশালের বানারিপাড়া, উজিরপুর এবং পিরোজপুরের স্বরূপকাঠি থেকে কয়েকশ’ হিন্দু পরিবার বসত বাড়ি ছেড়ে গোপালগঞ্জের রামশীলে খোলা আকাশের নিচে আশ্রয় নেয়।

তবে নিজ নির্বাচনী এলাকার মানুষের এমন দুর্দশার পরও উদ্বেগহীন ছিলেন বিএনপির তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আলতাফ হোসেন চৌধুরী। বরং সেই এলাকার ওপর দিয়ে হেলিকপ্টারে উড়ে এসে তিনি গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন, ‘কোনো নির্যাতনের ঘটনা ঘটেনি।’

২০০২ সালেও চলে বিএনপির বর্বরতা



শুধু ২০০১ নয়, পরের বছর ২০০২ সালেও অব্যাহত ছিল বিএনপি-জামায়াত নেতাকর্মীদের ধর্ষণ, নিপীড়ন, নির্যাতন। ২০০১ সালে বিএনপি নেতাকর্মীদের হাতে ধর্ষণের শিকার হন ৫৬৬ জন। ২০০২ সালে এই সংখ্যা ছিল ১ হাজার ৯১।

এসব ঘটনার তদন্তে ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ সরকার সাবেক জেলা জজ মো. শাহাবুদ্দিনকে প্রধান করে তিন সদস্যের কমিশন গঠন করে। এই কমিটি ২০১১ সালের ২৪ এপিল ৫ খণ্ডে ১ হাজার ১০০ পৃষ্ঠার প্রতিবেদন জমা দেয় সরকারের কাছে।

আরও পড়ুন: বিএনপির নির্বাচনী কৌশল: বর্জনে সন্ত্রাস, অংশগ্রহণে ষড়যন্ত্র

কমিশনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতায় ঢাকায় ২৭৬টি, চট্টগ্রামে ৪৯৭টি, সিলেটে ১৭টি, খুলনায় ৪৭৮টি, রাজশাহীতে ১৭০টি এবং বৃহত্তর বরিশালে সবচেয়ে বেশি ২ হাজার ২২৭টি ঘটনার প্রমাণ মেলে।

এরমধ্যে ঢাকায়, ৯২টি হত্যা, ১৮৪টি ধর্ষণ এবং দলবদ্ধ ধর্ষণ, আগুন দেয়া ও অন্যান্য অপরাধ সংঘটিত হয়। চট্টগ্রামে হত্যা করা হয় ৯৭ জনকে। অন্যান্য গুরুতর অপরাধ হয় ৩৫০টি। রাজশাহীতে ৫০টি হত্যাকাণ্ড এবং ১১৭টি গুরুতর অপরাধ হয়। খুলনাতে ৭৩ জনকে হত্যা এবং ৪০৫টি গুরুতর অপরাধ হয়।

তথ্য বলছে, বাংলাদেশের ইতিহাসে নির্বাচনের পরে সবচেয়ে কম সহিংসতা হয়েছে ২০০৮ এর ভোটের পর।

দশম সংসদ নির্বাচনের পরেও আক্রান্ত সংখ্যালঘুরা



বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে পুলিশের জমা দেয়া রিপোর্ট অনুযায়ী, ৫ জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচনের পর বিএনপি-জামায়াত দেশের ২১ জেলায় সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা চালায়। ওই সময় মোট ১৬০টি হামলা ও অত্যাচারের ঘটনার প্রমাণ পাওয়া গেছে।

২০১৪ সালের ১৫ জানুয়ারি হাইকোর্ট বিভাগ একটি সুয়োমোটো রুল জারি করেন, যার মধ্যে বিভিন্ন পুলিশ রেঞ্জের কর্মকর্তারা অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিসের মাধ্যমে প্রতিবেদন জমা দেন। সেখানে দিনাজপুর, ময়মনসিংহ, নেত্রকোণা, শেরপুর, টাঙ্গাইল, কুমিল্লা, চাঁদপুর, বাগেরহাট, যশোর, নড়াইল, রাজশাহী, নওগাঁ, নাটোর, জয়পুরহাট, বরিশাল, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, রংপুর, গাইবান্ধা নীলফামারী ও ঠাকুরগাঁও জেলায় হিন্দুদের ওপর হামলার ঘটনা উঠে আসে।

সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়ে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র



দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে, সরকারকে চাপে রাখতে ষড়যন্ত্রও তত বাড়ছে। কেবল দেশের ভেতরেই না, বিদেশেও ছড়িয়ে পড়েছে সেই ষড়যন্ত্রের জাল। তারই অংশ হিসেবে সম্প্রতি মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে একটি চিঠি লিখেছেন ছয় কংগ্রেসম্যান। এতে বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের প্রতি নিপীড়নসহ বিভিন্ন মানবাধিকার লঙ্ঘনের কথা বলা হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে বিদেশে লবিস্ট নিয়োগ করে অর্থের বিনিময়ে এ চিঠি দেয়া হয়েছে।

চিঠিতে কংগ্রেসম্যানরা বলেছেন, ২০০৯ সাল থেকে বাংলাদেশে বিভিন্ন ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘন ও গণতন্ত্র হরণের ঘটনা ঘটেছে। যদিও তার কোনো প্রমাণ তুলে ধরা হয়নি।

অভিযোগে বলা হয়, বর্তমান সরকারের সময় বাংলাদেশে হিন্দুদের সংখ্যা অর্ধেকে নেমে এসেছে। ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর ধ্বংস, ধর্ষণ, বলপ্রয়োগে ধর্মান্তকরণ ও খ্রিস্টানদের নিপীড়নের কথা বলা হয়েছে।



রাজধানীর একটি হোটেলে ‘দ্য সিচুয়েশন অব মাইনরিটি ইন বাংলাদেশ: ইস্যুজ অ্যান্ড আউটলুক’ শীর্ষক আন্তর্জাতিক সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়।




এ ছাড়াও সরকারবিরোধী বিক্ষোভকারীদের ওপর ব্যাপক ধরপাকড়ের অভিযোগ তোলা হয়েছে।



সংখ্যালঘু ইস্যুতে বিএনপি-জামায়াতের রাজনীতি



জো বাইডেনকে দেয়া ছয় মার্কিন কংগ্রেসম্যানের চিঠিকে বিভ্রান্তিকর বলে উল্লেখ করেছেন বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত।




শেখ হাসিনা সরকারের সময়ে বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের সংখ্যা অর্ধেকে নেমে এসেছে বলে যে অভিযোগ চিঠিতে করা হয়েছে, সে বিষয়ে তিনি বলেন, আমরা যদি পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রতিবেদন দেখি, দেখা যায়, ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে পূর্ববঙ্গে মোট জনসংখ্যার ২৯ দশমিক সাত শতাংশ ছিল সংখ্যালঘু। ১৯৭০ সালের দিকে এসে সেটা নেমে যায় ১৯ থেকে ২০ শতাংশের মধ্যে। অর্থাৎ পাকিস্তানের প্রথম তেইশ বছরে হারিয়ে গেল প্রায় ৯ দশমিক সাত শতাংশ।

আরও পড়ুন: কংগ্রেসম্যানদের চিঠি: অসত্য, বিভ্রান্তিমূলক তথ্য ছড়ানোর অপকৌশল




‘১৯৭০ সালের সংখ্যালঘুরা একচ্ছত্রভাবে ছয় দফার পক্ষে ভোট দিয়েছে। পাকিস্তান সরকার যখন অপারেশন সার্চলাইট শুরু করল, তখন তাদের পাঁচটি নির্দেশনা ছিল। তার মধ্যে একটি হচ্ছে সংখ্যালঘুদের নির্মূল ও নিশ্চিহ্ন করা,’ যোগ করেন রানা দাশগুপ্ত।

মানবতাবিরোধী আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের এই প্রসিকিউটর বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় দেখেছি যে ওই নির্দেশনা অনুযায়ী তৎকালীন পূর্ববঙ্গের সংখ্যালঘু পল্লীগুলোতে নির্বিচারে গণহত্যা, ধর্ষণ, লুটতরাজ ও ধর্মান্তকরণ হয়েছে। এমনকি এক কোটি লোক যে উদ্বাস্তু হলো, তাদের মধ্যে ৯২ লাখের মতো ছিলেন হিন্দু সম্প্রদায়ের লোক। মুক্তিযুদ্ধের পরে তারা এক কাপড়ে দেশে ফিরে আসেন নিজেদের ভিটেমাটিতে।




রানা দাশগুপ্ত বলেন,
শেখ হাসিনা সরকারের সময় যে সংখ্যালঘু জনসংখ্যা অর্ধেকে নেমে এসেছে বলে দাবি করা হয়েছে, তা সঠিক না। গত ৫২ বছর ধরেই সংখ্যালঘুর সংখ্যা কমছে। যদি ছয় কংগ্রেসম্যান জো বাইডেনকে চিঠি দিয়ে শেখ হাসিনা সরকারের সময় অর্ধেক জনসংখ্যা হারিয়ে গেছে বলে দাবি করে, তাহলে তা সত্য না, এটা বিভ্রান্তিকর।






সংখ্যালঘুদের সংখ্যা অর্ধেকে নেমে আসা নিয়ে বাংলাদেশ খ্রিস্টান অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি নির্মল রোজারিও সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘এটি পুরোদস্তুর মিথ্যা কথা। বাস্তবতা হলো, আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সহায়তা আমরা সাম্প্রদায়িক সম্প্রতির সঙ্গে বসবাস করছি।’



সংখ্যালঘুদের নিয়ে বিতর্কিত তথ্য দেয়ার বিষয়টিকে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারকে চাপে রাকার কৌশল হিসেবে দেখছেন সিনিয়র সাংবাদিক নাইমুল ইসলাম খান।

তিনি বলেন,
আমরা ধরেই নিতে পারি, চিঠি দিতে বাংলাদেশের বিরোধীদলের লোকজন লবিস্ট ফার্মের মাধ্যমে কংগ্রেসম্যানদের ওপর প্রভাব বিস্তার করেছেন। তাদের বুঝিয়েছেন, তাদের দিয়ে চিঠি দিয়েছেন। এতে বলা হয়েছে, আমেরিকা যাতে জাতিসংঘের মাধ্যমে বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীকে শান্তিরক্ষী মিশনে না নেয়। এতে বোঝা যায়, মানুষের মধ্যে একটা অস্থিরতা তৈরি করতে, সরকারি দলের ওপর চাপ তৈরি করতে এগুলো করা হচ্ছে।





আরও পড়ুন: জামায়াতের টাকা আসে কোথা থেকে, জানা গেল




তার মতে, কিন্তু এই মুহূর্তে এই চিঠি বিপজ্জনক কিছু না। কারণ এটি একটি চিঠি মাত্র। এ বিষয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্টের অফিস থেকে কোনো প্রতিক্রিয়াও দেয়া হয়নি। এটি এখন পর্যন্ত সাধারণ একটি চিঠি।

আর পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম সাংবাদিকদের বলেন, এমন চিঠি অতীতেও এসেছে, ভবিষ্যতেও বেশি করে আসবে। নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসবে, এ ধরনের তৎপরতা বাড়বে। আমরা এসব কংগ্রেস সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করবো। সবাইকে এ বিষয়ে আমাদের অবস্থান জানাব।




এ ছাড়া সংবাদ সম্মেলনে চিঠির ভাষার সঙ্গে বিএনপির ভাষার মিল আছে বলেও দাবি করেন তিনি।

পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, বেগম খালেদা জিয়া ২০১৫ সালে নির্বাচনের পরাজয়ের পর যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকায় একটি লিখা লিখেছিলেন, সেখানে যে ধরনের ভাষা ব্যবহার করা হয়েছিল, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া এই চিঠির ভাষাও তেমনই।

Comments

Popular posts from this blog

ভাড়াটিয়া-ভাড়াদার আইনের জটিলতা পার হওয়া: ভাড়াটিয়াদের জন্য একটি গাইড

একটি ভিত্তিহীন গুজব উড়িয়ে দেওয়া: বাংলাদেশী সাংবাদিকদের ফ্রেঞ্চ ভিসা প্রত্যাখ্যান করা হয়নি৷

অধ্যায় 2: বাংলায় ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন