Search This Blog

Stories with afzal

"Stories with Afzal" is a platform where Afzal Hosen Mandal shares insights, experiences, and narratives on various topics, including legal advice, personal growth, and community stories. It serves as a space for thought-provoking content, aiming to inform and inspire readers with professional expertise, personal stories, and meaningful discussions.

Followers

STORIES WITH AFZAL

আর্টিকেল গল্পের আকারে অডিও ফাইল।

Subscribe Us

Recents

{getWidget} $results={3} $label={recent} $type={list1}

Updates

{getWidget} $results={4} $label={recent} $type={list2}

Main Tags

JSON Variables

Comments

{getWidget} $results={3} $label={comments} $type={list1}

আমার ছেলেবেলা প্রথম পর্ব





আমার ছেলেবেলা

 প্রথম পর্ব
উৎসর্গ
বড়মামা শেখ ফজলুল করিম যিনি এই পৃথিবীতে খুব অল্প আয়ু নিয়ে এসেছিলেন সেই অল্প আয়ুর সবটাই খরচ করে গেলেন আমাদের পেছনে।


তৃতীয় মুদ্রণের ভূমিকা
সিলেটের প্রখ্যাত কণ্ঠশিল্পী জনাব লিয়াকত হোসেন সাহেব আমার ছেলেবেলায় উল্লিখিত শুক্লাদি এবং মাথামোটা শংকর সম্পর্কে কিছু তথ্য দিয়েছেন। আমি তার চিঠি থেকে সেই অংশ হুবহু তুলে দিলাম।

শুক্লাদি : মীরা বাজারের এস. কে. রায় চৌধুরী-এর বড় কন্যা শুক্লা রায় চৌধুরী ভারতে অধ্যয়নকালে অকাল মৃত্যুবরণ করেন। তিনি এম. সি, কলেজের রসায়ন বিভাগ-এর বিভাগীয় প্রধানের মেয়ে ছিলেন। তিনি ১৯৫৪-তে সিলেট গভর্নমেন্ট গার্লস স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন। তার বড় ভাই সাধন ১৯৬১-তে পাটনায় অকাল মৃত্যুবরণ করেন এবং অধ্যাপক রায় চৌধুরী ১৯৭১-এর কিছুদিন আগে আসামের করিমগঞ্জে মৃত্যুমুখে পতিত হন। ওঁদের পরিবারের সঙ্গে আমার জানাশোনা ছিল। বর্তমানে রত্না, শংকর ও মানস ভারতে চাকুরি করছে। ঐ বাড়ি লতিফ চৌধুরী নামে একজন ব্যবসায়ী কিনেছেন। তিনিও আমার খুব পরিচিত। আপনার দেওয়া বাড়ির বর্ণনা ঠিক আছে—হিন্দুবনেদী বাড়ি গাছপালা বেষ্টিত থাকতো। মাথামোটা শংকরঃ আপনার ক্লাসমেট শংকর তার ছাত্রজীবন ইতি দিয়ে মাদ্রাসা মাঠে মোটা মাথা নিয়ে বাদাম বিক্রি করতো। জানি না এখন কোথায় আছে। মীরা বাজারের কারো সঙ্গে দেখা হলে তার খবর জানতে পারবো। নতুন খবর জানলে আপনাকে জানাবার ইচ্ছা রাখি।
হুমায়ূন আহমেদ
শহীদুল্লাহ হল
৫. ১০. ৯১


ভূমিকা
এক দুপরে ভাত খেতে বসেছি। আমার মেজো মেয়ে কী-একটা দুষ্টুমি করায় মার কাছে বকা খেয়েছে। মুখ অন্ধকার করে ভাতের থালা সামনে নিয়ে বসে আছে। অনেক সাধাসাধি করেও তাকে খাওয়ানো যাচ্ছে না। শেষ পর্যন্ত আমি বললাম, মা, তোমাকে আমি আমার ছেলেবেলার একটা গল্প বলব। গল্প শুনে তুমি যদি হেসে ফেলো তা হলে কিন্তু ভাত খেতে হবে।


আমি গল্প শুরু করলাম। সে প্রাণপণ চেষ্টা করতে লাগল না হাসার। শেষ পর্যন্ত খিলখিল করে হেসে ফেলে বলল, তুমি যদি তোমার ছেলেবেলার আরেকটা গল্প বল তা হলে ভাত খাব।
আমি যে একসময় তাদের মতো ছোট ছিলাম এবং খুব দুষ্ট ছিলাম এই বিস্ময়ই তাদের জন্যে যথেষ্ট। তার সঙ্গে যুক্ত হল মজার মজার ঘটনা। ওদের সঙ্গে গল্প করতে করতে মনে হল ছেলেবেলাটা লিখে ফেললে কেমন হয়। বিশ-পঁচিশ পৃষ্ঠা লিখেও ফেললাম। আমার বড় মেয়ে খুব উৎসাহ নিয়ে সেই পাণ্ডুলিপি আমার মাকে পড়াল। মার মুখ গম্ভীর হয়ে গেল। তিনি শীতল গলায় আমাকে বললেন, এইসব কী লিখেছিস? নিজের আত্মীয়-স্বজনদের নিয়ে রসিকতা?
আমার ছোট বোনও পাণ্ডুলিপি পড়ল। সে কাঁদো-কাঁদো গলায় বলল, আমাকে নিয়ে মাকড়সা প্রসঙ্গে যে গল্পটা লিখেছ ঐটা কেটে দাও। লোকে কী ভাববে? পাণ্ডুলিপির খবর ছড়িয়ে পড়ল। আমার ছোটমামা খুলনা থেকে চলে এলেন পড়ার জন্যে। তিনি পড়লেন এবং কোনো কথা না বলে খুলনা চলে গেলেন। বুঝলাম তারও পছন্দ হয়নি। তবু একসময় শেষ করলাম এবং কোথাও কোনো ভুলটুল আছে কি না তা যাচাই করবার জন্য নিজেই নানিজানকে পড়ে শোনালাম।
নানিজান বললেন, অনেক ভুলভ্রান্তি আছে। এই ধর, তুই লিখলি তোর মা পাগল হয়ে গিয়েছিল। পাগল হবে কীজন্যে? মানুষ চিনত না। উলটাপালটা কথা বলত-এর বেশি তো কিছু না। এটাকে পাগল বলে?
আমি দীর্ঘনিশ্বাস ফেললাম। আমার মেজো মেয়ে বলল, তুমি মন-খারাপ করছ কেন? লেখাটা তো মোটামুটি ভালোই হয়েছে। তবে তুমি একটা জিনিস লিখতে ভুলে গেছ।
কোন জিনিস মা? ছেলেবেলায় দুধ আর ডিম খেতে তোমার কেমন খারাপ লাগত তা তো লেখনি। দুধ ডিম তো মা তোমরা খাচ্ছ। আমরা খেতে পারিনি। এত পয়সা আমার বাবা-মার ছিল।
মেজো মেয়ে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলল, আহা কী সুখের ছিল তোমাদের ছেলেবেলা! হ্যাঁ, সুখেরই ছিল।
সেই সুখের খানিকটা ভাগ আজকের পাঠক-পাঠিকাদের দেয়ার জন্যেই এই লেখা। ছেলেবেলা লেখার সময় শৈশবে ফিরে গিয়েছিলাম। যতক্ষণ লিখেছি গভীর আনন্দে হৃদয় আচ্ছন হয়ে ছিল। পেছনে ফিরে তাকানো যে এত আনন্দময় হবে কে জানত?
হুমায়ূন আহমেদ




০১. শোনা কথা

 মানুষ অসম্ভব স্মৃতিধর।


 নব্বই বছরের একজন মানুষও তার ছেলেবেলার কথা মনে করতে পারে। মস্তিষ্কের অযত নিযুত নিওরোনে বিচিত্র প্রক্রিয়ায় স্মৃতি জমা হয়ে থাকে। কিছুই নষ্ট হয় না। প্রকৃতি নষ্ট হতে দেয় না। অথচ আশ্চর্য, অতি শৈশবের কোনো কথা আর মনে থাকে না। দুবছর বা তিন বছর বয়সের কিছুই সে মনে করতে পারে না। মাতৃগর্ভের কোনো স্মৃতি থাকে না, জন্মমুহূর্তের কোনো স্মৃতিও না। জন্মসময়ের স্মৃতিটি তার থাকা উচিত ছিল। এত বড় একটা ঘটনা অথচ এই ঘটনার স্মৃতি প্রকৃতি মুছে ফেলে। মনে হয় প্রকৃতির কোনো বিশেষ উদ্দেশ্য এতে কাজ করে। প্রকৃতি হয়তো চায় না পৃথিবীর সঙ্গে প্রথম পরিচয়ের কথা আমরা মনে করে রাখি।
 আমি যখন মন ঠিক করে ফেললাম ছেলেবেলার কথা লিখব, তখন খুব চেষ্টা করলাম জন্মমুহূর্তের স্মৃতির কথা মনে করতে এবং তারও পেছনে যেতে, যেমন মাতৃগর্ভ। কেমন ছিল মাতৃগর্ভের সেই অন্ধকার? আমার খুব জানতে ইচ্ছে করল। এল এস ডি (Lysergic acid dietlyamide) নামের একধরনের ডাগ নাকি মাতৃগর্ভ এবং জন্মমুহূর্তের স্মৃতি মনে করিয়ে দেয়। আমেরিকা থাকাকালীন এই ড্রাগের খানিকটা জোগাড় করেছিলাম। সাহসের অভাবে খেতে পারিনি। কারণ এই হেলুসিনেটিং ড্রাগ প্রায়ই মানুষের মানসিক অবস্থায় বড় রকমের ঢেউ তোলে।
 আসল ব্যাপার হচ্ছে, খুব পুরানো কথা আমার কিছুই মনে নেই। তবে জন্মের চার বছরের পর থেকে অনেক কিছুই আমি মনে করতে পারি। সেইসব কথাই লিখব। শুরুটা করছি শোনা কথার উপর নির্ভর করে। শোনা কথার উপর নির্ভর করাও বেশ কঠিন। একই গল্প একেক জন দেখি একেক রকম করে বলেন। যেমন একজন বললেন, তোমার জন্মের সময় খুব ঝড়বৃষ্টি হচ্ছিল। অন্য একজন বললেন, কই না তো, প্রচণ্ড ঠাণ্ডা ছিল এইটা খেয়াল আছে, ঝড়বৃষ্টি তো ছিল না!
 আমি সবার কথা শুনে শুনে একটি ছবি দাঁড় করিয়েছি। এই ছবি খানিকটা এদিক-ওদিক হতে পারে, তাতে কিছু যায় আসে না। আমি এমন কেউ না যে
 আমার জন্মমুহূর্তের প্রতিটি ঘটনা হুবহু লিখতে হবে। কোনো ভুলচুক করা যাবে না। থাকুক কিছু ভুল। আমাদের জীবনের একটা বড় অংশ জুড়েই তো আছে ভুল এবং ভ্রান্তি।
 আমার জন্ম ১৩ই নভেম্বর। ১৯৪৮ সন। শনিবার, রাত ১০টা তিরিশ মিনিট। শুনেছি ১৩ সংখ্যাটাই অশুভ। এই অশুভের সঙ্গে যুক্ত হল শনিবার। শনি মঙ্গলবারও নাকি অশুভ। রাতটাও কৃষ্ণপক্ষের। জন্মমুহূর্তে দপ করে হারিকেন নিভে গেল। ঘরে রাখা গামলার পানি উলটে গেল। একজন ডাক্তার, যিনি গত তিনদিন ধরে মার সঙ্গে আছেন, তিনি টর্চলাইট জ্বেলে তার আলো ফেললেন আমার মুখে। ক্ষিপ্ত গলায় বললেন, এই জানোয়ারটা দেখি তার মাকে মেরেই ফেলছিল!
 আমি তখন গভীর বিস্ময়ে টর্চলাইটের ধাঁধানো আলোর দিকে তাকিয়ে আছি। চোখ বড় বড় করে দেখছি-এসব কী? অন্ধকার থেকে এ আমি কোথায় এলাম?
 জন্মের পরপর কাঁদতে হয়। তাই নিয়ম।
 চারপাশের রহস্যময় জগৎ দেখে কাঁদতেও ভুলে গেছি। ডাক্তার সাহেব আমাকে কাঁদাবার জন্য ঠাশ করে গালে চড় বসালেন। আমি জন্মমুহূর্তেই মানুষের হৃদয়হীনতার পরিচয় পেয়ে আকাশ ফাটিয়ে কাঁদতে লাগলাম। ঘরে উপস্থিত আমার নানিজান আনন্দিত স্বরে বললেন, বামুন রাশির ছেলে। বামুন রাশি বলার অর্থ প্রেসেন্টার সঙ্গে যুক্ত রক্তবাহী শিরাটি বামুনের পৈতার মতো আমার গলা পেঁচিয়ে আছে।
 শিশুর কান্নার শব্দ আমার নানাজানের কানে যাওয়ামাত্র তিনি ছুটে এসে বললেন, ছেলে না মেয়ে?
 ডাক্তার সাহেব রহস্য করবার জন্যে বললেন, মেয়ে, মেয়ে। ফুটফুটে মেয়ে।
 নানাজান তৎক্ষণাৎ আধমণ মিষ্টি কিনতে লোক পাঠালেন। যখন জানলেন মেয়ে নয় ছেলে-তখন আবার লোক পাঠালেন-আধমণ নয়, এবার মিষ্টি আসবে একমণ। এই সমাজে পুরুষ এবং নারীর অবস্থান যে ভিন্ন তাও জন্মলগ্নেই জেনে গেলাম।
 নভেম্বর মাসের দুর্দান্ত শীত।
 গারো পাহাড় থেকে উড়ে আসছে অসম্ভব শীতল হাওয়া। মাটির মালশায় আগুন করে নানিজান সেক দিয়ে আমাকে গরম করার চেষ্টা করছেন।
 আশেপাশের বৌ-ঝিরা একের পর এক আসছে এবং আমাকে দেখে মুগ্ধ গলায়
 বলছে-সোনার পুতলা।
 এতক্ষণ যা লিখলাম সবই শোনা কথা। মার কাছ থেকে শোনা। কিন্তু আমার কাছে খুব বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হয় না। কারণ আমি ঘোর কষ্ণবর্ণের মানুষ। আমাকে দেখে সোনার পুতলা বলে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করার কিছু নেই। তা সদ জনামহুর্তের এতসব কথা আমার মারও মনে থাকার কথা নয়। তার তখন জীবন সংশয়। প্রসববেদনায় পুরো তিনদিন কাটা মুরগির মতো ছটফট করেছেন। অতিরিক্ত রকমের রক্তক্ষরণ হচ্ছে। পাড়াগার মতো জায়গায় তাকে বত দেবার কোনো ব্যবস্থা নেই। এই অবস্থাতেও তিনি লক্ষ্য করছেন, তার সোনার পাতলা গভীর বিস্ময়ে চারপাশের পৃথিবীকে দেখছে, কাঁদতে ভুলে গেছে, এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। আমার ধারণা, মা যা বলেছেন তা অন্যদের কাছ থেকে শুনেই বলেছেন।
 ধরে নিচ্ছি, মা যা বলেছেন সবই সত্যি। ধরে নিচ্ছি, একসময় আমার গাত্রবর্ণ কাঁচা সোনার মতো ছিল। ধরে নিচ্ছি, আমার জন্মের আনন্দপ্রকাশের জন্য সেই রাতে একমণ মিষ্টি কিনে বিতরণ করা হয়েছিল। মিষ্টি কেনার অংশটি বিশ্বাসযোগ্য। নানাজানের অর্থবিত্ত তেমন ছিল না, কিন্তু তিনি দিলদরিয়া ধরনের মানুষ ছিলেন। আমার মা ছিলেন তাঁর সবচে আদরের প্রথমা কন্যা, বিয়ে হয়ে যাবার পরও যে-কন্যার মাথার চুল তিনি নিজে পরম যত্নে আঁচড়ে দিতেন। এই অতি আদরের কন্যার বিয়ের সময়ও তিনি জমিটমি বিক্রি করে খরচের চুড়ান্ত করলেন। পিতৃহৃদয়ের মমতা প্রকাশ করলেন দুহাত খুলে টাকা খরচের মাধ্যমে।
 উদাহরণ দিই—মোহনগঞ্জ স্টেশন থেকে বর আসবে, হাঁটাপথে পাঁচ মিনিটের রাস্তা। পালকির ব্যবস্থা করলেই হয়। আমার নানাজান হাতির ব্যবস্থা করলেন। সুসং দুর্গাপুর থেকে দুটি হাতি আনানো হল। যে-লোেক এই কাজ করতে পারেন, তিনি তার প্রিয় কন্যার প্রথম সন্তানজন্মের খবরে বাজারের সমস্ত মিষ্টি কিনে ফেলতে পারেন।
 আমার বাবা তখন সিলেটে। বিশ্বনাথ থানার ওসি।
 ছেলে হবার খবর তাঁর কাছে পৌঁছল। তাঁর মুখ অন্ধকার হয়ে গেল। বেচারার খুব শখ ছিল প্রথম সন্তানটি হবে মেয়ে। তিনি মেয়ের নাম ঠিক করে বসে আছেন। একগাদা মেয়েদের ফ্রক বানিয়েছেন। রূপার মল বানিয়েছেন। তার মেয়ে মল পায়ে দিয়ে ঝমঝম করে হাঁটবে—তিনি মুগ্ধ হয়ে দেখবেন। ছেলে। হওয়ায় সব পরিকল্পনা মাঠে মারা গেল। তিনি একগাদা ফ্রক ও রূপার মল নিয়ে ছেলেকে দেখতে গেলেন। পাঠক-পাঠিকাদের জ্ঞাতার্থে জানাচ্ছি, এইসব মেয়েলি পোশাক আমাকে দীর্ঘদিন পরতে হয়। বাবাকে সন্তুষ্ট করার জন্যে মা আr, মাথার চুলও লম্বা রেখে দেন। সেই বেণিকরা চুলে রংবেরঙের রিবন পতে আমার শৈশবের শুরু।
 বাবা-মার প্রথম সন্তান হচ্ছে চমৎকার একটি জীবন্ত খেলনা। এই খেলনার সবই ভালো। খেলনা যখন হাসে, বাবা-মা হাসেন। খেলনা যখন কাঁদে, বাবা, মার মুখ অন্ধকার হয়ে যায়। আমার বাবা-মার ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হল না। তারা তাদের শিশুপুত্রের ভেতর নানান প্রতিভার লক্ষণ দেখে বারবার চমৎকৃত হলেন। হয়তো আমাকে চাবি-দেয়া একটা ঘোড়া কিনে দেয়া হল, আমি সঙ্গে সঙ্গে ঘোড়া ভেঙে ফেললাম। আমার বাবা পুত্রপ্রতিভায় মুগ্ধ। হাসিমুখে বললেন, দ্যাখো দ্যাখো, ছেলের কী কৌতূহল! সে ভেতরের কলকবজা দেখতে চায়।
 হয়তো আমাকে খাওয়ানোর জন্য মা থালায় করে খাবার নিয়ে গেলেন, আমি সেই থালা উড়িয়ে ফেলে দিলাম। বাবা আমার প্রতিভায় মুগ্ধ-দ্যাখো দ্যাখো, ছেলের রাগ দ্যাখো। রাগ থাকা ভালো। এই যে থালা সে উড়িয়ে ফেলে দিল এতে প্রমাণিত হল তার পছন্দ-অপছন্দ দুটিই খুব তীব্র।
 এই সময় বই ছিড়ে ফেলার দিকেও আমার ঝোঁক দেখা গেল। হাতের কাছে বই পাওয়ামাত্র টেনে ছিড়ে ফেলি। এর মধ্যেও বাবা আমার প্রতিভার লক্ষণ দেখতে পেলেন। তিনি মাকে বোঝালেন-এই যে সে বই ছিড়ছে, তার কারণ বইয়ের লেখা সে পড়তে পারছে না, বুঝতে পারছে না। যে-জিনিস সে বুঝতে পারছে না সেই জিনিস সে নষ্ট করে দিচ্ছে। এটি প্রতিভার লক্ষণ।
 আদরে বাঁদর হয়।
 আমি পুরোপুরি বাঁদর হয়ে গেলাম। এবং আমার প্রতিটি বাঁদরামিতে প্রতিভার লক্ষণ দেখে আমার বাবা-মা বারবার চমৎকৃত হতে লাগলেন। বাবা মার সঙ্গে যুক্ত হলেন বাবার এক বন্ধু গনি সাহেব এবং তার স্ত্রী। এই নিঃসন্তান দম্পতি তাঁদের বুভুক্ষু হৃদয়ের সবটুকু ভালোবাসা আমার জন্যে ঢেলে দিলেন। তাদের ভালোবাসার একটা ছোট্ট নমুনা দিচ্ছি। একদিন বেড়াতে এসে দেখেন। আমি চামচে করে চিনি খাচ্ছি। গনি চাচা বললেন, আরে এ তো আগ্রহ করে চিনি খাচ্ছে। চিনি খেতে পছন্দ করে তা তো জানতাম না! তিনি তৎক্ষণাৎ বের হয়ে গেলেন। ফিরে এলেন পাঁচ সের চিনি নিয়ে। মেঝেতে পাটি পেতে আমাকে বসিয়ে দিলেন। আমার চারদিকে চিনি ছড়িয়ে দেয়া হল। গনি চাচা হষ্টচিত্তে বললেন, খা ব্যাটা, কত চিনি খাবি খা।
 আমাকে ঘিরে বাবা-মার আনন্দ স্থায়ী হল না। আমার মা অসুস্থ হয়ে পড়লেন। কালান্তক জ্বর। টাইফয়েড। তখন টাইফয়েডের অষুধ বাজারে আসেনি। রুগীকে ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দিয়ে চুপচাপ বসে থাকা ছাড়া কিছুই করণীয় নেই। যতই দিন যেতে লাগল মার শরীর ততই কাহিল হতে থাকল। এক সময় দেখা গেল তিনি কাউকে চিনতে পারলে না। এক গভীর রাতে বাবাকে ঘুম ভাংগিয়ে অত্যন্ত অবাক গলায় জিজ্ঞেস করলেন, আমার পাশে এই যে ছোট্ট ছেলেটা শুয়ে আছে এ কে?
 বাবা হতভম্ব হয়ে গেলেন। মা বললেন, এই ছেলেটা এখানে কেন? এ কার ছেলে?
 আমাকে পাঠিয়ে দেয়া হল নানাজানের কাছে। সিলেটের বিশ্বনাথ থেকে ময়মনসিংহের মোহনগঞ্জে। পিতৃমাতৃ স্নেহ থেকে পুরোপুরি বঞ্চিত হয়ে আমার দ্বিতীয় জীবন শুরু হল। আমার নানিজান আমাকে লালনপালনের ভার গ্রহণ করলেন। তখন তাঁর একটি মেয়ে হয়েছে। তার এক কোলে সেই মেয়ে, অন্য কোলে আমি। নানিজানের বুকের দুধ খেয়ে দুজন একসঙ্গে বড় হচ্ছি।
 দুমাস জ্বরে ভোগার পর মা সেরে উঠলেন কিন্তু টাইফয়েড তার প্রবল থাবা বসিয়ে গেল। মার মস্তিষ্কবিকৃতি দেখা গেল। কাউকে চেনেন না। যার সঙ্গে দেখা হয় তাকেই বলেন, কত টাকা লাগবে তোমার বলো তো! আমার কাছে অনেক টাকা আছে। যত টাকা চাইবে ততই পাবে। ফেরত দিতে হবে না।
 বলেই তোশকের নিচ থেকে লক্ষ লক্ষ কাল্পনিক টাকা বের করতে শুরু করেন। মাঝে মাঝে এইসব কাল্পনিক টাকা জানালা দিয়ে উড়িয়ে দেন। চিকন স্বরে চেঁচিয়ে বলেন, টাকা নিয়ে যাও। টাকা। আমি টাকা উড়াচ্ছি। যার যত দরকার, নাও। ফেরত দিতে হবে না।
 মা বিয়ের পর খুব কষ্টে পড়েছিলেন। টাকাপয়সার কষ্ট। বিশ্বনাথ থানার ওসি হিসেবে বাবার বেতন ছিল আশি টাকা। বেতনের এই আশিটি টাকা বাবা তার খামখেয়ালি স্বভাবের জন্য অতি দ্রুত বরচ করে ফেলতেন। মাসের দশ তারিখেই বাবার হাতে একটা পয়সা নেই। থানার ওসিদের টাকাপয়সার অভাব হবার কথা না। কিন্তু আজ লিখতে গিয়ে গর্ব এবং অহংকারে বুক ভরে যাচ্ছে যে আমার বাবা ছিলেন সাধু প্রকৃতির মানুষ। বেতনের টাকাই ছিল তার একমাত্র রোজগার। মার কাছে শুনেছি, পুলিশের রেশনই তাদের বাঁচিয়ে রাখত। মাসের প্রথমেই রেশন তোলা হত। রেশনে চাল, ডাল এবং তেল পাওয়া যেত। সারা মাসে তাদের খাবারের মেনু ছিল ডাল, ডালের বড়া এবং নিমপাতা ভাজা। বাসার সঙ্গে লাগোয়া একটা নিমগাছ ছিল। সেই নিমের কচি পাতা ভাজা করা হত। মাকে শাড়ি কিনে দেবার সামর্থ্য বাবার ছিল না। মার শাড়ি পাঠাতেন নানাজান। সতেরো বছরের একটি মেয়ে, যে মোটামুটি সচ্ছলতায় মানুষ হয়েছে তার জন্য এই অর্থকষ্ট বড়ই ভয়াবহ ছিল। অর্থনৈতিক পীড়ন তার উপর যে প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করেছিল মানসিক বিকৃতির সময় তা-ই ফুটে বের হল। যার সঙ্গেই দেখা হয় তাকেই মা এক লাখ বা দুলাখ টাকা দিয়ে দেন।
 দুবছর এমন করেই কাটল। আমি নানিজানের কাছে। মা বাবার সঙ্গে সিলেটে। পুরোপুরি পাগল একজন মানুষ।
 এক শ্রাবণ মাসের রাতে মার ঘুম ভেঙে গেল। বাইরে ঝুম বৃষ্টি। হাওয়ায় বাড়ি যেন উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। বাড়ির পেছনের-ঝাকড়া জামগাছে শোশে শব্দ হচ্ছে। মা বাবাকে ডেকে তুলে ভয়ার্ত স্বরে বললেন, বাতি জ্বালাও, ভয় লাগছে।
 বাবা চমকে উঠলেন। দিব্যি সুস্থ মানুষের মতো কথাবার্তা।
 হারিকেন জ্বালানো হল। মা তীব্র স্বরে বললেন, আমার ছেলে কোথায়?
 বাবা তাকিয়ে রইলেন। তাঁর মন আশা-নিরাশায় দুলছে। তা হলে কি মাথা ঠিক হয়ে গেল?
 কথা বলছ না কেন? আমার ছেলে কোথায়?
 আয়েশা, তোমার কি সবকিছু মনে পড়ছে।
 আমার ছেলে কোথায়?
 ও আছে। ও ভালো আছে, তোমার মার কাছে আছে। তুমি দীর্ঘদিন অসুস্থ হয়ে ছিলে। তাকে পাঠিয়ে দেয়া ছাড়া উপায় ছিল না। তুমি শান্ত হও, কাল ভোরেই তোমাকে নিয়ে আমি মোহনগঞ্জ রওনা হব।
 আমি অসুস্থ ছিলাম?
 হ্যাঁ।
 মা উঠে গিয়ে একটা আয়না আনলেন। আয়নায় নিজেকে দেখে চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়তে লাগল। মাথাভরতি চুল ছিল। কোনো চুল নেই। দাঁতের রং কুচকুচে কালো। আয়নায় যার ছায়া পড়েছে সে উনিশ বছরের তরুণী নয়, যেন ষাট বছর বয়সের এক বৃদ্ধা।
 আয়েশা, তোমার কি সব মনে পড়ছে।
 হ্যাঁ।
 বলো তো কত তারিখে আমাদের বিয়ে হয়েছিল?
 আষাঢ় মাসে। পয়লা আষাঢ়।
 আনন্দে বাবার চোখ ভিজে উঠল।
 বাইরে ঝড়বৃষ্টির মাতামাতি। ঘরে নিবুনিবু হারিকেনের রহস্যময় আলো।
 সেই আলোয় মূর্তির মতো বসে আছেন পুত্রবিরহকাতর এক মা, যিনি ততক্ষণ আগে তার হারানো স্মৃতি ফিরে পেয়েছেন।
 মাকে নিয়ে মোহনগঞ্জ উপস্থিত হলেন। আমাকে মার কোলে বসিয়ে দেয়া হল। মা বিস্মিত হয়ে বললেন, এই কি আমার ছেলে?
 নানিজান বললেন, হ্যাঁ।
 ছেলে এত বড় কেন?
 ছেলের বয়স দুই বছর, বড় হবে না?
 কথা বলতে পারে?
 পারে, সব কথা বলতে পারে।
 মা নানিজানের দিকে তাকিয়ে কঠিন স্বরে বললেন, আমার ছেলের কোনো অনাদর হয়নি তো?
 নানিজান হেসে ফেললেন।
 আমার ছেলের সোনার মতো গায়ের রং ছিল। ও এত কালো হল কেন?
 সারাদিন রোদে রোদে ঘোরে।
 কেন, আপনারা দেখেন না? কেন আমার ছেলে সারাদিন রোদে রোদে ঘোরে।
 মা যতই রাগ করেন সবাই তত হাসে।
 বাড়িভরতি মানুষ। মাতা-পুত্রের মিলনদৃশ্য দেখতে পাড়া ভেঙে বৌ-ঝিরা এসেছে। আমার নানাজান আবার একমণ মিষ্টি কিনতে লোক পাঠিয়েছেন।
 আসরের মধ্যমণি হয়ে আমার মা একটা জলচৌকিতে আমাকে কোলে নিয়ে বসে আছেন। এই তার মুখে তৃপ্তি, এই তার চোখে জল। মেঘ ও রৌদ্রের খেলা চলছে। পৃথিবীর মধুরতম একটি দৃশ্য সবাই দেখছে মুখ হয়ে। এর মধ্যে মা সবাইকে সচকিত করে একটি ক্ষুদ্র প্রার্থনা করলেন। তিনি উচ্চস্বরে বললেন, আমার এই ছেলের শৈশব বড় কষ্টে কেটেছে, আল্লাহ, তার বাকি জীবনটা তুমি সুখে সুখে ভরে দিও। বাকি জীবনে সে যেন কোনো দুঃখ না পায়।
 ঈশ্বর মার এই প্রার্থনা গ্রহণ করেননি। এই ক্ষুদ্র জীবনে আমি বারবার দুঃখ পেয়েছি। বারবার হৃদয় হা-হা করে উঠেছে। চারপাশের মানুষদের নিষ্ঠুরতা, হৃদয়হীনতায় আহত হয়ে কতবার মনে হয়েছে—এই পৃথিবী বড়ই বিষাদময়! আমি এই পৃথিবী ছেড়ে অন্য কোনো পৃথিবীতে যেতে চাই, যে-পৃথিবীতে মানুষ নেই। চারপাশে পত্ৰপুষ্পশোভিত বৃক্ষরাজি। আকাশে চিরপূর্ণিমার চাঁদ, যে-চাদের ছায়া পড়েছে ময়ূরাক্ষী নামের এক নদীতে। সেই নদীর স্বচ্ছ জলে সারাক্ষণ খেলা করে জোছনার ফুল। দূরের বন থেকে ভেসে আসে অপার্থিব সংগীত।
 মা আমাকে নিয়ে সিলেটে চলে এলেন। কিছুদিন তার নিশ্চয়ই খুব সুখে কাটল। কোনো সুখই স্থায়ী হয় না। এই সুখও স্থায়ী হল না, আবার টাইফয়েড হল। টাইফয়েডের বীজ হয়তো লুকিয়ে ছিল। প্রাণসংহারক মূর্তিতে সে আবার আত্মপ্রকাশ করল। বাবা দিশাহারা হয়ে পড়লেন। মা সারাদিন প্রবল জুরের ঘোরে আচ্ছন্ন হয়ে থাকেন। মাঝে মাঝে জ্ঞান ফিরে এলে ব্যাকুল হয়ে তার শিশুপুত্রকে খোঁজেন। সেই শিশুকে তার কাছে যেতে দেয়া হয় না। মা কাকুতি মিনতি করেন, ওকে একটু দেখতে দাও। একবার শুধু দেখব।
 কাজের মেয়ে আমাকে নিয়ে দরজার পাশে এসে দাঁড়ায়। মা মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকেন। গভীর বিষাদ এবং গভীর আনন্দে তার চোখে জল আসে।
 এর মধ্যেই একদিন ডাক্তার সাহেব বাবাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে বললেন, আপনার স্ত্রী বাঁচবেন না। আপনি মানসিকভাবে এর জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করুন।
 বাবা বললেন, কোনো আশাই কি নেই?
 না। টাইফয়েড দ্বিতীয়বার হলে আর রক্ষা নেই, তবে …
 তবে কী?
 টাইফয়েডের নতুন একটা অষুধ বাজারে এসেছে। শুনেছি অষুধটা কাজ করে। ইন্ডিয়াতে হয়তোবা পাওয়া যায়। আপনি চেষ্টা করে দেখতে পারেন।
 আসামের শিলচরে বাবা লোক পাঠালেন। অষুধ পাওয়া গেল না। বাবা স্ত্রীর মৃত্যুর জন্যে মানসিক প্রস্তুতি গ্রহণ করলেন। সেই প্রস্তুতির প্রমাণ হচ্ছে আমার নামকরণ। আমার নাম রাখলেন কাজল। বিভূতিভূষণের পথের পাঁচালীর অপুর স্ত্রীর মৃত্যু হয়েছিল। অপুর ছেলের নাম ছিল কাজল। আমার ভালো নাম রাখা হল শামসুর রহমান। বাবার নাম ফয়জুর রহমান। বাবার নামের সঙ্গে মিলিয়ে ছেলের নাম। ছয় বছর বয়স পর্যন্ত আমাকে শামসুর রহমান নাম নিয়ে চলাফেরা করতে হল। সপ্তম বছরে বাবা হঠাৎ সেই নাম বদলে রাখলেন হুমায়ূন আহমেদ। বছর দুই হুমায়ূন আহমেদ নামে চলার পর আবার আমার নাম বদলে দেবার ব্যবস্থা হল। আমি কঠিন আপত্তি জানালাম। বারবার নাম বদলানো চলবে না। আমাদের সব ভাইবোনই প্রথম ছসাত বছর এক নাম, তারপর অন্য নাম। আমার বাবার মৃত্যুর পর তাঁর পেনশন এবং গ্যাচুইটির টাকাপয়সা তুলতে গিয়ে বিরাট যন্ত্রণায় পড়লাম। দেখা গেল, তিনি তার টাকাপয়সা তাঁর স্ত্রী এবং তিন ছেলেমেয়েকে দিয়ে গেছেন। কিন্তু তিন ছেলেমেয়ের যে নাম লিখে রেখে গেছেন, এখন কারওরই সেই নাম নেই। বাবা তার ছেলেমেয়ের নাম বদলেছেন। কিন্তু কাগজপত্র ঠিকঠাক করতে ভুলে গেছেন।
 আমি এখন আমার বিচিত্র বাবা সম্পর্কে বলব। মৃত্যুপথযাত্রী মার প্রসঙ্গটা আপাতত থাক। শুধু এইটুকু বলে রাখি, তিনি দ্বিতীয়বার টাইফয়েডের ধাক্কাও সামলে ওঠেন জনৈক হিন্দু সাধুবাবার দেয়া তাৰ্পিন তেল খেয়ে। নিতান্তই অবিশ্বাস্য ব্যাপার। তাৰ্পিন টাইফয়েডের অষুধ নয়। নিশ্চয়ই অন্য কোনো ব্যাপার আছে। আমি যা শুনেছি তা-ই লিখলাম। সাধুবাবার ফুঁ-দেয়া তার্পিন খেয়ে মৃত্যুর মুখ থেকে কেউ ফিরে আসবে এই তথ্য হজম করা আমার পক্ষে বেশ কঠিন। যেহেতু মা দাবি করছেন, সেহেতু লিখছি।
 এবার বাবার কথা বলি।
http://afzaltipu.blogspot.com/?m=1
x

Post a Comment

0 Comments